আল হাসানাইন (আ.)

আত্নশুদ্ধির প্রচেষ্টা-১ম পর্ব

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

আজকে তোমরা যারা ধর্মীয়-পড়াশুনা করছো, যারা আগামী দিনে সমাজের নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব নেবে – ভেবোনা যে কেবলমাত্র কিছু ধর্মীয় পরিভাষা শেখা-ই তোমাদের দায়িত্ব; এগুলি ছাড়াও তোমাদের অন্যান্য দায়িত্বও রয়েছে। এসব শিক্ষাকেন্দ্রে তোমাদের নিজেদেরকে অবশ্যই এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেনো যখন তোমরা কোনো গ্রাম বা শহরে যাবে, তখন সেখানের মানুষদের গাইড করতে পারবে এবং তাদেরকে আত্মশুদ্ধির পথ দেখাতে পারবে। যখন তোমরা ধর্মীয় আইনশিক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পড়বে, তখন যেনো তোমরা নিজেরাই পরিশোধিত ও সুসংস্কৃত হও, যাতে মানুষকে ইসলামের নৈতিক আদবকায়দা, রীতিনীতি ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে সুশিক্ষিত করে তুলতে পারো – এটাই কাম্য। আল্লাহ না করুন যদি তোমরা শিক্ষাকেন্দ্রে এসে নিজেদের সংস্কার করতে না পারো, আধ্যাত্মিক আদর্শকে উপলব্ধি করতে না পারো, তাহলে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন – যেখানেই তোমরা যাবে, (তোমাদের শিক্ষার প্রভাবে) মানুষ বিকৃতমনা হবে, এবং তোমরা মানুষকে ইসলাম ও আলেমগণের ব্যাপারে নিচু ধারণা দেবে।

তোমাদের এক গুরুদায়িত্ব রয়েছে। তোমরা যদি মাদ্রাসায় নিজেদের দায়িত্ব পালন না করো, নিজের পরিশুদ্ধির পরিকল্পনা না করো; যদি শুধুমাত্র কিছু টার্ম শেখা, আইনের কিছু ইস্যু কিংবা বিচারশাস্ত্র শেখার পিছনে ছোটো, তাহলে তোমরা ইসলাম ও ইসলামী সমাজের যে ক্ষতি করবে – খোদা আমাদের সেটা থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহ রক্ষা করুন, কিন্তু তোমাদের দ্বারা মানুষকে বিকৃত ও বিপথগামী করা সম্ভব। যদি তোমাদের কাজ, কর্ম ও অনুচিত আচণের কারণে কোনো ব্যক্তি পথচ্যুত হয়ে ইসলাম ত্যাগ করে, তবে তুমি সবচে বড় কবিরা গুনাহর দোষে দোষী হবে, আর তোমার তওবা আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়াও কঠিন হবে। অনুরূপভাবে, (যদি তোমাদের কাজ, কর্ম ও আচরণের কারণে) একজন ব্যক্তি সঠিক পথ খুঁজে পায়, তবে একটা বর্ণনা অনুযায়ী – সেটা ঐ সকল কিছুর চেয়ে উত্তম, যার উপর সূর্যরশ্মি বিকীরিত হয়। তোমাদের দায়িত্ব অনেক কঠিন। সাধারণ মানুষের চেয়ে তোমাদের দায়িত্ব বেশি। সাধারণ মানুষের জন্য কত কিছুই বৈধ, যা তোমাদের জন্য অনুমিত নয়, এমনকি হারামও হতে পারে ! অনেককিছুই সাধারণ মানুষের জন্য বৈধ, কিন্তু তোমরা তা করো, সেটা মানুষ পছন্দ করে না। অনৈতিক কাজের সামনে তোমরা চুপ করে থাকবে, এটা তারা প্রত্যাশা করে না, আর আল্লাহ না করুন যদি তোমরা সেগুলো করো, তবে মানুষ ইসলাম সম্পর্কেই খারাপ ধারণা করে বসবে, আলেম সমাজ সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হবে।

সমস্যা হলো : মানুষ যদি তোমাদের কাজকর্মকে প্রত্যাশার বিপরীত দেখতে পায়, তাহলে তারা ধর্ম থেকেই সরে যায়। তারা গোটা আলেম সমাজ থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়, কোনো নির্দিষ্ট একজনের থেকে নয়। যদি তারা শুধু ঐ একজন আলেমের থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতো এবং শুধু ঐ ব্যক্তির ব্যাপারেই নিচু ধারণা করতো ! কিন্তু তারা যদি একজন আলেমকে প্রত্যাশিত আচরণের বাইরে অনুচিত কাজ করতে দেখে, তারা বিষয়টাকে এভাবে পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ করে দেখে না যে একই সময়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও খারাপ ও বিকৃতরুচির লোক আছে, এবং অফিস-কর্মচারীদের মাঝেও দুর্নীতি ও নোংরা কাজকর্ম দেখা যায়, সুতরাং এটা সম্ভব যে আলেমগণের মাঝেও এক বা একাধিক অধার্মিক ও পথচ্যুত মানুষ থাকতে পারে। সুতরাং, যদি একজন মুদি দোকানী একটা দোষ করে, তখন বলা হয় যে ওমুক দোকানী একজন খারাপ লোক। যদি একজন ফার্মাসিস্ট কোনো নোংরা কাজের অপরাধে দোষী হয়, বলা হয় যে ওমুক ফার্মাসিস্ট খারাপ লোক। কিন্তু যদি একজন দায়ী কোনো অনুচিত কাজ করে, তখন লোকে বলে না যে ওমুক ধর্মপ্রচারকটি খারাপ, বরং বলা হয় যে ধর্মপ্রচারকেরাই খারাপ !

