আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত6%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 69479 / ডাউনলোড: 9381
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

আল মুরাজায়াত

(পত্রালাপ)

অনুবাদ

আবুল কাসেম

আল্লামাহ্ সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন আল মুসাভী

আল মুরাজায়াত

গ্রন্থকার : আল্লামাহ্ সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন আল মুসাভী

অনুবাদ : আবুল কাসেম

প্রকাশকাল :

শাওয়াল ১৪২৩ হিজরী

পৌষ ১৪০৯ বাংলা

ডিসেম্বর ২০০২ খ্রিস্টাব্দ

প্রকাশক : এস. এম. আলীম রেজা

 ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।

(প্রকাশক কর্তৃক গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষিত)

প্রচ্ছদ

রফিকুল্লাহ গাযালী

মুদ্রণে

চৌকস প্রিন্টার্স লিমিটেড

১৩১ ডিআইটি এক্সটেনসন রোড,ঢাকা-১০০০

Al Muraja'at,Written by Allamah Sayyed Abdul Hussain Sharafuddin Al Musavi (R.),Translated by Abul Quasem,Published by S.M. Alim Reya,Published on Shawal ১৪২৩,Poush ১৪০৯,December ২০০২.

بسم الله الرحمن الرحيم

প্রকাশকের কথা

জ্ঞানের চেয়ে বড় আর কোন সম্পদ এই পৃথিবীতে নেই। এটি এমন এক মূল্যবান ও স্থায়ী সম্পদ যা প্রচুর পরিমাণ দান করলেও বিন্দুমাত্র হ্রাস পায় না। জ্ঞান হলো নূর বা আলো যা পৃথিবীর মানুষকে পথ দেখায়। মহান আল্লাহ্ বলেছেন যে,সে-ই বেশি তাকওয়া সম্পন্ন যে বেশী জ্ঞানী। মহান আল্লাহ্ আরো বলেছেন,যে জানে আর যে জানে না তারা দু জন সমান নয়। এই জ্ঞান অর্জনের পথে কারো মৃত্যু হলে তাকে শহীদের মৃত্যুসম বলা হয়েছে। তাই এই জ্ঞান অর্জনে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করা-একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করা উভয়ই কল্যাণকর ও আনন্দদায়ক। জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্য হলো অন্ধকার ও অজ্ঞতা দূর করা। অনৈক্য ও বিভেদ মুছে ফেলা। আর সত্যের চূড়ায় আরোহণ করা। যুগে যুগে যেসব সাধক মনীষী এ অনুভূতি নিয়ে কাজ করেছেন,পরস্পর বন্ধুত্ব করেছেন,কথা বলেছেন আল্লামাহ্ শারাফুদ্দীন (রহ.) ও মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শেখ সালিম আল বিশরী (রহ.) তাঁদেরই অন্যতম পুরোধা। মুসলমানদের মাঝের বিতর্কিত বিষয়গুলো পরিহার করা ও সর্বজনস্বীকৃত বিষয়গুলোর দিকে সবারই ফিরে আসা এই ছিল তাঁদের পত্রালাপের মূল প্রতিপাদ্য। সর্বজনস্বীকৃত হাদীস,তাফসির,রেওয়ায়েতসমূহ তাঁদের পরিচয়,বন্ধুত্ব ও পত্রালাপকে পূর্ণতা দিয়েছিল। নিগুঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। পরস্পরের অমিল,অনৈক্য ও বিভেদসূচক বিষয়াদি নিয়ে যখন মুসলিম বিশ্ব চিন্তা ও দলগত শত শত ফিরকায় বিচ্ছিন্ন তখন এই দুই শ্রেষ্ঠ আলেম খুঁজেছিলেন মিল ও ঐক্যের সূত্রসমূহ। তাঁদের যুগের সীমা পেরিয়ে এ ঐক্য আমাদেরও উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।

আল্লামাহ্ শারাফুদ্দীন ও আল্লামাহ্ শেখ সালিম-এর পত্রালাপই আরবী ভাষায় আল মুরাজায়াত নামে সংকলিত হয়। মুরাজায়াত অর্থ পরস্পর রুজু হওয়া বা পরস্পরের দিকে মুখাপেক্ষী হওয়া।

এ মহামূল্যবান গ্রন্থটি ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় এই বইটি প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত। এই বইটি অনুবাদ করতে জনাব আবুল কাসেম যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে বড় পুরস্কার আশা করছি। এই বইটি প্রকাশের জন্য যাঁরা এগিয়ে এসেছেন বিশেষ করে জনাব মোঃ নাঈম (Md.Nayeem),জনাব সালমান খান (Mr.Salman Khan) এর কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। অনুবাদ, সম্পাদনা, প্রকাশনার প্রতিটি পর্যায়ে যাঁরা কষ্ট করেছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন তাঁদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

বইটি আজকের বাংলা ভাষী সত্যান্বেষী মানুষকে উপকৃত করলে ও মুসলমানদের ঐক্যের পথে এগিয়ে নিলেই আমাদের এ শ্রম সার্থক হবে। মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি।

লেখক পরিচিতি

সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন ১২৯০ হিজরীতে ইরাকের কাযেমাইন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এমন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যেখানে জ্ঞানের পূর্ণ পরিবেশ ছিল। তিনি এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেকে ইসলামের একজন পরিপূর্ণ আলেম হিসেবে প্রস্তুত করতে তৎপর হন। তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সমাধিস্থলের নিকটে প্রতিষ্ঠিত নাজাফের মাদ্রাসায় বিশিষ্ট আলেমদের নিকট উসূল,ফিকাহ্ ও ইসলামী জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে সাইয়্যেদ কাযেম তাবাতাবায়ী,আখুন্দ খোরাসানী,ফাতহুল্লাই ইস্ফাহানী,শেখ মুহাম্মদ ত্বাহা নাজাফ এবং হাসান কারবালাই প্রসিদ্ধ।

