একশতম পত্র
৮ রবিউস সানী ১৩৩০ হিঃ
১। আলোচনার কেন্দ্র পরিত্যাগ।
২। আহবান গ্রহণ।
১। আপনি স্বীকার করেছেন যে সকল বিষয়ের উল্লেখ আমরা করেছি তাতে তাঁরা হস্তক্ষেপ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ্,আমাদের কথাকে সত্যায়ন করেছেন। এখন তাঁদের এ কর্মের পেছনে সৎ উদ্দেশ্য,সাধারণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দান,উম্মতের জন্য সর্বোত্তম পথ গ্রহণ,ইসলামের শক্তি ও সম্মান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা প্রভৃতি বিষয় ছিল কি না তা আমাদের আলোচনার বহির্ভূত বিষয়। আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় তাঁরা এ সকল বিষয়ে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ্ অনুযায়ী আমল করেছেন কি করেন নি? কিন্তু কেন তা করেন নি তা আমাদের আলোচনার কেন্দ্র বহির্ভূত।
২। আপনার সর্বশেষ পত্রে হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে যে সকল সহীহ হাদীস আহলে সুন্নাহ্ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে কিন্তু সাহাবীগণ তদনুযায়ী আমল করেন নি বা সেগুলোকে উপেক্ষা করেছেন তা আলোচনা করার আহবান জানিয়েছেন। আপনি স্বয়ং সুন্নাহ্ ও হাদীসের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের বিশেষজ্ঞদের নেতা এবং হাদীস সংকলন অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণে দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর শ্রম দিয়ে আসছেন। তাই আমি কি করে ভাবতে পারি যে সকল বিষয় আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করেছি আপনি সে সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত নন? কে আমাদের ইশারাকৃত ঐ সকল বিষয়ে নিজকে আপনার হতে অধিকতর জ্ঞানী মনে করতে পারে? আহলে সুন্নাহর আলেমদের মধ্যে আপনার সমপর্যায়ের অন্য কেউ রয়েছেন কি? অবশ্যই নেই।
তাই বিস্তারিত আলোচনার জন্য আপনার যে আহবান তাকে আমরা এ বাক্যটির নমুনা মনে করছি যে,‘
কত অধিক প্রশ্নকারী রয়েছে যারা এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত’
।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন,অনেক সাহাবীই হযরত আলী (আ.)-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন এবং তাঁর সঙ্গে শত্রুতা করে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। তাঁরা আলী (আ.)-কে কষ্ট ও অপবাদ দিতেন,তাঁর প্রতি অবিচার করতেন,তাঁকে মন্দ বলা ও গালি দেয়াকে নিজেদের জন্য অপরিহার্য কর্ম মনে করতেন,এমন কি কেউ কেউ আলী (আ.),তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের বিরুদ্ধে অস্ত্রও ধারণ করেছেন। হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থসমূহ এর সাক্ষী।
অথচ নবী (সা.) বলেছেন,“
যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করেছে সে আল্লাহর আনুগত্য করেছে,আর যে আমার নির্দেশ অমান্য করেছে সে আল্লাহরই নির্দেশ অমান্য করেছে। যে ব্যক্তি আলীর আনুগত্য করেছে সে আমারই আনুগত্য করেছে। আর যে আলীর নির্দেশ অমান্য করেছে সে আমার নির্দেশই অমান্য করেছে।”
অন্যত্র রাসূল (সা.) বলেছেন,“
যদি কেউ আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয় সে আল্লাহ্ হতে বিচ্ছিন্ন হয় আর যে আলী হতে বিচ্ছিন্ন হয় সে আমা হতেই বিচ্ছিন্ন হয়।”
