আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত6%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 69495 / ডাউনলোড: 9382
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

উনপঞ্চাশতম পত্র

১১ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

১।   আলীর ফজীলত ও শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার।

২।   তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব খেলাফতের বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়াকে অপরিহার্য করে না।

১। ইমাম আবু আবদুল্লাহ্ আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেন, রাসূল (সা.) হতে আলী ইবনে আবি তালিবের মত কোন সাহাবীর বিষয়েই এত অধিক ফজীলতসম্পন্ন হাদীস বর্ণিত হয় নি। ৩৪৮

ইবনে আব্বাস বলেন, আলীর মত অন্য কারো ক্ষেত্রেই কোরআনের এত অধিক আয়াত অবতীর্ণ হয় নি। ৩৪৯ অন্যস্থানে তিনি বলেছেন, আলী সম্পর্কে কোরআনে তিন শ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ৩৫০ তিনি আরো বলেছেন, কোরআনের যে স্থানেইيا ايها الذين آمنوا অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ বলা হয়েছে আলী (আ.) তাঁদের মধ্যে প্রধান ও নেতা। ৩৫১ আল্লাহ্ অসংখ্য আয়াতে সাহাবীদের সমালোচনা করলেও কোথাও আলীকে প্রশংসা ব্যতীত স্মরণ করেন নি।

আবদুল্লাহ্ ইবনে আইয়াশ ইবনে আবি রাবিয়া বলেন, আলী (আ.)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে যা কিছুই বলতে চাও দৃঢ়তার সাথে তা বর্ণনা করতে পার। তাঁর ইসলামের অতীত উজ্জ্বল ও ভাস্বর এবং তিনি রাসূল (সা.)-এর জামাতা। হাদীসে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা,যুদ্ধে সাহসিকতা,বীরত্ব ও জয় এবং দানের ক্ষেত্রে তাঁর উদারতা নজীরবিহীন। ৩৫২

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলকে হযরত আলী (আ.) এবং মুয়াবিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে বললেন,৩৫৩ আলীর প্রচুর শত্রু ছিল। তাঁর শত্রুরা তাঁকে ক্ষুদ্র ও ছোট করার জন্য সব সময় তাঁর ত্রুটি অন্বেষণে ব্যস্ত থাকত,তদুপরি এরূপ কিছু পায় নি। ফলে তারা আলীর শত্রুদের (যারা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে) প্রশংসা করার মাধ্যমে তাঁকে কষ্ট দেয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করত।

কাজী ইসমাঈল,নাসায়ী,আবু আলী নিশাবুরী ও অন্যান্যরা বলেছেন, আলীর মত কোন সাহাবীর পক্ষেই সহীহ সনদে এত অধিক ফাজায়েল ও মানাকিব বর্ণিত হয় নি। ৩৫৪

২। এ বিষয়গুলোতে কোন প্রতিবাদ ও সমালোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো নবী (সা.) তাঁর খেলাফতের বিষয়ে সরাসরি বলেছেন নাকি বলেন নি? আপনি যে হাদীস ও সুন্নাহ্গুলো বর্ণনা করেছেন তা বিভিন্ন অবস্থা ও প্রেক্ষাপটে আলী (আ.)-এর বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করছে। আমরাও বিশ্বাস করি তিনি এ সকল বিষয়ে অন্যদের হতে শ্রেষ্ঠত্ব রাখেন এবং আপনি যা বর্ণনা করেছেন তার হতে অধিক সংখ্যায় এ সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসগুলো তাঁর ইমামতের প্রতি ইঙ্গিত করলেও রাসূল (সা.)-এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্তের বিষয়টি প্রকাশ করে না।

ওয়াসসালাম

পঞ্চাশতম পত্র

১৩ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

নেতার (ইমামের) বৈশিষ্ট্য বর্ণনা হতেই তাঁর নেতৃত্বের (ইমামতের) বিষয়টি প্রমাণিত হয়

আপনার মত উজ্জ্বল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন,বক্তব্যের প্রেক্ষাপট ও উৎস সম্পর্কে সচেতন এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তি যিনি শেষ নবী হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রজ্ঞা,তাঁর কথা ও কর্মের পরিমাপ ও তাঁর কোন কথাই যে প্রবৃত্তির অনুগত নয় সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী তাঁর নিকট এ সকল হাদীসের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাধারণ অর্থ অস্পষ্ট ও আবরিত নয় এবং এগুলো বর্ণনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও অজ্ঞাত নয়। আপনি জন্মগত প্রতিষ্ঠিত আরব হিসেবে এটি উপলব্ধি করেন যে,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষে সম্ভব নয় তাঁদের দীনের রক্ষাকারী প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কারো প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দান করে কথা বলবেন। তাই এ হাদীসগুলো হতে বোঝা যায় আলী বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী এবং সেগুলো সরাসরি খেলাফতের প্রমাণ না দিলেও সেদিকে ইঙ্গিতকারী হিসেবে অপরিহার্য প্রমাণ বলে গণ্য। কারণ নবীকুল শিরোমণি ও শ্রেষ্ঠ রাসূল (সা.) খেলাফতের এইরূপ উচ্চমর্যাদা তাঁর মত নেতৃত্ব ও পদমর্যাদার ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো হাতে স্থানান্তর করতে পারেন না।

তদুপরি আলী সম্পর্কিত বিশেষ হাদীসগুলো যদি কেউ ইনসাফের দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবং যথাযথভাবে পর্যালোচনা করে তাহলে দেখতে পাবে সেগুলোর অধিকাংশই ইমামতের দিকেই নির্দেশনা দান করে। হয় তা গাদীরের৩৫৫ প্রতিশ্রুতি গ্রহণের হাদীসের মত সরাসরি ইমামতের পূর্ণ প্রমাণ দেয় নতুবা আটচল্লিশতম পত্রের হাদীসগুলোর মত ইমামতের অপরিহার্যতার প্রতি ইঙ্গিত দান করে। যেমন এ হাদীসটি আলী কোরআনের সঙ্গে এবং কোরআন আলীর সঙ্গে এবং এরা একে অপর হতে কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না ও এ অবস্থায়ই হাউজে কাওসারে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। ৩৫৬

অনুরূপ রাসূল (সা.) হতে বর্ণিত একটি হাদীস, আলীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক আমার দেহের সঙ্গে আমার মাথার সম্পর্কের ন্যায়। ৩৫৭

আবদুর রহমান ইবনে আওফ৩৫৮ বলেন, রাসূল (সা.) আমাদের ভয় প্রদর্শন করে বললেন : সেই মহান সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ নিবদ্ধ,তোমরা অবশ্যই নামায কায়েম করবে,যাকাত দিবে নতুবা তোমাদের প্রতি এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবো যে আমা হতে এবং আমার প্রাণস্বরূপ। হাদীসটির শেষে এসেছে অতঃপর রাসূল (সা.) আলীর হাত ধারণ করে বললেন, এই সে ব্যক্তি।

এছাড়াও এ সম্পর্কিত আরো হাদীস বিদ্যমান।

যে ব্যক্তি সত্যের সমুদ্রে অবগাহনে আকাঙ্ক্ষী,বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা ও অস্পষ্টতাকে দূর করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তাকে আমি এ মূল্যবান হাদীসগুলোর প্রতি দৃষ্টি দানের আহবান জানাব। সত্যের অনুসন্ধানে ও গবেষণায় ব্যাপৃত ব্যক্তি সত্য উদ্ঘাটন ব্যতীত যার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই তার উচিত ব্যক্তিগত আবেগ ও প্রবণতাকে দূরে ঠেলে এই আলোচনার প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টি দান।

ওয়াসসালাম

একান্নতম পত্র

১৪ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

এই প্রমাণসমূহের বিপরীতেও দলিল রয়েছে। আপনার বিরোধীরা প্রথম তিন খলীফার ফজীলতে বর্ণিত হাদীসসমূহ আপনার বিপক্ষে দলিল বলে মনে করেন এবং বিশ্বাস করেন মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে অগ্রগামীদের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের বিষয়ে তাঁরা আলী হতে অগ্রগামী। তাই আপনার প্রমাণ অগ্রহণযোগ্য। আপনার বক্তব্য কি?

ওয়াসসালাম

বায়ান্নতম পত্র

১৫ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

তাঁদের দাবীর বিপক্ষে জবাব

আমরা মুহাজির ও আনসারদের অগ্রগামী ব্যক্তিবর্গের ফজীলত ও মর্যাদাকে স্বীকার করি। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত বাণীসমূহই যথেষ্ট। আমরা উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করে এমন কিছু পাই নি যাতে করে বলা যায় সেগুলো আলীর শ্রেষ্ঠত্বের বিপক্ষে দলিল,এমন কি তাঁর মধ্যে ইমামতের জন্য প্রয়োজনীয় পারিপার্শ্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দলিলও নেই।

অবশ্য আমাদের বিরোধীরা নিজেদের হতে তাঁদের অনেকের ফজীলত বর্ণনা করে হাদীস বলেছেন যা আমাদের নিকট প্রমাণিত নয়। সুতরাং সেগুলো আমাদের বর্ণিত রেওয়ায়েতের বিপরীতে অগ্রহণযোগ্য এবং অযথা তর্ককারী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো কাছে তা আশা করা যায় না। কারণ আমরা তাঁদের মত ঐ হাদীসগুলোকে নির্ভরযোগ্য মনে করতে পারি না। আমাদের সূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহকে তাঁদের বিপরীতে এনে প্রমাণ করতে যাওয়া যেমন যুক্তিযুক্ত নয় তেমনি ঐ হাদীসসমূহকে এ হাদীসগুলোর (হযরত আলীর শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজীলত বর্ণনাকারী হাদীসসমূহ) বিপরীতে দাঁড় করানোও অযৌক্তিক। তাই আমরা আমাদের বিরোধীদের বর্ণনা হতেই আলীর শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্বের বিষয়টি আলোচনা করছি (আমাদের সূত্রে নয়) যেমন গাদীরের হাদীস ও অন্যান্য হাদীস।

