ওয়াহাবীদের সৃষ্ট সংশয়ের অপনোদন

লেখক: আলী আসগার রেজওয়ানী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব
লেখক: আলী আসগার রেজওয়ানী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: ইসলামী সেবা দপ্তর,কোম,ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব
সাহাবীদের জীবন ও কর্মে রাসূল (সা.)-এর কবর জিয়ারত
আমরা সাহাবী,তাবেয়ী ও ইসলামের প্রথম সারির অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের কর্মধারায় মহানবীর কবর জিয়ারতের রীতি লক্ষ্য করি। এরূপ কয়েকটি নমুনা এখানে উপস্থাপন করছি।
১।হযরত ফাতিমাতুজ যাহরা ( আ.) : হযরত আলী (আ.) বলেছেন : মহানবীর দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর ফাতিমা জাহরা (আ.) তাঁর পিতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এক মুঠো কবরের মাটি নিয়ে নিজ চোখে স্পর্শ করলেন এবং ক্রন্দনরত অবস্থায় নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করলেন১৩৯ :
ماذا علی من شمّ تربة احمد
ان لا يشمّ علی الزمان غوالیا
صبت علیَّ مصائب لو أنها
صبَّت علی الایام عدن لیالیا
২।হযরত বেলাল ( রা.) : হযরত বেলাল রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সিরিয়ায় হিজরত করেন। একরাত্রে তিনি মহানবী (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলেন যে,তিনি তাঁকে বলছেন,‘ হে বেলাল! আমার প্রতি দায়িত্বের ক্ষেত্রে এটি তোমার কিরূপ অবহেলা? তোমার কি আমাকে জিয়ারতের সময় আসে নি? হযরত বেলাল অস্থির হয়ে ঘুম থেকে জাগলেন ও দ্রুত প্রস্তুত হয়ে বাহনে আরোহণ করে মদীনার দিকে যাত্রা করলেন। মদীনায় পৌঁছেই তিনি রাসূলের কবরের নিকট গিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন ও নিজের গণ্ডদেশ কবরের উপর রাখলেন।১৪০
৩।আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর : সামহুদী বর্ণনা করেছেন,‘ আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর যখনই কোন সফর হতে ফিরতেন রাসূলের কবরের নিকট গিয়ে সালাম দিতেন।১৪১
৪।হযরত আবু আইয়ুব আনসারী : হাকিম নিশাবুরী বর্ণনা করেছেন,‘ একদিন মারওয়ান ইবনে হাকাম মহানবীর কবরের নিকট গিয়ে দেখল এক ব্যক্তি রাসূলের কবরের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে (ও ক্রন্দন করছে)। মারওয়ান ঐ ব্যক্তির ঘাড় ধরে উঠিয়ে বলল,‘ জান তুমি কি করছ?’ কিন্তু পরক্ষণেই তাকিয়ে দেখল তিনি রাসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী। আবু আইয়ুব আনসারী তার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘ আমি কোন পাথরের নিকট আসি নি,আমি আল্লাহর রাসূলের নিকট এসেছি।১৪২
আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণের কবর জিয়ারত মুস্তাহাব হওয়ার দলিল
রাসূলের পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ তাঁদের অনুসারীদের তাঁদের কবরসমূহ জিয়ারত করতে বলেছেন। এরূপ কয়েকটি হাদীস এখানে উল্লেখ করছি।
১। শেখ তূসী ইমাম আলী ইবনে মূসা (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন,‘ প্রত্যেক ইমামেরই তাঁর অনুসারীদের উপর অধিকার ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই প্রতিশ্রুতি তাঁদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে পূর্ণরূপে পালিত হয়।১৪৩
২। মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিম ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি বলেছেন,‘ আমাদের অনুসারীদের ইমাম হুসাইন ইবনে আলীর কবর জিয়ারতের উপদেশ দিচ্ছি। কারণ প্রতিটি মুমিনের জন্য ইমাম হুসাইনের ইমামতের সাক্ষ্য প্রদান ও তাঁর স্বীকারোক্তি মহান আল্লাহর পক্ষ হতে ওয়াজিব করা হয়েছে।’ ১৪৪
৩। আলী ইবনে মাইমুন বলেছেন,‘ ইমাম সাদিক (আ.) হতে শুনেছি,‘ যদি তোমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি এক হাজার বার হজ্জ্ব পালন করে,কিন্তু ইমাম হুসাইনের কবর জিয়ারত না করে,আল্লাহর অধিকারসমূহের একটি অধিকারকে পালন করে নি (অর্থাৎ ত্যাগ করেছ)।’ এরূপ কেন হবে সে সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন,‘ প্রতিটি মুসলমানের উপর ইমাম হুসাইনের অধিকার রয়েছে।’ ১৪৫
কবর জিয়ারতের নিয়তে সফরের শরীয়তগত বৈধতা
পূর্বে আমরা ওয়াহাবী আলেমদের ফতোয়ার আলোচনায় উল্লেখ করেছি তাদের সাম্প্রতিক আলেমগণ কবর জিয়ারতকে বৈধ মনে করলেও কবর জিয়ারতের নিয়তে যাত্রাকে বৈধ ও জায়েয মনে করেন না,বরং একে‘ বিদআত’ বলে অভিহিত করেছেন,এমনকি যদি তা রাসূল (সা.)-এর কবর জিয়ারতের নিয়তেও হয়। তবে ইবনে তাইমিয়া কবর জিয়ারতকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফতোয়া দিয়েছেন।
এখন আমরা কবর জিয়ারতের নিয়তে (বিশেষত রাসূলের কবর জিয়ারত) সফরের শরীয়তগত (শারয়ী) বৈধতাকে প্রমাণ করব :
১। মহান আল্লাহ বলেছেন :
( وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا)
আয়াতটিতে১৪৬ ‘ جاءوک ’ বলা হয়েছে যাতে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী সকল স্থান হতে রাসূলের নিকট গমনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়।
