ওয়াহাবীদের দলিল সমূহের পর্যালোচনা
ওয়াহাবিগণ কবরের উপর সৌধ নির্মাণ হারাম হওয়ার সপক্ষে যে দলিল উপস্থাপন করেছে আমরা এখানে তার উত্তর দান করব।
১। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ শিরকের অন্যতম দৃষ্টান্ত অথবা শিরকের দিকে মানুষকে ধাবিত করে।
আমরা তাদের এ কথার জবাবে বলব : প্রথমত আমরা অন্যত্র তাওহীদ ও শিরকের আলোচনায় উল্লেখ করেছি শিরকের দু’
টি দিক রয়েছে-মানুষ এমন কোন কাজ করবে যা কারো প্রতি অবনত হওয়ার পরিচায়ক এবং যার প্রতি অবনত হয় তার উপাস্য ও প্রতিপালক হওয়ার বিশ্বাস রাখে। শিরকের এই দু’
টি স্তম্ভ ও দিক শিরক সম্পর্কিত আয়াত ও তার সংজ্ঞা হতে জানা যায়। এই দু’
টি দিকের উপস্থিতি কবরের উপর সৌধ নির্মাণের মধ্যে নেই। কারণ যে ব্যক্তি নবী ও আল্লাহর ওলীদের মাজার ও সৌধকে সম্মান প্রদর্শন করে সে তাঁদের উপাস্য ও প্রতিপালক হওয়ার বিশ্বাস রাখে না।
দ্বিতীয়ত আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে কোন হারামের সকল প্রাথমিক প্রস্তুতিমূলক কর্ম হারাম নয়,বরং যে প্রস্তুতি তাকে নিশ্চিত ভাবে হারামে ফেলে তাই শুধু হারাম। অর্থাৎ যদি কেউ শিরক করার উদ্দেশ্যেই কবরের উপর সৌধ নির্মাণ করে তবেই তা হারাম হবে। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে কবরের উপর সৌধ নির্মাণ করে তবে তা হারাম তো হবেই না,বরং মুস্তাহাব বলে পরিগণিত হবে।
২
।
কবরের উপর সৌধ নির্মাণ মুশরিকদের কাজ
!
উত্তর
: প্রথমত মূর্তিপূজকরা (মুশরিকরা) তাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের কবরের উপর সৌধ নির্মাণ করত এ বিশ্বাসে যে তারা তাদের প্রভু ও প্রতিপালক। (আমরা অন্যত্র এ বিষয়ে আলোচনা করেছি) এ কারণেই ইসলাম তাদের সমালোচনা করেছে কিন্তু মুসলমানরা এরূপ বিশ্বাস নিয়ে তাদের মৃতদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণ করে না।
দ্বিতীয়ত কাফের বা মুশরিকদের সাথে যে কোন প্রকার মিল থাকলেই তা হারাম হতে পারে না। যদি তা এমন কোন বিষয় হয় যা কেবলমাত্র তাদের মধ্যেই প্রচলিত এবং তাদের ধর্ম ও আচারসমূহকে পুনর্জীবন দানের লক্ষ্যে করা হয় তবেই তা হারাম বলে বিবেচিত। আমরা‘
উৎসব পালন’
সম্পর্কিত পরবর্তী আলোচনায় এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
৩। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ নিষিদ্ধ বিদআতী কাজ?
