একশত ছয়তম পত্র
১৮ রবিউস সানী ১৩৩০ হিঃ
১। ইবনে আব্বাসের যুক্তিসমূহ।
২। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উপস্থাপিত দলিল।
৩। রাসূল (সা.)-এর যে সব সাহাবী শিয়া বলে প্রসিদ্ধ তাঁদের উপস্থাপিত দলিল।
৪। মহানবী (সা.)-এর ওসিয়তের বিষয়ে তাঁদের উপস্থাপিত দলিলের প্রতি ইঙ্গিত।
১। এখানে ইবনে আব্বাস ও হযরত উমরের মধ্যে সংঘটিত দীর্ঘ আলোচনার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইবনে আব্বাসকে উমর বললেন,“
তুমি কি জান তোমাদের স্বগোত্রীয়রা কেন তোমাদেরকে তোমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে?”
ইবনে আব্বাস বলেন,“
আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই নি। তাই বললাম : আমীরুল মুমিনীন জানেন। উমর বললেন : নবুওয়াত ও খেলাফত এক গৃহে সমবেত হোক এটি তারা পছন্দ করে নি,কারণ এতে যদি তোমরা অহঙ্কারী ও অতি উৎফুল্ল হয়ে পড়। এজন্য কুরাইশরা খেলাফতকে নিজেদের জন্য নির্ধারণ করে ও তাতে পৌঁছতে সক্ষম হয়।”
ইবনে আব্বাস বলেন,“
যদি আমাকে কিছু বলার অনুমতি দেন তাহলে এ বিষয়ে আপনার ক্রোধকে প্রশমিত করে আমি কিছু বলব। তিনি বললেন : বল।
আমি বললাম : আপনার বক্তব্য অনুযায়ী কুরাইশরা খেলাফতকে নিজেদের জন্য নির্ধারণ করে তাতে পৌঁছতে সফল হয়। এক্ষেত্রে যদি মহান আল্লাহ্ই খেলাফতকে তাদের জন্য মনোনীত করে থাকেন তবে তারা সঠিক কাজটিই করেছে। তাই তাদের প্রতি হিংসা পোষণ করা বা তাদের হতে তা ফিরিয়ে নেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আপনি যে বলছেন তারা চায় নি নবুওয়াত ও খেলাফত এক গৃহে সমবেত হোক যদি তা সঠিক হয়ে থাকে তবে তারা নিম্নোক্ত আয়াতের অন্তর্ভুক্ত যেখানে আল্লাহ্ বলেছেন :(
ذلك بأنّهم كرهوا ما أنْزَلَ الله فأحْبطَ أعمالهم
)
আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তারা তার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল,তাই তিনি তাদের কর্মকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (সূরা-মুহাম্মদঃ৯)
উমর বললেন : আফসোস,হে আব্বাসের পুত্র! তোমার বিষয়ে আমার নিকট কিছু তথ্য এসেছে। আমি চাই না তুমি নিজেই সে বিষয়ে স্বীকারোক্তি করে আমার নিকট তোমার মর্যাদা হারাও। আমি বললাম : বিষয়টি কি? যদি আমি সত্য বলে থাকি তবে আপনার নিকট আমার মর্যাদা হারানো উচিত নয়। যদি অসত্য হয়ে থাকে তবে বলব আমি মিথ্যাকে আমা হতে দূরে সরিয়ে দিয়েছি।
উমর বললেন : আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে,তুমি বলেছ খেলাফতকে বিদ্বেষবশত অন্যায়ভাবে তার প্রকৃত কেন্দ্র হতে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমি বললাম : আপনি বলেছেন অন্যায়ভাবে এটি করা হয়েছে,তা জ্ঞানী ও মূর্খ সকলের নিকটই স্পষ্ট এজন্য যে,হযরত আদমের প্রতিও বিদ্বেষ পোষণ করা হযেছিল এবং আমরা তাঁর সন্তান হিসেবে অন্যদের বিদ্বেষের কারণ হওয়া স্বাভাবিক।
উমর বললেন : বহুদূর,বহুদূর। আল্লাহর শপথ,তোমাদের বনি হাশিমের অন্তরসমূহ বিদ্বেষে পূর্ণ যা কখনো দূর হবার নয়। আমি বললাম : হে আমীরুল মুমিনীন! যে অন্তরসমূহকে মহান আল্লাহ্ অপবিত্রতা ও কলুষতা থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন
সে সম্পর্কে এমন কথা বলবেন না।”
অন্য একবার তাঁদের মধ্যে এ বিষয়ে কথোপকথন হলে উমর ইবনে আব্বাসকে প্রশ্ন করলেন,“
তোমার চাচাতো ভাইয়ের খবর কি?”
