দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা

দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা20%

দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা লেখক:
: মোঃ মাঈনুদ্দিন তালুকদার
প্রকাশক: শহীদ আল্লামা বাকের সাদর (রহঃ) বিশ্ব সম্মেলন কমিটি,কোম-ইরান।
বিভাগ: নবুয়্যত

দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 26 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 13574 / ডাউনলোড: 3913
সাইজ সাইজ সাইজ
দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা

দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা

লেখক:
প্রকাশক: শহীদ আল্লামা বাকের সাদর (রহঃ) বিশ্ব সম্মেলন কমিটি,কোম-ইরান।
বাংলা

দার্শনিক যুক্তির সম্মুখে বস্তুবাদের অবস্থানঃ

যান্ত্রিক বস্তুবাদ এ যুক্তির মোকাবিলায় কোন প্রকার অসুবিধার সম্মুখীন হয় না। কেননা আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে,যান্ত্রিক বস্তুবাদ প্রাণ,অনুভূতি ও চিন্তাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে,এ বিষয়গুলো বস্তুদেহসমূহের বিচ্ছিন্নতা ও একীভূতি থেকে অর্জিত হয়েছে-কোন প্রাচুর্য থেকে নয়। অতএব,এ বিচ্ছিন্নতা ও একীভূতির মাধ্যমেই যান্ত্রিক শক্তি অনুসারে অংশসমূহের গতি নামক নূতন কিছু অর্জিত হয়েছে।

কিন্তু নব্য বস্তুবাদ বস্তুর প্রকরণগত ও অবস্থাগত বিবর্তন ও বিকাশের মাধ্যমে বস্তু বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে -এ বিশ্বাস হেতু উক্ত যুক্তির সম্মুখে সমস্যায় পতিত হয়। তবে এ প্রতিষ্ঠান গুণগত বা অবস্থাগত বিবর্তনকে এমন এক পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে যা পূর্বোল্লিখিত দ্বিতীয় বিষয়টির (অর্থাৎ নিম্ন পর্যায়ের বস্তু উচ্চ পর্যায়ের বস্তুর অস্তিত্বগত কারণ হতে পারে না) সাথে সমন্বয়  রক্ষা করে এবং একমাত্র পদার্থকেই এ অবস্থাগত বা গুণগত বিবর্তনের জন্য যথেষ্ট মনে করে। অর্থাৎ পদার্থই এ অবস্থাগত ও গুণগত বিবর্তন ও বিকাশের উৎস। আর এটি বিত্তহীন ব্যক্তির আপন সম্পদের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পূর্বোল্লিখিত এ উদাহরণের মতো;দ্বিতীয় বিষয়টির সাথে বৈপরীত্য প্রদর্শন করে না।

বরং এ ব্যাখ্যাটি এরূপ যে,প্রতিটি বিকশিত ও বিবর্তিত রূপ এবং এর ধারণকৃত উপাদানসমূহ পদার্থের মধ্যে সৃষ্টির আদি থেকেই বিদ্যমান। যেমন ডিমের মধ্যে মুরগী এবং পানির মধ্যে গ্যাস সৃষ্টির আদিতেই উপস্থিত ছিল। কিন্তু কিরূপে পদার্থ সমসাময়িককালে ডিম,আবার মুরগী;কিংবা গ্যাস আবার পানিও হতে পারে? দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এর জবাব নিম্নরূপে প্রদান করে :

এটা হলো পারস্পরিক বৈপরীত্য যা প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। প্রতিটি পদার্থই স্বয়ং তার বিপরীত উপাদানের অধিকারী এবং এ দু পরস্পর বিপরীত উপাদানের মধ্যে এক প্রকার নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্ব বিরাজমান। এ দ্বন্দ্বের ফলেই পদার্থের বিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন যখন ডিমের খোলস ভেঙ্গে যায় তখন একটি মুরগীর বাচ্চা তা থেকে বের হয়ে আসে। আর এভাবেই পদার্থ সর্বদা পূর্ণতা লাভ করতে থাকে। কারণ পারস্পরিক বৈপরীত্যের দ্বন্দ্বের ফলে যে বৈপরিত্য (نقيض ) অর্জিত হয়েছে তা পরবর্তী দু বৈপরীত্যের একটি হিসাবে কাজ করে।

অতএব,আমরা বলতে পারি নব্য বস্তুবাদ এ পদ্ধতির দ্বারা বুঝাতে চায় যে,প্রতিটি পদার্থ স্বয়ং তার বিপরীতেরও ধারণকারী। সুতরাং নিম্নলিখিত যে কোন একটি অর্থ উদ্দিষ্ট হতে পারে :

১. তবে কি ডিম এবং মুরগীর বাচ্চা পরস্পর বিরোধী বস্তু এবং ডিমই কি মুরগীকে অর্জন করে ও প্রাণ নামক বিশেষ গুণকে এর মধ্যে অস্তিত্বে আনে? অর্থাৎ মৃত বস্তু জীবন ও অস্তিত্ব সৃষ্টি করে এবং প্রাণ ও জীবন দান করে। তাহলে তো তা দরিদ্র ও বিত্তহীন ব্যক্তির সম্পদহীন অবস্থায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করার মতোই যা  উল্লিখিত ভূমিকার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে।

২. অথবা এর অর্থ হলো ডিম বাচ্চাকে অস্তিত্বে আনে না,বরং তার অপ্রকাশিত অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। কারণ প্রতিটি বস্তুরই নিভৃতে তার বিপরীত বস্তুও বিদ্যমান। অর্থাৎ ডিম যে অবস্থায় ডিম সে অবস্থায় বাচ্চাও বটে। যেন সে ছবির মতো-এক দিক থেকে একরকম আবার অন্য দিক থেকে বিভিন্ন রকম।

তাহলে এটা পরিষ্কার যে,ডিম যে অবস্থায় ডিম আবার সে অবস্থায়ই যদি বাচ্চাও হয়,তবে পূর্ণতার জন্য কোন কার্য সম্পাদিত হয়নি (অর্থাৎ পূর্ণতা অর্জিত হয়নি)। কারণ যা এখন বিদ্যমান তা প্রথম থেকেই অস্তিত্ববান ছিল। যেমন কোন ব্যক্তি তার পকেট থেকে টাকা বের করল এবং তাতে অতিরিক্ত কোন টাকা সংযোজিত হয়নি। কারণ এ টাকা পূর্ব থেকেই তার পকেটে ছিল। যদি তাই হয়,তবে পূর্ণতার গতি (حركت تكاملي ) যা নতুন বস্তু সৃষ্টি করে,তার অর্থ কি?

