বিয়াল্লিশতম পত্র
৪ মুহররম ১৩৩০ হিঃ
১। আরবরা একবচনের ক্ষেত্রেও কখনো কখনো বহুবচনের ব্যবহার করে।
২। এর সপক্ষে নমুনা উপস্থাপন।
৩। এ বিষয়ে তাবারী যা বলেছেন।
৪। এ বিষয়ে যামাখশারী যা বলেছেন।
৫। আমি যা মনে করি।
১। আরবরা একবচনের জন্যও বহুবচন ব্যবহার করে থাকে। পরিস্থিতির এরূপ দাবীর কারণেই এমনটি করা হয়।
২। এ কথার সপক্ষে দলিল হিসেবে সূরা আলে ইমরানের ১৭৩ নম্বর আয়াতকে আমরা উল্লেখ করতে পারি যেখানে বলা হয়েছে-
)
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّـهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ(
যাদেরকে লোকেরা বলেছে তোমাদের সাথে মোকাবিলা করার জন্য লোকেরা সমাবেশ করেছে (বহু সাজ-সরঞ্জামসহ),তাদের ভয় কর,তখন তাদের বিশ্বাস (ঈমান) আরও দৃঢ়তর হয়ে যায় এবং তারা বলে আমাদের জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট,কতই না উত্তম সংরক্ষণকারী তিনি!
আমরা জানি এখানে বক্তা এক ব্যক্তি,সে হলো নাঈম ইবনে মাসউদ আশজাঈ (মুফাসসির,মুহাদ্দিস ও হাদীসবেত্তাগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন)।
মহান আল্লাহ্ এখানে এক ব্যক্তিকে বোঝাতে‘
আন্-নাস’
শব্দ ব্যবহার করেছেন যা বহুবচন। এখানে বহুবচন ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো যে সকল ব্যক্তি ঐ ব্যক্তির অসত্য ও ভিত্তিহীন কথায় কর্ণপাত করেন নি তাঁদের সম্মানিত করা। কথিত আছে,আবু সুফিয়ান ঐ ব্যক্তিকে দশটি উট দান করে যাতে সে এরূপ গুজবের মাধ্যমে মুসলমানদের ভীত ও দুর্বল করতে চেষ্টা চালায়। তাই সে এ কাজ করে। সে মুসলমানদের নিকট এসে বলে,“
হে লোকসকল! মুশরিকদের যোদ্ধারা তোমাদের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে,তাদের হতে ভীত হও।”
মুসলমানদের অধিকাংশই এ কথা শুনে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পতিত হলে রাসূল (সা.) সত্তর জন অশ্বারোহী নিয়ে সেদিকে যাত্রা করেন। এ আয়াত এই সত্তর জন ব্যক্তির শানে অবতীর্ণ হয়েছিল যাঁরা ঐ গুজবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ ও কর্ণপাত করেন নি।
সুতরাং এখানে‘
আন্-নাস’
একবচনের স্থানে ব্যবহার একটি সম্মানের বিষয়। যেহেতু যে সত্তর জন ব্যক্তি রাসূলের সঙ্গে যাত্রা করেন তাঁদের জন্য অলঙ্কারিকভাবে অধিকতর উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করা উচিত সেজন্য সেখানেالّذين قال لَهم رجل إنّ النّاس قد جَمعوا
‘
যাদেরকে একজন ব্যক্তি বলেছিল’
না বলে الّذين قال لَهم النّاس
‘
তাদেরকে লোকসকল বলেছিল’
বলা হয়েছে।
এরূপ বিষয় আল্লাহর বাণীতে,রাসূলের হাদীসে এবং আরবদের কথায় প্রচুর লক্ষ্য করা যায়। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন,
)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّـهِ عَلَيْكُمْ إِذْ هَمَّ قَوْمٌ أَن يَبْسُطُوا إِلَيْكُمْ أَيْدِيَهُمْ فَكَفَّ أَيْدِيَهُمْ عَنكُمْ(
“
হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ কর যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের দিকে স্বীয় হস্ত প্রসারিত করতে সচেষ্ট হয়েছিল তখন তিনি তাদের হস্ত তোমাদের হতে প্রতিহত করে দিলেন।”
এখানে উল্লেখ্য,উপরোক্ত আয়াতে সম্প্রদায় বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ঘটনা হলো বনি মাহারেব গোত্রের গুরাস নামক এক ব্যক্তি বনি নাজির গোত্রের আমর ইবনে জাহাশের নির্দেশে অস্ত্রধারণ করতঃ রাসূলের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তখন আল্লাহ্ রাসূলকে তা অবহিত করার মাধ্যমে রক্ষা করেন। এ ঘটনাটি মুফাসসির ও হাদীসবিদগণ উল্লেখ করেছেন। ইবনে হিশাম তাঁর সিরাত গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে‘
জাতুর রিকাহ্’
নামক যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ্ কওম বা সম্প্রদায় শব্দটি বহুবচন হওয়া সত্ত্বেও এই এক ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করেছেন কারণ এ ঘটনায় রাসূলের জীবন রক্ষা পায় যা মুসলমানদের প্রতি বিশেষ রহমত বলে গণ্য।
