কবরের উপর সৌধ নির্মাণ ও পবিত্র কোরআন
পবিত্র কোরআন কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট কিছু না বললেও কোরআনের আয়াত হতে এ সম্পর্কিত বিধান পাওয়া যায়। এ যুক্তিতে যে-
১। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শামিল। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে তাঁর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন,কারণ তা অন্তরের পরহেজগারীর (আত্মসংযম) প্রমাণ। যেমন বলা হয়েছে,
(
وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ)
“
যারা আল্লাহর (
দ্বীনের)
নিদর্শনসমূহের সম্মান করে তা অন্তরের পরহেজগারীর প্রমাণস্বরূপ
।”
‘
شعائر
’
শব্দটি‘
شعیره
’
শব্দের বহুবচন যার অর্থ নিদর্শন ও প্রমাণ।‘
আল্লাহর নিদর্শন’
(شعائر الله
)হলো এমন কোন প্রতীক যা আল্লাহর দিক নির্দেশক। যদি কেউ আল্লাহর নিকট পৌঁছাতে চায় (নৈকট্য পেতে চায়) তবে ঐ প্রতীকের মাধ্যমে তাতে পৌঁছাতে পারে। অবশ্য‘
আল্লাহর নিদর্শন’
অর্থ যদি তাঁর দ্বীনের নিদর্শন বুঝায় তবে আয়াতটির অর্থ হবে যদি কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় তবে তাঁর দ্বীনের নিদর্শনসমূহের স্থান প্রদর্শনের মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে।
পবিত্র কোরআনে সাফা ও মারওয়াকে আল্লাহর নিদর্শন ও চিহ্ন বলা হয়েছে:
(
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ)
“
নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া (পর্বত দু
’
টি) আল্লাহর (দ্বীনের) নির্দশন।
”
কোরবানীর উদ্দেশ্যে যে উটকে মিনায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকেও আল্লাহর নিদর্শন বলা হয়েছে,
(
وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ)
“
আমরা কোরবানীর হৃষ্টপুষ্ট উষ্ট্রকে তোমাদের জন্য আল্লাহর (
দ্বীনের)
নিদর্শন বানিয়েছি।
”
এ বিষয়গুলো ইবরাহীমের ধর্মের (দ্বীনে হানিফের) নিদর্শনসমূহরে অন্তুর্ভুক্ত। মুজদালিফাকেمَشعَر
বলা হয়,কারণ তা আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন ও প্রতীক স্বরূপ। হজ্জ্বের সকল আচারই আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শন কারণ তা একত্ববাদী ও অবিকৃত ধর্মের প্রতীকস্বরূপ।
যেহেতু এই আচারসমূহ আল্লাহর দ্বীনের নিদর্শনস্বরূপ এবং মানবজাতিকে একত্ববাদী ও অবিকৃত ঐশী দ্বীনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়,সেহেতু নিঃসন্দেহে বলা যায়,আল্লাহর নবী ও ওলিগণ তাঁর দ্বীনের সর্বোচ্চ নিদর্শন। কারণ তারা হলেন নিষ্পাপ,কখনোই অন্যায়কর্ম করেন না এবং তাদের বাণী ও কর্ম সত্যের অনুরণন। তাঁরা এমন এক আদর্শ যাদের অনুসরণে একত্ববাদ ও মহাসত্যের পথ খুঁজে পাওয়া যায়।
যখন মহানবী (সা.),তাঁর স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি (পবিত্র ইমামগণ) ও আল্লাহর অন্যান্য ওলিগণ এরূপ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তখন তাদের সকল স্মৃতি সংরক্ষন যেমন তাঁদের কবর,তা সংরক্ষনের নিমিত্তে তার উপর সৌধ ও গুম্বুজ নির্মাণ আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মানেরই নমুনা স্বরূপ। কারণ এরূপ কর্ম সেই ব্যক্তিবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করা হয়,যাদের কর্ম,বাণী ও নির্দেশনা মানুষকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে।
কুরতুবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,‘
আল্লাহর নিদর্শন হলো এমন কিছু যা তাঁর দ্বীনের চিহ্ন ও স্মৃতি বহন করে বিশেষত যে সকল বিষয় দ্বীনের আচারের পথে সংশ্লিষ্ট।
মিশরীয় লেখক প্রফেসর আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ কারবালা ও ইমাম হুসাইনের মাজার সম্পর্কে বলেছেন :‘
