দুটি কথা
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রভুর জন্য। আর সর্বোৎকৃষ্ট দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক নবীকুল শিরোমণি,মহান আল্লাহর নির্বাচিত আমানতদার হযরত আবুল কাশেম মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর এবং তাঁর পবিত্র ও কল্যাণময় আহলে বাইত (আ.)-এর ওপর।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র যবান দ্বারা হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদায় যে অগণিত প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণিত হয়েছে তা অন্য কোনো সাহাবী কিংবা তাবেঈনের জন্যে বর্ণিত হয়নি। (সাহাবী হলো রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সেসকল সহচর যারা তাঁর সংস্পর্শ এবং সংসর্গ লাভ করেছেন। আর তাবেঈন হলো তাঁরা,যারা স্বয়ং রাসূলুল্লাহকে কিংবা তাঁর সময়কালকে দেখেনি অথবা তাঁর সময়কালে ইসলামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি)। এই কারণে তাঁকে অন্য সবার তুলনায় স্বতন্ত্র করে তুলে ধরেছেন এবং তাঁকে অন্যদের চেয়ে উচ্চতম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এই সব কিছুই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরবর্তীকালের জন্য তাঁর নেতৃত্ব,শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে। আর সত্যিকার অর্থেই মর্যাদার শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্গনে তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে তাঁর মর্যাদায় বর্ণিত মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ এই অমোঘ সত্যকে স্পষ্টরূপে তুলে ধরে।
ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় হযরত আমিরুল মুমিনীন (আ.)-এর মর্যাদা ও গুণাবলীর ওপর বর্ণনাসমূহকে মুছে ফেলা কিংবা বিকৃত ও রদবদল ঘটানোর যে অবিরাম প্রয়াস চালানো হয়েছে এত কিছু সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিত্বের ঔজ্জ্বল্য আজো দিনের সূর্য কিরণের ন্যায় দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে। ইবনে আবিল হাদীদ বলেন,‘‘
তাঁর মর্যাদা ও গুণাবলী এমনই শীর্ষ স্থানে বর্ণাঢ্যময় সুবিস্তৃতি লাভ করেছে যে তা থেকে বিমুখ হওয়া এবং সেগুলো প্রচার ও প্রচলনে বিরোধিতা করা একটি কদর্য ও নিন্দনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর আমার কি সাধ্য রয়েছে সেই মানুষটির সম্মান আর মর্যাদা বর্ণনা করার,যার শত্রুরা এবং অনিষ্টকামীরাও পর্যন্ত এমন পরিস্থিতিতে তাঁর প্রশংসায় কীর্তনে পঞ্চমুখ হয়েছে যখন তাঁর মর্যাদা ও মহিমা গোপন করা কিংবা অস্বীকার করা তাদের জন্যে সাধ্যাতীত হয়ে পড়েছিল। আর আপনারা নিজেরাও ভালো করে জানেন যে,উমাইয়ারা,যারা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত গোটা মুসলিম জাহানে শাসন ক্ষমতা চালিয়েছিল,তারা তাঁর পবিত্র আলোকময় অস্তিত্বকে ম্লান করে দেওয়ার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল,জনগণকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল,তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ ও দুর্নাম রটিয়ে ছিল,তাঁকে সকল মেম্বর (মঞ্চ) থেকে অভিসম্পাত বর্ষণ করেছিল। আর যারা তাঁর প্রশংসায় মুখ খুলতো যেমন ইবনে সিক্কীত,তাদেরকে হুমকি ধমকিসহ এমনকি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে হত্যা করেছে। তদ্রুপভাবে যে কোনো কথায় যদি তাঁর কোনো প্রশংসার ঘ্রাণ পাওয়া যেত কিংবা তাঁকে স্মরণের কারণ হতো তাহলে তা বলতে বাধা দিত। এমনকি কোনো সন্তানকে তাঁর নামে নাম রাখতেও অনুমতি দিত না।
