ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন

লেখক: আলী আসগার রেজওয়ানী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব
লেখক: আলী আসগার রেজওয়ানী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে বিদআতে হাসানাহ ও বিদআতে কাবিহ
পূর্ববর্তী আলোচনা হতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদআত নিন্দনীয় (অপছন্দনীয়) একটি বিষয় এবং তা শরীয়তের বিধান মতে হারামের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বিদআতকে হাসান (পছন্দনীয়) ও কাবিহ (অপছন্দনীয়) এ দু’ ভাগে ভাগ করা সঠিক নয়। কিন্তু আহলে সুন্নাতের আলেমদের মতে বিদআত‘ হাসান’ ও‘ কাবিহ’ এ দু’ ভাগে বিভক্ত।২৪
বিদআতকে বৈধ ও অবৈধ অর্থাৎ পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় এরূপ বিভাজনের কোন বৈধতা নেই। কারণ বিদআত হলো এমন বিষয় যার কোন শরীয়তগত ভিত্তি নেই অর্থাৎ এমন কোন বিধান সৃষ্টি করা যার উৎস কোরআন ও সুন্নাতে খুঁজে পাওয়া যায় না,তা-ই বিদআত। তাই এরূপ বিধান নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় ও হারাম বলে গণ্য।
কোন বিষয় বা কর্মে মোবাহের কর্মগত বিধান
(যে ক্ষেত্রে শরীয়ত কোন বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করে নি সেক্ষেত্রে ঐ বিষয়টি বৈধ হওয়ার সার্বিত নীতি)
উসূলশাস্ত্রের পণ্ডিতগণ বলে থাকেন,‘ কোন বিষয় বা কর্মের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো বৈধতার নীতি অর্থাৎ যদি কোন বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে বৈধতার অথবা স্বাধীনতার সর্বজনীন নীতি কার্যকর হবে। যাকে উসূলশাস্ত্রের পরিভাষায় আসালাতুল হিল্লিয়াত (বৈধতার সর্বজনীন নীতি) অথবা আসালাতুল জাওয়ায বলা হয়। স্বাধীনতার সর্বজনীন নীতি (আসালাতুল বারায়াত) হতেও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এ নীতি মতে যে বিষয়ে শরীয়তের প্রবর্তক করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়কে বর্ণনা করেন নি সে বিষয়টি শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ বলে গণ্য অর্থাৎ সেক্ষেত্রে শরীয়তের অনুসারীদের স্বাধীনতা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন :
( قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّـهِ )
“ আপনি বলে দিন ; যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্য যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস-এটা অপবিত্র ও অবৈধ-অথবা যবেহ করা জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয় সে কারণে। ” ২৫
ড. ইউসুফ কারদ্বাভী বলেছেন,‘ ইসলাম সর্বপ্রথম যে নীতি প্রবর্তন করেছে তা হলো সকল বস্তু ও কল্যাণকর বিষয়ের ক্ষেত্রে বৈধতার সর্বজনীন নীতি এবং যে বিষয়গুলো শরীয়তের প্রবর্তক সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেন নি,তার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা হতে মুক্তির নীতি।’ ২৬
রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসৃত নীতিও সুন্নাত বলে গণ্য এবং তা শরীয়তের নীতি নির্ধারক।
এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলোকে ওয়াহাবীরা এজন্য বিদআত বলে থাকে যে,তারা রাসূলের আহলে বাইতের সুন্নাতকে শরীয়তের জন্য নীতি নির্ধারক ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। অথচ সহীহ হাদীসসমূহে তাদের অনুসৃত কর্ম ও নীতিও শরীয়তের নির্ধারক ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ঘোষিত হয়েছে। এখানে আমরা এরূপ কয়েকটি দলিলে প্রতি ইশারা করছি।
১। আয়াতে তাত্বহীর
মহান আল্লাহ বলেছেন :
( إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا )
“ নিশ্চয় আল্লাহ চান হে ( নবীর) আহলে বাইত! তোমাদের হতে সকল অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র করতে। ” ২৭
সহীহ মুসলিম হযরত আয়েশা সূত্রে বর্ণনা করেছে যে,একদিন সকালে মহানবী (সা.) গৃহ হতে বের হলেন এবং তখন তাঁর কাঁধে সেলাইবিহীন বিশেষ চাদর ছিল। (অতঃপর যখন তিনি বসলেন) তখন হাসান ইবনে আলী এসে ঐ চাদরের ভিতর প্রবেশ করল,তারপর হুসাইন তাতে প্রবেশ করল,তারপর ফাতেমা আসলে তাঁকেও চাদরে আবৃত করলেন,অতঃপর আলী আসলে তাঁকেও তাতে আবৃত করলেন। তাঁরা সকলে প্রবেশ করলে রাসূল এ আয়াতটি পাঠ করলেন,২৮
( إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا )
আয়াতটির লক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
প্রথমত আয়াতটিতে ((إنّما )) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা দ্বারা বিধানকে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর জন্য সীমিত করা হয় এবং এটি সীমিতকরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যকরণশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আয়াতটিতে আল্লাহর ইচ্ছা বিশেষ ব্যক্তিবর্গের (আহলে বাইতের) জন্য নির্দিষ্ট ঘোষিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত আয়াতটিতে আল্লাহর ইচ্ছা অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাকভীনি) অন্তর্ভুক্ত যার কোন ব্যত্যয় হয় না,إنّما أمره اذا أراد شیئاً أن یقول له کن فیکن “ কিছু করার ইচ্ছা করেন তখন বলেন :‘ হও’ ,অতঃপর তা হয়ে যায়।”
আয়াতটিতে (আয়াতে তাত্বহীরে) আল্লাহর অবশ্যম্ভাবী ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাকভীনী) প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে,কেননা তা শরীয়তের বিধানগত ইচ্ছার (ইরাদায়ে তাশরীয়ী) অন্তর্ভুক্ত হলে যাতে বান্দার স্বাধীনতা রয়েছে সকল বান্দাই তার অন্তর্ভুক্ত হতো ও এরূপ পবিত্রতার আকাঙ্ক্ষা সবার জন্য প্রযোজ্য হতো। সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে আহলে বাইতকে উল্লেখ মূল্যহীন হয়ে পড়ত। অর্থাৎ এ আয়াতে বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহর বিশেষ অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছার প্রতিফলনের কথা বলা হয়েছে।
তৃতীয়ত আয়াতটিতে যেرجس বা অপবিত্রতার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এমন অপবিত্রতা যা বস্তুর প্রতি অন্যদের ঘৃণার উদ্রেক করে। তাই কোরআনرجس শব্দটি বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থাৎ বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় অপবিত্রতার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করেছে। যেমন :
( أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ)
“ অথবা শুকরের মাংস,নিশ্চয়ই তা অপবিত্র” এবং
( وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَىٰ رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ )
“ এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি ( সন্দেহ ও কপটতার) রয়েছে তা তাদের অপবিত্রতার উপর অপবিত্রতা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং তারা কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। ” (সূরা তওবা: ১২৫)
