আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত0%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত

লেখক: আল্লামাহ্ সাইয়্যেদ আবদুল হুসাইন শারাফুদ্দীন আল মুসাভী
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ:

ভিজিট: 66893
ডাউনলোড: 8915

পাঠকের মতামত:

আল মুরাজায়াত
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 66893 / ডাউনলোড: 8915
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

বিরানব্বইতম পত্র

২২ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

১।   আমাদের বক্তব্যের সঙ্গে তাঁদের ব্যাখ্যার কোন সংঘর্ষ ও বৈপরীত্য নেই।

২।   শাহরেস্তানী হতে আমরা যে হাদীসটি বর্ণনা করেছি তা মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

১। আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থ রাখুন। আপনি নবী (সা.)-এর দ্রুত যাত্রার নির্দেশ সত্ত্বেও উসামার সেনাদলের সঙ্গে যাত্রায় তাঁদের অনীহা ও জুরফে যাত্রাবিরতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন ও মেনে নিয়েছেন যে,তাঁরা উসামার সেনাপতিত্বের বিষয়ে রাসূলের বক্তব্য ও বাস্তব ভূমিকার পরও আপত্তি উত্থাপন করেছেন। আপনি এও মেনে নিয়েছেন উসামার নেতৃত্বের বিষয়ে আপত্তি তোলায় রাসূল তাঁদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি এতটা তীব্র ছিল যে,অসুস্থ ও উত্তপ্ত শরীরে মাথায় পট্টি বাঁধা অবস্থায় গৃহ হতে বের হয়ে মিম্বারে যান ও এ কর্মের জন্য তাঁদের সমালোচনা করেন যা একটি ঐতিহাসিক সত্য। এ বক্তব্যে রাসূল (সা.) সেনাপতিত্বের ক্ষেত্রে উসামার যোগ্যতার বিষয়টিকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁরা খলীফা আবু বকরের নিকট তাঁর অপসারণের দাবী জানান।

আপনি আরো স্বীকার করেছেন নবীর নির্দেশ সত্ত্বেও তাঁরা খলীফার নিকট সেনা প্রেরণ স্থগিত করার দাবী জানান। নবী কর্তৃক বাঁধা পতাকা তাঁরা খুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। যদিও তাঁরা দেখেছিলেন তিনি এ বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিলেন এবং এ কারণেই প্রস্তুতি সম্পন্নের পর দ্রুত যাত্রা করতে বলেছিলেন এবং তাঁর উপর্যুপরি তাকিদ হতেও তাঁরা বুঝেছিলেন যে,বিষয়টি অবশ্য পালনীয় (ফরয) [তদুপরি তা পালনে তাঁরা বিরত থাকেন]।

যে সকল ব্যক্তিকে রাসূল (সা.) উসামার নেতৃত্বে যুদ্ধ যাত্রা করতে বলেন ও স্বহস্তে তাঁদের সুসজ্জিত করেন তার অনেকেই সে সেনাদলের সাথে যাত্রা করেন নি এটিও আপনি স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে হাদীস লেখক,হাফিয ও মুহাদ্দিসগণ একমত পোষণ করেছেন।

কিন্তু আপনি বলেছেন তাঁরা এক্ষেত্রে ক্ষমার যোগ্য। কারণ নবীর বক্তব্য ও নির্দেশ নয়,বরং তাঁদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের জন্য অধিকতর কল্যাণকর ছিল। এজন্যই তাঁরা নবী (সা.)-এর নির্দেশের ওপর ব্যক্তিগত মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন,এর বাইরে আমরা আর কিছু বলতে পারি না। অন্যভাবে বললে আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সাহাবীরা কোরআন ও সুন্নাহর সকল নির্দেশ মেনে চলতেন কি না? আপনার মত ছিল তাঁরা সমগ্র কোরআন ও সুন্নাহর ওপর আমল করতেন কিন্তু আমরা বলেছি না,সকল ক্ষেত্রে তাঁরা তা করতেন না। সুতরাং এক্ষেত্রে আপনার স্বীকারোক্তিসমূহ আমাদের কথাকেই প্রমাণ করে। তাই বিষয়টিতে তাঁরা ক্ষমার যোগ্য ছিলেন কি না তা আমাদের আলোচনা বহির্ভূত।

