বিরাশিতম পত্র
৩০ সফর ১৩৩০ হিঃ
ইজমা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং বিভেদও দূর হয় নি।
প্রকাশ্য ও গোপনে হযরত আবু বকরকে সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্মতি এক বিষয় এবং ইজমার মাধ্যমে তাঁর খেলাফত বৈধ হওয়া ভিন্ন এক বিষয়। এ দুই বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক বা শরীয়তগত কোনভাবেই অবিচ্ছেদ্য কোন বিষয় নয়। কারণ হযরত আলী ও তাঁর বংশের পবিত্র ইমামগণ বাহ্যিক ইসলাম পালনকারী শাসকগোষ্ঠী ও প্রসিদ্ধ মাজহাবগুলোর বিপক্ষে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন এবং আমরাও তাতে বিশ্বাসী। আপনার প্রশ্নের জবাবে এ পন্থা নিয়ে আলোচনা করছি।
মুসলিম উম্মাহকে বিচ্ছিন্নতা হতে রক্ষা করা,এর সমস্যা সমাধান,সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য হুকুমতের (শাসনকার্যের) প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই হুকুমত শাসক ও নিবেদিতপ্রাণ জনসাধারণ ব্যতীত প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। এ প্রেক্ষিতে যদি এই হুকুমতের প্রকৃত অধিকারী ও শরীয়তসম্মত উত্তরাধিকারী আল্লাহর পক্ষ হতে মনোনীত নবীর সঠিক স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তির হাতে অর্পণ করা সম্ভব হয় তাহলে তা সর্বোত্তম এবং সেক্ষেত্রে এমন ব্যক্তির আনুগত্য মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরয ও তিনি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তিকে সে পদে অধিষ্ঠিত করা অপরাধ বলে গণ্য।
কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়,বরং এমন ব্যক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় যে (অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে এবং কোন অবস্থায়ই এর প্রকৃত দাবীদারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজী নয় কিন্তু সে) ইসলামের বিধিবিধান কার্যকর করে ও ইসলামী দায়িত্ব পালন করে এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট ও বিভেদের সৃষ্টি করে ফলে ইসলাম হুমকির সম্মুখীন হয় তবে মুসলিম উম্মাহর ওপর ফরয হলো যে সকল বিষয় ইসলামের সম্মান ও মর্যাদার সাথে সম্পর্কিত সে সকল বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করা এবং ইসলামের ভিত্তিকে মজবুত ও এর সীমাকে সংরক্ষণের জন্য তার পৃষ্ঠপোষকতা করা। এক্ষেত্রে মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট করে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ঐক্যকে বিভেদে পরিণত করা অবৈধই শুধু নয়,বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য ওয়াজিব হলো তার সাথে ন্যায়ত খলীফার মত আচরণ করা । তাকে ভূমি কর ও রাজস্ব (খারাজ),চতুষ্পদ জন্তু ও ফসলের যাকাত দেয়া যাবে,তার সাথে ক্রয়-বিক্রয়,দান,সদকা,উপহার বিনিময় করা যাবে। যারা তার নিকট থেকে খারাজভুক্ত জমি গ্রহণ করে তারা বাৎসরিক নির্দিষ্ট কর দিবে। ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের ওপর আরোপিত এ দায়িত্ব থেকে তারা অব্যাহতি পাবে। এক্ষেত্রে সে সত্যপন্থী ও মনোনীত ইমামগণের অনুসরণের ন্যায় দায়িত্ব পালন করছে। তাই হযরত আলী (আ.) ও তাঁর পরবর্তী পবিত্র ইমামগণ এ পন্থাই তাঁদের সাথে অবলম্বন করতেন।
নবী (সা.) বলেছেন,“
অতি শীঘ্রই আমার পর স্বৈরাচারী ও অবৈধ শাসকবর্গকে দেখবে যারা অপরিচিত।”
বলা হলো : হে রাসূল! আমাদের সময়ে তাদের আগমন ঘটলে আমরা কি করবো? তিনি বললেন,“
তোমাদের দায়িত্ব তোমরা পালন করবে এবং আল্লাহর কাছে চাইবে তারা যেন তোমাদের অধিকার দান করে।”
কারণ যদি তা করা না হয় তাহলে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে ও হুমকির সম্মুখীন হবে।
হযরত আবু যর গিফারী (রা.) প্রায়ই বলতেন,“
আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমাকে ওসিয়ত করে গিয়েছেন শ্রবণ ও আনুগত্য করতে যদি সে হাত-পা কাটা ক্রীতদাসও হয়।”
সালামা জো’
ফী জানতে চাইলেন,“
হে রাসূলাল্লাহ্! যদি এমন ব্যক্তিবর্গ আমাদের ওপর শাসক হয় যারা আমাদের অধিকার দেয় না,তাদের বিষয়ে আমরা কি করবো?”
