ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব0%

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব লেখক:
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

লেখক: আলী শীরাযী
: নূর হোসেন মজিদী
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 15409
ডাউনলোড: 4105

পাঠকের মতামত:

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 20 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15409 / ডাউনলোড: 4105
সাইজ সাইজ সাইজ
ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

ফকিহ-এর নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্ব জিজ্ঞাসা ও জবাব

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মানব সমাজের জন্য ফকিহদের নেতৃত্বের প্রয়োজন কেন?

জবাবঃ রাষ্ট্রদর্শনের মনীষীগণ প্রায় সর্বসম্মতভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে,মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি অপরিহার্য বিষয়। অর্থাৎ তারা মনে করেন যে,সমাজে এমন একটি গোষ্ঠী,দল বা প্রতিষ্ঠান থাকা অপরিহার্য যা আদেশ প্রদান করবে এবং অন্যরা তা মেনে চলবে,অথবা তারা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য আইন-কানুন ও বিধিবিধান সমূহ কার্যকর করবে এবং যারা এ সবের বিরোধিতা বা লঙ্ঘন করবে তাদেরকে পাকড়াও করবে ও শাস্তি প্রদান করবে।

শুধু নৈরাজ্যবাদীরাই মনে করে যে,মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। প্রাচীন গ্রীসে এই চৈন্তিক গোষ্ঠীর সমর্থক ছিলো। নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকগণ মনে করতেন যে,জনগণ যদি আইন-কানুন সম্পর্কে অবহিত থাকে তাহলে তারা নৈতিক নিষ্ঠার কারণেই তা মেনে চলবে,অতএব,তখন আর তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোনো প্রয়োজন হবে না।

এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে,নৈরাজ্যবাদীদের এ ধারণা একটি কল্পনা নির্ভর ও ভিত্তিহীন অপরিপক্ব ধারণা। ইসলাম ও মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনহীনতার ধারণাকে অপরিপক্ব ও অবাস্তব ধারণা বলে গণ্য করেছে। বস্তুতঃ সব সময়ই মানব সমাজে আইন লঙ্ঘনকারী ও অপরাধে লিপ্ত কিছু লোক ছিলো ও আছে এবং নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে,ভবিষ্যতেও এ ধরনের লোক থাকবেই।

নাহ্জুল্ বালাগায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীতে বলা হয়েছে যে,এমনকি সমাজে যদি ন্যায়বান ও উপযুক্ত লোকদের হুকুমাত না থাকে সে ক্ষেত্রে হুকুমাত বিহীন অবস্থার তুলনায় যালেম ও পাপাচারী লোকদের শাসনও অপেক্ষাকৃত উত্তম। কারণ,মানব সমাজে যদি হুকুমাত বা আইন-কানুন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ না থাকে তাহলে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং এর ফলে সমষ্টির স্বার্থ ও কল্যাণ বিনষ্ট হবে।

অতএব,দেখা যাচ্ছে যে,ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণের সর্বাধিক অপরিহার্য দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বান লোকদের পরিচালিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা যা সমাজের জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। এ রাষ্ট্রের শাসক হবেন হয় স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.),অথবা কোনো মা ছূম ইমাম (আ.) অথবা পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহ।

বিচারবুদ্ধিজাত প্রথম মূলনীতি অনুযায়ী কোনো মানুষই অন্য কোনো মানুষের ওপর শাসনক্ষমতা,নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের অধিকার রাখে না,যদি না বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে তার জন্য শাসনক্ষমতার অধিকার প্রমাণিত হয়। আর যেহেতু বিচারবুদ্ধির রায় থেকে সকল সৃষ্টির ওপর আল্লাহ্ তা আলার শাসনাধিকার অকাট্যভাবে প্রমাণিত,সেহেতু নীতিগতভাবে কেবল সেই শাসন কর্তৃত্বই গ্রহণযোগ্য যার যে কোনো হস্তক্ষেপ,নিয়ন্ত্রণ ও শাসন-কর্তৃত্ব কার্যতঃ স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার শাসন কর্তৃত্বে পর্যবসিত হয়। অন্যথায় পূর্বোক্ত প্রাথমিক মূলনীতির বাইরে যাওয়া যাবে না অর্থাৎ কোনো মানুষই অন্য কোনো মানুষের ওপর শাসন ক্ষমতা,নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের অধিকার রাখে না।

