মানব সমাজের জন্য ফকিহদের নেতৃত্বের প্রয়োজন কেন?
জবাবঃ রাষ্ট্রদর্শনের মনীষীগণ প্রায় সর্বসম্মতভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে,মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি অপরিহার্য বিষয়। অর্থাৎ তারা মনে করেন যে,সমাজে এমন একটি গোষ্ঠী,দল বা প্রতিষ্ঠান থাকা অপরিহার্য যা আদেশ প্রদান করবে এবং অন্যরা তা মেনে চলবে,অথবা তারা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য আইন-কানুন ও বিধিবিধান সমূহ কার্যকর করবে এবং যারা এ সবের বিরোধিতা বা লঙ্ঘন করবে তাদেরকে পাকড়াও করবে ও শাস্তি প্রদান করবে।
শুধু নৈরাজ্যবাদীরাই মনে করে যে,মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। প্রাচীন গ্রীসে এই চৈন্তিক গোষ্ঠীর সমর্থক ছিলো। নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকগণ মনে করতেন যে,জনগণ যদি আইন-কানুন সম্পর্কে অবহিত থাকে তাহলে তারা নৈতিক নিষ্ঠার কারণেই তা মেনে চলবে,অতএব,তখন আর তাদের জন্য রাষ্ট্রের কোনো প্রয়োজন হবে না।
এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে,নৈরাজ্যবাদীদের এ ধারণা একটি কল্পনা নির্ভর ও ভিত্তিহীন অপরিপক্ব ধারণা। ইসলাম ও মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনহীনতার ধারণাকে অপরিপক্ব ও অবাস্তব ধারণা বলে গণ্য করেছে। বস্তুতঃ সব সময়ই মানব সমাজে আইন লঙ্ঘনকারী ও অপরাধে লিপ্ত কিছু লোক ছিলো ও আছে এবং নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে,ভবিষ্যতেও এ ধরনের লোক থাকবেই।
‘
নাহ্জুল্ বালাগায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীতে বলা হয়েছে যে,এমনকি সমাজে যদি ন্যায়বান ও উপযুক্ত লোকদের হুকুমাত না থাকে সে ক্ষেত্রে হুকুমাত বিহীন অবস্থার তুলনায় যালেম ও পাপাচারী লোকদের শাসনও অপেক্ষাকৃত উত্তম। কারণ,মানব সমাজে যদি হুকুমাত বা আইন-কানুন বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ না থাকে তাহলে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হবে এবং এর ফলে সমষ্টির স্বার্থ ও কল্যাণ বিনষ্ট হবে।
অতএব,দেখা যাচ্ছে যে,ইসলামের দৃষ্টিতে জনগণের সর্বাধিক অপরিহার্য দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বান লোকদের পরিচালিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা যা সমাজের জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। এ রাষ্ট্রের শাসক হবেন হয় স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.),অথবা কোনো মা‘
ছূম ইমাম (আ.) অথবা পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকীহ।
বিচারবুদ্ধিজাত প্রথম মূলনীতি অনুযায়ী কোনো মানুষই অন্য কোনো মানুষের ওপর শাসনক্ষমতা,নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের অধিকার রাখে না,যদি না বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে তার জন্য শাসনক্ষমতার অধিকার প্রমাণিত হয়। আর যেহেতু বিচারবুদ্ধির রায় থেকে সকল সৃষ্টির ওপর আল্লাহ্ তা‘
আলার শাসনাধিকার অকাট্যভাবে প্রমাণিত,সেহেতু নীতিগতভাবে কেবল সেই শাসন কর্তৃত্বই গ্রহণযোগ্য যার যে কোনো হস্তক্ষেপ,নিয়ন্ত্রণ ও শাসন-কর্তৃত্ব কার্যতঃ স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার শাসন কর্তৃত্বে পর্যবসিত হয়। অন্যথায় পূর্বোক্ত প্রাথমিক মূলনীতির বাইরে যাওয়া যাবে না অর্থাৎ কোনো মানুষই অন্য কোনো মানুষের ওপর শাসন ক্ষমতা,নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের অধিকার রাখে না।
কেবল নবী-রাসূলগণের (আ.) ও তাদের উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্তগণের শাসনই কার্যতঃ আল্লাহ্ তা‘
