ছাপ্পান্নতম পত্র
২২ মুহররম ১৩৩০ হিঃ
১। প্রাকৃতিক নিয়মেই গাদীরের হাদীস মুতাওয়াতির।
২। হাদীসটি বর্ণনার পশ্চাতে আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টি ও অনুগ্রহও বিদ্যমান।
৩। রাসূল (সা.) স্বয়ং এটি বর্ণনায় বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন।
৪। আলী (আ.)-ও তদ্রুপ হাদীসটিকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন।
৫। ইমাম হুসাইন (আ.) এটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
৬। ইমাম হুসাইনের বংশধারার নয়জন ইমামই এ হাদীসকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেছেন।
৭। শিয়ারা এ হাদীসকে বিশেষ গুরুত্ব দান করে।
৮। এমন কি আহলে সুন্নাহর সূত্রেও গাদীরের হাদীস মুতাওয়াতির।
২৪ নং পত্রে এ সম্পর্কে যে দলিল-প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করেছি তা এখানেও প্রযোজ্য।
১। তদুপরি স্বাভাবিকভাবেই গাদীরের হাদীস মুতাওয়াতির হতে বাধ্য। কারণ এমন পরিবেশে মহান আল্লাহ্ তা বর্ণনার নির্দেশ দিয়েছেন যে,অন্যান্য ঐতিহাসিক স্মরণীয় ঘটনার মত সেখানেও হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল যাঁরা বিভিন্ন স্থান হতে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন যাতে করে এ খবর তাঁদের মাধ্যমে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং এ ঘটনা ঐ বংশধারার ব্যক্তিদের বিশেষ দৃষ্টিতে ছিল বলেই তাঁদের বন্ধুদের মাধ্যমে তা সকল যুগে ও সকল স্থানে পৌঁছেছে। তাই এ হাদীসটি মুতাওয়াতির না হয়ে পারে কি? না,কখনোই নয়। তাই এটি জলে-স্থলে সকল স্থানে প্রচারিত হয়েছিল আল্লাহর সেই নিয়মে যাতে কোন পরিবর্তন নেই-
و لن تجد لسنّة الله تحويلا
(এবং তোমরা আল্লাহর নিয়মে কোন পরিবর্তন পাবে না)।
২। গাদীরের হাদীস মহান আল্লাহ্ বিশেষ দৃষ্টিতে ছিল বলেই তাঁর নবীর প্রতি ওহী হিসেবে কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ করে এর ঘোষণা দিয়েছেন যা মুসলমানরা দিবারাত্রি কখনো নিভৃতে,কখনো প্রকাশ্যে,কখনো নামায ও প্রার্থনায়,কখনো মিম্বারে,কখনো মসজিদে,কখনো উপাসনার স্থানে (জায়নামাযে) তেলাওয়াত করে। আয়াতটি হলো :
)
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّـهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ(
হে নবী! যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পৌঁছে দিন। যদি আপনি তা না করেন তবে রেসালতের কোন দায়িত্বই আপনি পালন করেন নি। আল্লাহ্ আপনাকে লোকদের হতে রক্ষা করবেন।
অতঃপর যখন রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর ইমামত ও খেলাফত ঘোষণার রেসালতী দায়িত্ব সম্পাদন করলেন তখন আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন-
)
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(
এই দিন তোমাদের দীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণ করলাম এবং আমার নিয়ামতকে তোমাদের ওপর সম্পূর্ণ করলাম ও ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে মনোনীত করলাম।
তাই এটি আল্লাহর বিশেষ রহমত যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। যে কেউ এ আয়াতটির বিষয়ে চিন্তা করবে সে আল্লাহর এ বিশেষ দৃষ্টি ও অনুগ্রহের প্রতি অনুগত হবে।