অতএব,এর যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য আমাদেরকে বলতে হবে যে,ডিম,বাচ্চা বা মুরগী ছিল না,বরং সেটার জন্য যোগ্য ছিল-যা বাচ্চায় পরিণত হয়েছে। আর এভাবে ব্যাখ্যা করেই আমরা ডিমকে প্রস্তরখণ্ড থেকে পৃথক করতে পারি। কারণ প্রস্তরখণ্ড কখনই মুরগী হতে পারবে না। অপরদিকে মুরগীর ডিমের এ সম্ভাবনা আছে যে,উপযুক্ত পরিস্থিতি ও শর্ত সাপেক্ষে তা মুরগীর বাচ্চায় পরিবর্তিত হতে পারবে। সর্বোপরি কথা হলো সৃষ্টি ও সংগঠনের জন্য শুধু সম্ভাবনাই যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ যদি কখনও ডিম বাচ্চায় পরিণত হয়,তবে শুধু সম্ভাবনার ভিত্তিতে এ পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা যাবে না।

অপরদিকে বস্তুর এ রূপান্তর যদি অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ফল হয়,তবে উক্ত রূপান্তরকেও অবশ্যই এ অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ভিত্তেতে ব্যাখ্যা করা উচিত। মুরগীর ডিমের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য অবশ্য পানির অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ ডিমের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ফল হলো মুরগী,আর পানির অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ফল হলো গ্যাস। এ কল্পনার উপর ভিত্তি করে সহজেই বস্তুর শেষ রূপান্তর থেকে বস্তুর গাঠনিক একক (অর্থাৎ ইলেকট্রন,প্রোটন ও নিউট্রন) পর্যন্ত আলোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

প্রোটন একটি অসমস (ضد ),ইলেকট্রন অপর একটি অসমস ( ضد )। তাহলে নিউট্রন কি? প্রতিটি বস্তুই কি এ অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ভিত্তিতে একটি বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে? অর্থাৎ প্রোটন বস্তুর অভ্যন্তরে বিদ্যমান এবং পরবর্তীতে গতি ও পারস্পরিক সংস্পর্শের ফলে কি মুরগী ও ডিমের মতো  প্রকাশিত রূপ লাভ করে?

যদি তাই হয়,তবে বস্তুর রূপান্তরকে কিরূপে ব্যাখ্যা করতে পারি? কারণ অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের যুক্তি অনুসারে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে,বস্তসমূহ অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ক্ষেত্রে পরস্পর পৃথক। অর্থাৎ বস্তুসমূহের অভ্যন্তরীণ মৌলিক সত্তা পরস্পর ভিন্ন। কিন্তু অধুনা বিজ্ঞান বস্তুর মৌলিক সত্তাগত অভিন্নতায় বিশ্বাসী। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় বস্তুসমূহের অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহ বা মৌলিক সত্তাসমূহ অভিন্ন এবং তারা যে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে তা তাদের এ অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহের (যারা সর্বদা এক ও অভিন্ন) ভিত্তিতে হতে পারে না।

তবে  প্রোটন নিউট্রনে বা নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ বস্তুর বাহ্যিক রূপ (পরমাণু ও মৌলিক সত্তাগত অভিন্নতা বিবেচনা না করলে) পরিবতির্ত হতে পারে। কিন্তু বস্তুর অভ্যন্তরীণ মৌলিক সত্তা সর্বদা একই থাকে যদিও তাদের রূপসমূহ বিভিন্ন। অতএব,কিরূপে এ ধারণা করা যায় যে,অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য ও বস্তুর অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহের পার্থক্যের কারণে বস্তুসমূহ বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে?

মুরগী ও এর ডিমের উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে উপস্থাপন করা যায়। বিভিন্ন ডিম বিভিন্ন বাচ্চায় পরিণত হয়। তাহলে বস্তুসমূহের বিভিন্ন রূপের কারণ হলো তাদের অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্য -এ ধারণার উপর ভিত্তি করে বলতে হয় যে,এ ডিমগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ গঠনেও পরস্পর বিভিন্ন ধরনের। অতএব,মুরগীর ডিম এবং অন্য কোন পাখির ডিম দু টি ভিন্ন বাচ্চা অর্থাৎ মুরগী এবং অন্য পাখিতে পরিণত হয়। কিন্তু যদি উভয়েই একই প্রকারের অর্থাৎ মুরগীর ডিম হয়,তবে বলা যাবে না যে,ডিম দু টির অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের কারণেই দু টি ভিন্ন রূপে পরিণত হয়েছে।

অতএব,দেখা যায় যে, বস্তুরূপের বৈসাদৃশ্য,অভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের কারণ -নব্য বস্তুবাদের এ ব্যাখ্যা এবং অধুনা বিজ্ঞানের বস্তুর অভ্যন্তরীণ মৌলিক সত্তার অভিন্নতায় যে বিশ্বাস তা দু টি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়।

৩. অথবা এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভবত বুঝানো হয়েছে যে,স্বয়ং মুরগীর ডিম দু টি অসমস বা দুটি স্বাধীন বিপরীত সত্তার ধারক যেখানে প্রতিটিই একটি বিশেষ অস্তিত্বের অধিকারী।

তাদের একটি হলো : জীবন একক (نطفه ) যার কারণ স্বয়ং মুরগীর ডিমের অভ্যন্তরে রূপ লাভ করে এবং অপরটি হলো : যা মুরগীর ডিমের অন্যান্য উপাদানে সমন্বিত। এ দু টি অসমস ডিমের অভ্যন্তরে সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়,যার ফলে তাদের একটি অপরটি অপেক্ষা অধিকতর প্রকাশ লাভ করে অর্থাৎ জীবন একক (نطفه ) জয়ী হয় এবং ডিম মুরগীর বাচ্চা আকারে প্রকাশিত হয়। অসমসদের (اضداد ) মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব সর্বদা মানুষের জীবনে বিদ্যমান ছিল এবং দার্শনিক চিন্তায় তো বটেই,এমনকি মানুষের দৈনন্দিন চিন্তায়ও তা  আদিকাল থেকে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু কেন ডিমের অভ্যন্তরস্থ জীবন একক ও ডিমের প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে বিদ্যমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে পারস্পরিক বৈপরীত্য (تناقض ) নামকরণ করব? কেন বীজ,মাটি ও বাতাসের মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে পারস্পরিক বৈপরীত্য বলব? এবং কেনইবা মাতৃগর্ভে ভ্রুণ এবং তা যে সকল খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে তাদের মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে পারস্পরিক বৈপরীত্য নামকরণ করব? প্রকৃতপক্ষে এগুলো নিছক নামকরণ ছাড়া আর কিছুই না এবং এটাই বলা শ্রেয় যে,তাদের (অসমসদ্বয়) একটি অপরটিতে বিগলিত হয় বা অপরটির সাথে একীভূত হয়।