আলার শাসনে পর্যবসিত হয়। এ ধরনের শাসনের আনুগত্য করা জনগণের অপরিহার্য কর্তব্য। তাহলে একদিকে জনগণের পক্ষে যেমন স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা সম্ভব হবে,তেমনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত শাসকের পক্ষেও সমষ্টির কাজে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করণ ও সমাজকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করা,সমাজের স্বার্থ ও কল্যাণের বিনাশ প্রতিরোধ এবং সমাজের লোকদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সৌভাগ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
দ্বীন ইসলাম মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতের সৌভাগ্য নিশ্চিত করে। ইসলাম হচ্ছে মানব জাতির জন্য পরিপূর্ণতম জীবন ব্যবস্থা। ইবাদত-বন্দেগী,রাজনীতি,সমাজ,অর্থনীতি,আইন,শাস্তি,প্রতরক্ষা,শিক্ষা,পরিবার তথা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যই ইসলামের আইন-কানুন ও বিধি-বিধান রয়েছে যা প্রগতিশীল ও সার্বিক দিক থেকে উপযোগী। রাষ্ট্র ও শাসক সম্বন্ধেও ইসলামের আইন ও পরিকল্পনা আছে। ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের প্রধানকে অবশ্যই দ্বীনী তথা ইসলামী ও রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। সেই সাথে তাকে ইসলামের সার্বিক নীতিমালা থেকে বিস্তারিত ও খুটিনাটি বিধি-বিধান উদ্ঘাটনের যোগ্যতা এবং আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় সাহসিকতা,দৃঢ়তা ও আমানতদারীর অধিকারী হতে হবে এবং পাপকার্য থেকে দূরে থাকতে হবে।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) যুগের পরে এবং হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে এ দায়িত্ব পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসকের ওপর অর্পিত। আর জনগণের জন্য ধরণীর বুকে আল্লাহ্ তা‘
আলার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্যে তাকে মেনে চলা এবং তার আনুগত্য ও অনুসরণ অপরিহার্য। মা‘
ছূম ইমামগণ (আ.) এ দায়িত্ব পালনের জন্য ফকিহ শাসকগণকে নিয়োগ করেছেন।
‘
ছাহীফায়ে নূর’
গ্রন্থের দশম খণ্ডের ১৭৪ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ“
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তার ইন্তেকালের আগেই হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপন যুগের সময় পর্যন্ত তার স্থলাভিষিক্ত ঘোষণা করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত ইমামগণই (আ.) তার উম্মতের জন্য স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করেন। সঠিক পথের ওপর অধিষ্ঠিত নিষ্পাপ ইমামগণ (আ.) যদ্দিন ছিলেন তদ্দিন তারাই ছিলেন তার স্থলাভিষিক্ত,অতঃপর ফকিহগণ এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন।”
ফকিহগণ হচ্ছেন আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত হুকুমাতের শীর্ষ ব্যক্তি। আর এ হুকুমাতের প্রধানও আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকেই নির্ধারিত হন এবং মা‘
ছূমগণ (আ.) তাদেরকে নিয়োগ দেন ও পরিচয় করিয়ে দেন যাতে তারা খোদায়ী হুকুমাতের নেতৃত্ব প্রদান করেন।
আমরা এ দৃষ্টিকোণের সাথে একমত এবং এতে বিশ্বাসী। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)ও আমাদেরকে এ দৃষ্টিকোণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ২৬ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
মহান আল্লাহ্ তা‘
আলা কতগুলো আইন-কানুন অর্থাৎ শরয়ী বিধিবিধান প্রেরণের পাশাপাশি একটি হুকুমাত ও একটি প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়ও নির্ধারণ করে দিয়েছেন।”
হযরত ইমাম (রহ্ঃ) একই গ্রন্থের ৩১ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