এই বিশিষ্ট আলেমের বিশেষত্ব ছিল এই যে,তিনি অধিকাংশ দীনী ছাত্রের ন্যায় শুধু ধর্মীয় পড়াশুনায়ই সময় কাটাতেন না,বরং ইসলামী সমাজের অবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন ছিলেন ও সমাজের সমস্যাসমূহের সমাধানের পথ খুঁজতেন। বিশেষত এ গ্রন্থের ভূমিকায় তাঁর নিম্নোক্ত মন্তব্য থেকে তা বোঝা যায়। তিনি বলেছেন, তরুণ বয়স থেকেই শিয়া ও সুন্নী এ দু মাজহাবের মধ্যে অনৈক্যের বিষয়টি আমাকে কষ্ট দিত ও আমি এ অবস্থা হতে মুক্তির পথ খুঁজতাম।

তিনি ৩২ বছর বয়সে লেবাননের জাবালূল আমেল -এ হিজরত করেন। আমেলের অধিবাসী ও আলেমগণ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তিনি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের ঐশী নির্দেশ বাস্তবায়নে স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে মজলুমদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। এক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞানগর্ভ বাণী ও বক্তব্য লেবাননের আলেমদের ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন করত।

তিনি শুধু স্থানীয় শাসকদের বিরুদ্ধেই নয়,বরং তৎকালীন উপনিবেশবাদী ফরাসীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ফরাসীদের তৎপরতায় তিনি বাধ্য হয়ে সিরিয়ায় হিজরত করেন। ফরাসী সৈন্যরা লেবাননের শাখুরে তাঁর গৃহে ও সোউরে তাঁর গ্রন্থাগারে অগ্নিসংযোগ করে। এ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত তাঁর লিখিত উনিশটি গ্রন্থ এতে নিশ্চি হ্ন হয়ে যায়। এ কর্মে ফরাসীদের সভ্যতার রূপ উন্মোচিত হয়।

সিরিয়াতেও তিনি আলেম ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ফরাসী উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। এতে ফরাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকেসহ এ আন্দোলনের অসংখ্য নেতাকে ফিলিস্তিনে নির্বাসিত করে। কয়েক মাস সেখানে অবস্থানের পর ১৩৩৮ হিজরীতে তিনি স্বেচ্ছায় মিশর গমন করেন এবং বিশিষ্ট ধর্মীয়,সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচিত হন ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। যেহেতু তিনি ১৩২৯ ও ১৩৩০ হিজরীতে দু বার মিশর এসেছিলেন সেহেতু মিশরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও আলেমগণ তাঁকে চিনতেন। এখানেই তাঁর সাথে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শেখ সালিমের সাথে কয়েকটি বৈঠক হয়। এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় তাঁদের মধ্যে প্রচুর পত্র বিনিময় হয় যা গ্রন্থাকারে আল মুরাজায়াত নামে পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়।

লেখকের কথা

কেন ও কিভাবে এ গ্রন্থ রচিত হলো?

এ গ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলো আজ লেখা হয় নি আর এটি রচনার পেছনে যে চিন্তা কার্যকর ছিল তাও সাম্প্রতিক নয়,বরং এ গ্রন্থের পৃষ্ঠাগুলো পঁচিশ বছর পূর্বেই সংকলিত হয়েছিল। তখনই এর উচিত ছিল পত্রিকার পাতায় আলো বিকিরণ করার। কিন্তু বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এর গতিকে স্তব্ধ করে দেয়ায় এতদিন দৃশ্যমান হতে পারে নি। তবে এ দিনগুলো এর বিক্ষিপ্ততা ও ত্রুটি দূর করে পূর্ণতা দানের সুযোগ এনে দিয়েছিল। কারণ ইতোপূর্বে মুদ্রণের বিলম্বে এর পাতাগুলো অগোছালো ও বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

এ গ্রন্থ সংকলনের চিন্তা এটি রচনার অনেক পূর্বেই জন্মলাভ করেছিল। এ চিন্তা তরুণ বয়সেই আমার মাথায় উঁকি দিচ্ছিল ও বিদ্যুতের ন্যায় তা আমার ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ বিষয়টি আমার চিন্তাকে সব সময় সঠিক পথে পরিচালিত করত যেন মুসলমানদের মাঝে বিদ্যমান অকল্যাণের মূলোৎপাটন ও তাদের চোখের সামনে থেকে পর্দা অপসারণের মাধ্যমে বাস্তব দৃষ্টিতে জীবনকে অবলোকনে সক্ষম হই। বদ্ধ কপাট উন্মোচনের মাধ্যমে তাদের সামনে সেই প্রকৃত দীন- যার অনুসরণ সকলের ওপর অপরিহার্য তা তুলে ধরতে পারি। ফলশ্রুতিতে সকলে একযোগে ঐশী রজ্জু ধারণ,জ্ঞান ও কর্মের অনুসন্ধান ও সত্যের পতাকার নীচে সমবেত হতে পারি যা আমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও আদর্শের জন্ম দেবে এবং একে অপরের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত করবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,মুসলিম ভ্রাতৃগণ যারা একই উৎস থেকে উৎসারিত ও অভিন্ন বিশ্বাস পোষণ করে তারা পরস্পর শত্রুতে পরিণত হয়েছে। আলোচনার ক্ষেত্রে তারা মূর্খের ন্যায় এতটা সীমা লঙ্ঘন করছে যে,আলোচনা ও বির্তকের সীমা পেরিয়ে তা অস্ত্র ধারণ ও একে অপরকে আক্রমণে পর্যবসিত হচ্ছে। এ অবস্থাটি অন্তরের বিদ্বেষ হতে সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা একদিকে আমাদের চিন্তার দিকে আহবান করছে অন্যদিকে আমাদের অন্তরকে দুঃখভারাক্রান্ত করছে। এ অবস্থায় কি করা উচিত?