কেবল নবী-রাসূলগণের (আ.) ও তাদের উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্তগণের শাসনই কার্যতঃ আল্লাহ্ তা আলার শাসনে পর্যবসিত হয়। এ ধরনের শাসনের আনুগত্য করা জনগণের অপরিহার্য কর্তব্য। তাহলে একদিকে জনগণের পক্ষে যেমন স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা সম্ভব হবে,তেমনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত শাসকের পক্ষেও সমষ্টির কাজে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করণ ও সমাজকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করা,সমাজের স্বার্থ ও কল্যাণের বিনাশ প্রতিরোধ এবং সমাজের লোকদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সৌভাগ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

দ্বীন ইসলাম মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের সৌভাগ্য নিশ্চিত করে। ইসলাম হচ্ছে মানব জাতির জন্য পরিপূর্ণতম জীবন ব্যবস্থা। ইবাদত-বন্দেগী,রাজনীতি,সমাজ,অর্থনীতি,আইন,শাস্তি,প্রতরক্ষা,শিক্ষা,পরিবার তথা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই ইসলামের আইন-কানুন ও বিধি-বিধান রয়েছে যা প্রগতিশীল ও সার্বিক দিক থেকে উপযোগী। রাষ্ট্র ও শাসক সম্বন্ধেও ইসলামের আইন ও পরিকল্পনা আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের প্রধানকে অবশ্যই দ্বীনী তথা ইসলামী ও রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। সেই সাথে তাকে ইসলামের সার্বিক নীতিমালা থেকে বিস্তারিত ও খুটিনাটি বিধি-বিধান উদ্ঘাটনের যোগ্যতা এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় সাহসিকতা,দৃঢ়তা ও আমানতদারীর অধিকারী হতে হবে এবং পাপকার্য থেকে দূরে থাকতে হবে।

হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা ছূম ইমামগণের (আ.) যুগের পরে এবং হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে এ দায়িত্ব পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসকের ওপর অর্পিত। আর জনগণের জন্য ধরণীর বুকে আল্লাহ্ তা আলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্যে তাকে মেনে চলা এবং তার আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য। মা ছূম ইমামগণ (আ.) এ দায়িত্ব পালনের জন্য ফকিহ শাসকগণকে নিয়োগ করেছেন।

ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের দশম খণ্ডের ১৭৪ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তার ইন্তেকালের আগেই হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপন যুগের সময় পর্যন্ত তার স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত ইমামগণই (আ.) তার উম্মতের জন্য স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করেন। সঠিক পথের ওপর অধিষ্ঠিত নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) যদ্দিন ছিলেন তদ্দিন তারাই ছিলেন তার স্থলাভিষিক্ত,অতঃপর ফকিহগণ এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন।

ফকিহগণ হচ্ছেন আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হুকুমাতের শীর্ষ ব্যক্তি। আর এ হুকুমাতের প্রধানও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেই নির্ধারিত হন এবং মা ছূমগণ (আ.) তাদেরকে নিয়োগ দেন ও পরিচয় করিয়ে দেন যাতে তারা খোদায়ী হুকুমাতের নেতৃত্ব প্রদান করেন।

আমরা এ দৃষ্টিকোণের সাথে একমত এবং এতে বিশ্বাসী। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)ও আমাদেরকে এ দৃষ্টিকোণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তার বেলায়াতে ফকীহ্ গ্রন্থের ২৬ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ মহান আল্লাহ্ তা আলা কতগুলো আইন-কানুন অর্থাৎ শরয়ী বিধিবিধান প্রেরণের পাশাপাশি একটি হুকুমাত ও একটি প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

হযরত ইমাম (রহ্ঃ) একই গ্রন্থের ৩১ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ যে কেউ বলে যে,ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই,কার্যতঃ সে খোদায়ী বিধি-বিধান বাস্তবায়নের অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করে এবং সুস্পষ্ট দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও চিরন্তন জীবন বিধান হওয়ার সত্যতাকেও অস্বীকার করে।

ইসলাম মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্র এবং আল্লাহর ওলীগণ ও ফকিহগণের শাসন-কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। অতএব,মুসলমানদের জন্য ফকিহগণের শাসন-কর্তৃত্ব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ফকিহ শাসকের শাসন-কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করার মানে হচ্ছে তাগূতকে অভ্যর্থনা জানানো। মানুষের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। অতএব,তারা যদি খোদায়ী শাসককে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে এর মানে হচ্ছে এই যে,তারা তাগূতের শাসনব্যবস্থায় আস্থা স্থাপন করেছে।

ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের ১৭তম খণ্ডের ১০৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ একটি হুকুমাত যদি পূর্ব থেকেই পবিত্র শরীয়ত ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে বৈধতার অধিকারী না হয়ে থাকে তাহলে তা তার সকল মর্যাদা ও এখতিয়ার এবং তার প্রশাসনযন্ত্র ও সকল শাখা-প্রশাখা সহ তার আইন বিভাগ,বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগের অধিকাংশ কাজকর্মই শরয়ী বৈধতা বিহীন হবে। রাষ্ট্রের বিভাগ সমূহের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের শরীয়তের মাধ্যমে বৈধতা লাভ অপরিহার্য; এতদ্ব্যতীত তা অবৈধ হয়ে পড়ে। আর শরয়ী বৈধতা ব্যতিরেকে যদি কাজকর্ম সম্পাদন করা হয় তাহলে রাষ্ট্র ও সরকার তার সকল মর্যাদা ও এখতিয়ার সহ তাগূতী ও অপরাধীতে পরিণত হবে।

অতএব,এটা বলা যেতে পারে না যে,একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একজন রাষ্ট্রপ্রধান থাকাই যথেষ্ট এবং আমাদের জন্য ফকিহ শাসক ও ফকিহগণের শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।

ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের দশম খণ্ডের ৫৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ প্রজাতন্ত্রের প্রধান বা প্রেসিডেন্টকে ফকিহের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে।

একই গ্রন্থের নবম খণ্ডের ২৫৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমামের (রহ্ঃ) উক্তি ঃ প্রজাতন্ত্রের প্রধান বা প্রেসিডেন্টের নিয়োগ যদি ফকিহ শাসকের অনুমোদনক্রমে না হয় তাহলে তা হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ হলে তা হবে তাগূত এবং তার আনুগত্যও হবে তাগূতের আনুগত্য।

এর মানে হচ্ছে তার আনুগত্য করা হারাম হবে।

রাষ্ট্রের আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগও কেবল ফকিহ শাসকের মনোনয়ন বা অনুমোদনের মাধ্যমেই শরয়ী বৈধতার অধিকারী হয়। এটাই হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) সহ বুযুর্গানে দ্বীনের অভিমত। হযরত ইমাম (রহ্ঃ)-এর কর্মজীবনও এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তিশীল ছিলো।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) শুরু থেকে মা ছূমগণের (আ.) দ্বারা মনোনীত শাসকের তথা পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকিহ শাসকের নিরঙ্কুশ শাসন-কর্র্তৃত্বে এবং দ্বীনী হুকুমাতের শরয়ী বৈধতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বিশ্বাসের ওপর অটল ছিলেন এবং তদনুযায়ী আমল করেছেন। এ অভিমত ব্যক্তকরণ ও তদনুযায়ী আমল করণ ছিলো তার দ্বীনী দায়িত্ব। আমরাও এর ভিত্তিতে এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী এবং এর অনুসারী।

বেলায়াতে ফকীহ্ কি ঐশী পদ,নাকি পার্থিব ও জনগণের দ্বারা নির্বাচনীয় পদ?

জবাবঃ যেহেতু জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণকে নির্বাচন করে এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তারা ফকিহ শাসককে নির্বাচিত করেন,অতএব,এর ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নেতা পরোক্ষভাবে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত এবং এ হিসেবে এটি একটি পার্থিব পদ ও তার পদাভিষেক কার্যতঃ জনগণ কর্তৃক আইনগত বৈধতা লাভ করে,সেহেতু উপরোক্ত প্রশ্নের ও সংশয়ের উদয় হয়েছে।

