সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য ফকিহ শাসক মাত্র একজন হওয়া জরুরী ?
সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য ফকিহ শাসক মাত্র একজন হওয়া জরুরী,নাকি প্রত্যেক জাতির শাসক স্বতন্ত্র হতে পারেন?
জবাবঃ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ),মরহূম নারাক্বী
,মরহূম মারাগ্বেয়ী
ও‘
জাওয়াহের’
গ্রন্থের প্রণেতা প্রমুখ বহু মনীষী এবং এমনকি মরহূম নায়ীনী
বেলায়াতে ফকীহ্ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এমন সব দলীল উল্লেখ করেছেন যা থেকে প্রমাণিত হয় যে,সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য একজন ফকিহ শাসক থাকা প্রয়োজন।
এ অভিমতের ভিত্তি হচ্ছে এ দৃষ্টিকোণ যে,ফকিহ শাসক আল্লাহ্ তা‘
আলা ও তার খাছ বান্দাহ্দের পক্ষ থেকে মনোনীত হন। হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে আল্লাহ্ তা‘
আলা একজন ফকিহ শাসক মনোনীত করেন এবং সকলের জন্যই তার আনুগত্য করা অপরিহার্য।
তাত্ত্বিক দিক থেকে ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটাই বাঞ্ছিত যে,সমগ্র ইসলামী জাহানের জন্য একজন মাত্র ফকিহ শাসক থাকবেন। নেতৃত্বের এ ঐক্য ইসলামী ঐক্যকে এবং মুসলমানদের সামাজিক শক্তি ও তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন নিশ্চিত করবে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় ফিক্বহী বিষয়ের মতো নয় যে,জনগণ এ ব্যাপারে তাদের পছন্দ মোতাবেক বিভিন্ন মারজা-এ তাক্বলীদের
কাছে যাবে অথবা সতর্কতার মূলনীতির ভিত্তিতে আমল করবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক তথা সামষ্টিক বিষয়াদি এমন যে,শেষ পর্যন্ত জনগণকে একটি রায়ের ভিত্তিতে আমল করতে হবে। আর এ ব্যাপারে আইনগত ও শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে ফকিহ শাসকের রায়েরই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি রয়েছে। কারণ,মুজতাহিদ ফকীহ্ পরম দয়াবান আল্লাহ্ তা‘
আলা ও মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত। সুতরাং সকলের জন্যই তার রায় মেনে চলা অপরিহার্য।
যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্ন এলে এক ব্যক্তিকে আদেশ দিতে হবে যে,আমরা যুদ্ধ করবো,নাকি সন্ধি করবো। এ ব্যাপারে একজন ফকিহ শাসকের পক্ষ থেকে আদেশ আসতে হবে এবং সকলকে তার আদেশ মেনে নিতে ও তদনুযায়ী কাজ করতে হবে। নচেৎ সমস্যার সৃষ্টি হবে; বিভিন্ন মতের উদ্ভব ঘটবে; কতক ব্যক্তি শান্তির সমর্থন করবেন এবং অপর কতক ব্যক্তি যুদ্ধের সমর্থন করবেন। এভাবে বিভিন্ন মতের ফলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং করণীয় সম্পর্কে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে,আর এর পরিণতি হচ্ছে পরাজয়।
এমনকি ঈদুল ফিতর উদযাপনের মতো বিষয়েও প্রায় সর্বসম্মত সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকিহ ও মারজা-এ তাক্বলীদ্ অভিমত পোষণ করেন যে,এ ব্যাপারে ফকিহ শাসকের রায়ই অনুসৃত হতে হবে। কারণ,এটি একটি সামষ্টিক বিষয় এবং মতামতের বিভিন্নতা জনিত বিশৃঙ্খলা এড়ানো,জনগণকে ঈদের দিনে হারাম রোযা রাখার আশঙ্কা থেকে মুক্ত রাখা ও মাহে রামাযানের শেষ দিবসে রোযা রাখতে সহায়তা করার লক্ষ্যে ইসলাম এ ব্যাপারে ফকিহের রায়কে কার্যকর গণ্য করেছে। এমতাবস্থায় ফকিহ শাসক যদি একজন না হন তাহলে মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং,খোদা না করুন,মুসলিম জনগণের একাংশের দ্বারা গুনাহ্ সংঘটিত হয়ে পড়া অসম্ভব কিছু নয়।
সমকালীন বিশ্বে যখন সর্ব প্রথম ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বেলায়াতে ফকীহ্ বা ফকিহের শাসন বাস্তবে কার্যকর হয় তখন প্রায় সর্বসম্মত মতের ভিত্তিতে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-কে ইসলামী জাহানের ফকিহ শাসক রূপে গ্রহণ করা হয়। সারা দুনিয়ার সকল মুসলমানই তার বেলায়াত বা দ্বীনী শাসন-কর্তৃত্বকে মেনে নেয়। ঐ সময় কেউই বলে নি যে,পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী ইসলামী নেতৃত্বের জন্য হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর চেয়ে যোগ্যতর কেউ আছেন। শাসক হিসেবে একমাত্র হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর পক্ষেই সমগ্র ইসলামী জাহানের কল্যাণ নির্ধারণ করা সম্ভব ছিলো এবং এবং একমাত্র তিনিই সমাজকে ইসলামী আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতে পরিচালনা করতে সক্ষম ছিলেন। সমগ্র ইসলামী জাহানই এ বিষয়টি এবং এ তত্ত্ব ও আদর্শিক অভিমতকে মেনে নেয়।