৩। যখন দেখা যাচ্ছে বিষয়টির প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে তখন তাঁর নবীরও এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি থাকা স্বাভাবিক। এজন্যই যখন তিনি তাঁর ওফাত নিকটবর্তী হবার খবর শ্রবণ করেছেন তখনই আল্লাহর নির্দেশে বড় হজ্বের সময় সকলের সম্মুখে আলীর বেলায়েত ও নেতৃত্বের ঘোষণা দিয়েছেন।
রাসূল (সা.)‘
ইয়াওমুদ্দার’
-এ যেদিন প্রথমবারের মত নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করেন সেদিন হতে আলীর নেতৃত্বের বিষয়ে একের পর এক হাদীস বর্ণনা করেছেন কিন্তু সেগুলোকে যথেষ্ট মনে করেন নি,বরং বিষয়টির গুরুত্ব চিন্তা করে হজ্বের মৌসুমের পূর্বেই ঘোষণা করেছেন এটি তাঁর শেষ হজ্ব। তাই ইসলামী সাম্রাজ্যের সকল স্থান হতে মুসলমানরা রাসূলের সঙ্গে মদীনায় মিলিত হন এবং এক লক্ষ লোকসহ তিনি হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে যাত্রা করেন
ও তাদের সম্মুখে এ ঐতিহাসিক বক্তব্য রাখেন।
অতঃপর আরাফাতে পৌঁছার পর রাসূল (সা.) ঘোষণা করলেন,
عليّ منّي و أنا من عليّ ولا يودي عنّي إلّا أنا و عليّ
“
আলী আমা হতে এবং আমি আলী হতে। আমার পক্ষ হতে আমি এবং আলী ব্যতীত কেউ কিছু ঘোষণা করতে পারবে না।”
যখন রাসূলুল্লাহর কাফেলা প্রত্যাবর্তন শুরু করে‘
গাদীরে খুম’
উপত্যকায় পৌঁছে তখন হযরত জিবরাঈল (আ.) সূরা মায়েদাহর ৬৭ নং আয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হন। রাসূল (সা.) তা প্রচারের নির্দেশ পেয়ে যাত্রা বিরতি করেন এবং অগ্রবর্তীদের ফিরে আসার ও পশ্চাদবর্তীদের জন্য অপেক্ষার নির্দেশ দেন। যখন সকলেই সমবেত হলেন তখন তিনি ফরয নামায আদায় করলেন এবং আলীর নেতৃত্বের ঘোষণা দিয়ে খুতবা পড়লেন যার কিছু অংশ আমি পূর্বেই বর্ণনা করেছি যা আপনার জন্য যথেষ্ট মনে করি। যদিও বাকী অংশও সুস্পষ্ট ও নির্ভুল তদুপরি এর বর্ণনা দেয়া এখানে সম্ভব নয়।
ঐ দিন যাঁরাই নবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন তাঁরা এ বাণী অন্যদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন এবং তাঁদের সংখ্যা এক লক্ষেরও বেশী ছিল ও বিভিন্ন স্থান হতে সেখানে সমবেত হয়েছিলেন। তাই আল্লাহর নিয়মের স্বাভাবিক রীতিতেই হাদীসটি মুতাওয়াতির হয়েছে (যদিও তা বর্ণনার পথে অনেক বাধা ছিল)। এছাড়া আহলে বাইতের ইমামগণ এ হাদীসটি প্রচারের জন্য যে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেছিলেন তা ঐ লক্ষ্যকেই অন্বেষণ করছিল।
৪। স্বয়ং আলী তাঁর খেলাফতের সময়কালে একদিন কুফার রাহবা নামক স্থানে বক্তব্যে বলেন,“
আপনাদের প্রতি কসম দিয়ে বলছি যাঁরা গাদীরে খুমে রাসূল (সা.) হতে আমার বিষয়ে শুনেছেন তাঁরা দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিন। কিন্তু যাঁরা নিজের চোখে রাসূলকে বলতে দেখেন নি বা কর্ণ দিয়ে শুনেন নি তাঁদের দাঁড়ানোর প্রয়োজন নেই।”
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১২ জন সাহাবীসহ ৩০ জন সাহাবী দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন যে,নবী (সা.) আলীর হাত ধরে বলেছেন,
“
হে লোকসকল! তোমরা কি জান না আমি মুমিনদের ওপর তাদের হতে অধিকার রাখি?”
