বেলায়াতে ফকীহ্ প্রমাণের উদ্ধৃতিযোগ্য দলীল কী?
জবাবঃ এ বিষয়ে উদ্ধৃতিযোগ্য দলীল হচ্ছে সেই সব রেওয়ায়েত যাতে বলা হয়েছে যে,সাধারণ জনগণের জন্য তাদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে ফকীহ্ বা মুজতাহিদগণের শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য অথবা যে সব হাদীছে ফকীহ্গণকে নবী-রাসূলগণের (আ.)“
আমানতের ধারক-বাহক”
(اُمناء
),“
খলীফাহ্”
ও“
উত্তরাধিকারী”
হিসেবে এবং কর্মদায়িত্বশীল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এখানে এসব দলীলের কয়েকটির উল্লেখ করছি ঃ
১) শেখ ছাদূক (রহ্ঃ) তার বিখ্যাত হাদীছ-গ্রন্থ“
মান্ লা ইয়াহযুরুল্ ফাক্বীহ্”
তে নিম্নোক্ত হাদীছটি উদ্ধৃত করেছেনঃ
قال امير المؤمنين (عليه السلام): قال رسول الله (صلی الله عليه و آله): اللهم ارحم خلفائی. قيل: يا رسول الله و من خلفاؤک؟ قال الذين يروون عنی حديثی و سنتی.
“
আমীরুল মু’
মিনীন (আ.) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেনঃ হে আল্লাহ্! আমার খলীফাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। তাকে প্রশ্ন করা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনার খলীফাহ্ কারা? তিনি বললেনঃ যারা আমার নিকট থেকে আমার হাদীছ ও আমার সুন্নাত বর্ণনা করে।”
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার আল-বাই‘
(البيع
) গ্রন্থের ৪৬২ নং পৃষ্ঠায় বলেছেনঃ“
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর খেলাফত ও স্থলাভিষিক্ততার বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসের সূচনা কাল থেকেই সুস্পষ্ট তাৎপর্যের অধিকারী ছিলো এবং এতে কোনো রকমের দুর্বোধ্যতা বা অস্পষ্টতাই ছিলো না। তখন যদি খেলাফতের বিষয়টি বেলায়াত ও হুকুমাতের বাহ্যিক তাৎপর্য বহন না-ও করে থাকে,তো কম পক্ষে এ তাৎপর্য বহন করতো যে,বেলায়াত ও হুকুমাত হচ্ছে খেলাফতের সুদৃঢ়তম ও সুস্পষ্টতম নিদর্শন।”
হযরত ইমাম তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ৭৯ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে,আলোচ্য হাদীছের উক্তিতে ঐ সব হাদীছ-বর্ণনাকারীকে অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় নি যাদের ব্যাপারে কাতেব বা লিপিকার কথাটি প্রযোজ্য। কারণ,একজন লেখক বা লিপিকার হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর খলীফাহ্ হতে পারেন না,বরং এখানে খলীফাহ বলতে ফকীহ্গণকে বুঝানো হয়েছে।”
হযরত ইমাম তার একই গ্রন্থের ৮১ নং পৃষ্ঠায় একই আলোচনার ধারাবাহিকতায় লিখেছেনঃ“
অতএব,উক্ত হাদীছ থেকে যে বেলায়াতে ফকীহ্ প্রমাণিত হয় এ ব্যাপারে কোনোই সন্দেহ করা উচিৎ নয়। কারণ,এখানে খেলাফত মানে নবুওয়াতের সকল দিককে শামিলকারী স্থলাভিষিক্ততা।”
২) এ বিষয়ে ফকীহ্গণের মধ্যে যে রেওয়ায়েতটি বিশেষভাবে বিখ্যাত তা“
তাওক্বী‘
শারীফ”
নামে সর্বাধিক সুপরিচিত। মরহূম শেখ ছাদূক তার লেখা“
আকমালুদ্ দীন্”
গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড,পৃঃ ৪৮৩) এ রেওয়ায়েতটি উদ্ধৃত করেছেন। ইসহাক বিন ইয়াকুব হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর নিকট একটি পত্র লিখেন এবং তাতে তার নিকট জানতে চান ঃ হযরত ইমামের (আ.) দীর্ঘ আত্মগোপনের যুগে যে সব ঘটনা সংঘটিত হবে এবং যুগ জিজ্ঞাসার উদয় হবে সে সবের বেলায় আমাদের করণীয় কী?
হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) এ প্রশ্নের জবাবে ইসহাক বিন ইয়াকুবকে লিখে পাঠান ঃ
و اما الحوادث الواقعة فارجعوا فيها الی رواة احاديثنا فانهم حجتی عليکم و انا حجة الله عليهم.