ইসলামী বিপ্লবের পথিকৃৎ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর পরেও এমন এক ব্যক্তিকে পাওয়া যায় যিনি হযরত ইমামের অনুরূপ,যার মধ্যে ইমামের অভিন্ন চিন্তা-চেতনা ও যোগ্যতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি হলেন হযরত আয়াতুল্লাহ্ ওযমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী। হযরত ইমামের পরে তিনি ফকিহ শাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন এবং সমগ্র ইসলামী জাহান তার একক নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানায়। ইসলামী জাহানে তার এ গ্রহণযোগ্যতায় এখনো কোনো পরিবর্তন ঘটে নি,বরং ইসলামী দুনিয়া তাকে নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বের এখতিয়ারের অধিকারী ফকিহ শাসক হিসেবে গণ্য করে।
বস্তুতঃ ইসলামী জাহানের ও মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব,শৌর্যবীর্য ও সম্মান এই নেতৃত্বের একত্বের ছায়াতলেই নিহিত। আজকের দুনিয়ায় ইরাকী জনগণ নিজেদেরকে ইসলামী বিপ্লবের রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীর অনুসারী রূপে গণ্য করে। লেবাননের বিপ্লবী মুসলিম জনগণের সংগঠন হিযবুল্লাহর নেতা সাইয়েদ হাসান নাছরুল্লাহ্ নিজেকে মুজতাহিদ শাসকের সৈনিক বলে মনে করেন। মুসলিম দেশসমূহ ও ইউরোপ-আমেরিকা সহ বিশ্বের যে কোনো স্থানের মুসলিম জনগণের অধিকাংশই নিজেদেরকে ফকিহ শাসকের অনুগত ও অনুসারী বলে মনে করে।
ফকিহের নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে এ সমঝোতা ও মতৈক্য ইসলামী সমাজের ঐক্যের ও মুসলমানদের মধ্যে সমন্বয়ের এবং ইসলামের বিরাট শক্তির সামনে ইসলামের দুশমনদের পরাজয়ের কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
এটা নিঃসন্দেহ যে,ইসলাম এটাই চায় এবং এটাকেই সমর্থন করে ও স্বীকৃতি দেয়। ইসলামে নেতৃত্বের ঐক্য হচ্ছে একটি অনুসরণীয় আদর্শ তত্ত্ব এবং এটা সকলের দ্বারাই স্বীকৃত হয়েছে যে,নেতৃত্বের ঐক্য ইসলামী জাহানের অগ্রগতির এবং বিশ্বের কুফরী শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ইসলামী জাতিসমূহের বিজয়ের কারণ।
আমরাও হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ),মরহূম নারাক্বী,মরহূম মারাগেয়ী,‘
জাওয়াহের’
গ্রন্থের প্রণেতা ও মরহূম নায়ীনীর অনুসরণে এ মতকেই সমর্থন করি। আর যেহেতু আমাদের‘
আক্বিদাহ্ হচ্ছে এই যে,মুজতাহিদ শাসক স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলা ও মা‘
ছূমগণের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত,সেহেতু আমাদের এ-ও‘
আক্বিদাহ্ যে,সারা বিশ্বের জনগণের,বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য একজন একক মুজতাহিদ শাসকের আনুগত্য ও অনুসরণ করা অপরিহার্য।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার লেখা‘
হুকুমাতে ইসলামী’
গ্রন্থে বলেনঃ“
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা,তার দায়িত্ব গ্রহণ এবং তার সকল সামষ্টিক কাজকর্ম সম্পাদনের ব্যাপারে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) যে শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার ছিলো ফকিহ শাসক সেই একই শাসন-কর্তৃত্বের অধিকারী।”
হযরত ইমাম ফকিহ শাসকের জন্য রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) ন্যায় অভিন্ন ক্ষমতা ও এখতিয়ারের প্রবক্তা ছিলেন,বরং একে অপরিহার্য গণ্য করতেন। তিনি মনে করতেন,ফকিহ শাসক রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হুবহু হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারের অধিকারী।
এমন কথা কেউ বলে না যে,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) হুকুমাত একটি বা কয়েকটি দেশে বা ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই মুজতাহিদ ফকীহ্ হুকুমাতের জন্যও কোনো সীমারেখা গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব,ফকিহ শাসক বিশ্বের সকল মুসলমানের জন্য শাসক। সুতরাং সকল মুসলমানেরই উচিৎ তার রায় ও ফতোয়া অনুসরণ করা।