যখন আপনার নিকট এটি প্রমাণিত হয়েছে তাঁরা উসামার সেনাদলের বিষয়ে নিজ মতকে সুস্পষ্ট সুন্নাহর ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন তখন নবী (সা.)-এর পর খেলাফতের বিষয়টিতেও আমরা কি একই কথা বলতে পারি না যে,ইসলামের কল্যাণে গাদীর ও অন্যান্য স্থানে বর্ণিত নবীর নির্দেশের ওপর নিজ মতকে নবীর পর খেলাফতের জন্য তাঁরা অধিকতর উপযুক্ত মনে করেছেন?

যে সকল ব্যক্তি প্রবীণতার কারণে যুবক উসামার নেতৃত্বকে মেনে নেন নি তাঁদের পক্ষে যুক্তি হিসেবে আপনি বলেছেন প্রকৃতিগতভাবেই বৃদ্ধ ও প্রবীণরা তরুণদের নেতৃত্ব ও আনুগত্যে যেতে চায় না। যদি তাই হয় তবে অপেক্ষকৃত তরুণ আলীর নেতৃত্ব বর্ণনাকারী গাদীরের সুন্নাহকেও তাঁরা (বয়োবৃদ্ধরা) মেনে নেবেন না এটিই স্বাভাবিক,নয় কি? কারণ সুস্পষ্ট বর্ণনামতে উসামাকে সেনাদলের নেতৃত্বের জন্য তাঁরা যেরূপ যুবক মনে করেছিলেন নবীর মৃত্যুর পর ইসলামী রাষ্ট্রের খেলাফতের জন্য অনুরূপ আলীকেও তরুণ ভেবেছিলেন। একটি সেনাদলের নেতৃত্ব এবং সকলের ওপর নেতৃত্বের মধ্যে অনেক পার্থক্য। যখন তাঁদের প্রকৃতিই এরূপ যে,কয়েকদিনের এক যুদ্ধের জন্য এক তরুণের নেতৃত্বকে তাঁরা মেনে নিতে পারেন না তখন সমগ্র জীবনের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ এক ব্যক্তিকে তাঁরা কিভাবে মেনে নেবেন?

কিন্তু সাধারণ প্রবীণ মানসিকতা সামগ্রিকভাবে তরুণ নেতৃত্ব মেনে নেয় না বলে যে দাবী করেছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়,কারণ যে সকল প্রবীণ ঈমানের পূর্ণতায় পৌঁছেছেন তাঁরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের পথে যে কোন তরুণের নেতৃত্বকে নির্দ্বিধায় মেনে নেন। শুধু তরুণদের আনুগত্যের বিষয়েই নয়,বরং আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে যে কোন বিষয়েই তাঁরা অনুগত যেমনটি কোরআন বলেছে,

) فلا و ربِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتّى يحَكّمُوك فيما شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِم حَرَجاً مِّمَّا قَضَيْتَ وَ يُسَلِّمُوا تَسْلِيْمًا(

তোমার প্রভুর শপথ,তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান আনে নি যতক্ষণ না তাদের বিরোধপূর্ণ বিষয়ে তারা তোমাকে বিচারক মনোনীত করবে। অতঃপর তুমি যা ফয়সালা দেবে সে বিষয়ে তাদের মনে কোন কষ্ট থাকবে না ও পূর্ণ আনুগত্য করবে।