উত্তর
: আমরা অন্যত্র সুন্নাত ও বিদআতের মধ্যকার পার্থক্যের আলোচনায় উল্লেখ করেছি বিদআতের দু’
টি মৌলিক দিক রয়েছে তা হলো ধর্মের মধ্যে কম বা বেশি করা এবং সে বিষয়টি নতুন কিছু হওয়া যার সপক্ষে সাধারণ বা বিশেষ কোন শারয়ী দলিল নেই। কিন্তু কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বৈধতার বিষয়ে একদিকে বিশেষ দলিল রয়েছে যেমন সুন্নাত ও মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অন্যদিকে সর্বজনীন বৈধতার দলিলও রয়েছে।
৪। কবরের উপর সৌধ নির্মাণের নিষিদ্ধতার বিষয়ে আলেমদের মধ্যে সর্বজনীন ঐকমত্য রয়েছে:
জান্নাতুল বাকীতে বিদ্যমান সৌধসমূহের ব্যাপারে সৌদী রাজদরবারের প্রশ্নের জবাবে মদীনা শরীফের ওয়াহাবী আলেমগণ বলেছেন :‘
আলেমদের সর্বসম্মত মত হচ্ছে কবরের উপর সৌধ নির্মাণ নিষিদ্ধ। কারণ তার নিষিদ্ধতার বিষয়ে সহীহ্ হাদীসসমূহ রয়েছে.।’
উত্তর
: প্রথমত দাবীকৃত ইজমা বা আলেমদের ঐকমত্যের বিষয়টি হাদীস নির্ভর। আমরা পরবর্তীতে এ সম্পর্কিত হাদীসগুলো নিয়ে আলোচনা করব। হাদীস নির্ভর ইজমার ক্ষেত্রে যদি উপস্থাপিত হাদীস দুর্বল হয় তবে সেই ইজমার কোন মূল্য থাকে না।
দ্বিতীয়ত দাবীকৃত ইজমাকে আমরা সম্ভাব্য তিন ভাগে ভাগ করতে পারি :
ক) ইজমায়ে তাকদীরি (বিষয়বস্তু ভিত্তিক ইজমা) :
এরূপ ইজমায় কয়েকটি হাদীসের বিষয়বস্তু হতে ধারণার ভিত্তিতে ফতোয়া দেওয়া হয়। এরূপ ইজমা অগ্রহণযোগ্য। কারণ যে সকল হাদীসের ভিত্তিতে ফতোয়া দেওয়া হবে তার সনদ ও দালালাতের (সূত্র ও বিষয়বস্তু) বিশুদ্ধতার উপরও ফতোয়া নির্ভরশীল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উভয় দৃষ্টিতেই তা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত।
খ) ইজমায়ে মুহাক্কাক (প্রতিষ্ঠিত ইজমা)
: প্রতিষ্ঠিত ইজমা হলো সকল আলেম ঐ বিষয়ে একমত যে,তা হারাম ও নিষিদ্ধ। কবরের উপর সৌধ নির্মাণ যেমন হারাম তা বিদ্যমান রাখাও হারাম এ উভয় ক্ষেত্রে তারা একমত। প্রতিষ্ঠিত ইজমার সম্ভাবনাও এক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য। কারণ অধিকাংশ আলেম সর্বজনীনভাবে কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়ে কথা বলেছেন অথবা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু আল্লাহর ওলীদের কবর নিয়ে।
আমরাও আল্লাহর ওলী ভিন্ন সাধারণ মুমিনদের কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়টি মাকরূহ হওয়ায় বিশ্বাসী। দ্বিতীয়ত অধিকাংশ আলেম সৌধ নির্মাণের বিষয়টিকে নিষিদ্ধ বলেন না,বরং তারা মাকরূহ বলে মনে করেন এমনকি কেউ কেউ মাকরূহ হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করেন না।
যারা হারাম হওয়ার বিষয়টি সমর্থন করেন না :-
১। আবদুর রহমান জাযিরী বলেছেন :‘
কবরের উপর গম্বুজ বা সৌধ নির্মাণ মাকরূহ।’
২। নাভাভী শারহে সহীহ মুসলিম গ্রন্থে বলেছেন,‘
যদি কোন কবর ঐ ব্যক্তির মালিকানাধীন স্থানে হয় তবে তার উপর সৌধ নির্মান মাকরূহ। যদি জনসাধারণের চলার পথে অবস্থিত হয় তবে তা নির্মাণ হারাম।’
৩। মালিকী মাজহাবের প্রধান জনাব মালিক ইবনে আনাস হতে বর্ণিত হয়েছে,‘
কবরের উপর সৌধ নির্মাণ ও চুনকাম করা আমার মতে মাকরূহ।’
৪। শাফেয়ী বলেছেন,‘
আমি পছন্দ করি কবরের উপর সৌধ নির্মিত ও তাতে চুনকাম করা না হোক। কারণ এটি কবরের সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে করা হয় অথচ কবর সৌন্দর্য ও অলংকৃত করার স্থান নয়।’
