আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত6%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 69361 / ডাউনলোড: 9362
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

1

2

3

ه

৯০। হারুন ইবনে সা দ আজালী কুফী

যাহাবী তাঁর নামের পাশে সাংকেতিকভাবে মুসলিম লিখেছেন,যেহেতু তিনি মুসলিমের রিজাল ও রাবীদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর তাঁর চরিত্র বর্ণনা করে বলেছেন, তিনি সত্যবাদী কিন্তু কট্টর রাফেযী ও অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী। আব্বাস ইবনে মুঈন হতে বলেছেন, হারুন শিয়া গালীদের (বাড়াবাড়ির আকীদা পোষণকারী) অন্তর্ভুক্ত। তিনি আবদুর রহমান ইবনে আবু সাঈদ খুদরী হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে আবি হাফছ আত্তার,মাসউদী এবং হাসান ইবনে হাই তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবু হাতেম তাঁকে ত্রুটিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।

৯১। হাশিম ইবনে বুরাইদ ইবনে যাইদ (আবু আলী কুফী)

যাহাবী তাঁর নামের পাশে সাংকেতিক আবু দাউদ ও নাসায়ী লিখেছেন,কারণ তিনি এ দুই সহীহর রিজালদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ইবনে মুঈনের সূত্রে তাঁর রাফেযী ও শিয়া হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বস্ত হবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। অতঃপর আহমাদ হতে তাঁর ত্রুটিহীনতার কথা বলেছেন। হাশিম যাইদ ইবনে আলী এবং মুসলিম বাতিন হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর পুত্র আলী ইবনে হাশিম ও খারিবী তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

হাশিম যে শিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এ সত্যটি আলী ইবনে হাশিমের পরিচিতি পর্বে আমরা বর্ণনা করেছি।

৯২। হুবাইরা ইবনে বারীম হিমায়ারী

তিনি হযরত আলী (আ.)-এর সাহাবীদের অন্তর্গত। আলীর প্রতি ভালবাসা ও তাঁর বেলায়েতের স্বীকৃতিতে তিনি হারিসের মত। যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল গ্রন্থে তাঁর নামের পাশে সুনানের লেখকগণের নাম সাংকেতিক চিহ্নে লিখেছেন,কারণ সুনানসমূহের সনদে রাবীদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। অতঃপর আহমাদের সূত্রে বলেছেন, তিনি ত্রুটিহীন এবং হারিস হতে আমাদের নিকট অধিকতর প্রিয়।

যাহাবী আরো বলেছেন, ইবনে খাররাশ বলেছেন যে,তিনি দুর্বল। সিফ্ফিনের যুদ্ধে তিনি যুদ্ধাহতদের হত্যা করেন। জাওযাজানী বলেছেন, তিনি মুখতার সাকাফীর পক্ষে খাযেরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।

শাহরেস্তানী তাঁর মিলাল ওয়ান নিহাল -এ তাঁকে শিয়া রিজালদের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং তিনি হযরত আলী হতে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন তা সুনান গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আবু ইসহাক ও আবু ফাখিতাহ্ তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

৯৩। হিশাম ইবনে যিয়াদ (আবু মাকদাম বাসরী)

শাহরেস্তানী তাঁর মিলাল ওয়ান নিহাল -এ তাঁকে শিয়া রিজালদের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল -এ নামানুসারে এবং কুনিয়ার স্থানেهاء বর্ণের স্থলে তাঁর পরিচয় দান করেছেন। কুনিয়ার আলোচনায় তাঁর নামের পাশে(ت ق) লিখেছেন,কারণ সুনান লেখকগণ তাঁর ওপর নির্ভর করতেন।

যে সকল হাদীস তিনি হাসান ও কারযী হতে বর্ণনা করেছেন তা সহীহ তিরমিযীতে দেখতে পারেন। শাইবান ইবনে ফারুখ,কাওয়ারিরী এবং অন্যান্যরা তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

৯৪। হিশাম ইবনে আম্মার ইবনে নুসাইর ইবনে মাইসারাহ আবুল ওয়ালিদ (জা ফারী দামেস্কী)

তিনি বুখারীর সহীহতে তাঁর উস্তাদ। ইবনে কুতাইবা তাঁকে শিয়া রিজালের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। তিনি তাঁর মা আরিফ গ্রন্থের আল ফিরাক অধ্যায়ে শিয়া রিজালদের নামের তালিকায় তাঁর নাম এনেছেন।

যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল গ্রন্থে তাঁকে ইমাম,খাতীব,ক্বারী,মুহাদ্দিস,দামেস্কের আলেম,সত্যবাদী ও অধিক হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করে বলেছেন তিনি এমন অনেক হাদীস নকল করেছেন যা অনেকেরই পছন্দ নয়।

বুখারী যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত ও দরিদ্রকে সময় দেয় সে সম্পর্কিত হাদীসের এবং সঠিক

ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসায় পদ্ধতি সম্পর্কিত আলোচনা অধ্যায়ে তাঁর হতে সরাসরি হাদীস বর্ণনা করেছেন। বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতগণ এ বিষয়ে অধিকতর অবগত আছেন। তাঁর বর্ণিত অন্যান্য হাদীস নবী করীম (সা.)-এর সাহাবীদের ফাজায়েল,পানীয়সমূহের আলোচনায় এবং মাগাজী বা যুদ্ধসমূহ নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ইয়াহিয়া ইবনে হামযাহ্,সাদাকা ইবনে খালিদ,আবদুল হামিদ ইবনে আবিল ঈশরীন ও অন্যান্যদের হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল গ্রন্থে বলেছেন, অসংখ্য লোক কোরআন ও হাদীস শিক্ষার জন্য তাঁর নিকট যেত ও তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করত।

ওয়ালিদ ইবনে মুসলিম তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর শিক্ষকদের অন্যতম। হিশাম আবু লাহিয়া হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত। আবদান বলেছেন, তৎকালীন সময়ে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। কেউ বলেছেন, হিশাম বাগ্মী,ভাষা অলংকারশাস্ত্রবিদ এবং জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন।

আমার মতে তিনি অন্যান্য শিয়াদের মত কোরআনের শব্দসমূহ আল্লাহর সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করতেন অর্থাৎ বর্তমানে কোরআনে যে বর্ণ ও ধ্বনি রয়েছে সেভাবেই রাসূল (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। মিযানুল ই তিদাল গ্রন্থে হিশামের পরিচিতি পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে- আহমাদ তাঁর এ বিশ্বাসের কথা শুনে বলেন, আমি তাকে অজ্ঞ ও মূর্খ পেয়েছি। আল্লাহ্ তাকে হত্যা করুন। আহমাদ হিশামের লিখিত একটি গ্রন্থের প্রথমে দেখলেন লেখা রয়েছে-

الحمد لله الّذي تجلّى لخلقه بخلقه

সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেকে তাঁর সৃষ্টির কাছে প্রকাশিত করেছেন।

আহমাদ তা দেখে রাগের প্রচণ্ডতায় একবার উঠছিলেন ও একবার বসছিলেন এবং ক্রোধের সাথে বললেন যারা হিশামের পেছনে নামায পড়েছেন তাঁরা যেন তা পুনরায় আদায় করেন।

হিশামের বক্তব্যতে আল্লাহর পবিত্রতা,তাঁর সৃষ্টিতে তাঁর নিদর্শনের প্রমাণ,তাঁর পবিত্রতার প্রকৃতি ও মর্যাদা যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা দৃষ্টিমান ব্যক্তিদের নিকট গোপন নয়। কারণ তাঁর বক্তব্য এই কথার সমার্থক যে,প্রতিটি বস্তুতেই আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে। অবশ্যই তাঁর কথা এ থেকেও পরিষ্কার ও বোধগম্য। কিন্তু আলেমগণ নিজের ইচ্ছামত একজন অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

হিশাম ১৫৩ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও ২৪৫ হিজরীর মুহররম মাসে মৃত্যুবরণ করেন। আল্লাহ্ তাঁকে রহম করুন।

৯৫। হাশিম ইবনে বাশির ইবনে কাসিম ইবনে দীনার সালামী (আবু মুয়াবিয়া,ওয়াসেতী)

তিনি প্রকৃতপক্ষে বাল্খের লোক,কারণ তাঁর প্রপিতা কাসিম ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ওয়াসেত এসেছিলেন।

