ষাটতম পত্র
৩০ মুহররম ১৩৩০ হিঃ
সত্যকে পাশ কাটানোর উত্তরের জবাব
আল্লাহ্ আপনার মাধ্যমে সত্যকে প্রকাশ করুন। আপনি চেয়েছেন আমরা গাদীরের হাদীসের এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হব যে,আলী (আ.) তখনই ইমাম বা নেতা ও অভিভাবক হবেন যখন মুসলমানরা তাঁকে নির্বাচিত করে তাঁর হাতে বাইয়াত করবে। তাই তাঁর নেতৃত্বের যে ঘোষণা গাদীর দিবসে দেয়া হয়েছে তা ঐ দিন হতে প্রযোজ্য নয়,বরং তাঁর নির্বাচনের দিন হতে প্রযোজ্য। অন্যভাবে বললে তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকলেও এর কার্যকারিতা ছিল না। যদি এটি আমরা গ্রহণ করি তবে প্রথম তিন খলীফার খেলাফতের বিষয়টি প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না।
আমি আপনাকে সত্যের আলো,ন্যায়,ইনসাফ ও সম্মানের মর্যাদার শপথ দিয়ে বলছি,আপনি কি এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট? যদি তা হয় তবে আমরাও আপনার অনুসরণ করবো। আপনি কি রাজী হবেন এরূপ কোন ব্যাখ্যা আপনার নামে প্রচলিত হোক? আমার মনে হয় না আপনি এতে রাজী ও সন্তুষ্ট হবেন?
আপনি নিশ্চিত জানুন আপনিও সেইসব ব্যক্তিদের এ কর্মে আশ্চর্যান্বিত হবেন যাঁরা এ ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কারণ হাদীসটি শাব্দিকভাবেও এরূপ অর্থ বহন করে না এবং কেউই এ থেকে এমন কিছু বুঝবে না। এটি যেমন একদিকে নবী (সা.)-এর প্রজ্ঞার পরিপন্থী,অন্যদিকে তাঁর অন্য কোন বক্তব্য ও কর্মের সঙ্গেও সামঞ্জস্যশীল নয়। তদুপরি আমরা এতদ্সংশ্লিষ্ট অকাট্য যে সকল প্রমাণের প্রতি ইশারা করেছি এ ব্যাখ্যা তার সঙ্গেও সামঞ্জস্যশীল নয়। যেমন হারিস ইবনে নো’
মান ফাহরী এ হাদীস হতে যা বুঝেছেন তা আপনার যুক্তির বিরুদ্ধেই বুঝেছেন। সুতরাং আল্লাহ্,তাঁর রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের উদ্দেশ্যও তাই ছিল যা আমরা বলেছি।
এগুলো বাদ দিলেও আলী (আ.)-এর নেতৃত্বের বিষয়টি হাদীসের সর্বজনীনতার কারণে আপনার ব্যাখ্যার সঙ্গে সংগতিশীল নয়। কারণ হাদীসটি হতে বোঝা যায় আলী এমন কি প্রথম তিন খলীফাসহ সকল মুসলমানদের ওপর নেতা। যদি তা না হয় তবে তা রাসূলের নিম্নোক্ত কথার পরিপন্থী হবে-‘
আমি কি মুমিনদের ওপর তাদের হতে অধিকতর অধিকার রাখি না।’
সকলে বলল,“
হ্যাঁ।”
তখন তিনি বলেন,من كنت مولاه
অর্থাৎ আমি যেরূপ প্রত্যেক ব্যক্তির নেতা,فعليّ مولاه
অর্থাৎ সেরূপ আলীও (কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই) তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির নেতা। এমন কি হযরত আবু বকর এবং উমরও গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) হতে এ বক্তব্য শোনার পর আলীকে বলেন,أمسيت يا بن ابى طالب مولى كل مؤمن و مؤمنة
অর্থাৎ হে আবু তালিবের পুত্র! আপনি প্রতিটি মুমিন পুরুষ ও নারীর নেতা মনোনীত হয়েছেন। যেহেতু এই দুই ব্যক্তিও এটি স্বীকার করেছেন যে,আলী সকল মুমিন পুরুষ ও নারীর নেতা সেহেতু গাদীরের দিন হতেই আলী সকল মুমিনের ওপর নেতা।
বর্ণিত হয়েছে হযরত উমরকে প্রশ্ন করা হলো : আলীর প্রতি আপনি যেরূপ আচরণ করেন রাসূলের অন্য কোন সাহাবীর সঙ্গে কেন সেরূপ আচরণ করেন না?
হযরত উমর বলেন,“
তিনি আমার মাওলা ও নেতা।”
এখানে লক্ষ্য করুন যখন আলী খলীফা হিসেবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নি,তাঁর বাইয়াত সংঘটিত হয় নি তখনও খলীফা উমর তাঁকে নিজের মাওলা ও নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আলী (আ.) যে সকল সময়ের জন্যই মুমিনদের নেতা তা এ বর্ণনা হতে বোঝা যায়। তাই যখন রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে আলীর নেতৃত্বের ঘোষণা দান করেন তখন হতেই তিনি সকল মুমিন পুরুষ ও নারীর মাওলা বলে পরিগণিত।
এ সম্পর্কিত অন্য একটি ঘটনা ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে। একবার দু’
জন আরব তাদের মধ্যকার বিবাদ মীমাংসার জন্য হযরত উমরের নিকট আসলে হযরত উমর আলী (আ.)-কে তাদের মধ্যে বিচার করার আহবান জানান। তারা দু’
জন বলে,“
কেন এই ব্যক্তি আমাদের মধ্যে মীমাংসা করবে?”