এর বিপরীতে পবিত্রতাও বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় বিষয়ে হতে পারে। আল্লামা তাবাতাবায়ী বলেছেন: রিজস বা অপবিত্রতা হলো এমন আত্মিক অনুভূতি ও প্রভাব যা বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত বিশ্বাস এবং নিকৃষ্ট কর্ম হতে উদ্ভূত। আলোচ্য আয়াতেرجس শব্দটির পূর্বেال এসেছে যা‘ আলিফ ওয়া লামে জিন্স’নামে অভিহিত তা সকল প্রকৃতির অপবিত্রতাকে শামিল করে। তাই আয়াতে আত্মিক অপবিত্রতা অর্থাৎ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বা কর্মের ক্ষেত্রে ভুলের কারণ হতে পারে এমন সকল অপবিত্রতা হতেও মুক্তি ও পবিত্রতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এবং এরূপ পবিত্রতা কেবল ঐশী নিষ্পাপত্বের (স্রষ্টা প্রদত্ত পবিত্রতার) ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য অর্থাৎ ব্যক্তির মধ্যে এমন আত্মিক অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যা তাকে ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অসৎ কর্ম হতে নিবৃত রাখে।’ ২৯
যে বিশিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় ইচ্ছার অধীনে সকল প্রকার ত্রুটি ও পাপ-পঙ্কিলতা হতে মুক্ত ঘোষিত হয়েছেন,নিঃসন্দেহে তাঁরা নিষ্পাপ ও পবিত্র এবং যে কোন পবিত্র ও নিষ্পাপ ব্যক্তির কর্ম ও নীতি আল্লাহর ইচ্ছার অধীনে হওয়ায় সুন্নাত ও সকলের জন্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে গণ্য। তাই আল্লাহর নবীর আহলে বাইতের সদস্যদের অনুসৃত নীতিও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ও প্রামাণ্য দলিল বলে গণ্য।
২। হাদীসে সাকালাইন
তিরমিযী তাঁর সহীহ গ্রন্থে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.)-কে বিদায় হজ্জ্বের সময় উটের পিঠে বসে বক্তব্য দিতে দেখলাম ও তাঁকে বলতে শুনলাম :
‘ হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে দু’ টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি। যদি তোমরা তা আঁকড়ে ধর,তাহলে কখনোই বিভ্রান্ত হবে না : আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত।’ ৩০
হাদীসটি হতে বিভিন্নভাবে মহানবীর আহলে বাইতের নিষ্পাপত্ব প্রমাণ করা যায়। হাদীসটিতে কোরআন ও আহলে বাইতকে একত্রে উল্লেখ করে উভয়কে আঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে। তাই কোরআন যেরূপ সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে,আহলে বাইতও সেরূপ সকল ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে।
বারজাখের জীবন
(মৃত্যু ও পুনরুত্থানের অন্তর্বর্তীকালীন জীবন)
ওয়াহাবীদের সঙ্গে সাধারণ মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্যের একটি বিষয় হলো বারজাখ বা মৃত্যু পরবর্তী কবরের জীবন। আল্লাহর আউলিয়ার (ওলীদের) রুহ হতে সাহায্য চাওয়া,তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের উসিলা দিয়ে আল্লাহর নিকট চাওয়া (তাওয়াসসুল) ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য মুসলমানের সাথে ওয়াহাবীদের মতপার্থক্য উপরিউক্ত মতভিন্নতারই ফলশ্রুতিতেই ঘটেছে। অন্যান্য সকল মুসলমানই বিশ্বাস রাখেন দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ বারজাখে মানুষের,বিশেষত আল্লাহর ওলীদের বিশেষ জীবন রয়েছে। কিন্তু ওহাবিগণ মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবনে,এমনকি আল্লাহর ওলীদের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসী নয়। এ কারণেই তাঁদের নিকট সাহায্য চাওয়া,তাঁদেরকে মাধ্যম বা উসিলা হিসেবে গ্রহণকে জায়েয মনে করে না,বরং এক প্রকার শিরক বলে বিশ্বাস করে। প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর ওলীদের প্রতি (মৃত্যুর পরে) আহ্বানকে পাথরের ন্যায় প্রাণহীন বস্তুর প্রতি আহ্বান মনে করে। কারণ তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর ওলিগণ মৃত্যুর পর অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন না এবং পৃথিবীর উপর তাঁদের কোন প্রভবই নেই। আমরা এখন এ বিশ্বাস নিয়ে মৌলিক আলোচনা করব।
ওয়াহাবীদের ফতোয়াসমূহ
১। বিন বায বলেছেন,‘ দ্বীনের অপরিহার্য ও স্বীকৃত বিশ্বাসসমূহ এবং শরীয়তী দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত যে,আল্লাহর রাসূল (সা.) সকল স্থানে বিদ্যমান নন বরং তাঁর দেহ (মোবারক) মদীনায় রয়েছে তবে তাঁর রুহ বেহেশ্তে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে রয়েছে।৩১
তিনি অন্যত্র বলেছেন,‘ আহলে সুন্নাতের এক বৃহৎ অংশ মৃত্যুর পর কবরের জীবনে (বারজাখী জীবনে) বিশ্বাসী । কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে,কবরে শায়িতরা‘ গাইব’ বা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন অথবা পৃথিবীর ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে খবর পান বরং এ বিষয়গুলো হতে তাঁরা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন।
একই গ্রন্থে অন্য স্থানে তিনি বলেছেন,‘ মহানবী (সা.) তাঁকে সালামকারী ব্যক্তিকে দেখতে পান- এ কথাটির আদৌ কোন ভিত্তি নেই। কোরআন ও হাদীসে এর সপক্ষে কোন দলিল নেই। রাসূল (সা.) দুনিয়াবাসীর এবং পৃথিবীর উপর যা কিছু ঘটছে সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানেন না। কারণ মৃত ব্যক্তির সাথে এ পৃথিবীর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।৩২
২। বিশিষ্ট ওহাবী হাদীসবিদ নাসিরউদ্দিন আলবানী তাঁর‘ আল আয়াতুল বাইয়্যেনাহ্ আলা আদামে সিমায়েল আসওয়াত’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন,‘ আলোচ্য বিষয়টির গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের জানানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আশা করি কিছু জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট স্পষ্ট হয়েছে,বিশেষত যারা সবসময় অজ্ঞতার অন্ধকারে বাস করে তাদের জন্য নিমোক্ত বিষয়সমূহ,যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা,নবিগণ,আল্লাহর ওলী ও সৎকর্মশীল বান্দাদের রুহের নিকট মুক্তি কামনা করা,এরূপ ধারণা ও বিশ্বাস রাখা যে,তাঁরা তাদের কথা শুনতে পারছেন ইত্যাদি বিষয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হবে।
মানুষ রুহ ও দেহের সমন্বয়ে সৃষ্ট
কালামবিদগণ মানুষকে দুই সত্তার সমন্বয় বলে বিশ্বাস করেন,যথা রুহ (আত্মা) ও দেহ। এই দুইয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে তাঁরা বেশ কিছু প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। এখানে আমরা তার কয়েকটি উল্লেখ করছি :
১। প্রত্যেক মানুষই নিজ কর্মকে এক বাস্তব অস্তিত্বসম্পন্ন সত্তার সাথে সম্পর্কিত করে যাকে‘ আমি’ বলে অভিহিত করে থাকে এবং দাবী করে‘ আমি অমুক কাজটি করেছি,‘ আমি অমুককে মেরেছি’ ইত্যাদি। এই‘ আমি’ সত্তাটি কি? এটি কি মানবের সেই সত্তা নয় যাকে‘ রুহ’ বা‘ আত্মা’ নামে অভিহিত করা হয়,অনুরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিই তার দৈহিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে এক বাস্তব সত্তার সাথে সম্পকির্ত করে বলে,আমার হৃদয়,আমার উদর,আমার পদযুগল ইত্যাদি। এই‘ আমি’ সত্তাটি কি রুহ বা নাফ্স ব্যতীত অন্য কিছু?
২। প্রত্যেক মানুষ এই অনুভূতিটি ধারণ করে যে,তার ব্যক্তিত্ব ও সত্তা সময়ের পরিবর্তনে অপরিবর্তিত রয়েছে যাতে কোনরূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয় না,অথচ তার দেহে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এই অপরিবর্তিত সত্তাই কি তার আত্মা বা নাফ্স নয়?