এসব আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিত;আমার কাঁধে যেন দুঃখের বোঝা চেপে বসেছিল। এ অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় ১৩২৯ হিজরীতে আমি মিশরে গমন করি। মুসলমানদের মাঝে ঐক্যের লক্ষ্যে কলমসমূহকে এ পথে আনার প্রচেষ্টা শুরু করি। পূর্বেই আমার মধ্যে এ অনুভূতি দৃঢ়তা লাভ করেছিল যে,এমন ব্যক্তির সন্ধান লাভ করবো যার কাছে আমার অনুভূতি আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করতে পারব ও ঐক্যের সে লক্ষ্যে পৌঁছার সঠিক পথ নির্বাচনে সক্ষম হব। হয়তো আল্লাহ্ আমাদের মধ্য থেকে এমন এক তীর ছোঁড়াবেন যা ছিন্ন ভিন্ন মুসলিম জাতিকে ঐক্যের পতাকাতলে সমবেত করবে ও নিজেদের বিপদাপদকে দূরীভূত করবে।

আলহামদুলিল্লাহ্,অবশেষে যখন মিশরে এলাম তখন আমার সে লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হলাম। কারণ সে সময় মিশর এমন এক কেন্দ্র ছিল যেখান থেকে জ্ঞান অঙ্কুরিত এবং প্রমাণের ওপর নির্ভর করে তা সত্যের দিকে পরিচালিত ও অবনমিত হত। এছাড়াও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতির বৈশিষ্ট্যও সমন্বিত হয়েছিল মিশরে। অবশেষে এখানেই সৌভাগ্যক্রমে এমন একজন বড় আলেমের সন্ধান পাই যাঁর সাক্ষাৎ আমার আনন্দকে পূর্ণতা,হৃদয়কে প্রফুল্ল ও মস্তিষ্ককে নিশ্চিন্ততা দান করে। তিনি সুন্দর চরিত্র,গভীর চিন্তাশক্তি,সজীব হৃদয় ও সমুদ্রের ন্যায় প্রসারিত জ্ঞানের অধিকারী মিশরের এক সম্মানিত ও কৃতি সন্তান। তিনি সেখানকার ধর্মীয় নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন এবং প্রকৃতই এ পদের উপযুক্ত ছিলেন।

এ বিষয়টি কতই না সুন্দর আলেম ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা পরস্পরের মিলনে পবিত্র হৃদয়,হাসিমুখ ও নবী (সা.)-এর ন্যায় ব্যবহার ও আচরণ প্রদর্শন করবে! কোন আলেম ও জ্ঞানী ব্যক্তি এমন চমৎকার পোষাক তাঁর দেহ ও মনে পরিধান করে নিজে যেমন প্রফুল্ল থাকবেন তেমনি মানুষরাও নিরাপত্তা ও প্রশান্তি সহকারে তাঁর নিকট মনের কথা বলবে,এ বিষয়ে কোন সংকোচ অনুভব করবে না ও নির্দ্বিধায় তাদের গোপন কথাগুলো বলতে পারবে।

মিশরের এ বিশিষ্ট ব্যক্তিটি এমনই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নাজাফের বৈঠকগুলো এত আকর্ষণীয় ছিল,আশা করতাম যেন তার সমাপ্তি না ঘটে। আমি আমার অসন্তোষ ও মনোকষ্টগুলো তাঁর নিকট বলতাম এবং তিনিও তাঁর বিভিন্ন অভিযোগ-অনুযোগ আমাকে বলতেন। যে বিষয়ে আমাদের দু জনের মধ্যে ঐকমত্য ছিল তা হলো শিয়া ও সুন্নী উভয়ই মুসলমান ও নিঃসন্দেহে সত্য দীন- ইসলামের অনুসারী। তাই নবী (সা.) তাদের জন্য যা এনেছেন সে বিষয়ে তারা একমত পোষণ করে। ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহে তাদের মাঝে কোন অনৈক্য নেই। যে অনৈক্য রয়েছে তা কোরআন,সুন্নাহ্,ইজমা ও আকল হতে দীনের আহকাম উদ্ঘাটনে মুজতাহিদদের মধ্যকার পার্থক্যের ন্যায়। তাই এ ক্ষুদ্র বিভেদ উম্মতের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে না। কি কারণে এ দু সম্প্রদায়ের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হলো ও তারা পরস্পরকে সহ্য করতে পারছে না তার রহস্য উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন।

আমরা যদি ইসলামের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে,এ বিভেদের কারণ একটি বিশ্বাসগত মৌল বিষয়ের মধ্যে নিহিত,আর তা হলো ইমামত। কারণ ইসলামের অন্য কোন মৌল বিষয়ের জন্য কেউ অস্ত্র ধারণ করে নি। সুতরাং ইমামত এ অনৈক্যের সর্ববৃহৎ কারণ। যুগ যুগ ধরে ইমামতের বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা হয় নি,বরং দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখা হয়েছে। যদি উভয় পক্ষ বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে (শত্রুতার দৃষ্টিতে নয়) পরস্পরের উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণগুলোকে দেখতেন তবে সত্য প্রকাশিত এবং সত্যাকাঙ্ক্ষীদের সামনে সত্যের সূর্য উদিত হত।

আমরা উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ যথার্থরূপে পর্যালোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের ব্রত নিয়েছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এমনভাবে বিষয়টিকে অনুভব করবো যাতে পরিবেশে অন্ধ অনুকরণ ও আবেগের কোন স্থান না থাকে। নিজেদের সকল প্রকার গোঁড়ামী ও অন্ধত্ব হতে মুক্ত করে সত্যের পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সংকল্প নিয়েছিলাম যাতে করে সর্বসম্মত সঠিক পথকে অনুভবের মাধ্যমে মুসলমানদের হৃদয়ে প্রশান্তি দান ও আমাদের নিকট সত্য প্রমাণিত বিষয়ের প্রতি মুসলমানদের চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করা যায়। আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহে এ সীমার মধ্যেই আমাদের আলোচনার সমাপ্তি ঘটানো।

তাই আমরা চুক্তিবদ্ধ হলাম তিনি যে কোন প্রশ্ন লিখিতরূপে উপস্থাপন করবেন এবং আমি স্বহস্তে সঠিকতার ভিত্তিতে তার উত্তর দান করবো যা উভয় পক্ষের নিকট গ্রহণযোগ্য সূত্র যথা কোরআন,সুন্নাহ্ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

আল্লাহর ইচ্ছায় আল মুরাজায়াত গ্রন্থটি এভাবেই প্রস্তুত হয়েছিল। যদিও আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল সে সময়েই আমাদের সম্পাদিত কর্মকাণ্ড গ্রন্থাকারে প্রকাশ করবো কিন্তু ভাগ্য ও কালের হস্তক্ষেপে তা সম্ভব হয় নি। হয়তো এর মধ্যে কোন কল্যাণ নিহিত ছিল যা আমরা অবগত ছিলাম না।