৫। ইবনে হাজাম বলেছেন,‘
যদি কোন কবরের উপর সৌধ বা স্তম্ভ নির্মাণ করা হয় তাতে কোন অসুবিধা নেই।’
৬। জনাব নাভাভী কবরের উপর সৌধ নির্মাণ মাকরূহ বলেছেন কিন্তু তিনি বলেছেন,আবু হানিফার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে,তিনি মাকরূহ মনে করেন না।
কবরের উপর সৌধ নির্মাণের বিষয়ে যে মাকরূহ ফতোয়া দেয়া হয়েছে তা মূলত সাধারণ মুমিনদের কবরের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে কিন্তু আল্লাহর ওলিগণের কবর এ সাধারণ নীতির ব্যতিক্রম।
আবদুল গণি নাবলসী তাঁর‘
আল হাদীকাতুন্নাদীয়া’
গ্রন্থে বলেছেন,‘
কবরের নিকট মোমবাতি জ্বালানো ও তা আলোকিত করা মাকরূহ এজন্য যে,তা নিরর্থক তবে তা যদি কোন ভাল উদ্দেশ্যে যেমন... কোন আল্লাহর ওলী বা সম্মানিত বিশেষ আলেমের রুহের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে করা হয় তবে তাতে অসুবিধা নেই।’
গ) ইজমার অর্থ এখানে মুসলমানদের অনুসৃত সর্বজনীন রীতি যা রাসূলের ইন্তেকালের সময় হতে বর্তমান পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে। আমরা পূর্বেই প্রমাণ করেছি মুসলমানদের সর্বজনীন অনুসৃত রীতি এর বিপরীত বিষয়কে প্রমাণ করে। কারণ মুসলমানদের ইতিহাসের উপর চোখ বুলালে আমরা দেখি কবরের উপর সৌধ নির্মাণ তাদের সর্বকালীন অনুসৃত রীতি।
৫। কবরের উপর সৌধ নির্মাণের নিষিদ্ধতার পক্ষে উপস্থাপিত হাদীসসমূহ :
কবরের উপর সৌধ নির্মাণের নিষিদ্ধতার বিষয়ে আহলে সুন্নাতের সূত্রে উদ্ধৃত ওয়াহাবীদের হাদীসভিত্তিক দলিলগুলো নিয়ে এখানে আমরা আলোচনা করব।
১। আবিল হায়াজের হাদীস : সহীহ্ মুসলিম ইয়াহিয়া ইবনে ইয়াহিয়া,আবু বকর ইবনে আবি শাবি এবং জুহাইর ইবনে হারব ওয়াকী হতে,তিনি সুফিয়ান হতে,তিনি হাবীব ইবনে আবি সাবিত হতে,তিনি আবি ওয়ায়িল হতে তিনি আবিল হায়াজ আসাদী হতে বর্ণনা করেছেন,হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) তাকে বলেছেন :‘
তোমাকে এমন কাজে পাঠাবো যা করতে মহানবী (সা.) পাঠিয়েছিলেন এবং তা হলো যে কোন মূর্তিই (ভাস্কর্যই) পাও না কেন তা ধ্বংস করবে এবং যে কোন অসমতল এবং উচ্চ কবর পাবে তা সমতল করবে।’
হাদীসটি সনদ ও দালালাতের দিক থেকে দুর্বল ও জায়িফ হিসেবে পরিগণিত।
ক) সনদের মূল্যায়ন : বর্ণনাকারী কয়েকজন রাবী দুর্বল বলে ঘোষিত হয়েছেন। যেমন,ওয়াকী ইবনে জাবরা,ইবনে মালিহ্ রাওয়াসী কুফীকে অনেকেই দুর্বল বর্ণনাকারী বলেছেন।
সুফিয়ান ইবনে সাঈদ ইবনে মাসরুফ সাওবী কুফী যাকে ইবনে হাজার ও যাহাবী হাদীসের সনদ জালকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন অর্থাৎ যে বর্ণনাকারীকে সে দেখে নি তার নামে হাদীস বর্ণনার দাবী সে করত।
হাবীব ইবনে আবি সাবিত কাইস ইবনে দিনার সম্পর্কেও একই অভিযোগ রয়েছে।
আবু ওয়ায়িল আসাদী হযরত আলীর বিরোধী ছিল।
সে কুফায় আবদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের সহযোগী ছিল এবং তার অত্যাচার ও লুটপাটের ইতিহাস কারো নিকট অজানা নয়।
আবুল হায়াজ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ নন। এ কারণে আল্লামা সুয়ূতী সুনানে নাসায়ীর ব্যাখ্যাগ্রন্থেও টীকায় বলেছেন,‘