৩। কখনো কখনো মানুষ সবকিছু,এমনকি তার দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কেও অসচেতন হয়ে যায়;কিন্তু সে মুহূর্তেও সে তার‘ আমি’ সত্তা সম্পর্কে অসচেতন নয়। এটি কি তার আত্মা বা নাফ্স নয়? ফখরুদ্দীন রাজী বলেছেন,‘ কখনো কখনো আমি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন,অথচ আমার দৈহিক সত্তা সম্পর্কে অবচেতন থাকি। আমার ঐ আত্মসচেতনতাই আমার আত্মা ও নাফ্স।’ ৩৩
পবিত্র কোরআনও এই সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছে :
( يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي )
‘ হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুর দিকে প্রত্যাবর্তন কর এমন অবস্থায় যে, তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট; আমার বিশেষ বান্দাদের (নৈকট্যপ্রাপ্ত) অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার বেহেশ্তে প্রবেশ কর। ’ ৩৪
অন্যত্র বলেছেন :
( فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ وَأَنتُمْ حِينَئِذٍ تَنظُرُونَ )
‘ অতঃপর যখন তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় তোমরা ( তার শিয়রে দাঁড়িয়ে) তা প্রত্যক্ষ কর। ’ (সূরা ওয়াকেয়া :৮৩-৮৪)
পৃথিবী হতে বিদায় নেয়ার পরও জীবনের অব্যাহত থাকা
পবিত্র কোরআনের আয়াত হতে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে,মানুষের মৃত্যু তার জীবনের শেষ নয়,বরং সে অন্য এক জীবনে প্রবেশ করে ও স্থানান্তরিত হয়। মানুষ মৃত্যুর পর বস্তুগত জগতের ঊর্ধ্বে এক নতুন জগতে অধিকতর বিস্তৃত জীবন লাভ করে। যেমন :
১। মহান আল্লাহ বলেছেন :
( اللَّـهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ )
‘ আল্লাহ মৃত্যুর সময় প্রাণকে পূর্ণরূপে হরণ করেন এবং (তার প্রাণকে)যে ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে ও মৃত্যুবরণ করে নি। অতঃপর যার মৃত্যু অবধারিত হয়েছে তার প্রাণকে আবদ্ধ রাখেন এবং অন্যান্যদেরকে (প্রাণ)নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফিরিয়ে দেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলী (আল্লাহর ক্ষমতার) রয়েছে। ’ ৩৫
২। অন্যত্র বলা হয়েছে :
( وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ )
‘ যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তাদের তোমরা মৃত ভেবো না, বরং তারা জীবিত এবং তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে জীবিকাপ্রাপ্ত। ’ ৩৬
অন্য একটি আয়াত হতে জানা যায় এই বিশেষ জীবন (বারজাখের জীবন) শুধু শহীদদের জন্যই নয়,বরং আল্লাহর সকল অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দার জন্য নির্ধারিত।
মহান আল্লাহ বলেছেন :
( وَمَن يُطِعِ اللَّـهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَـٰئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّـهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـٰئِكَ رَفِيقًا )
‘ যারা আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষের আনুগত্য করবে তারা সেই সকল ব্যক্তির সঙ্গে থাকবে নবিগণ, সত্যবাদিগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য হতে যাদের তিনি নিয়ামত দিয়েছেন। তারা কতই না উত্তম সঙ্গী! ’ ৩৭
যদি শহীদগণ আল্লাহর নিকট জীবিত থাকেন ও জীবিকা লাভ করেন তবে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হবে-যেহেতু রাসূল নিজেও তাঁর আনীত নির্দেশের আনুগত্যকারী,সেহেতু তিনিও এর অন্তর্ভুক্ত-সেও শহীদদের সাথে থাকবে,কারণ উপরিউক্ত আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী শহীদদের সঙ্গে থাকবে বলা হয়েছে। যদি শহীদরা মৃত্যুর পর আল্লাহর নিকট জীবিত থাকে তবে তারাও আল্লাহর নিকট জীবিত রয়েছে ও বারজাখী জীবনের অধিকারী। যদি বিন বাযের মতো কেউ বলেন,‘ তাঁরা আল্লাহর নিকট বেহেশ্তে রয়েছেন এবং এই পৃথিবীর কোন খবর রাখেন না’ ,এর জবাবে বলব,‘ আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বলেছেন :
( وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ )
‘ তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন। ’ ৩৮
( فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّـهِ )
‘ তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও না কেন, সেদিকেই তিনি আছেন। ’ ৩৯
( نَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ )
‘ আমরা তার শাহরগ হতেও তার নিকটবর্তী। ’ ৪০
যদি আল্লাহ সকল স্থানে সকলের সাথে থাকেন তবে যেহেতু শহীদগণ তাঁর নিকটে অবস্থান করছেন তাঁরাও তাঁর নৈকট্যপ্রাপ্ত হিসেবে সকল স্থানের উপর পূর্ণ দৃষ্টি লাভ করেছেন এবং অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন। আল্লাহর অলী ও অনুগত সৎকর্মশীল বান্দারাও তদ্রুপ। কোরআন বলছে :
( يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ )
‘ তিনি ( আল্লাহ) চক্ষুসমূহের বিশ্বাসঘাতকতা ও অন্তরসমূহ যা গোপন করে সে সম্পর্কে অবহিত। ’ ৪১
যে সর্বজ্ঞ আল্লাহ সবকিছু জানেন তিনিই তাদেরকে অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত করেন। তিনিই তাঁর রাসূলকে অদৃশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন।
( عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَىٰ غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَىٰ مِن رَّسُولٍ فَإِنَّهُ يَسْلُكُ مِن بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ رَصَدًا )
‘ তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী এবং তিনি অদৃশ্য বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। তখন তিনি তার অগ্রপশ্চাতে প্রহরী নিযুক্ত করেন। ’ ৪২
বিভিন্ন হাদীসেও এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। বদর যুদ্ধের পর মহানবী (সা.) যখন মুশরিকদের মৃতদেহগুলো একটি গর্তে নিক্ষেপ করলেন তখন সেই মৃত মুশরিকদের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন,‘ নিশ্চয়ই তোমরা আল্লাহর রাসূলের মন্দ প্রতিবেশী ছিলে,তাকে তোমরা তার গৃহ হতে বহিষ্কার ও তাকে প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হও নি বরং তার বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলে। আমাকে আমার প্রতিপালক যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা সত্য পেয়েছি।’ এক ব্যক্তি মহানবীকে উদ্দেশ্য করে বলল,‘ হে আল্লাহর নবী! আপনি কিরূপে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাগুলোর সাথে কথা বলছেন?’ মহানবী তাকে বললেন,‘ তুমি তাদের হতে অধিক শুনতে পাও না।’ ৪৩
আনাস ইবনে মালিক মহানবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,‘ যখন কোন ব্যক্তিকে মৃত্যুর পর কবরে শুইয়ে তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যায়,তখন সে তাদের পদধ্বনি শুনতে পায়।’ ৪৪
মুত্তাকী হিন্দী স্বীয় সূত্রে নবী করিম (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,যে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত না করে যায়,তাকে মৃতদের সাথে কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে না।’ বলা হলো :‘ হে আল্লাহর রাসূল! মৃতরা কি কথা বলে?’ তিনি বললেন,‘ হ্যাঁ,তারা পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ করে।’ ৪৫
অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান
মানুষের মধ্যে আরেকটি জ্ঞানমাধ্যম রয়েছে , তা হচ্ছে তার অন্তঃকরণ (قلب ) । এর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে অন্তঃকরণজাত বা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান (علم قلبی ) বলা যেতে পারে । বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণের মধ্যে পার্থক্য এখানে যে , বিচারবুদ্ধি প্রত্যক্ষ (ইন্দ্রিয়বহির্ভূত) অভিজ্ঞতা থেকে (যেমন: স্বীয় অস্তিত্ব সম্বন্ধে) অথবা ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞানে উপনীত হয় , কিন্তু অন্তঃকরণের জ্ঞান এমন যা এরূপ কার্যকারণ ছাড়াই অন্তঃকরণে উদ্ভূত হয়। যেমন: যথাযথ চিন্তাগবেষণা ছাড়াই কারো মনে কোনো প্রশ্নের জবাব বা কোনো সমস্যার সমাধান ভেসে উঠলো । তেমনি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ব ধারণা ছাড়াই তাকে প্রথম বারের মতো দেখা মাত্রই অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , ভয় , আশা , শ্রদ্ধা , ভক্তি ইত্যাদি জেগে উঠতে পারে এবং পরে তা যথার্থ বলে প্রমাণিত হতে পারে। অবশ্য ইন্দ্রিয়লব্ধ পূর্বাহ্নিক তথ্য বা বিচারবুদ্ধির প্রভাবেও এ ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে , তবে এ সবের প্রভাব ছাড়াও , দৃশ্যতঃ কোনো কারণ ছাড়াও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্ত ধরনের অনুভূতি অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান , যদিও প্রথমোক্ত ও দ্বিতীয়োক্ত উভয় ধরনের জ্ঞানেরই শারীরিক প্রতিক্রিয়ার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে হৃদপিণ্ড।
কারো প্রতি ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , ভয় , আশা , শ্রদ্ধা , ভক্তি ইত্যাদি জাগ্রত হওয়ার বিষয়টি সহজাত প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হিসেবে একে সহজাত জ্ঞান বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে সহজাত জ্ঞান থেকে পার্থক্য এই যে , মানুষের মূল অনুভূতিগুলো সহজাত , কিন্তু তার প্রয়োগক্ষেত্র তথা কা’ রা এগুলোর উপযুক্ত সে সংক্রান্ত জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা অর্জিত তথ্যাদি বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই অর্জিত হয়ে থাকে এবং কেবল এর পরেই ঐ সব অনুভূতি সে সব পাত্রের দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু তা যদি ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা অর্জিত তথ্য ও বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই , দৃশ্যতঃ বিনা কারণেই ঘটে , যেমন: একজন লোককে প্রথম বারের মতো দেখেই মনে হলো লোকটি বিপজ্জনক , তাহলে তা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান।
বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণের মধ্যকার পার্থক্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের একটি দিক হেচ্ছ এই যে , বিচারবুদ্ধির জ্ঞানের উদয় , বিচারবিশ্লেষণ ও উপসংহার যেখানে মস্তিষ্কে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটায় সেখানে অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান অন্তঃকরণ থেকে মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয় , যদিও পরে বিচারবুদ্ধি সে সব নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে পারে এবং সে সবকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন , তা হচ্ছে , অনেকে শরীরের হৃদপিণ্ডকেই“ ক্বালব্” বলে মনে করেন। যদিও আরবী ভাষায় হৃদপিণ্ডকেও“ ক্বালব্” বলা হয় , কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অন্তঃকরণ বা হৃদয় (ক্বালব্) কোনো বস্তুগত অঙ্গ নয় , যদিও উভয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। অনেক ভাষায়ই যেমন এক শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় , আরবী ভাষায়ও তদ্রূপ ব্যবহারের প্রচলন আছে। আরবী ভাষায় হৃদপিণ্ড এবং অন্তঃকরণ বা হৃদয় উভয় অর্থেই“ ক্বালব্” শব্দ ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে অন্তঃকরণ বা হৃদয়ের অনুভূতি হৃদপিণ্ডে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে বিধায় অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এ উভয় অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অন্তঃকরণ বা হৃদয় হচ্ছে মানবসত্তায় নিহিত একটি অবস্তুগত জ্ঞানকেন্দ্র , আর হৃদপিণ্ডের মূল কাজ হচ্ছে রক্ত পরিশোধন ও সঞ্চালন।
যা-ই হোক ,“ ক্বালব্” -এর জ্ঞান দুই ধরনের। ইতিপূর্বে যেমন ইঙ্গিত করা হয়েছে , এর এক ধরনের জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বিচারবুদ্ধির আওতাধীন জগতের সাথে যোগসূত্র থাকে। অর্থাৎ এ দুই জগতের কোনো তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয়ে তা বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই অন্তরে স্থানান্তরিত হতে এবং তাকে কেন্দ্র করে অন্তরে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে যা পরে সেখান থেকে মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয়। যেমন: একজন মানুষকে দেখামাত্রই অন্তরে তার প্রতি ভয় বা ঘৃণা জাগ্রত হতে পারে যদিও দৃশ্যতঃ তার মধ্যে তাকে ভয় বা ঘৃণা করার মতো কোনো কারণ দেখা যায় না এবং বিচারবুদ্ধি তাকে ভয় বা ঘৃণা করার সপক্ষে রায় দেয় না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি ও বিচারবুদ্ধির ফয়সালার বিপরীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও তার ভিত্তিতে কোনো কাজ করে বা কোনো কাজ পরিহার করে কেবল এ কারণে যে , মন বলছে , এ কাজটি করা উচিত অথবা করা উচিত নয়।
ক্ষেত্রবিশেষে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বিচারবুদ্ধির আওতাভুক্ত বিষয় এমন হতে পারে যে , সে ব্যাপারে সঠিক ফয়সালায় উপনীত হবার পথে স্থানগত , কালগত , পরিবেশগত বা পরিস্থিতিগত বাধা থাকতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ক্বালব্ ব্যক্তিকে পথপ্রদর্শন করতে পারে। অর্থাৎ ব্যক্তির পক্ষে অভিজ্ঞতা হাসিল , গবেষণা ও বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই কেবল অন্তরের অনুভূতির ভিত্তিতে কোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হতে পারে।
মানুষের শরীরের বস্তুগত অঙ্গ হৃদপিণ্ড ছাড়াও যে তার মধ্যে অন্তঃকরণ বা হৃদয় নামক একটি অবস্তুগত শক্তি রয়েছে কোরআন মজীদের আয়াত থেকে তার সন্ধান পাওয়া যায়। আল্লাহ্ তা‘ আলা অতীতের বহু শক্তিশালী জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর এরশাদ করেছেন:
) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَذِكْرَى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْب(
“ নিঃসন্দেহে এতে তার জন্য উপদেশ রয়েছে যে ব্যক্তি ক্বালব্-এর অধিকারী।” (সূরাহ্ ক্বাফ্: 37)
বলা বাহুল্য যে , এখানে শরীরের বস্তুগত হৃদপিণ্ডের কথা বলা হয় নি , কারণ , তা প্রত্যেকেরই রয়েছে যা না থাকলে কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
বিভিন্ন জাতির ধ্বংসের কারণ সম্বন্ধে গবেষণা করলে বহু প্রাকৃতিক , বস্তুগত , রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু নির্মল অন্তঃকরণের অধিকারী ব্যক্তি এ ধরনের প্রতিটি জাতির পাপাচারের ক্ষেত্রে সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার পর ধ্বংস হবার ঘটনা অবহিত হয়ে অনুভব করতে পারেন যে , এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘ আলার এক অমোঘ বিধান , যদিও তা প্রাকৃতিক বা মানবিক কার্যকারণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
ক্বালবের দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান হচ্ছে এমন যার সাথে ইন্দ্রিয়লব্ধ বা বিচারবুদ্ধিজাত তথ্যের কোনোরূপ যোগসূত্র নেই। বরং বস্তুগত ও বিচারবুদ্ধিগত কার্যকারণের সংযোগ ছাড়াই অন্তঃকরণে বা হৃদয়ে কোনো তথ্য জাগ্রত হয় এবং তাতে প্রত্যয়ও সৃষ্টি হয়। ওয়াহী ও ইলহাম্ এ পর্যায়ের জ্ঞান। এ ক্ষেত্রে তা শব্দ ও বাক্যের সাহায্যে তৈরী বাণী , কোনো স্থির বা চলমান দৃশ্য , অথবা উভয়ই হতে পারে যা নবী-রাসূলগণ (আঃ) পেয়েছিলেন। আল্লাহর কোনো কোনো ওয়ালীও এরূপ বাণী লাভ করেন , যেমন: হযরত মূসা (আঃ)-এর মাতা লাভ করেছিলেন।