জানাশোনা মানুষের দায়িত্ব বড় কঠিন; অন্যদের তুলনায় উলামাগণের দায়িত্ব বেশি। উলামাগণের দায়িত্ব বিষয়ে উসুলে কাফি কিংবা ওয়াসসাইল বইয়ের সংশ্লিষ্ট অধ্যায়গুলো যদি দেখো, তাহলে দেখবে কিভাবে তারা জানাশোনা মানুষদের কঠিন দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতার কথা বর্ণনা করেছে ! বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, যখন আত্মা গলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন আর তওবা করার সুযোগ থাকে না, এবং তখন কারো তওবা কবুল-ও হবে না। অবশ্য যদিও অজ্ঞদের তওবা আল্লাহ তাদের জীবনের শেষ মিনিট পর্যন্ত কবুল করে থাকেন। আরেকটা বর্ণনা অনুযায়ী কোনো আলেমের একটি গুনাহ ক্ষমা হবার আগে একজন অজ্ঞ মানুষের ৭০টি পাপ ক্ষমা করা হবে। এর কারণ হলো একজন আলেমের পাপ ইসলাম ও ইসলামী সমাজের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যদি কোনো অসভ্য মূর্খ মানুষ একটা পাপ করে, সে কেবল নিজেরই দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। কিন্তু যদি একজন আলেম পথচ্যুত হয়, যদি সে নোংরা কাজে লিপ্ত হয়, সে গোটা একটা দুনিয়াকে (আলম) নষ্ট করে। সে ইসলাম ও ইসলামের উলামাদের ক্ষতিসাধন করে।

আরেকটা বর্ণনা অনুযায়ী জাহান্নামের বাসিন্দাদের ঐসব আলেমের দুর্গন্ধ দ্বারা কষ্ট দেয়া হবে, যাদের কাজ ('আমল) তাদের জ্ঞান ('ইলম) মোতাবেক ছিলো না। ঠিক এই কারণেই, ইসলাম ও ইসলামী সমাজের লাভ-ক্ষতির ক্ষেত্রে এই দুনিয়ায় একজন আলেম ও একজন অজ্ঞ ব্যক্তির মাঝে পার্থক্য আছে। কোনো আলেম যদি পথচ্যুত হয়, তাহলে খুবই সম্ভব যে তার গোটা কমিউনিটিই ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে। আবার একজন আলেম যদি বিশুদ্ধ হন এবং ইসলামী আচরণবিধি ও নীতি-নৈতিকতা মেনে চলেন, তিনি গোটা কমিউনিটিকেই পরিশুদ্ধির দিকে পরিচালিত করবেন।

এই গ্রীষ্মে আমি কয়েকটা এলাকায় গিয়েছিলাম। আমি দেখলাম একটা এলাকার মানুষজন আচার-ব্যবহারে বেশ ভালো, তাদের আচার-আচরণে ধার্মিকতার ছাপ। আসল ব্যাপার হলো তাদের মাঝে একজন আলেম ছিলেন, যিনি নিজে ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ন ছিলেন। যদি কোনো সমাজে, এলাকায় কিংবা রাষ্ট্রে একজন ন্যায়পরায়ন ধার্মিক আলেম বাস করেন, শুধু তাঁর উপস্থিতিই ঐ এলাকার মানুষের পথপ্রদর্শন ও পরিশুদ্ধিকে উন্নত করবে, এমনকি যদিও তিনি মৌখিকভাবে দাওয়াত দেয়া, গাইড করা ইত্যাদি না করেন। আমরা এমন মানুষকে দেখেছি যাঁর কেবল উপস্থিতিই শিক্ষাগ্রহণ ঘটায়, শুধুমাত্র তাদেরকে দেখলে, তাদের দিকে তাকালেই মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ৷

পরকালে আমাদের কপালে যা ঘটবে, তা এই দুনিয়াতেই প্রস্তুত করে থাকি। আমরা যা করি তার বাইরে আমাদেরকে কিছুই দেয়া হয় না। একজন আলেম যদি দুর্নীতিগ্রস্ত ও খারাপ হয়, তবে সে গোটা সমাজকেই নষ্ট করে ফেলে, যদিও এই দুনিয়ায় আমরা সেটার দুর্গন্ধ বুঝতে পারি না। কিন্তু পরকালে সেটা টের পাওয়া যাবে। কোনো অসভ্য-মূর্খ মানুষের সেই ক্ষমতা নেই যে ইসলামি সমাজে সেই পরিমাণ দূর্নীতি ও দূষণ প্রবেশ করাবে যা একজন দূর্নীতিপরায়ন আলেম করতে পারে। অসভ্য-মূর্খ মানুষেরা কখনো নিজেদেরকে ইমাম কিংবা ইমাম মাহদি দাবী করবে না, কিংবা নবীও দাবী করবে না, অথবা বলবে না যে তার কাছে ওহী নাযিল হয়েছে। বরং এটা হলো দুর্নীতিগ্রস্ত আলেমদের কাজ, যারা দুনিয়াকে নষ্ট করে : “যদি একজন আলেম নষ্ট হয়, গোটা একটা দুনিয়া-ই নষ্ট হয়ে যায়।

তাই, একজন আলেমের নীতিহীনতা ইসলামের যে ক্ষতি করে, আর কারো নীতিহীনতা সে ক্ষতি করতে পারে না। জ্ঞান হলো আলো, কিন্তু কালো দূষিত হৃদয়ে সেটা কেবল অন্ধকার ও কলুষকেই বৃদ্ধি করে। যে “জ্ঞান” মানুষকে খোদার নিকটবর্তী করে, সেটাই আবার দুনিয়ালোভী মানুষকে সর্বশক্তিমান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। এমনকি একত্ববাদ – তাওহীদের জ্ঞান – সেটাও যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অর্জিত হয়, সেটা হয়ে যায় অন্ধকার এক আবরণ, কারণ সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোনো কিছুর জন্যে অর্জিত ৷

তুমি যদি কিছুটা কষ্ট করো, পড়াশুনা করো, তাহলে তুমি আলেম হতে পারবে বটে, কিন্তু জেনে রাখো যে আলেম হওয়া ও পরিশুদ্ধ হওয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে।

আমাদের প্রয়াত শিক্ষক শাইখ আবদুল করিম হায়েরী ইয়াযদী (র.) বলেছেন, “লোকে বলে : 'মোল্লা হওয়া কতই না সহজ, আর মানুষ হওয়া কতই না কঠিন' – কথাটা আসলে ঠিক নয়। বরং বলা উচিত : 'মোল্লা হওয়া কতই না কঠিন, আর মানুষ হওয়া তো অসম্ভব !'

