অনুবাদকের কথা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে আমাদের সমাজে বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে এ বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তির ব্যাপারে বিশেষ জিজ্ঞাসা ও ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়। এ সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার জবাবে জানা যায় যে,বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের আক্বিদাহ্ পোষণের কারণেই কোনোরূপ দলীয় সাংগঠনিক কাঠামো ছাড়াই ইরানে এ বিপ্লব সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে যখন জানা যায় যে,হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) ইরাকের নাজাফে নির্বাসিত জীবন যাপন কালে“
বেলায়াতে ফকীহ্”
শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন,তখন এ ধারণা অধিকতর শক্তিশালী হয়।
এ তথ্যের সাথে দু’
টি ধারণা প্রসূত ব্যাখ্যা যুক্ত হয়ে যায়। একটি ধারণা এই যে,হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের উদ্গাতা; যদিও তিনি ইসলামী সূত্র থেকে উপাদান নিয়ে এ তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন,তবে তার আগে বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের বিষয়টির প্রতি কারোই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় নি। এ ধারণা গড়ে ওঠার পিছনে একটি বড় কারণ এই যে,ইমাম খোমেনীর আগে কেউই গায়রে ফকিহের শাসনকে অবৈধ গণ্য করে তার অবসান ঘটানো ও তদস্থলে ফকিহের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেন নি এবং সে লক্ষ্যে বিপ্লব ঘটাবার উদ্যোগ নেন নি। দ্বিতীয়তঃ ধারণা করা হয় যে,বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব শিয়া মাযহাবের সাথে সামঞ্জস্যশীল; আহলে সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। বলা হয় যে,শিয়া মাযহাবের ইমামতের আক্বিদাহর কারণে শিয়াদের মধ্যে দল-উর্ধ ধর্মীয় নেতার প্রতি যে আনুগত্য গড়ে উঠেছে আহলে সুন্নাতের মধ্যে তা সম্ভব নয়।
বলা বাহুল্য যে,দুটো ধারণাই প্রকৃত অবস্থা থেকে বেশ দূরে। বেলায়াতে ফকীহ্ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) কর্তৃক উদ্ভাবিত কোনো তত্ত্ব নয়,যদিও তিনি এ ধারণাকে অনেক শানিত করেছেন। বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের শাসনের বিষয়টি ইসলামে সব সময়ই ছিলো। বিশেষ করে সকল যুগেই শিয়া মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে অতীতে এর রাজনৈতিক দিকটি কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো; বাস্তবে রূপায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় নি; তেমনি তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতিও তৈরী হয় নি। (স্মর্তব্য,বেলায়াতে ফকীহ্ কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয় নয়,বরং সর্বাত্মক দ্বীনী নেতৃত্বের বিষয়।) হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) উপযুক্ত প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেলায়াতে ফকীহর ধারণাকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয়তঃ বেলায়াতে ফকীহ্ শিয়া মাযহাবের কোনো একান্ত বিষয় নয়,বরং এটা শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে গোটা মুসলিম উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। প্রকৃত পক্ষে শিয়াদের পূর্বেই সুন্নীদের জন্য বেলায়াতে ফকীহ্ তথা উপযুক্ততম দ্বীনি নেতা ও শাসকের অপরিহার্যতা দেখা দেয়। কারণ,শিয়া মাযহাবের ইমামতের আক্বিদাহর দাবী অনুযায়ী সর্বশেষ ইমামের জনসমাজের আড়ালে চলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইমাম ব্যতীত কোনো‘
উপযুক্ততম দ্বীনী নেতা ও শাসকের’
অপরিহার্যতা দেখা দেয় নি। কিন্তু আহলে সুন্নাতের মাঝে ইমামতের আক্বিদাহ্ না থাকার অনিবার্য দাবী হচ্ছে,হযরত রাসূলে আকরামের (সা.) ইন্তেকালের পর পরই মুসলিম উম্মাহর জন্য‘
উপযুক্ততম দ্বীনি নেতা ও শাসকের’
অপরিহার্যতা দেখা দেয়। কারণ,তাত্ত্বিকভাবে‘
উপযুক্ততম দ্বীনী নেতা ও শাসক’
ব্যতীত কেউই আল্লাহর রাসূলের (সা.) স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন না। এখানে কেউ কেউ হয়তো ছাহাবীগণ,তাবে‘
ঈন ও তাবে‘
তাবে‘
ঈন-কে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত গণ্য করার কথা বলতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাত্ত্বিকভাবে তাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত গণ্য করা যেতে পারে না। কারণ,তারা ছিলেন একটি সীমিত সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ,যদিও তাদের মধ্যকার উপযুক্ততম ব্যক্তিগণকে‘
উপযুক্ততম দ্বীনি নেতা ও শাসক’
হিসেবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে গণ্য করতে বাধা নেই। (অবশ্য ব্যক্তি হিসেবে উপযুক্ততম ব্যক্তি কে তা এক স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়।)
“
আল-‘
উলামাউ ওয়ারাছাতুল্ আম্বিয়া”
(আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী) - এ হাদীছটি শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের সূত্রে বর্ণিত এমন একটি হাদীছ যার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কখনোই বিতর্ক সৃষ্টি হয় নি এবং বিচারবুদ্ধিও এর প্রতিপাদ্যকে সমর্থন করে। মূলতঃ বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন-কর্তৃত্বের তত্ত্ব এ হাদীছেই নিহিত। পরবর্তীকালে আহলে সুন্নাতের মনীষীগণ শাসকের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আহলুল হাল্লি ওয়াল্‘
আক্বদ্ তথা দ্বীনি বিষয়ে মতামত দানের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকগণ কর্তৃক শাসক নির্বাচনের কথা বলেছেন যা বর্তমান ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রায় সমার্থক। তবে উক্ত হাদীছ ও বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী যদিও আহলে সুন্নাতের মধ্যে“
সর্বোত্তম চরিত্রের দূরদর্শী ও সুপরিচালক আলেমে দ্বীনই হবেন মুসলমানদের শাসক এবং তার পরিবর্তে গায়রে আলেমের শাসন-কর্তৃত্বের বৈধতা নেই”
- এ মর্মে আক্বিদাহ্ গড়ে ওঠা প্রয়োজন ছিলো,কিন্তু কার্যতঃ বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ না করার কারণে এ আক্বিদাহ্ গড়ে ওঠে নি। বিলম্বে হলেও,ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরে অন্ততঃ এ দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে,বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়াই এটিকে ইমাম খোমেইনীর (রহ্ঃ) উদ্ভাবন ও শিয়া মাযহাবের সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে অভিহিত করে একে পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
যা-ই হোক,এখনো এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। এ ব্যাপারে বক্ষ্যমাণ অনুবাদগ্রন্থটি উৎসাহ সৃষ্টির কারণ হবে বলে আশা করা যায়। প্রশ্নোত্তর আকারে লিখিত অত্র সংক্ষিপ্ত গ্রন্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে,এতে বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন প্রশ্নে উদ্ভূত সর্বশেষ সংশয়মূলক প্রশ্নাবলীর জবাব দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য যে,ইসলামী হুকুমাতের বিরোধী শক্তির বিভ্রান্তিকর প্রচারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাবেই এসব প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব থেকে বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের নিকট বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত ধারণা অনেকখানি সুস্পষ্ট হবে বলে আশা করি। সেই সাথে আরো আশা করি যে,এ থেকে বাংলাভাষী ইসলামী মহল সমূহ,বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকীহর শাসন সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হবেন এবং সমাজের জন্য ফকীহ্ ও ফকীহ্ শাসকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে উচ্চতর দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে ইজতিহাদী শিক্ষাও যোগ করবেন(এ ক্ষেত্রে তারা শিয়াদের অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হতে পারেন)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা অবান্তর হবে না যে,আমাদের সমাজে দ্বীনী মহল সমূহের মধ্যকার অন্তর্বিরোধ,বিশেষতঃ গৌণ বিষয়াদি কেন্দ্রিক অন্তর্বিরোধের জন্য ইজতিহাদী শিক্ষা ও মুজতাহিদের উপস্থিতি না থাকাই প্রধান কারণ।
অনুবাদ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে,পরিবেশগত পার্থক্যের কারণে বাংলাভাষী পাঠকদের জন্যে কয়েকটি বিষয়ের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা ও কিছু মনীষী সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা প্রদান জরুরী গণ্য করেছি এবং তা অন্ত্যটীকা আকারে সংযোজন করেছি। আশা করি টীকাগুলো পাঠক-পাঠিকাদেরদেরকে উপকৃত করবে।
অত্র গ্রন্থের অনুবাদ বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদেরকে আলোচ্য বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা দিতে এবং এ বিষয়ে চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হলেই অনুবাদকের শ্রম সার্থক হবে। আল্লাহ্ তা‘
আলা অত্র গ্রন্থের রচনা,অনুবাদ,প্রকাশ,প্রচার,অধ্যয়ন ও আলোচনা-পর্যালোচনাকে তার দ্বীনের খেদমত হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
বিনীত
নূর হোসেন মজিদী
ঢাকা
১৬ই সফর ১৪৩০
১লা ফাল্গুন ১৪১৫
১৩ই ফেব্র“
য়ারী ২০০৯।