ইসলামের রিসালাতের বৈশিষ্ট্যঃ
ইসলামের রিসালাত এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণেই অন্যান্য ঐশী রিসালাত হতে স্বতন্ত্র। কারণ তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক ঐকান্তিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছে এ সকল বৈশিষ্ট্যের কারণেই।
নিম্নে এ সকল বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলো :
১. এ রিসালাত কোরআনের অকাট্য ভাষ্যসম্বলিত,পবিত্র ও অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান এবং কোন প্রকার ত্রুটি,ভ্রম এতে প্রবেশ করতে পারেনি। অপরদিকে অন্যান্য ঐশী গ্রন্থ ক্রটি-বিচ্যুতিতে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল এবং আপন সত্য বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেন :
اِناَّ نَحْنُ نَزَّلنْاَ الْذِّكْرَ وَ اِناَّ لَهُ لَحاَفِظُونَ .
“
নিশ্চয় আমরাই এ কোরআন অবতীর্ণ করিয়াছি এবং আমরাই উহার রক্ষাকারী।
”
(সূরা হিজর : ৯)
যেহেতু ইসলামের রিসালাত তার বিশ্বাসগত ও বিধানগত বিষয়বস্তু থেকে বিস্মৃত হয়নি সেহেতু তা প্রশিক্ষণ ও (আধ্যাত্মিক) পরিচর্যার ক্ষেত্রে আপন ভূমিকাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। কারণ যে রিসালাত আপন বিষয়বস্তু থেকে ত্রুটি-বিচ্যুতির মাধ্যমে দূরে সরে যায় তা খোদার সাথে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের যোগ্যতা হারায়। কারণ এ সম্পর্ক শুধু নামকরণের সাথেই সম্পর্কযুক্ত নয়,বরং প্রকৃতপক্ষে রিসালাতের মূল বিষয়বস্তুর প্রতিফলন এবং চিন্তা পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে তার রূপদানের সাথেও সম্পর্কযুক্ত। এ দিক থেকে ইসলামের রিসালাতের সঠিকতা ও নির্ভুলতা কোরআনের বিষয়বস্তুর নির্ভুলতার সাথে সম্পর্কযুক্ত যাতে করে আপন উদ্দেশ্য ও মতবাদকে প্রতিপাদন করতে পারে।
২. কোরআনের রুহ (অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত) অবিকৃত থাকায় তা কোরআনের ঐশ্বরিকতা প্রমাণের জন্য উত্তম হাতিয়ার। কারণ কোরআন এবং তা হতে উদ্বৃত বিধানসমূহ ও রিসালাতের বিষয়বস্তু হলো পূর্বোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসারে মুহাম্মদ (সা.)-এর রিসালাত ও নবুওয়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত আরোহ যুক্তি। যদবধি কোরআন থাকবে তদোবধি এ দলিলও থাকবে,যা অন্যান্য নবুওয়াত ও রিসালাতের ব্যতিক্রম,যার প্রমাণ স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে কোন নির্দিষ্ট ঘটনা ও বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ছিল এবং যা ঐ নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই প্রযোজ্য ছিল। যেমন অন্ধকে আলো দান এবং কুষ্ঠ রোগীকে কুষ্ঠরোগ থেকে মুক্তিদান। কারণ এ ঘটনাগুলো শুধু সমসাময়িক কালের মানুষই উপলব্ধি ও অবলোকন করেছিল এবং সময় ও কালের ধারায় তা বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল,এমনকি স্বয়ং ঐ ঘটনাগুলোও হারিয়ে গিয়েছিল। আর এ কারণেই মানুষ এ সকল ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করতে এবং তার তাৎপর্যের গভীরে প্রবেশ করতে অপারগ। যে সকল নবুওয়াত ও রিসালাতের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা অসম্ভব মহান আল্লাহ সে সকল রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও ঐগুলোর সত্যতা প্রমাণের জন্য কোন দায়িত্ব মানুষের উপর অর্পণ করেননি। কারণ :
لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْساً اِلاّ مَا آتاَهاَ
“
মহান আল্লাহ মানুষের প্রতি কোন দায়িত্ব অর্পণ করেন নাই,একমাত্র তাহা ব্যতীত যাহা তাহার নিকট পৌঁছিয়াছে।”
