আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত6%

আল মুরাজায়াত লেখক:
: আবুল কাসেম
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বিভাগ: ইতিহাস

আল মুরাজায়াত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 133 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 69482 / ডাউনলোড: 9381
সাইজ সাইজ সাইজ
আল মুরাজায়াত

আল মুরাজায়াত

লেখক:
প্রকাশক: এস. এম. আলীম রেজা ৯৩,আরামবাগ,ঢাকা।
বাংলা

দশম পত্র

১৯ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

আরো কয়েকটি হাদীস

যদি আমার পত্রটি আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকেন তাহলে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে এ জন্য প্রস্তুত করেছেন। আপনার পত্র দিনে দিনে আমার আকাঙ্ক্ষাকে লক্ষ্যে নিয়ে পৌঁছাচ্ছে এবং আমার কর্মকাণ্ডকে সফলতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যে ব্যক্তি পবিত্র নিয়ত ও অন্তর,সুন্দর চরিত্র,বিনয়,সৌজন্যবোধ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার অধিকারী,জ্ঞানের মুকুট তার মাথায়ই শোভা পাওয়া স্বাভাবিক। যে সহনশীলতার মাল্য পরিধান করেছে তার কথা ও লেখনীতেই সত্য প্রতিমূর্ত হয় এবং সত্যপরায়ণতা ও সুবিচার তার মুখেই প্রতিভাত হয়।

আমাকে আরো অধিক জানাতে বলে আপনার নির্দেশ পালনে ও কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ হতে বাধ্য করেছেন। ইতোপূর্বে এর চেয়ে অধিক অনুগ্রহ ও সৌজন্যের সন্ধান আমি পাই নি। আল্লাহর শপথ,অবশ্য অবশ্যই আপনার দৃষ্টিকে সমুজ্জ্বল করবো। তবে শুনুন।

১। তাবরানী তাঁর কাবীর গ্রন্থে এবং রাফেয়ী তাঁর মুসনাদে অবিচ্ছিন্ন সনদে ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি এজন্য আনন্দিত যে,সে চায় আমার মত জীবন যাপন করতে,আমার মত মৃত্যুবরণ করতে ও আমার প্রতিপালকের চিরস্থায়ী বেহেশতে বাস করতে সে যেন আলীকে ভালবাসে এবং আলীকেই তার অভিভাবক বলে জানে,সে যেন আলীর বন্ধুকেও বন্ধু বলে জানে ও আমার পর আমার আহলে বাইতের অনুসরণ করে। কারণ তারা আমার সর্বাধিক আপন এবং তারা আমার অস্তিত্ব হতে অস্তিত্ব লাভ করেছে,আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকেই তারা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করেছে। ধ্বংস আমার সেই উম্মতের জন্য যারা তাদের (আহলে বাইতের) শ্রেষ্ঠত্বকে মিথ্যা মনে করে এবং আমার ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে কর্তন করে। আল্লাহ্ আমার শাফায়াতকে তাদের জন্য হারাম করুন। ৩৪

২। মুতির,বাওয়ারদী,ইবনে জারির,ইবনে শাহীন এবং ইবনে মানদুহ ইসহাকের মাধ্যমে যিয়াদ ইবনে মুতরিফ হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলকে বলতে শুনেছি : যে কেউ পছন্দ করে আমার মত জীবন যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে ও আমাকে যে চিরস্থায়ী জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেখানে প্রবেশ করতে,সে যেন আলী ও তার বংশধরদের ভালবাসে কারণ তারা কখনোই তোমাদের সত্য ও হেদায়েতের পথ হতে বিপথে পরিচালনা করবে না এবং তোমাদের গোমরাহীতেও নিক্ষেপ করবে না। ৩৫

৩। এরূপ আরেকটি হাদীস হলো যায়িদ ইবনে আরকাম হতে বর্ণিত হাদীস যেখানে রাসূল (সা.) বলেছেন, যে কেউ আমার মত জীবন যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে চায়,আমার প্রভুর প্রতিশ্রুত চিরস্থায়ী বেহেশতে প্রবেশ করতে চায়,সে যেন অবশ্যই আলীকে ভালবাসে,কেননা আলী কখনোই তাকে হেদায়েত থেকে বিচ্যুত করবে না এবং গোমরাহও করবে না। ৩৬

৪। তেমনি হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাসূল (সা.) থেকে বলেছেন, যে কেউ আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও আমাকে সত্যায়ন করেছে তাদেরকে আমি আলী ইবনে আবি তালিবের বেলায়েতকে মেনে নেয়ার সুপারিশ করছি (নির্দেশ দিচ্ছি),যে ব্যক্তি আলীকে নিজের আভিভাবক মেনেছে,সে যেন আমাকেই তার আভিভাবক জেনেছে এবং যে আমাকে অভিভাবক জেনেছে সে আল্লাহকে নিজের অভিভাবক মনোনীত করেছে। যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসে সে আমাকেই ভালবেসেছে,আর যে আমাকে ভালবেসেছে সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকেই ভালবেসেছে। যে কেউ আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে আমার প্রতিই বিদ্বেষ পোষণ করে। আর যে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে অবশ্যই তার অন্তরে আল্লাহর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে। ৩৭

৫। অন্যত্র হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রাসূল থেকে বর্ণনা করেছেন, হে প্রতিপালক! তুমি সাক্ষী থাকো,এ উম্মতকে আমি জানিয়েছি যে ব্যক্তি আমার প্রতি ঈমান এনেছে ও আমাকে সত্য প্রতিপন্ন করেছে সে যেন আলী ইবনে আবি তালিবের বেলায়েত হতে হাত সঙ্কুচিত না করে,কারণ আলীর বেলায়েত আমারই বেলায়েত আর আমার বেলায়েত আল্লাহরই বেলায়েত। ৩৮

৬। রাসূল (সা.) তাঁর এক খুতবায় বলেন, হে লোকসকল! মর্যাদা,সম্মান ও অভিভাবকত্বের পদমর্যাদা রাসূল (সা.) ও তার বংশধরদের জন্য। সুতরাং অন্যদের অন্যায় দাবী ও বক্তব্য যেন তোমাদের বিভ্রান্ত না করে। ৩৯

৭। অন্যত্র রাসূল বলেছেন, আমার উম্মতের প্রতিটি প্রজন্মের সময়ই আমার বংশধর হতে কোন না কোন সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি থাকবে। তারা বিভ্রান্ত ব্যক্তিদের সৃষ্ট বিকৃত চিন্তা ও দীন ধ্বংসকারী কর্মকাণ্ডের অপনোদন করবে এবং দীন হতে অজ্ঞ ব্যক্তিদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যাসমূহকে দূরীভূত করবে। জেনে রাখো,তোমাদের ইমাম ও নেতৃবর্গ তোমাদের প্রতিপালকের নিকট আদর্শ ব্যক্তি,তাই কাকে নিজের ইমাম ও নেতা মনোনীত করে আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে সে বিষয়ে চিন্তা করো। ৪০

৮। রাসূল (সা.) বলেছেন, আমার আহলে বাইতের ইমামগণ হতে পেছনে পড়ো না,তাদের বিষয়ে গাফেল ও অসচেতন হয়ো না তাহলে তোমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তাদেরকে কোন বিষয়ে শিক্ষাদান করতে যেও না,তারা এ বিষয়ে তোমাদের হতে অধিকতর জ্ঞাত। ৪১

৯। অন্যত্র রাসূল বলেছেন, আমার আহলে বাইতকে দেহের মধ্যে মস্তকের ন্যায় ও মস্তকের মধ্যে চোখের ন্যায় মনে কর। জেনে রেখো,চক্ষু ব্যতীত মস্তক হেদায়েতপ্রাপ্ত হতে পারে না। ৪২

১০। রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, আমার আহলে বাইতের ভালবাসার প্রতি অনুগত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও। কারণ যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে যে,সে আমাদের ভালবাসে তাহলে সে আমাদের শাফায়াতের মাধ্যমে বেহেশতে প্রবেশ করবে। যাঁর হাতের মুঠোয় আমার জীবন আবদ্ধ সেই প্রভুর শপথ,আমাদের অধিকারের প্রতি সচেতনতা ও সম্মান প্রদর্শন ব্যতীত কোন সৎ কর্মই ফলদান করবে না। ৪৩

১১। রাসূল (সা.) বলেছেন, আমার আহলে বাইতের প্রকৃত পরিচয় জানা জাহান্নামের অগ্নি হতে মুক্তির উপায়। আমার বংশধরদের প্রতি প্রেম ও ভালবাসা পুলসিরাত অতিক্রমের অনুমতিপত্র ও রক্ষাকবচ এবং তাদের বেলায়েত আল্লাহর আজাব হতে নিরাপত্তা দানকারী। ৪৪