কিন্তু এত কিছুর পরেও কোনো ফল হয়নি। তাঁর আকাশ ছোঁয়া মহিমা ও মর্যাদা মৃগনাভির হৃদয়গ্রাহী সুঘ্রাণের মতো-যা লুকিয়ে রাখা যায় না,যতই তাকে লুকিয়ে রাখা হয় ততই তা মূল্যবান হয়ে ওঠে,কিংবা সূর্যের অপ্রতিরোধ্য উজ্জ্বলতার মতো যা হাতের তালুতে বন্দী করা যায় না,কিংবা প্রস্ফূটিত দিনের শুভ্রতার মতো যা অন্ধ চোখ দেখতে না পেলেও অগণিত চাক্ষুষ্মানের চোখ তার থেকে উপকার লাভ করে থাকে।
আমি আর কি বলবো সেই ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে যাঁর প্রত্যেকটি গুণ-বৈশিষ্ট্য নিজে নিজে গর্ব করে,প্রত্যেক ফেরকাই তাদের বংশ লতিকাকে তাঁর কাছে নিয়ে উপনীত করে আর প্রত্যেক দলই তাঁকে নিজের দিকে টানতে চায়।
তিনি হলেন সকল শুভ এবং পুণ্যের উৎসমূল,সেগুলোর পূর্ণতা দানকারী। তিনি সকল মঙ্গলের অগ্রদূতসম আর সকল পুণ্যের প্রতিভাস স্থল। তাঁর পরে যে কেউ যে কোনো মর্যাদার অধিকারী হলে সেটা তাঁর থেকেই সে গ্রহণ করে থাকে,তাঁকেই অনুসরণ করেছে এবং তাঁর পথেই গমন করেছে।’’
(শারহে নাহজুল বালাগা,ইবনে আবিল হাদীদ,খণ্ড ১,পৃঃ ১৬)
ইবনে আব্দুল বার মালেকী আহমাদ ইবনে হাম্বাল এবং ইসমাঈল ইবনে ইসহাকের নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যে,‘‘
যা কিছু আলী ইবনে আবি তালিবের মর্যাদায়‘
হাসান’
সনদবিশিষ্ট রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে তা অন্য কোনো সাহাবীর সম্পর্কে বর্ণিত হয়নি।’’
(আল-ইস্তিয়াব,খণ্ড ৩ পৃঃ ৫১,মুস্তাদরাকে হাকেম,খণ্ড. ৩,পৃঃ ১০৭,তারীখে দামেস্ক,খণ্ড ৩,পৃঃ ৮৩,১১৭,তাহযীবুত তাহযীব,ইবনে হাজার,খণ্ড ৭,পৃঃ ৩৩৯,নেসায়ী ও অন্যান্য)
এই মুহূর্তে আমাদের সম্মুখে রয়েছে মূল্যবান ও বিরাট এক স্মৃতিকথা। আমাদের মহান মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর (জন্ম থেকে শাহাদাত পর্যন্ত) শ্রেষ্ঠত্বের স্মৃতিকথা,তৎকালীন দিনকাল,শাসনব্যবস্থাসহ যেখানেই তাঁর সে শ্রেষ্ঠত্বের স্মৃতি চিহ্ন বহন করে,সে সকল স্মৃতি কথা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। সেসকল বর্ণাঢ্য শ্রেষ্ঠত্বের সামনে দাঁড়িয়ে সম্মানে আমাদের মাথা অবনত হয়ে আসে। কারণ,তিনি হলেন তাদের জন্য একটি স্পষ্ট মানদণ্ডস্বরূপ যারা হাকীকতকে (প্রকৃত সারসত্য) চিনতে সক্ষম হয়েছে এবং সেই পথে অগ্রসর হয়েছে এবং তার ধারক বাহকদেরকে অনুসরণ করেছে। আর দুনিয়া যাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে ফলে তারা সত্য থেকে চোখ বুঁজে মিথ্যাপন্থীদের পেছনে ধাবিত হয়েছে। তারা হলো ঐ জঙ্গে জামালের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী দল,জঙ্গে সিফফীনের অত্যাচারী দল আর বেদআতপন্থী খারিজী দল। আর সেসকল দু-মুখো মুনাফিক দল যারা মনের মধ্যে অসংখ্য দ্বিধা আর সংকোচ নিয়ে মাটির টিলার ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে যে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন্ দিকে ঘুরে এবং বিজয় কার প্রাপ্য হয়…
.
হে আল্লাহ! আমাদেরকে সত্যপন্থীদের সঙ্গী করে দাও এবং আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) এর সাথে পুনরুত্থিত করো যিনি সত্য পথের দিশা লাভকারীদের প্রতীক স্বরূপ,মুত্তাকীদের নেতা,ন্যায়পন্থীদের অগ্রদূত,সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী,সাধকদের সৌন্দর্য শোভা এবং মুক্তিপ্রাপ্তদের সরদার।
এবার এতসব পুণ্য ও মর্যাদার সাগর থেকে যা শুধু কেবল এক আল্লাহর উপাসনাকারীদের মাওলা আমিরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর ব্যক্তিত্বেই সৌন্দর্য বর্ধন করে,তার মধ্যে থেকে ১১০টি হাদীসকে বেছে নিয়ে তাঁরই পবিত্র নামে উৎসর্গ করছি। মহানবী (সা.)-এর পবিত্র যবান থেকে নিঃসৃত হযরত আলী (আ.)-এর মর্যাদায় এই বাণীগুলো যেন সূর্যের ভাষায় চন্দ্রের স্ত্ততি। অবশ্য,‘‘
এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্যে যার অনুধাবন করার মতো অন্তর রয়েছে অথবা যে নিবিষ্ট মনে শ্রবণ করে। আর তিনি নিজে তো সবার ওপর সাক্ষী রয়েছেন।’’
(কফঃ৩৭)