ইবনে কুতাইবা তাঁর মা আরিফ গ্রন্থে তাঁকে শিয়া রিজালের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। তিনি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং তাঁর পর্যায়ের অনেকেরই শিক্ষক। যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল গ্রন্থে তাঁর নামের পাশে সিহাহ সিত্তাহর গ্রন্থকার কর্তৃক তাঁর হাদীস হতে যুক্তি প্রদর্শনের সাংকেতিক চি হ্ন লিখেছেন এবং তাঁকে হাফিয বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে তিনি সেসব আলেমের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা যুহরী ও হুসাইন ইবনে আবদুর রহমান হতে হাদীস শ্রবণ করেছেন।

ইয়াহিয়া ইবনে কাত্তান,আহমাদ,ইয়াকুব দাউরাকী এবং অনেকেই তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যে সকল হাদীস তিনি হামিদ তাভীল,ইসমাঈল ইবনে আবি খালিদ,আবু ইসহাক শায়বানী ও অন্যদের হতে বর্ণনা করেছেন তা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আপনি দেখতে পারেন।

বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনানুসারে উমর,নাকেদ,আমর ইবনে যুরারাহ্ এবং সাঈদ ইবনে সুলাইমান তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া বুখারীতে আমর ইবনে আওফ,সা দ ইবনে নাদর,মুহাম্মদ ইবনে নিবহান,আলী ইবনে মাদিনী ও কুতাইবা তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ মুসলিমে আহমাদ ইবনে হাম্বল,শুরাইহ্,ইয়াকুব দাউরাকী,আবদুল্লাহ্ ইবনে মুতী,ইয়াহিয়া ইবনে ইয়াহিয়া,সাঈদ ইবনে মানসুর,ইবনে আবি শাইবা,ইসমাঈল ইবনে সালিম,মুহাম্মদ ইবনে সাবাহ,দাউদ ইবনে রশিদ,আহমাদ ইবনে মানী,ইয়াহিয়া ইবনে আইউব,যুহাইর ইবনে হারব,উসমান ইবনে আবি শাইবা,আলী ইবনে হাজার এবং ইয়াযীদ ইবনে হারুন তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

তিনি ১৮৩ হিজরীতে ৭৯ বছর বয়সে বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ্ তাঁকে রহম করুন।

و

৯৬। ওয়াকী ইবনে জাররাহ্ ইবনে মালিহ ইবনে আদী (তাঁর কুনিয়াত তাঁর পুত্র সুফিয়ান রাওয়াসীর নামানুসারে আবু সুফিয়ান)

তিনি কাইস গাইলান গোত্রের লোক। ইবনে কুতাইবা তাঁর মা আরিফ গ্রন্থে শিয়া রিজালের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। ইবনে মাদিনী তাঁর তাহ্যীব গ্রন্থে তাঁর শিয়া হবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

মারওয়ান ইবনে মুয়াবিয়ার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না যে,তিনি রাফেযী। একদিন ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন মারওয়ানের নিকট বেশ কিছু লিখিত বস্তু দেখলেন যার প্রতিটি লেখা ছিল অমুক এরূপ,অমুক এরূপ,সেখানে ওয়াকীর নামও লিখা ছিল এবং তাতে তাঁকে রাফেযী বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ইবনে মুঈন তাঁকে বললেন, ওয়াকী তোমার চেয়ে উত্তম। সে শুনে বলল, হ্যাঁ। ওয়াকী একথা শুনে বললেন, ইয়াহিয়া আমাদের বন্ধু।

আহমাদ ইবনে হাম্বলকে প্রশ্ন করা হলো, যদি আবদুর রহমান ইবনে মাহদী এবং ওয়াকী কোন বিষয়ে দ্বৈতমত পোষণ করেন তবে কার কথাকে গ্রহণ করবেন? তিনি যে দৃষ্টিকোণ থেকে আবদুর রহমানকে দেখতেন সে দৃষ্টিতে বললেন, আবদুর রহমানকে। কারণ আবদুর রহমানের দৃষ্টিতে পূর্ববর্তীগণ ত্রুটিমুক্ত,ওয়াকীর দৃষ্টিতে নন।

এ কথার সপক্ষে দলিল হলো যাহাবীর মিযান -এ হাসান ইবনে সালিহের পরিচিতি পর্বে ওয়াকীর যে বক্তব্য তিনি এনেছেন। ওয়াকী বলেছেন, হাসান ইবনে সালিহ আমার নেতা ও পথ প্রদর্শক। তাঁকে বলা হলো, হাসান হযরত উসমানের জন্য দোয়া করেন না। ওয়াকী বললেন, তুমি হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের ওপর দরূদ পড়? এখানে ওয়াকী হযরত উসমানকে হাজ্জাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

উপরোক্ত বিষয়গুলো যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল -এ এনেছেন। সিহাহ সিত্তাহর হাদীসবিদগণ তাঁর হাদীসসমূহ যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যে সকল হাদীস তিনি আ মাশ,সাওরী,শো বা,ইসমাঈল ইবনে আবি খালিদ এবং আলী ইবনে মোবারক হতে বর্ণনা করেছেন তা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। এ দুই হাদীসগ্রন্থেই ইসহাক হানযালী এবং মুহাম্মদ ইবনে নুমাইর তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

বুখারীর বর্ণনামতে,আবদুল্লাহ্ ইবনে হামিদী,মুহাম্মদ ইবনে সালাম,ইয়াহিয়া ইবনে জা ফর ইবনে আ য়ুন,ইয়াহিয়া ইবনে মূসা,মুহাম্মদ ইবনে মাকাতিল তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুসলিমের মতে,যুহাইর,ইবনে আবি শাইবা,আবু কুরাইব,আবু সাঈদ আশাজ,নাছর ইবনে আলী,সাঈদ ইবনে আযহার,ইবনে আবি উমর,আলী ইবনে খাশরাম,উসমান ইবনে আবি শাইবা এবং কুতাইবা ইবনে সাঈদ তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

তিনি ১৯৭ হিজরীর মুহররম মাসে হজ্ব হতে ফেরার পথে ৬৮ বছর বয়সে ফাইদ নামক স্থানে মৃত্যুবরণ করেন।

ي

৯৭। ইয়াহিয়া ইবনে জাযযার আরানী কুফী (আমীরুল মুমিনীন আলী [আঃ]-এর সাহাবী)

যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল গ্রন্থে তাঁর নামের পাশে সহীহ মুসলিম ও সুনান লেখকগণের নাম সাংকেতিকভাবে লিখেছেন তাঁদের তাঁর হাদীসসমূহ দলিল হিসেবে ব্যবহারের কারণে। তিনি তাঁকে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বলেছেন।

হাকাম ইবনে উতাইবার সূত্রে তিনি বলেছেন, ইয়াহিয়া ইবনে জাযযার শিয়া বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতেন।

ইবনে সা দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ২০৬ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে,ইয়াহিয়া ইবনে জাযযার শিয়া ছিলেন এবং তাঁর কথায় এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি ছিল। তিনি তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন ও তাঁর হাদীস নকল করেছেন। আমার জানা মতে,সহীহ মুসলিমে নামাযের অধ্যায়ে তাঁর হাদীস রয়েছে। তাছাড়া ঈমান অধ্যায়েও আবদুর রহমান ইবনে আবি লাইলা হতে তিনি হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাকাম ইবনে উতাইবা ও আরানী এবং অন্যরা সহীহ মুসলিমে তাঁর হতে হাদীস নকল করেছেন।

৯৮। ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ কাত্তান (তাঁর কুনিয়াত আবু সাঈদ,বনি তামীমের দাস,বসরার অধিবাসী এবং তাঁর সময়ের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের অন্তর্ভুক্ত)

ইবনে কুতাইবা তাঁর মা আরিফ গ্রন্থে তাঁকে শিয়া রিজালের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন। সিহাহ সিত্তাহর গ্রন্থকারগণ ও অন্যান্যরা তাঁর হাদীস প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যবহার করেছেন। সুতরাং হামিদ তাভীল,হিশাম ইবনে উরওয়া,ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ আনসারী এবং অন্যদের হতে তিনি যে সকল হাদীস বর্ণনা করেছেন তা সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে। তাঁদের দু জনের মতেই মুহাম্মদ ইবনে মুসান্না ও বানদার তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