এগুলো বাদ দিলেও আমাদের বিরোধীরা তাঁদের ফজীলত বর্ণনা করে যে হাদীসসমূহ এনেছেন তা আমাদের বর্ণিত হাদীসের বিরোধীও যেমন নয় তেমনি তা তাঁদের খেলাফতের বিষয়টিকেও প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণ করে না। এ কারণে কেউই সেগুলো তাঁদের খেলাফতের জন্য প্রমাণ হিসেবে আনেন নি,এমন কি তাঁরা নিজেরাও সাকীফায়৩৫৯ বা খলীফা নির্বাচনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় উপরোক্ত হাদীসসমূহের ওপর নির্ভর করেন নি৩৬০

ওয়াসসালাম

তেপান্নতম পত্র

১৬ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

হাদীসে গাদীরের বিবরণ পেশের আহবান।

আপনি অনেক স্থানেই গাদীরের হাদীসের কথা উল্লেখ করেছেন। আহলে সুন্নাহর সূত্রে হাদীসটি আমার জন্য বর্ণনা করুন যাতে বিষয়টি নিয়ে আমি চিন্তা করতে পারি।

ওয়াসসালাম

চুয়ান্নতম পত্র

১৮ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

গাদীরের হাদীসের কিছু অংশের প্রতি ইঙ্গিত

তাবরানী ও অনেকেই যাইদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণিত এ হাদীসটির বিশুদ্ধতার বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।৩৬১ তিনি বর্ণনা করেছেন,নবী করিম (সা.) গাদীরে খুম নামক স্থানে একটি বৃক্ষের নীচে একটি খুতবা পাঠ করেন যা এরূপ : হে লোকসকল! খুব শীঘ্রই আমি আমার প্রভুর পক্ষ হতে দাওয়াত পাব এবং আমি তা গ্রহণ করবো৩৬২ । আমি দায়িত্বশীল এবং এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হব৩৬৩ এবং তোমরাও দায়িত্বশীল ও তোমাদের দায়িত্বের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে৩৬৪ তখন তোমরা আমার বিষয়ে কি বলবে? সকলে বলল, আপনি আপনার ওপর আরোপিত রেসালতের দায়িত্ব পালন করেছেন,জিহাদ করেছেন,উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করুন। রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা কি এ সাক্ষ্য প্রদান কর না,আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই ও মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও রাসূল,বেহেশত-দোযখ,মৃত্যু,মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সবই সত্য? তোমরা মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও কিয়ামতের বিষয়ে কি বিশ্বাস স্থাপন কর নি? তারা বলল, হ্যাঁ,আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। ৩৬৫

অতঃপর মহানবী (সা.) বলেন, হে আল্লাহ্! আপনি সাক্ষী থাকুন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করেন, হে লোকসকল! আল্লাহ্ আমার মাওলা ও অভিভাবক এবং আমি মুমিনদের অভিভাবক হিসেবে তাদের নিজেদের অপেক্ষা তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি। ৩৬৬

 فمن كنت مولاه فهذا مولاه  يعنى عليّا اللّهم وال من والاه و عاد من عاداه 

সুতরাং জেনে রাখ আমি যার মাওলা বা অভিভাবক এই ব্যক্তি (আলীও) তার মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে আর তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করুন যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে।

হে লোকসকল! আমি তোমাদের পূর্বেই হাউজে কাওসারে উপস্থিত হব তোমরা হাউজের নিকট আমাকে পাবে। এ হাউজ বসরা হতে সানআ র দূরত্ব হতেও দীর্ঘ এবং এর তীরে আকাশের তারকারাজির সংখ্যার মত রৌপ্য পাত্রসমূহ থাকবে। যখন তোমরা এ হাউজে আমার নিকট আসবে তোমাদের আমি দু টি ভারী বস্তু (কোরআন ও আমার আহলে বাইত) সম্পর্কে প্রশ্ন করব যে,এ দু য়ের সাথে তোমরা কিরূপ আচরণ করেছ। প্রথম ভারী বস্তু আল্লাহর কিতাব যার এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্ত তোমাদের হাতে যা দ্বারা এটি আঁকড়ে ধরবে যাতে করে বিচ্যুত এবং পরিবর্তিত (আমার পরে) না হয়ে যাও এবং দ্বিতীয় ভারী বস্তু আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত যাদের সম্পর্কে সূক্ষ্মদর্শী পরম জ্ঞানী আল্লাহ্ আমাকে জানিয়েছেন এ দু টি ভারী বস্তু হাউজে আমার সঙ্গে মিলিত হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না। ৩৬৭

হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১০৯ পৃষ্ঠায় হযরত আলী (আ.)-এর মানাকিব বর্ণনায় যাইদ ইবনে আরকাম হতে দু টি সূত্রে (যা বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ বলে পরিগণিত) হাদীসটি উল্লেখ করেছেন, যখন রাসূল (সা.) বিদায় হজ্ব হতে ফিরে আসছিলেন তখন গাদীরে খুম নামক স্থানে থামলেন। একটি বৃক্ষের নীচে উঁচু মঞ্চ প্রস্তুত করা হলো। তিনি তার ওপর দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বললেন : আমি আমার প্রভুর পক্ষ হতে আহবায়িত হয়েছি এবং তা গ্রহণ করেছি। আমি তোমাদের মাঝে দু টি মূল্যবান বস্তু রেখে যাচ্ছি যার একটি অপরটি হতে বৃহৎ,তার একটি হলো আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি আমার আহলে বাইত। এ দু বস্তুর সঙ্গে তোমরা কিরূপ আচরণ করবে? এরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না যতক্ষণ না হাউজে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। আল্লাহ্ আমার মাওলা ও অভিভাবক এবং আমি মুমিনদের মাওলা। অতঃপর রাসূল (সা.) আলীর হাত ধরে ঘোষণা করলেন :من كنت مولاه فهذا وليّه আমি যার মাওলা এও (আলীও) তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে এবং তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করুন যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে।

হাদীসটি বেশ দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও হাকিম পুরোটিই বর্ণনা করেছেন কিন্তু যাহাবী তাঁর তালখিস গ্রন্থে শেষ অংশ বর্ণনা করেন নি। হাকিম উক্ত গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ৫৩৩ পৃষ্ঠায় যাইদ ইবনে আরকাম হতে দ্বিতীয় বারের মত হাদীসটি বর্ণনা করে একে বিশুদ্ধ বলেছেন। যাহাবী তাঁর তালখিস গ্রন্থেও এ সত্যটি স্বীকার করেছেন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল যাইদ ইবনে আরকাম৩৬৮ হতে বর্ণনা করেছেন, আমরা রাসূলের সঙ্গে এক উপত্যকায় উপস্থিত হলাম যাকে গাদীরে খুম বলা হত। সেখানে একটি বৃক্ষের সঙ্গে কাপড় ঝুলিয়ে ছায়া সৃষ্টি করা হলে নবী তার নীচে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলেন : তোমরা কি জান না এবং সাক্ষ্য দিবে না,আমি মুমিনদের ওপর তাদের হতে অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী? সবাই বলল : হ্যাঁ। অতএব,আমি যার ওপর ক্ষমতার অধিকারী (মাওলা) আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে এবং তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করুন যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে।

নাসায়ী যাইদ ইবনে আরকাম৩৬৯ হতে বর্ণনা করেছেন, যখন নবী (সা.) বিদায় হজ্ব হতে ফিরে আসছিলেন তখন গাদীরে খুম নামক স্থানে অবতরণ করলেন ও একটি বৃক্ষের তলা পরিষ্কার করার আদেশ দিলেন। অতঃপর তিনি বললেন : আমি আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত পেয়ে তা গ্রহণ করেছি। আমি তোমাদের মাঝে দু টি মূল্যবান ও ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি যার একটি অপরটি হতে বৃহৎ;আল্লাহর কিতাব এবং আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত। আমার আহলে বাইতের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে সতর্ক হও কারণ তারা একে অপর হতে বিচ্ছিন্ন হবে না যতক্ষণ না হাউজে কাউসারে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। অতঃপর বললেন : আল্লাহ্ আমার মাওলা (অভিভাবক) ও আমি মুমিনদেরও মাওলা (অভিভাবক) এবং আলীর হাত (উঁচু করে) ধরে বললেন : আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে এবং শত্রুতা করুন তার সঙ্গে যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা করে।

আবু তুফাইল বলেন, আমি যাইদকে প্রশ্ন করলাম : আপনি কি রাসূল (সা.) হতে এটি শুনেছেন?৩৭০ তিনি বললেন : ঐ বৃক্ষের নীচে এমন কোন ব্যক্তি ছিল না যে তার চক্ষু দিয়ে তা দেখে নি এবং কর্ণ দিয়ে তা শ্রবণ করে নি।

এ হাদীসটি মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে যাইদ ইবনে আরকাম হতে কয়েকটি সূত্রে বর্ণনা করেছেন কিন্তু আহলে সুন্নাহর অন্যান্য হাদীসবেত্তার মত হাদীসটির শেষ অংশ কেটে বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্ত করেছেন।৩৭১