এ প্রশ্ন ও সংশয়ের জবাবে বলতে হয় ঃ এভাবে জনগণ কর্তৃক বৈধতা প্রদান মানে প্রকৃত পক্ষে ফকিহ শাসককে গ্রহণ করে নেয়া। ফকিহ শাসকের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি নির্ধারণ করার জন্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে এমন একটি পথ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে যাতে আইনানুগ ফকিহ শাসক জনগণের সমর্থনের ফলে ইসলামী সমাজে খোদায়ী আইন-কানুন ও বিধি-বিধান বাস্তবায়ন ও কার্যকর করণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হন।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) অস্থায়ী সরকারের প্রধান মন্ত্রী নিয়োগের ঘোষণায় বলেনঃ শরয়ী অধিকার এবং ইরানী জনগণ আন্দোলনে শরীক হয়ে সারা ইরানে বহু সংখ্যক বিশাল বিশাল জনসভা ও বিরাট বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে অকাট্যভাবে প্রায় সর্বসম্মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহকারে যে মতামত ব্যক্ত করেছে তা থেকে উৎসারিত আইনগত অধিকারের ভিত্তিতে আমি আপনাকে অস্থায়ী সরকার গঠনের জন্য দায়িত্ব প্রদান করলাম।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর দৃষ্টিতে জনগণ কর্তৃক নির্বাচন - তা বিশাল বিশাল জনসভা ও বিরাট বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমেই হোক বা সর্বোচ্চ নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের মাধ্যমেই হোক - মুজতাহিদ শাসকের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বের বৈধতার উৎস নয়। কারণ,হুকুমাতের বৈধতার মূল উৎস হচ্ছে দ্বীন এবং আল্লাহ্ তা আলার শরীয়াত বা আইন-বিধান প্রণয়ন বিষয়ক শাসন-কর্তৃত্ব। আর জনগণ কর্তৃক তা গ্রহণ করার ফলে প্রকৃত পক্ষে ফকিহের ঐশী হুকুমাত বাস্তবে কার্যোপযোগিতা লাভ করে এবং এর ফলে সে হুকুমাত সুদৃঢ় ও টেকসই হয়।

জনগণ যখন এ ধরনের হুকুমাত ও শাসন-কর্তৃত্বকে গ্রহণ করে নেয় তখন দ্বীনের ওপর আস্থার ও খোদা-কেন্দ্রিকতার পতাকা উড্ডীন হয় এবং বেলায়াতে ফকীহর ছায়াতলে জনগণের অন্তঃকরণে ও দৃষ্টিতে তাওহীদ,নবুওয়াত ও ইমামতের সীমাহীন বরকত বর্ষিত হতে থাকে এবং পূর্ণতার পথ সমুজ্জল হয়ে ওঠে।

জনগণের এ ভূমিকাকেই গ্রহণযোগ্যতা (مقبوليت ) নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ গ্রহণযোগ্যতা সকল যুগেই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ছিলো এবং সব সময়ই আদর্শ ও নেতৃত্বের পাশে স্থান লাভ করেছে। আর এ হচ্ছে এমন এক বাস্তবতা যে,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এর অধিকারী ছিলেন। তাই এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেনঃ

) هو الذی ايدک بنصره و بالمؤمنين (

তিনিই সেই সত্তা যিনি স্বীয় সাহায্য ও মু মিনদের দ্বারা আপনাকে শক্তিশালী করেছেন।

এর কারণেই,আমরা দেখতে পাই,হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) বলেনঃ জনগণ যদি তাদের রাষ্ট্রক্ষমতায় একজন ন্যায়বান ফকিহকে অধিষ্ঠিত করার জন্য নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করে এবং তারা এক ব্যক্তিকে নেতৃত্বের জন্য নির্বাচিত করেন,অতঃপর তিনি নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন,তাহলে অবশ্যই তিনি জনগণ কর্তৃক গ্রহণযোগ্য হয়েছেন। ফলে তিনি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত শাসক এবং তার আদেশ-নিষেধ অবশ্য কার্যকরযোগ্য। (ছাহীফায়ে নূর,২১তম খণ্ড,পৃঃ ১২৯)

জনগণ যদি নেতাকে সমর্থন না করে এবং নেতার পিছনে না থাকে তাহলে সুস্পষ্ট যে,জনগণের নিকট তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং এ কারণে তার আদেশ-নিষেধ কার্যকর হয় না। কিন্তু এর মানে ফকিহ শাসককে জনগণ কর্তৃক বৈধতা প্রদান নয়। কারণ,গ্রহণ করা-না করা ও বৈধতা প্রদান এক কথা নয়। জনগণ গ্রহণ না করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত শাসক শাসনক্ষমতা পরিচালনার সুযোগ না পেতে পারেন,কিন্তু সে কারণে দ্বীন ও শরীয়াতের দৃষ্টিতে তার মনোনয়ন বৈধতা হারায় না।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) অন্যত্র এ বিষয়টির ওপর সুস্পষ্টভাবে আলোকপাত করেছেন। ছাহীফায়ে নূর গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খণ্ডের ৯৫ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমামের (রহ্ঃ) যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকিহের শাসন-কর্তৃত্ব এমন কোনো বিষয় নয় যা নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদ কর্তৃক তৈরী হয়েছে। বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা মহান আল্লাহ্ তা আলা তৈরী করেছেন। আর এ হচ্ছে সেই শাসন-কর্তৃত্ব স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) যার অধিকারী ছিলেন।