২। যে হাদীসটিতে মহানবী (সা.) বলেছেনمن زار قبری তাতে জিয়ারতের শব্দটিও নিকট ও দূরবর্তী উভয় স্থানকে শামিল করবে। বিশেষত যে হাদীসটিতে ইবনুস সাকান সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন তাতে উল্লেখও হয়েছেمن جائنی زائراً অর্থাৎ যে আমার নিকটে আসবে জিয়ারতকারী হিসেবে যা জিয়ারতের সফরের প্রতিই ইঙ্গিত করছে। বাহ্যিকভাবে তা হতে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর বোঝা যায়।
৩। কোন কোন হাদীস হতে স্পষ্টভাবে অথবা বাক্যের ধরন হতে জিয়ারত মুস্তাহাব ও জায়েয হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়,এমনকি জিয়ারতের নিয়ত করা ও জিয়ারতের নিয়তে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সে উদ্দেশ্যে যাত্রার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়।
মুসলিম ও অন্যান্যরা সহীহ সনদে বুরাইদা আসলামী হতে বর্ণনা করেছেন মহানবী (সা.) বলেছেন :‘ আমি তোমাদেরকে আমার কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম,কিন্তু আমাকে আমার মাতার কবর জিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন হতে তোমরাও কবর জিয়ারত কর,তা তোমাদের আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।’ ১৪৭
মহানবী (সা.) বলেছেন,‘ আমাকে আমার মাতার কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে’ - বাক্যটি হতে বোঝা যায় কোন স্থান হতে জিয়ারতের নিয়তে বের হতে কোন অসুবিধা নেই।
সামআনী ইমাম আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন যে,এক আরব বেদুইন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর দাফনের তিনদিন পর মদীনায় প্রবেশ করে সরাসরি তাঁর কবরের নিকট গিয়ে তাঁর কবরের উপর উপুড় হয়ে মাটি উঠিয়ে নিজের মাথার উপর ফেলতে লাগল এবং তাঁর উদ্দেশে বলল,‘ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের উদ্দেশে বলেছেন এবং আমরাও আপনার কথা শুনেছি। আপনি আল্লাহর নিকট হতে কোরআনের আয়াত গ্রহণ করেছেন এবং আমরা আপনার নিকট থেকে তা গ্রহণ করেছি। আপনার উপর অবতীর্ণ আয়াতের একটি হলোولو أنّهم إذ ظلموا أنفسهم جاءوک ... আমি আমার উপর জুলুম (অনিষ্ট সাধন) করেছি। এখন আপনার নিকট এসেছি,আমার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুন।১৪৮
হযরত বেলালের স্বপ্ন দেখা এবং সিরিয়া থেকে মদীনার উদ্দেশে রাসূলের জিয়ারতের লক্ষ্যে যাত্রার বিষয়টি যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি,কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রার বৈধতাকে ভালোভাবেই প্রমাণ করে।১৪৯
সাবকী বর্ণনা করেছেন,‘ খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ প্রায়শই সিরিয়া হতে কাউকে না কাউকে মদীনায় তাঁর পক্ষ হতে জিয়ারত করতে ও রাসূলের প্রতি সালাম দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করতেন।১৫০
খাতিব বাগদাদী হাম্বালী ফিকাহর শীর্ষস্থানীয় আলেম আবি আল খাল্লাল হতে বর্ণনা করেছেন যে,তিনি তাঁর সময়ে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যায় হযরত মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর কবর জিয়ারতের নিয়ত করতেন ও সে উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন। তিনি তাঁর প্রতি তাওয়াসসুল করতেন (অর্থাৎ তাঁর মধ্যস্থতায় ও মর্যাদার শানে আল্লাহর নিকট চাইতেন)। ফলে তাঁর সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।১৫১
পূর্বে উল্লিখিত আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে মুয়াম্মালের বর্ণনা হতেও আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রার বৈধতা প্রমাণিত হয়।১৫২
তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ্ও বর্ণনা করেছেন যে,রাসূল (সা.) সাহাবীদের নিয়ে ওহুদের শহীদদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে গিয়েছেন।১৫৩
হযরত আয়েশা বলেছেন,‘ যে রাতগুলোতে আমার পালা থাকত এবং রাসূল (সা.) আমার ঘরে থাকতেন শেষ রাত্রিতে তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে কবর জিয়ারতে যেতে দেখতাম।১৫৪
উপরিউক্ত হাদীসগুলো থেকে কবর জিয়ারতের নিয়তে যাত্রা শুধু জায়েযই নয়,এমনকি মুস্তাহাব হওয়ার বিষয়টিও প্রমাণিত হয়।
৪। মুসলমানদের ইতিহাসের ধারায় এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে,তারা আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন।
৫। আহলে সুন্নাতের সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহে রাসূল (সা.) হতে অসংখ্য বর্ণনায় বলা হয়েছে,যদি কেউ মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ ফেলে তার প্রতি পদে মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ও তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করা হয়।১৫৫
এই সওয়াব লাভের বিষয়টি মসজিদে অবস্থানের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে যাত্রা ও পদক্ষেপ গ্রহণের কারণেই ঘটে থাকে,তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে তাঁর ওলীদের কবর জিয়ারতের প্রস্তুতি গ্রহণ ও এজন্য যাত্রাও আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়।
