আটষট্টিতম পত্র
৯ সফর ১৩৩০ হিঃ
স্থলাভিষিক্তের হাদীস
স্থলাভিষিক্তের হাদীস নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইত হতে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। অন্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলো আমরা বিংশতম পত্রে উল্লেখ করেছি যার অন্যতম এই হাদীসটি- রাসূল (সা.) আলী (আ.)-এর পৃষ্ঠে হাত রেখে বললেন,
هذا أخي و وصيّي و خليفتي فيكم فاسمعوا له و أطيعوا
“
এ আমার ভাই,স্থলাভিষিক্ত ও তোমাদের ওপর আমার প্রতিনিধি। সুতরাং তোমরা তার কথা শোন ও আনুগত্য কর।”
মুহাম্মদ ইবনে হামিদ রাযী সালামাহ্ আবরাশ হতে,তিনি ইবনে ইসহাক হতে,তিনি আবু রাবীয়াহ্ আইয়াদি হতে,তিনি ইবনে বুরাইদাহ্ হতে এবং ইবনে বুরাইদাহ্ তাঁর পিতা বুরাইদাহ্ হতে বর্ণনা করেছেন যে,রাসূল (সা.) বলেছেন,“
প্রত্যেক নবীই স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী রেখে গেছেন,আমি আমার স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী হিসেবে আলী ইবনে আবি তালিবকে রেখে যাচ্ছি।”
তাবরানী তাঁর‘
আল কাবীর’
গ্রন্থে হযরত সালমান ফারসী হতে বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন,“
আমার স্থলাভিষিক্ত,আমার গোপন রহস্যের কেন্দ্র যে আমার পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসেবে আমার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে ও আমার দীনকে রক্ষা করবে সে আলী ইবনে আবি তালিব।”
এ হাদীসটিতে সুস্পষ্টরূপে আলী রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ও রাসূলের পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসেবে উল্লিখিত হয়েছেন। রাসূলের খলীফা হিসেবে আলীর আনুগত্য যে অপরিহার্য তা কারো নিকট অস্পষ্ট নয়।
হাফিয আবু নাঈম(*২৪) তাঁর‘
হুলইয়াতুল আউলিয়া’
গ্রন্থে আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণনা করেছেন,তিনি বলেন,“
রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন : হে আনাস! সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসেবে এ দ্বার দিয়ে যে ব্যক্তি প্রবেশ করবে সে মুত্তাকীদের ইমাম,মুসলমানদের নেতা,দীনের সর্দার,নবীদের সরাসরি স্থলাভিষিক্তদের সর্বশেষ ব্যক্তি ও উজ্জ্বল মুখাবয়ববিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রধান।”
আনাস বলেন,“
আলী তখন প্রবেশ করলেন ও রাসূল দাঁড়িয়ে তাঁকে সুসংবাদ দিয়ে আলিঙ্গন করে বললেন : তুমি আমার ঋণ পরিশোধকারী,মানুষের নিকট আমার বাণীকে পৌঁছাবার দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং আমার পর তাদের মধ্যকার মতবিরোধে ব্যাখ্যা প্রদানকারী।”
তাবরানী তাঁর‘
আল কাবীর’
গ্রন্থে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী হতে বর্ণনা করেছেন,রাসূল (সা.) বলেছেন,“
হে ফাতিমা! তুমি কি জান না মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং এর অধিবাসীদের মধ্য হতে তোমার পিতাকে নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করলেন। অতঃপর দ্বিতীয় বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তোমার স্বামীকে মনোনীত করলেন এবং আমার প্রতি ওহী (প্রত্যাদেশ) প্রেরণ করলেন যেন তাকে তোমার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করি ও আমার স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করি।”
লক্ষ্য করুন,মহান আল্লাহ্ কিরূপে পৃথিবীর অধিবাসীদের মধ্য থেকে শেষ নবীকে মনোনীত করার পর আলীকে মনোনীত করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে,নবী মনোনয়নের বিষয়ের মত তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনয়নের বিষয়টিও আল্লাহর ইচ্ছাধীন। নিজ কন্যাকে আলীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা ও তাঁকে স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করার জন্য আল্লাহর ওহী প্রেরণের বিষয়টিও লক্ষ্য করুন। পূর্ববর্তী নবীগণের স্থলাভিষিক্তরা তাঁদের মনোনীত ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত অন্য কেউ ছিলেন কি? সুতরাং যে ব্যক্তিকে আল্লাহ্ মনোনীত করেছেন এবং তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর প্রতিনিধি বানিয়েছেন তাঁকে উপেক্ষা করে অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া ঠিক হবে কি? অন্য কোন ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী হবার যোগ্যতা রাখে কি? মানুষ যে ব্যক্তিকে শাসক হিসেবে নির্বাচিত করেছে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের মনোনীত ব্যক্তির ওপর তাকে প্রাধান্য দিয়ে তার আনুগত্যকে ওয়াজিব মনে করা যুক্তিসংগত কি? এটি কিরূপে সম্ভব যে,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের মনোনীত ব্যক্তিকে উপেক্ষা করে আমরা নিজেরা অন্য ব্যক্তিকে নির্বাচন করি? অথচ কোরআন বলছে,“
আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দানের পর কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর এ বিষয়ে কোন এখতিয়ার নেই। যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করবে সে স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত হবে।”
(সূরা আহযাব : ৩৬)
এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরস্পর সহায়ক হাদীস এসেছে যে,যখন রাসূল (সা.) হযরত মারিয়মের উত্তরসূরী এবং বেহেশতের নারীদের নেত্রী হযরত ফাতিমাকে আলীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন সেই সকল ব্যক্তি যাঁরা এ সৌভাগ্যের অধিকারী হতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন তাঁরা অসন্তুষ্ট হলেন ও হিংসা করতে লাগলেন। কারণ এতে হযরত আলীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হলো এবং এ মর্যাদায় পৌঁছার আর কারো অবকাশ রইল না।
তাই তাঁরা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কুৎসা রটনাকারীদের দাওয়াত দিয়ে আনলেন এবং আলীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর জন্য হযরত ফাতিমার কাছে তাদের পাঠালেন,যাতে করে তিনি হযরত আলীর প্রতি বিতৃষ্ণ হন। তারা নবী কন্যার নিকট গিয়ে বলল,“
আলী নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তি তার কোন সম্পদ নেই।”
কিন্তু তাঁদের এ চক্রান্ত ও অসৎ উদ্দেশ্য হযরত ফাতিমার ওপর কোন প্রভাব ফেলল না এবং তিনি কোন অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করলেন না। অবশেষে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটল। কিন্তু হযরত ফাতিমা আমীরুল মুমিনীন আলীর ফজীলত ও মর্যাদা প্রকাশের মাধ্যমে শত্রুদের মুখ বন্ধ করার জন্য রাসূল (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন,“
হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কি এমন ব্যক্তির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করছেন যে কোন সম্পদের অধিকারী নয়?”