এইযে এত এত ধর্মীয় শিক্ষা– যদি এগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে তা ধ্বংস ছাড়া আর কিছু বয়ে আনবে না।

এত এত ধর্মীয় শিক্ষার সাথে– যদি আত্মশুদ্ধি ও তাক্বওয়া অর্জন না হয়, তাহলে সেটা মুসলিম সমাজের জন্য এই দুনিয়ায় ও পরকালে কেবল ক্ষতি-ই বয়ে আনবে। কেবলমাত্র কিছু ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা তেমন কার্য্যকর হতে পারে না; এমনকি একত্ববাদের জ্ঞান (ইলম আত-তাওহীদ)জ্ঞান শিক্ষাও – যদি না এই জ্ঞানের সাথে সাথে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করা যায় ৷ অতএব তা না করতে সক্ষম হলে শেষে দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই আসবে না। দুনিয়ায় কত মানুষ তাওহীদের জ্ঞান নিয়ে আলেম হয়েছে এবং অসংখ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে,আজও করে চলেছে ৷ তোমাদের যে জ্ঞান আছে, আরো কত মানুষের এই একই জ্ঞান ছিলো, এমনকি হয়তো বেশিও ছিল, কিন্তু তারা পথচ্যুত ছিলো, কারন তারা নিজেদের সংস্কার করেনি; সুতরাং যখন তারা সমাজে (আলেম পরিচিতি সহকারে) প্রবেশ করলো, তখন অসংখ্য মানুষকে নষ্ট করলো, বিভ্রান্ত করলো।

এই নিষ্প্রাণ ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি যদি তাক্বওয়া (খোদার বিধান অমান্য করার ভয়) ও আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন না হয়, তাহলে যত বেশি এসব ধর্মীয় জ্ঞান একজনের মাথায় ঢুকবে, ততই তার অহংকার বেড়ে যাবে। যেই হতভাগ্য আলেম নিজের অহংকারের কাছে পরাজিত হয়েছে, সে নিজের কিংবা সমাজের সংস্কার করতে পারে না; এবং এর ফলাফল হিসেবে আসবে কেবলই ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি। উপরন্তু এটাও সম্ভব যে তার (কলুষিত আলেমের) উপস্থিতি-ই সমাজকে ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতা জানার পথে বাধা সৃষ্টি করবে ৷

আমি পড়াশুনা করতে নিষেধ করছি না, বলছি না যে তোমাদের জ্ঞানার্জনের প্রয়োজন নেই; বরং তোমাদের সতর্ক থাকতে হবে; কারণ যদি তোমরা সমাজের কাজে লাগতে চাও, ইসলামের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে চাও, জাতিকে ইসলামের ব্যাপারে সচেতন করতে চাও, ইসলামের মৌলিক আক্বীদাকে রক্ষা করতে চাও, তাহলে ইসলামী আইনের মৌলিক জ্ঞানের ভিত্তি খুব দৃঢ় হতে হবে, এ বিষয়ে তোমাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আল্লাহ না করুন তোমরা যদি সে জ্ঞান অর্জন করতে ব্যর্থ হও, তাহলে মাদ্রাসায় থাকার কোনো অধিকার তোমাদের নেই। (সেক্ষেত্রে) তোমরা ধর্মশিক্ষার ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত ভাতা গ্রহণ করতে পারবে না। অবশ্যই জ্ঞান অর্জনের দরকার আছে। ফিকাহ ও উসুল শিক্ষায় তোমরা যেমন কষ্ট করো, তেমনি নিজের সংস্কারের জন্যও কষ্ট করতে হবে। জ্ঞানার্জনের পথে নেয়া প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে সাথে প্রবৃত্তির দমনের পথেও একটি করে পদক্ষেপ নিতে হবে : প্রবৃত্তিকে দমন করতে হবে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের জন্য, আধ্যাত্মিকতা ও তাক্বওয়া অর্জনের জন্য।

ফিকাহ, উসুল ইত্যাদি বিষয় শিক্ষা করাটা হলো আত্মিক পরিশুদ্ধি, পবিত্র গুণাবলী, আচরণ ও ঐশী জ্ঞান অর্জনের সূচনা। গোটা জীবনটা কেবল সূচনায় পড়ে থেকো না যাতে তোমরা সমাপ্তিটা ভুলে যাও। তোমরা এসব জ্ঞান অর্জন করছো এক সুউচ্চ পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের জন্য : খোদাকে জানা এবং নিজেকে বিশুদ্ধ করা। তোমাদের কাজের ফলাফল ও প্রভাব উপলব্ধি করার জন্য প্ল্যান করা উচিত, সেইসাথে মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে সিরিয়াস হওয়া উচিত।

যখন তোমরা মাদ্রাসাজীবন শুরু করো, তখন আর সবকিছুর আগে নিজেকে সংস্কারের পরিকল্পনা করা উচিত। মাদ্রাসায় থাকাকালীন সময়ে পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেদের বিশুদ্ধ করা উচিত, যাতে তোমরা যখন মাদ্রাসা ছেড়ে গিয়ে কোনো শহর বা জেলার ইমাম হও, তারা যেনো তোমার দ্বারা লাভবান হতে পারে, তোমার কাছ থেকে উপদেশ নিতে পারে, এবং তোমার নৈতিক গুণাবলী, আচরণ, কর্ম ইত্যাদি দেখে যেনো তারা নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করতে পারে। মানুষের মধ্যে প্রবেশ করার আগে নিজেকে সংস্কার করার চেষ্টা করো। এখন, যখন তোমাদের সময়-সুযোগ আছে, এখন যদি তোমরা নিজেদের সংস্কার করতে না পারো, তাহলে যখন মানুষ তোমাদের কাছে আসতে শুরু করবে, তখন আর নিজেদের সংস্কারের সুযোগ পাবে না ৷ সুতরাং দাড়ি সাদা হবার আগেই কাজে লেগে পড়ো; মানুষের নজরে আসার আগে নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করো ! আল্লাহ না করুন কেউ না আবার এই উদ্দেশ্যে নিজেকে গড়ে তোলে যে সে লোকের নজরে পড়বে, মানুষের মাঝে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবে, প্রভাবশালী হবে আর এসব করে সে তার নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলবে।