কিন্তু এখন আমরা পূর্বের নবী-রাসূলগণের প্রতি এবং তাঁদের মু’
জেযার প্রতি কোরআনের তথ্য ও সংবাদ অনুসারে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।
৩. ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি যে,কালের প্রবাহে ইসলামের রিসালাতের মৌলিক যুক্তির তো কোন প্রকার ঘাটতি হয়ইনি,বরং তা মানব সভ্যতার বিবর্তন ও বিকাশের ধারায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে এ মৌলিক যুক্তিকে এক নবসংযোগ প্রদান করেছে। শুধু তা-ই নয়,কোরআন স্বয়ং এ সমস্ত বিষয়কেও ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং এ যুক্তিসমূহকে ও পার্থিব বিভিন্ন ঘটনাকে প্রজ্ঞাবান প্রভুর সাথে সম্পর্কিত করেছে এবং মানুষকে এ রহস্য সম্পর্কে অবগত করেছে। এমনকি মানুষ এমন অনেক বিষয় সম্পর্কে আজ জানতে পেরেছে যা শত শত বছর পূর্বেই এ কোরআনে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের একজন উম্মী ব্যক্তি কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আর তাই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আজনিয়ারী(اجنيري
)
নামক আরবী ভাষার এক অধ্যাপক বলেছিলেন:
“
প্রকৃতপক্ষে ফুল-ফলের পরাগায়ণে বাতাসের ভূমিকা সম্পর্কে উটের মালিকেরা (আরবরা) ইউরোপে এর আবিষ্কারের বহু পূর্বেই জানতে পেরেছিল।”
৪. এ রিসালাত জীবনের প্রতিটি স্তরের সাথে সমন্বিত। আর এর ভিত্তিতে জীবনের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে-একীভূত করেছে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একসূত্রে-সম্পর্ক স্থাপন করেছে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের মধ্যে।
৫. প্রকৃতপক্ষে রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমে আনয়নকৃত এ রিসালাতই একমাত্র ঐশী রিসালাত যা মানব জীবনে প্রয়োগ ক্ষেত্রে এক বিরাট সফলতা লাভ করেছে। সর্বোপরি,এ রিসালাত মানব জীবনের বিকাশের মাধ্যমে মানুষকে সত্যের পথে আহবান করেছে।
৬. এ রিসালাত তার প্রায়োগিক পর্যায়ে এসে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। কারণ এর ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে এক সমাজ যারা গ্রহণ করেছে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা। এ রিসালাত এক ঐশী রিসালাত যা পৃথিবীর জন্য প্রেরিত হয়েছে এবং যা সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। যার ফলশ্রুতিতে মানুষের এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে অদৃশ্য অজড় জগতের সাথে যা অলৌকিক ও ধারণাতীত।
আর এ ক্ষেত্রেই আমরা ভুল করি। আমরা শুধু বাহ্যিক ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই ইতিহাসকে বুঝতে চেষ্টা করি অথবা শুধু বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা ইতিহাসকে বিচার করি। যার ফলে এ
বস্তুগত বোধ মানুষের সাথে ঐশী বিষয়কে সম্পর্কিত করতে পারে না। অনুরূপ পারে না এ রিসালাতকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে। যেমন এ রিসালাত ঐশী হওয়ার সত্যতা অনুধাবন করতে বা এর ইতিহাস বুঝতে অপারগতা প্রকাশ করে।
৭. এ রিসালাত তার কার্যকারিতাকে শুধু এক বিশেষ সমাজের জন্য সীমাবদ্ধ করেনি,বরং অন্যান্য সমাজেও তার বিস্তৃতি রয়েছে। এর প্রভাব পরিব্যপ্ত করেছে সাড়া বিশ্বজগতকে-সকল যুগকে। এমনকি ইউরোপীয় মনীষীরাও এর প্রভাবের অধীন। যার ফলে অধুনা ইউরোপীয় মনীষিগণ স্বীকার করেছেন যে,ইসলাম তার যাত্রাপথে ঘুমন্ত ইউরোপকে জগ্রত করেছে এবং এক নব দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে।