অন্যত্র বলেছে,

) وَما آتاكُم الرَّسُول فَخُذُوه وَما نَهاكُم عَنْه فانْتَهوا(

এবং রাসূল যা তোমাদের দেন তা গ্রহণ কর এবং যা হতে নিষেধ করেন তা হতে বিরত হও।

২। যাঁরা উসামার সেনাদল হতে বিরত থাকার ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন তাঁদের মধ্যে শাহরেস্তানী হাদীসটি কোন সনদ ছাড়া বর্ণনা করেছেন বলে আপনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আবু বকর আহমাদ ইবনে আবদুল আযীয জাওহারী তাঁর আসসাকিফা গ্রন্থে সনদসহ হাদীসটি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তা এখানে উল্লেখ করছি, হামিদ ইবনে ইসহাক ইবনে সালিহ্,আহমাদ ইবনে সাইয়ার হতে,তিনি সাঈদ ইবনে কাসির আনসারী হতে এবং তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে আবদুর রহমান হতে বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) তাঁর সর্বশেষ অসুস্থতার সময় (যাতে তাঁর মৃত্যু হয়) উসামা ইবনে যাইদকে সকল আনসার ও মুহাজিরের ওপর নেতা মনোনীত করেন। এ সেনাদলে হযরত আবু বকর,উমর,আবু উবাইদা জাররাহ্,আবদুর রহমান ইবনে আউফ,তালহা এবং যুবাইরও ছিলেন। অতঃপর নবী (সা.) উসামাকে নির্দেশ দেন তাঁর পিতার শাহাদাতস্থল মুতায় হামলা করার এবং ফিলিস্তিনে পৌঁছার। কিন্তু উসামা এ যাত্রায় অলসতা প্রদর্শন করে বিলম্ব করেন,তাঁর সেনাদলও তদ্রুপ করে। এ অবস্থায় নবীর অসুস্থতা কখনো বৃদ্ধি পাচ্ছিল কখনো কম হচ্ছিল। তিনি তখনও সেনাদলের যাত্রার বিষয়ে তাকিদ দিতে থাকলে উসামা বললেন : আমার পিতামাতা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত। আপনি কয়েকদিন বিলম্বের অনুমতি দেবেন কি যাতে আল্লাহ্ আপনাকে আরোগ্য দান করেন? তিনি (সা.) বললেন : আল্লাহর অনুগ্রহসহ যাত্রা কর। উসামা বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার অবস্থা এরূপ সঙ্গীন হওয়া সত্ত্বেও কি আমি যাত্রা করবো অথচ মদীনা হতে বের হতে আমার হৃদয় কষ্ট পাচ্ছে। তিনি বললেন : বিজয় ও সমৃদ্ধির দিকে (ক্ষমার দিকে) যাত্রা কর।

উসামা পুনরায় বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমার জন্য এটি কঠিন যে,আপনার অবস্থা পথিকদের নিকট জানব অথচ আপনি এ অবস্থায় শায়িত থাকবেন। নবী (সা.) তাঁকে বললেন : আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিয়েছি সে অনুযায়ী কাজ কর। এই বলে রাসূল অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। উসামা নবীর গৃহ হতে বের হয়ে মদীনা হতে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগল। নবীর জ্ঞান ফিরে আসলে উসামার সেনাদল সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। বলা হলো তারা যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) পুনঃপুনঃ বলছিলেন : উসামার সেনাদলকে যাত্রা করতে বল। যে ব্যক্তি উসামার সেনাদলের সঙ্গে যাত্রার নির্দেশ পেয়ে যাবে না তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। উসামা যাত্রা শুরু করলেন,সাহাবীরাও তাঁর সামনে-পেছনে অগ্রসর হতে লাগলেন এবং জুরফে পৌঁছে তাঁরা ছাউনী ফেললেন। হযরত আবু বকর,উমরসহ অধিকাংশ মুহাজির তাঁর সঙ্গে ছিলেন,আনসারদের হতেও উসাইদ ইবনে খুজাইর,বাশির ইবনে সা দসহ প্রায় সকলেই ছিলেন। জুরফে উম্মে আইমান উসামাকে খবর দিলেন যে,রাসূল মৃত্যুবস্থায় রয়েছেন,মদীনায় ফিরে চল। উসামা দ্রুত যাত্রা করে মদীনায় পৌঁছলেন। তিনি পতাকা নবীর গৃহের দরজায় যখন বাঁধছিলেন ঠিক তখনই রাসূল (সা.) দুনিয়া হতে বিদায় নেন।