হযরত উমর দু’
হাতে তাদের দু’
জনের গলা চেপে ধরে
বলেন,“
হে হতভাগারা! জানিস না এ ব্যক্তি কে? এ তোদের ও সকল মুমিনের নেতা। যে কেউ এ ব্যক্তিকে মাওলা ও নেতা হিসেবে গ্রহণ না করবে সে মুমিন নয়।”
এ সম্পর্কিত হাদীস ও ঘটনা অসংখ্য। আপনি ভালভাবেই অবগত আছেন,যদি ইবনে হাজার ও তাঁর অনুসারীদের মনগড়া এ সকল যুক্তি সঠিক হত তবে রাসূল (সা.)-কে একজন উদ্দেশ্যহীন ও নিষ্ফল কর্ম সম্পাদনকারী ব্যক্তি বলতে হবে যিনি তাঁর বাক্য ও কর্মে প্রজ্ঞাবান নন (আল্লাহর নিকট তাঁর ওপর এরূপ অপবাদ আরোপ হতে আশ্রয় চাই),কারণ তাঁদের যুক্তিতে মহানবী (সা.)-এর গাদীরের সেই বৃহৎ ও আশ্চর্যজনক সমাবেশ আয়োজনের পেছনে কোন গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল না। তিনি শুধু চেয়েছিলেন এটি বলতে-আমার মৃত্যুর অনেক দিন পর যখন আলীকে তোমরা খেলাফতের জন্য নির্বাচিত করবে তখন আলী তোমাদের ওপর নেতৃত্বের অধিকারী হবে। এ সকল বিশেষজ্ঞের এরূপ ব্যাখ্যা শুনে উম্মাদরাও হাসতে শুরু করবে। বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদের কথা না হয় বাদই দিলাম।
তাদের এরূপ অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্য হলো যাতে আলী (আ.)-এর আর কোন শ্রেষ্ঠত্ব না থাকে। কারণ যে কোন মুসলমানেরই বাইয়াত করা হবে সে নেতৃত্বের অধিকারী হবে,সেক্ষেত্রে আলী (আ.),অন্যান্য সাহাবী আর সকল মুসলমান সমান হয়ে পড়বে। তাহলে প্রশ্ন হলো গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) কোন্ বিষয়ে আলীকে ইসলামে অগ্রগামীদের থেকেও শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করতে চেয়েছেন? সেই শ্রেষ্ঠত্বটি কি? হে মুসলিম সমাজ! এই অপব্যাখ্যাকারীদের উত্তর দান সম্পন্ন হলে আপনারা জবাব দিন।
আপনার শেষ যুক্তিটিতে আপনি বলেছেন যদি আলীর ইমামত ও নেতৃত্বের বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য না হয় তবে তিনি রাসূলের উপস্থিতিতেই ইমাম বলে পরিগণিত হবেন। এ যুক্তিটি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও বিচ্যুত। এটি রাসূল (সা.)-এর নির্দেশকে অবজ্ঞার শামিল এবং তাঁর মনোনীত খলীফা,প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত নেতার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গের নামান্তর। এটি রাসূলের উদ্ধৃত এ সম্পর্কিত অন্যান্য হাদীস,যেমন‘
মানযিলাত’
-এর হাদীসের প্রতি নিজেদের অজ্ঞতার ভান বৈ কিছু নয়,কারণ সেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন,أنت منّي بِمنْزلة هارون من موسى إلّا أنّه لا نبِيّ بعدي
অর্থাৎ হে আলী! তোমার স্থান আমার কাছে মূসার নিকট হারুনের ন্যায় শুধু পার্থক্য এটি,আমার পর কোন নবী নেই।
হাদীসে‘
ইনযার’
বা‘
ইয়াওমুদ্দার’
-কেও এর মাধ্যমে তাঁরা অস্বীকার করেছেন যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন,“
তোমরা তার (আলীর) কথা শুনবে ও আনুগত্য করবে।”
এরূপ অন্যান্য সহযোগী হাদীসগুলোও উপেক্ষিত হয়েছে যাতে রাসূল আলী (আ.)-এর ইমামত ও নেতৃত্বের বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছিলেন।
তদুপরি যদিও রাসূলের উপস্থিতিতে আলী (আ.)-এর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের বিষয়টি বাস্তব নমুনা হিসেবে বিদ্যমান ছিল না কিন্তু রাসূলের ওফাতের পর পরই বিষয়টিকে বাস্তব রূপ দান এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ এ বিধিটি সবাই স্বীকার করেন যে,যদি বাক্যের অর্থ প্রচলিত ও প্রকৃত অর্থে ব্যবহার সম্ভব না হয় তবে তা নিকটতম রূপক ও সম্ভাব্য অর্থে ব্যবহার করতে হবে। বিষয়টি চিন্তা করে দেখুন।
আপনার কথামত এ হাদীসটির ব্যাখ্যা না করলেও অগ্রবর্তী পুণ্যবান সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদা সংরক্ষিত রাখা সম্ভব যা আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্।
ওয়াসসালাম
শ