নফসের উপর কর্তৃত্ব হারানোর আগেই নিজেকে গড়ে তোলো, নিজের সংস্কার করো ! সুঅভ্যাস দ্বারা নিজেকে সাজিয়ে তোলো, নিজের দোষগুলি দূর করো ! তোমাদের শিক্ষাগ্রহণ ও আলোচনায় বিশুদ্ধ হয়ে ওঠো, যেনো আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে পারো ! যদি কারো সৎ নিয়ত না থাকে, তাহলে সে স্বর্গীয় গৃহ থেকে অনেক দূরে সরে পড়বে। আল্লাহ না করুন; কখনো এমনটা যেনো না হয় যে সত্তর বছর ধরে তোমরা সর্বশক্তিমান খোদার থেকে দূরে ছিলে ! তোমরা কি সেই “পাথর” এর গল্প শুনেছো, যেটাকে দোযখে ফেলা হয়েছিলো ? সত্তর বছর পর সেটার পতনের শব্দ শোনা গিয়েছিলো। একটা বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহর রাসূল (তাঁর ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও দয়া বর্ষিত হোক) বলেছেন : সেটা ছিলো এক বৃদ্ধ লোক, যে সত্তর বছর বয়সে মারা গিয়েছিলো, আর এই সত্তর বছর ধরেই সে জাহান্নামের ভিতরে পড়ছিলো। সাবধান থাকো, যেনো মাদ্রাসায় তোমার নিজের শ্রম আর কপালের ঘাম দিয়ে পঞ্চাশ বা তার কম-বেশি সময়ে তোমরা যেনো দোযখে পৌঁছে না যাও ! সময় থাকতে এখনই চিন্তা করো ! আত্মার পরিশুদ্ধি ও সংস্কারের পথে পরিকল্পনা করো, এবং নিজের চারিত্রিক সংস্কার সাধন করো।

নিজের জন্য একজন নৈতিক শিক্ষক নির্ধারণ করে নাও; উপদেশ-পরামর্শ-সতর্কীকরণ সেশন আয়োজন করো। তুমি নিজে নিজের সংস্কার করতে পারবে না। কাহ ও উসুল (আইন ও তার মূলনীতি) শিক্ষার জন্য শিক্ষক প্রয়োজন; প্রতিটা বিশেষ পড়াশুনা ও দক্ষতা অর্জনের জন্যই শিক্ষক অপরিহার্য, এবং আত্মতুষ্টি ও নাক-উঁচু ভাব নিয়ে কেউ-ই কোনো বিশেষ বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারে না – অথচ এটা কী করে সম্ভব যে আত্মিক ও নৈতিক বিষয়ে, যা কিনা অত্যন্ত কঠিন একটি বিদ্যা, সেটার জন্য শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণের কোনো প্রয়োজন হবে না, মানুষ সেটা নিজে নিজে এমনি এমনিই পেরে যাবে, অথচ যেখানে এই আধ্যাত্মিকতার চর্চাই ছিলো নবীগণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য !

স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষদের প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে প্রশিক্ষিত করার জন্য, মানবতাবোধ উন্নত করার জন্য, এবং মানুষের মাঝ থেকে কদর্যতা, কলুষতা, দূর্নীতি ও অনৈতিক কাজ দূর করার জন্য। তাঁদেরকে প্রেরণ করা হয়েছিলো মানুষকে সুন্দর আচরণ ও সদগুণাবলীর সাথে পরিচিত করানোর জন্য : “আমার সৃষ্টি হয়েছে মহান গুণাবলী (মাকারিম আল আখলাক) পূর্ণ করার জন্য।” (উল্লিখিত উক্তিটি সূরা কলম, ৬৮:৪ নং আয়াতের তাফসিরে মুহাম্মাদ (সা.) এর উক্তি – অনুবাদক।) এই জ্ঞান সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে এজন্যে তিনি নবীগণকের প্রেরণ করেছেন; অথচ আমাদের মাদ্রাসায় আলেমদের মাঝে এই জ্ঞানের ব্যাপারে কোনো গুরুত্বই দেখা যায় না। কেউ এটাকে যোগ্য মর্যাদা দেয় না। মাদ্রাসায় আধ্যাত্মিকতা ও রহস্যজ্ঞান বিষয়ে পর্যাপ্ত চর্চার অভাবে বস্তুবাদী দুনিয়াবী বিষয় এত বেশি বেড়ে গিয়েছে যে সেটা এমনকি আলেমসমাজের ভিতরে ঢুকে পড়েছে এবং তাদের অনেককেই পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতা (রুহানিয়াত) থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ক্ষেত্রবিশেষে দুনিয়াবী বিষয় আলেমদেরকে এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে যে তাদের অনেকে এমনকি রুহানিয়াত অর্থ-ই জানে না ! জানে না আলেমগণেরর দায়িত্ব কী কী এবং তাদের কাজকর্ম কেমন হওয়া উচিত। তাদের কেউ কেউ পরিকল্পনা করে যে কেবল কয়েকটা শব্দ শিখবে, নিজেদের লোকালয়ে বা অন্য কোথাও ফিরে যাবে, বিভিন্ন পদ-পদবী দখল করে বসবে, আর সেজন্যে অন্যদের সাথে লড়াই করবে। এমন হয় না যে প্রথম থেকেই তুমি পড়াশুনা করবে কারো পদ-পদবী দখল করার উদ্দেশ্যে; পড়াশুনা করবে এই নিয়তে যে তুমি কোনো গ্রাম বা শহরের মোড়ল হয়ে বসবে। তুমি তোমার স্বার্থপর কামনা ও মন্দ ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারবে হয়তো, কিন্তু নিজের ও ইসলামী সমাজের জন্য তুমি ক্ষতি আর দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। মুয়াবিয়াহ-ও দীর্ঘদিন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলো, কিন্তু নিজের জন্য সে অভিশাপ, ঘৃণা ও পরকালের অনন্ত শাস্তি ছাড়া উপকারী কোনো কিছু অর্জন করতে পারেনি।

নিজেদের সংস্কার করা তোমাদের জন্যে খুব জরুরি; যাতে তোমরা যখন কোনো সমাজ বা গোত্রের প্রধান হও, তোমরা যেনো তাদেরকেও পরিশুদ্ধ করতে পারো। কোনো সমাজ সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নিতে হলে তোমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত ইসলাম ও মুসলিমের খেদমত করা।

যদি তুমি খোদার তরে পদক্ষেপ নাও, তবে তিনিই তো হৃদয় পরিবর্তনকারী ! তিনিই তোমার দিকে মানুষের অন্তর পরিবর্তিত করে দেবেন : “নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, করুণাময় (আল্লাহ) তাদের জন্য (মুমিনদের অন্তরে) ভালোবাসা দান করবেন।” (সূরা মারইয়াম, ১৯:৯৬)