এ হাদীসটি আল্লামাহ্ ইবনে আবিল হাদীদ তাঁর শারহে নাহজুল বালাগাহ্ -এর দ্বিতীয় খণ্ডের ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।

ওয়াসসালাম

তিরানব্বইতম পত্র

২৩ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

এরূপ অন্যান্য ঘটনাও উপস্থাপনের আহবান।

বৃহস্পতিবারের শোকাবহ ঘটনার বর্ণনার মত উসামার সেনাদলের যাত্রার বর্ণনাটিও দীর্ঘ হলো। যা হোক এটি সত্যানুসন্ধানীদের জন্য দিনের আলো উদ্ভাসিত করে অস্পষ্টতা দূর করেছে। অনুগ্রহপূর্বক অন্য যে সকল ক্ষেত্রে তাঁরা কোরআন ও সুন্নাহ্ অনুযায়ী আমল করেন নি তার উল্লেখ করুন।

ওয়াসসালাম

চুরানব্বইতম পত্র

২৫ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

ফিতনার উদ্গাতাকে হত্যার জন্য রাসূলের নির্দেশ অমান্য

উম্মতের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ,নেতা ও হাফিযদের হতে বর্ণিত এ সম্পর্কিত উদ্ধৃতিসমূহ এ বিষয়ে যথেষ্ট। এ সম্পর্কিত আহমাদ ইবনে হাম্বলের মুসনাদের ৩য় খণ্ডের ১৫ পৃষ্ঠা হতে বর্ণনা করছি যা আবু সাঈদ খুদরী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে।

তিনি বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু বকর রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! আমি অমুক নাম ও চিহ্নের স্থান অতিক্রম করার সময় অত্যন্ত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখেছি। সেখানে এক ব্যক্তি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নামায পড়ছিল। নবী (সা.) তাঁকে বললেন : যাও তাকে হত্যা কর। আবু বকর সেখানে গিয়ে তাকে নামাযরত অবস্থায় দেখেন। তাঁর মন চাইল না তাকে হত্যা করতে,তাই তিনি ফিরে আসলেন। রাসূল (সা.) তা দেখে হযরত উমরকে বললেন : যাও ঐ ব্যক্তিকে হত্যা কর। হযরত উমরও গিয়ে তাকে সেই অবস্থায় দেখে হত্যা হতে বিরত হলেন। তিনি ফিরে এসে রাসূলকে বললেন : তাকে পূর্ণ বিনয় ও মনোযোগের সঙ্গে নামায পড়তে দেখে হত্যা করা হতে বিরত হলাম।

নবী (সা.) আলীকে বললেন : যাও তাকে হত্যা কর। হযরত আলী (আ.) সেখানে গিয়ে তাকে না পেয়ে ফিরে এসে নবীকে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল! তাকে দেখলাম না। নবী বললেন : ঐ ব্যক্তি ও তার অনুসারীরা কোরআন পাঠ করবে কিন্তু এ পাঠ তাদের জিহ্বার কম্পনেই সীমিত,তা তাদের অন্তরে প্রবেশ করবে না। তীর যেমন ধনুক হতে বিচ্ছিন্ন হয় তেমনি তারা আল্লাহর দীন হতে বিচ্ছিন্ন হবে এবং কখনোই ফিরে আসবে না। এদের হত্যা কর কারণ পৃথিবীর ওপর এরা সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি।