তেমনি মুবাহিলার আয়াতে‘
আবনা’
,‘
নিসা’
ও‘
আনফুস’
শব্দগুলো সর্বজনীন হওয়া সত্ত্বেও ইমাম হাসান ভ্রাতৃদ্বয়,হযরত ফাতিমা ও হযরত আলীর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। এটি সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁদের সম্মান ও মর্যাদার কারণেই তা করা হয়েছে।
এ উদাহরণসমূহ একবচনের স্থানে বহুবচন ব্যবহারকে অদূষণীয়,এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে অলঙ্কারশাস্ত্রের জন্য অপরিহার্য বলে প্রমাণ করে।
৩। ইমাম তাবারসী তাঁর‘
মাজমাউল বায়ান’
গ্রন্থে উপরোক্ত আয়াতের (বেলায়েতের আয়াত) তাফসীরে বলেছেন,“
এখানে বহুবচন বাচক শব্দ হযরত আলীর জন্য ব্যবহার তাঁর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের নিমিত্তে করা হয়েছে। কারণ ভাষাবিদগণ একবচনের স্থলে বহুবচনের ব্যবহার এ উদ্দেশ্যেই করে থাকেন। এটি এতটা প্রসিদ্ধ রীতি যে,দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে না।
৪। যামাখশারী তাঁর‘
তাফসীরে কাশশাফ’
গ্রন্থে বলেছেন,“
যদি প্রশ্ন করা হয় বহুবচন সূচক শব্দ কিরূপে হযরত আলীর জন্য ব্যবহার করা হলো,তার উত্তরে বলব যদিও একের অধিক ব্যক্তি এরূপ কাজ সম্পাদন করে নি তদুপরি যাতে মানুষ এরূপ কাজের প্রতি উৎসাহিত হয় এবং তদ্রুপ সম্মান লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালায় সেজন্যই এখানে বহুবচন সূচক শব্দ একবচনের স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলমানদের অপরিহার্যরূপে দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি সাহায্যের ক্ষেত্রে আগ্রহী করে তোলার জন্য নামাযের মধ্যেও তা বিলম্বিত না করার শিক্ষা এখানে দেয়া হয়েছে।”
৫। একবচনের স্থলে বহুবচনের ব্যবহারের বিষয়টি আমার দৃষ্টিতে এসব হতেও সূক্ষ্ম একটি বিষয় এবং এটি অধিকাংশ মানুষের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতের ফলশ্রুতিতে দান করা হয়েছে। কারণ হযরত আলী ও বনি হাশিমের প্রতি বিদ্বেষ,হিংসা ও শত্রুতা পোষণকারী মুনাফিকরা ও অন্যদের মধ্যে যারা তাঁর হতে অগ্রগামী হবার ইচ্ছা পোষণ করত তারা একবচনের মাধ্যমে বিষয়টি হযরত আলীর জন্য নির্দিষ্ট হওয়াকে কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারত না। যেহেতু তখন সত্যকে আড়াল করার সরাসরি কোন সুযোগ তারা পেত না তাই সম্ভাবনা ছিল তা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এমন কর্মে লিপ্ত হত যার ফলশ্রুতিতে ইসলামই বিপন্ন হয়ে পড়ত। এখানে একবচনের স্থানে বহুবচন ব্যবহারের মাধ্যমে সে পথ বন্ধ করা হয়েছে এবং রাসূল (সা.) হতে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হাদীসসমূহের মাধ্যমে বেলায়েতের বিষয়টিকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। রাসূলের মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হবার প্রক্রিয়া সেদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল যেদিন দীনকে পূর্ণাঙ্গ ও নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেন। যে বিষয়টি গ্রহণে জনসাধারণ কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয় সে বিষয়ের প্রচারে এরূপ প্রজ্ঞাপূর্ণ পদক্ষেপেরই প্রয়োজন। নতুবা একবচনের মাধ্যমে বিষয়টি নির্দিষ্ট হলে তারা একগুঁয়েমীবশত সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করত।
এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটি শুধু এ আয়াতের জন্য নয়,বরং কোরআনের যে সকল আয়াত আলী (আ.) ও আহলে বাইতের শানে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর জন্যও প্রযোজ্য এবং বিষয়টি সুস্পষ্ট। এই বিষয়টিকে আমি আমার‘
সাবিলুল মুমিনীন ওয়া তানযিলুল আয়াত’
গ্রন্থে সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণসহ উপস্থাপন ও স্পষ্ট করেছি। হেদায়েত ও তৌফিকের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করছি।
ওয়াসসালাম
শ