১২। রাসূল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন মানুষকে চারটি প্রশ্নের জবাব দানের পূর্বে কোথাও যেতে দেয়া হবে না (১) তার জীবনকে কোন্ পথে ব্যয় করেছে (২) তার দেহকে কোন্ কাজে নিয়োজিত রেখেছে (৩) অর্থকে কোন্ পথে ব্যয় করেছে অর্থাৎ কোথা হতে আয় করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছে (৪) আমার আহলে বাইতের প্রতি কিরূপ ভালবাসা পোষণ করেছে? ৪৫ (*১২)

১৩। অন্যত্র রাসূল (সা.) বলেছেন, যদি কেউ তার সমগ্র জীবন মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে ও রোযা রাখে কিন্তু আমার আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

১৪। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রাসূলের বংশধরদের প্রতি ভালবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছে। জেনে রাখো,রাসূলের আহলে বাইতের ভালবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণকারী ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছে,রাসূলের আহলে বাইতের ভালবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণকারী তওবাকারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে। জেনে রাখো,যারা রাসূলের আহলে বাইতের ভালবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে,ঈমান নিয়ে অর্থাৎ মুমিন হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে এবং মৃত্যুর ফেরেশতা তাকে বেহেশতের সুসংবাদ দান করেছে এবং কবরেও মুনকার-নাকীর তাকে এ সুসংবাদ দান করবে। যে কেউ আমার আহলে বাইতকে ভালবেসে দুনিয়া থেকে চলে গেছে,সে নববধূ যেরূপ স্বামীর ঘরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ও সসম্মানে প্রবেশ করে সেরূপ বেহেশতে প্রবেশ করবে। আমার আহলে বাইতের ভালবাসা নিয়ে মৃত্যুবরণকারীর জন্য কবর হতে দু টি দরজা বেহেশতের দিকে উন্মুক্ত করা হবে এবং আল্লাহ্ তার কবরকে ফেরেশতাদের জন্য যিয়ারতের স্থানে পরিণত করবেন। জেনে রাখো,আমার আহলে বাইতের ভালবাসাসহ প্রাণদানকারী ব্যক্তি রাসূলের দীনের পথে ও সুন্নাহর ওপর মৃত্যুবরণ করেছে এবং এও জেনে রাখো,যে ব্যক্তি আমার আহলে বাইতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার কপালে কিয়ামতের দিন লিখা থাকবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত ৪৬

এ বক্তব্যগুলোর মাধ্যমে এক মহাসত্যকে প্রকাশ করে রাসূল (সা.) চেয়েছিলেন প্রবৃত্তি ও বাসনার কুপ্রভাবকে এদিকে (সত্যের দিকে) ফিরিয়ে আনতে। এ সকল হাদীস বর্ণনাসূত্রে মুতাওয়াতির ও বহুল বর্ণিত বিশেষত আহলে বাইতের পক্ষ থেকে তা নির্ভরযোগ্য ও সহীহ। সুতরাং প্রমাণিত হয় যে,তাঁরা যদি আল্লাহর স্পষ্ট নিদর্শন না হতেন তাহলে এই মর্যাদা ও সম্মান লাভ করতেন না। অবশ্যই যদি তাঁরা সত্যের মহাউৎস,ঐশী আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে রাসূলের স্থলাভিষিক্ত ও হেদায়েতের প্রতিকৃতি না হতেন তাহলে কখনোই এরূপ মর্যাদায় ভূষিত হতেন না। তাই তাঁদের অনুসারী ও প্রেমিকরা আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রেমিক এবং তাঁদের বিরুদ্ধাচারণকারী ও বিদ্বেষীরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণকারী ও বিদ্বেষী বলে পরিগণিত। এ কারণে রাসূল (সা.) বলেছেন, পরহেজগার ও মুমিন ব্যতীত কেউ আমাদের বন্ধু হতে পারে না এবং মুনাফিক ও পাষাণহৃদয় ব্যক্তি ব্যতীত কেউ আমাদের শত্রু হতে পারে না। ৪৭

প্রসিদ্ধ কবি ফারাযদাক আহলে বাইত সম্পর্কে বলেছেন,

مِنْ مَعْشَرٍ حُبُّهُمْ دِيْنٌ وَ بُغْضُهُمْ كُفْرٌ وَ قُرْبُهُمْ مُنْجِي وَ مُعْتَصِمٌ

তাঁরা এমন ব্যক্তিবর্গ যাঁদের ভালবাসাই ধর্ম এবং তাঁদের প্রতি শত্রুতাই কুফর। তাঁদের নৈকট্যই মুক্তি ও নিরাপত্তা লাভের উপায়।

إِنْ عُدَّ أَهْل التُقى كانُوا ائِمَّتَهُمْ أَوْ قِيْلَ مَنْ خَيْرُ أَهْلِ الأَرْضِ قِيْلَ هُمْ

যদি পরহেজগার ব্যক্তিদের গণনা করা হয়,তবে তাঁরা তাদের নেতা। যদি বলা হয় পৃথিবীর ওপর শ্রেষ্ঠতম মানুষ কারা,তবে বলা হবে তাঁরা।

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) সব সময় বলতেন, আমি,আমার পিতৃপুরুষ ও বংশধরগণ সবচেয়ে বুদ্ধিমান,শৈশবে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সহনশীল এবং বৃদ্ধাবস্থায় তাদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী। আমাদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ মিথ্যাকে ভূলুণ্ঠিত করেন,নেকড়ের দাঁতগুলোকে উপড়ে ফেলেন,দুনিয়াপ্রেমিকদের লাঞ্ছিত করেন,তোমাদের বন্দীত্ব ও অপমানের অবসান ঘটান এবং তোমাদের স্কন্ধ হতে জিঞ্জির ও শিকলকে অপসারিত করেন। আমাদের মাধ্যমেই তিনি শুরু করেন এবং আমাদের হতেই শেষ করেন। ৪৮

তাঁদের অনুসরণের পক্ষে যুক্তি হিসেবে আমাদের জন্য এটিই যথেষ্ট যে,আল্লাহ্পাক তাঁদেরকে অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তাঁদের ওপর দরূদ পড়াকে ফরয নামাযের অংশ হিসেবে তাঁর প্রতিটি বান্দার ওপর অপরিহার্য করেছেন অর্থাৎ তাঁদের ওপর দরূদ না পড়লে কারো নামাযই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না তিনি যে কেউ হোন না কেন- সিদ্দীক (মহাসত্যবাদী),ফারুক (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী),যুন্নূর (আলোর অধিকারী),যুন্নূরাইন (*১৩) (দুই দ্যুতির অধিকারী),যু আনওয়ার (দ্যুতিসমূহের অধিকারী)- সকল বান্দার জন্যই নামাযের মধ্যে যেমনভাবে শাহাদাতাইন বলা ইবাদত তেমনি তাঁদের ওপর দরূদ পাঠানোও ইবাদত। তাঁদের এ মর্যাদার প্রতি চার মাজহাবের ইমামগণসহ সকল প্রসিদ্ধ ব্যক্তি অনুগত ও বিনীত।

ইমাম শাফেয়ী এ বিষয়ে বলেছেন,

يَا أَهْلَ بَيْتِ رَسُوْلِ اللهِ حُبُّكُمْ   فَرْضٌ مِنَ اللهِ فِيْ الْقرْآن أَنْزَلَهُ

হে রাসূলের আহলে বাইত! তোমাদের ভালবাসা সবার জন্য ফরয করা হয়েছে যা কোরআনে অবতীর্ণ হয়েছে।

كَفَاكُمْ مِنْ عَظِيْمِ الْفَضْلِ إِنَّكُمْ مَنْ لَمْ يُصَلِّ عَلَيْكُمْ لا صَلَوة لَهُ

তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এটিই যথেষ্ট যে,যদি কেউ নামাযে তোমাদের ওপর দরূদ না পড়ে,তার নামায কবুল হবে না। ৪৯

রাসূল (সা.)-এর পবিত্র সুন্নাহ্ হতে তাঁর আহলে বাইতকে অনুসরণ করার অপরিহার্যতার সপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন এখানেই শেষ করছি। আল্লাহর কিতাবেও (কোরআনে) এ বিষয়ে স্পষ্ট আয়াত রয়েছে,যেহেতু আপনি ঐ সকল ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত যাঁরা ইশারা হতেই অনেক কিছু বুঝেন তাই এ বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণের দায়িত্ব আপনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবৃত্তির ওপর ছেড়ে দিলাম।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন

এগারতম পত্র

২০ জিলক্বদ ১৩২৯ হিঃ

১। প্রামাণ্য হাদীসের উদ্ধৃতিতে আশ্চর্যান্বিত হওয়া।

২। এরূপ রেওয়ায়েত হতে আহলে সুন্নাতের দূরত্বের বিষয়ে চিন্তা করে হতচকিত হওয়া।

৩। কোরআন হতে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের আহবান।

১। আপনার মূল্যবান পত্রটি আমার হস্তগত হয়েছে। পত্রটি সত্যকে প্রকাশের জন্য স্পষ্ট,বোঝার জন্য সহজ ও গ্রহণোপযোগী। আপনি আপনার জ্ঞানের কূপ হতে বালতি পূর্ণ করে দিয়েছেন যেন পর্বত হতে দলিল-প্রমাণের ঝরনাধারা প্রবাহিত হয়েছে। আপনার পত্রটি গভীর মনোযোগের সাথে পড়েছি এবং দীর্ঘক্ষণ এর ওপর চিন্তা করেছি। আমার মনে হয়েছে,সংলাপে আপনার মধ্যে কোন ক্লান্তি আসে না,বিতর্কে আপনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও দৃঢ় এবং বক্তব্যে প্রাঞ্জল।

২। যখন আপনার উপস্থাপিত দলিলগুলোর মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করলাম ও যুক্তি-প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণে নিমগ্ন হলাম তখন বুঝতে পারলাম আপনার অকাট্য যুক্তির মোকাবিলায় আমার মনে অদ্ভুত এক অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। আপনার বর্ণিত হাদীসগুলো পড়ে আহলে বাইতের ইমামগণকে আল্লাহ্ ও রাসূলের সামনে এমন এক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত দেখতে পাচ্ছি যে,তাঁদের সম্মুখে আমাদের ভক্তি ও বিনয়ের পাখা মেলে দেয়া উচিত।

অন্যদিকে মুসলমানদের বৃহৎ অংশের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখেছি তারা এ হাদীসগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। আমার দ্বিধাবিভক্ত অন্তরের এক অংশ আমাকে এই দলিল-প্রমাণের অনুসরণের দিকে আর অন্য অংশ অধিকাংশ মুসলমানের অনুসৃত পথের দিকে টানছে।

প্রথমটি এর লাগামকে আপনার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমাকে শান্ত হতে ও আপনা হতে বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করছে আর দ্বিতীয়টি আপনার বিরোধিতা করে বিচ্ছিন্ন হতে বলছে।

৩। যদি সম্ভব হয় কোরআন হতে অকাট্য দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে আমার একগুঁয়ে এ

অন্তরের বিরোধিতার পথকে রুদ্ধ করুন এবং আহলে বাইতের পথে আমাকে পরিচালিত করুন যেন আমার ও অধিকাংশের অনুসৃত পথের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়।

ওয়া আলাইকাসসালাম

কোরআন মজীদ ও আরবী ভাষার চূড়ান্ত বিকাশ

আল্লাহ্ তা আলা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে তাঁর যুগ থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমগ্র মানবপ্রজাতির পথনির্দেশের জন্য পাঠান। বস্তুতঃ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীকে পাঠানোর এটাই অনিবার্য দাবী যে , তাঁকে তাঁর যুগ থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমগ্র মানবপ্রজাতির পথনির্দেশের জন্য পাঠানো হবে। এমতাবস্থায় তাঁকে দেয় মু জিযাহ্ সমূহের মধ্যে অন্ততঃ এমন একটি মু জিযাহ্ থাকা অপরিহার্য ছিলো যা হবে স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার উর্ধে , অন্যদিকে তাঁকে যে হেদায়াত-গ্রন্থ দেয়া প্রয়োজন তার বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা এমনই সীমাহীন হওয়া অপরিহার্য যাকে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণকে ( আঃ) প্রদত্ত গ্রন্থ ও পুস্তিকা (ছ্বাহীফাহ্)র সাথে কোনোভাবেই তুলনা করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এমন কোনো বিশালায়তন গ্রন্থ নাযিল্ করাও বাস্তবসম্মত হতো না যা থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হতো। তাই এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য এমন হওয়া অপরিহার্য ছিলো যে , সংক্ষেপে কিন্তু ভাষাগত কৌশলের মাধ্যমে তাতে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য তাদের জীবনের সকল দিকের পথনির্দেশের সমাহার ঘটবে। আর এ ধরনের গ্রন্থ মানবিক ক্ষমতার উর্ধে বিধায় এ গ্রন্থকে শ্রেষ্ঠতম ও কালোত্তীর্ণ মু জিযাহ্ হিসেবে গণ্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বস্তুতঃ এ ধরনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী গ্রন্থ নাযিলের জন্য একটি যথোপযুক্ত ভাষার উদ্ভব অপরিহার্য। কিন্তু কেবল মানবিক আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের একটি উপযুক্ত ভাষা তো না-ও গড়ে উঠতে পারে। তাই আল্লাহ্ তা আলা স্বাভাবিক মানবিক গতিধারায় পরোক্ষ সহায়তার মাধ্যমে এ ধরনের একটি ভাষার বিকাশ ও তাকে উন্নতির চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করার নিশ্চিত ব্যবস্থা করবেন এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।

আমরা বাস্তবেও দেখতে পাই যে , আরবী ভাষা - যে ভাষায় কোরআন মজীদ নাযিল্ হয়েছে - একদিকে যেমন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিকাশের চরম পর্যায়ে উপনীত হয় , অন্যদিকে এ ভাষার গুণগত মান তথা প্রকাশক্ষমতা এমনই বিস্ময়কর মাত্রায় ব্যাপকতার অধিকারী ও উন্নত যে , বিশ্বের অন্য কোনো ভাষা এর ধারেকাছেও পৌঁছতে সক্ষম নয়।

রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাবের মোটামুটি সমসময়েই আরবী ভাষা তার চরমোন্নতির পর্যায়ে উপনীত হয় এবং আরবী ভাষা-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাগুলোরও এ সময়েই আবির্ভাব ঘটে। তাদের সামনে কোরআন মজীদকে এক কালোত্তীর্ণ মু জিযাহ্ রূপে পেশ করা হয়। আর ভাষাশৈলীর সৌন্দর্য ও মান এবং প্রকাশের ব্যাপকতা ও সূক্ষ্মতার বিচারে কোরআন মজীদের অনন্যতার কারণে এ গ্রন্থকে মানবিক প্রতিভার উর্ধে বলে ইসলামের দুশমন তৎকালীন শ্রেষ্ঠতম আরবী সাহিত্যপ্রতিভাসমূহ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো।

অন্যান্য আসমানী কিতাব্ মু জিযাহ্ নয় কেন

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , আল্লাহর কালাম্ যেহেতু আল্লাহর কালাম্ , সেহেতু তা যে ভাষাতেই নাযিল্ হোক না কেন , তা ঐ ভাষার ভাষা-সাহিত্যগত মানের বিচারে শ্রেষ্ঠতম ও নিখুঁততম হতে বাধ্য। আর মানুষের প্রতিভা যতোই তীক্ষ্ণ হোক না কেন , যেহেতু সে মানুষ , সেহেতু কোনো মানবিক প্রতিভার বক্তব্যই মানের দিক থেকে খোদায়ী কালামের সমপর্যায়ে উপনীত হতে পারে না। অতএব , অন্যান্য আসমানী গ্রন্থও যখন নাযিল্ হয়েছিলো তখন তৎকালীন সংশ্লিষ্ট ভাষা-সাহিত্যের মানের ভিত্তিতে বিচার করলে তা মানবিক ক্ষমতার উর্ধে প্রমাণিত হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হচ্ছে :

(1) সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহ ঐ সব গ্রন্থ নাযিলের সময় স্বীয় বিকাশের চরমোৎকর্ষে উপনীত হয়েছিলো কিনা তা ঐতিহাসিক বিচারে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে যতোটা জানা যায় , একমাত্র আরবী ভাষা ছাড়া সকল ভাষারই পরবর্তীকালে ক্রমোন্নতি ঘটে এবং এ সব ভাষার মধ্যে জীবিত ভাষাগুলোর মানোন্নয়ন এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর মানে হচ্ছে , ঐ সব গ্রন্থ নাযিল-কালে ভাষা-সাহিত্যের মানের বিচারে সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহে রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম প্রমাণিত হলেও , ঐ সব গ্রন্থ যদি অবিকৃতভাবে টিকে থাকতো , তো পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট ভাষা-সাহিত্যের উন্নতি হবার কারণে ঐ সব গ্রন্থের খোদায়ী কালাম্ হবার ব্যাপারে ভাষা-সাহিত্যের পণ্ডিতদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হতো।

(2) সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের মধ্যে ভাষা-সাহিত্যগত শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাসমূহ সমাজের সর্বাধিক সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য হতো না বিধায় ঐ সব গ্রন্থকে সেগুলো নাযিল্ হবার সময় বা পরে কখনোই ভাষা-সাহিত্যের মানগত দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করা হয় নি। ফলে অন্য মু জিযাহ্ দ্বারা সংশ্লিষ্ট নবীর নবুওয়াত প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর আনীত গ্রন্থকে লোকেরা আল্লাহর কিতাব্ মনে করেছে , ভাষা-সাহিত্যের মানগত দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্য বিবেচনা করে আল্লাহর কিতাব্ মনে করে নি। অর্থাৎ নবীর আনীত কিতাব্ হওয়ার কারণে একটি কিতাবকে আল্লাহর কিতাব্ মনে করা হয়েছে , এর বিপরীতে কিতাবকে মু জিযাহ্ হিসেবে লক্ষ্য করে সেটিকে তার বাহকের নবুওয়াতের প্রমাণরূপে গণ্য করা হয় নি।