ইবনে আব্বাস বলেন,“
আমি মনে করেছিলাম তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে জা’
ফর সম্পর্কে জানতে চাইছেন। তাই বললাম : সে তার বন্ধুদের সাথে জীবন অতিবাহিত করছে। উমর বললেন : আমি তার কথা বলি নি। আমার উদ্দেশ্য তোমাদের আহলে বাইতের প্রধান ব্যক্তি। আমি বললাম : তাঁকে বালতি দিয়ে পানি উঠাতে দেখে এসেছি ও তখন তিনি কোরআন পাঠ করছিলেন। উমর রাগান্বিত হয়ে বললেন : কোরবানীর সকল উটের রক্তের দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর বর্তাক,আমি যা জানতে চেয়েছি তা তুমি গোপন করছ। আমি জানতে চাইছি এখনও তাঁর অন্তরে খেলাফতের আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করছে কি? বললাম : হ্যাঁ। উমর বললেন : সে কি মনে করেছে রাসূলুল্লাহ্ তাঁকে খলীফা মনোনীত করে গিয়েছেন?”
ইবনে আব্বাস বলেন,“
আমি এর থেকে বড় কিছু বলতে চাই। আমি আমার পিতাকে খেলাফতের বিষয়ে হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন : বিষয়টি সত্য। উমর বলেন : নবী (সা.) তাঁর কথায় তাঁর (আলীর) উচ্চ মর্যাদার বিষয়ে বলতেন,কিন্তু তাঁর এ কথা খেলাফতের বিষয়ে সুস্পষ্ট দলিল হতে পারে না। যদিও নবী কখনো কখনো তাঁর খেলাফতের বিষয়ে উম্মতকে পরীক্ষা করতেন এবং তাঁর অন্তিম অসুস্থতার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁকে খলীফা মনোনীত করবেন কিন্তু আমি তা হতে দিই নি।”
তৃতীয়বারের মত এ বিষয়ে ইবনে আব্বাসের সাথে তাঁর কথোপকথনে উমর ইবনে আব্বাসকে বলেন,“
তোমার বন্ধুকে মজলুম দেখছি।”
ইবনে আব্বস বললেন,“
যদি তাই হয় তবে অন্যায়ভাবে তাঁর যে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে তা ফিরিয়ে দিন। উমর এ কথা শুনে আমার হাত হতে নিজ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ নিজে নিজে কি যেন বলতে লাগলেন। তিনি দাঁড়ালে আমি নিকটে গেলাম। তিনি বললেন : ইবনে আব্বাস! আমার মনে হয় না স্বগোত্রীয়রা (কুরাইশ) তাঁর মর্যাদাকে ছোট করে দেখা ব্যতীত অন্য কোন কারণে তাঁকে বঞ্চিত করেছে।”
ইবনে আব্বাস বললেন,“
আমি বললাম : আল্লাহর শপথ,আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যখন আলীকে তোমার বন্ধু (আবু বকর) হতে সূরা তওবা গ্রহণের জন্য পাঠান তখন তাঁকে ক্ষুদ্র মনে করেন নি। উমর আমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্রুত চলে গেলেন,আমিও ফিরে আসলাম।”
বনি হাশিমের মুখপাত্র,রাসূলের চাচাত ভাই,উম্মতের জ্ঞানের প্রতিভূ ইবনে আব্বাসের সাথে খলীফা উমরের এ ধরনের আলোচনা কয়েকবার সংঘটিত হয়েছে। একদল ব্যক্তি যারা আলী (আ.)-এর সম্পর্কে মন্দ বলছিল তাদের উদ্দেশ্যে ইবনে আব্বাস যে দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন তা ছাব্বিশ নম্বর পত্রে এনেছি যাতে হযরত আলী (আ.)-এর দশটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তিনি উল্লেখ করেছেন। সেখানে উল্লিখিত হয়েছে নবী (সা.) তাঁর দাদা ও চাচার পুত্রদের সমবেত করে বলেন,“
তোমাদের মধ্য হতে কে দুনিয়া ও আখেরাতে আমার সহযোগী হতে রাজী আছ?”
