বত্রিশতম পত্র
২৪ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ
১। উম্মে সালিমের সাক্ষাতে এরূপ বর্ণনার অস্তিত্ব।
২। হযরত হামযাহর কন্যার উপস্থিতিতে।
৩। নবী (সা.) যখন আলী (আ.)-এর ওপর ভর করে বসেছিলেন।
৪। প্রথম ভ্রাতৃবন্ধনের দিন।
৫। দ্বিতীয় ভ্রাতৃবন্ধনের ঘটনা।
৬। মসজিদের দিকে অবস্থিত সকল দ্বার বন্ধ করার দিন।
৭। নবী আলী ও হারুন (আ.)-কে দু’
টি নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন যারা একসঙ্গে থাকে।
১। একদিন নবী (সা.) উম্মে সালিমের
নিকট হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর পবিত্র মুখ দিয়ে এরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
উম্মে সালিম ইসলামের অগ্রগামীদের অন্তর্ভুক্ত ও তীক্ষ্ণ জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন। ইসলামের ক্ষেত্রে অগ্রগামিতা,ইখলাস,ধৈর্যশীলতা ও ত্যাগের কারণে রাসূলের নিকট তাঁর বিশেষ মর্যাদা ছিল।
নবী (সা.) তাঁদের ঘরে যেতেন ও তাঁর জন্য হাদীস বর্ণনা করতেন। একদিন তিনি তাঁকে বলেন,“
হে উম্মে সালিম! আলীর রক্ত ও মাংস আমার রক্ত ও মাংস হতে। সে আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের মত।”
এ হাদীসটি‘
কানযুল উম্মাল’
গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ১৫৪ পৃষ্ঠায় ২৫৫৪ নং হাদীস হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।‘
মুনতাখাবে কানয’
গ্রন্থেও হাদীসটি এসেছে। এজন্য‘
মুসনাদে আহমাদ’
গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ৩১ পৃষ্ঠার পাদটীকায় দেখতে পারেন। আমাদের বর্ণিত সূত্রের হুবহু সেখানে এসেছে।
আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এ হাদীসটি নবী (সা.) কোন বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেন নি,বরং আল্লাহর পক্ষ হতে প্রাপ্ত দায়িত্ব পালন এবং তাঁর বাণীর প্রচার ও উপদেশ দানের লক্ষ্যেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তির শান ও মর্যাদা এভাবে বর্ণনা করেছেন। এটি তাই তাবুক যুদ্ধের সঙ্গেই শুধু সংশ্লিষ্ট নয়।
২। হযরত হামযাহর কন্যা সম্পর্কে হযরত আলী,জা’
ফর ও যাইদের মধ্যে যে আলোচনা হচ্ছিল সে সর্ম্পকিত বর্ণনায় অনুরূপ হাদীস এসেছে যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন,“
হে আলী! তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত।”
৩। তদ্রুপ একদিন হযরত আবু বকর,উমর ও আবু উবাইদা জাররাহ্ রাসূলের সামনে বসেছিলেন। হযরত রাসূল (সা.) আলীর ওপর ভর করে বসেছিলেন এমতাবস্থায় নিজের হাত আলী (আ.)-এর কাঁধে রেখে বললেন,“
হে আলী! তুমি মুমিনদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যে আমার প্রতি ঈমান এনেছ ও ইসলাম গ্রহণ করেছ,তুমি আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের মত।”
৪। প্রথম ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপনের দিন যা মক্কায় সংঘটিত হয়েছিল সেদিন রাসূল এরূপ কথা বলেছেন। হিজরতের পূর্বে রাসূল (সা.) বিশেষত মক্কার মুহাজিরদের মধ্যে দু’
জন দু’
জন করে ভ্রাতৃত্বের যে বন্ধন সৃষ্টি করেন (আকদের মাধ্যমে) সেখানে তিনি এরূপ কথা বলেন।
৫। ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের দ্বিতীয় চুক্তির দিন যা হিজরতের পঞ্চম মাসে মদীনায় অনুষ্ঠিত হয় এবং রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়ে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) আলীকে নিজের ভাই হিসেবে মনোনীত করেন ও অন্যদের ওপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের কারণে অন্য কাউকে নিজের ভাই হিসেবে ঘোষণা করেন নি
এবং আলীর প্রতি নির্দেশ করে বলেন,“
তুমি আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের মত তবে আমার পর কোন নবী নেই।”
নবী করিম (সা.)-এর পবিত্র বংশধরদের হতে এ বিষয়ে মুতাওয়াতির সূত্রে হাদীসসমূহ বর্ণিত হয়েছে। আহলে বাইতের বাইরে প্রথম ভ্রাতৃবন্ধন সম্পর্কে যায়েদ ইবনে আবি আওফী যা বলেছেন আপনার জন্য সেটিই যথেষ্ট বলে মনে করছি। এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর‘
মানাকিবে আলী’
,ইবনে আসাকির তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে,বাগাভী ও তাবরানী তাঁদের মাজমায়,বারুদী তাঁর‘
কিতাবুল মারেফাত’
গ্রন্থে এবং ইবনে আদী
ও অন্যরাও বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীসটি বেশ দীর্ঘ। এতে ভ্রাতৃত্বের আকদ পাঠের প্রক্রিয়াও বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটির শেষে এভাবে এসেছে- আলী (আ.) রাসূলকে বললেন,“
হে রাসূল (সা.)! আমার যেন মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে,আত্মা বের হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে,আমাকে ছাড়াই আপনি সাহাবীদের নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছেন। যদি আপনি কোন বিষয়ে আমার ওপর রাগান্বিত হয়ে থাকেন তাহলে আমি আপনার দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। আপনি আপনার দয়া ও অনুগ্রহ দ্বারা তা ক্ষমা করে দিন।”
রাসূল (সা.) বললেন,“
সেই মহান সত্তার শপথ,যিনি আমাকে সত্য নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন,আমার প্রয়োজন ব্যতীত অন্য কোন কারণে তোমাকে বাদ দেই নি এবং তুমি আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের মত এ পার্থক্য ব্যতীত যে,আমার পর কোন নবী নেই। তুমি আমার ভাই ও আমার উত্তরাধিকারী।”
আলী বললেন,“
আপনার নিকট হতে আমি উত্তরাধিকার সূত্রে কি লাভ করব?”