(3) ঐ সব গ্রন্থ কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে বা বিকৃত হয়েছে এবং কতক গ্রন্থ মূল ভাষায় অবশিষ্ট নেই বা অন্য ভাষার অনুবাদ থেকে পুনরায় মূল ভাষায় অনূদিত হয়েছে (যা ঐ সব গ্রন্থের অনুসরণের দাবীদার মনীষীগণও স্বীকার করেন)। ফলে বর্তমানে ঐ সব গ্রন্থকে সংশ্লিষ্ট ভাষার ভাষা-সাহিত্যগত মানের মানদণ্ডে বিচার করা আদৌ সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে এরূপ মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে , যেহেতু পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থসমূহ সাময়িক প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট স্থান , কাল ও জনগোষ্ঠীর পথনির্দেশের জন্য নাযিল্ করা হয়েছিলো এবং সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহ স্বীয় সম্ভাবনার চরমোন্নতিতে উপনীত হয় নি বিধায় ভাষাগত ও সাহিত্যিক মানের বিবেচনায় ঐ সব গ্রন্থকে ঐ সব ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থরূপে নাযিল্ করা সম্ভব ছিলো না (কারণ তা করা হলে ঐ সব গ্রন্থ সংশ্লিষ্ট লোকদের বোধগম্য হতো না) , সেহেতু পরবর্তীকালে ঐ সব ভাষার চরমোন্নতির যুগে যাতে ঐ সব ঐশী গ্রন্থ নিম্ন মানের বলে প্রতিভাত না হয় , সে উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা আলা ঐ সব গ্রন্থকে বিলুপ্তি বা বিকৃতি থেকে সুরক্ষা প্রদান করেন নি।

শুধু তা-ই নয় , এমনকি ঐ সব ঐশী গ্রন্থ নাযিলের যুগে যদি সংশ্লিষ্ট ভাষা স্বীয় সম্ভাবনার চরমোন্নতির অধিকারীও হতো তথাপি ঐ সব গ্রন্থের বিলুপ্তি বা বিকৃতি থেকে সুরক্ষা পাওয়ার কারণ ছিলো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে ঐ সব গ্রন্থকে কেবল সংশ্লিষ্ট ভাষার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাবলীর সাথে তুলনা করেই শ্রেষ্ঠতম গণ্য করা হতো না , বরং অন্যান্য ভাষার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাবলীর সাথেও তুলনা করা হতো। ফলে শ্রেষ্ঠতম ভাষার (আরবী) শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের (কোরআন) সাথে তুলনা করে ঐ সব গ্রন্থের মান সম্পর্কে নিম্নতর ধারণা সৃষ্টি হতো এবং সেগুলোর ঐশী গ্রন্থ হওয়া সম্পর্কেও সন্দেহ সৃষ্টি হতো। সুতরাং ঐ সব গ্রন্থের বিলুপ্তি বা বিকৃতি মূল ঐশী গ্রন্থগুলোর সম্মান রক্ষার্থেই অপরিহার্য ছিলো।

এর বিপরীতে যে গ্রন্থ ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে অনিবার্যভাবেই সে গ্রন্থের এমন এক ভাষায় নাযিল্ হওয়া প্রয়োজন ছিলো যে ভাষা হবে সাহিত্যিক মানের বিচারে শ্রেষ্ঠতম তথা সংক্ষিপ্ততম কথায় সুন্দরতমভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশের উপযোগী এবং সে ভাষার চরমতম উন্নতির পর্যায়ে তা নাযিল্ হওয়া অপরিহার্য যাতে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত কোনো যুগে কোনো দেশে ও কোনো ভাষায়ই ঐ গ্রন্থের সমমানসম্পন্ন গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব না হয়। আর কার্যতঃও তা-ই হয়েছে।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদ উক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থাবলী থেকে ভিন্নতার অধিকারী। অর্থাৎ যেহেতু কোরআন নাযিল-কালে আরবী ভাষা ও সাহিত্য তার উৎকর্ষতার চরমতম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো সেহেতু কোরআন মজীদ তখন যেমন আরবী ভাষার অপ্রতিদ্ব দ্বী শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ছিলো , এখনো তা-ই আছে এবং ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে ; পরবর্তী কালের ভাষা-সাহিত্যের মানের বিচারে তার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের মর্যাদা হারাবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

দ্বিতীয়তঃ কোরআন নাযিলের যুগে আরবদের মধ্যে এ ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি , সুবক্তা ও আরবী ভাষার অলঙ্কারবিশেষজ্ঞগণের আবির্ভাব ঘটেছিলো এবং ঐ যুগের আরব জনগণের কাছে কবি , সুবক্তা ও আরবী ভাষার অলঙ্কারবিশেষজ্ঞগণ সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ফলে কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় তাঁদের অপারগতা কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হবার ব্যাপারে জনগণের সামনে অকাট্য দলীলে পরিণত হয়।

কোরআনের মু জিযাহর সাথে পরিচিতি অপরিহার্য

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণ রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজন। তা হচ্ছে , যে কোনো মু জিযাহকে কেবল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণই মু জিযাহরূপে পরিপূর্ণ প্রত্যয় সহকারে অনুভব করতে পারেন ; সাধারণ জনগণ ঐ বিশেষজ্ঞদের স্বীকৃতি বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থতা থেকে প্রত্যয়ে উপনীত হতে পারে। সুতরাং বলা বাহুল্য যে , কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব কেবল তাঁদের সামনেই পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিভাত হওয়া সম্ভব যারা আরবী ভাষা ও তার প্রকাশক্ষমতার ওপরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দক্ষতা বা ব্যুৎপত্তির অধিকারী। বরং তাঁরাও যতোই অলৌকিকত্ব পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে কোরআন মজীদ অধ্যয়ন করবেন ততোই তাঁদের কাছে এ মহাগ্রন্থের নব নব বিস্ময়কর দিক ধরা পড়বে - যা আরবী ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ব্যুৎপত্তির অধিকারী নয় এমন লোকের পক্ষে পুরোপুরি বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তবে মোটামুটিভাবে কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনো লোকের পক্ষেই সম্ভব।

এখানে একটি পার্শ্বপ্রসঙ্গের উল্লেখ প্রয়োজন মনে করছি। তা হচ্ছে , যার কাছে রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রতিভাত হয়েছে তার কাছে কোরআন মজীদের খোদায়ী কালাম্ হওয়ার বিষয়টি স্বতঃপ্রতিভাত। অন্যদিকে যার কাছে কোরআন মজীদ মানবীয় প্রতিভার উর্ধে এক অলৌকিক গ্রন্থরূপে প্রমাণিত হবে সে ব্যক্তির পক্ষে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের সত্যতা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব প্রতিভাত হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তাঁর নবুওয়াতকে স্বীকার না করবে , তা যে নেহায়েতই অন্ধ গোঁড়ামি তা বলাই বাহুল্য।

সে যা-ই হোক , কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে সাধারণ মুসলিম জনগণের প্রত্যয় থাকলেও এ প্রত্যয় হচ্ছে এজমালী (মোটামুটি) ধরনের। এ গ্রন্থের অলৌকিকত্বের মূল বৈশিষ্ট্য ও তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খুব কম লোকেরই ধারণা আছে , অথচ প্রতিটি মুসলমানেরই এ সম্পর্কে অন্ততঃ একটি ন্যূনতম পর্যায় পর্যন্ত অবশ্যই ধারণা থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যেভাবে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে সব ধরনের উপায়-উপকরণ ও প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে ইসলামের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হামলা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারাভিযান চলছে তখন এ প্রয়োজন আরো বেশী তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। আর যারা দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে সময়-শ্রম ব্যয়ে আগ্রহী তাঁদের জন্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অপরিহার্য প্রয়োজন।

বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ প্রসঙ্গে

আরবী ও ফার্সী ভাষায় কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে , তেমনি রয়েছে কোরআনের ইতিহাস ও কোরআন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর বহু মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু বাংলা ভাষায় কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সংক্রান্ত কোনো গ্রন্থ এ পর্যন্ত অত্র লেখকের চোখে পড়ে নি। তাই এ প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যেই বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের অবতারণা।

কোরআন মজীদের পরিচিতিমূলক গ্রন্থে ও কোরআন মজীদের তাফসীরের মুখবন্ধে সাধারণতঃ কোরআনের মু জিযাহ্ সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু তা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে ন্যূনতম পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে আরবী ও ফার্সী ভাষায় কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে যে সব স্বতন্ত্র গ্রন্থ পাওয়া যায় সে সবের আয়তনের ব্যাপকতা ছাড়াও সে সবের রচনামান এমনই উঁচু স্তরের যে , আমাদের সমাজে সে সব গ্রন্থের অনুবাদ অনুধাবনের জন্যে প্রয়োজনীয় ইলমী পূর্বপ্রস্তুতির খুবই অভাব রয়েছে।