হাদীস গ্রন্থসমূহে এ হাদীসটি ছাড়া অন্য কোন হাদীস তার হতে বর্ণিত হয় নি এবং ইবনে হাব্বান ব্যতীত অন্য কেউই তাকে বিশ্বস্ত বলেন নি। ইবনে হাব্বান সাধারণত অজ্ঞাত রাবীদের বিশ্বস্ত বলার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ।
হাদীসবিদ আজলীও তাকে বিশ্বস্ত বলেছেন যিনি তাবেয়ীদের গড়পড়তা হারে বিশ্বস্ত বলেছেন এ কারণে যে,তাদের প্রতি তার বিশেষ ভাল ধারণা ও সুদৃষ্টি ছিল।
খ) দলিলের নির্ভরযোগ্যতা : উল্লিখিত হাদীসটিতে দলিলের দৃষ্টিতেও অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে।
১। হাদীসের সনদ বর্ণনার বিষয়বস্তুতে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন একটি হাদীসে আবিল হায়াজ বলেছে,‘
হযরত আলী আমাকে বলেছেন’
,অন্য হাদীসে আবি ওয়ায়িল বর্ণনা করেছে,‘
আলী আবিল হায়াজকে বলেন’
,অন্যত্র বলেছে,‘
আলী আবিল হায়াজকে বলেন,আমি অবশ্যই তোমাকে প্রেরণ করব। আমরা জানি হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু বর্ণনার ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলে তা হাদীসের নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
২। হাদীসটিতে পৃথিবীর সকল পাকা কবর ভাঙ্গার ও ধ্বংস করার কথা বলা হয় নি,বিশেষ বিষয়ে তাকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সম্ভবত কবরগুলো মুশরিকদের (মূর্তিপূজক) ছিল এবং তারা সেখানে উপাসনার জন্য যেত এ কারণে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যদি ধরেও নেই তা মুসলমানদের কবর ছিল তদুপরি তার সঙ্গে আল্লাহর ওলীদের কবরের কোন সম্পর্ক নেই;কারণ তাঁদের কবর আল্লাহর নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাঁদের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহর দিকে অধিক মনোযোগী হওয়ার লক্ষ্যে নির্মিত হয়ে থাকে যার মধ্যে শিরক ও অংশীদারিত্বের কোন সম্পর্ক নেই।
৩। আভিধানিকগণ (تسویه
) শব্দটি যদি কোন সহযোগী শব্দ ছাড়া একাকী উল্লিখিত হয় তবে তার অর্থ শুধুই সমতল করা। এই হাদীসটিতে শব্দটি এভাবেই এসেছে,ফলে অনুরূপ অর্থই শুধু প্রকাশ করে না। কারণ হাদীসটিতে বলা হয় নি ভূমি সমতল কর। তাই হাদীসটির অর্থ হবে বক,মাছের বা উটের পিঠের ন্যায় কবরসমূহকে সমতল করে দাও। কারণ কোন কোন হাদীসে এসেছে শহীদদের কবরসমূহ সে সময় উটের পিঠের ন্যায় উঁচু ছিল।
৪। হাদীসটিতে কবরের উপর নির্মিত ছাদ,দেয়াল ইত্যাদি ধ্বংস করার কোন কথাই আসে নি।
৫। উপরন্তু উপরিউক্ত হাদীসটি ইসলামের ইতিহাসের সকল পর্যায়ে মুসলিম মনীষী ও আলেমদের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য ছিল এবং তারা এর উপর আমল করেন নি। এ কারণে হাদীসটি পালনীয় নয়।
২। জাবির হতে বর্ণিত হাদীস : মুসলিম আবু বাকর ইবনে শাইবা হতে,তিনি হাফস ইবনে গিয়াম হতে,তিনি জাবির হতে বর্ণনা করেছেন যে,মহানবী (সা.) কবরের উপর চুনকাম করা,কিছু লেখা ও সৌধ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছেন।
একই ভাবার্থে কয়েকটি হাদীস বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এ হাদীসগুলোতে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে যে কারণে নির্ভরযোগ্যতা হারিয়েছে।