রাসূল (সা.) যে জবাব দিয়েছিলেন তা পূর্বে উল্লেখ করেছি (যে হাদীসটি বেশ কয়েক লাইন পূর্বে তাবরানী সূত্রে আবু আইয়ুব আনসারী হতে বর্ণিত হয়েছে)। এখানে কবিদের ভাষায় বলতে চাই- যখনই আল্লাহ্ চান কোন ব্যক্তির খ্যাতি প্রচার করতে তখনই হিংসুক ও পরনিন্দা চর্চাকারীদের এজন্য (তাঁর খ্যাতি প্রচারের জন্য) ব্যবহার করেন।
খাতীব বাগদাদী তাঁর‘
আল মুত্তাফিক’
গ্রন্থে ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন,যখন রাসূল (সা.) হযরত ফাতিমাকে হযরত আলীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন তখন হযরত ফাতিমা প্রশ্ন করলেন,“
হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে একজন দরিদ্র ব্যক্তির স্ত্রী করলেন?”
রাসূল (সা.) বললেন,“
তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও,মহান আল্লাহ্ পৃথিবীবাসীদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে দু’
ব্যক্তিকে মনোনীত করলেন যার একজন তোমার পিতা আর দ্বিতীয় জন তোমার স্বামী।”
হাকিম তাঁর‘
মুসতাদরাক’
গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ১২৯ পৃষ্ঠায় হযরত আলীর প্রশংসা বর্ণনায় সারীজ ইবনে ইউনুস হতে এবং তিনি আবু হাফস আবার হতে,তিনি আ’
মাশ হতে,তিনি আবু সালেহ হতে,তিনি আবু হুরাইরা হতে বর্ণনা করেছেন,“
হযরত ফাতিমা রাসূল (সা.)-কে প্রশ্ন করলেন : হে আল্লাহর নবী! আমাকে আলীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন অথচ সে দরিদ্র এবং তার কোন সম্পদ নেই। রাসূল বললেন : তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে মহান আল্লাহ্ পৃথিবীবাসীদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে দু’
ব্যক্তিকে মনোনীত করলেন যার একজন তোমার পিতা এবং অপর জন তোমার স্বামী।”
ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করা হয়েছে তখন রাসূল (সা.) ফাতিমাকে বলেন,“
তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও,তোমাকে এমন ব্যক্তির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করছি যে সর্বপ্রথম মুসলমান,সকল মুসলমান হতে জ্ঞানী আর তুমি আমার উম্মতের নারীদের নেত্রী যেমন মরিয়ম তাঁর সময়ের নারীদের নেত্রী ছিলেন। হে ফাতিমা! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও,মহান আল্লাহ্ পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি দিলেন এবং এর অধিবাসীদের মধ্য হতে দু’
ব্যক্তিকে মনোনীত করলেন যার একজন তোমার পিতা আর অপর জন তোমার স্বামী।”
এরপর হতে বিশ্ব নারীনেত্রী হযরত ফাতিমার ওপর যে কোন বিপদ ও মুসিবতই আপতিত হত রাসূল (সা.) তাঁকে আল্লাহ্ প্রদত্ত এই নিয়ামতের (তাঁর উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ) কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিতেন।
এরূপ একটি ঘটনা আহমাদ তাঁর‘
মুসনাদ’
গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২৬ পৃষ্ঠায় মা’
কাল ইবনে ইয়াসার হতে বর্ণনা করেছেন,“
নবী (সা.) একবার হযরত ফাতিমার অসুস্থতার সময় তাঁকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন : কেমন আছ? তিনি জবাব দিলেন : আল্লাহর শপথ,প্রচণ্ড দুঃখ ও কষ্টের মধ্যে নিমজ্জিত আছি। আমার অসুস্থতা দীর্ঘ ও কষ্ট শেষ সীমায় পৌঁছেছে। নবী (সা.) বললেন : তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে আমি তোমাকে ইসলাম গ্রহণে সকল মুসলমানের অগ্রগামী,সর্বাধিক জ্ঞানী এবং ধৈর্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধৈর্যবান ও সহিষ্ণু ব্যক্তির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেছি?”
এ সম্পর্কিত হাদীস এত অধিক যে এ পত্রে তার উল্লেখ সম্ভব নয়।
ওয়াসসালাম
শ