আমি দাবি করছি না এ পৃষ্ঠাসমূহ সে সময়ে আমাদের মাঝে যে পত্রসমূহ বিনিময় হয়েছে হুবহু সেগুলোই বা তাঁর বর্ণিত শব্দগুলোই এনেছি। কারণ ছাপার বিলম্বের কারণে পৃষ্ঠাসমূহ অবিন্যস্ত হয়ে পড়ায় অনুক্রম রক্ষা করা যায় নি। তাই বাধ্য হয়ে নতুন করে পৃষ্ঠাগুলো বিন্যস্ত করেছি। তবে এ প্রতিশ্রুতি দিতে পারি,আমাদের মাঝে যা কিছু আলোচিত হয়েছে তা পুরোপুরিই এ গ্রন্থে এসেছে।

আমি প্রথম দিন যে আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতাম এখনো একই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি। আর তা হলো এ গ্রন্থ যেন ইসলামী উম্মতের সংস্কার ও কল্যাণ সাধন করতে পারে। তাই যদি মুসলমানরা এ গ্রন্থের প্রতি আগ্রহ পোষণ করে তবে তা আল্লাহর অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়। এটিই হবে আমার কর্মের সর্বোত্তম প্রাপ্তি। কারণ আমার যোগ্যতা ও ক্ষমতার সীমায় সংস্কার মহান প্রতিপালকের বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া সম্ভব নয়। তাই তাঁর প্রতি নির্ভর ও প্রত্যাবর্তন করছি-

انْ اُريدُ الاّ الاِصلاحَ ما استطَعْتُ و ما توفِيقي اِلاّ بالله عليه توكلتُ و اليه اُنيبُ

আমি এ গ্রন্থটি সেই সকল জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছি যাঁরা সত্যকে অনুধাবনের জন্য যথার্থ পর্যালোচনা করেন। সেই সকল হাফিয ও মুহাদ্দিসের উদ্দেশ্যে আমার এ নিবেদন যাঁরা হাদীস গবেষণার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দলিলের ওপর নির্ভর করেন। আমার এ নিবেদন অভিজ্ঞ দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রবিদদের এবং অন্ধত্ব ও গোঁড়ামীর শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা সেই সকল স্বাধীন ও মুক্তমনা শিক্ষার্থী যুবকের উদ্দেশ্যে যারা আমাদের নবীন ও মুক্ত জীবনের আশার আলো। তারা এ গ্রন্থ  হতে লাভবান হলেই আমার সফলতা।

আমি এ গ্রন্থের বিন্যাস,সংস্কার ও পর্যাপ্ত ব্যাখ্যামূলক প্রশ্নের উত্তর দানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি যাতে ন্যায়পরায়ণ ও সঠিক যুক্তিপ্রত্যাশী পাঠকরা কোন সন্দেহ ব্যতীত এর প্রতি সম্পৃক্ত হতে পারেন। আমি এ গ্রন্থে সুস্পষ্ট,সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস ও রেওয়ায়েতগুলোই শুধু এনেছি যাতে করে পাঠকদের ইতিহাস,হাদীস ও কালামশাস্ত্রের উদ্ধৃত গ্রন্থগুলোর প্রতি রুজু করার তেমন কোন প্রয়োজন না হয়। যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমি ভারসাম্য ও সত্যপরায়ণতার প্রতি লক্ষ্য রেখেছি। এতে পাঠকরা প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত গ্রন্থটি অধ্যয়নে উক্ত লক্ষ্যে অগ্রসর হবেন। আমার এ গ্রন্থ সত্যাকাঙ্ক্ষী ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির হাতে সমর্পিত হোক আল্লাহর নিকট এ আশা করছি।

আলহামদুলিল্লাহ্,এ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ায় স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। এজন্য আমি আমার নিজ জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট। কারণ এ কর্মের মাধ্যমে আমার সারা জীবনে যে কষ্ট করেছি,যে দুঃখভার সহ্য করেছি তা ভুলে গিয়েছি বলে আমার বিশ্বাস। শত্রুদের ষড়যন্ত্র,অপচেষ্টার অভিযোগ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নিকট উপস্থাপন করবো না। তিনি বিচারক হিসেবে যথেষ্ট। সর্বোপরি দোয়া করছি মহান আল্লাহ্ বিপদাপদের সকল পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ ও আমার অন্তর হতে সকল অন্ধকার দূরীভূত করুন,এই গ্রন্থকে দুনিয়া ও আখেরাতে আমার মুক্তির মাধ্যম (উসিলা) করে দিন,আমার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন ও আমার অন্তরে প্রশান্তি দিন। তাঁর নিকট আশা করছি আমার কর্মকাণ্ডকে কবুল করুন ও একে মুমিনদের হেদায়েতের উপকরণ বানিয়ে দিন।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।

নিবেদক

সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন আল মুসাভী

প্রথম আলোচনা

দীনি নেতৃত্ব

মাজহাবে ইমামত

প্রথম পত্র

৬ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। সালাম ও অভিনন্দন!

২। আলোচনার অনুমতি!

১। বিশিষ্ট আলেম আল্লামাহ্ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন মুসাভীর প্রতি সালাম। আল্লাহর রহমত ও বরকত আপনার ওপর অবতীর্ণ হোক।

আমি আমার সমগ্র জীবনে শিয়াদের অবস্থার স্বরূপ,অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা ও চরিত্র সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম এবং কখনো তা জানার জন্য প্রচেষ্টাও চালাই নি। এটি এ কারণে যে,তাদের সঙ্গে আমার কোন ওঠাবসা ছিল না এবং আমি শিয়া সমাজ ও রাষ্ট্রেও কখনো বসবাস করি নি। কিন্তু তাদের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ ও আলেম সমাজের সঙ্গে আলোচনার জন্য সব সময়ই খুবই আগ্রহী ছিলাম। সেই সাথে ইচ্ছা ছিল তাদের সাধারণ মানুষের মাঝে গিয়ে তাদের ইচ্ছা ও প্রবণতা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা লাভ ও কৌতুহল নিবারণ করবো। এ কারণেই হয়তো স্বর্গীয় বিধি আপনার জ্ঞান মহাসাগরের তীরভূমি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেছে যাতে আমার এ তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ আপনার জ্ঞানের সুপেয় পানি পানে সিক্ত হয়। মহান আল্লাহ্ আপনার জ্ঞানের সুপেয়তায় আমার ব্যাধির উপশম করেছেন এবং আমার তৃষ্ণা নিবারিত হয়েছে। আপনার প্রপিতা জ্ঞানের শহর মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.) এবং তাঁর দ্বারা আপনার পিতা আলী মুর্তাযার নামের শপথ করে বলতে পারি তৃষ্ণা নিবারিত করার এরূপ ক্ষমতাসম্পন্ন কোন স্বর্গীয় ঝরনার সন্ধান এ পর্যন্ত আমি পাই নি।