তিনি বললেন,“
পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণ যা ইতোপূর্বে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যেতেন আর তা ছিল তাঁদের প্রভুর গ্রন্থ ও তাঁদের নবীর সুন্নাহ্। তুমি আমার কন্যা ফাতিমাসহ বেহেশতে আমার প্রাসাদে থাকবে। তুমি আমার ভাই ও বন্ধু।”
অতঃপর রাসূল (সা.) নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেনاخوانا على سرر متقابلين
সেখানে তারা পরস্পর ভাই হিসেবে মুখোমুখি বসে থাকবে।
অর্থাৎ তাঁরা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালবাসার কারণে বেহেশতে অবস্থান করবেন এবং পরস্পরকে লক্ষ্য করবেন।
এছাড়া দ্বিতীয় ভ্রাতৃত্ববন্ধনের দিন সম্পর্কিত হাদীসটি তাবরানী তাঁর‘
কাবীর’
গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে এভাবে এনেছেন- নবী (সা.) আলীকে বললেন,“
যখন তুমি লক্ষ্য করলে আমি মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিলাম কিন্তু তোমাকে কারো ভাই হিসেবে ঘোষণা করলাম না তখন কি তুমি আমার প্রতি অভিমান করেছ? তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও,তোমার অবস্থান আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের অবস্থানের ন্যায় হোক এ পার্থক্য ব্যতীত যে,আমার পরে কোন নবী আসবে না?”
৬। যেদিন রাসূল আলী (আ.)-এর দ্বার ব্যতীত মসজিদে নববীর দিকে উন্মুক্ত সকল দ্বারকে বন্ধ করার ঘোষণা দেন সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে জাবের বিন আবদুল্লাহ্ আনসারী
হতে বর্ণিত হাদীসটি লক্ষণীয়। তিনি বলেন,“
নবী (সা.) বলেছেন : হে আলী! মসজিদে আমার জন্য যা কিছু হালাল তোমার জন্যও তদ্রুপ। তুমি আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের মত এ পার্থক্য ব্যতীত যে,আমার পর কোন নবী নেই।”
হুজাইফা ইবনে উসাইদ গাফফারী
বলেন,“
যেদিন রাসূল মসজিদের দিকে উন্মুক্ত সকল দ্বার বন্ধ করে দেন সেদিন দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে খুতবা পাঠ করে বলেন : কোন কোন ব্যক্তির মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আমি আলীকে মসজিদে স্থান দিয়ে অন্য সকলকে বের করে দিয়েছি,না বরং খোদার শপথ,তিনিই আলীকে মসজিদে স্থান দিয়ে অন্যদের মসজিদ হতে বের করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ ওহী প্রেরণ করে মূসাকে তাঁর ও তাঁর ভ্রাতার জন্য মিশরে গৃহ নির্বাচন,ঐ গৃহকে কেবলা হিসেবে গ্রহণ এবং সেখানে নামায পড়ার নির্দেশ দিলেন।”
হাদীসটির শেষে রাসূল (সা.) বললেন,“
আলীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক মূসা ও হারুনের মত। সে আমার ভ্রাতা। সে ব্যতীত কারো জন্য জায়েয নেই মসজিদে জুনুব (যৌন কারণে অপবিত্র) অবস্থায় প্রবেশ করবে।”
এরূপ অসংখ্য নমুনা রয়েছে যা এ সংক্ষিপ্ত সময়ে এখানে উপস্থাপন সম্ভব নয়। অবশ্য‘
হাদীসে মানযিলাত’
যে শুধু তাবুকের যুদ্ধের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট নয় তা প্রমাণের জন্য আমরা যতটুকু আলোচনা করেছি ততটুকুই যথেষ্ট মনে করছি। তাই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে হাদীসটির বর্ণনা এর গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে।
৭। যে কেউ নবী (সা.)-এর জীবনী ও ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা করলে দেখতে পাবেন তিনি আলী ও হারুন (আ.)-কে উত্তর আকাশের (বিশেষ) নক্ষত্রদ্বয়ের মত একই ধাঁচের বলে মনে করতেন এবং কোন বিষয়ে তাঁদের একজনকে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিতেন না যা হাদীসটির সর্বজনীনতার সপক্ষে দলিল। পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করলেও শুধু হাদীসের শাব্দিক অর্থ থেকেও এই সর্বজনীনতা সুস্পষ্ট।
ওয়াসসালাম
শ