সকলে বলল,“
হ্যাঁ।”
তখন রাসূল (সা.) বললেন,“
আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ্! যে আলীকে ভালবাসে তুমি তাকে ভালবাস আর যে তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে তুমিও তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ কর।”
আপনার নিকট বিষয়টি স্পষ্ট যে ত্রিশজন সাহাবীর পক্ষে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এরূপ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করা সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই তাঁদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে ঘটনাটি মুতাওয়াতির হয়ে যায় এবং এতে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না। সেদিন যে সকল ব্যক্তি রাহবায় ছিলেন তাঁরাও বিষয়টি শুনেছেন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবার পর তা অন্যদের নিকট প্রচার করেছেন।
রাহবার ঘটনাটি আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময় অর্থাৎ ৩৫ হিজরীর পর ঘটেছিল। এ ঘটনাটি হতেও বোঝা যায় আলীর নেতৃত্বের ঘোষণা বিদায় হজ্জের পর গাদীরে খুমে ঘটেছিল এবং গাদীর ও রাহবার দিনের মধ্যে কমপক্ষে ২৫ বছরের ব্যবধান ছিল। এ সময়ের মধ্যে অনেক যুদ্ধ,বিজয়,মহামারী ও অন্যান্য ঘটনায় গাদীরে উপস্থিত অনেক ব্যক্তিই মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং সেদিনের যুবক ও মুজাহিদদের অনেকেই আল্লাহর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তাঁর রাসূলের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁরাও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করতেন। তাই কেবল যাঁরা আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সঙ্গে ইরাকে বসবাস করতেন তাঁদের একটি অংশ সেদিন রাহবায় ছিলেন ও গাদীরের ঘটনার সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যাঁদের মধ্যে বার জন বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী (বদরী) সাহাবী ছিলেন। অবশ্য গাদীরে উপস্থিত কিছু ব্যক্তি সেদিন সেখানে উপস্থিত থাকলেও সাক্ষ্য দান করেন নি যেমন আনাস ইবনে মালিক।
যদি সেদিন আলীর পক্ষে সকল জীবিত সাহাবীর (পুরুষ ও নারীসহ) রাহবায় একত্রিত করে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্ভব হত তবে তার সংখ্যা ঐ ত্রিশের কয়েক গুণ হত। আর যদি এর পঁচিশ বছর পূর্বে এই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হত তবে তাদের সংখ্যা কিরূপ হত একটু চিন্তা করুন। যদি এ সত্যকে অনুধাবন করতে সক্ষম হন তবে গাদীরের হাদীস মুতাওয়াতির হবার সপক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হাতে পেয়েছেন।
রাহবার ঘটনা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর‘
মুসনাদ’
গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের ৩৭০ পৃষ্ঠায় আবু তুফাইল হতে যাইদ ইবনে আরকাম সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,“
আলী রাহবায় সকলকে সমবেত করে বলেন : আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি,এখানে উপস্থিত সেই সকল মুসলমান যাঁরা গাদীরের দিবসে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের আহবান করে বলছি তাঁরা দাঁড়িয়ে রাসূল (সা.) হতে যা শুনেছেন তা বলুন। ত্রিশ ব্যক্তি দাঁড়ালেন।”