কবর জিয়ারত হারাম হওয়ার বিষয়গুলোতে ওয়াহাবীদের দলীল
কবর জিয়ারত হারাম হওয়ার বিষয়ে [এমনকি রাসূল (সা.)-এর কবরও] ওয়াহাবীদের প্রধান দলিল হলো আবু হুরাইরা বর্ণিত এ হাদীসটি : রাসূল (সা.) বলেছেন :‘ তিনটি মসজিদ,যথা মসজিদুল হারাম,মসজিদুন নবী ও মসজিদুল আকসা ব্যতীত অন্য কোন স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা কর না।’ ১৫৬
তাদের উপস্থাপিত এই দলিলের জবাবে বলব,এই হাদীসে তিনটি স্থানকে ব্যতিক্রম ধরা হয়েছে অর্থাৎ আরবী ব্যকরণের ভাষায়‘ মুসতাসনা মিনহু’ র অনুবর্তী।‘ মুসতাসনা মিনহু’ অর্থাৎ যার হতে ব্যতিক্রম করা হয়েছে তা দু’ ধরনের হতে পারে।
প্রথমত মুসতাসনা মিনহু‘ مسجد من المساجد ’ অর্থাৎ মসজিদসমূহের মধ্যে তিনটি মসজিদ ব্যতিক্রম। সেক্ষেত্রে হাদীসটির অর্থ হবে : মসজিদগুলোর মধ্যে তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্যগুলোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বৈধ ও জায়েয নয়।
দ্বিতীয়ত যদি‘ মুসতাসনা মিনহু’ স্থানসমূহ হয়,সেক্ষেত্রে স্থানসমূহের মধ্যে তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে ছাড়া যাত্রা করা জায়েয নয়।
প্রথম অর্থে মহানবী (সা.)-এর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রার ক্ষেত্রে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। কারণ মহানবীর কবর মসজিদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
দ্বিতীয় অর্থে নিষেধাজ্ঞা সার্বিক হয়ে পড়ে,সেক্ষেত্রে যে কোন ধরনের সফরই নিষিদ্ধ হয়ে যায়,এমনকি যদি তা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নাও হয়। কোন ব্যক্তিই এরূপ নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বাসী নয়।
তাই আমরা বলতে পারি,যদি হাদীসটি সহীহ ও সঠিক হয়ে থাকে তবে রাসূলের ঐ নিষেধ নিষিদ্ধ ঘোষক নয়,বরং উপদেশমূলক এ অর্থে যে,যেহেতু প্রত্যেক শহরেই মসজিদ রয়েছে তাই অন্য শহরের মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা বাঞ্ছনীয় নয় ও অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু আল্লাহর ওলীগণের কবর জিয়ারত এরূপ নয়। উপরন্তু তাঁদের কবর জিয়ারতের বরকত ও আধ্যাত্মিক ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করব।
গাজ্জালী এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন :‘ সফর করা একটি মুস্তাহাব ইবাদত। যেমন আল্লাহর নবী,সাহাবী,তাবেয়ী,ওলীগণ ও আলেমদের কবর জিয়ারত। সার্বিকভাবে যে সকল ব্যক্তির জীবদ্দশায় তাঁদের হতে বরকত ও আধ্যাত্মিক ফায়দা লাভ করা যায় তাঁদের মৃত্যুর পরও কবর জিয়ারতের মাধ্যমে তাঁদের হতে বরকত ও ফায়দা লাভ করা যায়। তাই এ উদ্দেশ্যে যাত্রা বৈধ ও জায়েয। এ বিষয়টির সাথে মহানবী (সা.) হতে উদ্ধৃত হাদীসটির-তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করো না-কোন বৈপরীত্য নেই। কারণ হাদীসটি মসজিদ সম্পর্কিত এবং সকল মসজিদ মর্যাদার দিক থেকে পরস্পর সমান। তাই একটির উপর অপরটির কোন প্রাধান্য নেই যে,তার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে তিনটি মসজিদের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশেষত্ব রযেছে,তাই সেগুলোর উদ্দেশ্যে যাত্রার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা নেই। আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা এ বিষয়টি হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন।১৫৭
ডক্টর আবদুল মালিক সাদী বলেছেন :‘ অন্য সকল মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা নিষেধ এজন্য যে,এরূপ কর্ম অর্থহীন যেহেতু সকল মসজিদের সওয়াব সমান,তিনটি মসজিদ ব্যতীত।’ ১৫৮
কবর জিয়ারত ও নারিগণ
ওয়াহাবীরা যদিও জিয়ারতের নিয়তে যাত্রা ব্যতীত কবর জিয়ারতকে পুরুষদের জন্য জায়েয মনে করে,কিন্তু নারীদের জন্য কোনভাবেই কবর জিয়ারত জায়েয মনে করে না।
দ্বীনি মাসয়ালার জবাব দানের জন্য গঠিত ওয়াহাবীদের স্থায়ী সদস্য কমিটি ঘোষণা করেছে‘ কবর জিয়ারত কেবল পুরুষদের জন্য জায়েয,তদুপরি তা সে উদ্দেশ্যে যাত্রার নিয়ত ব্যতীত হতে হবে। কিন্তু নারীদের জন্য কোন কবর জিয়ারত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।১৫৯
শেখ আবদুল আজিজ বিন বায বলেছেন :‘ কবর জিয়ারত নারীদের জন্য জায়েয নয়। কারণ রাসূল (সা.) যে সকল নারী কবর জিয়ারতে যায় তাদের উপর অভিশাপ কামনা করেছেন।’ ১৬০
অন্যত্র এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে বলেছে,‘ যেহেতু নারীদের ধৈর্যশক্তি কম,সেহেতু তারা কবরের নিকট আবেগতাড়িত হয়ে মর্সিয়া পাঠ করে ও তাদের মুখ হতে ধৈর্যের পরিপন্থী কথা বেরিয়ে আসে।’ ১৬১