রাসূল আরো বলেছেন,“
হে আলী! তুমি পৃথিবীতেও যেমনি নেতা আখেরাতেও তেমনি নেতা। তোমার বন্ধু আমারই বন্ধু এবং আমার বন্ধু আল্লাহরই বন্ধু। তোমার শত্রু আমারই শত্রু এবং আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। ধ্বংস সেই ব্যক্তির জন্য যে আমার পর তোমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়।”
তিনি আরো বলেছেন,“
যে ব্যক্তি আলীকে মন্দ বলল (গালি দিল) সে আমাকেই মন্দ বলল,আর যে আমাকে মন্দ বলল সে আল্লাহকেই যেন মন্দ বলল।”
রাসূল (সা.) বলেছেন,“
যে আলীকে কষ্ট দিল সে আমাকেই কষ্ট দিল আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল।”
অন্যত্র নবী বলেছেন,“
যে আলীকে ভালবাসল সে আমাকেই ভালবাসল,আর যে তাকে অপছন্দ করল সে আমাকেই অপছন্দ করল।”
রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে বলেছেন,“
হে আলী! মুমিন ব্যতীত কেউ তোমাকে ভালবাসবে না এবং মুনাফিক ব্যতীত কেউ তোমার প্রতি অন্তরে বিদ্বেষ পোষণ করবে না।”
রাসূল (সা.) বলেছেন,“
হে আল্লাহ্! যে আলীকে ভালবাসে আপনি তাকে ভালবাসুন এবং যে তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে আপনি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করুন। তার সাহায্যকারীকে আপনি সাহায্য করুন। যে তাকে অপমানিত করতে চায় তাকে আপনি অপমানিত করুন।”
একদিন রাসূল (সা.) হযরত আলী,ফাতিমা,ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে লক্ষ্য করে বললেন,“
তোমাদের সঙ্গে যে যুদ্ধ করে আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করি এবং তোমাদের সঙ্গে যে সন্ধি করে আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করি।”
যেদিন রাসূল (সা.) তাঁদের (আহলে বাইত) ওপর আবা (এক প্রকার বস্ত্র) বিছিয়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করেছিলেন সেদিন তিনি বলেছিলেন,“
তাদের সঙ্গে যারা যুদ্ধে লিপ্ত হয় আমি তাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হই,যারা তাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে আমিও তাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করি। তাদের সঙ্গে আমি শত্রুতা পোষণ করি যারা তাদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে।”
এরূপ অধিকাংশ হাদীসই এই সকল সাহাবী গ্রহণ করেন নি,বরং এর বিপরীত আচরণ করেছেন। এক্ষেত্রে নিজ প্রবৃত্তি ও উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে তাঁরা এগুলোকে উপেক্ষা করেছেন। চিন্তাশীল সচেতন ব্যক্তিরা সুনান গ্রন্থসমূহে হযরত আলী (আ.)-এর ফজীলত ও মর্যাদা বর্ণনাকারী হাদীসসমূহ সম্পর্কে অবগত যার সংখ্যা শতাধিক। এ সকল হাদীসে তাঁর আনুগত্যের অপরিহার্যতা ও তাঁর সঙ্গে শত্রুতা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে সুস্পষ্টরূপে। এর প্রতিটিতে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নিকট তাঁর বিশেষ সম্মান,মর্যাদা ও স্থান বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী পত্রসমূহে এর অনেকাংশই আমরা উল্লেখ করেছি তদুপরি অবর্ণিত অংশ এর কয়েক গুণ। আলহামদুলিল্লাহ্,আপনি সুনান গ্রন্থসমূহের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞানের অধিকারী ও এগুলোর ওপর আপনার পূর্ণ দখল