“
আর উদ্ভূত ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে তোমরা আমাদের হাদীছ বর্ণনাকারীদের নিকট গমন করো,কারণ,তারা হচ্ছেন তোমাদের ওপর আমার হুজ্জাত এবং আমি তাদের ওপর আল্লাহর হুজ্জাত।”
এখানে‘
উদ্ভূত ঘটনাবলী’
(الحوادث
الواقعة
) বলতে আভিধানিক দৃষ্টিতে কোনোভাবেই শরয়ী আহ্কামের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীকে বুঝানো হয় নি। বরং ইসহাক বিন ইয়াকুবের প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিলো হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে সংঘটিতব্য সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনাবলী ও ইসলামী সমাজে উদ্ভবনীয় সমস্যাবলী।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ১০৩ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
রেওয়ায়েতে বর্ণিত‘
উদ্ভূত ঘটনাবলী’
(الحوادث
الواقعة
) বলতে শরয়ী আহকাম সংশ্লিষ্ট সমস্যাবলীকে বুঝানো হয় নি। বরং এর দ্বারা হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগের অভূতপূর্ব সামাজিক ঘটনাবলী এবং জনগণ ও মুসলমানদের সমস্যাবলীর কথা বুঝানো হয়েছে।”
মরহূম শেখ আনছারী তার‘
মাকাসেব’
গ্রন্থের ১৫৫ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ উক্ত হাদীছে যা বলা হয়েছে তা থেকে বুঝতে পারি যে,এ রেওয়ায়েতটির উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি।”
ইতিপূর্বে যেমন আভাস দেয়া হয়েছে উক্ত রেওয়ায়েতের বর্ণনাকারীগণও হচ্ছেন ইসলামের ফকীহ্। হাদীছ বর্ণনাকারীকে অবশ্যই হুজ্জাত ও কোনো নির্ভরযোগ্য শরয়ী দলীলের ভিত্তিতে তার রেওয়ায়েতকে মা‘
ছূম ইমাম (আ.) পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হতে হবে। এ বিশেষজ্ঞত্ব ফিকাহ্ শাস্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং ইসলামের ফকীহ্গণ তথা মুজতাহিদগণ এ বিশেষজ্ঞত্বের অধিকারী।
আয়াতুল্লাহ্ মা‘
রেফাত
ও এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ৭৮ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
উক্ত রেওয়ায়েতে বর্ণিতحجتی
عليکم
কথার অর্থ হচ্ছে মা‘
ছূম ইমাম (আ.)-এর নিরঙ্কুশ বেলায়াতের অনুরূপ।”
অতএব,দেখা যাচ্ছে যে,অত্র রেওয়ায়েত থেকেও বেলায়াতে ফকীহ্ প্রমাণিত হয়। কারণ,এর বর্ণনাকারীরাও হচ্ছেন সেই মুজতাহিদ ও ওলামায়ে দ্বীন। তারা হচ্ছেন সেই ফকীহ্ বা মুজতাহিদ যারা মা‘
ছূম ইমাম (আ.)-এর এখতিয়ারের নিরঙ্কুশ শাসন-কর্তৃত্বের অধিকারী।”
৩) ওমর বিন হানযালাহ্ কর্তৃক হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) থেকে বর্ণিত রেওয়ায়েত। এ রেওয়ায়েতটি সকলের নিকটই গৃহীত হয়েছে,যে কারণে এটি‘
রেওয়ায়েতে মাক্ববুলাহ্’
নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আল্লামা হুর‘
আমুলী
তার“
ওয়াসায়েলুশ্ শী‘
আহ্”
গ্রন্থে (১৮তম খণ্ড,পৃঃ ৯৮) লিখেছেনঃ ওমর বিন হানযালাহ্ বলেনঃ
“
শিয়াদের মধ্যকার দু’
জন লোক - যাদের মধ্যে ঋণ বা মীরাছ নিয়ে বিরোধ ছিলো এবং তারা সমকালীন শাসক কর্তৃক নিয়োজিত বিচারকের নিকট ফয়সালার জন্য গিয়েছিলো,তাদের ব্যাপারে ইমাম সাদেক (আ.)কে জিজ্ঞেস করলাম যে,তাদের এ কাজ কি বৈধ ছিলো?