এই আপত্তির জবাবে আমরা বলব : প্রথমত এই ফতোয়া রাসূলের সাহাবীদের ফতোয়া ও আচরণনীতির পরিপন্থী। কারণ হযরত ফাতিমা (আ.) রাসূলের জীবদ্দশায় প্রতি শুক্রবার (জুমআর দিনে) হযরত হামজা (রা.)-এর কবর জিয়ারতে যেতেন। তিনি তাঁর পিতা রাসূলের ইন্তেকালের পর স্বীয় পিতার কবর জিয়ারতে নিয়মিত যেতেন। প্রথম ক্ষেত্রে স্বয়ং রাসূল (সা.) তাঁর এ কর্মে বাধা দেন নি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.) ও অন্যান্য সাহাবী তাঁকে নিষেধ করেন নি। ইবনে আবি মালিকা বলেছেন,‘ আমি হযরত আয়েশাকে তাঁর ভ্রাতা আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরের কবর জিয়ারতে নিয়মিত যেতে দেখতাম।’ ১৬২
দ্বিতীয়ত‘ হে আল্লাহ কবর জিয়ারতকারী নারীর উপর অভিশাপ বর্ষণ কর’ - এ হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল। যে তিনটি সনদে,যথা: হাসসান ইবনে সাবেত,ইবনে আব্বাস ও আবু হুরাইরা হতে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তিনটি সূত্রেই দুর্বল রাবী (হাদীস বর্ণনাকারী) রয়েছেন।
তৃতীয়ত এ হাদীস হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত হাদীসের (রাসূল কবর জিয়ারত নিষেধ করেছিলেন,কিন্তু পরে অনুমতি দিয়েছেন) পরিপন্থী।
চতুর্থত যদি নারীদের কম ধৈর্যের কারণে কবর জিয়ারত হতে তাদের নিষেধ করা হয়ে থাকে তবে যে সকল নারীর ধৈর্য অধিক ও আপত্তিজনক কথা তাদের মুখ হতে বের হয় না,তাদের ক্ষেত্রে জিয়ারত নিষিদ্ধ নয়। কারণ হারাম হওয়ার প্রাথমিক শর্ত তাদের মধ্যে নেই। হারাম তখনই হবে যখন কোন জায়েয কর্ম নিশ্চিতরূপে মানুষকে হারামে ফেলে। তাই আহলে সুন্নাতের অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিই নারীদের কবর জিয়ারকে ধৈর্যধারণের শর্তে জায়েয বলেছেন।
কবর জিয়ারতের ইতিবাচক প্রভাবসমূহ
কবর জিয়ারত মানুষকে কোন অন্যায়ে তো ফেলেই না,বরং কোন কোন হাদীসে এর কল্যাণমূলক প্রভাবের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এখানে আমরা এরূপ কয়েকটির প্রতি ইশারা করছি :
১। জিয়ারতকারীর মধ্যে বিনয় সৃষ্টি করে এবং মৃত্যু ও আখেরাতের স্মরণ করায়;সন্দেহ নেই মৃত ব্যক্তিদের কবর জিয়ারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো আখেরাতের স্মরণ।
মুসলিম,আহমাদ ইবনে হাম্বাল,ইবনে মাজা এবং অন্যান্য হাদীসগ্রন্থ প্রণেতা নিজ নিজ সূত্রে রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,‘ তোমরা কবর জিয়ারতে যাও,কেননা তা তোমাদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’ ১৬৩
২। মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া : এ বিষয়টি একটি উন্নত নৈতিক পদ্ধতি যা মৃত্যুর পরও সমাজে একজন মুসলমানের মর্যাদাকে রক্ষা ও সমুন্নত রাখার প্রমাণ বহন করে। উপরন্তু সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ,ভালোবাসা,পারস্পরিক সম্প্রীতি ও অধিকার রক্ষার মনোবৃত্তিকে জাগরুক রাখে।
মহানবী (সা.) বলেছেন,‘ তোমাদেরকে আমি কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু এখন হতে তোমরা কবর জিয়ারত কর এবং তাদের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ ১৬৪
৩। মৃতের অধিকার রক্ষা : নিঃসন্দেহে কোন কোন মৃত ব্যক্তি জীবিতদের উপর বিশেষ অধিকার রাখেন। এই অধিকারের দাবী হলো জীবিতরা তাঁদের কবর জিয়ারত করবে। ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন,‘ প্রতি ইমামের তাঁদের অনুসারীদের উপর অধিকার ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে যা পালনের সর্বোত্তম পন্থা হলো তাঁদের কবর জিয়ারত।’ ১৬৫
আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের দর্শন
আল্লাহর ওলীদের বিশেষত মহানবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের কবর জিয়ারতের বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রভাব ও বরকত রয়েছে। এখানে আমরা আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারতের কিছু আত্মিক প্রভাবের উল্লেখ করছি:
১। আল্লাহর ওলী ও ধর্মীয় ব্যক্তিগণ প্রকৃতপক্ষে সকলের আদর্শ যাদের অনুসরণের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভ ও পূর্ণতায় পৌঁছা যায়। শুধু মুসলিম সমাজেই নয়,বরং যে কোন সমাজেই তাঁদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদের মহৎ হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস চালায় যাতে করে অন্যরাও তাঁদের অনুসরণের মাধ্যমে পূর্ণতা ও সাফল্যের পথে পা রাখতে পারে। যদিও এই অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গ জীবিত নেই কিন্তু তাঁদের কবর ও স্মৃতি সৌধে গমনের আহ্বান তাঁদের পথে চলতে অন্যদের অনুপ্রাণিত করে।
অনেক দেশেই কোন বিশেষ চত্বর বা ভাস্কর্যকে নাম না জানা আত্মত্যাগী সৈনিকদের নামে নামকরণ করা হয়। কারণ তারা দেশ প্রেমের প্রতীক এবং এ পথে নিজ জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছে। এ কর্মের মাধ্যমে ঐ জাতি চায় নতুন প্রজন্মকে তাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বহিঃশত্রুর হাত হতে দেশ রক্ষার মহান ব্রত নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
জাতির মহান ব্যক্তিবর্গ ও আদর্শ নেতাদের কবরের নিকট যাওয়ার বিশেষ আত্মিক প্রভাব রয়েছে মনস্তত্ত্ববিদগণ এ বিষয়ের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন।