আল্লাহর দিকে যাত্রার পথে কিছুটা কষ্ট করো, নিজেকে নিবেদিত করো। খোদা তোমাকে প্রতিদান দেবেন; যদি এই দুনিয়ায় না হয় তো পরকালে তিনি তোমাকে পুরস্কৃত করবেন। যদি এই দুনিয়াতে তোমার আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুই চাওয়া পাওয়ার না থাকে, তাহলে এর চেয়ে উত্তম আর কী-ই বা হতে পারে ! এই দুনিয়া কিছুই না। এই জাঁকজমক, এই নাম-যশ এগুলো সবই কিছুদিন পর শেষ হয়ে যাবে, যেভাবে মানুষের চোখের সামনে দিয়ে স্বপ্ন পার হয়ে যায়; কিন্তু অপর দুনিয়ার পুরস্কার অসীম, এবং তা কখনোই শেষ হবে না ৷

অথচ যদি আলেমরাই একে অপরের বিরোধিতা করে, একজন আরেকজনকে অসম্মান করে, এবং ইসলামী নৈতিক আচরণবিধি অনুযায়ী আচরণ না করে, তাহলে সমাজে তাদের যে অবস্থান রয়েছে, তা থেকে তারা বিচ্যুত হয়ে পড়বে, জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। মানুষ তোমাদেরকে রুহানি (আলেম, আধ্যাত্মিক ব্যক্তি) হিসেবে দেখতে চায়। দেখতে চায় ইসলামী আদব-কায়দা পালনকারী হিসেবে, দেখতে চায় হিজবুল্লাহ (আল্লাহর দল) হিসেবে। এইসব মেকি জাঁকজমক, চাকচিক্য থেকে নিজেকে সংযত করো; ইসলামী আদর্শ প্রচারের অগ্রযাত্রায় ও মুসলিম জাতির স্বার্থে কোনো আত্মত্যাগকেই না কোরো না। সর্বশক্তিমান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে তাঁর পথে অগ্রসর হও এবং অনন্য স্রষ্টা ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিও না।

যাইহোক, যদি প্রত্যাশার বিপরীতে মানুষ দেখে যে, আধ্যাত্মিকতার দিকে মনোযোগ দেয়ার বদলে তোমরা কেবল দুনিয়াবি বিষয়েই মশগুল, এবং অন্যদের মত তোমরাও ব্যক্তিগত ও দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের পিছনে ছুটছো, দুনিয়াবি সুখের জন্য লড়াই করছো; এবং আল্লাহ না করুন নিজেদের নোংরা, নীচ দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলাম ও কুরআনকে খেলাচ্ছলে গ্রহণ করছো, ধর্মকে ব্যবসায় পরিণত করেছো – তাহলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে, সন্দিগ্ধ হয়ে পড়বে। তোমরাই এর জন্য দায়ী হবে। যদি মাদ্রাসার পাগড়িধারী লোকেদের কেউ কেউ পদ-পদবী, দুনিয়াবী বিষয়, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা ইত্যাদির কারণে পরস্পর মারামারি করে, একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায় ও গিবত করে, তাহলে তারা ইসলাম ও কুরআনের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করলো, এবং পবিত্র আস্থার ভঙ্গ করলো। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা আমাদের উপর আস্থা রেখে তাঁর দেয়া পবিত্র ধর্মকে রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন। পবিত্র কুরআন হলো এক মহান ঐশী আস্থার নিদর্শন। উলামা এবং রুহানিগণ হলেন এই স্বর্গীয় আস্থার বাহক, আর এই আস্থার যেনো ভঙ্গ না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাদেরই। (ইসলাম নিয়ে বিবাদমান আলেমগণের) এই একগুঁয়েমি, দুনিয়াবী ও ব্যক্তিগত বিরোধ – এগুলো সবই ইসলাম ও তার মহান নবীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা।

আমি জানি না এইসব বিরোধিতা, হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য দল তৈরী করা, পারস্পরিক শত্রুতা ইত্যাদির মাধ্যমে কী লক্ষ্য অর্জিত হয়। যদি সেটা তোমাদের দুনিয়াবী স্বার্থে হয়ে থাকে, তাহলে তোমাদের তো দুনিয়াবী তেমন কিছুই নেই! যদি তোমরা দুনিয়াবী আনন্দ-সুখ অর্জন করে থাকো, তাহলে তো এত দ্বন্দ্ব থাকার কথা না ! অবশ্য যদিনা তোমরা সেইসব রুহানি হও, যারা রুহানিয়াত বলতে বোঝে কেবল আলখাল্লা আর পাগড়ি। যেই রুহানি (আলেম, আধ্যাত্মিক ব্যক্তি) আধ্যাত্মিক বিষয়ে মশগুল, যার মধ্যে ইসলামের সংস্কারমূলক গুণাবলী আছে, যে কেউ নিজেকে মাওলা আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) অনুসারী মনে করে, সেতো দুনিয়ার লোভে পড়তে পারে না ! এবং দুনিয়াবী বিষয়কে সে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণও হতে দেবে না। তোমরা যারা নিজেদেরকে আমিরুল মুমিনিনের (বিশ্বাসীদের নেতার)অনুসারী বলে দাবী করো – তাদের অবশ্যই এই মহান মানুষটার জীবন সম্পর্কে তোমাদের কিঞ্চিৎ হলেও গবেষণা করে দেখা উচিত, আর ভেবে দেখা উচিত, আসলেই কি তোমরা তাঁর অনুসারী ! তোমরা কি তাঁর তাক্বওয়া, কঠোর সংযম, সাধারণ অনাড়ম্বর জীবন যাপন সম্পর্কে জানো ? তোমরা কি সেটা অনুসরণ করো ? অত্যাচার-অবিচার, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই মহান মানুষটির লড়াই সম্পর্কে কি তোমরা কিছু জানো ? জানো কিভাবে তিনি নির্যাতিত মানুষকে নির্দ্বিধায় সমর্থন দিতেন, সমাজের বাস্তুহারা দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণীর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন ? তোমরা কি সেটা চর্চা করো ? তাহলে, তোমাদের সাথে সেইসব মানুষের পার্থক্য কোথায় ভেবে দেখ, যারা সদগুণের দিক থেকে “আহলে বাইতের অনুসারিদের” তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর ? তাদের তুলনায় তোমাদের কী-ই বা বিশেষত্ব আছে ?