ইবনে হাজারের আল ইসাবাহ্ গ্রন্থের যু সাদিয়ার জীবনী হতে আবু ইয়ালী তাঁর মুসনাদে আনাস ইবনে মালিক হতে বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এক ব্যক্তির ইবাদত-বন্দেগী আমাদের সকলকে আশ্চর্যান্বিত করত। আমরা বিষয়টি নবীর নিকট উপস্থাপন করে ঐ ব্যক্তির নাম,পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করলে তিনি চিনলেন না। ঠিক এ সময় সেই ব্যক্তি উপস্থিত হলে আমরা নবীকে বললাম : এই সেই ব্যক্তি। রাসূলুল্লাহ্ তখন বললেন : তোমরা আমাকে এমন ব্যক্তির বর্ণনা দিচ্ছিলে যার চেহারায় শয়তানের চি হ্ন সুস্পষ্ট। ঐ ব্যক্তি আরো নিকটবর্তী হয়ে সাহাবীদের নিকট দণ্ডায়মান হলো কিন্তু কাউকেই সালাম দিল না। নবী (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন : তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি,যখন তুমি এখানে উপস্থিত হও তখন তোমার মনে কি এটি আসে নি যে,এ সভায় তোমার চেয়ে উত্তম কোন ব্যক্তি উপস্থিত নেই? সে উত্তর দিল : হ্যাঁ। অতঃপর সে ভেতরে প্রবেশ করে নামযরত হল। নবী বললেন : কে এই ব্যক্তিকে হত্যা করবে? আবু বকর বললেন : আমি। এ বলে তিনি তার নিকট গিয়ে দেখলেন সে নামাযে দাঁড়িয়েছে। তিনি নিজে নিজে বললেন : সুবহানাল্লাহ্ (আল্লাহ্ পবিত্র),আমি কি এমন ব্যক্তিকে হত্যা করবো যে নামায পড়ে? তিনি ফিরে এলে নবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন : তাকে হত্যা করেছ? তিনি বললেন : যেহেতু আপনি নামাযীদের হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাই তাকে নামাযরত দেখে হত্যা করি নি।৫০০ নবী পুনরায় বললেন : কে ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করতে রাজী আছ? উমর বললেন : আমি । অতঃপর তিনি গিয়ে ঐ ব্যক্তিকে সিজদারত অবস্থায় দেখে নিজেকে বললেন : আবু বকর আমার চেয়ে উত্তম,তিনি তাকে হত্যা করেন নি,আমি কিরূপে তা করবো? এ কথা বলে ফিরে আসলে নবী প্রশ্ন করলেন : কি হয়েছে? তিনি বললেন : আমি গিয়ে দেখলাম সে মাটিতে সিজদারত অবস্থায় রয়েছে,তাই মন চাইল না তাকে হত্যা করতে। নবী (সা.) বললেন : কে তাকে হত্যা করতে রাজী আছ? আলী বললেন : আমি। রাসূল তাঁকে বললেন : যদি তাকে পাও। আলী সেস্থানে গিয়ে তাকে পেলেন না। তিনি ফিরে এলে রাসূল তাঁর নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে আলী বললেন : তাকে পেলাম না। রাসূল বললেন : যদি ঐ ব্যক্তি নিহত হত তবে আমার উম্মতের মধ্যে কোনদিনই এখতেলাফ (বিভেদ) হত না।

এই হাদীসটি হাফিয মুহাম্মদ ইবনে মূসা সিরাজী তাঁর গ্রন্থে ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান,মাকাতিল ইবনে সুলাইমান,ইউসুফ কাত্তান,কাসেম ইবনে সালাম,মাকাতিল ইবনে হায়ান,আলী ইবনে র্হাব্,সা দী,মুজাহিদ,কাতাদাহ্,ওয়াকী ও ইবনে জারিহ্ হতে বর্ণনা করেছেন। বিশিষ্ট আলেমদের কয়েকজন,যেমন শাহাবুদ্দীন আহমাদ যিনি ইবনে আবদে রাব্বিহি আন্দালুসী বলে প্রসিদ্ধ তাঁর আকদুল ফারিদ গ্রন্থের ১ম খণ্ডে আসহাবে আহওয়ার আলোচনায় এ ঘটনাটিকে প্রতিষ্ঠিত বলেছেন। তিনি এ ঘটনার শেষে রাসূল (সা.) হতে বলেছেন, এই ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম বিদ্রোহী হবে। যদি তোমরা তাকে হত্যা করতে তবে দুই ব্যক্তি আমার পর এখতেলাফ করত না। বনি ইসরাঈল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল,আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। তাদের একদল ব্যতীত সবাই জাহান্নামী হবে। ৫০১