ধরা যাক,একে আমরা পারস্পরিক বৈপরীত্য নামকরণ করব। অতএব,যদবধি আমরা বলব যে,দু টি অসমসের মধ্যে বিশেষ দ্বন্দ্বই বিকশিত নূতন বস্তুর আবির্ভাবের কারণ যা পূর্বের  অসমসদ্বয়ের উপাদনাসমূহের সমষ্টি অপেক্ষা বেশি,তদবধি এটা দ্বারা আমাদের সমস্যা দূরীভূত হয় না। কারণ এ বেশি অংশ কোথা থেকে এসেছে? দু টি অসমসের (যাদের প্রতিটিই তৃতীয় কোন বিষয়ের ঘাটতিযুক্ত) পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফলেই কি এ বেশি অংশটুকু উদ্ভাবিত হয়েছে? এ ব্যাখ্যা পূর্বোল্লিখিত বিষয়ত্রয়ের দ্বিতীয়টির (নিম্ন পর্যায়ের বস্তু উচ্চ পর্যায়ের বস্তুর কারণ হতে পারে না) ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অসমস এবং দু টি অসমসের মধ্যকার সংঘর্ষই প্রকৃত বিকাশ ও বিবর্তনের কারণ-এ ধরনের কোন উদাহরণ কি আমরা প্রকৃতিতে পেতে পারি? কিরূপে এক অসমস পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মাধ্যমে নিজের বিপরীতের বিকাশ ও বিবর্তনে সাহায্য করতে পারে যেখানে অসমতা বা দ্বন্দ্বের অর্থ হলো প্রতিরোধ বা কোন কিছু গ্রহণে আপত্তি এবং প্রতিটি প্রতিরোধই আপন শক্তির বিপরীতকে পরাজিত করতে বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ বিপরীতের বিকাশ ও পূর্ণতার বিরোধী?

আমরা সকলেই জানি যে,সাঁতারু যখন সমুদ্রতরঙ্গের সম্মুখীন হয় তখন সমুদ্রতরঙ্গ তাকে সম্মুখে এগুতে বাধাগ্রস্ত করে এবং সাঁতারুকে গতিশীল করার পরিবর্তে তার অগ্রসর হওয়ার শক্তিকে হরণ করে। যদি অসমসদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ (যে কোন অর্থেই হোক না কেন) ডিমের  বিকাশ এবং এর মুরগীতে বিবর্তিত হওয়ার মূলে বিদ্যমান থাকে,তবে যে বিকাশ অসমসমূহের  দ্বন্দ্বের ফলে পানিকে গ্যাসে পরিণত করে বা গ্যাস পানিতে পরিণত হয়,তা কোথায়?

প্রকৃতি আমাদেরকে ঐ সকল অসমসের সাথে পরিচয় করায় যাদের মধ্যকার সংঘর্ষ,এমনকি সম্পৃক্তি,বিবর্তন ও বিকাশের কারণ তো নয়ই,বরং বিনাশ ও ধ্বংসের কারণ হয়। ধনাত্মক প্রোটন পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং ঋণাত্মক ইলেকট্রন উক্ত নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে পরিক্রমণ করে। যদি এ দু টি বিপরীতধর্মী সত্তা পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়,তবে পরমাণু ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং ফলশ্রুতিতে উক্ত পদার্থ প্রকাশিত অবস্থা থেকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে।

মোটকথা পদার্থ (এর বহির্ভূত) কোন বাহ্যিক সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া প্রকৃত বিকাশ ও পূর্ণতা লাভ করতে এবং উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। বিশেষ করে,পদার্থ কখনই স্বয়ং পূর্ণতা প্রাপ্তির মাধ্যমে জীবন,অনুভূতি ও অনুধাবনের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না যদি না মহান আল্লাহ পদার্থকে এ সকল বিশেষত্ব অর্জনে সাহায্য করে। বিকাশ ও বিবর্তনের কার্যক্রমে পদার্থের ভূমিকা শুধুমাত্র জীবন,অনুভূতি ও উপলব্ধির বিশেষত্বকে গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ততা অর্জন ব্যতীত আর কিছুই নয়। যেমন কোন শিশু তার শিক্ষকের কাছে জ্ঞান নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।

অতএব,বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহ অতীব বরকতময়।

মহান আল্লাহর গুণসমূহ

এখন যেহেতু প্রজ্ঞা ও কৌশল অনুযায়ী সৃষ্টিকারী,প্রতিপালনকারী এবং জগতের শৃঙ্খলা বিধানকারী হিসাবে মহান আল্লাহর প্রতি আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি স্বভাবতঃই তাঁর সৃষ্টি ও সৃষ্টের মাধ্যমে তাঁর গুণাবলীর সাথেও আমরা পরিচিত হব এবং এ সৃষ্টসমূহের সাহায্যে তাঁর গুণাবলীকে পর্যালোচনা করব। যেমনি করে আমরা একজন প্রকৌশলীকে তাঁর তৈরিকৃত ইমারতের বৈশিষ্ট্য অনুসারে কিংবা একজন লেখককে তাঁর লিখিত বইয়ের বিষয়বস্তু অনুসারে অথবা একজন শিক্ষককে তাঁর শিক্ষার্থীদের গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সঠিকভাবে চিনতে পারি।

এরূপে আমরা মহান স্রষ্টার কতিপয় গুণ,যেমন তাঁর জ্ঞান,প্রজ্ঞা,জীবন,ক্ষমতা,দর্শন ও শ্রবণ সম্পর্কে অবগত হতে পারব। কারণ এ সৃষ্টিজগৎ সুনিপুণতা ও সূক্ষ্ম কার্যে পরিপূর্ণ (যার জন্য গভীর মনোযোগের প্রয়োজন),যা আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাক্ষ্য প্রদান করে এবং এ সুনিপুণ বিন্যাস ব্যবস্থার গভীরে এমন সব শক্তির অস্তিত্ব রয়েছে যারা তাঁর ক্ষমতা ও আধিপত্যকে প্রদর্শন করে। এছাড়া বিচিত্র রূপ,বর্ণ ও বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপলব্ধিও বিদ্যমান যা মহান আল্লাহর জীবন ও উপলব্ধিকে বর্ণনা করে। জগতের এ বিন্যাস ব্যবস্থায় বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে এক বিশেষ সমন্বয় ও সুসংগতি প্রতিষ্ঠিত যা সৃষ্টিকর্তার একত্বের প্রমাণ বহন করে। আর সে সাথে প্রমাণ করে তাঁর জ্ঞানের একত্বকেও যা থেকে এ মহাজগৎ সৃষ্ট ও সিদ্ধি লাভ করেছে।