আব্বাস মাহমুদ আক্কাদ বলেছেন : সময়ের পরিক্রমায় এমন দিন আসল যখন হুসাইন (আ.)-এর জন্য সকল পথ রুদ্ধ করে কারবালার দিকে যেতে তাঁকে বাধ্য করা হল। আজ পর্যন্ত কারবালার ইতিহাস ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে,প্রকৃত প্রস্তাবে তা মানবজাতির ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়েছে।
কারবালা বর্তমানে এমন এক স্থানে পরিণত হয়েছে,যেখানে মুসলমানগণ শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে জিয়ারতে যায়। এমনকি অমুসলমানরাও সেখানে ভ্রমণ ও দর্শনের উদ্দেশ্যে যায়। কিন্তু কারবালার অধিকার তখনই আদায় হবে যখন তা মানুষের জন্য পবিত্রতা ও মর্যাদায় বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তির জিয়ারতের স্থানে পরিণত হবে। কারণ আমার এমন কোন স্থানের কথা জানা নেই যা কারবালার ন্যায় মানবতার সকল মর্যাদাপূর্ণ ও ইতিবাচক সুন্দর দিকের স্মৃতি বহন করছে এবং এ বৈশিষ্ট্য সেটি ইমাম হুসাইনের শাহাদাতের মাধ্যমে অর্জন করেছে।১৬৬
২। জিয়ারত ভালবাসার প্রকাশ ও প্রতিচ্ছবি সন্দেহ নেই। আহলে বাইতের ভালবাসা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের উপর ওয়াজিব। মহানবী (সা.) বলেছেন :أحبُّوا اهل بیتی لِحُبّی ‘ আমার আহলে বাইতকে আমার ভালবাসার কারণে ভালবাস।’ ১৬৭
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ভালবাসা যেমনি ওয়াজিব তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ভালবাসাও তদ্রুপ ওয়াজিব। আমরা জানি ভালবাসার অবশ্যই প্রকাশ আছে যা শুধু তাঁদের আনুগত্য ও আন্তরিক ভালোবাসা পোষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের কবর জিয়ারতও ঐ আন্তরিক ভালোবাসার প্রকাশ।
৩। মহানবী (সা.) আহলে বাইতের পবিত্র ব্যক্তিদের কবর জিয়ারত তাঁর রেসালতের দায়িত্বে একরূপ বিনিময় স্বরূপ। মহান আল্লাহ বলেছেন,
( قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى)
“ ( হে নবী!) বলুন, আমি আমার রেসালতের দায়িত্বের বিনিময় স্বরূপ আমার নিকটাত্মীয়ের ভালবাসা ব্যতীত কিছুই চাই না। ” ১৬৮
রাসূলের নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা পোষণের অন্যতম প্রকাশ হলো তাঁদের কবর জিয়ারত।
৪। আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারত তাঁদের অনুসৃত পথের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গভীরতার নিদর্শন।
৫। আল্লাহর ওলিগণের কবর জিয়ারত বাস্তবিক ভাবে তাঁদের সঙ্গে নতুন করে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হওয়া যে,তাঁদের আদর্শ ও পথকে আমরা চিরজাগরুক রাখব। আমরা জানি আহলে বাইতের ইমামগণ আমাদের উপর অধিকার ও অভিভাবকত্ব রাখেন। তাই আমাদেরও উচিত তাঁদের অভিভাবকত্ব ও আমাদের উপর অধিকারকে মেনে নিয়ে তাদের সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। এই প্রতিশ্রুতি শুধু মুখে ঘোষণার মাধ্যমে নয়,বরং নিজেদের কর্মের মাধ্যমে এই আন্তরিক প্রতিশ্রুতির প্রকাশ ঘটাব। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁদের কবর জিয়ারত ও তাঁদের রওজায় উপস্থিতির মাধ্যমে এই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি ঘটাব। এ কারণেই ইমাম রেজা (আ.)-এর হাদীসে এসেছে- নিশ্চয়ই প্রতি ইমামের তাঁদের অনুসারীদের উপর অধিকার ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে যা রক্ষা ও পালনের সর্বোত্তম পন্থা হলো তাঁদের কবর জিয়ারত করা।’ ১৬৯
৬। আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারত মানুষের আধ্যাত্মিকতাকে বৃদ্ধি করে ও হৃদয়ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে।
৭। আল্লাহর ওলীদের কবর জিয়ারত তাঁদের সন্তুষ্টির কারণ হয় এবং তাঁদের দোয়ার ফলে ঐশী বরকত জিয়ারতকারীর উপর অবতীর্ণ হয়।
৮। ওলিগণের কবরের নিকটে গেলে তাঁদের ঐতিহাসিক অবদান ও আত্মত্যাগের কথা সকলের স্মরণ হয় যা তাঁদের অনুসৃত পথে চলার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করে।
৯। সর্বোপরি তাঁদের কবর জিয়ারত তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সন্ধির এবং তাঁদের শত্রুদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা স্বরূপ।
পবিত্র মক্কা নগরীর উত্তরে এ নগরী অবস্থিত। মক্কা থেকে এ নগরীর দূরত্ব 90 ফারসাখ (540 কি.মি.)। এ নগরীর চারপাশে খেজুর ও অন্যান্য ফলের বাগান আছে। মদীনার ভূমি বনায়ন ও চাষাবাদের জন্য অধিকতর উপযোগী।
প্রাক ইসলামী যুগে এ নগরী‘ ইয়াসরিব’(يثرب ) নামে পরিচিত ছিল। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর এ নগরীর নামকরণ করা হয়‘ মদীনাতুর রাসূল’(مدينة الرّسول ) অর্থাৎ রাসূলের নগরী;পরে সংক্ষেপ করার জন্য এর নামের শেষাংশ বাদ দেয়া হলে এ নগরী‘ মদীনা’নামে অভিহিত হয়। ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে,প্রথম যারা এ নগরীতে বসতি স্থাপন করেছিল তারা আমালিকাহ্ (عمالقة ) গোত্রীয় ছিল। এদের পর এখানে ইয়াহুদী,আওস (أوس ) ও খাযরাজ (خزرج ) গোত্র বসতি স্থাপন করে। আওস ও খাযরাজ গোত্র মুসলমানদের কাছে‘ আনসার’(أنصار ) নামে পরিচিত।
