মুজতাহিদ নন এমন বিশেষজ্ঞগণ কি বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য হতে পারেন?
জবাবঃ ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর পরই হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর উপস্থিতিতে যখন সংবিধান প্রণয়নকারী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সামনে বেলায়াতে ফকীহ্ মূলনীতি প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো তখনো অন্য একভাবে এ সংশয় উত্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু সংবিধান প্রণয়নকারী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের জ্ঞান,সচেতনতা ও দূরদর্শিতা এবং ইসলামী বিপ্লবোত্তর ভাবগম্ভীর পরিবেশের কারণে এ প্রশ্নটি গুরুত্ব লাভ করে নি ও সহজেই বাদ পড়ে যায়।
কিন্তু পরবর্তীকালে,ভবিষ্যত রাহবার হিসেবে মনোনীত ব্যক্তিকে
বাদ দেয়ার পরে এবং বিশেষ করে সংশোধনের যুগে এ সংশয় শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বর্তমানে অধিকতর শক্তিশালীভাবে তা উপস্থাপিত হচ্ছে।
উপরোক্ত প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে মুজতাহিদ শাসক হচ্ছেন ইমামতের পদের স্থলাভিষিক্ত এবং তিনি আল্লাহর ওলীগণের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। তার হুকুমাতের বৈধতা মা‘
ছূম ইমামের (আ.) হুকুমাতের বৈধতার ন্যায়ই স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার নিকট থেকেই উৎসারিত। বস্ততঃ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলা ব্যতীত অন্য কেউই মুজতাহিদের হুকুমাতের বৈধতা প্রদানের উপযুক্ত নয়।
এ বিষয়টির মূল নবুওয়াতের দর্শনে নিহিত রয়েছে। তা হচ্ছে,মানুষের জন্য আদর্শ নির্ধারণ ও আইন মূলগতভাবে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলা ছাড়া আর কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় সে সব আইন প্রয়োগের জন্যেও আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে শাসক নির্ধারণ বা মনোয়ন অপরিহার্য। আর মুজতাহিদ শাসক আল্লাহ্ তা‘
আলার সাথে তার নৈকট্য,চিন্তা ও আচরণের ভারসাম্য,সুবিচার ও ইলমী অগ্রগণ্যতার কারণে এ দায়িত্বের জন্য মনোনীত হন।
ইসলামে হুকুমাতের মর্যাদা হচ্ছে একটি খোদায়ী কার্যের হেফাযতের মর্যাদা। এর মানে হচ্ছে,আসমানী দ্বীন এবং ঐশী ও পবিত্র পদ এর মালিক অর্থাৎ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হতে হবে।
মা‘
ছূম ইমামমগণের (আ.) প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের যুগ শেষ হওয়ার পরে হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগ শুরু হয় এবং তিনি কখন আত্মপ্রকাশ করবেন তা কারোই জানা নেই। এমতাবস্থায় জনগণকে তো তাদের সামাজিক ও সামষ্টিক প্রয়োজনের প্রশ্নে পথনির্দেশনা ও পরিচালনা বিহীন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া যায় না। (এরূপ ছেড়ে দেয়া হলে তা হতো বিচারবুদ্ধির দাবীরও পরিপন্থী।) তাই মা‘
ছূম ইমাম (আ.) তার পক্ষ থেকে সাধারণ ও নীতিগতভাবে প্রতিনিধি মনোনীত করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শাসকের শর্ত ও গুণাবলী জানিয়ে দেন এবং এভাবেই মুসলিম সমাজের জন্য মুজতাহিদ শাসক মনোনীত করেন। আর বিশেষজ্ঞগণের দায়িত্ব হচ্ছে ইমাম (আ.) কর্তৃক নির্ধারিত শর্তাবলীর আলোকে মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করা ও জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দেয়া। এর ফলে তার শাসন-কর্তৃত্ব সমাজের জন্য অলঙ্ঘনীয় হয়ে যায়।