আহমাদ ইবনে হাম্বল বাররা ইবনে আযেব৩৭২ হতে দু টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন, আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে হজ্ব হতে প্রত্যাবর্তনের সময় গাদীরে খুমে যাত্রা বিরতি করলাম। আহবানকারী আহবান করে জানাল : নামাযের জামায়াত। নবী (সা.)-এর জন্য বৃক্ষের নীচে ব্যবস্থা করা হলে তিনি যোহর নামায পড়ালেন ও অতঃপর আলীর হাত ধারণ করে ঘোষণা করলেন : তোমরা কি অবগত নও আমি মুমিনদের নিজেদের হতে তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি। সকলে বলল : হ্যাঁ। অতঃপর আলীর হাত উঁচু করে ধরে বললেন : আমি যার মাওলা এই আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আপনি তাকে ভালবাসুন যে আলীকে ভালবাসে এবং তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করুন যে আলীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে। তখন হযরত উমর আলীর নিকট এসে বললেন : মোবারকবাদ হে আলী ইবনে আবি তালিব! এখন হতে আপনি সকল মুমিন পুরুষ ও নারীর অভিভাবক হলেন।

নাসায়ী আয়েশা বিনতে সা৩৭৩ হতে বর্ণনা করেছেন, আমার পিতা হতে শুনেছি জোহফার দিনে নবী (সা.) আলীর হস্তধারণ করতঃ নিম্নোক্ত ভাষণ প্রদান করেন যাতে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে তিনি বলেন : হে লোকসকল! আমি কি তোমাদের অভিভাবক? লোকেরা বলল : অবশ্যই। অতঃপর আলীর হাত উঁচু করে ধরে বললেন : সে আমার স্থলাভিষিক্ত,সে আমার ঋণ পরিশোধ করবে। আমি তার বন্ধুদের প্রতি ভালবাসা পোষণ করি ও তার শত্রুদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করি।

নাসায়ী তাঁর খাসায়েস গ্রন্থের ২৫ পৃষ্ঠায় সা দ হতে বর্ণনা করেছেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। যখন গাদীরে খুমে পৌঁছলাম তিনি যাত্রা বিরতির নির্দেশ দিয়ে বললেন : যারা আগে চলে গিয়েছে তাদের এখানে প্রত্যাবর্তন করতে বল। যখন পশ্চাতগামীরা এসে মিলিত হলো তখন তিনি প্রশ্ন করলেন (জনতার উদ্দেশ্যে) : তোমাদের নেতা কে? সকলে বলল : আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল। তিনি তখন আলীর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে ঘোষণা করলেন : আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যার নেতা ও অভিভাবক এই আলীও তার নেতা ও অভিভাবক। হে আল্লাহ্! আপনি আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণকারীকে ভালবাসুন এবং তার প্রতি শত্রুতা পোষণকারীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করুন।

এ বিষয়ে এত অধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে তা এখানে উল্লেখের সুযোগ নেই। এ হাদীসগুলোতে সুস্পষ্টরূপে আলীর স্থলাভিষিক্ত হবার বিষয়টি ঘোষিত হয়েছে। তাই আলী-ই মুসলমানদের ওপর রাসূল (সা.)-এর পর দায়িত্বশীল যেমনটি ফযল ইবনে আব্বাস ইবনে আবু লাহাব বলেছেন,

و كان وليّ العهد بعد محمّد

عليّ و في كلّ المواطن صاحبه

   মুহাম্মদের পর স্থলাভিষিক্ত হলেন তিনি 

     আলী,রাসূলের সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিলেন যিনি।৩৭৪

ওয়াসসালাম

পঞ্চান্নতম পত্র

১৯ মুহররম ১৩৩০ হিঃ

মুতাওয়াতির না হলে কিরূপে ঐ হাদীসকে এর দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে?

স্বয়ং শিয়ারা বিশ্বাস করে ইমামত প্রমাণের জন্য অবশ্যই হাদীস মুতাওয়াতির হতে হবে কারণ তাদের মতে ইমামত উসূলে দীন বা ধর্মের মৌল বিষয়ের অন্তর্গত। হাদীসটি যেহেতু আহলে সুন্নাহর নিকট মুতাওয়াতির নয় সুতরাং প্রমাণ হিসেবে এ হাদীসের উপস্থাপন গ্রহণযোগ্য নয় যদিও তার সনদ সহীহ হয়ে থাকে।

ওয়াসসালাম

চৌত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   যেদিন আলী (আ.)-এর পুত্রদের শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির বলেছেন।

২।   ভ্রাতৃবন্ধনের দিন।

৩।   মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারসমূহ রুদ্ধ করার দিন।

রাসূল (সা.)-এর জীবনী অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে দেখবেন তিনি আলী ও হারুন (আ.)-কে আসমানের দুই যুগ্ম তারকা ও মানবদেহের দুই চোখের সাথে তুলনা করেছেন। এ দুই উম্মতের মধ্যে তাঁদের থেকে অন্য কেউই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না।

১। আর এজন্যই তিনি চান নি আলী (আ.)-এর সন্তানদের নাম হারুনের সন্তানদের হতে ভিন্ন কিছু হোক। এজন্য তাঁদের হাসান,হুসাইন ও মুহসিন২৬৪ নাম রেখেছেন ও বলেছেন, তাদের নাম হারুনের সন্তানদের সহনামে রাখলাম কারণ তাদের (হারুনের সন্তানদের নাম) শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির ছিল। রাসূল (সা.) তাঁর এই কর্মের মাধ্যমে এ দুই হারুনের মধ্যের মিলকে তুলে ধরে সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বজনীনতা দান করতে চেয়েছিলেন।

২। এজন্যই আলী (আ.)-কে নিজের ভাই হিসেবে মনোনীত করে অন্যদের ওপর হারুনের প্রাধান্যের সর্বজনীনতার বিষয়টিকে উল্লেখ করার মাধ্যমে বিষয়টিকে তাকীদ দিয়েছেন। যে দু বার ভ্রাতৃত্বের আকদ পাঠ করা হয় দু বারই তিনি আগ্রহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করুক। এজন্য প্রথম আকদের সময় সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু বকরকে হযরত উমরের সাথে,হযরত উসমানকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের সাথে ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টি করলেও দ্বিতীয় আকদের সময় হযরত আবু বকরকে খারাজা ইবনে যাইদের ভ্রাতা এবং হযরত উমরকে উতবান ইবনে মালিকের ভ্রাতা মনোনীত করেন। অথচ উভয় আকদেই আলীকে নিজের ভ্রাতা বলে মনোনীত ও ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে (যার অধিকাংশই সহীহ) তার উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়।

এজন্য ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর,যাইদ ইবনে আরকাম,যাইদ ইবনে আবি আউফি,আনাস ইবনে মালিক,হুজাইফা ইবনে ইয়ামান,মুখদাজ ইবনে ইয়াযীদ,উমর ইবনে খাত্তাব,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ লক্ষ্য করুন।

মহানবী (সা.) হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন,أنت أخي في الدّنيا و الآخرة অর্থাৎ তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ভাই।২৬৫ আমরা আমাদের বিংশতম পত্রে বর্ণনা করেছি রাসূল (সা.) আলীর স্কন্ধে হাত রেখে বললেন, এ আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত ও তোমাদের মাঝে আমার প্রতিনিধি,তার কথা শুনবে ও তার আনুগত্য করবে।

একদিন রাসূল (সা.) হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাসূলকে তাঁর আনন্দের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূল উত্তরে বললেন, আমার ভাই ও পিতৃব্যপুত্র এবং আমার কন্যার ব্যাপার আমার প্রভুর পক্ষ হতে আমার নিকট সুসংবাদ এসেছে যে,মহান আল্লাহ্ ফাতিমাকে আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন...। সাওয়ায়েক গ্রন্থের ১০৩ পৃষ্ঠায় আবু বকর খাওয়ারেজমী সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

যখন নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতিমার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পুরুষ আলী (আ.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হলো তখন নবী (সা.) উম্মে আইমানকে বললেন, আমার ভ্রাতাকে ডাক। উম্মে আইমান বললেন, তিনি আপনার ভ্রাতা এবং আপনি তাঁকে নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিচ্ছেন? রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ,উম্মে আইমান। অতঃপর তিনি আলীকে ডেকে আনলেন।২৬৬

মহানবী (সা.) বারবার আলীর প্রতি ইশারা করে বলতেন,

هذا أخي و ابن عمّي و صهري و أبو ولدي

অর্থাৎ এ আমার ভাই,আমার চাচার পুত্র,আমার জামাতা ও আমার সন্তানদের পিতা।২৬৭

একদিন রাসূল (সা.) আলীর সঙ্গে আলোচনা করার সময় বললেন, তুমি আমার ভাই ও বন্ধু। ২৬৮ অন্য একবার তিনি বলেন, তুমি আমার ভ্রাতা এবং বেহেশতে বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে থাকবে। ২৬৯ অন্য একদিন আলী,তদীয় ভ্রাতা জা ফর এবং যাইদ ইবনে হারিসার মধ্যে কোন একটি ঘটনায় তাঁকে লক্ষ্য করে রাসূল (সা.) বলেন, হে আলী! তুমি আমার ভ্রাতা,আমার বংশধরদের পিতা,তুমি আমার হতে এবং আমার প্রতিই তোমার প্রত্যাবর্তন। ২৭০  

অনুরূপ এক দিন আলীকে উপদেশ দিয়ে বললেন, তুমি আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে,আমার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করবে। ২৭১ যখন তাঁর (আমার মাতাপিতা তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত) মৃত্যুকাল উপস্থিত হলো তখন মহানবী বললেন, আমার ভাইকে ডাক। হযরত আলী (আ.) আসলে বললেন, আমার নিকটে আস। তিনি তাঁর নিকটবর্তী হয়ে তাঁর পবিত্র মাথা নিজের বুকের ওপর টেনে নিলেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) তাঁকে অনেক কথা বললেন এবং কথা বলতে বলতেই তাঁর পবিত্র আত্মা দেহ হতে ঊর্ধ্বে যাত্রা করল২৭২ এবং তাঁর বর্ণিত কথাগুলোর একটি হলো : বেহেশতের দ্বারে নিম্নোক্ত কথাটি লেখা রয়েছে-