যারা আজকে দুনিয়ার একটা অংশকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, হত্যা-রক্তপাত করছে, তারা এসব করছে কারণ তারা দুনিয়ার জাতিগুলোকে লুট করার প্রতিযোগীতায় নেমেছে; তারা প্রতিযোগীতায় নেমেছে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করার, মানুষের শ্রমের ফসলকে দখল করা এবং দুর্বল ও অনুন্নত জাতিগুলোকে নিজের করায়ত্ত্বে নিয়ে আসার। একারণে তারা স্বাধীনতা, উন্নতি-অগ্রগতি, সীমান্ত রক্ষা, স্বাধীনতা রক্ষা ইত্যাদি প্রতারণামূলক শ্লোগান দিয়ে প্রতিদিনই দুনিয়ার কোনো না কোনো প্রান্তে যুদ্ধের আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলছে নিরাপত্তাহীন জাতিগুলোর উপর। দুনিয়াবী বিষয়ে মত্ত কলুষিত মস্তিষ্কের মানুষের কাছে এধরণের যুদ্ধ খুবই যৌক্তিক। কিন্তু তোমাদের (আলেমদের) যে লড়াই, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, তা এমনকি ঐসব দুনিয়ালোভী মানুষের কাছেও অযৌক্তিক। যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে তোমরা কেনো পরস্পর লড়াই করছো, তাহলে তারা জবাব দেবে যে ওমুক ওমুক দেশ দখল করার জন্য করছি : ওমুক ওমুক দেশের সম্পত্তি আমাদের নিতে হবে। কিন্তু যদি তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কেনো তোমাদের মধ্যে এত দ্বন্দ্ব, কেনো তোমরা পরস্পর লড়াই করছো, তোমাদের উত্তর কী হবে ? দুনিয়া থেকে কী এমন লাভ তোমরা পাচ্ছো, যার জন্যে লড়াই করছো ?

এ সমস্ত দ্বন্দ্ব, আসলে যার কোনো পবিত্র লক্ষ্য নেই, এসব দ্বন্দ্বের গোড়া হলো দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা। যদি তোমাদের মাঝে এধরণের দ্বন্দ্ব বিদ্যমান থাকে, তবে এর কারণ হলো তোমরা নিজেদের অন্তর থেকে দুনিয়ার মায়াকে ত্যাগ করতে পারোনি। যেহেতু দুনিয়াবী লাভ খুবই সীমিত, সুতরাং সেটা অর্জনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তুমি কোনো নির্দিষ্ট পদ অর্জন করতে চাও, যেটা কিনা আরেকজনও চায়, এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই এটা ঈর্ষা ও বিবাদের জন্ম দেবে। কিন্তু যারা খোদার লোক, যারা দুনিয়ার মায়াকে অন্তর থেকে বের করে দিয়েছে, এক আল্লাহ ছাড়া যাদের আর কোনো লক্ষ্য নেই, তারা কখনোই একে অপরের সাথে লড়াই করে না; এমন দূর্দশা-অনৈক্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। যদি আজকে স্বর্গীয় নবীগণ সকলে কোনো শহরে একত্রিত হতেন, তবে তাঁদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য কিংবা দ্বন্দ্ব থাকতো না, কারণ তাঁদের সকলের লক্ষ্য ও গন্তব্য একই। তাঁদের প্রত্যেকের হৃদয়ই খোদামুখী, এবং দুনিয়ার যেকোনো মায়া থেকে তাঁরা মুক্ত।

যদি তোমাদের কাজকর্ম, জীবনযাত্রা, অভিযাত্রা তেমনটাই হয় যা এখন দেখা যাচ্ছে, তাহলে তোমরা বরং খোদাকে ভয় করো। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন, তোমরা না আবার আলী ইবনে আবি তালিবের (আ.) অনুসারী না হয়ে দুনিয়া ত্যাগ করো। তোমাদের ভয় করা উচিত যে, তোমাদের তওবা না-ও কবুল হতে পারে, এবং ইমাম আলীর শাফায়াত তোমার উপকার না-ও করতে পারে। সুযোগ হারানোর আগেই তোমাদের উচিত এই বিষয়টার সমাধান করা। এইসব তুচ্ছ অপমানজনক দ্বন্দ্ব বাদ দাও। এসব দ্বন্দ্ব-লড়াই সম্পূর্ণরূপে অনুচিত। তোমরা কি (এক মুসলিম জাতি ভেঙে) একাধিক জাতি সৃষ্টি করছো ? তোমাদের ধর্ম কি উগ্র জাতীয়তাবাদের ধর্ম ? কেনো তোমরা সাবধান হচ্ছো না ? কেনো তোমরা বিশুদ্ধ, সৎ ও পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ নও ? কেনো ? কেনো ?

এসব বিভেদ খুব মারাত্মক, কারণ এসবের ফলস্বরূপ এমন অনৈক্যের জন্ম হয়, যার ক্ষতি পূরণ করা অসম্ভব। (বিভেদের ফলস্বরূপ) মাদ্রাসাগুলো শেষ হয়ে যাবে, সমাজে তোমরা হবে মূল্যহীন ও অসম্মানিত। এইসব দল সৃষ্টি করা কেবল তোমাদের-ই ক্ষতি বয়ে আনছে। এটা যে কেবল তোমাদের জন্যই কলঙ্কজনক তা নয়, বরং সমাজ ও জাতির জন্য এটা অসম্মান ও বদনাম ডেকে আনে, ফলস্বরূপ ইসলাম হয় ক্ষতিগ্রস্ত। যদি তোমাদের পরস্পরবিরোধিতার কারণে মুসলিম জাতির মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি হয়, তাহলে সেটা হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সেটা হবে অন্যতম কবিরা গুনাহ, কারণ এর ফলে সমাজে অনৈক্য সৃষ্টি হবে, যা আমাদের উপর শত্রুদের প্রভাব বৃদ্ধির দ্বার খুলে দেবে। সম্ভবত মাদ্রাসার ভিতরে অনৈক্য ও শত্রুতার প্রসার ঘটানোর জন্য কোনো অদৃশ্য হাত কাজ করছে। মানুষের চিন্তাকে দূষিত করে, মানুষের মাঝে সংশয় ঢুকিয়ে দিয়ে এগুলোকে “ধর্মীয় দায়িত্বের” ছদ্মবেশ পরিয়ে সেই অদৃশ্য হাত বিভেদ ও সংঘাতের বীজ বপন করছে। এভাবে তারা ধর্মশিক্ষাকেন্দ্রে সৃষ্টি করেছে অনৈক্য, যাতে যে ব্যক্তিরা ইসলামের ভবিষ্যতের জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারতো, তারা যেনো শেষ হয়ে যায়। তারা যেনো ইসলাম ও ইসলামী সমাজের খেদমতে না আসে। সতর্ক ও সচেতন হওয়াটা আমাদের দরকার। “আমার ধর্মীয় দায়িত্ব হলো এটুকু, আর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা হলো এটুকু” – এজাতীয় চিন্তা করে নিজেকে বোকা বানিও না। কখনো কখনো শয়তান মানুষের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়। কখনো কখনো স্বার্থপর চাওয়া-পাওয়া মানুষকে বাধ্য করে ধর্মীয় দায়িত্বের নাম করে (স্বার্থলোভী) কাজ করতে। কোনো মুসলমানকে কষ্ট দেয়া কিংবা কোনো ভাইয়ের সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা – এগুলো কোনো ধর্মীয় দায়িত্ব নয়।