তিনি বললেন,“
শ্রবণ কর এবং আনুগত্য কর। তারা তাদের কর্মের প্রতিফল বহন করবে,তোমরাও তোমাদের কর্মের।”
হুজাইফা ইবনে ইয়ামান রাসূল (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“
আমার পর এমন ব্যক্তিবর্গ শাসক হবে যারা আমার পথে হেদায়েতপ্রাপ্ত নয় এবং আমার পর সুন্নাহর ওপর আমল করবে না। তাদের চারিদিকে এমন লোকেরা সমবেত হবে যাদের হৃদয় শয়তানের ন্যায় কিন্তু চেহারা মানুষের ন্যায়।”
হুজাইফা বলেন,“
যদি আমরা সে সময় উপস্থিত থাকি তাহলে কি করবো?”
তিনি বললেন,“
শ্রবণ কর ও আনুগত্য কর। যদিও (সে) তোমাদের চাবুক দ্বারা প্রহার করে ও তোমাদের সম্পদ কেড়ে নেয়।”
হযরত উম্মে সালামাহ্ নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেছেন,“
আমার পর তোমাদের ওপর এমন শাসকবর্গ আসবে যাদের কোন কোন কর্ম দেখবে উত্তম,কোন কোন কর্ম অন্যায়। যে কেউ তাদের অন্যায় কর্ম বুঝতে পারবে ও সঠিক সময়ে অসৎ কর্ম হতে বিরত রাখার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবে তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে;যারা তাদের অস্বীকার করার ক্ষমতা রাখে ও অস্বীকার করে তারাও মুক্তি পাবে।”
বলা হলো : আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও যুদ্ধ করবো না? তিনি বললেন,“
ততক্ষণ পর্যন্ত নয় যতক্ষণ তারা নামায পড়ে।”
এ বিষয়ে নবীর পবিত্র আহলে বাইত হতে মুতাওয়াতির সূত্রে হাদীসসমূহ বর্ণিত হয়েছে। এ কারণেই আহলে বাইতের ইমামগণ স্বয়ং ধৈর্যধারণ করেছেন যদিও তাঁদের চোখে কাঁটা ও গলায় হাড় বিদ্ধ হবার মত অবস্থা হয়েছিল। নবী (সা.) বিশেষভাবে তাঁদের এ বিষয়ে ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন যে,সকল প্রকার নির্যাতনের পরও ইসলাম ও উম্মতকে রক্ষার তাগিদে তাঁরা যেন কাঁটাবিদ্ধ চোখ বন্ধ করে রাখেন। তাই তাঁরাও তাঁদের অধিকার হৃত হবার পরও এ সকল শাসকের বিরুদ্ধে সে মোতাবেক কাজ করেছেন। এটি তাঁদের নিকট তিক্ত রস হজমের মত বিষয় হলেও তা মেনে নিয়ে সত্য ও উন্নতির পথের দিকে শাসকদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এরূপ শাসকদের ক্ষমতারোহণ তাঁদের হৃদয়ে ধারালো ছুরি বিদ্ধ হবার মত হলেও ঐশী নির্দেশ ও প্রতিশ্রুতি পালনের শরীয়তগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক অপরিহার্য দায়িত্ব হিসেবে তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ দুই বিপরীতমুখী দায়িত্বের অধিকতর গুরুত্বের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ কারণেই আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে প্রথম তিন খলীফাকে নিষ্ঠার সাথে পরামর্শ দিতেন ও সর্বাত্মকভাবে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা দিতে চেষ্টা করতেন। কেউ প্রথম তিন খলীফার শাসনামলে হযরত আলীর ভূমিকা নিয়ে পর্যালোচনা করলে দেখবেন রাসূল (সা.) ওফাতের পর যখন তিনি খেলাফতের অধিকার পাবেন না বলে নিশ্চিত হলেন তখন ক্ষমতাসীন শাসকদের সাথে সমঝোতা ও সহযোগিতার পথ বেছে নিলেন। রাসূল (সা.) হতে তাঁর ওপর অর্পিত নেতৃত্বের দায়িত্ব অন্যের দ্বারা হৃত হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন নি। দীন ও মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা এবং আখেরাতকে দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি নিজ অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হতে পিছিয়ে আসেন। তখন তিনি দু’
টি বিপদ ও সমস্যার মধ্যে ছিলেন যেরূপ অন্য কেউ ছিল না।