রয়েছে। আপনার নিকট প্রশ্ন এর কোনটিতে আলীর প্রতি কটুক্তি ও যুদ্ধ করা বৈধ ঘোষিত হয়েছে কি? এর কোনটিতে তাঁর সঙ্গে শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণ করার কথা বলা হয়েছে কি? এগুলোতে তাঁর অধিকার হরণ,তাঁকে কষ্টে আপতিত করা,তাঁর প্রতি অবিচার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কি? কখনোই নয়। তবে কেন মুসলমানদের মিম্বারে জুমআ ও ঈদের দিনে তাঁর প্রতি লানত ও অভিশাপ বর্ষণ তাঁদের সুন্নাহ্য় পরিণত হয়েছিল? কেন তাঁরা এ সকল হাদীসের বিশুদ্ধতা ও আধিক্যের প্রতি গুরুত্ব দিতেন না? কারণ তাঁরা এ সকল হাদীসকে তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের পরিপন্থী মনে করতেন। তাঁরা উত্তমরূপে জানতেন আলী (আ.) নবীর ভ্রাতা,স্থলাভিষিক্ত,উত্তরাধিকারী,রক্ত সম্পর্কীয়দের নেতা,পরম বন্ধু,তাঁর উম্মতের হারুন (আ.),তাঁর নয়নের মনির জীবনসঙ্গী (ও সমমর্যাদার ব্যক্তি),তাঁর সন্তানদের পিতা,তাঁর ওপর সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী,ইখলাস (নিষ্ঠা)-এর ক্ষেত্রে সকলের ঊর্ধ্বে,সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী,সর্বাধিক আমলকারী,ধৈর্যের ক্ষেত্রে সকলের আদর্শ,ইয়াকীন (দৃঢ় বিশ্বাস)-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে দৃঢ়,দীনের পথে সর্বাধিক কষ্ট সহ্যকারী,ঐশী পরীক্ষায় সর্বোত্তমরূপে উত্তীর্ণ,মর্যাদার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ,দীনের ক্ষেত্রে সকল হতে অগ্রগামী ও প্রথম,ইসলামের ওপর সর্বাধিক দক্ষ,রাসূলের সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী,চরিত্র ও আচরণে রাসূলের সদৃশ,বাণী ও নীরবতার ক্ষেত্রে অনন্য এবং হেদায়েতের নমুনা। তদুপরি তাঁরা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে নিজ ইচ্ছা ও প্রবৃত্তিকে এর ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। সুতরাং এখানে আশ্চর্যের কিছু নেই যে,তাঁরা ইমামতের ক্ষেত্রে গাদীরের হাদীসকে দূরে ঠেলে দেবেন এবং এরূপ অন্যান্য শত হাদীসের ন্যায় গাদীরের হাদীসটিকেও নিজ ইচ্ছানুযায়ী ভিন্নরূপে ব্যাখ্যা করবেন। এটিই স্বাভাবিক,তাঁরা রাসূলের এ বাণী শুনে থাকবেন যে,তিনি (সা.) বলেছেন,“
আমি তোমাদের মাঝে দু’
টি ভারী বস্তু রেখে যাচ্ছি যদি তা তোমরা আঁকড়ে ধর কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না,আল্লাহর কিতাব ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় আহলে বাইত।”
রাসূল (সা.) তাঁদের বলেন,“
আমার আহলে বাইতের উদাহরণ হলো নূহের তরণির ন্যায়। যে তাতে আরোহণ করবে সে মুক্তি পাবে আর যে আরোহণ করবে না সে নিমজ্জিত হবে”
এবং“
আমার আহলে বাইত বনি ইসরাঈলের তওবা ও মুক্তির তোরণের ন্যায়। যে কেউ তাতে প্রবেশ করবে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে”
।
রাসূল (সা.) বলেন,“
আকাশের তারকারা পৃথিবীবাসীদের নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষার উপায়। আমার আহলে বাইতও তদ্রুপ বিভেদ হতে মুক্তির উপায়। তাই আরবদের কোন গোত্র তাদের বিরোধিতা করলে বা তাদের বিষয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে শয়তানের দলে পরিণত হবে।”
পরিশেষে বলা যায় এরূপ সকল সহীহ হাদীসের প্রতি তাঁরা অনুগত ছিলেন না।
ওয়াসসালাম
শ