বুখারীর বর্ণনানুসারে মুসাদ্দিদ,আলী ইবনে মাদিনী ও বায়ান ইবনে আমর এবং মুসলিমের বর্ণনানুসারে মুহাম্মদ ইবনে হাতেম,মুহাম্মদ ইবনে খাল্লাদ বাহেলী,আবু কামেল,ফুযাইল ইবনে হুসাইন জাহদারী,মুহাম্মদ মোকাদ্দামী,আবদুল্লাহ্ ইবনে হাশিম আবু বকর ইবনে আবি শাইবা,আবদুল্লাহ্ ইবনে সাঈদ,আহমাদ ইবনে হাম্বল,আবদুল্লাহ্ কাওয়ারিরী,ইয়াকুব দারুকী,আহমাদ ইবনে আবদুহু,আমর ইবনে আলী এবং আবদুর রহমান ইবনে বাশির তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি ১৯৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৯৯। ইয়াযীদ ইবনে আবি যিয়াদ কুফী (কুনিয়াত আবু আবদুল্লাহ্,বনি হাশিমের দাস)

যাহাবী তাঁর মিযানুল ই তিদাল -এ সাংকেতিকভাবে মুসলিম ও সুনানে আরবাআহর নাম তাঁর নামের পাশে লিখেছেন। তাঁরা তাঁর হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি আবু ফুযাইল হতে বর্ণনা করেছেন। ইয়াযীদ ইবনে আবি যিয়াদ শিয়াদের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব।

তিনি আরো স্বীকার করেছেন ইয়াযীদ কুফার আলেমদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি আবু বারযা বা আবু বারদা হতে হাদীস নকল করেছেন যে,আবু বারদা বলেছেন, আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম তখন গান বাজনার শব্দ ভেসে আসল,পরে বোঝা গেল মুয়াবিয়া ও আমর ইবনে আস এর আয়োজন করেছে। নবী (সা.) বললেন : হে আল্লাহ্! তাদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করো ও আগুনের দিকে পরিচালনা করো। (এ হাদীস বর্ণনার কারণে অনেকেই এটি তাঁর ত্রুটি হিসেবে উল্লেখ করে তাঁর ওপর জুলুম করেছে।)

আবদুর রহমান ইবনে আবি লাইলী হতে তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ মুসলিম তাঁর সহীহতে আত্ইমাহ্ অধ্যায় হতে উদ্ধৃত করেছেন। সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা তাঁর হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

তিনি ১৩৬ হিজরীতে ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ্ তাঁকে রহম করুন।

১০০। আবু আবদুল্লাহ্ জাদলী

যাহাবী কুনিয়াসমূহের আলোচনায় তাঁর নামের পাশে(د ت) লিখেছেন,কারণ তিনি আবু দাউদ ও তিরমিযীর রিজালদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর তাঁকে হিংসুক শিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জাওযাজানী হতে বর্ণনা করেছেন আবু আবদুল্লাহ্ মুখতারের বাহিনীর পতাকাধারী ছিলেন এবং আহমাদের সূত্রে তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন।

শাহরেস্তানী তাঁর আল মিলাল ওয়ান নিহাল -এ তাঁকে শিয়া রিজালের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং ইবনে কুতাইবা তাঁর মা আরিফ গ্রন্থে তাঁকে রাফেযী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ সহীহ তিরমিযী,আবু দাউদ,মুসনাদ ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে।

ইবনে সা দ তাঁর তাবাকাত গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১৫৯ পৃষ্ঠায় তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, তিনি কট্টর শিয়া ও এ আকীদায় অটল ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে মনে করা হয় মুখতারের বিশেষ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে ৮০০ ব্যক্তির যে দলটি আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবাইরের সঙ্গে যুদ্ধ করে তিনি তার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইবনে যুবাইর যখন বনি হাশিম ও ইবনে হানাফিয়াকে গৃহবন্দী করে চতুর্দিকে আগুন জ্বালিয়ে ভীতির সঞ্চার করে তাদের হতে বাইয়াত গ্রহণ করার চেষ্টা করে আবু আবদুল্লাহ্ জাদলী এ অবস্থাতে তাঁদের রক্ষা করেন। আল্লাহ্ নবী পরিবারের পক্ষ হতে তাঁর কর্মের পুরস্কার দান করুন।

এই সংক্ষিপ্ত সময়ে যে একশ তাকওয়া সম্পন্ন,শক্তিশালী,সম্ভ্রান্ত ও প্রসিদ্ধ শিয়া ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করলাম তাঁদের শেষ ব্যক্তি হলেন আবু আবদুল্লাহ্ জাদলী। তাঁরা আহলে সুন্নাহর জন্য নিদর্শন ও দলিল,তাঁরা উম্মতের ইলমের পাত্র যাঁদের মাধ্যমে নবুওয়াত সংরক্ষিত হয়েছে এবং তাঁদের বর্ণিত হাদীসসমূহ সিহাহ্,মুসনাদ এবং সুনান গ্রন্থগুলোতে স্থান পেয়েছে। তাঁদের পূর্ণ নাম উল্লেখ করে আহলে সুন্নাহর আলেমদের মতে যে তাঁরা শিয়া ছিলেন এতদ্সত্ত্বেও তাঁরা (আহলে সুন্নাহর আলেমরা) তাঁদের বর্ণিত হাদীসসমূহ প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যবহার করতেন তা বর্ণনা করেছি। যদিও তাঁরা নিজস্ব মত ও নিয়মানুযায়ী চলতেন তদুপরি তাঁদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিলেন। সুতরাং আমার মনে হয় যাঁরা এ কথা বলেন,আহলে সুন্নাহ্ শিয়া রিজালদের হাদীস গ্রহণ করেন না ও তাঁদের হাদীস দলিল ও যুক্তি হিসেবে পেশ করেন না এমন ব্যক্তিবর্গ নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। তাঁরা খুব শীঘ্রই বুঝতে পারবেন আহলে সুন্নাহর হাদীসবিদগণের নিকট কোন হাদীস গ্রহণের মানদণ্ড শিয়া ও সুন্নী হওয়া নয়,বরং তাঁদের সত্যবাদিতা ও আমানতদারীই। যদি শর্ত এটিই হয়,শিয়া সূত্র হতে বর্ণিত হাদীস সম্পূর্ণ বর্জনীয় তবে নবুওয়াতের চি‎‎ হ্ন সম্পূর্ণরূপে মুছে যাবে। যেমনটি যাহাবী তাঁর মিযান গ্রন্থে আবান বিন তাগলিবের পরিচিতি পর্বে স্বীকার করেছেন। মহান আল্লাহ্ সত্যকে আপনার মাধ্যমে সাহায্য করুন। আপনি জানেন,প্রাচীন শিয়াদের মধ্যে যাঁদের আমি উল্লেখ করেছি তাঁদের বাইরে অনেকেই রয়েছেন আহলে সুন্নাহর আলেমগণ যাঁদের হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ উপস্থাপন করতেন। তাঁদের সংখ্যা যেমন অধিক তেমনি তাঁদের মর্যাদা ও হাদীসের আধিক্য সনদের মূল্যের দিক থেকেও সমধিক। তাঁদের জ্ঞান,সময়ের দিক হতে অগ্রগামিতা ও শিয়া বিষয়ে দৃঢ়তাও লক্ষণীয় । মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে এ ধরনের ব্যক্তিত্বের নামের তালিকা ও পরিচয় আপনার অবগতির জন্য আমাদের ফুসূলুল মুহিম্মা গ্রন্থে এনেছি। এছাড়া তাবেয়ীদের মধ্যকার শিয়া আলেমদের পরিচয়ও আমরা সেখানে দিয়েছি। তাঁদের সকলেই হাফিয,বিশ্বস্ত,নির্ভরযোগ্য ও প্রামাণ্য। তাঁদের অনেকেই আলী (আ.)-এর সহযোগী হয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন,কেউ জঙ্গে জামালে,কেউ সিফ্ফিনে,কেউ নাহরাওয়ানে,কেউবা বুসর ইবনে আরতাতের বিরুদ্ধে ইয়েমেন ও হেজাজের যুদ্ধে এবং মুয়াবিয়ার পক্ষ হতে বসরায় সৃষ্ট গোলযোগে২২১ শাহাদাত বরণ করেছেন। আবার কেউ কেউ বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (আ.)-এর সঙ্গে কারবালায় এবং তাঁর নাতী যাইদ ইবনে আলীর সঙ্গে কুফায় শহীদ হয়েছেন এবং তাঁরা অপমানকে সহ্য করেন নি বরং ধৈর্যের সঙ্গে আল্লাহর পথে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। অনেকেই অত্যাচারিত হয়ে হিজরত করতে বা ভয়-ভীতির কারণে ঈমানকে গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছেন,যেমন আহনাফ ইবনে কাইস,আসবাগ ইবনে নুবাতাহ্ এবং ইয়াহিয়া ইবনে ইয়ামুর যিনি আরবী হরফে নোকতা চি হ্ন সংযোজন করেন। তন্মধ্যে খালিল বিন আহমদ ফারায়েযী যিনি লুগাত বা অভিধানশাস্ত্র এবং স্বরচিহ্নের প্রবর্তক এবং মায়াজ ইবনে মুসলিম হাররা যিনি ইলমে ছারফের প্রবক্তা ও এ ধরনের আরো অনেক প্রবক্তা রয়েছেন যাঁদের নামের তালিকা দিতে গেলে মোটা একটি গ্রন্থ সৃষ্টি হবে। যা হোক নাসেবীদের (আহলে বাইত বিদ্বেষী) মধ্যে যারা তাঁদের প্রতি আক্রমণ করেছে এবং চুলচেরা বিশ্লেষণের নামে দুর্বল বলার চেষ্টা করেছে ও তাঁদের হাদীস গ্রহণে অনীহা দেখিয়েছে তাদের কথা বাদ দিন।