কিন্তু আবু নাঈম বলেছেন,“
অনেকেই দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিলেন রাসূল (সা.) আলীর হাত ধরে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন : তোমরা কি জানো আমি মুমিনদের ওপর তাদের অপেক্ষা অধিক অধিকার রাখি? তারা বলল : হ্যাঁ,ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তখন তিনি বললেন : আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ্! তুমি আলীর বন্ধুকে ভালবাস ও তার শত্রুকে শত্রু গণ্য কর।”
আবু তুফাইল বলেন,“
আমি যখন রাহবা হতে বের হয়ে আসি তখন আমার মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল কিরূপে এ উম্মতের অধিকাংশ মানুষ রাসূলের এ নির্দেশের ওপর আমল করে নি? তাই যাইদ ইবনে আরকামের নিকট গিয়ে বললাম : আলী এরূপ বলছিল ও দাবী করছিল। যাইদ বললেন : এতে অস্বীকার করার কিছু নেই,আমি নিজেও নবী (সা.) হতে তা শুনেছি।”
যদি এই ত্রিশ ব্যক্তির সঙ্গে স্বয়ং আলী ও যাইদ ইবনে আরকামকে যোগ করেন তবে মোট রাবীর সংখ্যা দাঁড়ায় বত্রিশ জন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল তাঁর‘
মুসনাদ’
গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১১৯ পৃষ্ঠায় আবদুর রহমান ইবনে আবি লাইলা হতে ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন,“
রাহবার ঘটনার দিন আলীকে দেখলাম লোকদের কসম দিয়ে বলছেন কেবল তারাই দাঁড়াও ও সাক্ষ্য দাও যারা রাসূলকে সে অবস্থায় দেখেছে।”
আবদুর রহমান বলেন,“
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বার জন সাহাবী দাঁড়ালেন,যেন আমি এখনও তাঁদের বলতে দেখছি : আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি গাদীরে খুমে ঐ দিন নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি,আমি কি মুমিনদের ওপর তাদের অপেক্ষা অধিক ক্ষমতা রাখি না? সবাই বলল : হ্যাঁ। রাসূল বললেন : আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা। হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুদের প্রতি আপনি ভালবাসা ও তার শত্রুদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করুন।”
ইমাম আহমাদ একই পৃষ্ঠায় অপর একটি সূত্রে উল্লেখ করেছেন,“
রাসূল (সা.) বলেছেন : হে আল্লাহ্! তুমি তার প্রতি ভালবাসা পোষণকারীদের ভালবাস এবং শত্রুতা পোষণকারীদের শত্রু গণ্য কর। তার সাহায্যকারীদের তুমি সাহায্য কর এবং বিরোধীদের হতাশ ও লাঞ্ছিত কর।”
উক্ত সাহাবীরা রাসূলের উদ্ধৃতি দিয়ে এটি বলেন এবং তিন ব্যক্তি গাদীরে খুমে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও না দাঁড়ানোর কারণে আলী তাদের অভিসম্পাত করেন ও তারা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বার জন বদরী সাহাবীর সঙ্গে বদরী সাহাবী হিসেবে আলী এবং যাইদ ইবনে আরকামকে যোগ করলে তাঁদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় চৌদ্দ জন অর্থাৎ চৌদ্দ জন বদরী সাহাবী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। রাহবার হাদীসটির বিষয়ে কেউ চিন্তা করলে বুঝতে পারবে হাদীসটি প্রচারের জন্য আলী (আ.) কিরূপ প্রজ্ঞাজনোচিত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