যে কেউ বলে যে,ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই,কার্যতঃ সে খোদায়ী বিধি-বিধান বাস্তবায়নের অপরিহার্যতাকে অস্বীকার করে এবং সুস্পষ্ট দ্বীন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও চিরন্তন জীবন বিধান হওয়ার সত্যতাকেও অস্বীকার করে।”
ইসলাম মানব সমাজের জন্য রাষ্ট্র এবং আল্লাহর ওলীগণ ও ফকিহগণের শাসন-কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। অতএব,মুসলমানদের জন্য ফকিহগণের শাসন-কর্তৃত্ব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ফকিহ শাসকের শাসন-কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করার মানে হচ্ছে তাগূতকে অভ্যর্থনা জানানো। মানুষের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। অতএব,তারা যদি খোদায়ী শাসককে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে এর মানে হচ্ছে এই যে,তারা তাগূতের শাসনব্যবস্থায় আস্থা স্থাপন করেছে।
‘
ছাহীফায়ে নূর’
গ্রন্থের ১৭তম খণ্ডের ১০৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ“
একটি হুকুমাত যদি পূর্ব থেকেই পবিত্র শরীয়ত ও আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে বৈধতার অধিকারী না হয়ে থাকে তাহলে তা তার সকল মর্যাদা ও এখতিয়ার এবং তার প্রশাসনযন্ত্র ও সকল শাখা-প্রশাখা সহ তার আইন বিভাগ,বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগের অধিকাংশ কাজকর্মই শরয়ী বৈধতা বিহীন হবে। রাষ্ট্রের বিভাগ সমূহের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের শরীয়তের মাধ্যমে বৈধতা লাভ অপরিহার্য; এতদ্ব্যতীত তা অবৈধ হয়ে পড়ে। আর শরয়ী বৈধতা ব্যতিরেকে যদি কাজকর্ম সম্পাদন করা হয় তাহলে রাষ্ট্র ও সরকার তার সকল মর্যাদা ও এখতিয়ার সহ তাগূতী ও অপরাধীতে পরিণত হবে।
অতএব,এটা বলা যেতে পারে না যে,একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য একজন রাষ্ট্রপ্রধান থাকাই যথেষ্ট এবং আমাদের জন্য ফকিহ শাসক ও ফকিহগণের শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন নেই।
‘
ছাহীফায়ে নূর’
গ্রন্থের দশম খণ্ডের ৫৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ“
প্রজাতন্ত্রের প্রধান বা প্রেসিডেন্টকে ফকিহের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে।”
একই গ্রন্থের নবম খণ্ডের ২৫৩ নং পৃষ্ঠায় হযরত ইমামের (রহ্ঃ) উক্তি ঃ“
প্রজাতন্ত্রের প্রধান বা প্রেসিডেন্টের নিয়োগ যদি ফকিহ শাসকের অনুমোদনক্রমে না হয় তাহলে তা হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ হলে তা হবে তাগূত এবং তার আনুগত্যও হবে তাগূতের আনুগত্য।”
এর মানে হচ্ছে তার আনুগত্য করা হারাম হবে।
রাষ্ট্রের আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগও কেবল ফকিহ শাসকের মনোনয়ন বা অনুমোদনের মাধ্যমেই শরয়ী বৈধতার অধিকারী হয়। এটাই হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) সহ বুযুর্গানে দ্বীনের অভিমত। হযরত ইমাম (রহ্ঃ)-এর কর্মজীবনও এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তিশীল ছিলো।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) শুরু থেকে মা‘
ছূমগণের (আ.) দ্বারা মনোনীত শাসকের তথা পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ফকিহ শাসকের নিরঙ্কুশ শাসন-কর্র্তৃত্বে এবং দ্বীনী হুকুমাতের শরয়ী বৈধতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বিশ্বাসের ওপর অটল ছিলেন এবং তদনুযায়ী আমল করেছেন। এ অভিমত ব্যক্তকরণ ও তদনুযায়ী আমল করণ ছিলো তার দ্বীনী দায়িত্ব। আমরাও এর ভিত্তিতে এ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী এবং এর অনুসারী।