নব্বইতম পত্র
১৭ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ
উসামার সেনাদল
উচ্চৈঃস্বরে সত্যের বাণী প্রচারে যদি মানুষের সমালোচনার ভয় না করেন তবে সত্যই আপনার কথা যথার্থ। আপনি প্রকৃতই বৃক্ষের এক দৃঢ় ও ফলদায়ক শাখা। মানুষ আপনার নিকট আশ্রয় পেতে পারে এবং আপনার কথাও বিশ্বাস করতে পারে,আপনার মত পেলে অন্যদের মতের তারা মুখাপেক্ষী হবে না যেহেতু আপনি সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশ্রিত করেন না,আপনার সম্মান উচ্চ ও হৃদয় পবিত্র। আপনার আত্মিক পবিত্রতা আপনাকে কলুষতা হতে দূরে রেখেছে। আল্লাহ্ আপনাকে সম্মানিত করুন। আপনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন অন্যান্য যে সকল ক্ষেত্রে সাহাবীগণ নিজ মতকে নবী (সা.)-এর নির্দেশের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন সেগুলো উল্লেখ করার। এর উল্লেখযোগ্য দলিল হিসেবে রাসূলের জীবদ্দশায় প্রেরিত সর্বশেষ সেনাদল যা রোমানদের উদ্দেশ্যে উসামা ইবনে যাইদ ইবনে হারেসার নেতৃত্বে প্রেরিত হয়েছিল সে সম্পর্কে বর্ণনা করছি। নবী (সা.) এ সেনাদল প্রেরণের বিষয়টিতে খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং এজন্য সাহাবীদের প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। নবী (সা.) স্বয়ং সাজসরঞ্জাম ও প্রস্তুতির বিষয়টি তদারকের মাধ্যমে তাঁদের মনোবলকে দৃঢ় করছিলেন। নবী (সা.) আনসার ও মুহাজেরদের সকলকেই,এমন কি হযরত আবু বকর,উমর,
আবু উবাইদাকেও সেনাদলের সঙ্গে যাত্রার নির্দেশ দেন। একাদশ হিজরীর সফর মাসের ২৫ তারিখে এ ঘটনা ঘটেছিল।
ঐদিন প্রভাতে নবী (সা.) উসামাকে ডেকে বললেন,“
তোমার পিতার শাহাদাত স্থানের দিকে অশ্ব নিয়ে রওয়ানা হও। তোমাকে এ সেনাদলের দায়িত্ব দিলাম।
উবনার
অধিবাসীদের ওপর প্রত্যুষে আক্রমণ করে তাদের অবরোধ কর। তাদের নিকট এ হামলার খবর পৌঁছার পূর্বেই দ্রুত সেখানে পৌঁছাও। যদি তাদের ওপর জয়ী হও তাহলে সেখানে স্বল্পদিন অবস্থান কর। যাত্রার সময় অভিজ্ঞ ও পথ চেনে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে নাও। অগ্রগামী সৈন্যদের সঙ্গে পূর্বেই পাহারাদার ও গুপ্তচরদের প্রেরণ কর। ২৮ সফর নবী (সা.)-এর আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা লোপ পেল এবং তিনি প্রচণ্ড মাথা ব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হলেন। ২৯ তারিখে তিনি লক্ষ্য করলেন সেনাদল তাঁর নির্দেশের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করছে। এজন্য স্বয়ং সেনাদলের মধ্যে গিয়ে তাঁদের উৎসাহিত করলেন। তাঁদের মনোবলকে দৃঢ় ও উজ্জীবিত করার জন্য নিজ হাতে পতাকা বেঁধে উসামার হাতে দিয়ে বললেন,“
আল্লাহর নামে তাঁর পথে যুদ্ধ কর এবং সকল কাফিরকে ঐ এলাকা হতে বহিষ্কার কর।”
উসামা পতাকা হাতে মদীনা হতে বের হয়ে বুরাইদার হাতে অর্পণ করেন ও‘
জুরফে’
ছাউনি ফেলার নির্দেশ দেন। যদিও নবী (সা.) তাঁদেরকে যাত্রার জন্য উপর্যুপরি তাকিদ দিয়েছিলেন তদুপরি তাঁরা নবীর নির্দেশ অমান্য করে সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। নবী (সা.) তাঁদের বলেছিলেন,‘
প্রত্যুষে উবনার অধিবাসীদের ওপর আক্রমণ কর। দ্রুত যাত্রা কর যাতে আক্রমণস্থলে খবর পৌঁছার পূর্বেই পৌঁছাতে পার’
অথচ অবশ্য পালনীয় ও সুস্পষ্ট এ নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁরা তা পালন করেন নি। নবী (সা.)-এর এ নির্দেশ হতে অবশ্যই তাঁরা ফরয ও ওয়াজিব বুঝেছিলেন,মুস্তাহাব নয়।
সাহাবীদের অনেকেই উসামার সেনাপ্রধান মনোনয়নের বিষয়টিকে উপহাস করেছেন যেমন মুতার যুদ্ধের সময় উসামার পিতা যাইদকে সেনানায়ক মনোনয়নের বিষয়টিকেও উপহাস ও নবীর নিকট এর তীব্র প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। এক্ষেত্রেও যখন নবী (সা.) সেনাদলের দায়িত্ব উসামার ওপর অর্পণ করে বললেন‘
এই সেনাদলের দায়িত্ব তোমার হাতে অর্পণ করলাম ও তোমাকে সেনাপতি মনোনীত করলাম’
এবং অসুস্থ শরীরে পতাকা বেঁধে তাঁর হাতে দিলেন তখনও তাঁরা এর প্রতিবাদ করতে লাগলেন। নবী (সা.) তাঁদের এ আচরণে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়ে প্রচণ্ড অসুস্থতা