৮. প্রকৃতপক্ষে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) যিনি এ রিসালাতের বাহক,পূর্ববর্তী সকল নবীর মতোই ঐশী সম্পর্কের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যে পদ্ধতিতে তিনি তাঁর রিসালাত বা ধর্মবাণী প্রচার করেছেন সে দিক থেকে এটা স্বতন্ত্র। এটা এ কারণে যে,তাঁর আনয়নকৃত রিসালাতই হচ্ছে সর্বশেষ রিসালাত। আর এ কারণেই তিনি ঘোষণা করেছেন যে,তিনিই সর্বশেষ নবী। নবুওয়াতের পরিসমাপ্তির পশ্চাতে দু’
টি তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত না-বোধক তাৎপর্য-যার মাধ্যমে অন্য কোন নবীর আবির্ভাবের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা হয়। দ্বিতীয়ত হ্যাঁ-বোধক তাৎপর্য-যার মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত এ নবুওয়াতের স্থায়িত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।
নবুওয়াতের সমাপ্তির না-বোধক তাৎপর্যের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে,ইসলামের প্রবর্তনের চৌদ্দ শত বছর অতিক্রান্ত হলেও এর তাৎপর্য বাস্তবের সাথে সঠিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যতদিন সময়ের গতি অব্যাহত থাকবে ইসলামের এ বৈশিষ্ট্যও অব্যাহত থাকবে। অর্থাৎ অন্য কোন নবুওয়াতের আবির্ভাব না ঘটলেও মানব সভ্যতায় মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের মৌলিক ভূমিকার কোন অপনোদন ঘটবে না। কারণ শেষ নবুওয়াত পূর্ববর্তী নবুওয়াতসমূহের প্রতিনিধিত্ব করেছে অর্থাৎ পূর্ববর্তী রিসালাতসমূহের সকল মূল্যবোধকে ধারণ করেছে এবং ক্ষণস্থায়ী ও অস্থায়ী মূল্যবোধসমূহকে দূরে রেখেছে। এভাবে এ রিসালাত তার গতিশীলতায় সকল প্রকার বিবর্তন ও বিকাশের ক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরী।
وَاَنْزَلْناَ اِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقاً لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتاَبِ وَمُهَيْمِناً عَلَيْهِ
“
আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করিয়াছি সত্যগ্রন্থ,
যাহা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং ঐগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী।
”
(সূরা ময়েদাহ্ : ৪৮)
৯. প্রভুর যে প্রজ্ঞার কারণে ইসলামের রিসালাতের সাথে সাথে নবুওয়াতের ধারার সমাপ্তি ঘটে সে প্রজ্ঞাই নবুওয়াতের ধারার সমাপ্তিতে উম্মতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য সৃষ্টিকর্তা কতৃর্ক কাউকে নির্বাচনেরও দাবি করে। আর এ প্রতিনিধিগণই হলেন বারো জন ইমাম,যাঁদের সংখ্যা প্রত্যক্ষ প্রমাণসহকারে সঠিক হাদীসসমূহে নবী (সা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যেগুলোর সত্যতা ও সঠিক হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানগণ ঐকমত্য পোষণ করেন।
এ ইমামগণের প্রথম হলেন আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)। তারপর ইমাম হাসান (আ.),তারপর ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তারপর তাঁর (হুসাইন) সন্তানগণের মধ্য থেকে নয়জন ইমাম। তাঁদের নাম যথাক্রমে আলী ইবনিল হুসাইন আস্ সাজ্জাদ (আ.),মুহাম্মদ ইবনে আলী আল বাকির (আ.),জাফর ইবনে মুহাম্মদ আস্ সাদিক (আ.),মূসা ইবনে জাফর আল কাযেম (আ.),আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.),মুহাম্মদ ইবনে আলী আল জাওয়াদ (আ.),আলী ইবনে মুহাম্মদ আল হাদী (আ.),হাসান ইবনে আলী আল আসকারী (আ.) এবং সর্বশেষে মুহাম্মদ ইবনিল হাসান আল মাহ্দী (আ.)।
১০. সর্বশেষ ইমামের অনুপস্থিতিতে (গাইবাত) ইসলাম ফকীহ্গণের হাতে মানুষের দায়িত্ব অর্পণ করেছে এবং ইজতিহাদের (অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহ্ থেকে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ উদ্ধৃত করার জন্য গভীর অনুসন্ধান করা) দ্বারকে খুলে দিয়েছে।