অন্যদিকে যে সব আরবী-ফার্সী গ্রন্থে অংশবিশেষরূপে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কিত আলোচনা স্থানলাভ করেছে সে সব আলোচনা বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের এতদসংক্রান্ত প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে এ সবের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ্ ইরাকের নাজাফে অবস্থিত দ্বীনী জ্ঞানকেন্দ্রে দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশীকাল যাবত দ্বীনী জ্ঞান চর্চাকারী ও বিতরণকারী আল্লামাহ্ সাইয়েদ আবূল্ ক্বাসেম্ খূয়ী (রহ্ঃ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল্-বায়ান্ ফী তাফসীরিল্ ক্বুরআন্-এর অংশবিশেষে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা আয়তনের দিক থেকে যেমন মধ্যম , তেমনি প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য এবং তা বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের প্রয়োজন পূরণে অনেকাংশে সহায়ক হবে বলে মনে হয়েছে। এ কারণে গ্রন্থটির সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের অনুবাদে হাত দেই এবং 1989 খৃস্টাব্দের এপ্রিলের শুরুতে এর অনুবাদের কাজ শেষ হয়।

অবশ্য আল্-বায়ান্-এর মু জিযাহ্ সংক্রান্ত অধ্যায়ের যে অনুবাদ করি তাকে আক্ষরিক অর্থে শুধু অনুবাদ বলা চলে না। কারণ , প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এতে পাদটীকা যোগ করা ছাড়াও মরহূম খূয়ীর আলোচনার ভিতর থেকে দু -একটি অংশ যরূরী নয় বিবেচনায় বাদ দেই , কোথাও কোথাও আক্ষরিক অনুবাদের পরিবর্তে ভাবানুবাদ করি , কয়েকটি জায়গায় অধিকতর সুবিন্যাসের লক্ষ্যে বক্তব্য অগ্র-পশ্চাত করি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বক্তব্য যোগ করে আলোচনার সম্পূরণ করি। এছাড়া পাঠক-পাঠিকাদের ব্যবহারের সুবিধার্থে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু বিবেচনায় তাঁর বক্তব্যে উপশিরোনাম প্রদান করি , যদিও অনেক উপশিরোনাম তাঁরই দেয়া ছিলো।

এছাড়া , স্বভাবতঃই একটি গ্রন্থের অংশবিশেষ হিসেবে লিখিত আলোচনা একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে লিখিত আলোচনা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে এবং তাতে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সকল দিক প্রতিফলিত হয় না বিধায় এর সম্পূরণের মাধ্যমে একে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপদানের লক্ষ্যে এর শুরুতে তিনটি নিবন্ধ এবং শেষে পরিশিষ্ট আকারে আরো দু টি নিবন্ধ , আল্লামাহ্ খূয়ীর লেখা অংশসমূহের ভিতরে কতক উপশিরোনাম ও এ গ্রন্থে ব্যবহৃত পরিভাষা সমূহের ব্যাখ্যা যোগ করি।

আল্লামাহ্ খূয়ীর লেখার অনুবাদ 1989 খৃস্টাব্দের এপ্রিলের শুরুতে শেষ হলেও প্রায় বিশ বছর পর এটিকে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেই এবং নিজেই কম্পিউটার-কম্পোজের কাজে হাত দেই। গ্রন্থটির পূর্ণতা প্রদান ও কম্পোজের কাজ 2010 খৃস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে সমাপ্ত হলেও প্রকাশের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় নি। দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত গ্রন্থটি এভাবে থেকে যাওয়ার পর অতি সম্প্রতি মূলতঃ ফেসবুকে পরিবেশনের লক্ষ্যে এটি পরিমার্জনের কাজে হাত দেই। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে মরহূম খূয়ীর লেখার অনুবাদকৃত অংশগুলোতে আমার পক্ষ থেকে যোগকৃত পাদটীকাগুলোর সংখ্যাধিক্য ও তার আয়তন একটি গ্রন্থের গতিশীলতার জন্য সহায়ক নয় বিবেচনায় প্রায় সবগুলো পাদটীকাকেই মূল পাঠে সমন্বিত করে নেই। (ফেসবুকের জন্য প্রস্তুত কপিতে অবশ্য অবশিষ্ট পাদটীকাগুলোও প্রথম বা তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে মূল পাঠের ভিতরে দিয়েছি ; আলাদা কোনো পাদটীকা দেই নি।) সেই সাথে আরো কিছু পরিবর্তন ও নতুন উপশিরোনাম যোগ করি। ফলে সব মিলিয়ে গ্রন্থটির আয়তনের শতকরা প্রায় ষাট ভাগ দাঁড়িয়েছে অত্র গ্রন্থকারের রচনা এবং চল্লিশ ভাগের কিছু বেশী মরহূম খূয়ীর রচনার অনুবাদ।

অত্র গ্রন্থে উদ্ধৃত বাইবেলের উদ্ধৃতি সমূহের অনুবাদের ক্ষেত্রে বাইবেলের অন্যতম প্রাচীন বঙ্গানুবাদ ধর্ম্মপুস্তক-এর সাহায্য নিয়েছি। (ধর্ম্মপুস্তক - 1937 খৃস্টাব্দের সংস্করণ যা লন্ডনে রয়েছে তার ফটোকপি থেকে 1950 সালে ব্রিটিশ ও ফরেণ বাইবেল সোসাইটির দ্বারা 23 নম্বর চৌরঙ্গী রোড কলিকাতা হতে প্রকাশিত সংস্করণ ব্যবহার করেছি।) এছাড়া ইসলামী জ্ঞানচর্চায় অপেক্ষাকৃত নবীন যে সব পাঠক-পাঠিকা ইসলামী পরিভাষা সমূহের সাথে খুব বেশী পরিচিত নন এমন পাঠক-পাঠিকাদের , বিশেষ করে অমুসলিম পাঠক-পাঠিকাদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গ্রন্থে ব্যবহৃত পরিভাষা সমুহের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পরিশিষ্ট আকারে যোগ করেছি।

অত্র গ্রন্থ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। একটি হচ্ছে এই যে , অত্র গ্রন্থে উদ্ধৃত কোরআন মজীদের কতক আয়াতে (মূল আরবী আয়াতে) আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে এক বচনে আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা শব্দের ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে , অত্র গ্রন্থে যে সব আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর বানানের ক্ষেত্রে আমরা যথাসম্ভব মূল উচ্চারণ প্রতিফলনের চেষ্টা করেছি। এ কারণে দীর্ঘ ঈ-কার ও দীর্ঘ ঊ-কার বজায় রাখা ছাড়াও কতক শব্দে , বিশেষ করে কম প্রচলিত শব্দে প্রতিবর্ণায়ন রীতি অনুযায়ী যথাসাধ্য মূল উচ্চারণ প্রতিফলিত করার লক্ষ্যেص -এর জন্য ছ্ব ,ط -র জন্য ত্ব ,ع -এর জন্য সংশ্লিষ্ট বর্ণের আগে ( ) চিহ্ন ,غ -এর জন্য গ্ব ,ق -এর জন্য ক্ব , আলেফ্ মামদূদাহ্ (آ ) ও যবরের পরবর্তী আলেফ্ (ا )-এর জন্য ডবল আ-কার (াা) এবং সাকিন্ হামযাহ্ (ء )র জন্য ( ) চিহ্ন ব্যবহার করেছি। এছাড়াও আরো কিছু নিজস্ব বানান অনুসরণ করেছি।

আশা করি অত্র গ্রন্থখানি বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের নিকট , বিশেষ করে যারা আল্লাহর দ্বীনকে ভালোভাবে জানতে , অনুসরণ করতে ও প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁদের নিকট সাদরে গ্রহণীয় হবে।

এ গ্রন্থ সম্পর্কে পাঠক-পাঠিকাদের যে কোনো মতামত সাদরে গ্রহণ করা হবে।

গ্রন্থটি যদি পাঠক-পাঠিকাদেরকে কোরআন মজীদের মু জিযাহর সাথে কিছুটা হলেও পরিচিত করাতে সক্ষম হয় এবং বাংলাভাষী ইসলাম-গবেষকগণ এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হন তাহলেই লেখকের শ্রম সার্থক হবে।

পরিশেষে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইতের নিকট মুনাজাত করি , তিনি যেন অত্র গ্রন্থকে তাঁর দ্বীনের খেদমতরূপে গণ্য করেন এবং মরহূম আল্লামাহ্ সাইয়েদ আবূল্ ক্বাসেম্ খূয়ীর , অত্র লেখকের , এ গ্রন্থের প্রকাশ-প্রচারের সাথে জড়িতদের ও এর পাঠক-পাঠিকাদের সকলের পরকালীন মুক্তির পাথেয়স্বরূপ করে দিন।