প্রথমত এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর মধ্যে সবকটিতেই উপরিউক্ত তিন রাবী অর্থাৎ জাবির,আবুজ জুবাইর ও ইবনে জুরাইহ একত্রে অথবা এককভাবে রয়েছেন অর্থাৎ কেবল তারাই এককভাবে অথবা এককসূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাজার বলেছেন,ইয়াহিয়া ইবনে মুঈনকে ইবনে জুরাইহের হাদীসটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বলেন যে,তার বর্ণিত সকল হাদীস জায়িফ (দুর্বল)।’
আহমাদ ইবনে হাম্বাল হতে ইবনে জুরাইহ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে,সে মুনকার
হাদীস বর্ণনা করে।
মালিক ইবনে আনাস তার সম্পর্কে বলেছেন,‘
ইবনে জুরাইহ ঐ ব্যক্তির সাথে তুলনীয় যে রাত্রে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহে লিপ্ত অর্থাৎ সে সবধরনের (সহীহ্ ও দুর্বল) হাদীস বর্ণনা করে।’
আবুজ জুবাইর সম্পর্কেও বর্ণিত হয়েছে সে দুর্বল হাদীস বর্ণনাকারী। আহমাদ ইবনে হাম্বাল আইয়ুব হতে বর্ণনা করেছেন যে,আবুজ জুবাইর দুর্বল বর্ণনাকারী।
শোবা বলেছেন,‘
আবুজ জুবাইর ঠিক মতো নামাজ পড়তো না এবং সে অন্যদের উপর অপবাদ আরোপ করে থাকে।’
আবু হাতেম রাজী বলেছেন,‘
তার বর্ণিত হাদীস লিখতে অসুবিধা নেই তবে তা প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা যাবে না।’
দ্বিতীয়ত জাবির বর্ণিত হাদীসটির বিভিন্ন বর্ণনায় চরম অমিল রয়েছে। কারণ জাবির হতে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় কবরে চুনকাম করা ও তার উপর ভর দেয়া হতে নিষেধ করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় কবরে চুনকাম করা,লেখা,সৌধ নির্মাণ,হাঁটা-চলা করা হারাম বলা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এগুলো ছাড়াও কবর জিয়ারত হারাম বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এত ব্যাপক ভিন্নতা হাদীসের বিশ্বাসযোগ্যতাকে শূণ্যের কোঠায় নিয়ে আসে।
তৃতীয়ত যদি ধরে নেই হাদীসের সনদের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই এবং বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও কোন ভিন্নতা নেই ও হাদীসে কেবলমাত্র কবরের উপর সৌধ নির্মাণ করতে নিষেধ করেছে কিন্তু হাদীসে হারাম হওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই। কারণ নিষেধ দু’
প্রকারের (১) কোন কাজ অপছন্দনীয় (মাকরূহ) হওয়ার কারণে নিষেধ করা হয়েছে যা ইসলামের অনেক বিধানের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। (২) হারামের নিষেধাজ্ঞা,যদিও সাধারণত নিষেধাজ্ঞা হারামের প্রতিই ইঙ্গিত করে কিন্তু উপরিউক্ত হাদীসটি হতে ফকীহ ও আলেমগণ হারাম নয়,বরং মাকরূহ হওয়ার সম্ভাবনাকেই গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই আমরা দেখি তিরমিযী তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে উপরিউক্ত হাদীসটিকে‘
কবরের উপর সৌধ নির্মাণ মাকরূহ’
শিরোনামের অধীনে এনেছেন। সহীহ্ ইবনে মাজার একজন ব্যাখ্যাকারী হাকিম নিশাবুরী হতে বর্ণনা করেছেন যে,এ কারণেই মুসলমানদের মধ্যে কেউই এ হাদীসটির উপর আমল করেন নি।
যদি ধরেও নিই এ হাদীস হতে বাহ্যিকভাবে বিষয়টি মাকরূহ হওয়া প্রমাণিত হয় তদুপরি যখন বিষয়টি আল্লাহর ওলীদের ক্ষেত্রে হবে তখন তাঁর নিদর্শনকে পুনর্জ্জীবিতকরণ ও সম্মান প্রদর্শনের আওতায় তা মাকরূহ থাকবে না,বরং মুস্তাহাব হয়ে যাবে।
এমতাবস্থায় কি করে ওয়াহাবীরা এ সকল হাদীসের ভিত্তিতে এ বিষয়টিকে হারাম ঘোষণা করে কবরের উপর সৌধ নির্মাণকারীকে মুশরিক বলে অভিহিত করার সাহস পাচ্ছে?