আমি শিয়াদের সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তা হলো আপনারা (শিয়ারা) স্বীয় সুন্নী ভ্রাতৃবৃন্দ হতে দূরে থাকেন,একাকী থাকতে পছন্দ করেন,ঘরের কোণে আশ্রয় গ্রহণ করেন ইত্যাদি। কিন্তু আমি আপনাকে সুন্দর আচরণের মানুষ,সেই সাথে আলোচনায় অত্যন্ত আগ্রহী,সংলাপে দক্ষ ও যথার্থ,বিতর্কে পারদর্শী,বক্তব্যে সূক্ষ্মদর্শী ও সহিষ্ণু,বাকযুদ্ধে ভদ্র ও মার্জিত,ওঠাবসায় কৃতজ্ঞতার ছাপ এবং আত্মমর্যাদাবোধে সৎ হিসেবে পেয়েছি। সুতরাং যে ব্যক্তি শিয়া মাজহাবকে গ্রহণ করেছে সে বন্ধুসুলভ এবং তার সঙ্গে বসার আকাঙ্ক্ষা সকল সাহিত্যিকেরই আছে।

২। আমি এখন আপনার জ্ঞানের অসীম দরিয়ার তীরে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাচ্ছি এর স্রোতে অবগাহন করতে এবং এর গভীরে প্রবেশ করে মণিমুক্তা আহরণ করতে। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে যে সমস্যা ও অস্পষ্টতা দীর্ঘকাল আমার হৃদয়কে তোলপাড় করছে তা আপনার সমীপে পেশ করবো। আমি আপনার আলোচনার ভুল-ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবো না,কারো ত্রুটি অন্বেষণ বা সমালোচনাও আমার লক্ষ্য নয়,এগুলোর মাধ্যমে মানুষের মাঝে গুজব ছড়ানোও আমার উদ্দেশ্য নয়,বরং আমি হারানো বস্তু ও সত্যের সন্ধানে রত। যদি সত্য প্রকাশিত হয় তবে অবশ্যই তার অনুসরণ করতে হবে নতুবা কবির ভাষায় বলতে হয়- আমার যা রয়েছে তাতে আমি সন্তুষ্ট আর তোমার যা রয়েছে তাতে তুমি । যদি অনুমতি দেন তাহলে দু টি শিরোনামে আমাদের আলোচনা চলবে :

১। ইমামত : মাজহাবের মূল ও শাখাগত পর্যায়ে (অর্থাৎ দীনি বিষয়ে) কার প্রতি রুজু করবো।

২। মুসলমানদের সার্বিক নেতৃত্ব অর্থাৎ রাসূল (সা.)-এর খেলাফত। আমি আমার পত্রের শেষে স্বাক্ষরের পরিবর্তে ব্যবহার করছি। আপনাকেও ব্যবহারের জন্য আহবান জানাচ্ছি। পত্রের যে কোন ত্রুটির জন্য আপনার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী।

ওয়াসসালাম

দ্বিতীয় পত্র

৬ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। সালাম ও অভিনন্দনের উত্তর।

২। আলোচনা শুরু করার অনুমতি প্রদান!

১। শাইখুল ইসলাম সালিমের ওপর সালাম। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।

আপনার ভালবাসাপূর্ণ পত্রটি আমার হাতে পৌঁছেছে। আপনি যেভাবে আপনার স্বভাবগত কোমলতা ও বিশেষ দৃষ্টিতে আমাকে রেখেছেন এর ধন্যবাদ জ্ঞাপনে আমার বাচনশক্তি অক্ষম অর্থাৎ দীর্ঘসময়েও এর সঠিক ও উপযোগী হক্ব আদায় করা সম্ভব নয়।

আপনি আপনার ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে আমার নিকট উপস্থাপন করেছেন অথচ আপনি স্বয়ং আশাবাদীদের কেন্দ্র ও আশ্রয় প্রার্থনাকারীদের মুক্তিদাতা।

আমি সিরিয়া থেকে আকাঙ্ক্ষার বাহনে আরোহণ করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আপনার দ্বারে উপনীত হয়েছি যাতে আপনার জ্ঞান থেকে কিছু আহরণ করতে পারি। আপনার গুণের বারিধারা থেকে কিছু অর্জন করে খুব শীঘ্রই আল্লাহর ইচ্ছায় প্রাণবন্ত আশা ও অবিচলিত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ফিরে যাব।

২। আপনি আমার নিকট আলোচনার জন্য অনুমতি চেয়েছেন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদেশ-নিষেধ তো আপনার পক্ষ থেকেই। আমি পূর্বেই আপনাকে গ্রহণ করেছি। আপনার যা ইচ্ছা আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন,যা ইচ্ছা বলতে পারেন। ন্যায়,শ্রেষ্ঠত্ব ও সঠিকতা (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) যাচাইয়ের দায়িত্ব আপনার।

ওয়া আলাইকাসসালাম

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম

তৃতীয় পত্র

৭ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   কেন শিয়ারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করে না?