আহলে বাইতের অনুসারীদের মধ্যে এরূপ শত সহস্র প্রতিষ্ঠিত আলেম ও হাফিয ছিলেন যাঁদেরকে আহলে সুন্নাহর আলেমরা উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু শিয়া আলেমগণ তাঁদের পরিচয় ও তালিকা প্রকাশ করে তাঁদের অবদানকে বিভিন্ন গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন ও ইসলামের চিরায়ত সত্য ও সহজ শরীয়তের প্রসারে তাঁদের ভূমিকাকে তুলে ধরেছেন যাতে সত্যান্বেষীরা তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারে। আপনি তা অধ্যয়নে তাঁদের সততা,আমানতদারিতা,দুনিয়াবিমুখতা,নিষ্ঠা,খোদাভীতি (তাকওয়া) ও ইবাদতের নমুনা ও আদর্শ খুঁজে পাবেন। আরো বুঝতে পারবেন তাঁরা আল্লাহ্,তাঁর রাসূল (সা.),পবিত্র কোরআন ও ইমামগণের বাণীকে কিরূপে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাঁর বরকতের দ্বারকে তাঁদের মাধ্যমেই আমাদের জন্য উন্মুক্ত করেছেন। তিনি আরহামুর রাহিমীন।

ওয়াসসালাম

হাতির বছরের গোলযোগ

কোন জাতির মধ্যে যে মহাঘটনা সংঘটিত হয় এবং কখনো কখনো যা ধর্মীয় ভিত্তিমূল এবং কখনো কখনো জাতীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের অধিকারী তা সাধারণ জনগণের আশ্চর্য ও বিস্ময়বোধের কারণে তারিখ ও গণনার সূচনা বা উৎস বলে গণ্য হয়। যেমন ইয়াহুদী জাতির মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আ.)-এর আন্দোলন,খ্রিষ্টানদের জন্য হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর হিজরত হচ্ছে তারিখ গণনার উৎস যা দিয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ তাদের জীবনের ঘটনাসমূহের উদ্ভবের সময়কাল নির্ণয় ও পরিমাপ করে থাকে।

কখনো কখনো কোন জাতি মৌলিক ইতিহাস ও তারিখের অধিকারী হওয়ার কারণে কিছু কিছু ঘটনাকেও তাদের তারিখ গণনার ভিত্তি ও উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যেমন পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মহান ফরাসী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে 1917 খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের কম্যুনিস্ট আন্দোলন ঐ সব দেশে যে সব ঘটনাপ্রবাহের উদ্ভব হয় সেগুলোর অনেক কিছুর তারিখ গণনার ভিত্তি বা উৎস হিসাবে গণ্য করা হযেছে। যে সব অনগ্রসর জাতি এ ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকে বঞ্চিত সে সব জাতি স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। এ কারণেই জাহেলী আরবগণ সঠিক কৃষ্টি ও সভ্যতার অধিকারী না হওয়ায় যুদ্ধ,ভূমিকম্প,দুর্ভিক্ষ অথবা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিজেদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার উৎস হিসাবে গণ্য করেছে। এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা আরব জাতির তারিখ গণনার ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি দেখতে পাই। এসব ভিত্তির মধ্যে সর্বশেষ ভিত্তি হচ্ছে হাতির বছরের ঘটনা এবং পবিত্র কাবাগৃহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা যা অন্যান্য ঘটনার তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। এখন আমরা 570 খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত মহাঘটনাটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব এবং এখানে স্মর্তব্য যে,মহানবী (সা.)ও এই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এ ঘটনার উৎস

আসহাবে ফীল অর্থাৎ হস্তিবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরা এ ঘটনা বর্ণনা করার পর যে সব আয়াত এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে তা উল্লেখ করব। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে লিখেছেন : ইয়েমেনের বাদশাহ্ যূনুওয়াস তার সরকারের ভিত্তি মজবুত করার পর কোন এক সফরে মদীনা অতিক্রম করছিল। তখন মদীনা এক অতি উত্তম ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল। সে সময় একদল ইয়াহুদী ঐ শহরে বসতি স্থাপন করে প্রচুর মন্দির ও ইবাদাতগাহ্ নির্মাণ করেছিল। সুযোগসন্ধানী ইয়াহুদিগণ বাদশার আগমনকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাদশাহকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে ছিল নব্য ইয়াহুদী ধর্মে দীক্ষিত বাদশাহ্ যূনুওয়াসের শাসনাধীনে রোমের খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবের হামলা থেকে নিরাপদ থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা। এ ব্যাপারে তাদের প্রচার খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। যূনুওয়াস ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করল এবং এ ধর্ম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিল। অনেকেই ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে একদল জনতাকে বিরোধিতা করার জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে। তবে নাজরানের অধিবাসিগণ যারা বেশ কিছুদিন আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কোনক্রমেই খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইয়াহুদী ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল না।ইয়েমেনের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ এবং অবজ্ঞা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। বাদশাহ্ যূনুওয়াস এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাজরানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাপতি নাজরান শহরের পাশে সেনা শিবির ও তাঁবু স্থাপন করে এবং পরিখা খনন করার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়;আর বিদ্রোহীদেরকে ঐ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করার হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। নাজরানের অকুতোভয় সাহসী জনতা যারা মনে-প্রাণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা এতে মোটেও ভীত না হয়ে মৃত্যু ও জীবন্ত দগ্ধ হওয়াকে সানন্দে বরণ করে নেয়। তাদের দেহগুলো সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল।110

ইসলামী ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসীর জাযারী লিখেছেন : এ সময় দূস নামক একজন নাজরানবাসী খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া সমর্থক রোমান সম্রাট কাইসারের কাছে গমন করে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করল এবং রক্তপিপাসু যূনুওয়াসকে শাস্তি প্রদান এবং অত্র এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার আবেদন জানাল। রোমের অধিপতি গভীর দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের দেশ থেকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী অনেক দূরে অবস্থিত বিধায় এ ধরনের অত্যাচারের প্রতিকার বিধানার্থে হাবাশার বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে একটি চিঠি লিখছি যাতে করে তিনি ঐ রক্তপিপাসু নরপিশাচের কাছ থেকে নাজরানের নিহতদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। ঐ নাজরানবাসী কাইসারের চিঠি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাবাশার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করল। ফলে বাদশার শিরা ও ধমনীতে তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও চেতনাবোধের রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। তিনি আবরাহাতুল আশরাম নামক এক হাবাশী সেনাপতির নেতৃত্বে 70 হাজারের এক বিশাল সেনাবাহিনী ইয়েমেনের দিকে প্রেরণ করেন। হাবাশার উক্ত সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীটি সমুদ্রপথে ইয়েমেনের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করে। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে যূনুওয়াসের আর কিছুই করার ছিল না। সে যতই চেষ্টা করল তাতে কোন ফল হলো না। প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য যতই গোত্রপতিদের নিকট আহবান জানাল তাতে তাদের পক্ষ থেকে সে কোন সাড়া পেল না। পরিণতিতে আবরাহার এক সংক্ষিপ্ত আক্রমণের মুখে যূনুওয়াসের প্রশাসনের ভিত ধসে পড়ে এবং সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী ইয়েমেন হাবাশাহ্ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়।