 لا إله إلّا الله مُحمّد رّسول الله عليّ أخو رسول الله

অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই মুহাম্মদ তাঁর রাসূল আলী রাসূলের ভ্রাতা।২৭৩

মহান আল্লাহ্ লাইলাতুল মাবি তে (অর্থাৎ হিজরতের রাত্রি যে রাত্রিতে হযরত আলী রাসূলের বিছানায় তাঁর স্থানে রাসূলের প্রাণ রক্ষার জন্য শয়ন করেছিলেন) হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.)-কে বললেন, আমি তোমাদের দু জনের মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করলাম এবং তোমাদের একজনকে অন্যজন অপেক্ষা দীর্ঘজীবন দান করতে চাই। তোমাদের মধ্যে কে রাজী আছো তার জীবন সংক্ষিপ্ত ও অন্যজনের জীবন দীর্ঘ হোক। তাঁরা দু জনই নিজ জীবনের দীর্ঘতা চাইলেন। তখন মহান আল্লাহ্ তাঁদেরকে ওহী প্রেরণ করে বললেন, তোমরা আলী ইবনে আবি তালিবের মত হতে পারবে না। আমি মুহাম্মদ ও আলীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছি। আলী মুহাম্মদের বিছানায় শয়ন করেছে যাতে নিজেকে তার জন্য উৎসর্গ করতে পারে এবং এভাবে তার জীবনকে নিজের জীবনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তোমরা পৃথিবীতে নেমে যাও এবং তার জীবন রক্ষা কর। তাঁরা পৃথিবীতে অবতরণ করলেন এবং জিবরাঈল ও মিকাঈল যথাক্রমে হযরত আলী (আ.)-এর মাথা ও পায়ের নিকট অবস্থান নিলেন। হযরত জিবরাঈল আহবান করে বললেন, বাহ! বাহ! হে আবু তালিবের পুত্র! তোমাকে নিয়ে আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করছেন। এ ঘটনার পটভূমিতেই নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ(

এবং মানুষের মাঝে এমন লোক আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে বাজী রাখে আর মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।২৭৪ (সূরা বাকারা : ২০৭)

হযরত আলী (আ.) সব সময় বলতেন, আমি আল্লাহর বান্দা,রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা এবং আমিই সিদ্দীকে আকবর। আমি ব্যতীত অন্য কেউ এ দাবী করলে সে মিথ্যাবাদী বৈ কিছু নয়। ২৭৫

হযরত আলী (আ.) আরো বলেছেন, আল্লাহর শপথ,আমি রাসূলের ভ্রাতা,তাঁর চাচার সন্তান ও তাঁর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী,তাই তাঁর কাছে আমা হতে কে অধিকতর যোগ্য? ২৭৬ তৃতীয় খলীফা নির্বাচনের দিন শুরার সদস্য উসমান,আবদুর রহমান,সা দ ও যুবাইরের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের কসম দিয়ে বলছি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের দিন রাসূল (সা.) আমাকে ব্যতীত তোমাদের মধ্য হতে কাউকেই কি নিজের ভ্রাতা হিসেবে মনোনীত করেছেন? তাঁরা বললেন, আল্লাহ্ জানেন,না। ২৭৭

বদরের যুদ্ধে যখন আলী (আ.) ওয়ালিদের মুখোমুখি হন তখন ওয়ালিদ তাঁকে প্রশ্ন করে, কে তুমি? আলী (আ.) বলেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের ভ্রাতা। ২৭৮

অনুরূপ একবার হযরত উমরের খিলাফতের সময় আলী (আ.) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, যদি বনি ইসরাঈলের একজন লোক আপনার নিকট আসে ও তাদের একজন বলে : আমি মূসা (আ.)-এর চাচাত ভাই তবে অন্যান্যদের ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন কি? হযরত উমর বললেন, অবশ্যই। আলী বললেন, আমি খোদার কসম করে বলছি আমি রাসূলের ভ্রাতা ও চাচাত ভাই। হযরত উমর নিজের গায়ের চাদর খুলে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন ও আল্লাহর শপথ করে বললেন, আপনি অবশ্যই এর ওপর বসবেন যতক্ষণ না আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। রাসূলের  ভ্রাতা ও চাচাত ভাই হবার কারণেই হযরত উমর তাঁর প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন করেন।২৭৯

৩। আমার কলম আমার এখতিয়ারের বাইরে চলে গিয়েছিল। যা হোক রাসূল (সা.) মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা এবং অন্যায় ও অপবিত্রতা হতে মসজিদ মুক্ত রাখার নিমিত্তে যেসকল সাহাবীর ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন কিন্তু হযরত আলীর ঘরকে পূর্বের মত খোলা রাখেন ও আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত হয়ে আলী (আ.)-এর জন্য অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ মুবাহ ঘোষণা করেন যেমনটি হযরত হারুন (আ.)-এর জন্যও ছিল। এ বিষয়েও আলী ও হযরত হারুন (আ.)-এর মধ্যে আমরা সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যে সকল ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত সেগুলোকে বন্ধ করে দেন আলীর ঘর ব্যতীত। আলী ঐ পথেই মসজিদে প্রবেশ ও অতিক্রম করতেন। যেহেতু ঐ পথ ব্যতীত অন্য পথ ছিল না তাই অপবিত্র অবস্থাতেও সে পথেই বের হতেন। ২৮০

বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ২৮১ একটি হাদীসানুযায়ী হযরত উমর ইবনে খাত্তাব বলেন, আলীকে তিনটি বস্তু দান করা হয়েছে,এর একটি যদি আমার হত তবে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ (লাল চুলের উষ্ট্র) হতে তা আমার নিকট উত্তম বলে পরিগণিত হত। তাঁর স্ত্রী রাসূলের কন্যা। তাঁর ঘর রাসূলের ঘর ও মসজিদ সংলগ্ন ছিল;সেখানে রাসূলের জন্য যা হালাল ছিল তা তাঁর জন্যও হালাল ছিল এবং খায়বারের দিন রাসূল তাঁর হাতেই পতাকা তুলে দেন। অন্য একটি সহীহ হাদীস মতে একদিন সা দ ইবনে মালিক আলী (আ.)-এর কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস ও অন্যান্যদের মসজিদ হতে বাইরে যাবার নির্দেশ দিলে আব্বাস বললেন : আমাদের বের হতে বলছ অথচ আলীকে কাছে রেখেছ? রাসূল বললেন : আমি তোমাদের বের হতে বা তাকে থাকার নির্দেশ দেই নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বাইরে যেতে ও তাকে এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮২

হযরত যাইদ ইবনে আরকাম বলেন, রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবীরই দরজা মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল ও তাঁরা সে পথে বাইরে যেতেন। রাসূল (সা.) আলীর গৃহ ব্যতীত অন্য সকল গৃহের দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা এ বিষয়ে কথা উঠালে রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে বললেন : আমিই মসজিদের দিকে উন্মুক্ত সকল দ্বারকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি আলীর দ্বার ব্যতীত এবং আমি এরূপ করতে নির্দেশিত হয়েই তা করেছি। ২৮৩

তাবরানী তাঁর আল কাবীর গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) একদিন মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন : আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাদের মসজিদ হতে বের হবার নির্দেশ দান করি নি এবং তাকে (আলী)-ও অবস্থান করতে বলি নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বের হতে ও তাকে এখানে অবস্থান করতে বলেছেন। আমি বান্দা হিসেবে তাঁর নির্দেশ পালনকারী মাত্র। ওহীর মাধ্যমে যা আমাকে নির্দেশ দান করা হয় তা ব্যতীত আমি অন্য কিছু করি না। ২৮৪

রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তুমি ও আমি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে বৈধ নয় অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করা। ২৮৫

সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আজেব,ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর ও হুজাইফা ইবনে উসাইদ গাফফারী সকলেই বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) মসজিদে আসলেন ও বললেন : মহান আল্লাহ্ মূসাকে ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্য পবিত্র মসজিদ নির্মাণ কর এবং সেখানে তুমি ও হারুন ব্যতীত কেউ যেন সর্বাবস্থায় অবস্থান না করে। তিনি আমাকেও নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র মসজিদ নির্মাণের সেখানে যেন আমি ও আমার ভাই আলী ব্যতীত অন্য কেউ অবস্থান (সর্বাবস্থায়) না করে। ২৮৬

আমাদের এ ক্ষুদ্র লেখায় এ সম্পর্কিত সকল হাদীস ও রেওয়ায়েত একত্রিত করা সম্ভব নয়। এমন কি নির্ভরযোগ্য যে সকল বর্ণনা ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,যাইদ ইবনে আরকাম,আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হুজাইফা ইবনে উসাইদ,সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব,উমর ইবনে খাত্তাব,আবু যর,আবু তুফাইল,বুরাইদা আসলামী,আবু রাফে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কৃতদাস,জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী ও অন্যান্যদের হতে এসেছে তাও লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব।

রাসূল (সা.) হতে একটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা এরূপ- হে আল্লাহ! আমার ভ্রাতা মূসা আপনার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষকে প্রসারিত করে দিন ও আমার জন্য আমার কাজকে সহজ করে দিন। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন যাতে করে জনগণ আমার কথা বুঝতে পারে। আমার পরিবার হতে আমার ভ্রাতা হারুনকে আমার সহযোগী মনোনীত করুন। তার মাধ্যমে আমার মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করুন ও আমার কাজে তাকে সহযোগী করুন। আপনি তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেছিলেন : অতিশীঘ্রই তোমার ভ্রাতার মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমি শক্তিশালী করবো ও তোমাদের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করবো।