এটাই হলো দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা, নিজের প্রতি ভালোবাসা। এগুলোই হলো শয়তানের কুমন্ত্রণা, যা মানুষের জন্য আঁধার ডেকে আনে। এই শত্রুতা হলো ধ্বংসপ্রাপ্তদের শত্রুতা : “জাহান্নামবাসীদের জন্যে বাকবিতণ্ডা অবশ্যম্ভাবী।” (সূরা সা'দ, ৩৮:৬৪)

শত্রুতা আর বাকবিতণ্ডা হলো জাহান্নামের জিনিস। দোযখের মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকে, থাকে পারস্পরিক মারামারি। যদি তোমরা এই দুনিয়ার জন্যে ঝগড়া করো, তবে সাবধান হও ! কারণ তোমরা নিজেদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত করছো, আর তোমরা তার মাঝপথে আছো। পরকালের দুনিয়ায় তো কোনো কিছুর জন্যে মারামারি নেই ! ওপারের দুনিয়ার মানুষেরা বিশুদ্ধ, প্রশান্ত হৃদয়ের অধিকারী। তাদের পরস্পরের মাঝে কেবলই শান্তি। খোদার প্রতি ভালোবাসা আর আনুগত্য তাদের হৃদয় ছাপিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো আল্লাহতে ঈমান আনা ব্যক্তিদেরকে ভালোবাসা। আল্লাহর বান্দাদের প্রতি ভালোবাসা-ই হলো তাঁর ভালোবাসার ছায়া।

তোমার নিজের হাতকে আগুনের মধ্যে দিও না। দোযখের আগুনের শিখাকে উস্কে দিও না। জাহান্নাম মানুষের নোংরা কাজকর্ম দ্বারা প্রজ্বলিত। এগুলো হলো একগুঁয়ে লোকেদের কাজ, যা দোযখের আগুনকে প্রজ্বলিত করে। হাদীসে বর্ণিত আছে : “আমি জাহান্নামকে অতিক্রম করেছি যখন তার আগুন নেভানো ছিলো।” যদি কোনো মানুষ নিজের কর্ম দ্বারা জাহান্নামের আগুনকে প্রজ্বলিত না করে, তবে জাহান্নামের চিহ্ন থাকবে না। এজাতীয় (একগুঁয়ে) আচরণের ভিতরেই থাকে জাহান্নাম। এজাতীয় আচরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানে জাহান্নামের দিকেই এগিয়ে যাওয়া। যখন মানুষ এই দুনিয়া থেকে চলে যায়, তার সামনে পর্দা উন্মোচিত হয়, তখন সে উপলব্ধি করে যে : “এ হলো তারই ফল, যা তোমরা ইতিপূর্বে নিজহাতে পাঠিয়েছো,...” (আলে ইমরান, ৩:১৮২) এবং “তারা তাদের কৃতকর্মকে সেখানে উপস্থিত দেখবে” (সূরা কাহফ, ১৮:৪৯)। মানুষের এই দুনিয়ার সকল কৃতকর্ম অপর দুনিয়ায় দেখা যাবে, এবং তার জন্যে সেই কর্মগুলোকে সত্যিকার রূপ দেয়া হবে : “অতঃপর কেউ অনু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে, এবং কেউ অনু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা যালযালাহ, ৯৯:৭-৮)। মানুষের এই দুনিয়ার সকল কথা-কর্ম অপর দুনিয়ায় প্রতিফলিত হবে। যেনো আমাদের জীবনের সবকিছু ফিল্মে রেকর্ড করা হচ্ছিলো, আর ঐ দুনিয়ায় সেই ফিল্মটা দেখানো হবে, এবং কেউ-ই সেটার বিন্দুমাত্র অস্বীকার করতে পারবে না। আমাদের সকল কাজকর্ম, পদক্ষেপ – সবকিছু আমাদেরকে দেখানো হবে, সেইসাথে আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেবে সাক্ষ্য : “... তারা ( মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ত্বক) বলবে : আল্লাহ, যিনি সকল কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন।...” (সূরা ফুসসিলাত, ৪১:২১)।

আল্লাহ, যিনি সকল কিছুকে বাকশক্তি দান করবেন এবং সাক্ষী বানাবেন, তাঁর সামনে তোমার কোনো নোংরা কর্মকেই তুমি অস্বীকার করতে বা লুকাতে পারবে না। একটু চিন্তা করো, সামনে তাকাও, তোমার কর্মের পরিণতি ভেবে দেখো, মৃত্যুর পরে যেসব ভয়ানক ঘটনা ঘটে তা স্মরণে রাখো, কবরের চাপকে স্মরণ করো, বারযাখের দুনিয়াকে স্মরণ করো, এবং তার পরে যে যন্ত্রণা-দূর্দশা আসবে, তাকে উপেক্ষা কোরো না। অন্ততঃ জাহান্নামে বিশ্বাস রাখো। যদি কোনো মানুষ মৃত্যুর পরের ভয়ানক ঘটনাগুলোর কথা স্মরণে রাখে, সে তার জীবন যাপনের ধারা বদলে ফেলবে। যদি এই বিষয়ে তোমাদের ঈমান ও নিশ্চয়তা (নিশ্চিত জ্ঞান) থাকতো, তবে তোমরা এতো স্বাধীনভাবে নীতিহীন জীবন যাপন করতে না।

তোমাদের লেখনী, তোমাদের পদক্ষেপ, তোমাদের জিহবা – এগুলোকে সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণ করো সংস্কার ও নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করে তোলার জন্য।