অন্যদিকে অন্তঃকরণে ভেসে ওঠা দৃশ্য বা অকাট্য তথ্য আকারেও কোনো জ্ঞান কেউ পেতে পারেন এবং তা অকাট্য প্রত্যয় উৎপাদক হয়ে থাকে। নবী-রাসূলগণ (আঃ) ও আল্লাহর ওয়ালীগণ ছাড়াও যে কোনো লোকই এ ধরনের জ্ঞান লাভ করতে পারে (যেমন অনেক বিজ্ঞানী লাভ করেন)। এমনকি নাস্তিক ব্যক্তির জন্যও এরূপ জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব নয়।
বাণীর আকারে হলে এরূপ জ্ঞানকে ‘ পঠনযোগ্য ওয়াহী ’ (وحی متلوء )বলা হয় , আর বাণী আকারে না হলে এরূপ জ্ঞানকে ‘ পঠন - অযোগ্য ওয়াহী ’ (وحی غير متلوء ) বা প্রেরণা (الهام - ইলহাম্) বা‘ প্রত্যক্ষ অনুভূতি’ (intuition) বলা হয়।
বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান
ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানকে সহজাত , ইন্দ্রিয়লব্ধ , বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান - এ চার ভাগে ভাগ করার পাশাপাশি বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বা উদ্ধৃত জ্ঞান (علم نقلی ) নামেও একটি বিভাগ নির্দেশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইন্দ্রিয়লব্ধ , বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত যে জ্ঞান বর্ণনাসূত্রে (লেখা ও কথা নির্বিশেষে) অবগত হয় তাকেই বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত বা উদ্ধৃত জ্ঞান বলা হয়। এ ধরনের জ্ঞান যদি বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান হয় এবং যথাযথভাবে স্থানান্তরিত হয় অর্থাৎ বর্ণনা ও গ্রহণ যথাযথ হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের জ্ঞান একই পর্যায়ের হবে। তবে বিচারবুদ্ধির জ্ঞানের ক্ষেত্রেই এটা যথাযথভাবে হওয়া সম্ভব। অন্তঃকরণে উদ্ভূত কোনো কোনো জ্ঞানের‘ যথাযথ’ স্থানান্তর ও যার কাছে স্থানান্তরিত হয় তার পক্ষে তা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারা‘ প্রায় অসম্ভব’ ব্যাপার। অবস্তুগত সমুন্নত সত্তা ও জগতসমূহ সংক্রান্ত জ্ঞান এ পর্যায়ের।
অন্যদিকে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের বিষয়টি ভিন্ন ধরনের। প্রকৃত পক্ষে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়নিচয় দ্বারা যে তথ্য আহরণ করে , বা প্রচলিত কথায় , যে জ্ঞান অর্জন করে , তা হুবহু অন্যের মাঝে স্থানান্তরিত করতে পারে না , কেবল এ সংক্রান্ত একটা প্রতীকী ধারণা স্থানান্তরিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ , কোনো ব্যক্তি যখন একটি সুন্দর দৃশ্য দেখার পর তা অন্যের নিকট মুখে বা লিখে বর্ণনা করে তখন তার পক্ষে পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতাকে হুবহু নিজের অভিজ্ঞতা প্রদান করা সম্ভব হয় না ; প্রতীকী শব্দাবলীর সাহায্যে ধারণা প্রদান করা সম্ভব হয় মাত্র। অবশ্য বর্ণনা যত নিখুঁত হবে পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতার পক্ষে স্বীয় কল্পনানেত্রে ততটাই কাছাকাছি দৃশ্য রচনা করা সম্ভব হবে। কিন্তু কখনোই তা বক্তার বা লেখকের দেখা দৃশ্যের হুবহু অনুরূপ হবে না। এমনকি তার ভিডিও-চিত্র প্রদর্শন করা হলেও ভিডিও-দর্শনকারীর জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর ন্যায় হুবহু জ্ঞান অর্জিত হবে না। কারণ , সংশ্লিষ্ট চলমান দৃশ্যাবলী ও শব্দ ( sound) ছাড়াও সেখানকার পরিবেশগত অনেক বিষয় , ধরুন বাতাসের স্পর্শ ইত্যাদি অনেক কিছু ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় শামিল থাকে যা চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত থাকে।
তেমনি একটি সুর , কোনো বস্তুর স্বাদ , কোনো কিছুর ঘ্রাণ ও কোনো বস্তুর স্পর্শের অনুভূতি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ এগুলো মৌখিক বা লিখিত বর্ণনা , এমনকি রেকর্ড বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও হুবহু পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতার কাছে স্থানান্তরিত করা সম্ভবপর হয় না , কেবল এ সংক্রান্ত ধারণা প্রদান করা সম্ভব হয় মাত্র। যদিও লেখ্য বা মৌখিক বর্ণনার তুলনায় রেকর্ড বা চলচ্চিত্রের সাহায্যে প্রদত্ত ধারণা বাস্তবতার অধিকতর কাছিাকাছি হয়ে থাকে , কিন্তু তা হুবহু অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর অনুভূতির ন্যায় হয় না। আর পরীক্ষাগারে হাতে-কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান দেয়া হয় মূলতঃ তা আর উদ্ধৃত জ্ঞান থাকে না , বরং জ্ঞান গ্রহণকারীর জন্যও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হয় , যদিও অন্য একজন তাকে সাহায্য করেছে বা ইতিপূর্বে সে অন্যের কাছ থেকে যে উদ্ধৃত জ্ঞান পেয়েছে তা থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য নিয়েছে।
ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দু’ টি শর্ত বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। প্রথমতঃ গ্রহীতার সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় অর্থাৎ তার যে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অন্যের ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত তথ্যাদি তার মধ্যে স্থানান্তরিত করা হবে সে ইন্দ্রিয়টি অক্ষত ও অবিকৃত থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ গ্রহীতার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বর্ণনার বিষয়বস্তুর অনুরূপ বিষয়বস্তু বা তার কাছাকাছি বিষয় সম্পর্কে পূর্বাহ্নিক ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকতে হবে। কেবল তাহলেই গ্রহীতার পক্ষে স্বীয় অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে অন্যের অভিজ্ঞতাভুক্ত বিষয় সম্পর্কে কোনো না কোনো পর্যায়ের ধারণা লাভ করা সম্ভব , অন্যথায় নয়। যেমন: চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে বর্ণনার দ্বারা একটি‘ দৃশ্য’ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা দেয়া সম্ভব। ধরুন , যে ব্যক্তি তাজমহল দেখে নি তাকে বর্ণনার দ্বারা তাজমহল সম্পর্কে তাজমহল-দর্শকের অনুরূপ ধারণা দেয়া সম্ভব নয় , তবে মোটামুটি ধারণা দেয়া সম্ভব । অবশ্য বর্ণনার সাথে সাথে ছবি দেখানো হলে দর্শক-শ্রোতার এতদসংক্রান্ত জ্ঞান উন্নততর ও অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর অধিকতর কাছাকাছি হবে। আর রঙিন ছবি ও ভিডিও-চিত্রের সাহায্যে পর্যায়ক্রমে অধিকতর উন্নত স্তরের ধারণা দেয়া ও তার এ সংক্রান্ত জ্ঞানকে অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর জ্ঞানস্তরের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব হবে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও তার জ্ঞান হুবহু তাজমহল-পরিদর্শনকারীর এতদসংক্রান্ত জ্ঞানের অনুরূপ হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তির চোখ নেই তাকে , বিশেষতঃ জন্মান্ধকে তাজমহলের সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোনো ধারণাই দেয়া সম্ভব হবে না।
অন্যান্য ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও এটা সত্য।
অবশ্য বর্ণিত সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে তৈরী পটভূমিকার কারণে ব্যক্তি বর্ণনাকারীর অনুরূপ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য উদ্যোগী হতে পারে। যেমন: সে তাজমহলের সৌন্দর্য দেখতে যেতে পারে , সমুদ্রের শো-শো শব্দ শোনার জন্য সমুদ্রে যেতে পারে , যে নতুন ফলের প্রশংসা সে শুনেছে তা সংগ্রহ করে খেয়ে দেখতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার এতদসংক্রান্ত জ্ঞান আর বর্ণনাসূত্রে লব্ধ জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না , বরং ইন্দ্রিয়লব্ধ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হলো।
অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান
জ্ঞানকে অন্য এক বিবেচনায় দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: বিচারবুদ্ধি দ্বারা আয়ত্তযোগ্য জ্ঞান (علم تعقلی ) ও অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান (علم تعبدی ) । সহজাত জ্ঞান , ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান , অভিজ্ঞতালব্ধ বা পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান এবং অনেক উদ্ধৃত জ্ঞানই প্রথমোক্ত ধরনের জ্ঞানের মধ্যে শামিল। আর দ্বিতীয়োক্ত ধরনের জ্ঞান যদিও পুরোপুরিভাবে বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার বহির্ভূত নয় , তবে তা সর্বজনীন নয়। তাই এ জ্ঞান যার আছে তাঁর কাছ থেকে অন্ধভাবে গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। উদাহরণস্বরূপ , লাওহে মাহফূযের কথা ধরা যাক। এ ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোরআন মজীদের তথ্য মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ , সংশ্লিষ্ট তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করা বিচারবুদ্ধির আওতাবহির্ভূত ব্যাপার।
এ পরিভাষা দু’ টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা পরিবর্তিত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তা হচ্ছে , যে তথ্য কেবল বিশেষজ্ঞদের পক্ষেই জানা সম্ভব তা তাঁদের জন্য বিচারবুদ্ধির আয়ত্তাধীন জ্ঞান (علم تعقلی ) এবং সাধারণ মানুষদের জন্য অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান (علم تعبدی ) । কারণ , এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞের কথা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের কথা চোখ বুঁজে মেনে নেয়ার আগে স্বীয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিশেষজ্ঞকে অর্থাৎ প্রকৃতই তিনি বিশেষজ্ঞ , নাকি বিশেষজ্ঞ হবার মিথ্যা দাবীদার তা পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ মিথ্যা বলবেন না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে বা প্রত্যয়ে উপনীত হতে হবে। যেমন: আমরা যখন অসুস্থ হই তখন চিকিৎসকের কাছে যাই , তবে বিচারবুদ্ধি নির্দেশিত বিভিন্ন পন্থায় , যেমন: চিকিৎসাক্ষেত্রে খ্যাতি , সার্টিফিকেট , সরকারী নিবন্ধন ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হই যে , ঐ ব্যক্তি চিকিৎসক হবার মিথ্যা দাবী করছেন না ; এ কারণেই নিশ্চিন্ত মনে তাঁর কাছে যাই।
অন্যদিকে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির ধারণযোগ্য বিষয়ে অন্যের কথা মেনে নেয়া এবং বিশেষজ্ঞ হবার দাবীদার ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিচার বা অনুসন্ধান পূর্বক নিশ্চিত না হয়েই তার কথা মেনে নেয়া বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নিন্দনীয় কাজ। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষজ্ঞত্বের দাবীদার ব্যক্তির কাছ থেকে যে ধারণা লাভ করে তাকে নেতিবাচক ও নিন্দনীয় অর্থেتعبد বা অন্ধ বিশ্বাস বলা হয়। বস্তুতঃ এ ধরনের অন্ধ বিশ্বাস জ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না।
কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে জ্ঞানমাধ্যম
সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য বিচারবুদ্ধির পর্যালোচনায় যে জ্ঞানমাধ্যমগুলোর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তা হচ্ছে: সহজাত প্রবণতা , বিচারবুদ্ধি , ইন্দ্রিয়নিচয় ও অন্তঃকরণ বা হৃদয় (قلب ) । এ মাধ্যমগুলো এমন যে , এগুলোকে আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই জ্ঞানমাধ্যমরূপে স্বীকার করতে বাধ্য , অবশ্য কেউ গোঁয়ার্তুমি করে বা অন্ধভাবে এর মধ্য থেকে কোনোটিকে অস্বীকার করতে চাইলে সে কথা স্বতন্ত্র এবং তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমরা কোরআন মজীদেও জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে এগুলোর উল্লেখ দেখতে পাই।
অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান
মানুষের মধ্যে আরেকটি জ্ঞানমাধ্যম রয়েছে , তা হচ্ছে তার অন্তঃকরণ (قلب ) । এর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে অন্তঃকরণজাত বা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান (علم قلبی ) বলা যেতে পারে । বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণের মধ্যে পার্থক্য এখানে যে , বিচারবুদ্ধি প্রত্যক্ষ (ইন্দ্রিয়বহির্ভূত) অভিজ্ঞতা থেকে (যেমন: স্বীয় অস্তিত্ব সম্বন্ধে) অথবা ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে জ্ঞানে উপনীত হয় , কিন্তু অন্তঃকরণের জ্ঞান এমন যা এরূপ কার্যকারণ ছাড়াই অন্তঃকরণে উদ্ভূত হয়। যেমন: যথাযথ চিন্তাগবেষণা ছাড়াই কারো মনে কোনো প্রশ্নের জবাব বা কোনো সমস্যার সমাধান ভেসে উঠলো । তেমনি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ব ধারণা ছাড়াই তাকে প্রথম বারের মতো দেখা মাত্রই অন্তরে তার প্রতি ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , ভয় , আশা , শ্রদ্ধা , ভক্তি ইত্যাদি জেগে উঠতে পারে এবং পরে তা যথার্থ বলে প্রমাণিত হতে পারে। অবশ্য ইন্দ্রিয়লব্ধ পূর্বাহ্নিক তথ্য বা বিচারবুদ্ধির প্রভাবেও এ ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে , তবে এ সবের প্রভাব ছাড়াও , দৃশ্যতঃ কোনো কারণ ছাড়াও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্ত ধরনের অনুভূতি অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান , যদিও প্রথমোক্ত ও দ্বিতীয়োক্ত উভয় ধরনের জ্ঞানেরই শারীরিক প্রতিক্রিয়ার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে হৃদপিণ্ড।
কারো প্রতি ভালোবাসা , স্নেহ-মমতা , ভয় , আশা , শ্রদ্ধা , ভক্তি ইত্যাদি জাগ্রত হওয়ার বিষয়টি সহজাত প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হিসেবে একে সহজাত জ্ঞান বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এখানে সহজাত জ্ঞান থেকে পার্থক্য এই যে , মানুষের মূল অনুভূতিগুলো সহজাত , কিন্তু তার প্রয়োগক্ষেত্র তথা কা’ রা এগুলোর উপযুক্ত সে সংক্রান্ত জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা অর্জিত তথ্যাদি বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই অর্জিত হয়ে থাকে এবং কেবল এর পরেই ঐ সব অনুভূতি সে সব পাত্রের দিকে প্রবাহিত হয়। কিন্তু তা যদি ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা অর্জিত তথ্য ও বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই , দৃশ্যতঃ বিনা কারণেই ঘটে , যেমন: একজন লোককে প্রথম বারের মতো দেখেই মনে হলো লোকটি বিপজ্জনক , তাহলে তা অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান।
বিচারবুদ্ধি ও অন্তঃকরণের মধ্যকার পার্থক্য ও পারস্পরিক সম্পর্কের একটি দিক হেচ্ছ এই যে , বিচারবুদ্ধির জ্ঞানের উদয় , বিচারবিশ্লেষণ ও উপসংহার যেখানে মস্তিষ্কে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটায় সেখানে অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান অন্তঃকরণ থেকে মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয় , যদিও পরে বিচারবুদ্ধি সে সব নিয়ে বিচারবিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে পারে এবং সে সবকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন , তা হচ্ছে , অনেকে শরীরের হৃদপিণ্ডকেই“ ক্বালব্” বলে মনে করেন। যদিও আরবী ভাষায় হৃদপিণ্ডকেও“ ক্বালব্” বলা হয় , কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অন্তঃকরণ বা হৃদয় (ক্বালব্) কোনো বস্তুগত অঙ্গ নয় , যদিও উভয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র রয়েছে। অনেক ভাষায়ই যেমন এক শব্দ একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয় , আরবী ভাষায়ও তদ্রূপ ব্যবহারের প্রচলন আছে। আরবী ভাষায় হৃদপিণ্ড এবং অন্তঃকরণ বা হৃদয় উভয় অর্থেই“ ক্বালব্” শব্দ ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে অন্তঃকরণ বা হৃদয়ের অনুভূতি হৃদপিণ্ডে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে বিধায় অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এ উভয় অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অন্তঃকরণ বা হৃদয় হচ্ছে মানবসত্তায় নিহিত একটি অবস্তুগত জ্ঞানকেন্দ্র , আর হৃদপিণ্ডের মূল কাজ হচ্ছে রক্ত পরিশোধন ও সঞ্চালন।