হে পরওয়ারদিগার! আমি মুহাম্মদ আপনার বান্দা ও রাসূল। আমার বক্ষকে আপনি প্রসারিত করুন। আমার কর্মকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আমার পরিবার হতে আমাকে একজন সহযোগী দান করুন এবং সে হলো আলী।২৮৭

বাযযার অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেখানে নবী (সা.) আলী (আ.)-এর হাত ধরে বললেন, হযরত মূসা আল্লাহর নিকট চেয়েছিলেন যেন হযরত হারুনের মাধ্যমে তাঁর মসজিদকে পবিত্র রাখেন এবং আমি তাঁর নিকট আলীর মাধ্যমে আমার মসজিদ পবিত্র রাখার প্রার্থনা করছি। অতঃপর একজনকে হযরত আবু বকরের নিকট পাঠালেন যেন তাঁর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারটি বন্ধ করে দেন। তিনি বললেন, শুনলাম ও মেনে নিলাম। অতঃপর একে একে হযরত উমর,হযরত আব্বাসসহ সকল সাহাবীর নিকট এ নির্দেশ পাঠালেন। অতঃপর বললেন, আমি তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করি নি বা আলীর দ্বার উন্মুক্ত রাখি নি,বরং আল্লাহ্ই আলীর দ্বার উন্মুক্ত করেছেন ও তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করেছেন। ২৮৮

হযরত আলী (আ.)-এর হযরত হারুনের সঙ্গে সাদৃশ্যের প্রমাণ হিসেবে এতটুকু আলোচনাই যথেষ্ট মনে করছি যেখানে তাঁদের পদমর্যাদা ও সম্মানের সর্বজনীনতা প্রমাণিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

পঁয়ত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

অন্যান্য রেওয়ায়েতগুলোও উল্লেখ করার আহবান।

আল্লাহ্ আপনার পিতাকে রহম করুন। এই আয়াতসমূহ ও হাদীসের দলিলগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং আপনার বর্ণনাও প্রাঞ্জল ও সাহিত্য মানসম্পন্ন। তাই অন্যান্য বর্ণনাসমূহও শোনার ও জানার আগ্রহ ব্যক্ত করছি। মুতাওয়াতির২৮৯ (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো আনুন। আপনার শেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুন।

ওয়াসসালাম

ছত্রিশতম পত্র

২৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস।

২।   ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণিত হাদীস।

৩।   বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস।

৪।   যে হাদীসে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

৫।   আলী বর্ণিত হাদীস।

৬। ওয়াহাবের হাদীস।

৭।   ইবনে আবি আছেমের হাদীস।

১। এ বিষয়ে ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলীর জীবনীতে আবু দাউদ তাইয়ালেসী সূত্রে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসটিই যথেষ্ট। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূল (সা.) আলীকে লক্ষ্য করে বললেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিনের অভিভাবক।

২। উপরোক্ত হাদীসের মত আরেকটি সহীহ হাদীস ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) একদল লোককে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন ও আলীকে সেনানায়ক নিযুক্ত করলেন। যুদ্ধ জয়ের পর আলী (আ.) খুমস হতে একটি ক্রীতদাসী নিজের জন্য গ্রহণ করলে সাধারণ সৈন্যরা এর প্রতিবাদ করল। তাদের চারজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো এ বিষয়ে রাসূলের নিকট অভিযোগ করতে। যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর এ চারজনের একজন রাসূলের নিকট অভিযোগ করে বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি শুনেছেন আলী এরূপ এরূপ করেছে? নবী (সা.) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তিও দাঁড়িয়ে একই অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তৃতীয় ব্যক্তিও প্রথম দু জনের মত অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন চতুর্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে চতুর্থবারের মত অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করলে রাসূল (সা.) তাদের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন : তোমরা আলী হতে কি চাও? আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আলী আমার পর সকল মুমিনের ওয়ালী (অভিভাবক)। ২৯০

৩। অনুরূপ বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস যা মুসনাদে আহমাদের ৫ম খণ্ডের ৩৫৬ পৃষ্ঠায় এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে দু দল সেনা প্রেরণ করেন। তাদের একদলের নেতৃত্ব আলী ইবনে আবি তালিবের হাতে ও অন্যদলের নেতৃত্ব খালিদ ইবনে ওয়ালিদের হাতে ন্যস্ত করেন। নবী দু দলের উদ্দেশ্যে বললেন : যখন তোমরা দু দল একত্রে মিলিত হবে তখন আলী একক সেনাপতি হবে।২৯১ আর যদি মিলিত হতে না পার তবে সেনানায়ক ভিন্ন থাকবে।

বুরাইদাহ্ বলেন, ইয়েমেনের বনি যুবাইদা গোত্রের সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে আমরা জয়ী হই এবং অনেককেই বন্দী করতে সক্ষম হই। আলী তাদের মধ্যে এক নারীকে নিজের জন্য মনোনীত করেন।

বুরাইদাহ্ বলেন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ একটি পত্রে ঘটনার বর্ণনা লিখে আমার হাতে দিয়ে রাসূলের নিকট পৌঁছাতে বললেন। যখন পত্রটি নিয়ে রাসূলের নিকট গিয়ে পাঠ করলাম তখন তাঁর চেহারা রাগে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এখানে আশ্রয়ের কেন্দ্র,আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে এক ব্যক্তির অধীনে প্রেরণ ও তার নির্দেশ পালন করতে বলেছেন। তাই তার নির্দেশে এ পত্র বহন করে এনেছি। রাসূল (সা.) বললেন : আলীর বিষয়ে মন্দ বলো না। কেননা আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক ও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। ২৯২  

নাসায়ী তাঁর খাসায়িসুল আলাভীয়া গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন-

لا تبغضنّ يا بريدة فإنّ عليّا منّي و أنا منه و هو وليّكم بعدي

অর্থাৎ হে বুরাইদাহ্! যাতে আমি আলীর ওপর রাগান্বিত হই এমন কাজ কর না,কারণ আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।

ইবনে জারির২৯৩ বুরাইদাহ্ হতে এভাবে বর্ণনা করেছেন, রাসূলের চেহারা অকস্মাৎ রক্তিম হয়ে গেল এবং তিনি বললেন :من كنت وليّه عليّ وليّه অর্থাৎ আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

বুরাইদাহ্ বলেন, যা আমার মনে ছিল সব ভুলে গেলাম। মনে মনে বললাম আলীর বিষয়ে আর কখনো মন্দ বলব না।

তাবরানী এ হাদীসটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় এসেছে- যখন বুরাইদাহ্ ইয়েমেন হতে ফিরে মসজিদে গেলেন তখন তিনি দেখলেন কিছু সংখ্যক সাহাবী নবী (সা.)-এর ঘরের সামনে বসে রয়েছেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সালাম দিলে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সফরের খবর কি? তিনি বললেন, উত্তম। আল্লাহ্ মুসলমানদের বিজয় দান করেছেন। তাঁরা বললেন, কেন অন্যদের পূর্বেই ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, আলী নিজের জন্য একজন দাসী খুমসের অংশ থেকে নিয়েছে। তাই আমি নবীকে এ খবর দিতে এসেছি যাতে করে সে নবী (সা.)-এর সুনজর হতে বঞ্চিত হয়। নবী (সা.) ঘরের মধ্য হতে একথা শুনে রাগান্বিত হয়ে বাইরে আসলেন ও বললেন, কেন একদল আলীর বিষয়ে মন্দ বলে? তাদের উদ্দেশ্য কি? যে কেউ আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে। যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হয়,সে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়। আলী আমা হতে,সে আমার মাটি হতেই সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি ইবরাহীমের মাটি হতে। আমি ইবরাহীম হতে উত্তম।২৯৪ আমরা একই বংশের,একজন হতে অপরজনের সৃষ্টি। আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। হে বুরাইদাহ্! তুমি কি জান না,আলী যে ক্রীতদাসীটি নিয়েছে তদাপেক্ষা অনেক বেশী গণীমতের অধিকারী? তার এ অধিকার রয়েছে কারণ সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।২৯৫

এই হাদীসটি যে রাসূল হতে বর্ণিত এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই এবং বুরাইদাহ্ হতে কয়েকটি সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে যার সবগুলোই নির্ভরযোগ্য।

৪। এরূপ আরেকটি মূল্যবান হাদীস হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন যেখানে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে,তন্মধ্যে নবী (সা.) আলীকে বলেছেন, আমার পর তুমি সকল মুমিনের অভিভাবক হবে। ২৯৬

৫। আরেক স্থানে নবী (সা.) একটি হাদীসে আলী (আ.)-কে বলেছেন, হে আলী! তোমার জন্য আল্লাহর নিকট পাঁচটি বস্তু চেয়েছিলাম। তন্মধ্যে চারটি তিনি দিয়েছেন ও একটি দেন নি.। যেগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো তুমি আমার পর মুমিনদের অভিভাবক হবে। ২৯৭

৬। আল ইসাবাহ্ গ্রন্থে ওয়াহাবের পরিচিতি পর্বে ইবনে সাকান ওয়াহাব ইবনে হামযাহ্ হতে বর্ণনা করেছেন, আলীর সঙ্গে সফরে গিয়ে তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রাসূল (সা.)-এর নিকট তার বিষয়ে অভিযোগ করবো। মদীনায় ফিরে রাসূলের নিকট আলী সম্পর্কে অভিযোগ করলে রাসূল বললেন : আলীর বিষয়ে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের অভিভাবক।