“
জবাবে ইমাম বললেনঃ যে ব্যক্তিই যথার্থ দাবী বা মিথ্যা দাবী নিয়ে তাদের কাছে যায়,প্রকৃত পক্ষে সে তাগূতের কাছে অর্থাৎ অবৈধ শাসকের কাছে গেলো এবং তাদের রায়ের ভিত্তিতে সে যা কিছু গ্রহণ করলো,প্রকৃত পক্ষে সে তা হারাম পন্থায় গ্রহণ করলো,যদিও সে যা গ্রহণ করলো তা তার অকাট্য অধিকার হয়ে থাকে। কারণ,সে তা তাগূতের রায়ের ভিত্তিতে গ্রহণ করেছে,অথচ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাকে আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘
আলা সূরাহ্ নিসা-র ৬০ নং আয়াতে এরশাদ করেছেনঃ
)
يريدون ان يتحاکموا الی الطاغوت و قد امروا ان يکفروا به.(
“
তারা বিচার-ফয়সালা পাওয়ার জন্যে তাগূতের কাছে যেতে চায়,অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য।”
“
ইমামকে জিজ্ঞেস করলাম ঃ তাহলে এই দুই ব্যক্তি তাদের মধ্যকার বিরোধের ব্যাপারে কী করবে?
“
ইমাম এরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের হাদীছ বর্ণনা করে এবং আমাদের দৃষ্টিতে যা হালাল ও হারাম সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখে এবং আমাদের আহকামের সাথে ভালোভাবে পরিচিত,তার কাছে যাবে এবং তার হুকুমকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নেবে।
(ইমাম বলেনঃ)
فانی قد جعلته عليکم حاکما، فاذا حکم بحکمنا فلن يقبل منه فانما استخف بحکم الله وعلينا رد و الراد علينا کالراد علی الله و هو علی حد الشرک بالله.
“
অবশ্যই আমি তাকে তোমাদের ওপর শাসক ও বিচারক নিয়োগ করেছি। অতএব,সে যখন আমাদের ফয়সালা অনুযায়ী ফয়সালা করে তখন যে ব্যক্তি তা গ্রহণ না করে সে আল্লাহর ফয়সালাকে গুরুত্বহীন গণ্য করলো এবং আমাদেরকে প্রত্যাখ্যান করলো,আর আমাদেরকে প্রত্যাখ্যানকারী আল্লাহকে প্রত্যাখ্যানকারীর সমতুল্য এবং তার সে কাজ আল্লাহর সাথে শিরক-এর পর্যায়ভুক্ত।”
এটা সুস্পষ্ট যে,ইমাম (আ.) যেখানে বলেনঃ“
যে ব্যক্তি আমাদের হাদীছ বর্ণনা করে এবং আমাদের দৃষ্টিতে যা হালাল ও হারাম সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখে এবং আমাদের আহকামের সাথে ভালোভাবে পরিচিত”
(قد
روی
حديثنا
و
نظر
فی
حلالنا
و
عرف
احکمنا
) সেখানে শরীয়াতের আহকাম ও দ্বীনী বিষয়াদিতে বিশেষজ্ঞ ফকীহ্ ও মুজতাহিদ ছাড়া আর কাউকে বুঝাতে চান নি। কারণ,অন্য কারো ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য হতে পারে না। অতএব,সন্দেহাতীতভাবেই হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ফকীহ্ ও ওলামায়ে দ্বীনকে জনগণের ওপর শাসক ও বিচারক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এবং ফকীহর ফয়সালাকে তার নিজের ফয়সালা হিসেবে গণ্য করেছেন। বলা বাহুল্য যে,মাছূম ইমাম (আ.)-এর হুকুম মেনে চলা ফরয তথা অপরিহার্য কর্তব্য। অতএব,ফকীহর ফয়সালা মেনে নেয়া ও তার আনুগত্য করাও ফরয।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্্’
গ্রন্থের ১২২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে,ইমাম (আ.) ফকীহগণকে হুকুমাত ও বিচারকার্যের জন্যে মনোনীত করেছেন। আর সাধারণ মুসলিম জনগণের জন্য ইমাম (আ.)-এর আদেশ মেনে চলা অপরিহার্য।”
আয়াতুল্লাহ্ ইউসুফ ছানে‘
ঈ
তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ১২৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
আমার মতে এ রেওয়ায়েতটি হচ্ছে ঐ সব রেওয়ায়েতের অন্যতম যা ফকীহর জন্য শাসন-কর্তৃত্ব নির্ধরণ করে দিয়েছে। এ ছাড়াও এ রেওয়ায়েতে এ জাতীয় অন্যান্য রেওয়ায়েতের চেয়ে অতিরিক্ত কিছুও আছে। তা হচ্ছে,এমনকি ব্যক্তির যদি দৃঢ় প্রত্যয় হয় যে,ফকীহ্ ভুল করছেন তা সত্ত্বেও ব্যক্তির জন্য ফকীহর হুকুমের আনুগত্য করা ও তার আদেশের সামনে আত্মসমর্পণ করা অপরিহার্য। ওমর বিন হানযালাহর বর্ণিত‘
সর্বজনগৃহীত’
(مقبولة