৩। আবু সাঈদ খুদরী ও উম্মে সালামার হাদীস : ওয়াহাবীরা অপর যে দু’
টি হাদীসকে তাদের ফতোয়ার সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে তার একটি হলো আবু সাঈদ খুদরী বলেছেন,‘
মহানবী (সা.) কবরের উপর সৌধ র্নিমাণ করতে নিষেধ করেছেন।’
অপর হাদীসটি হলো উম্মে সালামা বলেছেন,‘
রাসূল (সা.) কবরের উপর সৌধ নির্মাণ চুনকাম করতে নিষেধ করেছেন।’
প্রথম হাদীসটিতে একজন অপরিচিত রাবীর উপস্থিতির (যার বিশ্বস্ততার বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই) কারণে তার নির্ভরযোগ্যতা থাকে না।
দ্বিতীয় হাদীসটিতে আবদুল্লাহ্ ইবনে লাহিয়া রয়েছে যার সম্পর্কে যাহাবী ইবনে মুঈন হতে বলেছেন যে,সে দুর্বল এবং তার বর্ণিত হাদীসের উপর নির্ভর করা যায় না। তাছাড়া ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ হতেও বর্ণিত হয়েছে যে,তিনি ইবনে লাহিয়াকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।
৬। জান্নাতুল বাকীর কবরস্থানটি ওয়াক্ফ সম্পত্তি :
ওয়াহাবীরা জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত আহলে বাইতের ইমামদের কবরের চিহ্নসমূহকে ধ্বংস করার সপক্ষে এ যুক্তি উপস্থাপন করে যে,জান্নাতুল বাকীর কবরস্থান ওয়াক্ফ সম্পত্তি এবং ইমামদের কবরের উপর নির্মিত গম্বুজসমূহ ওয়াকফের নীতির পরিপন্থি। তাই মুসলমানদের নেতার (কতৃত্বশীল ব্যক্তির) উচিত তা ধ্বংস করা।
তাদের এ যুক্তির বিরুদ্ধে আমাদের বক্তব্য হলো : প্রথমত কোন হাদীস ও ইতিহাসের গ্রন্থেই উল্লিখিত হয় নি যে,বাকীর কবরস্থান ওয়াক্ফ সম্পত্তি। কারণ এ সময় মদীনা ও হিজাযের অন্যান্য স্থানের ভূমির এত মূল্য ছিল না যে কেউ তা ওয়াক্ফ করবে।
দ্বিতীয়ত সামহুদী হতে বর্ণিত হয়েছে বাকীতে যে স্থানে ইমামদের কবর রয়েছে তা হযরত আলীর ভ্রাতা আকীল ইবনে আবি তালিবের নিজস্ব ঘর ছিল। সামহুদী বলেছেন,‘
আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের কবর ফাতিমা বিনতে আসাদ ইবনে হাশেমের কবরের পাশে অবস্থিত এবং তিনি আকীলের গৃহে কবরস্থ হয়েছিলেন।’
এতদসত্বেও ওয়াহাবীরা সম্পত্তিটি ওয়াক্ফ হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে আহলে বাইতের পবিত্র ইমামদের কবরের গম্বুজগুলোকে ধ্বংস করেছে।