তাবরানীও তাঁর কাবীর গ্রন্থে ওয়াহাব হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে রাসূলের কথাটি এভাবে এসেছে-আলী সম্পর্কে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অধিকারী।২৯৮

৭। ইবনে আবি আছেম মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন : আমি কি মুমিনদের নিজেদের হতে তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি না? সবাই বলল : অবশ্যই। তিনি বললেন : আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

এ বিষয়ে আহলে বাইতের ইমামদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির। এখানে এটুকু বর্ণনাই যথেষ্ট মনে করছি। তদুপরি বেলায়েতের আয়াতটি আমাদের দাবীর সপক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ। সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর।

ওয়াসসালাম

চৌত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   যেদিন আলী (আ.)-এর পুত্রদের শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির বলেছেন।

২।   ভ্রাতৃবন্ধনের দিন।

৩।   মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারসমূহ রুদ্ধ করার দিন।

রাসূল (সা.)-এর জীবনী অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে দেখবেন তিনি আলী ও হারুন (আ.)-কে আসমানের দুই যুগ্ম তারকা ও মানবদেহের দুই চোখের সাথে তুলনা করেছেন। এ দুই উম্মতের মধ্যে তাঁদের থেকে অন্য কেউই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না।

১। আর এজন্যই তিনি চান নি আলী (আ.)-এর সন্তানদের নাম হারুনের সন্তানদের হতে ভিন্ন কিছু হোক। এজন্য তাঁদের হাসান,হুসাইন ও মুহসিন২৬৪ নাম রেখেছেন ও বলেছেন, তাদের নাম হারুনের সন্তানদের সহনামে রাখলাম কারণ তাদের (হারুনের সন্তানদের নাম) শাব্বার,শাব্বির ও মুশবির ছিল। রাসূল (সা.) তাঁর এই কর্মের মাধ্যমে এ দুই হারুনের মধ্যের মিলকে তুলে ধরে সম্মান ও মর্যাদার ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বকে সর্বজনীনতা দান করতে চেয়েছিলেন।

২। এজন্যই আলী (আ.)-কে নিজের ভাই হিসেবে মনোনীত করে অন্যদের ওপর হারুনের প্রাধান্যের সর্বজনীনতার বিষয়টিকে উল্লেখ করার মাধ্যমে বিষয়টিকে তাকীদ দিয়েছেন। যে দু বার ভ্রাতৃত্বের আকদ পাঠ করা হয় দু বারই তিনি আগ্রহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করুক। এজন্য প্রথম আকদের সময় সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবু বকরকে হযরত উমরের সাথে,হযরত উসমানকে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফের সাথে ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টি করলেও দ্বিতীয় আকদের সময় হযরত আবু বকরকে খারাজা ইবনে যাইদের ভ্রাতা এবং হযরত উমরকে উতবান ইবনে মালিকের ভ্রাতা মনোনীত করেন। অথচ উভয় আকদেই আলীকে নিজের ভ্রাতা বলে মনোনীত ও ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছে (যার অধিকাংশই সহীহ) তার উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়।

এজন্য ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর,যাইদ ইবনে আরকাম,যাইদ ইবনে আবি আউফি,আনাস ইবনে মালিক,হুজাইফা ইবনে ইয়ামান,মুখদাজ ইবনে ইয়াযীদ,উমর ইবনে খাত্তাব,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব ও অন্যান্যদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ লক্ষ্য করুন।

মহানবী (সা.) হযরত আলীকে লক্ষ্য করে বলেছেন,أنت أخي في الدّنيا و الآخرة অর্থাৎ তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ভাই।২৬৫ আমরা আমাদের বিংশতম পত্রে বর্ণনা করেছি রাসূল (সা.) আলীর স্কন্ধে হাত রেখে বললেন, এ আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত ও তোমাদের মাঝে আমার প্রতিনিধি,তার কথা শুনবে ও তার আনুগত্য করবে।

একদিন রাসূল (সা.) হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাহাবীদের সামনে উপস্থিত হলেন। আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাসূলকে তাঁর আনন্দের কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূল উত্তরে বললেন, আমার ভাই ও পিতৃব্যপুত্র এবং আমার কন্যার ব্যাপার আমার প্রভুর পক্ষ হতে আমার নিকট সুসংবাদ এসেছে যে,মহান আল্লাহ্ ফাতিমাকে আলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন...। সাওয়ায়েক গ্রন্থের ১০৩ পৃষ্ঠায় আবু বকর খাওয়ারেজমী সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।

যখন নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতিমার সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পুরুষ আলী (আ.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হলো তখন নবী (সা.) উম্মে আইমানকে বললেন, আমার ভ্রাতাকে ডাক। উম্মে আইমান বললেন, তিনি আপনার ভ্রাতা এবং আপনি তাঁকে নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিচ্ছেন? রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ,উম্মে আইমান। অতঃপর তিনি আলীকে ডেকে আনলেন।২৬৬

মহানবী (সা.) বারবার আলীর প্রতি ইশারা করে বলতেন,

هذا أخي و ابن عمّي و صهري و أبو ولدي

অর্থাৎ এ আমার ভাই,আমার চাচার পুত্র,আমার জামাতা ও আমার সন্তানদের পিতা।২৬৭

একদিন রাসূল (সা.) আলীর সঙ্গে আলোচনা করার সময় বললেন, তুমি আমার ভাই ও বন্ধু। ২৬৮ অন্য একবার তিনি বলেন, তুমি আমার ভ্রাতা এবং বেহেশতে বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে থাকবে। ২৬৯ অন্য একদিন আলী,তদীয় ভ্রাতা জা ফর এবং যাইদ ইবনে হারিসার মধ্যে কোন একটি ঘটনায় তাঁকে লক্ষ্য করে রাসূল (সা.) বলেন, হে আলী! তুমি আমার ভ্রাতা,আমার বংশধরদের পিতা,তুমি আমার হতে এবং আমার প্রতিই তোমার প্রত্যাবর্তন। ২৭০  

অনুরূপ এক দিন আলীকে উপদেশ দিয়ে বললেন, তুমি আমার ভাই,আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আমার ঋণ পরিশোধ করবে,আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে,আমার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করবে। ২৭১ যখন তাঁর (আমার মাতাপিতা তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত) মৃত্যুকাল উপস্থিত হলো তখন মহানবী বললেন, আমার ভাইকে ডাক। হযরত আলী (আ.) আসলে বললেন, আমার নিকটে আস। তিনি তাঁর নিকটবর্তী হয়ে তাঁর পবিত্র মাথা নিজের বুকের ওপর টেনে নিলেন। এমতাবস্থায় রাসূল (সা.) তাঁকে অনেক কথা বললেন এবং কথা বলতে বলতেই তাঁর পবিত্র আত্মা দেহ হতে ঊর্ধ্বে যাত্রা করল২৭২ এবং তাঁর বর্ণিত কথাগুলোর একটি হলো : বেহেশতের দ্বারে নিম্নোক্ত কথাটি লেখা রয়েছে-

 لا إله إلّا الله مُحمّد رّسول الله عليّ أخو رسول الله

অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই মুহাম্মদ তাঁর রাসূল আলী রাসূলের ভ্রাতা।২৭৩

মহান আল্লাহ্ লাইলাতুল মাবি তে (অর্থাৎ হিজরতের রাত্রি যে রাত্রিতে হযরত আলী রাসূলের বিছানায় তাঁর স্থানে রাসূলের প্রাণ রক্ষার জন্য শয়ন করেছিলেন) হযরত জিবরাঈল ও মিকাঈল (আ.)-কে বললেন, আমি তোমাদের দু জনের মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করলাম এবং তোমাদের একজনকে অন্যজন অপেক্ষা দীর্ঘজীবন দান করতে চাই। তোমাদের মধ্যে কে রাজী আছো তার জীবন সংক্ষিপ্ত ও অন্যজনের জীবন দীর্ঘ হোক। তাঁরা দু জনই নিজ জীবনের দীর্ঘতা চাইলেন। তখন মহান আল্লাহ্ তাঁদেরকে ওহী প্রেরণ করে বললেন, তোমরা আলী ইবনে আবি তালিবের মত হতে পারবে না। আমি মুহাম্মদ ও আলীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছি। আলী মুহাম্মদের বিছানায় শয়ন করেছে যাতে নিজেকে তার জন্য উৎসর্গ করতে পারে এবং এভাবে তার জীবনকে নিজের জীবনের ওপর প্রাধান্য দিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তোমরা পৃথিবীতে নেমে যাও এবং তার জীবন রক্ষা কর। তাঁরা পৃথিবীতে অবতরণ করলেন এবং জিবরাঈল ও মিকাঈল যথাক্রমে হযরত আলী (আ.)-এর মাথা ও পায়ের নিকট অবস্থান নিলেন। হযরত জিবরাঈল আহবান করে বললেন, বাহ! বাহ! হে আবু তালিবের পুত্র! তোমাকে নিয়ে আল্লাহ্ ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করছেন। এ ঘটনার পটভূমিতেই নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে-

) وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ(

এবং মানুষের মাঝে এমন লোক আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে বাজী রাখে আর মহান আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।২৭৪ (সূরা বাকারা : ২০৭)

হযরত আলী (আ.) সব সময় বলতেন, আমি আল্লাহর বান্দা,রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা এবং আমিই সিদ্দীকে আকবর। আমি ব্যতীত অন্য কেউ এ দাবী করলে সে মিথ্যাবাদী বৈ কিছু নয়। ২৭৫

