বিরানব্বইতম পত্র
২২ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ
১। আমাদের বক্তব্যের সঙ্গে তাঁদের ব্যাখ্যার কোন সংঘর্ষ ও বৈপরীত্য নেই।
২। শাহরেস্তানী হতে আমরা যে হাদীসটি বর্ণনা করেছি তা মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
১। আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থ রাখুন। আপনি নবী (সা.)-এর দ্রুত যাত্রার নির্দেশ সত্ত্বেও উসামার সেনাদলের সঙ্গে যাত্রায় তাঁদের অনীহা ও জুরফে যাত্রাবিরতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন ও মেনে নিয়েছেন যে,তাঁরা উসামার সেনাপতিত্বের বিষয়ে রাসূলের বক্তব্য ও বাস্তব ভূমিকার পরও আপত্তি উত্থাপন করেছেন। আপনি এও মেনে নিয়েছেন উসামার নেতৃত্বের বিষয়ে আপত্তি তোলায় রাসূল তাঁদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি এতটা তীব্র ছিল যে,অসুস্থ ও উত্তপ্ত শরীরে মাথায় পট্টি বাঁধা অবস্থায় গৃহ হতে বের হয়ে মিম্বারে যান ও এ কর্মের জন্য তাঁদের সমালোচনা করেন যা একটি ঐতিহাসিক সত্য। এ বক্তব্যে রাসূল (সা.) সেনাপতিত্বের ক্ষেত্রে উসামার যোগ্যতার বিষয়টিকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁরা খলীফা আবু বকরের নিকট তাঁর অপসারণের দাবী জানান।
আপনি আরো স্বীকার করেছেন নবীর নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁরা খলীফার নিকট সেনা প্রেরণ স্থগিত করার দাবী জানান। নবী কর্তৃক বাঁধা পতাকা তাঁরা খুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁরা দেখেছিলেন তিনি এ বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন এবং এ কারণেই প্রস্তুতি সম্পন্নের পর দ্রুত যাত্রা করতে বলেছিলেন এবং তাঁর উপর্যুপরি তাকিদ হতেও তাঁরা বুঝেছিলেন যে,বিষয়টি অবশ্য পালনীয় (ফরয) [তদুপরি তা পালনে তাঁরা বিরত থাকেন]।
যে সকল ব্যক্তিকে রাসূল (সা.) উসামার নেতৃত্বে যুদ্ধ যাত্রা করতে বলেন ও স্বহস্তে তাঁদের সুসজ্জিত করেন তার অনেকেই সে সেনাদলের সাথে যাত্রা করেন নি এটিও আপনি স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে হাদীস লেখক,হাফিয ও মুহাদ্দিসগণ একমত পোষণ করেছেন।
কিন্তু আপনি বলেছেন তাঁরা এক্ষেত্রে ক্ষমার যোগ্য। কারণ নবীর বক্তব্য ও নির্দেশ নয়,বরং তাঁদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের জন্য অধিকতর কল্যাণকর ছিল। এজন্যই তাঁরা নবী (সা.)-এর নির্দেশের ওপর ব্যক্তিগত মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন,এর বাইরে আমরা আর কিছু বলতে পারি না। অন্যভাবে বললে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সাহাবীরা কোরআন ও সুন্নাহর সকল নির্দেশ মেনে চলতেন কি না? আপনার মত ছিল তাঁরা সমগ্র কোরআন ও সুন্নাহর ওপর আমল করতেন কিন্তু আমরা বলেছি না,সকল ক্ষেত্রে তাঁরা তা করতেন না। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনার স্বীকারোক্তিসমূহ আমাদের কথাকেই প্রমাণ করে। তাই বিষয়টিতে তাঁরা ক্ষমার যোগ্য ছিলেন কি না তা আমাদের আলোচনা বহির্ভূত।
যখন আপনার নিকট এটি প্রমাণিত হয়েছে তাঁরা উসামার সেনাদলের বিষয়ে নিজ মতকে সুস্পষ্ট সুন্নাহর ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন তখন নবী (সা.)-এর পর খেলাফতের বিষয়টিতেও আমরা কি একই কথা বলতে পারি না যে,ইসলামের কল্যাণে গাদীর ও অন্যান্য স্থানে বর্ণিত নবীর নির্দেশের ওপর নিজ মতকে নবীর পর খেলাফতের জন্য তাঁরা অধিকতর উপযুক্ত মনে করেছেন?