আবরাহা প্রতিশোধ ও বিজয়ের মদমত্ততায় চূর ও মাতাল হয়েছিল। সে যৌনকামনা ও আমোদ-প্রমোদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মোটেও বিরত থাকত না। সে হাবাশার বাদশার নৈকট্য ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানআ নগরীতে একটি জমকালো গীর্জা নির্মাণ করে যা ছিল ঐ যুগে অতুলনীয়। তারপর সে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে পত্র লেখে, গীর্জা নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সকল অধিবাসীকে কাবার যিয়ারত করা থেকে বিরত এবং এই গীর্জাকে সাধারণ জনগণের জন্য তাওয়াফস্থল করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি।” চিঠিটির মূল বক্তব্য প্রচারিত হলে সমগ্র আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল,এমনকি বনি আফকাম গোত্রের এক মহিলা উক্ত মন্দিরের চত্বরকে নোংরা করে দিল। এ ধরনের কাজ যার মাধ্যমে আবরাহার গীর্জার প্রতি আরবদের পূর্ণ অবজ্ঞা,শত্রুতা ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে তা তদানীন্তন আবরাহা প্রশাসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে গীর্জার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে যত চেষ্টা চালানো হয়েছে ততই পবিত্র কাবার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে। এ সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে আবরাহা পবিত্র কাবা ধ্বংস করার শপথ নেয়। এজন্য আবরাহা এক বিশাল বাহিনী গঠন করে যার সম্মুখভাগে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত অনেক লড়াকু হাতি। তাওহীদী মতাদর্শের প্রাণপুরুষ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.) যে গৃহটির পুননির্মাণ করেছিলেন আবরাহা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ ও অতি সংবেদনশীল তা প্রত্যক্ষকরতঃ আরবের গোত্রপতিদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে,আরব জাতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব পতনের সম্মুখীন। কিন্তু আবরাহার অতীত সাফল্যসমূহ তাদেরকে যে কোন উপকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এতদ্সত্ত্বেও আবরাহার গমনপথের ওপর অরব গোত্রগুলোর কতিপয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নেতা পূর্ণ বীরত্বসহকারে আবরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেমন যূনাফার যিনি নিজেও এক অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে তাঁর নিজ গোত্রকে পবিত্র কাবাগৃহ রক্ষা করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই আবরাহার বিশাল বাহিনী তাঁদের ব্যুহসমূহ ভেদ করে দেয়। এরপর নুফাইল বিন হাবীব তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে তোলে,কিন্তু সেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় এবং আবরাহার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সে (নুফাইল) আবরাহার কাছে আবেদন জানালে আবরাহা তাকে বলেছিল, আমাদেরকে মক্কা নগরী অভিমুখে যদি তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।” তাই নুফাইল আবরাহাকে তায়েফ নগরী পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত অবশিষ্ট পথ দেখানোর দায়িত্ব নুফাইল আবু রাগাল নামক তারই এক বন্ধুর ওপর ন্যস্ত করে। নতুন পথ-প্রদর্শক আবরাহার সেনাবাহিনীকে পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী মাগমাস নামক স্থানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আবরাহার সেনাবাহিনী ঐ স্থানকে সেনা ছাউনি ও তাঁবু স্থাপন করার জন্য মনোনীত করে। আর আবরাহা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী একজন সেনাপতিকে তিহামার উট ও গবাদিপশু লুণ্ঠন করার দায়িত্ব দেয়। প্রায় 200টি উট লুণ্ঠন করা হয়। লুণ্ঠিত এ সব উটের মালিক ছিলেন মক্কাপ্রধান আবদুল মুত্তালিব। অতঃপর হানাতাহ্ নামীয় এক সেনাপতিকে আবরাহা মক্কার কুরাইশ নেতা ও প্রধানের কাছে তার বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিল, কাবাগৃহ ধ্বংস করার প্রকৃত চিত্র যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! আর নিশ্চিতভাবে কুরাইশরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মক্কার পথ ধরে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছে কুরাইশ প্রধানের খোঁজ করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বলবে : আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো কাবাগৃহ ধ্বংস করা। কুরাইশরা যদি প্রতিরোধ না করে তাহলে তারা যে কোন হামলা ও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।”

আবরাহার প্রেরিত দূত পবিত্র মক্কায় পৌঁছেই কুরাইশদের বিভিন্ন দলকে আবরাহার সামরিক অভিযান সম্পর্কে আলোচনারত দেখতে পেল। মক্কাপ্রধানের খোঁজ করলে তাকে আবদুল মুত্তালিবের গৃহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার বাণী শোনার পর বললেন, আমরা কখনই প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব না। কাবা মহান আল্লাহর গৃহ যার নির্মাতা হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)। মহান আল্লাহ্ যা কল্যাণকর তা-ই করবেন।” আবরাহার সেনাপতি কুরাইশপ্রধানের এ ধরনের কোমল ও শান্তিপূর্ণ যুক্তি যা প্রকৃত সুমহান আত্মিক ঈমানেরই পরিচায়ক তা শ্রবণ করে সন্তোষ প্রকাশ করল এবং তার সাথে আবরাহার তাঁবুতে আসার আমন্ত্রণ জানাল।

আবরাহার শিবিরে আবদুল মুত্তালিব-এর গমন

আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েক সন্তানসহ আবরাহার শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। কুরাইশপ্রধানের মহত্ত্ব,স্থিরতা,ধৈর্য,গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব আবরাহাকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলে। এ কারণেই সে আবদুল মুত্তালিবের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি,শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ,সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এসে আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে তাঁকে তার নিজের পাশে বসিয়েছিল। এরপর সে পূর্ণ ভদ্রতা ও শিষ্টাচারসহকারে দোভাষীর মাধ্যমে আবদুল মুত্তালিবকে প্রশ্ন করেছিল যে,তিনি কেন এখানে এসেছেন এবং তিনি কী চাচ্ছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিহামার উটগুলো এবং যে দু শ’উটের মালিক আমি সেগুলো আপনার সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ এটিই যে,অনুগ্রহপূর্বক ঐ সকল উট স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিন।” আবরাহা বলল, আপনার আলোকিত বদনমণ্ডল আপনাকে আমার কাছে এক জগৎ পরিমাণ মহান ও বিরাট করে তুলেছে,অথচ (যখন আমি এসেছি আপনার পূর্বপুরুষদের ইবাদাতগাহ্ ধ্বংস করতে) তখন আপনার ছোট ও অতি সামান্য আবেদন আপনার মহত্ত্ব,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাকে কমিয়ে দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম যে,আপনি কাবার ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং অনুরোধ জানাবেন যে,আমার যে লক্ষ্য আপনাদের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে তা থেকে অমি যেন বিরত থাকি। না,পক্ষান্তরে আপনি কয়েকটি মূল্যহীন উটের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে একটি বাক্য বলেছিলেন যা আজও তাঁর নিজস্ব মহত্ত্ব,গৌরব এবং মান বজায় রেখেছে। আর ঐ বাক্যটি ছিল :

أنا ربّ الإبل و للبيت ربّ يمنعه

“আমি উটগুলোর প্রতিপালনকারী এবং পবিত্র কাবারও এমন এক প্রভু আছেন যিনি (সব ধরনের আগ্রাসন,আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে) উক্ত গৃহকে রক্ষা করবেন।” আবরাহা এ কথা শোনার পর খুবই দাম্ভিকতার সাথে বলেছিল, এ পথে আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়ার শক্তি কারো নেই।” এরপর সে লুণ্ঠিত সব ধন-সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

অধীর আগ্রহে কুরাইশদের অপেক্ষা

সমগ্র কুরাইশ গোত্র অধীর আগ্রহে আবদুল মুত্তালিবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল যাতে করে তারা শত্রুর সাথে তাঁর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যখন আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রপতিদের মুখোমুখি হলেন তখন তিনি তাদেরকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের গবাদিপশু নিয়ে উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। এর ফলে তোমরা সবাই যে কোন ধরনের ক্ষতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।” এ কথা শোনার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল মক্কাবাসী তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। মধ্যরাত্রিতে শিশু ও নারীদের ক্রন্দনধবনি এবং পশুসমূহের আর্তনাদ সমগ্র পাহাড়-পর্বতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ঐ সময় আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন কুরাইশসহ পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে পবিত্র কাবায় গেলেন। ঐ সময় তাঁর চোখের চারপাশে অশ্রুবিন্দু জমেছিল। তিনি ব্যথিত অন্তরে পবিত্র কাবার দরজার কড়া হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে ইলাহী! তাদের (আবরাহা ও তার বিশাল সেনাবাহিনী) অনিষ্ট সাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আশা নেই। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র গৃহের অঙ্গন ও সীমানা থেকে প্রতিহত কর। সে-ই কাবার দুশমন যে তোমার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দাও। হে প্রভু! তোমার বান্দা নিজের ঘরকে রক্ষা করে। তাই তুমিও তোমার ঘরকে রক্ষা কর। ঐ দিনকে (আমাদের কাছে) আসতে দিও না যে দিন তাদের ক্রুশ জয়যুক্ত হবে,আর তাদের প্রতারণাও সফল ও বিজয়ী হবে। 111