যা-ই হোক ,“ ক্বালব্” -এর জ্ঞান দুই ধরনের। ইতিপূর্বে যেমন ইঙ্গিত করা হয়েছে , এর এক ধরনের জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বিচারবুদ্ধির আওতাধীন জগতের সাথে যোগসূত্র থাকে। অর্থাৎ এ দুই জগতের কোনো তথ্য মস্তিষ্কে জমা হয়ে তা বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই অন্তরে স্থানান্তরিত হতে এবং তাকে কেন্দ্র করে অন্তরে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে যা পরে সেখান থেকে মস্তিষ্কে স্থানান্তরিত হয়। যেমন: একজন মানুষকে দেখামাত্রই অন্তরে তার প্রতি ভয় বা ঘৃণা জাগ্রত হতে পারে যদিও দৃশ্যতঃ তার মধ্যে তাকে ভয় বা ঘৃণা করার মতো কোনো কারণ দেখা যায় না এবং বিচারবুদ্ধি তাকে ভয় বা ঘৃণা করার সপক্ষে রায় দেয় না। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ ইন্দ্রিয়লব্ধ তথ্যাদি ও বিচারবুদ্ধির ফয়সালার বিপরীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ও তার ভিত্তিতে কোনো কাজ করে বা কোনো কাজ পরিহার করে কেবল এ কারণে যে , মন বলছে , এ কাজটি করা উচিত অথবা করা উচিত নয়।
ক্ষেত্রবিশেষে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও বিচারবুদ্ধির আওতাভুক্ত বিষয় এমন হতে পারে যে , সে ব্যাপারে সঠিক ফয়সালায় উপনীত হবার পথে স্থানগত , কালগত , পরিবেশগত বা পরিস্থিতিগত বাধা থাকতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ক্বালব্ ব্যক্তিকে পথপ্রদর্শন করতে পারে। অর্থাৎ ব্যক্তির পক্ষে অভিজ্ঞতা হাসিল , গবেষণা ও বিচারবুদ্ধির বিশ্লেষণ ছাড়াই কেবল অন্তরের অনুভূতির ভিত্তিতে কোনো বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হতে পারে।
মানুষের শরীরের বস্তুগত অঙ্গ হৃদপিণ্ড ছাড়াও যে তার মধ্যে অন্তঃকরণ বা হৃদয় নামক একটি অবস্তুগত শক্তি রয়েছে কোরআন মজীদের আয়াত থেকে তার সন্ধান পাওয়া যায়। আল্লাহ্ তা‘ আলা অতীতের বহু শক্তিশালী জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর এরশাদ করেছেন:
) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَذِكْرَى لِمَنْ كَانَ لَهُ قَلْب(
“ নিঃসন্দেহে এতে তার জন্য উপদেশ রয়েছে যে ব্যক্তি ক্বালব্-এর অধিকারী।” (সূরাহ্ ক্বাফ্: 37)
বলা বাহুল্য যে , এখানে শরীরের বস্তুগত হৃদপিণ্ডের কথা বলা হয় নি , কারণ , তা প্রত্যেকেরই রয়েছে যা না থাকলে কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
বিভিন্ন জাতির ধ্বংসের কারণ সম্বন্ধে গবেষণা করলে বহু প্রাকৃতিক , বস্তুগত , রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু নির্মল অন্তঃকরণের অধিকারী ব্যক্তি এ ধরনের প্রতিটি জাতির পাপাচারের ক্ষেত্রে সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যাবার পর ধ্বংস হবার ঘটনা অবহিত হয়ে অনুভব করতে পারেন যে , এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘ আলার এক অমোঘ বিধান , যদিও তা প্রাকৃতিক বা মানবিক কার্যকারণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
ক্বালবের দ্বিতীয় ধরনের জ্ঞান হচ্ছে এমন যার সাথে ইন্দ্রিয়লব্ধ বা বিচারবুদ্ধিজাত তথ্যের কোনোরূপ যোগসূত্র নেই। বরং বস্তুগত ও বিচারবুদ্ধিগত কার্যকারণের সংযোগ ছাড়াই অন্তঃকরণে বা হৃদয়ে কোনো তথ্য জাগ্রত হয় এবং তাতে প্রত্যয়ও সৃষ্টি হয়। ওয়াহী ও ইলহাম্ এ পর্যায়ের জ্ঞান। এ ক্ষেত্রে তা শব্দ ও বাক্যের সাহায্যে তৈরী বাণী , কোনো স্থির বা চলমান দৃশ্য , অথবা উভয়ই হতে পারে যা নবী-রাসূলগণ (আঃ) পেয়েছিলেন। আল্লাহর কোনো কোনো ওয়ালীও এরূপ বাণী লাভ করেন , যেমন: হযরত মূসা (আঃ)-এর মাতা লাভ করেছিলেন।
অন্যদিকে অন্তঃকরণে ভেসে ওঠা দৃশ্য বা অকাট্য তথ্য আকারেও কোনো জ্ঞান কেউ পেতে পারেন এবং তা অকাট্য প্রত্যয় উৎপাদক হয়ে থাকে। নবী-রাসূলগণ (আঃ) ও আল্লাহর ওয়ালীগণ ছাড়াও যে কোনো লোকই এ ধরনের জ্ঞান লাভ করতে পারে (যেমন অনেক বিজ্ঞানী লাভ করেন)। এমনকি নাস্তিক ব্যক্তির জন্যও এরূপ জ্ঞান লাভ করা অসম্ভব নয়।
বাণীর আকারে হলে এরূপ জ্ঞানকে ‘ পঠনযোগ্য ওয়াহী ’ (وحی متلوء )বলা হয় , আর বাণী আকারে না হলে এরূপ জ্ঞানকে ‘ পঠন - অযোগ্য ওয়াহী ’ (وحی غير متلوء ) বা প্রেরণা (الهام - ইলহাম্) বা‘ প্রত্যক্ষ অনুভূতি’ (intuition) বলা হয়।
বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান
ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানকে সহজাত , ইন্দ্রিয়লব্ধ , বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান - এ চার ভাগে ভাগ করার পাশাপাশি বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞান বা উদ্ধৃত জ্ঞান (علم نقلی ) নামেও একটি বিভাগ নির্দেশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ইন্দ্রিয়লব্ধ , বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত যে জ্ঞান বর্ণনাসূত্রে (লেখা ও কথা নির্বিশেষে) অবগত হয় তাকেই বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত বা উদ্ধৃত জ্ঞান বলা হয়। এ ধরনের জ্ঞান যদি বিচারবুদ্ধিজাত ও অন্তঃকরণে উদ্ভূত জ্ঞান হয় এবং যথাযথভাবে স্থানান্তরিত হয় অর্থাৎ বর্ণনা ও গ্রহণ যথাযথ হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের জ্ঞান একই পর্যায়ের হবে। তবে বিচারবুদ্ধির জ্ঞানের ক্ষেত্রেই এটা যথাযথভাবে হওয়া সম্ভব। অন্তঃকরণে উদ্ভূত কোনো কোনো জ্ঞানের‘ যথাযথ’ স্থানান্তর ও যার কাছে স্থানান্তরিত হয় তার পক্ষে তা যথাযথভাবে ধারণ করতে পারা‘ প্রায় অসম্ভব’ ব্যাপার। অবস্তুগত সমুন্নত সত্তা ও জগতসমূহ সংক্রান্ত জ্ঞান এ পর্যায়ের।
অন্যদিকে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের বিষয়টি ভিন্ন ধরনের। প্রকৃত পক্ষে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়নিচয় দ্বারা যে তথ্য আহরণ করে , বা প্রচলিত কথায় , যে জ্ঞান অর্জন করে , তা হুবহু অন্যের মাঝে স্থানান্তরিত করতে পারে না , কেবল এ সংক্রান্ত একটা প্রতীকী ধারণা স্থানান্তরিত করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ , কোনো ব্যক্তি যখন একটি সুন্দর দৃশ্য দেখার পর তা অন্যের নিকট মুখে বা লিখে বর্ণনা করে তখন তার পক্ষে পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতাকে হুবহু নিজের অভিজ্ঞতা প্রদান করা সম্ভব হয় না ; প্রতীকী শব্দাবলীর সাহায্যে ধারণা প্রদান করা সম্ভব হয় মাত্র। অবশ্য বর্ণনা যত নিখুঁত হবে পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতার পক্ষে স্বীয় কল্পনানেত্রে ততটাই কাছাকাছি দৃশ্য রচনা করা সম্ভব হবে। কিন্তু কখনোই তা বক্তার বা লেখকের দেখা দৃশ্যের হুবহু অনুরূপ হবে না। এমনকি তার ভিডিও-চিত্র প্রদর্শন করা হলেও ভিডিও-দর্শনকারীর জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর ন্যায় হুবহু জ্ঞান অর্জিত হবে না। কারণ , সংশ্লিষ্ট চলমান দৃশ্যাবলী ও শব্দ ( sound) ছাড়াও সেখানকার পরিবেশগত অনেক বিষয় , ধরুন বাতাসের স্পর্শ ইত্যাদি অনেক কিছু ব্যক্তির অভিজ্ঞতায় শামিল থাকে যা চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত থাকে।