একই গ্রন্থের ১৯তম খণ্ডের ২৩৭ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত উক্তিতে হযরত ইমাম (রহ্ঃ) বলেনঃ পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকিহগণ মা ছূম ইমামগণের (আ.) পক্ষ থেকে সকল শরয়ী,রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে প্রতিনিধিত্বের অধিকারী,আর হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে সকল বিষয়ের দায়িত্বই তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে।

এ ধরনের ফকিহ শাসককে সমর্থন,সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা জনগণের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। আর ফকিহ শাসক যখন জনগণের সমর্থনপুষ্ট হন তখন তার জন্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম আলী (আ.) বলেনঃ

لو لاحضور الحاضر و قيام الحجة بوجود الناصر .

যদি এ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত না হতেন এবং এই সাহায্যকারীগণ থাকার কারণে আমার জন্য হুজ্জাত (চূড়ান্ত প্রমাণ) প্রতিষ্ঠিত না হতো (তাহলে আমি খেলাফতের এ দায়িত্ব গ্রহণ করতাম না)।

নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণের দায়িত্ব হচ্ছে মা ছূম ইমামগণের (আ.) ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে মনোনীত ফকিহ শাসককে চিহ্নিত করা ও জনগণের নিকট পরিচয় করিয়ে দেয়া। তারা হচ্ছেন মুজতাহিদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং এরূপ শাসককে চিহ্নিতকরণের যোগ্যতার অধিকারী। তাই তারা সাক্ষ্য দেন যে,এই ব্যক্তি নেতা হওয়ার যোগ্যতার অধিকারী। বিষয়টি এমন নয় যে,নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ -যারা সমাজের সদস্যগণ তথা জনগণের অন্যতম,তারা এক ব্যক্তিকে নেতা হিসেবে বৈধতা প্রদান করেন এবং তাকে এ পদের জন্য নির্বাচিত করেন। বরং নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণের কাজ হচ্ছে তারা নেতৃত্বের মানদণ্ড সম্পর্কে যে জ্ঞান রাখেন তার ভিত্তিতে সমকালে এ মানদণ্ড যার ব্যাপারে প্রযোজ্য এমন ব্যক্তি সম্বন্ধে সাক্ষ্য প্রদান করা। আর তাদের এভাবে সাক্ষ্যদানের ফলে যে সাধারণ জনগণ ফকিহ শাসককে চিহ্নিত করতে সক্ষম নয় তাদের করণীয় সুস্পষ্ট হয়ে যায়।

অতীতেও সাধারণ লোকেরা মুজতাহিদদেরকে চেনার জন্য তাদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখেন এমন বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হতো। তারা তখন নিজ নিজ শহরের শীর্ষস্থানীয় ও মোত্তাকী-পরহেযগার খ্যাতনামা আলেমদের নিকট যেতো এবং জিজ্ঞেস করতো ঃ সবচেয়ে বড় অলেম কে? বেশী জ্ঞানী কে? আজকের দিনেও সাধারণ জনগণ পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে নেতা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচন করে। আর নির্বাচিত বিশেষজ্ঞগণ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাদের বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে এ ধরনের ফকিহ নেতাকে চিহ্নিত করেন এবং তাকে জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দেন,যাতে জনগণ মা ছূম ইমামের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকিহ শাসকের প্রতি সমর্থন ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার বিধি-বিধান বাস্তবায়নের পথকে মসৃণ করে দিতে পারে।

একজন লোকের মধ্যে ফিক্বহী বিষয়ে বিশেষজ্ঞত্ব,দ্বীনী আইন-কানুন ও বিধি-বিধান চিহ্নিত ও প্রমাণিত করণের যোগ্যতা এবং দ্বীনের মৌলিক ভিত্তি সমূহের সাথে পরিচিতির মাত্রা কতখানি তা যথাযথভাবে বুঝতে পারা কোনো সহজ কাজ নয়। এ কারণেই এ বিষয়ে সচেতন ও বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তির শরণাপন্ন না হয়ে পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসককে চিনতে পারা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমরা যদি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা দেখতে পাই যে,আল্লাহ্ তা আলা,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা ছূম ইমামগণের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত ফকিহ শাসককে চেনার জন্যে সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে এমন বিশেষজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হওয়া যারা জনগণের হাতকে একজন ন্যায়বান,মোত্তাকী ও সুপরিচালক ফকিহের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন এবং যাদের ব্যাপারে জনগণ নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে,তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের অনুসরণ করলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়া সম্ভবপর হবে।