ন্যায়পরায়ণতা (عدل )ও দৃঢ়তা (استقامت ) :

আমরা প্রত্যেকেই (ফেতরাতগত ও তাৎক্ষণিকভাবে) আমাদের জীবন ব্যবস্থায় এক শ্রেণির সাধারণ মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এ মূল্যবোধ গুরুত্বারোপ করে যে,ন্যায়পরায়ণতা সত্য ও কল্যাণকর;জুলুম বা অত্যাচার মিথ্যা ও অকল্যাণকর। ন্যায়পরায়ণ পৃথিবীতে সম্মান ও পরকালে পুরস্কারের উপযুক্ত। আর অত্যাচারী ও সীমা লঙ্ঘনকারী পৃথিবীতে নিন্দিত ও আখেরাতে শাস্তির যোগ্য। এ মূল্যবোধসমূহ স্বভাবজাত ও ফেতরাতগতভাবেই মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা প্রদানের মূল,তবে যখন অজ্ঞতা ও সুবিধাবাদীতার মতো কোন প্রতিকূলতা না থাকে। অতএব,যদি কোন মানুষ সত্য ও মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে অথবা বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকে এবং যখন ব্যক্তিগত কোন বাধা ও কোন বিশেষ উদ্দেশ্য তাকে এ মূল্যবোধসমূহ থেকে বিচ্যুতিতে বাধ্য না করে,তবে সে সত্যকে মিথ্যা এবং বিশ্বস্ততাকে বিশ্বাসঘাতকতার উপর প্রাধান্য দেয়। অর্থাৎ যে এমন কারো উপর নির্ভরশীল নয়,যে তাকে এ সকল মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য করতে পারে অথবা কোন বিশেষ উদ্দেশ্য যাকে বিশ্বাসঘাতকতা ও অত্যাচারের পথে পরিচালিত না করতে পারে,সে ব্যক্তির সাথে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির মতো আচরণ করাই যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ ঠিক সেরকম আচরণ যা মহান আল্লাহর জন্যই সঠিক এবং তিনিও ঐ ধরনের ব্যক্তির সাথে এরূপ আচরণই করে থাকেন। এ সমস্ত মূল্যবোধ মহান আল্লাহরই আওতাধীন এবং আমরা যা ফেতরাতগত জ্ঞানের দ্বারা অনুধাবন করতে পারি। কারণ মহান আল্লাহই আমাদেরকে এ জ্ঞান দান করেছেন এবং ঐ অবস্থায় মহান প্রভু তাঁর মহাপরাক্রম ও জগতের সর্বত্রব্যাপী বিরাজমান শক্তি ও আধিপত্য এবং সকল পূর্ণতাব্যঞ্জক গুণের অধিকারী হওয়ার কারণে কোন  কিছু থেকে লাভবান হওয়ার মুখাপেক্ষী নন। এখানেই আমরা বিশ্বাস স্থাপন করব যে,মহান আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ এবং তিনি কাউকেই অত্যাচার করার অনুমতি প্রদান করেন না।

মহান আল্লাহর ন্যায়পরায়ণতা প্রতিদানের প্রমাণবহ :

ইতোপূর্বে আমরা জেনেছি যে,যে সকল মূল্যবোধে আমরা বিশ্বাসী সে সকল মূল্যবোধ আমাদেরকে ন্যায়পরায়ণতা,দৃঢ়তা,বিশ্বস্ততা,সততা,প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ও অন্যান্য সৎ গুণের দিকে আকৃষ্ট করে এবং ঐগুলোর বিরোধী কোন বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব থেকে আমাদেরকে দূরে রাখে। এ মূল্যবোধসমূহ শুধু আমাদেরকে কিছু  গুণের প্রতি আকৃষ্ট বা কিছু গুণের প্রতি বিকর্ষিতই করে না,বরং এগুলোর বিনিময়ে যথোপোযুক্ত প্রতিদানও যাঞ্ছা করে থাকে। ফেতরাতগত জ্ঞান নিরপেক্ষভাবেই অনুধাবন করে যে,অত্যাচারী ও বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি পাওয়া উচিত এবং ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বাসী,যে ন্যায়,বিশ্বাস ও সততার পথে নিজেকে উৎসর্গ করে তার পুরস্কৃত হওয়া উচিত। অবশ্য আমাদের প্রত্যেকেরই অস্তিত্বের গভীরে এমন একটি অবস্থা বিরাজমান যা অত্যাচারী সীমা লঙ্ঘনকারীকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন করে;আর ন্যায়পরায়ণ ও সৎ কর্মপরায়ণকে উৎসাহ ও স্বীকৃতি দান করে। এরূপ প্রতিক্রিয়ার অনুপস্থিতির কারণ,হয় কোন ব্যক্তির সঠিক অবস্থান গ্রহণে অক্ষমতা অথবা তার ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত থাকার বহিঃপ্রকাশ।

যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিশ্বাস করব যে,মহান আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ এবং যথাযথ প্রতিদান প্রদানে মহাপরাক্রমশালী;কোন কিছুই ঐ সকল মূল্যবোধের জন্য প্রতিশ্রুত প্রতিদান প্রদানে তাঁকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না এবং তিনি সৎ কর্মপরায়ণ ও দুষ্কর্ম পরায়ণের প্রত্যেককেই তাদের সঠিক প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে অতীব শক্তিধর,ততক্ষণ পর্যন্ত স্বভাবতঃই আমরা বিশ্বাস করব যে,মহান আল্লাহ পুণ্যবানকে তাঁর পুণ্য অনুসারে পুরস্কৃত করেন;আর অত্যাচারিতের প্রাপ্য অত্যাচারীর নিকট থেকে আদায় করেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে,এ প্রতিদানগুলোর অধিকাংশই মহান আল্লাহর আওতাধীন হওয়া সত্ত্বেও এ পৃথিবীতে কার্যকর হয় না।

অতএব,আমাদের পূর্বোল্লিখিত আলোচনার প্রেক্ষাপটে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে,প্রতিদানের জন্য এক আসন্ন দিবসের অস্তিত্ব রয়েছে-যেদিন কোন এক অখ্যাত ব্যক্তি,যে নিজেকে এক মহান উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেছিলেন,কিন্তু তাঁর এ ত্যাগের ফল পার্থিব জীবনে আহরণ করতে পারেননি এবং যে অত্যাচারী তার শাস্তি প্রাপ্তি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল,শত অত্যাচারিতের রক্তের উপর দিয়ে আপন পথ রচনা করেছিল,হরণকৃত সম্পদের বিনিময়ে সুখের নীড় গড়েছিল-তাদের প্রত্যেকেই ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠে যথাযথ প্রতিদান লাভ করবে। আর এ আসন্ন দিবসটিই হলো কিয়ামত বা পরকাল। সেদিন এ মূল্যবোধসমূহের প্রতিটিই মূর্তরূপে প্রতীয়মান হবে এবং এমন একটি দিবস ব্যতীত প্রাগুক্ত মূল্যবোধসমূহই অর্থহীন।