২।   অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অধিক।

৩। পরস্পর বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা দূরীকরণের একমাত্র পথ হলো অধিকাংশের মতাদর্শকে গ্রহণ।

১। আমার প্রথম প্রশ্ন হলো কেন আপনারা অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শের অনুসরণ করেন না? অধিকাংশ মুসলমানের মতাদর্শ বলতে আমি আকীদার ক্ষেত্রে আশা আরী মতবাদ (*১) ও ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবকে (*২) বুঝিয়েছি। কারণ পূর্ববর্তী সত্যপন্থীরা এ বিশ্বাসের অনুবর্তী ছিলেন এবং এই মাজহাবগুলোকে ন্যায়পন্থী ও শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। সকল যুগের সকল আলেম এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন যে,এ মাজহাবগুলোর প্রধানগণ ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদ,আমানতদারী,তাকওয়া,পরহেজগারী,আত্মিক পবিত্রতা,সুন্দর চরিত্র ও মর্যাদার ক্ষেত্রে অনন্য ছিলেন,তাই জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এদের অনুসরণ করা উচিত।

২। আপনি ভালভাবেই জানেন,বর্তমানে সমঝোতা ও ঐক্যের কতটা প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলার জন্য আপনাদের অধিকাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর মতের অনুসরণ অপরিহার্য। বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতে লক্ষ্য করছি দীনের শত্রুরা আমাদের বিরুদ্ধে অন্যদের মনে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের ধ্বংস করার সম্ভাব্য সকল পন্থা অবলম্বন করছে। তারা এজন্য সকল নক্সা ও পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে এবং চিন্তা ও অন্তঃকরণকে যে কোন রকম অসচেতনতা থেকে দূরে রেখেছে। অথচ আমরা মুসলমানরা পূর্বের মতই অসচেতন হয়ে আছি। আমরা যেন অজ্ঞতা ও অশিক্ষার সমুদ্রে বাঁচার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছি। এ বিষয়গুলো আমাদের শত্রুদের সহায়তা করছে। এ অবস্থা আমাদের জাতিগুলোকে দ্বিধাবিভক্ত করছে,বিভিন্ন দল ও গ্রুপের সৃষ্টি করছে,দলীয় সংকীর্ণতা ও অন্ধবিশ্বাস ঐক্যকে বিনষ্ট করছে,দলগুলো একে অপরকে বিচ্যুত ও বিপথগামী মনে করছে এবং একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এখন নেকড়েরা আমাদের শিকার করছে আর কুকুরেরা আমাদের দিকে লোভের জিহ্বা প্রসারিত করছে।

৩। আমি যা বলেছি আপনি পরিস্থিতিকে এর চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু মনে করেছেন কি? মহান আল্লাহ্ আপনাকে ঐক্য ও সমঝোতার পথে হেদায়েত দান করুন। সুতরাং বলুন এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখুন আপনার কথা মনোযোগসহ শোনা হবে। আপনার নির্দেশ মত চলার জন্য আমাকে নির্দেশ দান করুন।

ওয়াসসালাম

চতুর্থ পত্র

৮ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১।   শরীয়তি দলিল-প্রমাণ আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসরণকে ওয়াজিব ও অপরিহার্য মনে করে।

২।   অধিকাংশের মতাদর্শকে (আহলে সুন্নাতের) অনুসরণের পক্ষে কোন দলিল নেই।

৩।   প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানরা সুন্নী মাজহাবকে (চার ইমামের মাজহাব) চিনতেন না।

৪।   সকল যুগেই ইজতিহাদ সম্ভব।

৫।   বিভেদ দূরীকরণ আহলে বাইতের মতাদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সম্ভব।

১। দীনের মৌল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অ-আশা আরী এবং ফিকাহর ক্ষেত্রে চার মাজহাবের বাইরের একটি মতাদর্শকে গ্রহণ কোন দলবাজী,অন্ধবিশ্বাস বা দলীয় সংকীর্ণতার কারণে নয়। চার মাজহাবের ইমামগণের ইজতিহাদের বিষয়ে সন্দেহ বা তাঁদের ন্যায়পরায়ণতা,আমানতদারী,জ্ঞানগত যোগ্যতা ও আত্মিক পবিত্রতার প্রতি অবিশ্বাসের কারণেও ভিন্ন মতাদর্শ শিয়ারা গ্রহণ করে নি,বরং শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণই নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অনুসরণের প্রতি আমাদের অপরিহার্যতা দান করেছে। যেহেতু তাঁরা নবুওয়াতের ছায়ায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন,তাঁদের ঘরে ফেরেশতাদের আসা যাওয়া ছিল,সেখানে আল্লাহ্ ওহী ও কোরআন অবতীর্ণ করেছেন তাই আমরা আকীদা-বিশ্বাস,ফিকাহ্ ও শরীয়তের আহ্কাম কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান,চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে তাঁদের অনুবর্তী হয়েছি।

এটি কেবল যুক্তি প্রমাণের প্রতি আত্মসমর্পণের কারণে। আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহর প্রতি বিশ্বাসের কারণেই এ পথকে আমরা বেছে নিয়েছি। যদি যুক্তি আমাদের নবীর আহলে বাইতের বিরোধিতার অনুমতি দিত অথবা অন্য মাজহাবের অনুসরণের মাধ্যমে নৈকট্য ও দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকত তবে অধিকাংশ মুসলমানের অনুসরণ করতাম,তাদের পথে চলতাম তাতে করে বন্ধুত্বের বন্ধনও সুদৃঢ় হত এবং একে অপরকেও অধিকতর আস্থার সাথে গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু অকাট্য যুক্তি ও দলিল মুমিনের এ পথে যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং তার ও এ চাওয়ার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

২। তদুপরি সুন্নী মাজহাব অন্য মাজহাবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য কোন যুক্তি উপস্থাপনে সক্ষম নয়। সেখানে কিরূপে এর অনুসরণ অপরিহার্য হতে পারে। আমরা মুসলমানদের প্রদর্শিত যুক্তিসমূহে পূর্ণ ও যথার্থ দৃষ্টি দান করেছি এবং পর্যালোচনা ও গবেষণা চালিয়েছি কিন্তু আহলে সুন্নাহর অনুসরণের পক্ষে উপযুক্ত কোন দলিল পাই নি। আপনি তাঁদের অনুসরণের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে যে বিষয়গুলো বলেছেন যেমন আমানতদারী,ন্যায়পরায়ণতা,ইজতিহাদের ক্ষমতা,মর্যাদা প্রভৃতি,আপনি ভালভাবেই জানেন এ বিষয়গুলি শুধু তাঁদের মধ্যেই ছিল না,অন্যরাও এর অধিকারী ছিলেন। সুতরাং শুধু তাঁদের মাজহাবের অনুসরণ কিরূপে ওয়াজিব বলে গণ্য হবে।