হযরত আলী (আ.) আরো বলেছেন, আল্লাহর শপথ,আমি রাসূলের ভ্রাতা,তাঁর চাচার সন্তান ও তাঁর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী,তাই তাঁর কাছে আমা হতে কে অধিকতর যোগ্য? ২৭৬ তৃতীয় খলীফা নির্বাচনের দিন শুরার সদস্য উসমান,আবদুর রহমান,সা দ ও যুবাইরের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের কসম দিয়ে বলছি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের দিন রাসূল (সা.) আমাকে ব্যতীত তোমাদের মধ্য হতে কাউকেই কি নিজের ভ্রাতা হিসেবে মনোনীত করেছেন? তাঁরা বললেন, আল্লাহ্ জানেন,না। ২৭৭

বদরের যুদ্ধে যখন আলী (আ.) ওয়ালিদের মুখোমুখি হন তখন ওয়ালিদ তাঁকে প্রশ্ন করে, কে তুমি? আলী (আ.) বলেন, আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূলের ভ্রাতা। ২৭৮

অনুরূপ একবার হযরত উমরের খিলাফতের সময় আলী (আ.) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, যদি বনি ইসরাঈলের একজন লোক আপনার নিকট আসে ও তাদের একজন বলে : আমি মূসা (আ.)-এর চাচাত ভাই তবে অন্যান্যদের ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করবেন কি? হযরত উমর বললেন, অবশ্যই। আলী বললেন, আমি খোদার কসম করে বলছি আমি রাসূলের ভ্রাতা ও চাচাত ভাই। হযরত উমর নিজের গায়ের চাদর খুলে মাটিতে বিছিয়ে দিলেন ও আল্লাহর শপথ করে বললেন, আপনি অবশ্যই এর ওপর বসবেন যতক্ষণ না আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। রাসূলের  ভ্রাতা ও চাচাত ভাই হবার কারণেই হযরত উমর তাঁর প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন করেন।২৭৯

৩। আমার কলম আমার এখতিয়ারের বাইরে চলে গিয়েছিল। যা হোক রাসূল (সা.) মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা এবং অন্যায় ও অপবিত্রতা হতে মসজিদ মুক্ত রাখার নিমিত্তে যেসকল সাহাবীর ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল তা বন্ধ করার নির্দেশ দেন কিন্তু হযরত আলীর ঘরকে পূর্বের মত খোলা রাখেন ও আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত হয়ে আলী (আ.)-এর জন্য অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ মুবাহ ঘোষণা করেন যেমনটি হযরত হারুন (আ.)-এর জন্যও ছিল। এ বিষয়েও আলী ও হযরত হারুন (আ.)-এর মধ্যে আমরা সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যে সকল ঘর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত হত সেগুলোকে বন্ধ করে দেন আলীর ঘর ব্যতীত। আলী ঐ পথেই মসজিদে প্রবেশ ও অতিক্রম করতেন। যেহেতু ঐ পথ ব্যতীত অন্য পথ ছিল না তাই অপবিত্র অবস্থাতেও সে পথেই বের হতেন। ২৮০

বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ২৮১ একটি হাদীসানুযায়ী হযরত উমর ইবনে খাত্তাব বলেন, আলীকে তিনটি বস্তু দান করা হয়েছে,এর একটি যদি আমার হত তবে আরবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ (লাল চুলের উষ্ট্র) হতে তা আমার নিকট উত্তম বলে পরিগণিত হত। তাঁর স্ত্রী রাসূলের কন্যা। তাঁর ঘর রাসূলের ঘর ও মসজিদ সংলগ্ন ছিল;সেখানে রাসূলের জন্য যা হালাল ছিল তা তাঁর জন্যও হালাল ছিল এবং খায়বারের দিন রাসূল তাঁর হাতেই পতাকা তুলে দেন। অন্য একটি সহীহ হাদীস মতে একদিন সা দ ইবনে মালিক আলী (আ.)-এর কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, রাসূল (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস ও অন্যান্যদের মসজিদ হতে বাইরে যাবার নির্দেশ দিলে আব্বাস বললেন : আমাদের বের হতে বলছ অথচ আলীকে কাছে রেখেছ? রাসূল বললেন : আমি তোমাদের বের হতে বা তাকে থাকার নির্দেশ দেই নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বাইরে যেতে ও তাকে এখানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮২

হযরত যাইদ ইবনে আরকাম বলেন, রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবীরই দরজা মসজিদের দিকে উন্মুক্ত ছিল ও তাঁরা সে পথে বাইরে যেতেন। রাসূল (সা.) আলীর গৃহ ব্যতীত অন্য সকল গৃহের দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা এ বিষয়ে কথা উঠালে রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করে বললেন : আমিই মসজিদের দিকে উন্মুক্ত সকল দ্বারকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছি আলীর দ্বার ব্যতীত এবং আমি এরূপ করতে নির্দেশিত হয়েই তা করেছি। ২৮৩

তাবরানী তাঁর আল কাবীর গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) একদিন মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন : আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাদের মসজিদ হতে বের হবার নির্দেশ দান করি নি এবং তাকে (আলী)-ও অবস্থান করতে বলি নি,বরং আল্লাহ্ তোমাদের বের হতে ও তাকে এখানে অবস্থান করতে বলেছেন। আমি বান্দা হিসেবে তাঁর নির্দেশ পালনকারী মাত্র। ওহীর মাধ্যমে যা আমাকে নির্দেশ দান করা হয় তা ব্যতীত আমি অন্য কিছু করি না। ২৮৪

রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তুমি ও আমি ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে বৈধ নয় অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করা। ২৮৫

সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আজেব,ইবনে আব্বাস,ইবনে উমর ও হুজাইফা ইবনে উসাইদ গাফফারী সকলেই বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) মসজিদে আসলেন ও বললেন : মহান আল্লাহ্ মূসাকে ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন : আমার জন্য পবিত্র মসজিদ নির্মাণ কর এবং সেখানে তুমি ও হারুন ব্যতীত কেউ যেন সর্বাবস্থায় অবস্থান না করে। তিনি আমাকেও নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র মসজিদ নির্মাণের সেখানে যেন আমি ও আমার ভাই আলী ব্যতীত অন্য কেউ অবস্থান (সর্বাবস্থায়) না করে। ২৮৬

আমাদের এ ক্ষুদ্র লেখায় এ সম্পর্কিত সকল হাদীস ও রেওয়ায়েত একত্রিত করা সম্ভব নয়। এমন কি নির্ভরযোগ্য যে সকল বর্ণনা ইবনে আব্বাস,আবু সাঈদ খুদরী,যাইদ ইবনে আরকাম,আসমা বিনতে উমাইস,উম্মে সালামাহ্,হুজাইফা ইবনে উসাইদ,সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,বাররা ইবনে আযেব,আলী ইবনে আবি তালিব,উমর ইবনে খাত্তাব,আবু যর,আবু তুফাইল,বুরাইদা আসলামী,আবু রাফে,রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কৃতদাস,জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ আনসারী ও অন্যান্যদের হতে এসেছে তাও লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব।

রাসূল (সা.) হতে একটি দোয়া বর্ণিত হয়েছে যা এরূপ- হে আল্লাহ! আমার ভ্রাতা মূসা আপনার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষকে প্রসারিত করে দিন ও আমার জন্য আমার কাজকে সহজ করে দিন। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন যাতে করে জনগণ আমার কথা বুঝতে পারে। আমার পরিবার হতে আমার ভ্রাতা হারুনকে আমার সহযোগী মনোনীত করুন। তার মাধ্যমে আমার মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করুন ও আমার কাজে তাকে সহযোগী করুন। আপনি তাঁর প্রতি ওহী প্রেরণ করে বলেছিলেন : অতিশীঘ্রই তোমার ভ্রাতার মাধ্যমে তোমার বাহুকে আমি শক্তিশালী করবো ও তোমাদের উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দান করবো।

হে পরওয়ারদিগার! আমি মুহাম্মদ আপনার বান্দা ও রাসূল। আমার বক্ষকে আপনি প্রসারিত করুন। আমার কর্মকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আমার পরিবার হতে আমাকে একজন সহযোগী দান করুন এবং সে হলো আলী।২৮৭

বাযযার অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যেখানে নবী (সা.) আলী (আ.)-এর হাত ধরে বললেন, হযরত মূসা আল্লাহর নিকট চেয়েছিলেন যেন হযরত হারুনের মাধ্যমে তাঁর মসজিদকে পবিত্র রাখেন এবং আমি তাঁর নিকট আলীর মাধ্যমে আমার মসজিদ পবিত্র রাখার প্রার্থনা করছি। অতঃপর একজনকে হযরত আবু বকরের নিকট পাঠালেন যেন তাঁর মসজিদের দিকে উন্মুক্ত দ্বারটি বন্ধ করে দেন। তিনি বললেন, শুনলাম ও মেনে নিলাম। অতঃপর একে একে হযরত উমর,হযরত আব্বাসসহ সকল সাহাবীর নিকট এ নির্দেশ পাঠালেন। অতঃপর বললেন, আমি তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করি নি বা আলীর দ্বার উন্মুক্ত রাখি নি,বরং আল্লাহ্ই আলীর দ্বার উন্মুক্ত করেছেন ও তোমাদের দ্বারসমূহ বন্ধ করেছেন। ২৮৮

হযরত আলী (আ.)-এর হযরত হারুনের সঙ্গে সাদৃশ্যের প্রমাণ হিসেবে এতটুকু আলোচনাই যথেষ্ট মনে করছি যেখানে তাঁদের পদমর্যাদা ও সম্মানের সর্বজনীনতা প্রমাণিত হয়েছে।