কোরআন মজীদ ও আরবী ভাষার চূড়ান্ত বিকাশ

আল্লাহ্ তা আলা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)কে তাঁর যুগ থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমগ্র মানবপ্রজাতির পথনির্দেশের জন্য পাঠান। বস্তুতঃ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীকে পাঠানোর এটাই অনিবার্য দাবী যে , তাঁকে তাঁর যুগ থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতি নির্বিশেষে সমগ্র মানবপ্রজাতির পথনির্দেশের জন্য পাঠানো হবে। এমতাবস্থায় তাঁকে দেয় মু জিযাহ্ সমূহের মধ্যে অন্ততঃ এমন একটি মু জিযাহ্ থাকা অপরিহার্য ছিলো যা হবে স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার উর্ধে , অন্যদিকে তাঁকে যে হেদায়াত-গ্রন্থ দেয়া প্রয়োজন তার বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা এমনই সীমাহীন হওয়া অপরিহার্য যাকে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণকে ( আঃ) প্রদত্ত গ্রন্থ ও পুস্তিকা (ছ্বাহীফাহ্)র সাথে কোনোভাবেই তুলনা করা সম্ভব নয়।

কিন্তু এমন কোনো বিশালায়তন গ্রন্থ নাযিল্ করাও বাস্তবসম্মত হতো না যা থেকে পথনির্দেশ গ্রহণ করা মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হতো। তাই এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য এমন হওয়া অপরিহার্য ছিলো যে , সংক্ষেপে কিন্তু ভাষাগত কৌশলের মাধ্যমে তাতে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য তাদের জীবনের সকল দিকের পথনির্দেশের সমাহার ঘটবে। আর এ ধরনের গ্রন্থ মানবিক ক্ষমতার উর্ধে বিধায় এ গ্রন্থকে শ্রেষ্ঠতম ও কালোত্তীর্ণ মু জিযাহ্ হিসেবে গণ্য করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বস্তুতঃ এ ধরনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী গ্রন্থ নাযিলের জন্য একটি যথোপযুক্ত ভাষার উদ্ভব অপরিহার্য। কিন্তু কেবল মানবিক আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের একটি উপযুক্ত ভাষা তো না-ও গড়ে উঠতে পারে। তাই আল্লাহ্ তা আলা স্বাভাবিক মানবিক গতিধারায় পরোক্ষ সহায়তার মাধ্যমে এ ধরনের একটি ভাষার বিকাশ ও তাকে উন্নতির চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করার নিশ্চিত ব্যবস্থা করবেন এটাই বিচারবুদ্ধির দাবী।

আমরা বাস্তবেও দেখতে পাই যে , আরবী ভাষা - যে ভাষায় কোরআন মজীদ নাযিল্ হয়েছে - একদিকে যেমন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিকাশের চরম পর্যায়ে উপনীত হয় , অন্যদিকে এ ভাষার গুণগত মান তথা প্রকাশক্ষমতা এমনই বিস্ময়কর মাত্রায় ব্যাপকতার অধিকারী ও উন্নত যে , বিশ্বের অন্য কোনো ভাষা এর ধারেকাছেও পৌঁছতে সক্ষম নয়।

রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আবির্ভাবের মোটামুটি সমসময়েই আরবী ভাষা তার চরমোন্নতির পর্যায়ে উপনীত হয় এবং আরবী ভাষা-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাগুলোরও এ সময়েই আবির্ভাব ঘটে। তাদের সামনে কোরআন মজীদকে এক কালোত্তীর্ণ মু জিযাহ্ রূপে পেশ করা হয়। আর ভাষাশৈলীর সৌন্দর্য ও মান এবং প্রকাশের ব্যাপকতা ও সূক্ষ্মতার বিচারে কোরআন মজীদের অনন্যতার কারণে এ গ্রন্থকে মানবিক প্রতিভার উর্ধে বলে ইসলামের দুশমন তৎকালীন শ্রেষ্ঠতম আরবী সাহিত্যপ্রতিভাসমূহ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো।

অন্যান্য আসমানী কিতাব্ মু জিযাহ্ নয় কেন

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে , আল্লাহর কালাম্ যেহেতু আল্লাহর কালাম্ , সেহেতু তা যে ভাষাতেই নাযিল্ হোক না কেন , তা ঐ ভাষার ভাষা-সাহিত্যগত মানের বিচারে শ্রেষ্ঠতম ও নিখুঁততম হতে বাধ্য। আর মানুষের প্রতিভা যতোই তীক্ষ্ণ হোক না কেন , যেহেতু সে মানুষ , সেহেতু কোনো মানবিক প্রতিভার বক্তব্যই মানের দিক থেকে খোদায়ী কালামের সমপর্যায়ে উপনীত হতে পারে না। অতএব , অন্যান্য আসমানী গ্রন্থও যখন নাযিল্ হয়েছিলো তখন তৎকালীন সংশ্লিষ্ট ভাষা-সাহিত্যের মানের ভিত্তিতে বিচার করলে তা মানবিক ক্ষমতার উর্ধে প্রমাণিত হতো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হচ্ছে :

(1) সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহ ঐ সব গ্রন্থ নাযিলের সময় স্বীয় বিকাশের চরমোৎকর্ষে উপনীত হয়েছিলো কিনা তা ঐতিহাসিক বিচারে নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে যতোটা জানা যায় , একমাত্র আরবী ভাষা ছাড়া সকল ভাষারই পরবর্তীকালে ক্রমোন্নতি ঘটে এবং এ সব ভাষার মধ্যে জীবিত ভাষাগুলোর মানোন্নয়ন এখনো অব্যাহত রয়েছে। এর মানে হচ্ছে , ঐ সব গ্রন্থ নাযিল-কালে ভাষা-সাহিত্যের মানের বিচারে সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহে রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম প্রমাণিত হলেও , ঐ সব গ্রন্থ যদি অবিকৃতভাবে টিকে থাকতো , তো পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট ভাষা-সাহিত্যের উন্নতি হবার কারণে ঐ সব গ্রন্থের খোদায়ী কালাম্ হবার ব্যাপারে ভাষা-সাহিত্যের পণ্ডিতদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হতো।

(2) সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের মধ্যে ভাষা-সাহিত্যগত শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাসমূহ সমাজের সর্বাধিক সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য হতো না বিধায় ঐ সব গ্রন্থকে সেগুলো নাযিল্ হবার সময় বা পরে কখনোই ভাষা-সাহিত্যের মানগত দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করা হয় নি। ফলে অন্য মু জিযাহ্ দ্বারা সংশ্লিষ্ট নবীর নবুওয়াত প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর আনীত গ্রন্থকে লোকেরা আল্লাহর কিতাব্ মনে করেছে , ভাষা-সাহিত্যের মানগত দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্য বিবেচনা করে আল্লাহর কিতাব্ মনে করে নি। অর্থাৎ নবীর আনীত কিতাব্ হওয়ার কারণে একটি কিতাবকে আল্লাহর কিতাব্ মনে করা হয়েছে , এর বিপরীতে কিতাবকে মু জিযাহ্ হিসেবে লক্ষ্য করে সেটিকে তার বাহকের নবুওয়াতের প্রমাণরূপে গণ্য করা হয় নি।

(3) ঐ সব গ্রন্থ কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে বা বিকৃত হয়েছে এবং কতক গ্রন্থ মূল ভাষায় অবশিষ্ট নেই বা অন্য ভাষার অনুবাদ থেকে পুনরায় মূল ভাষায় অনূদিত হয়েছে (যা ঐ সব গ্রন্থের অনুসরণের দাবীদার মনীষীগণও স্বীকার করেন)। ফলে বর্তমানে ঐ সব গ্রন্থকে সংশ্লিষ্ট ভাষার ভাষা-সাহিত্যগত মানের মানদণ্ডে বিচার করা আদৌ সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে এরূপ মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে , যেহেতু পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থসমূহ সাময়িক প্রয়োজনে সুনির্দিষ্ট স্থান , কাল ও জনগোষ্ঠীর পথনির্দেশের জন্য নাযিল্ করা হয়েছিলো এবং সংশ্লিষ্ট ভাষাসমূহ স্বীয় সম্ভাবনার চরমোন্নতিতে উপনীত হয় নি বিধায় ভাষাগত ও সাহিত্যিক মানের বিবেচনায় ঐ সব গ্রন্থকে ঐ সব ভাষার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থরূপে নাযিল্ করা সম্ভব ছিলো না (কারণ তা করা হলে ঐ সব গ্রন্থ সংশ্লিষ্ট লোকদের বোধগম্য হতো না) , সেহেতু পরবর্তীকালে ঐ সব ভাষার চরমোন্নতির যুগে যাতে ঐ সব ঐশী গ্রন্থ নিম্ন মানের বলে প্রতিভাত না হয় , সে উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা আলা ঐ সব গ্রন্থকে বিলুপ্তি বা বিকৃতি থেকে সুরক্ষা প্রদান করেন নি।