এরপর তিনি কাবাগৃহের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসলেন এবং সেখান থেকে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। প্রভাতে যখন আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাভিমুখে রওয়ানা হল তখন হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সমুদ্রের দিক থেকে আকাশে আবির্ভূত হলো যেগুলোর প্রতিটির মুখ ও পায়ে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথর। পাখিদের ছায়ায় সৈন্যশিবিরের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্ত্র অতি বিস্ময়কর প্রভাব ও ফলাফল সৃষ্টি করল। মহান আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণ করল যার ফলে তাদের মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এবং দেহের মাংসগুলো খসে পড়ল। একটি ক্ষুদ্র পাথর আবরাহার মাথায়ও আঘাত করলে সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহে কম্পন শুরু হলো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে,মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজব তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেনাদলের দিকে তাকালে সে দেখতে পেল যে,তাদের মৃতদেহগুলো গাছের পাতা ঠিক যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকে ঠিক সেভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কালবিলম্ব না করে তার সেনাবাহিনীর যারা বেঁচে আছে,যে পথ ধরে তারা এসেছিল ঠিক সে পথেই ইয়েমেনের রাজধানী সানাআয় ফিরে যাবার জন্য সে নির্দেশ দিল। আবরাহার সেনাদলের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা সানাআর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক সৈন্যই ক্ষত ও ভীতিজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করল,এমনকি আবরাহাও যখন সানাআয় পৌঁছল তখন তার শরীরের মাংস খসে পড়ল এবং আশ্চর্যজনক অবস্থার মধ্যে তার মৃত্যু হলো।

বিস্ময়কর ও ভীতিপ্রদ এ ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করল। হাতিওয়ালাদের কাহিনী পবিত্র কোরআনের সূরা ফীল-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে : আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের ওপর এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো তাদের ওপর পোড়ামাটির তৈরি কঙ্কর নিক্ষেপকরতঃ তাদেরকে চর্বিত ঘাস ও পাতার মতো পিষ্ট করে দিয়েছিল।”

) بسم الله الرّحمان الرّحيم -ألم تر كيف فعل ربّك بأصحاب الفيل-ألم يجعل كيدهم في تضليل-و أرسل عليهم طيرا أبابيل-ترميهم بحجارة من سجيل-فجعلهم كعصف مأكول(

আমরা এখন যা কিছু আলোচনা করলাম আসলে তা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ এবং পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাও ঠিক এটিই। এখন আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় মুফাসসির মুহাম্মদ আবদুহু’এবং মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রখ্যাত পণ্ডিত (ড. হাইকাল) এতৎসংক্রান্ত যা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখব।

হাতির বছরের গোলযোগ

কোন জাতির মধ্যে যে মহাঘটনা সংঘটিত হয় এবং কখনো কখনো যা ধর্মীয় ভিত্তিমূল এবং কখনো কখনো জাতীয় ও রাজনৈতিক ভিত্তিমূলের অধিকারী তা সাধারণ জনগণের আশ্চর্য ও বিস্ময়বোধের কারণে তারিখ ও গণনার সূচনা বা উৎস বলে গণ্য হয়। যেমন ইয়াহুদী জাতির মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আ.)-এর আন্দোলন,খ্রিষ্টানদের জন্য হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম তারিখ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর হিজরত হচ্ছে তারিখ গণনার উৎস যা দিয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসারিগণ তাদের জীবনের ঘটনাসমূহের উদ্ভবের সময়কাল নির্ণয় ও পরিমাপ করে থাকে।

কখনো কখনো কোন জাতি মৌলিক ইতিহাস ও তারিখের অধিকারী হওয়ার কারণে কিছু কিছু ঘটনাকেও তাদের তারিখ গণনার ভিত্তি ও উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে। যেমন পাশ্চাত্যের দেশসমূহে মহান ফরাসী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে 1917 খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরের কম্যুনিস্ট আন্দোলন ঐ সব দেশে যে সব ঘটনাপ্রবাহের উদ্ভব হয় সেগুলোর অনেক কিছুর তারিখ গণনার ভিত্তি বা উৎস হিসাবে গণ্য করা হযেছে। যে সব অনগ্রসর জাতি এ ধরনের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলন থেকে বঞ্চিত সে সব জাতি স্বাভাবিকভাবে অসাধারণ ঘটনাবলীকে তাদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করে। এ কারণেই জাহেলী আরবগণ সঠিক কৃষ্টি ও সভ্যতার অধিকারী না হওয়ায় যুদ্ধ,ভূমিকম্প,দুর্ভিক্ষ অথবা অলৌকিক ঘটনাবলীকে নিজেদের ইতিহাস ও তারিখ গণনার উৎস হিসাবে গণ্য করেছে। এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা আরব জাতির তারিখ গণনার ভিন্ন ভিন্ন ভিত্তি দেখতে পাই। এসব ভিত্তির মধ্যে সর্বশেষ ভিত্তি হচ্ছে হাতির বছরের ঘটনা এবং পবিত্র কাবাগৃহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আবরাহার মক্কা আক্রমণের ঘটনা যা অন্যান্য ঘটনার তারিখ গণনার ভিত্তি হিসাবে গণ্য হয়েছে। এখন আমরা 570 খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত মহাঘটনাটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করব এবং এখানে স্মর্তব্য যে,মহানবী (সা.)ও এই একই বছরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

এ ঘটনার উৎস

আসহাবে ফীল অর্থাৎ হস্তিবাহিনীর ঘটনা পবিত্র কোরআনে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হয়েছে। আর আমরা এ ঘটনা বর্ণনা করার পর যে সব আয়াত এ ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে তা উল্লেখ করব। ইতিহাস রচয়িতাগণ এ ঘটনার মূল কারণ সম্পর্কে লিখেছেন : ইয়েমেনের বাদশাহ্ যূনুওয়াস তার সরকারের ভিত্তি মজবুত করার পর কোন এক সফরে মদীনা অতিক্রম করছিল। তখন মদীনা এক অতি উত্তম ধর্মীয় মর্যাদার অধিকারী ছিল। সে সময় একদল ইয়াহুদী ঐ শহরে বসতি স্থাপন করে প্রচুর মন্দির ও ইবাদাতগাহ্ নির্মাণ করেছিল। সুযোগসন্ধানী ইয়াহুদিগণ বাদশার আগমনকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে বাদশাহকে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। তাদের এ পদক্ষেপের উদ্দেশ্যে ছিল নব্য ইয়াহুদী ধর্মে দীক্ষিত বাদশাহ্ যূনুওয়াসের শাসনাধীনে রোমের খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক আরবের হামলা থেকে নিরাপদ থাকা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা। এ ব্যাপারে তাদের প্রচার খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। যূনুওয়াস ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করল এবং এ ধর্ম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছিল। অনেকেই ভীত হয়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। সে একদল জনতাকে বিরোধিতা করার জন্য কঠোর শাস্তি প্রদান করে। তবে নাজরানের অধিবাসিগণ যারা বেশ কিছুদিন আগেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা কোনক্রমেই খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইয়াহুদী ধর্মের অনুশাসন অনুসরণ করতে প্রস্তুত ছিল না।ইয়েমেনের বাদশার বিরুদ্ধাচরণ এবং অবজ্ঞা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ছিল। বাদশাহ্ যূনুওয়াস এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে নাজরানের বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সেনাপতি নাজরান শহরের পাশে সেনা শিবির ও তাঁবু স্থাপন করে এবং পরিখা খনন করার পর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়;আর বিদ্রোহীদেরকে ঐ আগুনে জীবন্ত দগ্ধ করার হুমকি প্রদর্শন করতে থাকে। নাজরানের অকুতোভয় সাহসী জনতা যারা মনে-প্রাণে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল তারা এতে মোটেও ভীত না হয়ে মৃত্যু ও জীবন্ত দগ্ধ হওয়াকে সানন্দে বরণ করে নেয়। তাদের দেহগুলো সেই আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছিল।110