কাছাকাছি বর্ণনায় হযরত আলী হতে সুনান লেখকগণও এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন,৫০২ যেমন বর্ণিত হয়েছে- কুরাইশ গোত্রের একদল ব্যক্তি নবী (সা.)-এর নিকট এসে বলল, হে মুহাম্মদ! আমরা তোমার প্রতিবেশী ও সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ। আমাদের কিছু দাস তোমার নিকট পালিয়ে এসেছে,তারা না দীনের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে,না জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি,তারা শুধু আমাদের বাগান ও সম্পদ দেখাশোনার কাজ হতে বাঁচার জন্য তোমাদের নিকট আশ্রয় নিয়েছে। তুমি তাদেরকে আমাদের নিকট ফিরিয়ে দাও। নবী (সা.) আবু বকরকে বললেন, এ ব্যাপারে তুমি কি বল? তিনি বললেন, হ্যাঁ,এরা আপনার প্রতিবেশী এবং সত্য বলেছে। এ কথা শুনে নবীর রং পরিবর্তিত হয়ে গেল। অতঃপর নবী উমরকে বললেন, তুমি কি বল? তিনি বললেন, হ্যাঁ,তারা সত্য বলেছে,তারা আপনার প্রতিবেশী ও চুক্তিবদ্ধ। নবীর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম,আল্লাহ্ তোমাদের (কুরাইশ) সঙ্গে যুদ্ধের জন্য এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যার অন্তরকে আল্লাহ্ ঈমান দ্বারা পরীক্ষা করেছেন। সে দীনের পথে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আবু বকর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, না। উমর বললেন, আমি কি সেই ব্যক্তি? তিনি বললেন, না। সে ব্যক্তি এখন জুতা সেলাই করছে। উল্লেখ্য নবী (সা.) তাঁর জুতা সেলাই করার জন্য আলী (আ.)-কে দিয়েছিলেন।

ওয়াসসালাম

পঁচানব্বইতম পত্র

২৬ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

ফিতনার উদ্গাতাকে হত্যা না করার কারণ

সম্ভবত আবু বকর ও উমর নবী (সা.)-এর নির্দেশ হতে তার হত্যাকে মুস্তাহাব মনে করেছিলেন অর্থাৎ তাঁরা এ কাজটিকে ওয়াজিব মনে করেন নি বা ওয়াজিব মনে করলেও ওয়াজিবে কেফায়ী মনে করেছেন,তাই হত্যা হতে নিবৃত্ত থাকেন। যেহেতু তাঁরা মনে করেছেন অন্য সাহাবীরা এ কাজটি করতে পারবেন সেহেতু ওয়াজিব হলেও তা সম্পন্ন হবে। আর সে ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে যাবে যার ফলে হত্যার কাজটি সম্পন্ন হবে না তা তাঁরা ভাবেন নি। কারণ ঐ ব্যক্তি এ বিষয়ে অবহিত ছিল না।