ওয়াসসালাম

পঁয়ত্রিশতম পত্র

২৭ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

অন্যান্য রেওয়ায়েতগুলোও উল্লেখ করার আহবান।

আল্লাহ্ আপনার পিতাকে রহম করুন। এই আয়াতসমূহ ও হাদীসের দলিলগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট এবং আপনার বর্ণনাও প্রাঞ্জল ও সাহিত্য মানসম্পন্ন। তাই অন্যান্য বর্ণনাসমূহও শোনার ও জানার আগ্রহ ব্যক্ত করছি। মুতাওয়াতির২৮৯ (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো আনুন। আপনার শেষ্ঠত্ব প্রমাণ করুন।

ওয়াসসালাম

ছত্রিশতম পত্র

২৯ জিলহজ্ব ১৩২৯ হিঃ

১।   ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস।

২।   ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণিত হাদীস।

৩।   বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস।

৪।   যে হাদীসে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে।

৫।   আলী বর্ণিত হাদীস।

৬। ওয়াহাবের হাদীস।

৭।   ইবনে আবি আছেমের হাদীস।

১। এ বিষয়ে ইসতিয়াব গ্রন্থে হযরত আলীর জীবনীতে আবু দাউদ তাইয়ালেসী সূত্রে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত হাদীসটিই যথেষ্ট। ইবনে আব্বাস বলেন, রাসূল (সা.) আলীকে লক্ষ্য করে বললেন :أنت ولِيّ كلّ مؤمن بعدي অর্থাৎ তুমি আমার পর সকল মুমিনের অভিভাবক।

২। উপরোক্ত হাদীসের মত আরেকটি সহীহ হাদীস ইমরান ইবনে হুসাইন বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) একদল লোককে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলেন ও আলীকে সেনানায়ক নিযুক্ত করলেন। যুদ্ধ জয়ের পর আলী (আ.) খুমস হতে একটি ক্রীতদাসী নিজের জন্য গ্রহণ করলে সাধারণ সৈন্যরা এর প্রতিবাদ করল। তাদের চারজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলো এ বিষয়ে রাসূলের নিকট অভিযোগ করতে। যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর এ চারজনের একজন রাসূলের নিকট অভিযোগ করে বলল : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি কি শুনেছেন আলী এরূপ এরূপ করেছে? নবী (সা.) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তিও দাঁড়িয়ে একই অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তৃতীয় ব্যক্তিও প্রথম দু জনের মত অভিযোগ আনল। নবী তার হতেও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন চতুর্থ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে চতুর্থবারের মত অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করলে রাসূল (সা.) তাদের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বললেন : তোমরা আলী হতে কি চাও? আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আলী আমার পর সকল মুমিনের ওয়ালী (অভিভাবক)। ২৯০

৩। অনুরূপ বুরাইদাহ্ বর্ণিত হাদীস যা মুসনাদে আহমাদের ৫ম খণ্ডের ৩৫৬ পৃষ্ঠায় এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, রাসূল (সা.) ইয়েমেনের উদ্দেশ্যে দু দল সেনা প্রেরণ করেন। তাদের একদলের নেতৃত্ব আলী ইবনে আবি তালিবের হাতে ও অন্যদলের নেতৃত্ব খালিদ ইবনে ওয়ালিদের হাতে ন্যস্ত করেন। নবী দু দলের উদ্দেশ্যে বললেন : যখন তোমরা দু দল একত্রে মিলিত হবে তখন আলী একক সেনাপতি হবে।২৯১ আর যদি মিলিত হতে না পার তবে সেনানায়ক ভিন্ন থাকবে।

বুরাইদাহ্ বলেন, ইয়েমেনের বনি যুবাইদা গোত্রের সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধে আমরা জয়ী হই এবং অনেককেই বন্দী করতে সক্ষম হই। আলী তাদের মধ্যে এক নারীকে নিজের জন্য মনোনীত করেন।

বুরাইদাহ্ বলেন, খালিদ ইবনে ওয়ালিদ একটি পত্রে ঘটনার বর্ণনা লিখে আমার হাতে দিয়ে রাসূলের নিকট পৌঁছাতে বললেন। যখন পত্রটি নিয়ে রাসূলের নিকট গিয়ে পাঠ করলাম তখন তাঁর চেহারা রাগে পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমি বললাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এখানে আশ্রয়ের কেন্দ্র,আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি আমাকে এক ব্যক্তির অধীনে প্রেরণ ও তার নির্দেশ পালন করতে বলেছেন। তাই তার নির্দেশে এ পত্র বহন করে এনেছি। রাসূল (সা.) বললেন : আলীর বিষয়ে মন্দ বলো না। কেননা আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক ও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। ২৯২  

নাসায়ী তাঁর খাসায়িসুল আলাভীয়া গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠায় ঠিক এভাবে বর্ণনা করেছেন-

لا تبغضنّ يا بريدة فإنّ عليّا منّي و أنا منه و هو وليّكم بعدي

অর্থাৎ হে বুরাইদাহ্! যাতে আমি আলীর ওপর রাগান্বিত হই এমন কাজ কর না,কারণ আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।

ইবনে জারির২৯৩ বুরাইদাহ্ হতে এভাবে বর্ণনা করেছেন, রাসূলের চেহারা অকস্মাৎ রক্তিম হয়ে গেল এবং তিনি বললেন :من كنت وليّه عليّ وليّه অর্থাৎ আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

বুরাইদাহ্ বলেন, যা আমার মনে ছিল সব ভুলে গেলাম। মনে মনে বললাম আলীর বিষয়ে আর কখনো মন্দ বলব না।

তাবরানী এ হাদীসটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বর্ণনায় এসেছে- যখন বুরাইদাহ্ ইয়েমেন হতে ফিরে মসজিদে গেলেন তখন তিনি দেখলেন কিছু সংখ্যক সাহাবী নবী (সা.)-এর ঘরের সামনে বসে রয়েছেন। তিনি সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁদের সালাম দিলে তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সফরের খবর কি? তিনি বললেন, উত্তম। আল্লাহ্ মুসলমানদের বিজয় দান করেছেন। তাঁরা বললেন, কেন অন্যদের পূর্বেই ফিরে এসেছ? তিনি বললেন, আলী নিজের জন্য একজন দাসী খুমসের অংশ থেকে নিয়েছে। তাই আমি নবীকে এ খবর দিতে এসেছি যাতে করে সে নবী (সা.)-এর সুনজর হতে বঞ্চিত হয়। নবী (সা.) ঘরের মধ্য হতে একথা শুনে রাগান্বিত হয়ে বাইরে আসলেন ও বললেন, কেন একদল আলীর বিষয়ে মন্দ বলে? তাদের উদ্দেশ্য কি? যে কেউ আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে। যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হয়,সে আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়। আলী আমা হতে,সে আমার মাটি হতেই সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি ইবরাহীমের মাটি হতে। আমি ইবরাহীম হতে উত্তম।২৯৪ আমরা একই বংশের,একজন হতে অপরজনের সৃষ্টি। আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। হে বুরাইদাহ্! তুমি কি জান না,আলী যে ক্রীতদাসীটি নিয়েছে তদাপেক্ষা অনেক বেশী গণীমতের অধিকারী? তার এ অধিকার রয়েছে কারণ সে আমার পর তোমাদের ওপর অভিভাবক।২৯৫

এই হাদীসটি যে রাসূল হতে বর্ণিত এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই এবং বুরাইদাহ্ হতে কয়েকটি সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে যার সবগুলোই নির্ভরযোগ্য।

৪। এরূপ আরেকটি মূল্যবান হাদীস হাকিম তাঁর মুসতাদরাক গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন যেখানে আলী (আ.)-এর দশটি বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে,তন্মধ্যে নবী (সা.) আলীকে বলেছেন, আমার পর তুমি সকল মুমিনের অভিভাবক হবে। ২৯৬

৫। আরেক স্থানে নবী (সা.) একটি হাদীসে আলী (আ.)-কে বলেছেন, হে আলী! তোমার জন্য আল্লাহর নিকট পাঁচটি বস্তু চেয়েছিলাম। তন্মধ্যে চারটি তিনি দিয়েছেন ও একটি দেন নি.। যেগুলো দিয়েছেন তার মধ্যে একটি হলো তুমি আমার পর মুমিনদের অভিভাবক হবে। ২৯৭

৬। আল ইসাবাহ্ গ্রন্থে ওয়াহাবের পরিচিতি পর্বে ইবনে সাকান ওয়াহাব ইবনে হামযাহ্ হতে বর্ণনা করেছেন, আলীর সঙ্গে সফরে গিয়ে তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রাসূল (সা.)-এর নিকট তার বিষয়ে অভিযোগ করবো। মদীনায় ফিরে রাসূলের নিকট আলী সম্পর্কে অভিযোগ করলে রাসূল বললেন : আলীর বিষয়ে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের অভিভাবক।

তাবরানীও তাঁর কাবীর গ্রন্থে ওয়াহাব হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে রাসূলের কথাটি এভাবে এসেছে-আলী সম্পর্কে এরূপ বলো না,সে আমার পর তোমাদের ওপর সবচেয়ে বেশী অধিকারী।২৯৮

৭। ইবনে আবি আছেম মারফু (অবিচ্ছিন্ন) সূত্রে হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন : আমি কি মুমিনদের নিজেদের হতে তাদের ওপর অধিক অধিকার রাখি না? সবাই বলল : অবশ্যই। তিনি বললেন : আমি যার অভিভাবক (ওয়ালী) আলীও তার অভিভাবক।

এ বিষয়ে আহলে বাইতের ইমামদের হতে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির। এখানে এটুকু বর্ণনাই যথেষ্ট মনে করছি। তদুপরি বেলায়েতের আয়াতটি আমাদের দাবীর সপক্ষে বলিষ্ঠ প্রমাণ। সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর।

ওয়াসসালাম


12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49