সত্ত্বেও (শরীরে প্রচণ্ড জ্বর ও মাথা ব্যথা এবং মাথায় জ্বরপট্টি বাঁধা ছিল) গৃহ হতে বের হয়ে এসে তাঁদেরকে এ কর্ম হতে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। এ ঘটনাটি ১০ রবিউল আউয়াল নবী (সা.)-এর ওফাতের দু’
দিন পূর্বে ঘটে। তিনি ঘরে হতে বের হয়ে মসজিদের মিম্বারে গেলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর বললেন,“
হে লোকসকল! উসামার সেনাপতিত্বের বিষয়ে এটি কিরূপ কথা যা আমার কানে পৌঁছেছে? এখন তোমরা তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছ,ইতোপূর্বে তোমরা তার পিতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছিলে। তার পিতা যেরূপ সেনাপতিত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল সেও অনুরূপ সেনাপতিত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন।”
অতঃপর নবী (সা.) তাঁদের যাত্রার জন্য তাকিদ দিলেন এবং সেনাদল জুরফের দিকে যাত্রা করল।
নবী (সা.) চরম অসুস্থতার সময়ও বারংবার বলছিলেন,“
উসামার সেনাদলকে সুসজ্জিত হতে বল,তাকে যাত্রা করতে বল,দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছতে বল।”
তদুপরি যাত্রার ক্ষেত্রে তাঁরা গড়িমসি করতে থাকেন। ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার উসামা সেনা ছাউনী হতে রাসূলের সঙ্গে দেখা করতে আসলে রাসূল তাঁকে আল্লাহর রহমত ও সাহায্যের আশা দিয়ে যাত্রা করার জন্য পুনঃনির্দেশ দিলেন। এ দিনই রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করেন। উসামা নবীকে বিদায় জানিয়ে গিয়েও পরে আবু উবাইদা ও হযরত উমরকে নিয়ে ফিরে আসলেন। সেনাদলও মদীনার নিকটবর্তী তিবায় ফিরে আসল। তাঁরা আবু বকরের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধযাত্রা হতে বিরত থাকবেন যদিও তাঁরা এ বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর পুনঃ পুনঃ তাকিদ,দ্রুত যাত্রার নির্দেশ,শত্রু অবহিত হবার পূর্বেই ঐ স্থানে পৌঁছানো ও আক্রমণের নির্দেশ শুনেছিলেন। তাঁরা দেখেছেন এ বিষয়ে রাসূলের পক্ষে যা করা সম্ভব তার সবটুকুই তিনি করেছেন। সেনাদলকে সুসজ্জিত করা,উসামাকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান,স্ব হস্তে তাঁর হাতে পতাকা অর্পণ এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও যাত্রার জন্য নির্দেশ প্রদান সবই করেছেন। রাসূলের মৃত্যুর পর আবু বকর ব্যতীত সকলেই সেনাদলের যাত্রা মূলতবী করার পক্ষে ছিলেন। যখন তাঁরা দেখলেন আবু বকর সেনা প্রেরণের বিষয়ে অনঢ় তখন উমর ইবনে খাত্তাব আনসারদের মাধ্যমে উসামাকে অপসারণের পরামর্শ দেন ও বলেন অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করুন। অথচ কয়েকদিনও অতিবাহিত হয় নি নবী (সা.) উসামার সেনাপতিত্বের বিষয়ে প্রতিবাদের কারণে তাঁদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে মাথায় জ্বরপট্টি বাঁধা অবস্থায় শরীরের প্রচণ্ড উত্তাপসহ মাটিতে পা টেনে টেনে মিম্বারে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন‘
হে লোকসকল! এটি কিরূপ কথা তোমরা উসামার সেনাপতিত্বের বিষয়ে বলছ? তোমরা ইতোপূর্বে তার পিতার বিষয়েও অনুরূপ কথা বলেছিলে। আল্লাহর শপথ,যাইদ সেনাপতি পদের জন্য উপযুক্ত ছিল আর তার পুত্রও সে পদের জন্য যোগ্য’
। লক্ষ্য করুন নবী (সা.) এখানে আল্লাহর শপথ করে বিশেষ্য পদ দিয়ে শুরু করে তাকিদের জন্য তাকিদের লাম(لام التّأكيد)
ও কসম ব্যবহার করেছেন
(وأيم الله إن كان لخليقا بالامارة و إن ابنه من بعده لخليق بِها)
এজন্য যাতে তাঁরা মন হতে বিদ্বেষ দূর করেন। কিন্তু তাঁরা এ বিদ্বেষ অন্তরে পোষণ করে রেখেছিলেন এবং নবীর ইন্তেকালের পর উসামাকে অপসারণের দাবী তুলেছিলেন কিন্তু খলীফা তাঁদের দাবী প্রত্যাখ্যান করে তাঁকে বহাল রাখেন। সেনাদলের যাত্রা মূলতবী করার পরামর্শও তিনি গ্রহণ করেন নি। এ বিষয়ে তাঁরা এতটা বাড়াবাড়ি করেন যে,খলীফা আবু বকর হযরত উমরকে বলেন,“
হে খাত্তাবের পুত্র! তোমার মাতার তোমার জন্য ক্রন্দন করা উচিত কারণ নবী (সা.) তাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছেন আর তুমি আমাকে বলছ তাকে পদচ্যুত করতে?”