ওয়াসসালাম

ছিয়ানব্বইতম পত্র

২৯ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

এ যুক্তির বিপক্ষে জবাব

আমর বা নির্দেশ মূলত ওয়াজিব বা অপরিহার্যতা বুঝায়। সুতরাং মুস্তাহাব নির্দেশক ব্যতীত তা হতে মুস্তাহাব বোঝা ঠিক নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয়টিতে মুস্তাহাব নির্দেশক কিছু ছিল না,বরং এমন নির্দেশনা ছিল যা ওয়াজিব ও অপরিহার্যতা অর্থ দেয়। অনুগ্রহপূর্বক এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোতে যথার্থ দৃষ্টি দিন। তখন আমাদের বক্তব্যকেই সত্যায়ন করবেন। বিশেষত এ বাক্যটি এই ব্যক্তি ও তার অনুসারীরা কোরআন পাঠ করে কিন্তু এই পঠন তাদের অন্তরে স্থান লাভ করে না;যেরূপ তীর ধনুক হতে বিচ্ছিন্ন হলে আর ফিরে আসে না সেরূপ তারা দীন থেকে বেরিয়ে গিয়ে কখনোও ফিরে আসবে না। তারা জমীনের ওপর নিকৃষ্ট সৃষ্টি,তাদেরকে হত্যা কর হতে আমরা উজুব বা অপরিহার্যতাই বুঝি। রাসূল (সা.) আরো বলেছিলেন এ ব্যক্তি যদি নিহত হত তাহলে আমার উম্মতের দুই ব্যক্তির মধ্যে বিভেদ হত না - এ বাক্যটিও তাকে হত্যার অপরিহার্যতা ও তাকিদই বুঝায়।

মুসনাদে আহমাদের হাদীসটিতে লক্ষ্য করলে দেখবেন হত্যার নির্দেশ প্রথমে বিশেষভাবে আবু বকরের ওপর ছিল। পরে উমরের প্রতিও বিশেষভাবে তা আরোপিত হয়। তাই বিষয়টি ওয়াজিবে কেফায়ী হতে পারে না।

হাদীসটিতে স্পষ্ট এসেছে তাঁরা ঐ ব্যক্তিকে বিনয়ের সাথে নামাযরত দেখায় তাকে হত্যা করা হতে বিরত হলেন অর্থাৎ নবীর নির্দেশের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে নিজ ইচ্ছানুযায়ী তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন। এখানেও তাঁরা নিজ ইচ্ছাকে নবীর নির্দেশের ওপর প্রাধান্য দেন। এটি কোরআন ও সুন্নাহর ওপর ব্যক্তিগত মতের প্রাধান্য দানের অন্যতম নমুনা।

ওয়াসসালাম

সাতানব্বইতম পত্র

৩০ রবিউল আউয়াল ১৩৩০ হিঃ

এরূপ অন্যান্য বিষয়ও আলোচনার আহবান।

অনুগ্রহপূর্বক এরূপ অন্যান্য বিষয়ের উল্লেখ করুন। যদি তাতে পত্র দীর্ঘ হয় তবুও কোন কিছু অবশিষ্ট রাখবেন না।

ওয়াসসালাম

আটানব্বইতম পত্র

৩ রবিউস সানী ১৩৩০ হিঃ

১।   এরূপ কয়েকটি বিষয়।

২।   অনুরূপ আরো বিষয়সমূহ।

১। হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনা,হুনাইন যুদ্ধের গণীমত,বদরের য্দ্ধুবন্দীদের ফিদিয়া (মুক্তিপণ গ্রহণ) আদায়,তাবুকের যুদ্ধের সময় অনাহারের কারণে বেশ কিছু উট জবাইয়ের জন্য রাসূলের নির্দেশ অমান্য,উহুদের যুদ্ধের ঘটনা (যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন), যে কেউ তাওহীদের ঈমান নিয়ে আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে সে বেহেশতের সুসংবাদ পাবে - আবু হুরাইরার এ ঘোষণা বর্ণনার দিন,মুনাফিকের ওপর নামায পড়া (জানাযার নামায),সদকার বিষয়ে বিতর্ক ও রুক্ষতার সঙ্গে প্রশ্ন উত্থাপন,যাকাত ও খুমসের আয়াতের অর্থের বিকৃতি,হজ্বে তামাত্তু ও মুতা বিয়ের বিধান পরিবর্তন,তালাকের আয়াতের বিধান পরিবর্তন,রমযান মাসের নফল নামায (তারাবীহ্) সম্পর্কিত সুন্নাহর পরিমাণ ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন সাধন,আযানের বাণীতে পরিবর্তন,হাইয়া আলা খাইরিল আমালকে আযান হতে বাদ দেয়া,জানাযার নামাযের তাকবীরের সংখ্যা হ্রাস এরূপ অসংখ্য বিষয় রয়েছে যা এ ক্ষুদ্র পত্রে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এছাড়া হাতেব ইবনে বালতাআর ঘটনায় বিরোধিতা,মাকামে ইবরাহীমের স্থান পরিবর্তন,বনি হাশিমের সম্পত্তি জোরপূর্বক মসজিদের আওতাভুক্ত করা,আবু খারাশ হাজলীর রক্তপণের ক্ষেত্রে ইয়ামানীদের প্রতি অবিচার,নাসর ইবনে হাজ্জাজ সালামীর নির্বাসন,জো দা ইবনে সালিমের ওপর হাদ্দ জারী৫০৩ ,ইরাক ভূ-খণ্ডে খারাজ প্রবর্তন,জিজিয়া আদায়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন,শুরা গঠনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব,রাত্রিতে মানুষের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে শরীয়তের সীমা লঙ্ঘন,দিনে অনুসন্ধান ও গুপ্তচরবৃত্তি,উত্তরাধিকার আইনে নিজ মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত প্রদান। এ বিষয়গুলোতে তাঁরা কোরআন ও সুন্নাহর বিধান হতে নিজ মত জনসাধারণের জন্য অধিকতর কল্যাণময় মনে করে তদনুযায়ী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