অতএব,বিষয়বস্তুর দাবী অনুযায়ী,এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞকে অবশ্যই পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদকে চিহ্নিত করার জন্যে প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞত্বের অধিকারী হতে হবে। তাই বিশেষজ্ঞের জন্য বিশেষজ্ঞত্বের যে ন্যূনতম শর্ত রাখা হয়েছে তা হচ্ছে,তাকে অন্ততঃ ফিকাহর কতক বিভাগে ইজতিহাদের যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে যাতে তার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞত্বের সংজ্ঞাটি প্রযোজ্য হয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ১০৭ নং ধারা অনুযায়ী মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ইসলামের আহকাম ও ফিক্বহী বিষয়াদির জ্ঞানে বা রাজনৈতিক ও সামাজিক-সামষ্টিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে অগ্রগণ্যতা বা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বা সংবিধানের ১০৯ নং ধারায় বর্ণিত গুণাবলীর কোনোটির ক্ষেত্রে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু যারা মুজতাহিদ নন তারা কিছুতেই ইসলামের আহকাম ও ফিক্বহী বিষয়াদির জ্ঞানে কোন্ মুজতাহিদ অগ্রগণ্য তা নির্ণয় করতে সক্ষম নন। অন্যদিকে এ ইজতিহাদী যোগ্যতা ব্যতীত অন্য যে সব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে একজন মুজতাহিদের মধ্যে তা আছে কিনা মুজতাহিদগণের পক্ষে তা-ও নির্ণয় করা সম্ভব।
ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের মর্যাদা অত্যন্ত সমুন্নত ও পবিত্র মর্যাদা। এ কারণে এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির মধ্যে একজন শাসকের জন্য প্রয়োজনীয় সাধারণ গুণাবলী ছাড়াও দ্বীনী বিষয়ে বিশেষজ্ঞত্বের অধিকারী হওয়া অপরিহার্য যাতে তিনি যথাযথভাবে দ্বীন ইসলামের হেফাযত করতে পারেন। তাই বিশেষজ্ঞকে অবশ্যই এ ধরনের যোগ্যতম ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। তারা মুজতাহিদ শাসক মনোনয়ন ও তাকে এখতিয়ার প্রদানের ক্ষমতা রাখেন না,কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত মুজতাহিদ শাসকের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সমূহ সর্বাধিক মাত্রায় কার বেলায় প্রযোজ্য হয় তা চিহ্নিত করার মতো যোগ্যতা তাদের অবশ্যই থাকতে হবে।
বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওলামায়ে কেরামের মধ্যে এমন ব্যক্তির সংখ্যা কম নয় যারা ইজতিহাদী যোগ্যতা ছাড়াও অর্থনীতি,আইন,রাষ্ট্রবিজ্ঞান,প্রশাসনিক বিজ্ঞান,সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীরও অধিকারী। তবে মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিতকরণ ও বিশেষজ্ঞ পরিষদে স্থানলাভের জন্য মূল ও অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে তাকে মুজতাহিদ হতে হবে এবং যোগ্যতম মুজতাহিদ কে সে সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ ধারণার অধিকারী হতে হবে। আমরা যদি ধরে নেই যে,পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করার জন্যে অন্যান্য জ্ঞানের বিশেষজ্ঞেরও দরকার আছে,তাহলে সে ক্ষেত্রে এমন মুজতাহিদকে বিশেষজ্ঞত্বের দায়িত্ব দেয়া উচিৎ যিনি অন্যান্য জ্ঞানেও বিশেষজ্ঞ,কিন্তু কিছুতেই বিশেষজ্ঞের জন্য মুজতাহিদ হওয়ার শর্ত বাদ দেয়া তথা মৌলিক বিষয়কে বাদ দিয়ে গৌণ বিষয়কে যথেষ্ট গণ্য করা যেতে পারে না। এর বিশেষ কারণ এই যে,ইসলামী নেতৃত্ব তথা মুজতাহিদ শাসকের জন্য মূল শর্ত হচ্ছে তাকে ফিকাহর ক্ষেত্রে রায় দেয়ার মতো যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। অন্যান্য বিষয়ে তার যোগ্যতা অবশ্যই কাম্য,তবে ফিকাহ্ ভিন্ন অন্যান্য বিষয়ে তার বিশেষজ্ঞ হওয়া অপরিহার্য নয়। এখানে ফিকাহ্ই গুরুত্বপূর্ণ,এ কারণে বিশেষজ্ঞদেরকে অবশ্যই মুজতাহিদ হতে হবে।