প্রেরিত

(রাসূল)

v নবুওয়াতের সাধারণ আলোচনা

v বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত

আল্লাহর  প্রতি  বিশ্বাস

সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আসছে। এমনকি দার্শনিক চিন্তা অথবা যুক্তিতত্ত্বকে অনুধাবনের পূর্বেই সে একক প্রভুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। সে স্বীকার করে নিয়েছিল তার সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব। আর তখন থেকেই সে অনুভব করত মহান প্রভুর সাথে তার এক গভীর সম্পর্কের কথা।

প্রভুর প্রতি মানুষের এ বিশ্বাস কোন শ্রেণিবৈষম্যের ফল ছিল না,ছিল না কোন সুবিধাবাদী জালিমের চাতুর্যের ফলও-শোষণের পথকে সুগম করাই যার অভিপ্রায়। তার এ বিশ্বাস না ছিল কোন নিপীড়িত,নিগৃহীত জনপদের জীবনাবসাদের ফলশ্রুতিও যে,এ বিশ্বাস স্থাপন করে তারা কষ্টাক্লিষ্ট জীবন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। কারণ মানুষের এ বিশ্বাস (স্রষ্টায় বিশ্বাস) বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এ ধরনের যে কোন বৈষম্য ও সংঘাতের চেয়েও প্রাচীন।

অনুরূপভাবে যুগ যুগ ধরে মানুষের এ লালিত বিশ্বাস কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বস্তুজগৎ ও প্রকৃতিজগতের বৈরিতা থেকে উৎসারিত ভয়-ভীতির ফলও ছিল না। কারণ দ্বীন যদি ভয়-ভীতির ফল হতো,তবে মানবতার দীর্ঘ ইতিহাসে অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষই-তা যে কোন ধর্মীয় মতাদর্শেরই হোক-সবচেয়ে ভীতু মানুষ  হিসাবে পরিগণিত হতো। কিন্তু আমরা জানি যে,যুগ যুগ ধরে যারা ধর্মের আলোকবর্তিকা ধারণ করে সম্মুখপানে এগিয়ে গিয়েছিলেন,তারাই সর্বাপেক্ষা দৃঢ় মনোবল ও মানসিক শক্তির অধিকারী মানুষ  হিসাবে পরিচিত ছিল।

অতএব,মানুষের এ বিশ্বাস তার অন্তরের গভীরে প্রোথিত।

স্রষ্টার প্রতি তার ভালোবাসা,অনুরাগ এবং অবিচলিত  বিবেকবোধও আত্মশক্তিরই পরিচায়ক। তার সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে  সে মহান প্রভু ও বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সাথে তার নিজ সম্পর্ককে অনুধাবন  করে।পরবর্তীকালে মানুষের মাঝে দার্শনিক মনোবৃত্তির বিকাশ হলে তার পারিপার্শ্বিক জগতের বস্তুসমূহ থেকে সে সামগ্রিক ধারাণাসমূহ,যেমন অনিবার্যতা,সম্ভাব্যতা ও অসম্ভবত্ব,একত্ব ও বহুত্ব,যৌগিকত্ব ও সরলত্ব,অংশ ও সমগ্র,অগ্রবর্তিতা ও উত্তরবর্তিতা এবং কারণ ও ফলাফল আবিষ্কার করেছিল। এ ধারণাগুলোকে সে তার নিজস্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে এমনভাবে কাজে লাগিয়েছিল যা প্রভুর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস ও ঈমানের সমর্থক ও সহায়ক হয়েছে। আর এভাবে সে এ ঈমানকে দর্শনের মাধ্যমে বর্ণনা এবং দার্শনিক আলোচনা ও পর্যালোচনার বিভিন্ন পদ্ধতির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেছিল ।

ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ আসল। অতঃপর মানুষ এগুলোকে জ্ঞানার্জন ও পরিচিতি লাভের ক্ষেত্রে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করল। কারণ চিন্তাবিদগণ উপলব্ধি করলেন যে,শুধু সামগ্রিক ধারণাই প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে সত্য,প্রকৃত নিয়ম-শৃঙ্খলা ও বিদ্যমান রহস্যসমূহ উদ্ঘাটনের জন্য যথেষ্ট নয়। সুতরাং তাঁরা ধারণা করলেন যে,পরীক্ষা-নিরীক্ষা,পর্যবেক্ষণ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানই হলো বিদ্যমান নিয়ম-শৃঙ্খলা ও রহস্য উদ্ঘাটনের প্রকৃত মাধ্যম। এ ইন্দ্রিয়ানুভূতি সামগ্রিকভাবে বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও অবগতির পূর্ণতা এবং বিস্তৃতির পথে গুরুত্বপূর্ণ।

এ শ্রেণির চিন্তাবিদগণ এ বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। তাঁরা মনে করতেন যে,ইন্দ্রিয়ানুভূতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো জ্ঞানার্জনের পথে দু টি বিশেষ মাধ্যম।

মানুষের  জ্ঞান এবং পরিচিতি স্বীয় পথে এগুলোর দিকে হাত বাড়াতে বাধ্য। তদুপরি মানুষ এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রয়োগ করে,তার পরিপার্শ্বে বিদ্যমান সামগ্রিক বিন্যাস ব্যবস্থা,বাস্তবতা ও রহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে লাভবান হতে চায়। মানুষের উচিত তার  চিন্তালব্ধ ফলাফলকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ করা। যেমন গ্রীক চিন্তাবিদ এরিস্টটল ঘরের এক কোণে বসে মুক্তাঙ্গনে বস্তুর গতি এবং গতিশক্তি সম্পর্কে চিন্তা করার পর বিশ্বাস স্থাপন করলেন যে,গতিশীল বস্তু তখনই স্থিরাবস্থায় পৌঁছে যখন গতিশক্তি লীন হয়ে যায়। অপরদিকে গ্যালিলিও,গতিশীল বস্তুকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং এ পর্যবেক্ষণকে পুনঃপুন অনুধাবন করলেন। অতঃপর গতিশক্তি এবং বস্তুর গতির মধ্যে একটি সম্পর্ক উদ্ভাবন করলেন যে, যখন গতিশক্তি কোন বস্তুকে গতিশীল অবস্থায় আনে,ঐ গতিশীল বস্তু স্থিরাবস্থায় আসবে না,যতক্ষণ পর্যন্ত না বিপরীত কোন শক্তি গতিশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং তাকে বাধাগ্রস্ত করে।

ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি গবেষকমণ্ডলীকে এবং মহাবিশ্বের পদার্থসমূহের যাবতীয় বস্তুনিচয়ের (বিদ্যমান) নিয়মগুলো আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করে। আর তা দু টি পর্যায়ে বা ধাপে অর্জিত হয় :

১। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতা,পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রাপ্ত ফলাফল গ্রহণ।

২। বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যায় অর্থাৎ প্রাপ্ত ফলাফলগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ ও বিন্যাসকরণ যাতে করে গ্রহণযোগ্য সামগ্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

অতএব,পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ইন্দ্রিয়ানুভূতি কোন তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার  পথে  বুদ্ধিবৃত্তির কাছে অনির্ভরশীল নয়।

কোন প্রকৃতিবিজ্ঞানী বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্য ব্যতীত শুধু ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মহাবিশ্বে বিদ্যমান রহস্যসমূহ থেকে কোন রহস্যের উদ্ঘাটন অথবা প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতির সম্পর্ক অবধারণ করতে পারেননি। কারণ প্রথম ধাপে যা অর্জিত হয় তা হলো গভীর পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ। আর দ্বিতীয় ধাপে আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি,এ পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত ফলাফলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিরূপণ করে এবং এর মাধ্যমে তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছে। এমন কোন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনার কথা আমাদের জানা নেই যা দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তি ও বোধশক্তির সাহায্য ব্যতিরেকে অর্জিত হয়েছে। কারণ প্রথম ধাপের বিষয়গুলো হলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত এবং দ্বিতীয় ধাপের বিষয়গুলো হলো প্রামাণ্য ও বিবেচ্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত যা (এ ধাপে) ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। যেমন নিউটন দু টি বস্তুর মধ্যে বিদ্যমান আকর্ষণ বলকে শুধু ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে অনুভব করেননি যে, এ আকর্ষণ বল ঐ দু টি বস্তুর কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দূরত্বের  বর্গের ব্যস্তানুপাতিক এবং ঐ বস্তুদ্বয়ের ভরদ্বয়ের গুণফলের সমানুপাতিক। বরং যা তিনি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জেনেছেন তা ছিল এই যে,প্রস্তরখণ্ডকে যদি উপরের দিকে নিক্ষেপ করা হয়,তবে তা ভূমিতে ফিরে আসে;চন্দ্র পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং গ্রহসমূহ সূর্যের চারিদিকে ঘূর্ণনরত। নিউটন তাঁর এ পর্যবেক্ষণগুলোকে পরস্পর বিশ্লেষণ করলেন এবং গবেষণা করলেন। সে সাথে তিনি আকষর্ণকারী বস্তু অভিমুখে গতিশীল আকর্ষিত বস্তুর গতি বৃদ্ধি পাওয়া সংক্রান্ত গ্যালিলিওর সূত্রটি এবং ভূপৃষ্ঠের উপর পতনশীল ও তীর্যক তলসমূহের উপর গড়িয়ে যাওয়া বস্তুসমূহের সুশৃঙ্খল দ্রুতি সংক্রান্ত গ্যালিলিওর তত্ত্বসমূহ এবং গ্রহসমূহের গতি সংক্রান্ত ক্যাপলারের সূত্রসমূহেরও সাহায্য নিলেন। ক্যাপলারের এক সূত্রে বলা হয়েছে  যে, সূর্যের চারিদিকে ঘূর্ণনরত প্রতিটি  গ্রহের পরিক্রমণ কালের বর্গফল,সূর্য ও উক্ত গ্রহের মধ্যকার দূরত্বের ঘনফলের সমানুপাতিক । অতঃপর নিউটন মহাকর্ষ সূত্র অবিষ্কার ও বর্ণনা করলেন যে,দু টি বস্তুকণার মধ্যে বিদ্যমান আকর্ষণ বল উক্ত বস্তুদ্বয়ের ভরদ্বয় এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের  গুণফলের সমানুপাতিক।

প্রাকৃতিক বিন্যাস ব্যবস্থার ব্যাপারে ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সৃষ্টিকর্তার প্রতি সুস্পষ্টরূপে বিশ্বাস স্থাপন করার ক্ষেত্রে একটি নতুন অবলম্বন হতে পারে। কারণ ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা মহাবিশ্বে যে বিভিন্ন ধরনের সামঞ্জস্য,ঐকতান,নিয়মানুবর্তিতা এবং প্রজ্ঞা ও কৌশলের নিদর্শনাদি আবিষ্কার করেছে তা প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী স্রষ্টার অস্তিত্বকে নির্দেশ করে। তবে প্রকৃতিবিজ্ঞানিগণ প্রকৃতিবিজ্ঞানী হিসাবে এ বিষয়টির গুরুত্ব প্রকাশ করার ব্যাপারে মোটেও ইচ্ছুক ছিলেন না যা এখনও মানব জ্ঞান ও পরিচিতি এবং এর সংশ্লিষ্ট বিষয় ও সমস্যাবলীর প্রচলিত শ্রেণিবিন্যাস অনুসারে একটি দার্শনিক বিষয় বলে গণ্য হচ্ছে। আর খুব শীঘ্রই বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ক্ষেত্রের বাইরে এমন সব দার্শনিক ও যুক্তিবিদ্যাগত ঝোঁক ও প্রবণতার উদ্ভব হলো যা এ ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে (ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি) দার্শনিক ও যৌক্তিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর প্রয়াস চালালো এবং ঘোষণা করল যে,পরিচিতি ও জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ই হলো একমাত্র মাধ্যম। যেখানেই ইন্দ্রিয় অপারগতা প্রকাশ করে সেখানেই মানব পরিচিতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভও অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় ও কোনভাবেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা যার উপর অসম্ভব,তা প্রমাণ করতে মানুষও সম্পূর্ণরূপে অপারগ।

আর এভাবেই ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রভুর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসকে অগ্রাহ্য করেছে। ইন্দ্রিয়বাদী দার্শনিক মতবাদের অনুসারীদের মতে খোদা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অস্তিত্ব নন,তাঁকে দেখাও অসম্ভব এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বকে অনুধাবন করা যায় না। সুতরাং তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণ করার এবং তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান লাভের কোন পথই বিদ্যমান নেই। অবশ্য এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে অনস্তিত্বশীল প্রমাণ করার জন্য ইন্দ্রিয়ানুভূতিলব্ধ জ্ঞান ও পরিচিতিকে মাধ্যমরূপে নির্ধারণ শুরু হয়েছে দার্শনিকদের পক্ষ থেকে-সে সকল মনীষীর পক্ষ থেকে নয় যাঁরা ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে এক বিশেষার্থে সফলতায় পৌঁছিয়েছেন। এটা দার্শনিকদেরই কাজ ছিল যাঁরা অভিজ্ঞতালব্ধ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানকে দর্শন ও অপযুক্তিরূপে ব্যাখ্যা করেছেন।