আমরা সাবিলুল মুমিনীন গ্রন্থে এ বিষয়গুলোতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।৫০৪ (*২৭)

২। হযরত আলীর খেলাফত এবং রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইত সংক্রান্ত হাদীসসমূহ ছাড়াও অন্যান্য সুন্নাহ্,হাদীস ও রেওয়ায়েত অনুযায়ী তাঁরা কাজ করেন নি,বরং এর বিপরীত ভূমিকাই পালন করেছেন। সুতরাং এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,খেলাফতের বিষয়টিতেও তাঁরা সুন্নাহর ওপর নিজ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ বিষয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই যে,খেলাফতের ক্ষেত্রে নবী (সা.)-এর সুন্নাহ্ এরূপ অন্যান্য বিষয়ের মত অকার্যকর রয়ে গিয়েছিল ও ব্যক্তিগত মত সুন্নাহর ওপর প্রাধান্য লাভ করেছিল।

ওয়াসসালাম

নিরানব্বইতম পত্র

৫ রবিউস সানী ১৩৩০ হিঃ

১।   তাঁরা এ সকল বিষয়ে সাধারণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতেন।

২।   এরূপ অন্যান্য বিষয়গুলোও আলোচনা করুন।

১। কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই তাঁদের সৎ উদ্দেশ্যের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করবেন না। কারণ তাঁরা জানেন এই ব্যক্তিবর্গ সাধারণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দিতেন। তাঁরা এমন পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টায় রত ছিলেন যা মুসলিম উম্মাহর জন্য অধিকতর কল্যাণকর ও সহজ হয় এবং উম্মাহর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। তাই তাঁরা যে সকল কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন তাতে কোন ত্রুটিই নেই,হোক সে বিষয়ে তাঁরা কোরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিধান অনুসারে ফয়সালা দিয়ে থাকেন অথবা নিজস্ব ব্যাখ্যা ও মতানুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

২। আপনার প্রতি আহবান জানিয়েছি যে সকল বিষয়ে তাঁরা কোরআন ও সুন্নাহর মত অনুযায়ী চলেন নি তার সবগুলোই বর্ণনা করার। আপনি তার আংশিক বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে,ইমাম ও আহলে বাইত সম্পর্কে খেলাফতের প্রসঙ্গ ব্যতীত অন্যান্য প্রসঙ্গেও হাদীসসমূহ ছিল যার ওপর পূর্ববর্তীগণ আমল করেন নি। যদি অনুগ্রহপূর্বক সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ দিতেন এবং উপর্যুপরি এ আহবান হতে আমাকে নিবৃত্ত করতেন।

ওয়াসসালাম