৫। শহীদদের নেতা আবু আবদুল্লাহ্ আল হুসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে তাঁর পিতার রাহবার ঘটনার মত আরাফার ময়দানে হজ্বের সময় লোকদের সমবেত করেন ও প্রথমে তাঁর নানা,পিতা-মাতা ও ভ্রাতার প্রশংসা করার পর গাদীরের হাদীস বর্ণনা করে অন্যদের হতে স্বীকৃতি নেন। তাঁর মত একজন বাগ্মী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি যাঁর কথা মানুষের কর্ণ,চক্ষু ও হৃদয়কে আবেশিত করে অন্যকে নিজের অধীন করে,জনতা ইতোপূর্বে তা প্রত্যক্ষ করে নি। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রয়োজনীয় যুক্তি প্রদর্শন করে অন্যদের হৃদয়ে তা প্রতিস্থাপন করে গাদীর দিবসের হক্ব আদায় করেন। এরূপ স্থানে গাদীরের হাদীস বর্ণনার প্রভাব খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল।
৬। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বংশধারার নয়জন প্রসিদ্ধ ইমামও এ হাদীসের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। আপনি আপনার বুদ্ধিবৃত্তি ও সমগ্র সত্তা দিয়ে তা অনুভব করতে পারবেন যে,এই মহান ব্যক্তিবর্গ প্রতি বছর ১৮ জিলহজ্ব (গাদীর দিবসে) আনন্দ করতেন,সবাইকে মোবারকবাদ জানাতেন এবং ঈদ হিসেবে পালন করতেন। এ দিনে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে রোযা রাখতেন,নফল নামায ও দোয়া পড়তেন। এ দিন মহান আল্লাহ্ তাঁদের যে নিয়ামত দান করেছেন তাঁরা সে নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা এভাবে আদায় করতেন। কারণ এ দিনেই নবী (সা.)-এর মুখনিসৃত পবিত্র বাণীর মাধ্যমে আলী (আ.)-এর ইমামত ও খেলাফত ঘোষিত হয়েছিল। এছাড়া এ দিনে তাঁরা নিকটাত্মীয়দের অধিক খোঁজ-খবর নিতেন ও তাদের বিভিন্ন উপহার দিতেন। তাঁদের অনুসারীদেরও তদ্রুপ করার উপদেশ দিতেন। এভাবেই গাদীরের ঘটনা বংশ পরম্পরায় টিকে রয়েছে।
৭। এর ওপর ভিত্তি করেই শিয়ারা সকল যুগে সকল গ্রাম-শহর,দেশ ও স্থানে ১৮ জিলহজ্ব ঈদ পালন করে আসছে।
এ দিন শিয়ারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশ্যে (এজন্য যে আল্লাহ্ আমীরুল মুমিনীন আলীর ইমামতের ঘোষণার মাধ্যমে দীনকে পূর্ণতা দান এবং নিয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন) মসজিদসমূহে নফল নামায ও কোরআন তেলাওয়াতের জন্য সমবেত হন। এ দিন তাঁরা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং পাড়া-প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের খাদ্যদানের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টায় ব্রত হন। সম্ভব হলে প্রতি বছর এই দিন হযরত আলী (আ.)-এর মাজার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে নাজাফে তাঁর কবরে যান। ১৮ জিলহজ্ব হযরত আলীর কবর যিয়ারতকারীর সংখ্যা লক্ষাধিক হয়ে থাকে। অনেকেই এ দিনে মুস্তাহাব রোযা রাখেন। যিয়ারতকারীরা সেখানে সাদকা,নজর প্রভৃতি দান করেন এবং ইমামদের হতে নির্দেশিত যিয়ারতসমূহ সেখানে পাঠ করেন। এ যিয়ারতসমূহে আলীর বিভিন্ন ফজীলত যেমন দীনের ক্ষেত্রে অগ্রগামিতা,দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অসীম কষ্ট স্বীকার,শ্রেষ্ঠ রাসূলের সেবায় তাঁর আত্মনিয়োগ ও আত্মত্যাগের বিবরণ,রাসূলের পক্ষ হতে তাঁকে মনোনয়নের হাদীসসমূহ বিশেষত গাদীরে খুমের হাদীস প্রভৃতি বিষয় উদ্ধৃত করা হয়। বক্তারা এ দিনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অবিচ্ছিন্ন ও বিচ্ছিন্ন (মুরসাল) সূত্রে বর্ণিত গাদীরের হাদীস এবং এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতাসমূহ
পাঠ করে থাকেন। এভাবেই যুগ যুগ ধরে গাদীর শিয়াদের মাঝে পালিত হয়ে আসছে।
সুতরাং আহলে বাইত ও শিয়া সূত্রে গাদীরে খুমের হাদীসটি মুতাওয়াতির হবার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ এর দাবীদারদের এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি নবী (সা.)-এর বাণীর প্রতিটি শব্দ যথাযথ সংরক্ষণে ভূমিকা রেখেছিল। এই সত্যকে যাচাই করতে চাইলে আপনি শিয়াদের নির্ভরযোগ্য বলে পরিচিত চারটি গ্রন্থে তা দেখতে পারেন। তদুপরি শিয়া আলেমদের সংকলিত মুসনাদসমূহে এ হাদীস মুত্তাছিল
ও মারফু
সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কেউ এ বিষয়ে অধ্যয়ন করলে হাদীসটি শিয়া সূত্রে মুতাওয়াতির হবার বিষয়টি তার নিকট সুস্পষ্ট হবে।
৮। এমন কি প্রকৃতির স্বাভাবিক নীতিতেই আহলে সুন্নাহর সূত্রেও হাদীসটি মুতাওয়াতির বলে গণ্য হয়েছে।
আল্লাহর সৃষ্টির নীতিতে কোন পরিবর্তন নেই এবং তাঁর দীন অপরিবর্তনীয় (যদিও অধিকাংশ মানুষ তা জানে না)। এ বাণীর ফলশ্রুতিতে বলা যায় গাদীরের হাদীস এ কারণেই সুন্নী সূত্রেও মুতাওয়াতির হয়েছে।‘
ফাতওয়া আল হামিদিয়া’
গ্রন্থের লেখক তাঁর‘
আস্ সালাওয়াতুল ফাখিরাহ্ ফিল আহাদিনিল মুতাওয়াতিরাহ্’
নামক প্রবন্ধে এ হাদীসটিকে মুতাওয়াতির বলেছেন (তাঁর কট্টর মনোভাব সত্ত্বেও)। আল্লামাহ্ সুয়ূতী ও তাঁর মত অনেকেই হুযাইফাহ্ হতে হাদীসটি বর্ণনা করে সহীহ বলেছেন। মুহাম্মদ ইবনে জারির তাবারী (মুফাসসির ও ঐতিহাসিক),আহমাদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সাঈদ ইবনে উকদা ও মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে ওসমান যাহাবী বিভিন্ন সূত্র হতে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং এ সম্পর্কিত গ্রন্থও রচনা করেছেন।
ইবনে জারির তাঁর বইয়ে পঁচাত্তরটি সূত্রে এবং ইবনে উকদা
১০৫টি সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। যাহাবী তাঁর কট্টর মনোভাব সত্ত্বেও এ সকল সূত্রকে বিশুদ্ধ ও সহীহ বলতে বাধ্য হয়েছেন।
‘
গায়াতুল মারাম’
গ্রন্থের ১৬ অধ্যায়ে আহলে সুন্নাহ্ হতে ৮৯টি সূত্রে গাদীরের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বিশেষত এ গ্রন্থে হাদীসটি তিরমিযী,নাসায়ী,তাবরানী,বাযযার ইবনে ইয়ালী ও অন্যদের হতে উদ্ধৃত করেছেন।
সুয়ূতী তাঁর‘
তারিখুল খুলাফা’
গ্রন্থে হযরত আলী (আ.)-এর জীবনীতে তিরমিযী হতে হাদীসটি বর্ণনা করে বলেছেন,“
আহমাদ হাদীসটি আলী,আবু আইয়ুব আনসারী,যাইদ ইবনে আরকাম,উমর ও যিমার হতে বর্ণনা করেছেন।”
তিনি আরো বলেছেন,“
আবু হুরাইরা হতে আবু ইয়ালী এবং ইবনে উমর,মালিক ইবনে হুয়াইরিস,হাবশ ইবনে জুনাদা,জারির ইবনে আবদুল্লাহ্,সা’
দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস,আবু সাঈদ খুদরী ও আনাস ইবনে মালিক হতে তাবরানী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাছাড়া বাযযার,ইবনে আব্বাস,বুরাইদাহ্ ও আম্মারাহ্ হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