ইসলামী ইতিহাসবেত্তা ইবনে আসীর জাযারী লিখেছেন : এ সময় দূস নামক একজন নাজরানবাসী খ্রিষ্টধর্মের গোঁড়া সমর্থক রোমান সম্রাট কাইসারের কাছে গমন করে তাঁকে পুরো ঘটনা অবহিত করল এবং রক্তপিপাসু যূনুওয়াসকে শাস্তি প্রদান এবং অত্র এলাকায় খ্রিষ্টধর্মের ভিত মজবুত ও শক্তিশালী করার আবেদন জানাল। রোমের অধিপতি গভীর দুঃখ ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলেন, আপনাদের দেশ থেকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী অনেক দূরে অবস্থিত বিধায় এ ধরনের অত্যাচারের প্রতিকার বিধানার্থে হাবাশার বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে একটি চিঠি লিখছি যাতে করে তিনি ঐ রক্তপিপাসু নরপিশাচের কাছ থেকে নাজরানের নিহতদের প্রতিশোধ নিতে পারেন। ঐ নাজরানবাসী কাইসারের চিঠি নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাবাশার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল এবং বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে পুরো ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করল। ফলে বাদশার শিরা ও ধমনীতে তীব্র আত্মসম্মানবোধ ও চেতনাবোধের রক্ত প্রবাহিত হয়ে গেল। তিনি আবরাহাতুল আশরাম নামক এক হাবাশী সেনাপতির নেতৃত্বে 70 হাজারের এক বিশাল সেনাবাহিনী ইয়েমেনের দিকে প্রেরণ করেন। হাবাশার উক্ত সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীটি সমুদ্রপথে ইয়েমেনের সৈকতে তাঁবু স্থাপন করে। এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে যূনুওয়াসের আর কিছুই করার ছিল না। সে যতই চেষ্টা করল তাতে কোন ফল হলো না। প্রতিরোধ ও যুদ্ধ করার জন্য যতই গোত্রপতিদের নিকট আহবান জানাল তাতে তাদের পক্ষ থেকে সে কোন সাড়া পেল না। পরিণতিতে আবরাহার এক সংক্ষিপ্ত আক্রমণের মুখে যূনুওয়াসের প্রশাসনের ভিত ধসে পড়ে এবং সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী ইয়েমেন হাবাশাহ্ সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে যায়।

আবরাহা প্রতিশোধ ও বিজয়ের মদমত্ততায় চূর ও মাতাল হয়েছিল। সে যৌনকামনা ও আমোদ-প্রমোদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে মোটেও বিরত থাকত না। সে হাবাশার বাদশার নৈকট্য ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইয়েমেনের রাজধানী সানআ নগরীতে একটি জমকালো গীর্জা নির্মাণ করে যা ছিল ঐ যুগে অতুলনীয়। তারপর সে বাদশাহ্ নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে পত্র লেখে, গীর্জা নির্মাণ কাজ প্রায় সমাপ্ত হওয়ার পথে। ইয়েমেনের সকল অধিবাসীকে কাবার যিয়ারত করা থেকে বিরত এবং এই গীর্জাকে সাধারণ জনগণের জন্য তাওয়াফস্থল করার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছি।” চিঠিটির মূল বক্তব্য প্রচারিত হলে সমগ্র আরব গোত্রগুলোর মধ্যে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল,এমনকি বনি আফকাম গোত্রের এক মহিলা উক্ত মন্দিরের চত্বরকে নোংরা করে দিল। এ ধরনের কাজ যার মাধ্যমে আবরাহার গীর্জার প্রতি আরবদের পূর্ণ অবজ্ঞা,শত্রুতা ও অবহেলা প্রকাশ পেয়েছে তা তদানীন্তন আবরাহা প্রশাসনকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে গীর্জার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও সাজ-সজ্জার ক্ষেত্রে যত চেষ্টা চালানো হয়েছে ততই পবিত্র কাবার প্রতি জনগণের আকর্ষণ ও ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে। এ সব ঘটনাপ্রবাহের কারণে আবরাহা পবিত্র কাবা ধ্বংস করার শপথ নেয়। এজন্য আবরাহা এক বিশাল বাহিনী গঠন করে যার সম্মুখভাগে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসজ্জিত অনেক লড়াকু হাতি। তাওহীদী মতাদর্শের প্রাণপুরুষ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.) যে গৃহটির পুননির্মাণ করেছিলেন আবরাহা তা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিস্থিতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ ও অতি সংবেদনশীল তা প্রত্যক্ষকরতঃ আরবের গোত্রপতিদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে,আরব জাতির স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্ব পতনের সম্মুখীন। কিন্তু আবরাহার অতীত সাফল্যসমূহ তাদেরকে যে কোন উপকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এতদ্সত্ত্বেও আবরাহার গমনপথের ওপর অরব গোত্রগুলোর কতিপয় আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নেতা পূর্ণ বীরত্বসহকারে আবরাহার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যেমন যূনাফার যিনি নিজেও এক অভিজাত বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করে তাঁর নিজ গোত্রকে পবিত্র কাবাগৃহ রক্ষা করার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু অতি অল্পদিনের মধ্যেই আবরাহার বিশাল বাহিনী তাঁদের ব্যুহসমূহ ভেদ করে দেয়। এরপর নুফাইল বিন হাবীব তীব্র প্রতিরোধ ও সংগ্রাম গড়ে তোলে,কিন্তু সেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয় এবং আবরাহার বাহিনীর হাতে বন্দী হয়। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য সে (নুফাইল) আবরাহার কাছে আবেদন জানালে আবরাহা তাকে বলেছিল, আমাদেরকে মক্কা নগরী অভিমুখে যদি তুমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।” তাই নুফাইল আবরাহাকে তায়েফ নগরী পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এবং পবিত্র মক্কা নগরী পর্যন্ত অবশিষ্ট পথ দেখানোর দায়িত্ব নুফাইল আবু রাগাল নামক তারই এক বন্ধুর ওপর ন্যস্ত করে। নতুন পথ-প্রদর্শক আবরাহার সেনাবাহিনীকে পবিত্র মক্কা নগরীর নিকটবর্তী মাগমাস নামক স্থানে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। আবরাহার সেনাবাহিনী ঐ স্থানকে সেনা ছাউনি ও তাঁবু স্থাপন করার জন্য মনোনীত করে। আর আবরাহা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী একজন সেনাপতিকে তিহামার উট ও গবাদিপশু লুণ্ঠন করার দায়িত্ব দেয়। প্রায় 200টি উট লুণ্ঠন করা হয়। লুণ্ঠিত এ সব উটের মালিক ছিলেন মক্কাপ্রধান আবদুল মুত্তালিব। অতঃপর হানাতাহ্ নামীয় এক সেনাপতিকে আবরাহা মক্কার কুরাইশ নেতা ও প্রধানের কাছে তার বাণী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে বলেছিল, কাবাগৃহ ধ্বংস করার প্রকৃত চিত্র যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে! আর নিশ্চিতভাবে কুরাইশরা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে রক্তপাত এড়ানোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মক্কার পথ ধরে এগিয়ে যাবে। সেখানে পৌঁছে কুরাইশ প্রধানের খোঁজ করে সরাসরি তার কাছে গিয়ে বলবে : আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো কাবাগৃহ ধ্বংস করা। কুরাইশরা যদি প্রতিরোধ না করে তাহলে তারা যে কোন হামলা ও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।”

আবরাহার প্রেরিত দূত পবিত্র মক্কায় পৌঁছেই কুরাইশদের বিভিন্ন দলকে আবরাহার সামরিক অভিযান সম্পর্কে আলোচনারত দেখতে পেল। মক্কাপ্রধানের খোঁজ করলে তাকে আবদুল মুত্তালিবের গৃহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার বাণী শোনার পর বললেন, আমরা কখনই প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ে তুলব না। কাবা মহান আল্লাহর গৃহ যার নির্মাতা হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)। মহান আল্লাহ্ যা কল্যাণকর তা-ই করবেন।” আবরাহার সেনাপতি কুরাইশপ্রধানের এ ধরনের কোমল ও শান্তিপূর্ণ যুক্তি যা প্রকৃত সুমহান আত্মিক ঈমানেরই পরিচায়ক তা শ্রবণ করে সন্তোষ প্রকাশ করল এবং তার সাথে আবরাহার তাঁবুতে আসার আমন্ত্রণ জানাল।