আমি কখনোই এ ধারণা করি না যে,কেউ বলবে জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে এই ব্যক্তিবর্গ আমাদের ইমামগণ থেকেও উত্তম অর্থাৎ নবী (সা.)-এর পবিত্র বংশধর যাঁরা উম্মতের মুক্তির তরণী,ক্ষমার দ্বার(*৩),ধর্মীয় বিভক্তির ফেতনা হতে রক্ষার কেন্দ্র,হেদায়েতের পতাকাবাহী,রাসূলের রেখে যাওয়া সম্পদ এবং ইসলামী উম্মতের মাঝে রাসূলের স্মৃতিচিহ্ন তাঁরা অবশ্যই সর্বোত্তম। কারণ তাঁদের সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, তাদের থেকে তোমরা অগ্রগামী হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবার ক্ষেত্রে অবজ্ঞার পথ বেছে নিও না তাহলেও তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে,তাদেরকে কোন কিছু শিক্ষা দিতে যেও না কারণ তারা তোমাদের হতে অধিক জ্ঞানী।

কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে অন্যরা তাঁদের অগ্রগামী হয়েছে। আপনি কি জানেন ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনীতির কি প্রয়োজন ছিল ও পরবর্তীতে তা কি হয়েছে? আপনার থেকে এ কথাটি শোনা আশ্চর্যজনক,আপনি বলেছেন, পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ এসব মাজহাবের অনুসারী ছিলেন আর এসব মাজহাবকে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে ন্যায়ভিত্তিক বলে বিবেচনা করার কারণেই সকল যুগে সর্বজনীনভাবে এগুলোর অনুসরণে আমল করা হত। সম্ভবত আপনি এ বিষয়ে অবহিত নন যে,পূর্ববর্তী সৎ কর্মশীলগণ ও পরবর্তীতে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাসূলের বংশধরদের অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর অর্ধেক ছিলেন এবং আহলে বাইতের ইমামগণ ও রাসূলুল্লাহর রেখে যাওয়া দ্বিতীয়ثقل বা ভারী বস্তুর প্রতি ঈমান রাখতেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখা যায় নি এবং তাঁরা হযরত আলী (আ.) ও ফাতিমা (আ.)-এর সময়কাল হতে এখন পর্যন্ত এ প্রথানুযায়ী আমল করেছেন। সে সময়ে আশা আরী,চার মাজহাবের ইমামগণ বা তাঁদের পিতৃকূলেরও কেউ ছিলেন না। এ বিষয়টি আপনার অজানা নয়।

৩। তদুপরি প্রথম তিন শতাব্দীতে মুসলমানগণ এ মাজহাবগুলোর কোনটিরই অনুসারী ছিলেন না। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের অবস্থান কোথায় আর এ মাজহাবগুলোরই বা অবস্থান কোথায়? অথচ সে সময়কাল ইসলামের জন্য আপনার ভাষায় শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। আপনি লক্ষ্য করুন,আশা আরী ২৭০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ৩৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল ১৩৪ হিজরীতে জন্ম ও ২৪১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। শাফেয়ী ১৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ২০৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। মালিক ৯৫ হিজরীতে জন্ম ও ১৭৯ হিজরীতে ওফাত প্রাপ্ত হন। আবু হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্ম ও ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু শিয়ারা ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি অনুগত ছিলেন কারণ আহলে বাইত নবুওয়াতের গৃহের বিষয়ে অধিকতর অবহিত ছিলেন অথচ অন্যরা তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের অনুসরণ করতেন।(*৪)

সুতরাং কোন্ যুক্তিতে সকল মুসলমানকে তিন শতাব্দী পর(*৫) যেসব মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলোর প্রতি আনুগত্যের শপথ দেয়া হয় অথচ প্রথম তিন শতাব্দীর অনুসৃত পথের কথা বলা হয় না? কি কারণে তাঁরা মহান আল্লাহর গ্রন্থ কোরআনের সমকক্ষ অপর ভারী বস্তু মহানবীর রক্তজ বংশধর,তাঁর জ্ঞানের দ্বার,মুক্তি-তরণী,পথ-প্রদর্শক,উম্মতের রক্ষা পাবার পথ হতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন?

৪। কেন ইজতিহাদের যে পথটি তিন শতাব্দী ধরে মুসলমানদের জন্য উন্মুক্ত ছিল হঠাৎ করে তা চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হলো? এটি অক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ,আস্থা হতে অনাস্থা ও অলসতার দিকে প্রত্যাবর্তন বৈ কিছু নয়। এটি কি অজ্ঞতায় সন্তুষ্টি ও বঞ্চনায় তুষ্টতার নামান্তর নয়?

কোন্ ব্যক্তি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে নিজেকে এ বাস্তবতার প্রতি সন্তুষ্ট মনে করতে পারে এবং বলতে পারে?

মহান আল্লাহ্ তাঁর প্রেরিত নবী ও রাসূলদের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে সর্বোত্তম গ্রন্থ যা চূড়ান্ত জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আইনের সমষ্টি তা দিয়ে প্রেরণ করেছেন যাতে করে তাঁর দীন পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামত সম্পূর্ণ হয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত সব কিছুর সমাধান তা থেকে পাওয়া যায়। অথচ তা চার মাজহাবের ইমামের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং তাঁরা সকল জ্ঞানকে সমবেত করবেন এমনরূপে যে অন্যদের অর্জন করার মত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না যেন কোরআন,সুন্নাহ্ ও ইসলামের বিধি-বিধান এবং অন্যান্য দলিল-প্রমাণ কেবল তাঁদেরই মালিকানা ও সত্তায় দেয়া হয়েছে অন্যরা এ সকল বিষয়ে মত প্রকাশের কোন অধিকার রাখেন না। তবে কি তাঁরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী ছিলেন? কিংবা এমন যে মহান আল্লাহ্ তাঁর নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সিলসিলা তাঁদের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন,এমন কি ভূত ও ভবিষ্যতের জ্ঞানও তাঁদের দেয়া হয়েছে এবং তাঁদের এমন কিছু দেয়া হয়েছে যা বিশ্বজগতের কাউকে দেয়া হয় নি। কখনোই নয়,বরং তাঁরাও অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের মত ইসলামের খেদমতকারী ও ইসলামের প্রতি আহবানকারী ছিলেন এবং দীনের আহবানকারীগণ জ্ঞান ভাণ্ডারের দ্বারকে কখনো বন্ধ করেন না,তার পথকেও কখনো রুদ্ধ করেন না। তাঁদেরকে কখনো এজন্য সৃষ্টি করা হয় নি যে,বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তিকে অবরুদ্ধ করবেন বা মানব জাতির চক্ষুকে বেঁধে রাখবেন। তাঁরা মানুষের হৃদয়কে তালাবদ্ধ,কর্ণকে বধীর,চক্ষুকে পর্দাবৃত ও মুখকে তালাবদ্ধ করতে আসেন নি। তাঁরা হাত,পা বা গর্দানেও কখনো শেকল পরাতে চান না। মিথ্যাবাদী ছাড়া কেউই তাঁদের প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করতে পারে না। তাঁদের নিজেদের কথাই এর সর্বোত্তম প্রমাণ।(*৬)