শুধু তা-ই নয় , এমনকি ঐ সব ঐশী গ্রন্থ নাযিলের যুগে যদি সংশ্লিষ্ট ভাষা স্বীয় সম্ভাবনার চরমোন্নতির অধিকারীও হতো তথাপি ঐ সব গ্রন্থের বিলুপ্তি বা বিকৃতি থেকে সুরক্ষা পাওয়ার কারণ ছিলো না। কারণ , সে ক্ষেত্রে ঐ সব গ্রন্থকে কেবল সংশ্লিষ্ট ভাষার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাবলীর সাথে তুলনা করেই শ্রেষ্ঠতম গণ্য করা হতো না , বরং অন্যান্য ভাষার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থাবলীর সাথেও তুলনা করা হতো। ফলে শ্রেষ্ঠতম ভাষার (আরবী) শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের (কোরআন) সাথে তুলনা করে ঐ সব গ্রন্থের মান সম্পর্কে নিম্নতর ধারণা সৃষ্টি হতো এবং সেগুলোর ঐশী গ্রন্থ হওয়া সম্পর্কেও সন্দেহ সৃষ্টি হতো। সুতরাং ঐ সব গ্রন্থের বিলুপ্তি বা বিকৃতি মূল ঐশী গ্রন্থগুলোর সম্মান রক্ষার্থেই অপরিহার্য ছিলো।

এর বিপরীতে যে গ্রন্থ ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে অনিবার্যভাবেই সে গ্রন্থের এমন এক ভাষায় নাযিল্ হওয়া প্রয়োজন ছিলো যে ভাষা হবে সাহিত্যিক মানের বিচারে শ্রেষ্ঠতম তথা সংক্ষিপ্ততম কথায় সুন্দরতমভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশের উপযোগী এবং সে ভাষার চরমতম উন্নতির পর্যায়ে তা নাযিল্ হওয়া অপরিহার্য যাতে ক্বিয়ামত্ পর্যন্ত কোনো যুগে কোনো দেশে ও কোনো ভাষায়ই ঐ গ্রন্থের সমমানসম্পন্ন গ্রন্থ রচনা করা সম্ভব না হয়। আর কার্যতঃও তা-ই হয়েছে।

বস্তুতঃ কোরআন মজীদ উক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থাবলী থেকে ভিন্নতার অধিকারী। অর্থাৎ যেহেতু কোরআন নাযিল-কালে আরবী ভাষা ও সাহিত্য তার উৎকর্ষতার চরমতম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো সেহেতু কোরআন মজীদ তখন যেমন আরবী ভাষার অপ্রতিদ্ব দ্বী শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ ছিলো , এখনো তা-ই আছে এবং ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে ; পরবর্তী কালের ভাষা-সাহিত্যের মানের বিচারে তার শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের মর্যাদা হারাবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই।

দ্বিতীয়তঃ কোরআন নাযিলের যুগে আরবদের মধ্যে এ ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি , সুবক্তা ও আরবী ভাষার অলঙ্কারবিশেষজ্ঞগণের আবির্ভাব ঘটেছিলো এবং ঐ যুগের আরব জনগণের কাছে কবি , সুবক্তা ও আরবী ভাষার অলঙ্কারবিশেষজ্ঞগণ সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। ফলে কোরআন মজীদের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় তাঁদের অপারগতা কোরআনের ঐশী গ্রন্থ হবার ব্যাপারে জনগণের সামনে অকাট্য দলীলে পরিণত হয়।

কোরআনের মু জিযাহর সাথে পরিচিতি অপরিহার্য

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় স্মরণ রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজন। তা হচ্ছে , যে কোনো মু জিযাহকে কেবল সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণই মু জিযাহরূপে পরিপূর্ণ প্রত্যয় সহকারে অনুভব করতে পারেন ; সাধারণ জনগণ ঐ বিশেষজ্ঞদের স্বীকৃতি বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থতা থেকে প্রত্যয়ে উপনীত হতে পারে। সুতরাং বলা বাহুল্য যে , কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব কেবল তাঁদের সামনেই পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিভাত হওয়া সম্ভব যারা আরবী ভাষা ও তার প্রকাশক্ষমতার ওপরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দক্ষতা বা ব্যুৎপত্তির অধিকারী। বরং তাঁরাও যতোই অলৌকিকত্ব পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে কোরআন মজীদ অধ্যয়ন করবেন ততোই তাঁদের কাছে এ মহাগ্রন্থের নব নব বিস্ময়কর দিক ধরা পড়বে - যা আরবী ভাষায় পূর্ণাঙ্গ ব্যুৎপত্তির অধিকারী নয় এমন লোকের পক্ষে পুরোপুরি বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তবে মোটামুটিভাবে কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে ধারণা লাভ মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনো লোকের পক্ষেই সম্ভব।

এখানে একটি পার্শ্বপ্রসঙ্গের উল্লেখ প্রয়োজন মনে করছি। তা হচ্ছে , যার কাছে রাসূলে আকরাম্ হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রতিভাত হয়েছে তার কাছে কোরআন মজীদের খোদায়ী কালাম্ হওয়ার বিষয়টি স্বতঃপ্রতিভাত। অন্যদিকে যার কাছে কোরআন মজীদ মানবীয় প্রতিভার উর্ধে এক অলৌকিক গ্রন্থরূপে প্রমাণিত হবে সে ব্যক্তির পক্ষে হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর নবুওয়াতের সত্যতা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব প্রতিভাত হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি তাঁর নবুওয়াতকে স্বীকার না করবে , তা যে নেহায়েতই অন্ধ গোঁড়ামি তা বলাই বাহুল্য।

সে যা-ই হোক , কোরআন মজীদের অলৌকিকত্ব সম্পর্কে সাধারণ মুসলিম জনগণের প্রত্যয় থাকলেও এ প্রত্যয় হচ্ছে এজমালী (মোটামুটি) ধরনের। এ গ্রন্থের অলৌকিকত্বের মূল বৈশিষ্ট্য ও তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খুব কম লোকেরই ধারণা আছে , অথচ প্রতিটি মুসলমানেরই এ সম্পর্কে অন্ততঃ একটি ন্যূনতম পর্যায় পর্যন্ত অবশ্যই ধারণা থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যেভাবে ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে সব ধরনের উপায়-উপকরণ ও প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে ইসলামের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হামলা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারাভিযান চলছে তখন এ প্রয়োজন আরো বেশী তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। আর যারা দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজে সময়-শ্রম ব্যয়ে আগ্রহী তাঁদের জন্য এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা অপরিহার্য প্রয়োজন।

বক্ষ্যমাণ গ্রন্থ প্রসঙ্গে

আরবী ও ফার্সী ভাষায় কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে , তেমনি রয়েছে কোরআনের ইতিহাস ও কোরআন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ওপর বহু মূল্যবান গ্রন্থ। কিন্তু বাংলা ভাষায় কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সংক্রান্ত কোনো গ্রন্থ এ পর্যন্ত অত্র লেখকের চোখে পড়ে নি। তাই এ প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যেই বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের অবতারণা।

কোরআন মজীদের পরিচিতিমূলক গ্রন্থে ও কোরআন মজীদের তাফসীরের মুখবন্ধে সাধারণতঃ কোরআনের মু জিযাহ্ সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু তা কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে ন্যূনতম পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে আরবী ও ফার্সী ভাষায় কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে যে সব স্বতন্ত্র গ্রন্থ পাওয়া যায় সে সবের আয়তনের ব্যাপকতা ছাড়াও সে সবের রচনামান এমনই উঁচু স্তরের যে , আমাদের সমাজে সে সব গ্রন্থের অনুবাদ অনুধাবনের জন্যে প্রয়োজনীয় ইলমী পূর্বপ্রস্তুতির খুবই অভাব রয়েছে।

অন্যদিকে যে সব আরবী-ফার্সী গ্রন্থে অংশবিশেষরূপে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কিত আলোচনা স্থানলাভ করেছে সে সব আলোচনা বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের এতদসংক্রান্ত প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে এ সবের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ্ ইরাকের নাজাফে অবস্থিত দ্বীনী জ্ঞানকেন্দ্রে দীর্ঘ সাত দশকেরও বেশীকাল যাবত দ্বীনী জ্ঞান চর্চাকারী ও বিতরণকারী আল্লামাহ্ সাইয়েদ আবূল্ ক্বাসেম্ খূয়ী (রহ্ঃ) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল্-বায়ান্ ফী তাফসীরিল্ ক্বুরআন্-এর অংশবিশেষে কোরআন মজীদের মু জিযাহ্ সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন তা আয়তনের দিক থেকে যেমন মধ্যম , তেমনি প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য এবং তা বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের প্রয়োজন পূরণে অনেকাংশে সহায়ক হবে বলে মনে হয়েছে। এ কারণে গ্রন্থটির সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের অনুবাদে হাত দেই এবং 1989 খৃস্টাব্দের এপ্রিলের শুরুতে এর অনুবাদের কাজ শেষ হয়।