একদিকে তাঁর খেলাফতের পক্ষে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বাণী ও প্রতিশ্রুতিসমূহ তাঁকে করুণস্বরে তাদের দিকে আহবান করছিল। সে আহবান হৃদয়কে রক্তাক্ত ও অন্তরকে দগ্ধ করছিল। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত বিদ্রোহী ও শত্রুদের অপতৎপরতার ফলে আরব উপদ্বীপে প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি ও ইসলাম হুমকির সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা ছিল। মদীনার যে সকল মুনাফিক নিফাকের মধ্যে চরমভাবে নিমজ্জিত ছিল ও মদীনার চারপাশে বসবাসকারী মুনাফিক যারা কুফর ও নিফাকের ক্ষেত্রে অন্য সকল হতে কঠোর ছিল (কোরআনের ভাষায় ঈমান তাদের মুখে রয়েছে,অন্তরে প্রবেশ করে নি) তারা ইসলামের নির্দেশ অস্বীকারের সুযোগ খুঁজছিল। আরব ভূ-খণ্ডের তৎকালীন অবস্থা এতটা আশঙ্কাজনক ছিল যে,সে অবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে ইসলামী সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যেত ও এর কোন অস্তিত্বই থাকত না। এ রকম অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল এজন্য যে,রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর এরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল এবং মুসলমানরা অন্ধকার রাত্রিতে পথ হারা মেষপালের ন্যায় হয়ে পড়েছিল যারা হিংস্র ও ভয়ঙ্কর নেকড়ের (ঐ সব কাফির ও মুনাফিকদের আক্রমণের মুখে পড়েছিল) হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। মুসাইলামা কায্যাব (ভণ্ড নবী),মিথ্যাবাদী তালহা বিন খালেদ,প্রতারক সাবাহ্ বিনতে হারেস ও তাদের সঙ্গী-সাথী ইসলামকে ধ্বংস ও মুসলমানদের নিশ্চি
হ্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল এবং এদের সাথে যুক্ত ছিল আরো একদল যারা তাদের অন্তরে নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতা পোষণ করত এবং ইসলামকে ভিন্ন এক দৃষ্টিতে দেখত। যে বিভিন্ন দলের কথা আমরা উল্লেখ করলাম তারা ইসলামের ভিত্তি উৎপাটনের মাধ্যমে যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করে মানসিক প্রশান্তি পেতে চাচ্ছিল এবং এজন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিল। রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর তারা পরিস্থিতি তাদের অনুকূল মনে করে দ্রুত সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলামের শক্তি কেন্দ্রীভূত হবার পূর্বেই আঘাত হানতে চেয়েছিল।
আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) একদিকে খেলাফতের ঘোষণার আহবান,অন্যদিকে তৎকালীন প্রতিকূল অবস্থা (যা ইসলামের ধ্বংসের সম্ভাবনা ডেকে এনেছিল)- এ উভয় দিক বিবেচনা করে নিজ অধিকারকে ইসলামের প্রাণের জন্য উৎসর্গ করাকেই শ্রেয় মনে করেন ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কল্যাণকে তাঁর ওপর অগ্রাধিকার দেন। সুতরাং হযরত আবু বকরের সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব ইসলামের সংরক্ষণ ও মুসলিম সমাজের ঐক্য রক্ষার তাগিদে আপাতঃপ্রশমিত হয়। এ উদ্দেশ্যে স্বয়ং আলী (আ.) সহ নবীর আহলে বাইতের সকল সদস্য এবং মুহাজির ও আনসারদের মধ্য হতে তাঁদের বন্ধু ও অনুসারীরা তখন ধৈর্য অবলম্বন করেছিলেন যদিও তাঁদের চক্ষুতে কণ্টক এবং গলায় হাড় বিদ্ধ হয়েছিল। রাসূলের ওফাতের পর হতে নিজ শাহাদাত পর্যন্ত তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য এ সত্যকেই সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে। নবীর আহলে বাইত সূত্রে এ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির।
কিন্তু আনসারদের প্রধান সা’
দ ইবনে উবাদা প্রথম দুই খলীফার কারো সাথেই সমঝোতা করেন নি,ঈদ ও জুমআর নামাযসহ কোন নামাযের জামাতেই তাঁদের সাথে অংশ গ্রহণ করেন নি,তাঁদের নির্দেশনাসমূহ পালন করেন নি,নিষেধসমূহ শ্রবণ করেন নি। অবশেষে দ্বিতীয় খলীফার শাসনামলে তাঁকে সিরিয়ায় গুপ্ত হত্যা করে প্রচার করা হয় জ্বিনরা তাঁকে হত্যা করেছে। তিনি সাকীফায় ও তার পরবর্তীতেও খেলাফতের বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন যা এখানে উল্লেখের প্রয়োজন মনে করছি না।
(*২৬)
সা’
দের সহযোগীদের মধ্যে হাব্বাব ইবনে মুনযির ও অন্যান্য আনসারদের জোরপূর্বক মাথা নত করানো
ও বাইয়াত নেয়া হয়। তরবারীর ও আগুনে পোড়ানোর ভয়
দেখিয়ে নেয়া বাইয়াতকে ঈমান ও বিশ্বাসের বাইয়াত বলা যায় কি? এটি কি ইজমার নমুনা হবে? এ অবস্থায় কি আমরা রাসূলের এ হাদীসটিلا تجتمع أمّتي على الخطأ
(আমার উম্মত ভুলের ওপর একত্রিত হবে না) দলিল হিসেবে উপস্থাপন করতে পারব? আপনিই এ বিষয়ে ফয়সালা দিন। এর প্রতিদানও আপনার জন্যই।
ওয়াসসালাম
শ