তেমনি একটি সুর , কোনো বস্তুর স্বাদ , কোনো কিছুর ঘ্রাণ ও কোনো বস্তুর স্পর্শের অনুভূতি সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ এগুলো মৌখিক বা লিখিত বর্ণনা , এমনকি রেকর্ড বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমেও হুবহু পাঠক-পাঠিকা বা শ্রোতার কাছে স্থানান্তরিত করা সম্ভবপর হয় না , কেবল এ সংক্রান্ত ধারণা প্রদান করা সম্ভব হয় মাত্র। যদিও লেখ্য বা মৌখিক বর্ণনার তুলনায় রেকর্ড বা চলচ্চিত্রের সাহায্যে প্রদত্ত ধারণা বাস্তবতার অধিকতর কাছিাকাছি হয়ে থাকে , কিন্তু তা হুবহু অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর অনুভূতির ন্যায় হয় না। আর পরীক্ষাগারে হাতে-কলমে পরীক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান দেয়া হয় মূলতঃ তা আর উদ্ধৃত জ্ঞান থাকে না , বরং জ্ঞান গ্রহণকারীর জন্যও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হয় , যদিও অন্য একজন তাকে সাহায্য করেছে বা ইতিপূর্বে সে অন্যের কাছ থেকে যে উদ্ধৃত জ্ঞান পেয়েছে তা থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য নিয়েছে।
ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দু’ টি শর্ত বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য। প্রথমতঃ গ্রহীতার সংশ্লিষ্ট ইন্দ্রিয় অর্থাৎ তার যে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অন্যের ইন্দ্রিয় দ্বারা সংগৃহীত তথ্যাদি তার মধ্যে স্থানান্তরিত করা হবে সে ইন্দ্রিয়টি অক্ষত ও অবিকৃত থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ গ্রহীতার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বর্ণনার বিষয়বস্তুর অনুরূপ বিষয়বস্তু বা তার কাছাকাছি বিষয় সম্পর্কে পূর্বাহ্নিক ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকতে হবে। কেবল তাহলেই গ্রহীতার পক্ষে স্বীয় অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে অন্যের অভিজ্ঞতাভুক্ত বিষয় সম্পর্কে কোনো না কোনো পর্যায়ের ধারণা লাভ করা সম্ভব , অন্যথায় নয়। যেমন: চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে বর্ণনার দ্বারা একটি‘ দৃশ্য’ সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা দেয়া সম্ভব। ধরুন , যে ব্যক্তি তাজমহল দেখে নি তাকে বর্ণনার দ্বারা তাজমহল সম্পর্কে তাজমহল-দর্শকের অনুরূপ ধারণা দেয়া সম্ভব নয় , তবে মোটামুটি ধারণা দেয়া সম্ভব । অবশ্য বর্ণনার সাথে সাথে ছবি দেখানো হলে দর্শক-শ্রোতার এতদসংক্রান্ত জ্ঞান উন্নততর ও অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর অধিকতর কাছাকাছি হবে। আর রঙিন ছবি ও ভিডিও-চিত্রের সাহায্যে পর্যায়ক্রমে অধিকতর উন্নত স্তরের ধারণা দেয়া ও তার এ সংক্রান্ত জ্ঞানকে অভিজ্ঞতা অর্জনকারীর জ্ঞানস্তরের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব হবে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও তার জ্ঞান হুবহু তাজমহল-পরিদর্শনকারীর এতদসংক্রান্ত জ্ঞানের অনুরূপ হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তির চোখ নেই তাকে , বিশেষতঃ জন্মান্ধকে তাজমহলের সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোনো ধারণাই দেয়া সম্ভব হবে না।
অন্যান্য ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও এটা সত্য।
অবশ্য বর্ণিত সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানের ভিত্তিতে তৈরী পটভূমিকার কারণে ব্যক্তি বর্ণনাকারীর অনুরূপ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য উদ্যোগী হতে পারে। যেমন: সে তাজমহলের সৌন্দর্য দেখতে যেতে পারে , সমুদ্রের শো-শো শব্দ শোনার জন্য সমুদ্রে যেতে পারে , যে নতুন ফলের প্রশংসা সে শুনেছে তা সংগ্রহ করে খেয়ে দেখতে পারে। সে ক্ষেত্রে তার এতদসংক্রান্ত জ্ঞান আর বর্ণনাসূত্রে লব্ধ জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না , বরং ইন্দ্রিয়লব্ধ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হলো।
অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান
জ্ঞানকে অন্য এক বিবেচনায় দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: বিচারবুদ্ধি দ্বারা আয়ত্তযোগ্য জ্ঞান (علم تعقلی ) ও অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান (علم تعبدی ) । সহজাত জ্ঞান , ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান , অভিজ্ঞতালব্ধ বা পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান এবং অনেক উদ্ধৃত জ্ঞানই প্রথমোক্ত ধরনের জ্ঞানের মধ্যে শামিল। আর দ্বিতীয়োক্ত ধরনের জ্ঞান যদিও পুরোপুরিভাবে বিচারবুদ্ধির ধারণক্ষমতার বহির্ভূত নয় , তবে তা সর্বজনীন নয়। তাই এ জ্ঞান যার আছে তাঁর কাছ থেকে অন্ধভাবে গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। উদাহরণস্বরূপ , লাওহে মাহফূযের কথা ধরা যাক। এ ক্ষেত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত কোরআন মজীদের তথ্য মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ , সংশ্লিষ্ট তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করা বিচারবুদ্ধির আওতাবহির্ভূত ব্যাপার।
এ পরিভাষা দু’ টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা পরিবর্তিত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তা হচ্ছে , যে তথ্য কেবল বিশেষজ্ঞদের পক্ষেই জানা সম্ভব তা তাঁদের জন্য বিচারবুদ্ধির আয়ত্তাধীন জ্ঞান (علم تعقلی ) এবং সাধারণ মানুষদের জন্য অন্ধভাবে গ্রহণীয় জ্ঞান (علم تعبدی ) । কারণ , এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞের কথা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের কথা চোখ বুঁজে মেনে নেয়ার আগে স্বীয় বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিশেষজ্ঞকে অর্থাৎ প্রকৃতই তিনি বিশেষজ্ঞ , নাকি বিশেষজ্ঞ হবার মিথ্যা দাবীদার তা পরীক্ষা করে দেখে নিশ্চিত হতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ মিথ্যা বলবেন না সে ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে বা প্রত্যয়ে উপনীত হতে হবে। যেমন: আমরা যখন অসুস্থ হই তখন চিকিৎসকের কাছে যাই , তবে বিচারবুদ্ধি নির্দেশিত বিভিন্ন পন্থায় , যেমন: চিকিৎসাক্ষেত্রে খ্যাতি , সার্টিফিকেট , সরকারী নিবন্ধন ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হই যে , ঐ ব্যক্তি চিকিৎসক হবার মিথ্যা দাবী করছেন না ; এ কারণেই নিশ্চিন্ত মনে তাঁর কাছে যাই।
অন্যদিকে সর্বজনীন বিচারবুদ্ধির ধারণযোগ্য বিষয়ে অন্যের কথা মেনে নেয়া এবং বিশেষজ্ঞ হবার দাবীদার ব্যক্তির গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে বিচারবুদ্ধির দ্বারা বিচার বা অনুসন্ধান পূর্বক নিশ্চিত না হয়েই তার কথা মেনে নেয়া বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে নিন্দনীয় কাজ। এরূপ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষজ্ঞত্বের দাবীদার ব্যক্তির কাছ থেকে যে ধারণা লাভ করে তাকে নেতিবাচক ও নিন্দনীয় অর্থেتعبد বা অন্ধ বিশ্বাস বলা হয়। বস্তুতঃ এ ধরনের অন্ধ বিশ্বাস জ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না।
কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে জ্ঞানমাধ্যম
সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য বিচারবুদ্ধির পর্যালোচনায় যে জ্ঞানমাধ্যমগুলোর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে তা হচ্ছে: সহজাত প্রবণতা , বিচারবুদ্ধি , ইন্দ্রিয়নিচয় ও অন্তঃকরণ বা হৃদয় (قلب ) । এ মাধ্যমগুলো এমন যে , এগুলোকে আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই জ্ঞানমাধ্যমরূপে স্বীকার করতে বাধ্য , অবশ্য কেউ গোঁয়ার্তুমি করে বা অন্ধভাবে এর মধ্য থেকে কোনোটিকে অস্বীকার করতে চাইলে সে কথা স্বতন্ত্র এবং তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমরা কোরআন মজীদেও জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে এগুলোর উল্লেখ দেখতে পাই।