একটি বিমানের ডিজাইন করার কাজ সারা রাত আল্লাহর ইবাদত করেন এমন একজন আরেফ ও দার্শনিক মুজতাহিদকে দেয়া যেতে পারে না,এমনকি একই সাথে তিনি যদি একজন স্থাপত্য বিশারদও হয়ে থাকেন। বিমানের ডিজাইন তৈরীর জন্য এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞত্বের অধিকারী আলাদা ইঞ্জিনীয়ার প্রয়োজন। অন্যদিকে একজন মুজতাহিদ ইজতিহাদের কাজে দক্ষতার অধিকারী। আর বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের যে কাজ তা মুজতাহিদগণের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ,এ পরিষদের কাজ হচ্ছে পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত ও সমাজের নিকট পরিচিত করিয়ে দেয়া। তাকে চিহ্নিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অবশ্যই প্রয়োজনীয় শর্তাবলী বিদ্যমান থাকতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে ফিকাহর জ্ঞান। অতএব,তাকে অবশ্যই মুজতাহিদ হতে হবে।
অবশ্য অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে,রাজনীতি ও প্রশাসন পরিচালনা বিশেষজ্ঞত্বের বিষয়। তাদের মতে,প্রশাসন পরিচালনা ও রাজনৈতিক যোগ্যতাই মুখ্য বিষয়,একাডেমিক ডিগ্রী মুখ্য বিষয় নয়। মুজতাহিদ শাসকের এ প্রশাসনিক যোগ্যতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা চিহ্নিত করার জন্য আলাদা কোনো বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করণ ও সে লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ পরিষদ গঠনের বিধানের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। অতএব,যারা নিজেদেরকে আইনের সমর্থক বলে দাবী করেন তারাও এ বিষয়টি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে,১৩৫৯ ফার্সী সালের মেহের মাসে (অক্টোবর ১৯৮০) প্রণীত বিশেষজ্ঞ পরিষদের নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের ২নং ধারা অনুযায়ী জনগণের নির্বাচিতব্য বিশেষজ্ঞদেরকে নিুলিখিত শর্তের অধিকারী হতে হবে ঃ
১) দ্বীনদারী,সত্যবাদিতা ও নির্ভরযোগ্যতা এবং চারিত্রিক উপযুক্ততা,
২) এমন পর্যায়ের ইজদিহাদী যোগ্যতা যাতে কতক ফিক্হী সমস্যার সমাধান প্রমাণ করতে সক্ষম হন,
৩) রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্দৃষ্টি এবং চলমান রাজনৈতিক সমস্যাবলীর সাথে পরিচিতি,
৪) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আস্থাশীল,
৫) দূষণীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক অতীতের অধিকারী না হওয়া।
অতএব,মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করার বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যপদের জন্য যারা প্রার্থী হবেন তাদেরকে অবশ্যই মুজতাহিদ হতে হবে - যারা ফিকাহর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্যে অন্ততঃ কতগুলোতে বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ ফিক্বহী বিধান অনুসন্ধানের যোগ্যতার অধিকারী। সেই সাথে তাদেরকে চারিত্রিক দিক থেকে উপযুক্ত হতে হবে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্দৃষ্টিরও অধিকারী হতে হবে। এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়া হলে অতঃপর আর উপরোক্ত সংশয়ের অবকাশ থাকে না।
অতএব,ইজতিহাদী ভিত্তি,অভিজ্ঞতা ও প্রশাসনিক জ্ঞানের আলোকে বিশেষজ্ঞ পরিষদে অ-মুজতাহিদ বিশেষজ্ঞের অন্তর্ভুক্তির দাবীর পিছনে শরয়ী ও আইনগত কোনো প্রমাণ নেই।