কারাবালা এমন একস্থান যেখানে মুসলমানরা শিক্ষাগ্রহণ ও ইমাম হুসাইনের স্মরণের জন্য যায়। অমুসলমানরাও সেখানে দর্শনের জন্য যায়। কিন্তু যদি ঐ ভূমির প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় তবে অবশ্যই তা সেই সব ব্যক্তিদের জিয়ারতের স্থান হওয়া উচিত যারা স্বজাতির জন্য বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদায় বিশ্বাসী। কারণ জিয়ারতের স্থানগুলোর মধ্যে ইমাম হুসাইনের মাজার হতে উত্তম কোন স্থানের কথা আমার জানা নেই।’
২। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যদের কবরসমূহের উপর সৌধ নির্মাণ মহানবীর নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ।
পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টরূপে আল্লাহর নবীর রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা পোষণের নির্দেশ দিয়েছে-
(
قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّة)
“
তোমাদের হতে আমি আমার (
রিসালাতের দায়িত্বের)
কোন বিনিময় চাই না কেবল আমার অতিনিকটাত্মীয়দের প্র
তি ভালোবাসা ছাড়া
।
নিঃসন্দেহে মহানবীর অতিনিকটাত্মীয়দের কবর সংরক্ষণের নিমিত্তে তার উপর সৌধ নির্মাণ করে জিয়ারতকারীদের জন্য তা চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন তাঁদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ স্বরূপ। কারণ প্রতিটি ভালোবাসারই প্রকাশ আছে এবং শুধু তাঁদের আনুগত্য করা ও তাঁদের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা পোষণ করাই ভালোবাসার নিদর্শন নয়,বরং সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে তাঁদের কবর সংরক্ষণও তাঁদের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন,যেহেতু এরূপ কর্ম কোন সূত্রেই নিষিদ্ধ করা হয় নি। (আবুশ শুহাদা,পৃ. ৫৬)
৩। আল্লাহর ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণ পবিত্র গৃহসমূহকে সমুন্নত রাখার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত,মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে অনুমতি দিয়েছেন যেসকল গৃহে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয় তা সমুন্নত করার।
(
فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَنْ تُرْفَعَ وَيُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ يُسَبِّحُ لَهُ فِيهَا بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ)
(
رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ)
“
আল্লাহ যেসব গৃহকে (যাতে তাঁর নূর রয়েছে) মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন,
সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এমন লোকেরা যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে,
নামাজ প্রতিষ্ঠা করা থেকে এবং জাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না।
”
(সূরা নূর : ৩৬-৩৭)
উপরিউক্ত আয়াত হতে আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে দু’
টি প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়।
প্রথমত উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে শুধু মসজিদ বুঝানো হয়নি,বরং আয়াতের উদ্দেশ্য মসজিদসহ যে কোন স্থান যেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়,যেমন নবিগণ ও তাঁদের স্থলাভিষিক্ত পবিত্র প্রতিনিধিদের গৃহ। এমনকি এ দাবীও সত্য যে,উপরিউক্ত আয়াতটিতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের বা গৃহসমূহের কথা বলা হয়েছে। কারণ গৃহ বলতে যে কোন চার দেয়াল ও ছাদ বিশিষ্ট স্থানকে বুঝানো হয়। যেমন পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে :
(
وَلَوْلَا أَنْ يَكُونَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقُفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُونَ)
“
যদি সব মানুষের এক মতাবলম্বী (কাফের) হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকত তবে যারা দয়াময়কে (আল্লাহকে) অস্বীকার করে তাদের গৃহসমূহের ছাদ ও সিঁড়িকে যা দ্বারা তারা উপরে যেত আমি রৌপ্য নির্মিত করে দিতাম।
”
উপরিউক্ত আয়াত হতে বোঝা যায় আরবী ভাষায় যে,কোন ছাদ বিশিষ্ট কক্ষকেই গৃহ((بیت))
বলা হয়। তদুপরি হাদীসসমূহে বলা হয়েছে মসজিদ ছাদবিহীন হওয়া মুস্তাহাব। তাই উল্লিখিত আয়াতে গৃহ বলতে মসজিদ ভিন্ন অন্য গৃহের কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু রাসূলের আহলে বাইতের সূত্রে ইমাম বাকির (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে,উপরিউক্ত আয়াতে গৃহ বলতে নবিগণ ও হযরত আলীর গৃহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
পবিত্র কাবাগৃহকে বাইতুল্লাহ্ বলা হয়,কারণ তার ছাদ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত আয়াতে যে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে তার দু’
রকম অর্থ হতে পারে :
ক) গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান যেমনটি আমরা এ আয়াতটিতে পড়ি
(
وَرَفَعْنَاهُ مَكَانًا عَلِيًّا)
“
আমরা তার মর্যাদাকে সমুন্নত করেছি।
”
খ) আয়াতের লক্ষ্য বাহ্যিক ও বস্তুগত উন্নয়ন অর্থাৎ ঐরূপ গৃহ বা স্থানের যেমন ওলীদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণের মাধ্যমে গৃহ বা কবরকে উন্নীত করা।
জামাখশারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে বলেছেন : গৃহকে উন্নীত করার অর্থ গৃহের কাঠামোকে উচ্চ করা যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতে বলা হয়েছে-
(
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ)
“
(
স্মরণ কর) যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবাগৃহের ভিত্তিকে উন্নীত করেছিল।
”
অথবা কাবাগৃহের প্রতি মর্যাদা দেখানোও সম্মান প্রদর্শন।"
তাফসীরে রুহুল বায়ানে বলা হয়েছে(أن ترفع)
উন্নীত করার অর্থ উচ্চ করা অথবা সেগুলোর মর্যাদাকে বৃদ্ধি করা।
যদি আয়াতটিতে উন্নীত করার অর্থ বাহ্যিক ও কাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়ে থাকে তবে তা সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর নবী ও ওলীদের কবরকে উন্নীত করণের দলিল হবে। বিশেষত যখন মহানবী (সা.) সহ তাঁর আহলে বাইতের কয়েকজন ইমাম তাঁদের গৃহেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। আর যদি উন্নীত করণের অর্থ মর্যাদা দান ও অবস্তুগত উন্নয়ন হয়ে থাকে তবে তার অর্থ হবে নবী ও আল্লাহর ওলীদের গৃহ ও কবরসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিমিত্তে তা সংরক্ষন করা,সৌধ নির্মাণ ও তার মেরামত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লামা সুয়ূতী আনাস ইবনে মালিক ও কুরাইদা হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.)فی
بیوت
اذن
أن
ترفع
আয়াতটি পাঠ করলে একব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল :‘
এখানে কোন গৃহসমূহের কথা বলা হয়েছে?’
রাসূল (সা.) বললেন :‘
নবিগণের গৃহসমূহ’
। হযরত আবু বকর রাসূলকে তখন হযরত আলী ও ফাতিমার গৃহের দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেন :‘
হে আল্লাহর রাসূল! এই গৃহটিও কি ঐসব গৃহের অন্তর্ভুক্ত,আল্লাহ ও আপনার দৃষ্টিতে যার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা উচিত।’
তিনি বললেন :‘
এই গৃহটি ঐ গৃহসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।’