আবরাহার শিবিরে আবদুল মুত্তালিব-এর গমন

আবদুল মুত্তালিব তাঁর কয়েক সন্তানসহ আবরাহার শিবিরের দিকে রওয়ানা হলেন। কুরাইশপ্রধানের মহত্ত্ব,স্থিরতা,ধৈর্য,গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব আবরাহাকে বিস্ময়াভিভূত করে ফেলে। এ কারণেই সে আবদুল মুত্তালিবের প্রতি অত্যন্ত ভক্তি,শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেছিল। এর প্রমাণস্বরূপ,সে সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এসে আবদুল মুত্তালিবের হাত ধরে তাঁকে তার নিজের পাশে বসিয়েছিল। এরপর সে পূর্ণ ভদ্রতা ও শিষ্টাচারসহকারে দোভাষীর মাধ্যমে আবদুল মুত্তালিবকে প্রশ্ন করেছিল যে,তিনি কেন এখানে এসেছেন এবং তিনি কী চাচ্ছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তিহামার উটগুলো এবং যে দু শ’উটের মালিক আমি সেগুলো আপনার সৈন্যদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়েছে। আপনার কাছে আমার অনুরোধ এটিই যে,অনুগ্রহপূর্বক ঐ সকল উট স্ব স্ব মালিকের কাছে ফেরত দেয়ার আদেশ দিন।” আবরাহা বলল, আপনার আলোকিত বদনমণ্ডল আপনাকে আমার কাছে এক জগৎ পরিমাণ মহান ও বিরাট করে তুলেছে,অথচ (যখন আমি এসেছি আপনার পূর্বপুরুষদের ইবাদাতগাহ্ ধ্বংস করতে) তখন আপনার ছোট ও অতি সামান্য আবেদন আপনার মহত্ত্ব,উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাকে কমিয়ে দিয়েছে। আমি আশা করেছিলাম যে,আপনি কাবার ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং অনুরোধ জানাবেন যে,আমার যে লক্ষ্য আপনাদের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে তা থেকে অমি যেন বিরত থাকি। না,পক্ষান্তরে আপনি কয়েকটি মূল্যহীন উটের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন এবং সেগুলো ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করেছেন? আবদুল মুত্তালিব আবরাহার প্রশ্নের জবাবে একটি বাক্য বলেছিলেন যা আজও তাঁর নিজস্ব মহত্ত্ব,গৌরব এবং মান বজায় রেখেছে। আর ঐ বাক্যটি ছিল :

أنا ربّ الإبل و للبيت ربّ يمنعه

“আমি উটগুলোর প্রতিপালনকারী এবং পবিত্র কাবারও এমন এক প্রভু আছেন যিনি (সব ধরনের আগ্রাসন,আক্রমণ এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে) উক্ত গৃহকে রক্ষা করবেন।” আবরাহা এ কথা শোনার পর খুবই দাম্ভিকতার সাথে বলেছিল, এ পথে আমার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়ার শক্তি কারো নেই।” এরপর সে লুণ্ঠিত সব ধন-সম্পদ প্রকৃত মালিকদের কাছে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

অধীর আগ্রহে কুরাইশদের অপেক্ষা

সমগ্র কুরাইশ গোত্র অধীর আগ্রহে আবদুল মুত্তালিবের ফেরার অপেক্ষায় ছিল যাতে করে তারা শত্রুর সাথে তাঁর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে অবগত হতে পারে। যখন আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রপতিদের মুখোমুখি হলেন তখন তিনি তাদেরকে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের গবাদিপশু নিয়ে উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কর। এর ফলে তোমরা সবাই যে কোন ধরনের ক্ষতি ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।” এ কথা শোনার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সকল মক্কাবাসী তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ী ছেড়ে পাহাড়-পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিল। মধ্যরাত্রিতে শিশু ও নারীদের ক্রন্দনধবনি এবং পশুসমূহের আর্তনাদ সমগ্র পাহাড়-পর্বতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। ঐ সময় আবদুল মুত্তালিব কয়েকজন কুরাইশসহ পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে এসে পবিত্র কাবায় গেলেন। ঐ সময় তাঁর চোখের চারপাশে অশ্রুবিন্দু জমেছিল। তিনি ব্যথিত অন্তরে পবিত্র কাবার দরজার কড়া হাতে নিয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেছিলেন, হে ইলাহী! তাদের (আবরাহা ও তার বিশাল সেনাবাহিনী) অনিষ্ট সাধন ও ক্ষয়ক্ষতি করা থেকে নিরাপদ থাকার ব্যাপারে কেবল তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র আশা নেই। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র গৃহের অঙ্গন ও সীমানা থেকে প্রতিহত কর। সে-ই কাবার দুশমন যে তোমার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। হে প্রভু! তাদেরকে তোমার পবিত্র ঘর ধ্বংস করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ করে দাও। হে প্রভু! তোমার বান্দা নিজের ঘরকে রক্ষা করে। তাই তুমিও তোমার ঘরকে রক্ষা কর। ঐ দিনকে (আমাদের কাছে) আসতে দিও না যে দিন তাদের ক্রুশ জয়যুক্ত হবে,আর তাদের প্রতারণাও সফল ও বিজয়ী হবে। 111

এরপর তিনি কাবাগৃহের দরজার কড়া ছেড়ে দিয়ে পর্বতশৃঙ্গে ফিরে আসলেন এবং সেখান থেকে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন। প্রভাতে যখন আবরাহা ও তার সেনাবাহিনী মক্কাভিমুখে রওয়ানা হল তখন হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি সমুদ্রের দিক থেকে আকাশে আবির্ভূত হলো যেগুলোর প্রতিটির মুখ ও পায়ে ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাথর। পাখিদের ছায়ায় সৈন্যশিবিরের আকাশ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাহ্যিকভাবে এগুলোর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্ত্র অতি বিস্ময়কর প্রভাব ও ফলাফল সৃষ্টি করল। মহান আল্লাহর নির্দেশে ঐ সব পাখি আবরাহার বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণ করল যার ফলে তাদের মাথা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল এবং দেহের মাংসগুলো খসে পড়ল। একটি ক্ষুদ্র পাথর আবরাহার মাথায়ও আঘাত করলে সে খুব ভয় পেয়ে গেল এবং তার দেহে কম্পন শুরু হলো। সে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারল যে,মহান আল্লাহর ক্রোধ ও গজব তাকে ঘিরে ফেলেছে। সেনাদলের দিকে তাকালে সে দেখতে পেল যে,তাদের মৃতদেহগুলো গাছের পাতা ঠিক যেভাবে মাটিতে পড়ে থাকে ঠিক সেভাবে মাটিতে পড়ে আছে। কালবিলম্ব না করে তার সেনাবাহিনীর যারা বেঁচে আছে,যে পথ ধরে তারা এসেছিল ঠিক সে পথেই ইয়েমেনের রাজধানী সানাআয় ফিরে যাবার জন্য সে নির্দেশ দিল। আবরাহার সেনাদলের মধ্যে থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা সানাআর দিকে রওয়ানা হলো। কিন্তু পথিমধ্যে অনেক সৈন্যই ক্ষত ও ভীতিজনিত কারণে প্রাণত্যাগ করল,এমনকি আবরাহাও যখন সানাআয় পৌঁছল তখন তার শরীরের মাংস খসে পড়ল এবং আশ্চর্যজনক অবস্থার মধ্যে তার মৃত্যু হলো।

বিস্ময়কর ও ভীতিপ্রদ এ ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করল। হাতিওয়ালাদের কাহিনী পবিত্র কোরআনের সূরা ফীল-এ এভাবে বর্ণিত হয়েছে : আপনি কি দেখেন নি যে,আপনার প্রভু হাতিওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেন নি? তিনি তাদের ওপর এক ঝাঁক পাখি প্রেরণ করেছিলেন যেগুলো তাদের ওপর পোড়ামাটির তৈরি কঙ্কর নিক্ষেপকরতঃ তাদেরকে চর্বিত ঘাস ও পাতার মতো পিষ্ট করে দিয়েছিল।”

) بسم الله الرّحمان الرّحيم -ألم تر كيف فعل ربّك بأصحاب الفيل-ألم يجعل كيدهم في تضليل-و أرسل عليهم طيرا أبابيل-ترميهم بحجارة من سجيل-فجعلهم كعصف مأكول(

আমরা এখন যা কিছু আলোচনা করলাম আসলে তা এ ক্ষেত্রে বর্ণিত ইসলামী ঐতিহাসিক বর্ণনাসমূহের সারসংক্ষেপ এবং পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনাও ঠিক এটিই। এখন আমরা প্রখ্যাত মিশরীয় মুফাসসির মুহাম্মদ আবদুহু’এবং মিশরের ভূতপূর্ব সংস্কৃতিমন্ত্রী প্রখ্যাত পণ্ডিত (ড. হাইকাল) এতৎসংক্রান্ত যা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে দেখব।


7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49