যে সকল ব্যক্তি প্রবীণতার কারণে যুবক উসামার নেতৃত্বকে মেনে নেন নি তাঁদের পক্ষে যুক্তি হিসেবে আপনি বলেছেন প্রকৃতিগতভাবেই বৃদ্ধ ও প্রবীণরা তরুণদের নেতৃত্ব ও আনুগত্যে যেতে চায় না। যদি তাই হয় তবে অপেক্ষকৃত তরুণ আলীর নেতৃত্ব বর্ণনাকারী গাদীরের সুন্নাহকেও তাঁরা (বয়োবৃদ্ধরা) মেনে নেবেন না এটিই স্বাভাবিক,নয় কি? কারণ সুস্পষ্ট বর্ণনামতে উসামাকে সেনাদলের নেতৃত্বের জন্য তাঁরা যেরূপ যুবক মনে করেছিলেন নবীর মৃত্যুর পর ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের জন্য অনুরূপ আলীকেও তরুণ ভেবেছিলেন। একটি সেনাদলের নেতৃত্ব এবং সকলের ওপর নেতৃত্বের মধ্যে অনেক পার্থক্য। যখন তাঁদের প্রকৃতিই এরূপ যে,কয়েকদিনের এক যুদ্ধের জন্য এক তরুণের নেতৃত্বকে তাঁরা মেনে নিতে পারেন না তখন সমগ্র জীবনের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ এক ব্যক্তিকে তাঁরা কিভাবে মেনে নেবেন?
কিন্তু সাধারণ প্রবীণ মানসিকতা সামগ্রিকভাবে তরুণ নেতৃত্ব মেনে নেয় না বলে যে দাবী করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়,কারণ যে সকল প্রবীণ ঈমানের পূর্ণতায় পৌঁছেছেন তাঁরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পথে যে কোন তরুণের নেতৃত্বকে নির্দ্বিধায় মেনে নেন। শুধু তরুণদের আনুগত্যের বিষয়েই নয়,বরং আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে যে কোন বিষয়েই তাঁরা অনুগত যেমনটি কোরআন বলেছে,
)
فلا و ربِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتّى يحَكّمُوك فيما شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِم حَرَجاً مِّمَّا قَضَيْتَ وَ يُسَلِّمُوا تَسْلِيْمًا(
তোমার প্রভুর শপথ,তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান আনে নি যতক্ষণ না তাদের বিরোধপূর্ণ বিষয়ে তারা তোমাকে বিচারক মনোনীত করবে। অতঃপর তুমি যা ফয়সালা দেবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোন কষ্ট থাকবে না ও পূর্ণ আনুগত্য করবে।
অন্যত্র বলেছে,
)
وَما آتاكُم الرَّسُول فَخُذُوه وَما نَهاكُم عَنْه فانْتَهوا(
এবং রাসূল যা তোমাদের দেন তা গ্রহণ কর এবং যা হতে নিষেধ করেন তা হতে বিরত হও।
২। যাঁরা উসামার সেনাদল হতে বিরত থাকার ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে শাহরেস্তানী হাদীসটি কোন সনদ ছাড়া বর্ণনা করেছেন বলে আপনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আবু বকর আহমাদ ইবনে আবদুল আযীয জাওহারী তাঁর‘
আসসাকিফা’
গ্রন্থে সনদসহ হাদীসটি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা এখানে উল্লেখ করছি,“
হামিদ ইবনে ইসহাক ইবনে সালিহ্,আহমাদ ইবনে সাইয়ার হতে,তিনি সাঈদ ইবনে কাসির আনসারী হতে এবং তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুর রহমান হতে বর্ণনা করেছেন,“