কিন্তু এ ধারা ও বিশ্বাস পর্যায়ক্রমে স্ববিরোধিতার জালে আটকা পড়েছে। দার্শনিক দিক থেকে এ বিশ্বাস ও ধারা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে,আমরা যে বিশ্বে বাস করি তার অস্তিত্বকেই অর্থাৎ বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতাকে আংশিক বা পূর্ণভাবে অস্বীকার করে বসেছিল। এ ধারার প্রবক্তারা বলেন, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ছাড়া আমাদের অধিকারে কোন অবলম্বন নেই এবং একমাত্র ইন্দ্রিয়ানুভূতিই কোন কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদেরকে অবহিত করে যেভাবে আমরা তা দেখি এবং উপলব্ধি করি ঠিক সেভাবে। কিন্তু  এ দেখা বা উপলব্ধি করা যথার্থ এবং মৌলিক নয়। কারণ কখনো কখনো কোন কিছুকে উপলব্ধি করি এবং সম্ভবত এর সত্তাকে আমাদের অনুভূতিতে গুরুত্বারোপ করি,কিন্তু লক্ষ্য করতে পারি যে,এর অস্তিত্ব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার আওতায় পড়ে না। অর্থাৎ তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। ফলে ইন্দ্রিয়ানুভূতিও ঐগুলোকে প্রমাণের মাধ্যম হতে পারে না। যেমন আমরা আকাশে চাঁদ দেখি এবং আমাদের এ চাঁদ দেখার মাধ্যমে এর অস্তিত্বের প্রতি কেবল গুরুত্বারোপ করতে পারি বৈ কি।

আর ঐ মুহূর্তে একে উপলব্ধিও করতে পারি। কিন্তু সত্যিই কি চাঁদ আকাশে বিদ্যমান? চোখ খোলা এবং এর প্রতি তাকানোর পূর্বেও কি তা বিদ্যমান ছিল?

অতএব,ইন্দ্রিয়ই জ্ঞান লাভের একমাত্র মাধ্যম-এ মতবাদের অনুসারিগণ পরিপূর্ণরূপে কোন কিছুকে প্রমাণ ও গুরুত্বারোপ করতে পারে না।

যেমন যার চোখ টেরা সে বস্তুকে দেখে এবং তার এই দেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করে,কিন্তু  ঐ বস্তুর সত্যিকারের অস্তিত্বের (অবস্থানের) প্রতি গুরুত্বারোপ বা বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না। আর এভাবেই ইন্দ্রিয়বাদী দার্শনিক মতবাদের অনুসারিগণ অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,ইন্দ্রিয় হলো জ্ঞান ও পরিচিতির অন্যতম মাধ্যম। আর তা জ্ঞান ও পরিচিতির মাধ্যম হওয়ার পরিবর্তে এর চূড়ান্ত সীমায় পর্যবসিত হয়েছে। এভাবেই ইন্দ্রিয়ানুভূতিলব্ধ জ্ঞান ও পরিচিতি এমন এক বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে,আমাদের উপলব্ধি  ও  মনোজগতের বাইরে যার স্বাধীন-স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই।

তাই উক্ত যুক্তিবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে যে বিষয়টি ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান -এর প্রবক্তারা উল্লেখ করেছেন তা হলো প্রতিটি বাক্য বা উদ্ধৃতিই-যার অন্তর্নিহিত অর্থকে ইন্দ্রিয়ভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করা যায় না ও তার উপর গুরুত্বারোপ সম্ভব হয় না,তবে  তা হলো অনর্থক বাক্য-কতগুলো এলোমেলো বর্ণমালার মতোই তা থেকেও কোন অর্থ লাভ করা সম্ভব নয়। আবার যে সকল বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থকে ঐন্দ্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্য বা মিথ্যা প্রমাণ করা যায় এবং যার উপর গুরুত্বারোপ করা সম্ভব তা হলো অর্থবোধক বাক্য। সুতরাং যদি ইন্দ্রিয় বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থকে প্রকৃত অবস্থা অনুসারে অনুধাবন করে ও গুরুত্বারোপ করে,তবে ঐ বাক্য সত্য হবে;আর যদি তার অন্যথা হয় তবে তা হবে মিথ্যা। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা হয় : বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় তবে এ বাক্যটি হলো একটি অর্থবোধক বাক্য এবং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও সত্য। যদি বলা হয় : শীতকালে বৃষ্টি হয় তবে তা একটি অর্থবোধক বাক্য বটে,কিন্তু তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো মিথ্যা। আবার  যদি বলা হয় : কদরের রাত্রে এমন কিছু বর্ষিত হয় যা দেখা ও অনুভব করা যায় না,তবে বাক্যটির অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য সত্য বা মিথ্যা  হওয়া তো  দূরের কথা,বরং এর কোন অর্থই নেই। কারণ ঐন্দ্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সত্যতা বা অসত্যতা যাচাই করা যায় না। অনুরূপ যদি কেউ বলে : দাইয কদরের রাত্রে অবতরণ করে ,তবে সত্যি কথা বলতে কি,এর যেমন কোন অর্থ নেই,তেমনি প্রাগুক্ত বাক্যটিরও অর্থ নেই। এভাবে যদি বলি, খোদা অস্তিত্বশীল তবে এটি উপরিউক্ত বাক্যে যে দাইয (অনর্থক শব্দ) অস্তিত্বশীল যার কোন অর্থ নেই,তার মতোই। কারণ খোদার অস্তিত্বকে ঐন্দ্রিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুধাবন করা যায় না। এ ধরনের ব্যাখ্যাও যা বাহ্যত যৌক্তিক,স্বয়ং পারস্পরিক বিরোধিতায় নিমজ্জিত। কারণ যে সর্বজনীন উক্তিতে বলা হয়েছে যে, যে সকল বাক্যের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে ঐন্দ্রিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সত্য বা মিথ্যারূপে আখ্যায়িত করা যায় না সে সকল বাক্য হলো অর্থহীন তা-ও স্বয়ং এ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের সত্যতা বা অসত্যতা ঐন্দ্রিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিরূপণ করা যায় না। অতএব,ঐ বাক্যটিও অর্থহীন। অর্থাৎ যে যৌক্তিক বাক্যের মাধ্যমে বলা হয় প্রতিটি বাক্যই-যার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ঐন্দ্রিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার  মাধ্যমে পাওয়া যায় না-তা অর্থহীন ,তা-ও ঐ সর্বজনীন উক্তির  আওতাভুক্ত। কারণ ঐন্দ্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আংশিক এবং সীমাবদ্ধতা ছাড়া সংঘটিত হয় না।