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের দয়া করেন বলে তিনি মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দান করেছেন। মানুষ যেনো নিজেকে বিশুদ্ধ ও পবিত্র করতে পারে, সেই ক্ষমতা দান করেছেন। নবী ও আউলিয়াগণকে (আল্লাহর বন্ধু) পাঠিয়েছেন মানুষকে সঠিকপথে গাইড করার জন্য, যেনো মানুষ আত্মসংস্কারের মাধ্যমে নিজেদেরকে জাহান্নামের ভয়ানক শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে। যদি এই পদ্ধতিতে কাজ না হয় (অর্থাৎ মানুষের মাঝে সংস্কার ও সচেতনতা সৃষ্টি না হয়), তবে পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অন্য উপায়ে সচেতন করেন : নানারকম সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র্য, অসুস্থতা ইত্যাদি দ্বারা। ঠিক একজন দক্ষ চিকিৎসক কিংবা ভালো নার্সের মতই তিনি (আল্লাহ তায়ালা) অসুস্থ মানুষকে তার ভয়ানক আত্মার রোগ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। যদি আল্লাহ তাঁর কোনো বান্দাকে দয়া করেন, তবে সে একের পর এক দুর্দশায় পতিত হতে থাকবে, যতক্ষণ না সে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট ফিরে আসে, নিজের সংস্কার সাধন করে। এটাই হলো প্রকৃত পথ, এছাড়া আর কোনো পথ নেই; কিন্তু এপথের শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে মানুষকে নিজ পায়েই হাঁটতে হবে। যদি (দুঃখ-দুর্দশা-পরীক্ষার মধ্যদিয়ে আত্ম-সংস্কার ও আত্মশুদ্ধির) এই পথে মানুষ সাফল্য লাভ করতেই হবে ৷

মানুষকে দোযখ থেকে দূরে রাখার জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহর কত দয়া ও অনুগ্রহ। তারপরও যদি আল্লাহর এত দয়া ও অনুকম্পা সত্ত্বেও মানুষ সংশোধন না হয় ? তাহলে তার শুদ্ধির জন্য আগুনে পোড়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। ইতিহাসের কত মানুষ আত্মশুদ্ধির পথে আসেনি, নিজের সংস্কার করেনি, এবং এইসব পন্থায়ও তাদের শুদ্ধি ঘটেনি, এবং শেষমেষ দয়াময় ও করুণাময় খোদা তার বান্দাকে আগুনে পুড়ানোর মাধ্যমে বিশুদ্ধ করেছেন, ঠিক যেভাবে সোনা পুড়িয়ে খাঁটি করা হয় ৷

এখন, যেখানে তোমরা এক মিনিটের জন্যও জ্বলন্ত একটা পাথর হাতে রাখতে পারো না, তাহলে দোযখের আগুনকে নিজের থেকে দূরে রাখো ! মাদ্রাসা ও আলেমগণকে এই আগুনের থেকে দূরে রাখো। তোমাদের অন্তর থেকে ঝগড়া-বিবাদকে অনেক দূরে সরিয়ে ফেলো। মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করো, রহমান-রহিম (করুণাময়, দয়ালু) হবার চেষ্টা করো। অবশ্য পাপী লোকেদের পাপ ও খোদাদ্রোহীতার ব্যাপারে নম্র হওয়া চলবে না। বরং তাদেরকে মুখের উপর বলে দাও যে সে পাপ করছে, তাকে নিষেধ করো, এবং নিজেও নৈরাজ্য ও বিদ্রোহ সৃষ্টি কোরো না। আল্লাহর বান্দা এবং সংকর্মীদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে জ্ঞানের কারণে সম্মান করো, সৎপথের ব্যক্তিদেরকে তাদের সদগুণের কারণে সম্মান করো, এবং জ্ঞানহীন অশিক্ষিতদেরকেও সম্মান করো, কারণ তারাও আল্লাহরই বান্দা। উত্তম আচরণের অধিকারী হও, দয়ালু হও, হও সৎ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ। নিজের সংস্কার করো। তুমি গোটা একটা কমিউনিটিকে গাইড করতে চাও, তাদেরকে সংস্কার করতে চাও; কিন্তু যে ব্যক্তি নিজেরই সংস্কার ও সংশোধন করতে সক্ষম নয়, সে কী করে অপরকে পথ দেখাবে ?

নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.)দুয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে অনেক বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মুনাজাতের ভাষা আদেশ-নিষেধের ভাষা থেকে একদমই আলাদা। মুনাজাতের মাধ্যমে তাঁরা গভীর আধ্যাত্মিক, অবস্তুগত এবং ঐশী বিষয় ব্যাখ্যা করতেন, আল্লাহর সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান প্রকাশ করতেন। কিন্তু আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুনাজাত করে যাই, অথচ এর অর্থের দিকে কোনো মনোযোগই দিই না, এবং তাঁরা মুনাজাতের মাধ্যমে আসলে কী বলতে চেয়েছেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা বুঝতে ব্যর্থ হই।

এই মুনাজাতে আমরা বলি : “হে আমার রব ! আমি যেনো তোমার ধ্যান ছাড়া আর সকল কিছুর থেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারি, এবং তোমার দিকে তাকানোর মাধ্যমে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে এমনভাবে আলোকিত করতে পারি, যেনো আলোর পর্দা ছিন্ন করে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি তোমার মহত্বের নিকটবর্তী হয়, এবং আমাদের আত্মা পরিপূর্ণভাবে তোমার সুপবিত্র সত্তার মালিকানাধীন হয়ে যায়।

দুনিয়াবি সুখ ত্যাগ করার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করেন (আর দুনিয়াবি সুখকে ত্যাগ করার মাধ্যমেই আল্লাহ ব্যতীত আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়)। আল্লাহ ব্যতীত আর সকল কিছু থেকে পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা সহজ কাজ নয়। এজন্যে খুব কঠোর সাধনার প্রয়োজন। ক্ষেত্রবিশেষে সেইসাথে আধ্যাত্মিক চর্চা, ধৈর্য্য, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে যেনো মানুষ আল্লাহ ছাড়া দুনিয়ার আর সকল কিছু থেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারে।

যদি কেউ এই কাজে সফল হয়, তাহলে সে অত্যন্ত সম্মানিত স্থান অর্জন করেছে। তবে, দুনিয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ থাকলে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব না। যেভাবে রমজানের রোজা পালন করতে বলা হয়েছে, পবিত্র রমজানে কেউ যদি ঠিক সেইভাবেই রোজা রাখতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে।

(মূলঃ-আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমিনি (রহঃ), অনুবাদঃ- নুরে আলম মাসুদ, সংকলনে-কামরুল হাসান)

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)