অবশ্য আল্-বায়ান্-এর মু জিযাহ্ সংক্রান্ত অধ্যায়ের যে অনুবাদ করি তাকে আক্ষরিক অর্থে শুধু অনুবাদ বলা চলে না। কারণ , প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এতে পাদটীকা যোগ করা ছাড়াও মরহূম খূয়ীর আলোচনার ভিতর থেকে দু -একটি অংশ যরূরী নয় বিবেচনায় বাদ দেই , কোথাও কোথাও আক্ষরিক অনুবাদের পরিবর্তে ভাবানুবাদ করি , কয়েকটি জায়গায় অধিকতর সুবিন্যাসের লক্ষ্যে বক্তব্য অগ্র-পশ্চাত করি এবং ক্ষেত্রবিশেষে বক্তব্য যোগ করে আলোচনার সম্পূরণ করি। এছাড়া পাঠক-পাঠিকাদের ব্যবহারের সুবিধার্থে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু বিবেচনায় তাঁর বক্তব্যে উপশিরোনাম প্রদান করি , যদিও অনেক উপশিরোনাম তাঁরই দেয়া ছিলো।

এছাড়া , স্বভাবতঃই একটি গ্রন্থের অংশবিশেষ হিসেবে লিখিত আলোচনা একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে লিখিত আলোচনা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে এবং তাতে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সকল দিক প্রতিফলিত হয় না বিধায় এর সম্পূরণের মাধ্যমে একে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপদানের লক্ষ্যে এর শুরুতে তিনটি নিবন্ধ এবং শেষে পরিশিষ্ট আকারে আরো দু টি নিবন্ধ , আল্লামাহ্ খূয়ীর লেখা অংশসমূহের ভিতরে কতক উপশিরোনাম ও এ গ্রন্থে ব্যবহৃত পরিভাষা সমূহের ব্যাখ্যা যোগ করি।

আল্লামাহ্ খূয়ীর লেখার অনুবাদ 1989 খৃস্টাব্দের এপ্রিলের শুরুতে শেষ হলেও প্রায় বিশ বছর পর এটিকে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেই এবং নিজেই কম্পিউটার-কম্পোজের কাজে হাত দেই। গ্রন্থটির পূর্ণতা প্রদান ও কম্পোজের কাজ 2010 খৃস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে সমাপ্ত হলেও প্রকাশের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় নি। দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত গ্রন্থটি এভাবে থেকে যাওয়ার পর অতি সম্প্রতি মূলতঃ ফেসবুকে পরিবেশনের লক্ষ্যে এটি পরিমার্জনের কাজে হাত দেই। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে মরহূম খূয়ীর লেখার অনুবাদকৃত অংশগুলোতে আমার পক্ষ থেকে যোগকৃত পাদটীকাগুলোর সংখ্যাধিক্য ও তার আয়তন একটি গ্রন্থের গতিশীলতার জন্য সহায়ক নয় বিবেচনায় প্রায় সবগুলো পাদটীকাকেই মূল পাঠে সমন্বিত করে নেই। (ফেসবুকের জন্য প্রস্তুত কপিতে অবশ্য অবশিষ্ট পাদটীকাগুলোও প্রথম বা তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে মূল পাঠের ভিতরে দিয়েছি ; আলাদা কোনো পাদটীকা দেই নি।) সেই সাথে আরো কিছু পরিবর্তন ও নতুন উপশিরোনাম যোগ করি। ফলে সব মিলিয়ে গ্রন্থটির আয়তনের শতকরা প্রায় ষাট ভাগ দাঁড়িয়েছে অত্র গ্রন্থকারের রচনা এবং চল্লিশ ভাগের কিছু বেশী মরহূম খূয়ীর রচনার অনুবাদ।

অত্র গ্রন্থে উদ্ধৃত বাইবেলের উদ্ধৃতি সমূহের অনুবাদের ক্ষেত্রে বাইবেলের অন্যতম প্রাচীন বঙ্গানুবাদ ধর্ম্মপুস্তক-এর সাহায্য নিয়েছি। (ধর্ম্মপুস্তক - 1937 খৃস্টাব্দের সংস্করণ যা লন্ডনে রয়েছে তার ফটোকপি থেকে 1950 সালে ব্রিটিশ ও ফরেণ বাইবেল সোসাইটির দ্বারা 23 নম্বর চৌরঙ্গী রোড কলিকাতা হতে প্রকাশিত সংস্করণ ব্যবহার করেছি।) এছাড়া ইসলামী জ্ঞানচর্চায় অপেক্ষাকৃত নবীন যে সব পাঠক-পাঠিকা ইসলামী পরিভাষা সমূহের সাথে খুব বেশী পরিচিত নন এমন পাঠক-পাঠিকাদের , বিশেষ করে অমুসলিম পাঠক-পাঠিকাদের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গ্রন্থে ব্যবহৃত পরিভাষা সমুহের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পরিশিষ্ট আকারে যোগ করেছি।

অত্র গ্রন্থ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। একটি হচ্ছে এই যে , অত্র গ্রন্থে উদ্ধৃত কোরআন মজীদের কতক আয়াতে (মূল আরবী আয়াতে) আল্লাহ্ তা আলা নিজের জন্য আমরা শব্দ ব্যবহার করেছেন। তৎকালীন আরবী বাকরীতিতে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশালীদের মুখে এক বচনে আমরা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো , এ কারণে তৎকালীন আরবের মোশরেকরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে নি। কিন্তু যদিও বাংলা সহ আরো অনেক ভাষায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বা বিনয় প্রকাশের জন্য এর প্রচলন রয়েছে তথাপি বাংলা বাকরীতিতে অনেক ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে বিনয়স্বরূপ আমরা এবং কর্তৃত্বভাব প্রকাশের জন্য আমি ব্যবহারেরও প্রচলন আছে। এ কারণে বাংলা ভাষায় আল্লাহ্ তা আলার জন্য আমরা শব্দের ব্যবহার বেখাপ্পা শুনায় বিধায় আমরা এক বচনে এর অনুবাদ করেছি। অত্র গ্রন্থে এ ধরনের সকল আয়াতের ক্ষেত্রেই আমরা এ রীতি অনুসরণ করেছি।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে , অত্র গ্রন্থে যে সব আরবী-ফার্সী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর বানানের ক্ষেত্রে আমরা যথাসম্ভব মূল উচ্চারণ প্রতিফলনের চেষ্টা করেছি। এ কারণে দীর্ঘ ঈ-কার ও দীর্ঘ ঊ-কার বজায় রাখা ছাড়াও কতক শব্দে , বিশেষ করে কম প্রচলিত শব্দে প্রতিবর্ণায়ন রীতি অনুযায়ী যথাসাধ্য মূল উচ্চারণ প্রতিফলিত করার লক্ষ্যেص -এর জন্য ছ্ব ,ط -র জন্য ত্ব ,ع -এর জন্য সংশ্লিষ্ট বর্ণের আগে ( ) চিহ্ন ,غ -এর জন্য গ্ব ,ق -এর জন্য ক্ব , আলেফ্ মামদূদাহ্ (آ ) ও যবরের পরবর্তী আলেফ্ (ا )-এর জন্য ডবল আ-কার (াা) এবং সাকিন্ হামযাহ্ (ء )র জন্য ( ) চিহ্ন ব্যবহার করেছি। এছাড়াও আরো কিছু নিজস্ব বানান অনুসরণ করেছি।

আশা করি অত্র গ্রন্থখানি বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের নিকট , বিশেষ করে যারা আল্লাহর দ্বীনকে ভালোভাবে জানতে , অনুসরণ করতে ও প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁদের নিকট সাদরে গ্রহণীয় হবে।

এ গ্রন্থ সম্পর্কে পাঠক-পাঠিকাদের যে কোনো মতামত সাদরে গ্রহণ করা হবে।

গ্রন্থটি যদি পাঠক-পাঠিকাদেরকে কোরআন মজীদের মু জিযাহর সাথে কিছুটা হলেও পরিচিত করাতে সক্ষম হয় এবং বাংলাভাষী ইসলাম-গবেষকগণ এ বিষয়ে অধিকতর গবেষণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হন তাহলেই লেখকের শ্রম সার্থক হবে।

পরিশেষে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইতের নিকট মুনাজাত করি , তিনি যেন অত্র গ্রন্থকে তাঁর দ্বীনের খেদমতরূপে গণ্য করেন এবং মরহূম আল্লামাহ্ সাইয়েদ আবূল্ ক্বাসেম্ খূয়ীর , অত্র লেখকের , এ গ্রন্থের প্রকাশ-প্রচারের সাথে জড়িতদের ও এর পাঠক-পাঠিকাদের সকলের পরকালীন মুক্তির পাথেয়স্বরূপ করে দিন।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41

42

43

44

45

46

47

48

49