অতএব,এ যুক্তি পারস্পরিক বিরোধিতা সৃষ্টি করে। ফলে এটাকে আর সর্বজনীনতা দেয়া সম্ভব না এবং একটি সর্বজনীন ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গিও এ থেকে প্রতিভাত হয় না। এ যুক্তির ফলে সৃষ্টি সম্পর্কে মহান মনীষিগণ যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন তার সবগুলোই একাধারে ভুল পর্যবসিত হয়। কারণ ইন্দ্রিয় সর্বজনীনতা কে উপলব্ধি করতে পারে না;শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুই যা সীমাবদ্ধ তাকেই প্রমাণ ও উদ্ঘাটন করতে পারে।

সৌভাগ্যবশত বিজ্ঞান তার নিরন্তর ক্রমবিকাশের পথে কখনই এ ধরনের প্রবণতার প্রতি আকর্ষিত হয়নি। বিজ্ঞান সর্বদা এ বিশ্বচরাচরে প্রথমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আবিষ্কার ও গবেষণার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অতঃপর বিজ্ঞান এ আবিষ্কার প্রক্রিয়াকে ইন্দ্রিয়বাদী দার্শনিক ও যৌক্তিক প্রবণতাসমূহ যে সকল সংকীর্ণ সীমারেখা আরোপ করেছিল তা থেকে মুক্ত করেছে। এর ফলে বিজ্ঞান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রপঞ্চ ও বিষয়াদি বিন্যস্তকরণ,সেগুলোকে সর্বজনীন নিয়ম-নীতির অবয়বে স্থাপন এবং এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কসমূহকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।  

তবে বস্তুবাদী দার্শনিক মতবাদসমূহের উপর এ চরমপন্থি ইন্দ্রিয়বাদী প্রবণতাসমূহের দার্শনিক ও যৌক্তিক প্রভাব দিন দিন ক্ষীণ ও ম্লান হয়ে গিয়েছে । আধুনিক বস্তুবাদী দর্শন-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরা হচ্ছে যার প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী-তা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও স্পষ্টভাবে এ সকল ইন্দ্রিয়কেন্দ্রিক প্রবণতাসমূহকে প্রত্যাখ্যান করতঃ নিজেকে প্রথম ধাপ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাভিত্তিক অভিজ্ঞতার সীমা রেখা এবং এমনকি দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করার অধিকারও প্রদান করে। আর এখানে উল্লেখ্য যে,বিজ্ঞানীরা এ ইন্দ্রিয় ও ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাভিত্তিক অভিজ্ঞতার আলোকে তার গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড শুরু এবং প্রাগুক্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের মাধ্যমে তার ইতি টানেন। কারণ বিজ্ঞানী প্রথম ধাপে অর্জিত ফলাফলগুলোর মধ্যে তুলনা করে একটি সর্বজনীন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা  ও  মতবাদ আবিষ্কার করে এবং যে সকল সম্পর্ক এই  অর্জিত ফলাফলগুলোর মধ্যে কল্পনা বা ধারণা করা সম্ভব,তা প্রকাশ করে।

এদিক থেকে বস্তুবাদীদের উত্তরসূরি,দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীরা চরমপন্থী ইন্দ্রিয়বাদী এ ধারার মতে অদৃশ্য ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তারা দ্বান্দ্বিক চিন্তার কলেবরে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে একটি  সাধারণ মতবাদ ব্যক্ত করে থাকেন।

বস্তুবাদী এবং আধ্যাত্মবাদী (الهيون ) উভয়েই এ ব্যাপারে একমত যে,ইন্দ্রিয়ভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমানা অতিক্রম করা উচিত এবং জ্ঞান ও পরিচিতির ক্ষেত্রে দু টি  ধাপ অতিক্রম করাই গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত।

প্রথমধাপ : ইন্দ্রিয় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল  সংগ্রহকরণ।

দ্বিতীয়ধাপ : সংগৃহীত ফলাফলগুলোর তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা ও বিচার-বিশ্লেষণ।

বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা,বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করেই বস্তুবাদী এবং আধ্যাত্মবাদীদের মধ্যে মতভেদ;অর্থাৎ  দ্বিতীয় ধাপে। বস্তুবাদী দর্শন এমন ব্যাখ্যা প্রদান করে যার মাধ্যমে প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যাত হয়। অপরপক্ষে,অধ্যাত্মবাদী দর্শন বিশ্বাস করে যে,ঐ সকল (১ম ধাপে) সংগৃহীত  তথ্যের  বিচার ও বিশ্লেষণ যতক্ষণ পর্যন্ত প্রজ্ঞাবান স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা সন্তোষজনক হবে  না।

অতএব,প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে প্রমাণ করার নিমিত্তে নিম্নোল্লিখিত দু প্রকারে যুক্তি উপস্থাপন  করব। উভয় প্রকার যুক্তির  ক্ষেত্রেই প্রথম ধাপে ঐন্দ্রিয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা লব্ধ এবং দ্বিতীয় ধাপে বুদ্ধিবৃত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ হতে প্রাপ্ত উপাত্তগুলোকে ব্যবহার করব। অতঃপর এ উপসংহারে পৌঁছব যে,বিদ্যমান এ বিশ্বকে এক প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। দু প্রকারের যুক্তি হলো :

১. বৈজ্ঞানিক বা আরোহী যুক্তি পদ্ধতি( Inductive  Reasoning)

২. দার্শনিক যুক্তি পদ্ধতি( Philosophical Reasoning)

বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা শুরু করার পূর্বে বৈজ্ঞানিক  যুক্তি ও দলিল বলতে কী বুঝানো হয়েছে তা তুলে ধরা সমীচীন বলে মনে করছি।

যে সকল যুক্তি ঐন্দ্রিয়  পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সম্ভাবনা তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল আরোহ যুক্তি পদ্ধতিকে অনুসরণ করে কোন কিছুকে প্রমাণ করে তাকে বৈজ্ঞানিক যুক্তি বলে। অতএব,স্রষ্টার  সত্তাকে প্রমাণ করার জন্য আমাদের অনুসৃত পদ্ধতি হলো বৈজ্ঞানিক যুক্তি পদ্ধতি যা সম্ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত।

এজন্য খোদার সত্তাকে প্রমাণ করার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক  যুক্তিকে আমরা আরোহ যুক্তি রূপে নামকরণ করেছি।

পরবর্তীতে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।


3

4

5

6

7

8

9

10