৫। এখন আমি মুসলমানদের মুক্তি ও ঐক্যের প্রসঙ্গে আসছি। আমার দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঐক্যের বিষয়টি সুন্নী হয়ে যাওয়া বা সুন্নী সম্প্রদায়ের শিয়া হবার ওপর নির্ভরশীল নয়,এজন্যই শিয়াদের ওপরও যেমন কোন দায়িত্ব বর্তায় না যে,নিজের মাজহাব থেকে সরে আসবে যেহেতু এটি যুক্তিহীন তেমনি বাস্তবে এটি সম্ভবও নয় যা পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে মোটামুটি বোঝা যায়।

তাই মুসলমানদের ঐক্য যেখানে সম্ভব তা হলো আপনারা আহলে বাইতের পথকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মাজহাব বলে স্বীকৃতি দান করুন এবং মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত মাজহাবগুলো একে অপরকে যে দৃষ্টিতে দেখে তদ্রুপ আহলে বাইতের অনুসারী মাজহাবকেও দেখুন। যে কোন মুসলমানই যেরূপ স্বাধীনভাবে হানাফী,শাফেয়ী,মালিকী ও হাম্বলী মাজহাবের অনুসরণ করতে পারে সেরূপ যেন আহলে বাইতের মতানুসারেও আমল করতে পারে।

এ পদ্ধতিতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদ একাত্মতায় পরিণত হবে এবং এ ঐক্য সুশৃঙ্খল ও সংহতও হবে।

এটি আমাদের অজানা নয় যে,চার মাজহাবের মধ্যে বিদ্যমান অনৈক্য শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিদ্যমান অনৈক্য হতে কম নয়। এই মাজহাবগুলোর (ধর্মীয় মৌল ও শাখাগত বিষয়ে) প্রকাশিত হাজারো গ্রন্থ এর সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে। সুতরাং কেন আপনাদের মধ্যের অনেকেই এ গুজব ছড়ান শিয়ারা আহলে সুন্নাহর বিরোধী কিন্তু এ কথা বলেন না আহলে সুন্নাহ্ শিয়া বিরোধী? কেন তাঁরা বলেন না আহলে সুন্নাতের এক দল অন্যদলের বিরোধী? যদি চারটি মাজহাব থাকা জায়েয হয় তবে কেন পঞ্চম মাজহাব জায়েয হবে না? যদি চার মাজহাব ঐক্য ও সমঝোতার কারণ হয় কেন পাঁচ মাজহাবে পৌঁছলে তা বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার কারণ হবে? প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের প্রত্যেকের এক এক পথে গমন করা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাবার কারণ নয় কি?

উত্তম হত আপনি যেমনভাবে আমাদের ঐক্যের দিকে ডাক দিচ্ছেন তেমনিভাবে চার মাজহাবের অনুসারীদেরও সেই দিকে ডাক দিতেন। আপনাদের জন্য চার মাজহাবের মধ্যে ঐক্য স্থাপন অধিকতর সহজ নয় কি? কেন ঐক্যের বিষয়টিতে আমাদের প্রতি বিশেষভাবে আহবান রাখছেন?

কেন আপনারা একজন লোকের আহলে বাইতের অনুসারী হওয়াকে ইসলামী সমাজের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী মনে করছেন,অথচ দৃষ্টিভঙ্গি,পথ ও চাওয়া-পাওয়ার হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও তাকে চার মাজহাবের ঐক্যের জন্য অন্তরায় মনে করছেন না। নবীর বংশধরগণের প্রতি আপনার ভালবাসা,বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের যে পূর্ব পরিচয় আমি পেয়েছি তাতে আমি এরূপ আশা করি নি।

ওয়াসসালাম

পঞ্চম পত্র

৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। আমাদের বক্তব্যসমূহের সত্যায়ন।

২। বিস্তারিত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করার আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আপনার চিঠিটি বেশ বিস্তারিত,আলোচনার অধ্যায়গুলি পূর্ণাঙ্গ,বোধগম্য এবং লেখাও প্রাঞ্জল। উপস্থাপিত যুক্তিসমূহ শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বর্ণনায় অধিকাংশের অনুসৃত মাজহাব অনুসরণের (মৌল ও অমৌল বিষয়ে) অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সুন্দরভাবে এসেছে,কোন বিষয়ই বাদ রাখেন নি,ইজতিহাদের পথকে উন্মুক্ত রাখার যুক্তিটি অন্যান্য দলিল-প্রমাণের মতই শক্তিশালী ছিল।

সুতরাং চার মাজহাবের অনুসরণ করা বা অপরিহার্য না হওয়া এবং ইজতিহাদের পথ উন্মুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে আপনার লিখিত যুক্তি খুবই মজবুত ও সঠিক এবং তা আমার বোধগম্য হয়েছে। যদিও আমরা সরাসরি এ বিষয়টির উল্লেখ করি নি তদুপরি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণীয়।

২। কিন্তু আমি আপনার নিকট আহলে সুন্নাহ্ হতে আপনাদের বিচ্ছিন্নতার কারণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম ও এজন্য প্রয়োজনীয় শরীয়তসম্মত দলিল-প্রমাণ চেয়েছিলাম। আপনি বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করবেন সে আহবান রইলো।

অতএব,কোরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অখণ্ডনীয় কোন যুক্তি বা দলিল যা আপনার ভাষায় শিয়া মাজহাব ত্যাগ করে অন্য মাজহাব গ্রহণের পথকে মুমিনের জন্য বন্ধ করে দেয় এবং তার ও তার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা বিস্তারিত আলোচনা করুন।

ধন্যবাদ ও সালাম


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49