এ হাদীসের পক্ষে আরেকটি দলিল হলো এ বর্ণনাটি যা ইমাম আহমাদ তাঁর‘
মুসনাদ’
গ্রন্থে রিয়াহ ইবনে হারিস হতে দু’
টি সূত্রে বর্ণনা করেছেন-“
একদল লোক আলীর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন : হে আমাদের মাওলা! আপনার ওপর সালাম! হযরত আলী তাদেরকে প্রশ্ন করলেন : তোমরা কারা? তারা বলল : হে আমীরুল মুমিনীন! আমরা আপনার অনুগত ব্যক্তি। হযরত আলী বললেন : আমি তোমাদের মাওলা কিরূপে হলাম,তোমরা তো আরব। তারা বলল : গাদীরের দিনে আমরা রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি : আমি যার মাওলা এই আলীও তার মাওলা।”
রিয়াহ বলেন,“
যখন তারা ফিরে যাচ্ছিল তখন আমি তাদের অনুসরণ করলাম ও তাদের প্রশ্ন করলাম : আপনারা কারা? তারা বলল : আমরা মদীনার আনসার। তাদের মধ্যে আবু আইয়ুব আনসারীও ছিলেন।”
হাদীসটি মুতাওয়াতির হবার পক্ষে অপর দলিল হলো এ হাদীস যা আবু ইসাহাক সা’
লাবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে সূরা মাআরিজের তাফসীরে দু’
টি নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,“
রাসূল (সা.) গাদীরের দিনে যখন জনগণকে সমবেত করে আলীর হাত ধরে ঘোষণা করলেন :
من كنت مولاه فعليّ مولاه
তখন এ খবরটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। হারিস ইবনে নোমান ফিহরী তা শুনে উটে আরোহণ করে রাসূলের নিকট আসল। উটকে বেঁধে রাসূলকে লক্ষ্য করে বলল : হে মুহাম্মদ! তুমি একদিন নির্দেশ দিয়েছিলে এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করতে ও তোমাকে তাঁর নবী হিসেবে স্বীকার করতে,আমরা তা করেছি। পরবর্তীতে বললে দিনে পাঁচবার নামায পড়,তাও মানলাম,আবার বললে যাকাত দাও,তাও করলাম,পরে রমযান মাসের রোযা রাখার নির্দেশ দিলে তাও শুনলাম,হজ্ব করার নির্দেশও পালন করলাম। এতকিছুতেও তোমার সন্তুষ্টি আসল না,অবশেষে নিজের চাচাত ভাইয়ের হাত ধরে তাকে আমাদের ওপর শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছ : আমি যার মাওলা আলী তার মাওলা- এ কথাটি তোমার নিজের পক্ষ হতে নাকি আল্লাহর পক্ষ হতে? নবী (সা.) বললেন : যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই সেই আল্লাহর শপথ করে বলছি। হারিস তার বাহনের দিকে ফিরে যেতে যেতে বলল : হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ যা বলছে তা যদি সত্য হয় তবে আমাদের ওপর আসমান হতে পাথর বর্ষণ করুন অথবা কোন কঠিন আজাব প্রেরণ করুন। তখনও সে তার বাহনের নিকট পৌঁছে নি,আকাশ হতে একটি বড় পাথর তার মাথার ওপর আপতিত হয়ে তাকে ধ্বংস করল এবং মহান আল্লাহ্ নিম্নোক্ত আয়াত রাসূলের ওপর অবতীর্ণ করলেন-
﴿
سَأَلَ سَائِلٌ بِعَذَابٍ وَاقِعٍ لِّلْكَافِرِينَ لَيْسَ لَهُ دَافِعٌ مِّنَ اللَّـهِ ذِي الْمَعَارِجِ﴾
এক ব্যক্তি চাইল,সেই আজাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত কাফিরদের জন্য। যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই তা এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী।”
হাদীসটি আমরা হুবহু বর্ণনা করলাম।
আহলে সুন্নাহর একদল হাদীসবেত্তা হাদীসটি বিনাবাক্যে গ্রহণ করেছেন।
ওয়াসসালাম
শ