একমাত্র হিজায এলাকাই অন্য সকল এলাকার বিপরীতে বহিরাগত বিজেতাদের হাত থেকে সুরক্ষিত ছিল। তৎকালীন বিশ্বের দু’ পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের সভ্যতার নিদর্শন হিজাযে দেখা যায় না। কারণ হিজাযের অনুর্বর ও বসবাসের অযোগ্য ভূমিসমূহ বিজেতাদের কাছে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় তারা সেখানে কোন সেনা অভিযান পরিচালনা করে নি। আর অত্র এলাকায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে যে,হাজারো সমস্যা ও প্রতিকূলতা দেখা দেয়ার পর তাদেরকে অবশ্যই ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে।
এতৎসংক্রান্ত একটি গল্প প্রচলিত আছে। এ গল্পটি ডিওডোরাস (ديودور ) বর্ণনা করেছেন : গ্রীক সেনাপতি ডিমিত্রিউস্ যখন আরব উপদ্বীপ দখল করার জন্য পেট্রা নগরীতে (হিজাযের একটি প্রাচীন নগরী) প্রবেশ করেন তখন সেখানকার অধিবাসীরা তাঁকে বলেছিল,“ হে গ্রীক সেনাপতি! আপনি কেন আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে চান? আমরা বালুকাময় অঞ্চলের অধিবাসী যা জীবনযাপনের সব ধরনের উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত। যেহেতু আমরা কারো বশ্যতা স্বীকার করতে রাজী নই সেহেতু আমরা জীবনযাপনের জন্য এ ধরনের শুষ্ক এবং পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুভূমিকেই বেছে নিয়েছি। অতএব,আমাদের যৎসামান্য উপঢৌকন গ্রহণ করে আমাদের দেশ জয়ের চিন্তা ত্যাগ করুন। আর আপনি যদি আপনার পূর্ব ইচ্ছার ওপর বহাল থাকেন তাহলে আমরা আপনাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই যে,অচিরেই আপনাকে হাজারো সমস্যা ও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আপনার জানা থাকা প্রয়োজন যে,‘ নাবতী’ রা কখনই তাদের জীবনযাত্রা ত্যাগ করবে না। কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করার পর আপনি কতিপয় নাবতীকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে যদি নিজের সাথে নিয়ে যান এরপরও তারা (বন্দীরা) আপনার কোন উপকারে আসবে না। কারণ তারা কুচিন্তা ও কর্কশ আচরণের অধিকারী এবং তারা তাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন করতে মোটেও ইচ্ছুক নয়।”
গ্রীক সেনাপতি তাদের শান্তিকামী আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরব উপদ্বীপে সেনা অভিযান এবং আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলেন।2
2.আরব উপদ্বীপের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় অংশ : এ অংশটি আরব মরুভূমি (صحراء العرب ) নামে পরিচিত।‘ নজদ’(النّجد ) এলাকা এ অংশেরই অন্তর্গত এবং তা উচ্চভূমি। এখানে লোকবসতি খুবই কম। আরব উপদ্বীপে সৌদী রাজবংশের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর তাদের রাজধানী রিয়াদ নগরী আরব উপদ্বীপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
3. আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ- পশ্চিমাংশ : যা ইয়েমেন নামে প্রসিদ্ধ। এ ভূখণ্ডের দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে 750 কি.মি. এবং পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রায় 400 কি.মি.। বর্তমানে এ দেশের আয়তন 60,000 বর্গমাইল। কিন্তু অতীতে এর আয়তন এর চেয়েও বেশি ছিল। এ ভূখণ্ডের একটি অংশ বিগত 50 বছর ধরে ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। এ কারণে ইয়েমেনের উত্তর সীমান্ত নজদ এবং দক্ষিণ সীমান্ত এডেন,পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং পূর্বে আর রুবুল খালী মরুভূমি।3
ঐতিহাসিক সানা (صنعاء ) নগরী ইয়েমেনের অন্যতম প্রসিদ্ধ নগরী। আর আল হাদীদাহ্ (الحديدة ) বন্দর হচ্ছে ইয়েমেনের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বন্দর যা লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত।
ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। এর রয়েছে অত্যুজ্জ্বল সভ্যতা। ইয়েমেন‘ তুব্বা’রাজাদের কেন্দ্রস্থল ছিল। এ তুব্বা রাজবংশ দীর্ঘকাল ইয়েমেন শাসন করেছিল। এ দেশটি ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে ইয়েমেনকে আরব ভূখণ্ডের‘ চৌরাস্তার মোড়’বলে গণ্য করা হতো। ইয়েমেনে অনেক আশ্চর্যজনক স্বর্ণের খনি ছিল। ইয়েমেনের স্বর্ণ,রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর বিদেশে রফতানী করা হতো।
ইয়েমেনের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। যে যুগে মানব জাতির হাতে ভারী কাজ করার যন্ত্রপাতি ছিল না তখন ইয়েমেনের বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠী সাহস করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