নবী (সা.) তাঁর সর্বশেষ অসুস্থতার সময় (যাতে তাঁর মৃত্যু হয়) উসামা ইবনে যাইদকে সকল আনসার ও মুহাজিরের ওপর নেতা মনোনীত করেন। এ সেনাদলে হযরত আবু বকর,উমর,আবু উবাইদা জাররাহ্,আবদুর রহমান ইবনে আউফ,তালহা এবং যুবাইরও ছিলেন। অতঃপর নবী (সা.) উসামাকে নির্দেশ দেন তাঁর পিতার শাহাদাতস্থল মুতায় হামলা করার এবং ফিলিস্তিনে পৌঁছার। কিন্তু উসামা এ যাত্রায় অলসতা প্রদর্শন করে বিলম্ব করেন,তাঁর সেনাদলও তদ্রুপ করে। এ অবস্থায় নবীর অসুস্থতা কখনো বৃদ্ধি পাচ্ছিল কখনো কম হচ্ছিল। তিনি তখনও সেনাদলের যাত্রার বিষয়ে তাকিদ দিতে থাকলে উসামা বললেন : আমার পিতামাতা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত। আপনি কয়েকদিন বিলম্বের অনুমতি দেবেন কি যাতে আল্লাহ্ আপনাকে আরোগ্য দান করেন? তিনি (সা.) বললেন : আল্লাহর অনুগ্রহসহ যাত্রা কর। উসামা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার অবস্থা এরূপ সঙ্গীন হওয়া সত্ত্বেও কি আমি যাত্রা করবো অথচ মদীনা হতে বের হতে আমার হৃদয় কষ্ট পাচ্ছে। তিনি বললেন : বিজয় ও সমৃদ্ধির দিকে (ক্ষমার দিকে) যাত্রা কর।
উসামা পুনরায় বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য এটি কঠিন যে,আপনার অবস্থা পথিকদের নিকট জানব অথচ আপনি এ অবস্থায় শায়িত থাকবেন। নবী (সা.) তাঁকে বললেন : আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিয়েছি সে অনুযায়ী কাজ কর। এই বলে রাসূল অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। উসামা নবীর গৃহ হতে বের হয়ে মদীনা হতে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগল। নবীর জ্ঞান ফিরে আসলে উসামার সেনাদল সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। বলা হলো তারা যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পুনঃপুনঃ বলছিলেন : উসামার সেনাদলকে যাত্রা করতে বল। যে ব্যক্তি উসামার সেনাদলের সঙ্গে যাত্রার নির্দেশ পেয়ে যাবে না তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। উসামা যাত্রা শুরু করলেন,সাহাবীরাও তাঁর সামনে-পেছনে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং জুরফে পৌঁছে তাঁরা ছাউনী ফেললেন। হযরত আবু বকর,উমরসহ অধিকাংশ মুহাজির তাঁর সঙ্গে ছিলেন,আনসারদের হতেও উসাইদ ইবনে খুজাইর,বাশির ইবনে সা’
দসহ প্রায় সকলেই ছিলেন। জুরফে উম্মে আইমান উসামাকে খবর দিলেন যে,রাসূল মৃত্যুবস্থায় রয়েছেন,মদীনায় ফিরে চল। উসামা দ্রুত যাত্রা করে মদীনায় পৌঁছলেন। তিনি পতাকা নবীর গৃহের দরজায় যখন বাঁধছিলেন ঠিক তখনই রাসূল (সা.) দুনিয়া হতে বিদায় নেন।”
এ হাদীসটি আল্লামাহ্ ইবনে আবিল হাদীদ তাঁর‘
শারহে নাহজুল বালাগাহ্’
-এর দ্বিতীয় খণ্ডের ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।
ওয়াসসালাম
শ