কেউ ইতিবাচক জবাব না দিলে ইমাম আলী (আ.) দাঁড়িয়ে বললেন,“
আমি দুনিয়া ও আখেরাতে আপনার সহযোগী হব।”
তখন তিনি আলী (আ.)-কে বললেন,أنت وليّ في الدّنيا و الآخرة
“
তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার সহযোগী।”
সর্বশেষে সেখানে উল্লিখিত হয়েছিল রাসূল (সা.) তাবুকের যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যখন মদীনা হতে সকলকে নিয়ে বের হন তখন আলী (আ.) এসে বললেন,“
হে আল্লাহর নবী! আমিও আপনার সাথে যেতে চাই?”
নবী (সা.) বললেন,“
না।”
আলী কেঁদে ফেললেন। রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন,“
তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে,তোমার সাথে আমার সম্পর্ক মূসার সাথে হারুনের সম্পর্কের ন্যায়,তবে আমার পর কোন নবী নেই। কিন্তু তুমি আমার খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত প্রতিনিধি হবার উপযুক্ত বলেই এটি ঠিক হবে না আমি চলে যাব আর তোমাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করে যাব না।”
ইবনে আব্বাস আরো বলেছেন,“
নবী (সা.) তাঁকে বলেন : তুমি আমার পর সকল মুমিনের নেতা ও অভিভাবক। আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।”
২। বনি হাশিমের অনেকেই এ ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করেছেন,এমন কি একবার ইমাম হাসান (আ.) আবু বকরকে উদ্দেশ্যে করে বলেন,“
আমার পিতার স্থান (রাসূলুল্লাহর মিম্বার) হতে নেমে আসুন।”
ইমাম হুসাইন (আ.)-ও হযরত উমরকে উদ্দেশ্য করে এরূপ কথা বলেন।
৩। শিয়া সূত্রের গ্রন্থগুলোতে হাশিমী এবং সাহাবী ও তাবেয়ীদের মধ্য হতে তাঁদের অনুসারীরা যে প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করেছেন তা উল্লিখিত হয়েছে। তাঁদের সম্পর্কে জানার জন্য এতদ্সম্পর্কিত গ্রন্থ অধ্যয়নের জন্য আহবান জানাচ্ছি। তবে এখানে আল্লামাহ্ তাবারসীর‘
ইহতিজাজ’
গ্রন্থে নিম্নোক্ত সাহাবীদের হতে যে বর্ণনা এসেছে তা লক্ষ্য করুন। সাহাবীদের মধ্যে খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আস উমাভী
,সালমান ফারসী,আবু যর গিফারী,আম্মার ইয়াসির,মিকদাদ,বুরাইদাহ্ আসলামী,আবুল হাইসাম ইবনে তিহান,সাহল ও উসমান ইবনে হুনাইফ,খুজাইমা ইবনে সাবেত যুশ শাহাদাতাইন,উবাই ইবনে কা’
ব,আবু আইয়ুব আনসারী ও অন্যান্যরা এ বিষয়ে যে সকল দলিল উপস্থাপন করেছেন তা অধ্যয়ন করুন।
কেউ আহলে বাইত (আ.) এবং তাঁদের বন্ধুদের জীবনী অধ্যয়ন করলে দেখবেন তাঁরা কখনোই সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। যখনই কোন সুযোগ পেতেন সরাসরি অথবা
ইশারা-ইঙ্গিতে,কখনো নরম স্বরে,কখনো উচ্চকণ্ঠে দৃঢ়তার সাথে বিরোধীদের সৃষ্ট কঠিন পরিস্থিতিতেও তাঁদের বক্তব্য ও লেখায় এ সম্পর্কে যুক্তি উপস্থাপন করতেন।
৪। তাঁরা বিভিন্ন সময় রাসূল (সা.)-এর ওসিয়ত সম্পর্কে কথা বলতেন ও তা হতে যুক্তি উপস্থাপন করতেন।
ওয়াসসালাম
শ