ইয়েমেনের সুলতানদের শাসনকর্তৃত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কিন্তু তাঁরা জ্ঞানী-গুণী ও সুধীজন কর্তৃক প্রণয়নকৃত ও গৃহীত সংবিধান বা শাসনকার্য পরিচালনা করার বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা থেকে বিরত থাকতেন না। তারা কৃষি ও উদ্যান ব্যবস্থাপনায় অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর ছিল। তারা জমি চাষাবাদ এবং ক্ষেত-খামার ও বাগানসমূহে সেচ দেয়া সংক্রান্ত সূক্ষ্ম বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবে তা প্রয়োগ করেছিল। এ কারণে তাদের দেশ ঐ সময় অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসাবে গণ্য হতো।
প্রসিদ্ধ ফরাসী ইতিহাসবিদ গোস্তাব লোবোঁ ইয়েমেন সম্পর্কে লিখেছেন :“ সমগ্র আরব উপদ্বীপ জুড়ে ইয়েমেন অপেক্ষা আর কোন উর্বর ও মনোরম অঞ্চল নেই।”
দ্বাদশ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ইদ্রিসী সানা নগরী সম্পর্কে লিখেছেন :“ সেখানে আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেনের রাজধানী অবস্থিত। এ নগরীর প্রাসাদ ও অট্টালিকাসমূহ বিশ্বখ্যাত। শহরের সাধারণ বাড়ি-ঘরও মসৃণ ও কারুকার্যময় পাথর দ্বারা নির্মিত।”
যে সব আশ্চর্যজনক ঐতিহাসিক নিদর্শন প্রাচ্যবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের সর্বশেষ অনুসন্ধান ও খনন কার্যের দ্বারা আবিস্কৃত হয়েছে তা ইয়েমেনের বিভিন্ন এলাকা,যেমন মারাব,সানা ও বিলকীসে ইয়েমেনের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের বিস্ময়কর সভ্যতাকেই প্রমাণ করে।
মারাব শহরে (প্রসিদ্ধ সাবা নগরী) গগনচুম্বী প্রাসাদসমূহের ফটকসমূহ এবং ঐগুলোর খিলান ও তাক স্বর্ণের কারুকার্য দ্বারা সুশোভিত ছিল। এ শহরে প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত পাত্র এবং ধাতুনির্মিত খাট ও বিছানা ছিল।4
মারাবের ঐতিহাসিক নিদর্শনাদির অন্যতম হচ্ছে মারাবের প্রসিদ্ধ বাঁধ যার ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। এ শহরটি জলোচ্ছ্বাসের দ্বারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ জলোচ্ছ্বাসের নাম পবিত্র কোরআনে‘ র্আম’(عرم ) বলা হয়েছে।5
দ্বিতীয় অধ্যায় : প্রাক ইসলামী যুগে আরব জাতি
ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা জানার জন্য নিম্নোক্ত সূত্রসমূহ ব্যবহার করা যেতে পারে :
1. তাওরাত যদিও এতে সকল ধরনের বিকৃতি রয়েছে;
2. মধ্যযুগীয় গ্রীক ও রোমান সাহিত্য ও বিবরণাদি;
3. মুসলিম পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক প্রণীত ইসলামের ইতিহাস;
4. প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও খনন কার্য এবং প্রাচ্যবিদগণের গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি। আর এগুলো সীমিত পরিসরে হলেও বেশ কিছু অজানা বিষয়ের ওপর থেকে রহস্যের জট খুলেছে।
এ সব সূত্র থাকা সত্ত্বেও আরব জাতির ইতিহাসের অনেক দিক ও বিষয় এখনো অস্পষ্ট থেকে গেছে এবং এমন এক ঐতিহাসিক ধাঁধার রূপ পরিগ্রহ করেছে যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু যেহেতু ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির অবস্থা কিরূপ ছিল তা অধ্যয়ন আমাদের অত্র গ্রন্থের ভূমিকার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং আমাদের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মহানবী (সা.)-এর জীবনী বিশ্লেষণ,সেহেতু ইসলামপূর্ব আরব জাতির জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলো খুব সংক্ষেপে আমরা এখানে বর্ণনা করব।
নিঃসন্দেহে আরব উপদ্বীপে সুদূর অতীতকাল থেকেই বহু গোত্র বসতি স্থাপন করেছে। এ সব গোত্রের মধ্য থেকে কতিপয় গোত্র বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু এ ভূখণ্ডের ইতিহাসে কেবল তিনটি প্রধান গোত্র অন্য সকল গোত্রের চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছে। আর এ তিন গোত্র থেকে বহু শাখাগোত্রের উৎপত্তি হয়েছিল। এ গোত্র তিনটি হলো :
1. বায়েদাহ্ (بائدة ) : বায়েদাহ্ শব্দের অর্থ ধ্বংসপ্রাপ্ত। কারণ এ গোত্র অবাধ্যতা ও পাপাচারের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে নিশ্চি হ্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত ধ্বংসপ্রাপ্ত গোত্রগুলো আদ ও সামুদ জাতি হয়ে থাকবে-যাদের বর্ণনা পবিত্র কোরআনে বহুবার এসেছে।
2. কাহ্তানিগণ (القحطانيون ) : এরা ইয়া’ রব বিন কাহ্তানের বংশধর। এরা আরব ভূখণ্ডের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ ইয়েমেনে বসবাস করত। এদেরকেই খাঁটি আরব বলা হয়। আজকের ইয়েমেনের অধিবাসীরা এবং আওস ও খাযরাজ গোত্র যারা ইসলামের আবির্ভাবের শুরুতে মদীনায় বসবাস করত তারা কাহ্তানেরই বংশধর। কাহ্তানিগণ অনেক সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ইয়েমেনকে সমৃদ্ধশালী ও আবাদ করার ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছে। তারা বহু সভ্যতারও গোড়াপত্তন করেছিল এবং সেগুলোর নিদর্শনাদি আজও বিদ্যমান। তাদের রেখে যাওয়া প্রাচীন শিলালিপিসমূহ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার ভিত্তিতে পাঠোদ্ধার করা হচ্ছে। এর ফলে কাহ্তানীদের ইতিহাস কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতির সভ্যতা সম্পর্কে যা কিছু আলোচনা করা হয় আসলে তার সবই এ কাহ্তানীদের সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং এ সভ্যতার বিকাশস্থল হচ্ছে ইয়েমেন।