অতঃপর তাঁদের আপত্তি সত্ত্বেও সেনাদল যাত্রা করল। এক হাজার আরোহীসহ মোট তিন হাজার সেনার বাহিনী নিয়ে উসামা যাত্রা করেন। যে সকল ব্যক্তিকে রাসূল ঐ সেনাদলের সঙ্গে যাত্রা করতে বলেছিলেন তাঁদের অনেকেই এ সেনাদলের সঙ্গে যাত্রা হতে বিরত থাকেন অথচ নবী (সা.) বলেছিলেন,“
যে উসামার সেনাদলের সঙ্গে যাত্রা হতে বিরত থাকবে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক।”
আপনি অবগত আছেন যে,তাঁরা প্রথম বারেও যাত্রা করতে বিলম্ব করেন এবং দ্বিতীয় বারে যাত্রা হতে বিরত থাকেন। নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে তাঁরা সুন্নাহর ওপর নিজস্ব প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দানকে অধিকতর লাভজনক মনে করেছেন। যেহেতু তাঁরা দেখেছেন নবীর নির্দেশ মত তাঁর মৃত্যুর পূর্বে সেনাদলের সঙ্গে যাত্রা করলে খেলাফত তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যাবে সেহেতু নবীর নির্দেশ অমান্য করে তাঁরা বিলম্ব করেন যদিও উসামার যাত্রা পরবর্তীতে মূলতবী হয় নি।
মহানবী (আমার পিতামাতা তাঁর জন্য উৎসর্গীকৃত) চেয়েছিলেন এ সকল ব্যক্তি হতে মদীনাকে মুক্ত রেখে শান্তিপূর্ণ ও নিশ্চয়তার সাথে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে খেলাফত অর্পণ করতে যাতে করে তাঁরা ফিরে আসার পূর্বেই তাঁর খেলাফত দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা ফিরে এসে কোন গোলযোগ সৃষ্টি করতে না পারেন। ১৭ বছরের উসামার হাতে রাসূল (সা.) সেনাপতিত্বের দায়িত্ব এজন্য অর্পণ করেছিলেন যাতে তাঁদের মধ্যকার কিছু আত্মগর্বী ও অহঙ্কারী ব্যক্তির গর্ব চূর্ণ হয় ও ক্ষমতার কেন্দ্রে তাঁদের হতে যুবক কোন ব্যক্তিকে অধিষ্ঠিত করলেও মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং কোন মন্দ আচরণ ও বিশৃঙ্খলার জন্মদান না করতে পারেন। তাঁরা এটি বুঝতে পেরেই উসামার বিষয়ে আপত্তি তুলতে থাকেন ও তাঁর সঙ্গে যাত্রায় গড়িমসি করতে থাকেন এবং এ অবস্থায়ই রাসূল (সা.) তাঁর প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।
তাঁরা কখনো যুদ্ধ প্রস্তুতি বন্ধের,কখনোও বা পতাকা খুলে ফেলা,কখনো উসামাকে অপসারণের চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের অনেকেই উসামার সেনাদল হতে ফিরে আসেন।
সুতরাং উসামার সেনাদল প্রেরণের এ ঘটনাতেই পাঁচটি ক্ষেত্রে তাঁরা নবী (সা.)-এর নির্দেশ পালন হতে বিরত থাকেন এবং এরূপ রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে তাঁরা নিজ মত অনুযায়ী কাজ করতেন,নবীর সুন্নাহর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতেন না।
ওয়াসসালাম
শ