3. আদনানিগণ (العدنانيّون ) : এরা হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর। ইসমাঈল (আ.) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র। এ গোত্রের উৎসমূল আমরা পরবর্তী আলোচনাসমূহে স্পষ্ট করে দেব। তবে উক্ত আলোচনাসমূহের সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ : পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর মা হাজেরাসহ পবিত্র মক্কায় পুনর্বাসন করার ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম (আ.) আদিষ্ট হন। তিনি ইসমাঈল ও তাঁর মা হাজেরাকে ফিলিস্তিন থেকে একটি গভীর উপত্যকায় নিয়ে আসলেন যা মক্কা নামে অভিহিত। এ উপত্যকা ছিল পানি ও উদ্ভিদবিহীন মরুপ্রান্তর। মহান আল্লাহ্ তাঁদের ওপর করুণা ও রহমতস্বরূপ সেখানে‘ যমযম’ঝরনা সৃষ্টি করে তাঁদের হাতে অর্পণ করেন। ইসমাঈল (আ.) মক্কার অদূরে বসতি স্থাপনকারী জুরহুম গোত্রের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি অনেক সন্তান-সন্ততি লাভ করেছিলেন। হযরত ইসমাঈলের এ সব বংশধরের একজন ছিলেন আদনান। কয়েকজন ঊর্ধ্বতন পিতৃপুরুষের মাধ্যমে আদনানের বংশ হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সাথে মিলিত হয়।
আদনানের সন্তান ও বংশধরগণ বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এ সব গোত্রের মধ্যে যে গোত্রটি সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিল তা হলো কুরাইশ গোত্র। আর বনি হাশিম ছিল কুরাইশ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগে আরব উপদ্বীপ
আরবদের সাধারণ চরিত্র
আরবদের ঐ সকল স্বভাব-চরিত্র এবং সামাজিক রীতি-নীতি তুলে ধরাই এখানে লক্ষ্য যা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। এ সব রীতি-নীতির মধ্যে বেশ কিছু রীতি গোটা আরব জাতির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। সার্বিকভাবে আরবদের সাধারণ এবং প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য নিম্নোক্ত কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে বর্ণনা করা যেতে পারে :
জাহেলীয়াতের যুগে আরবগণ,বিশেষ করে আদনানের বংশধরগণ স্বভাবতঃই দানশীল ও অতিথিপরায়ণ ছিল। তারা কদাচিৎ আমানতের খিয়ানত করত। তারা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাকে ক্ষমার অযোগ্য পাপ বলে গণ্য করত। তারা আকীদা-বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করত না। তারা স্পষ্টভাষী ছিল। তাদের মাঝে শক্তিশালী ধী ও স্মরণশক্তিসম্পন্ন এমন ব্যক্তিবর্গ ছিল যারা আরবের কবিতা এবং বক্তৃতাসমূহ কণ্ঠস্থ করে রেখেছিল। আরবগণ কাব্যচর্চা এবং বক্তৃতায় সে যুগে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল। তাদের সাহস প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তারা অশ্বচালনা এবং তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত ছিল। পলায়ন এবং শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনকে তারা মন্দ ও গর্হিত কাজ বলে বিবেচনা করত।
এ সব গুণের পাশাপাশি অনেক চারিত্রিক দোষ তাদেরকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছিল যে,তাদের সব ধরনের মানবীয় পূর্ণতার দীপ্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আর অদৃশ্যলোক থেকে যদি তাদের ওপর করুণা ও দয়ার বাতায়ন উন্মুক্ত করা না হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হতো। আপনারা বর্তমানে কোন আদনানী আরবের অস্তিত্বই খুঁজে পেতেন না এবং অতীতের বিলুপ্ত আরব গোত্রসমূহের কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি হতো।
একদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ও সঠিক কৃষ্টি-সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে চরিত্রহীনতা ও কুসংস্কারের ব্যাপক প্রসারের কারণে আরব জাতির জীবন মানবেতর জীবনে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসের পাতা আরবদের পঞ্চাশ বছর ও একশ’বছর স্থায়ী যুদ্ধের কাহিনী ও বিবরণে পূর্ণ। এ সব যুদ্ধ তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংঘটিত হয়েছে। বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করতে সক্ষম কোন শক্তিশালী সরকার ও প্রশাসন না থাকার কারণে আরব জাতি যাযাবর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে তারা প্রতি বছর তাদের পশু ও অশ্বসমেত মরুভূমিতে এমন সব এলাকার সন্ধানে ঘুরে বেড়াত যেখানে প্রচুর পানি ও লতাগুল্মের অস্তিত্ব আছে। এ কারণে যেখানেই তারা পানি ও বসতির নিদর্শন দেখতে পেত সেখানেই অবতরণ করে তাঁবু স্থাপন করত। আর যখনই অধিকতর উত্তম কোন স্থানের সন্ধান পেত তখনই সেখানে যাওয়ার জন্য মরুপ্রান্তর পাড়ি দিত।
তাদের এ যাযাবর জীবনের পেছনে দু’ টি কারণ রয়েছে : 1. পানি,জলবায়ু-আবহাওয়া এবং চারণভূমির দিক থেকে আরবের খারাপ ও প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা এবং 2. প্রচুর রক্তপাত ও হানাহানি যা তাদেরকে ভ্রমণ ও এক জায়গা ত্যাগ করে অন্যত্র গমন করতে বাধ্য করত।