) রেওয়ায়েতের এটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য।”
আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী অমোলী
ও এ বিষয়টিকে একই দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ১৯১ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
বিশ্লেষণ ও গবেষণা শক্তির অধিকারী হাদীছ বর্ণনাকারী অর্থাৎ যিনি ফিক্হী বিষয়ে মতামত দানের যোগ্যতা রাখেন এবং তিনি ইজতিহাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত ব্যক্ত করেন অর্থাৎ হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর উত্তরাধিকারী আলেমে দ্বীন,তিনি একদিকে যেমন জনগণের (বিরোধীয় বিষয়াদির) বিচারক,তেমনি তিনি শাসকও বটে।”
উপরোক্ত রেওয়ায়েতে যেভাবে তাগূত এবং স্বৈরাচারী জালেম শাসকের ও তার নিয়োজিত বিচারকের নিকট যেতে নিষেধ করা হয়েছে,তেমনি তার বিকল্প হিসেবে বৈধ শাসক ও বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে - যাতে উক্ত নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধানও সম্ভব হয়।
আয়াতুল্লাহ্ তাকী মেসবাহ্ ইয়াযদী
তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ১০৩ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
جعلته
عليکم
قاضياً
(তাকে তোমাদের ওপর বিচারক নিয়োগ করেছি) না বলে এই যে বলা হয়েছেجعلته
عليکم
حاکما
(তাকে তোমাদের ওপর শাসক নিয়োগ করেছি - যিনি বিচারকও বটে),এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তা হচ্ছেحاکم
শব্দটি অনেক বেশী ব্যাপক অর্থবোধক এবং এতে রাষ্ট্র ও শাসন-কর্তৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কাজকর্ম ও সকল বিষয় অন্তর্ভুক্ত বুঝায়।”
৪) মরহূম কুলাইনী
তার“
উছূলে কাফী”
গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃঃ ৫৮) বলেনঃ“
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেছেনঃالفقهاء
امناء
الرسل
ما
لم
يدخلوا
فی
الدنيا
-“
ফকীহ্গণ নবী-রাসূলগণের আমানত বহনকারী যতক্ষণ না দুনিয়ায় প্রবেশ করে।”
জিজ্ঞেস করা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! এখানে দুনিয়ায় প্রবেশের মানে কী? তিনি এরশাদ করলেনঃ শাসকদের আনুগত্য ও অনুসরণ। যখনই তারা রাজা-বাদশাহদের ও শক্তি-ক্ষমতার অধিকারীদের অনুসরণ করবে তখন নিজেদের দ্বীনের হেফাযতের লক্ষ্যে তাদেরকে পরিহার করে চলো।”
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) যে ফকীহ্গণকে নবী-রাসূলগণের (আ.) আমানত বহনকারী বলে উল্লেখ করেছেন তাতে তিনি তাদের আমানত বহনকারী হওয়ার বিষয়টিকে কোনো কিছুর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেন নি। তারা সকল বিষয়েই রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আমানত বহনকারী। ফকীহ্গণ আল্লাহ্ তা‘
আলার আইন-কানুনের ব্যাপারে,উক্ত আইন-কানুন কার্যকর করণের ব্যাপারে ও জনগণের মধ্যে বিচার-ফয়সালা করার ব্যাপারে তথা খোদায়ী আইনের বাস্তব রূপায়নের ব্যাপারে নবী-রাসূলগণের (আ.) আমানতের বহনকারী।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ৯২ নং পৃষ্ঠায়الفقهاء
امناء
الرسل
হাদীছ প্রসঙ্গে বলেনঃ“
অর্থাৎ নবী-রাসূলগণের (আ.) যত রকমের দায়িত্ব-কর্তব্য ছিলো ন্যায়পরায়ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ ফকীহ্গণ তার সব কিছুই আঞ্জাম দেয়ার জন্য দায়িত্বশীল। অতএব,امناء
الرسل
হচ্ছেন তারাই যারা (দ্বীন ও শরীয়তের) কোনো হুকুমই লঙ্ঘন করবেন না এবং গুনাহ্ থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকবেন।”
৫) মরহূম কুলাইনী তার“
উছূলে কাফী”
গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃঃ ৩৯৮) হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর সূত্রে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর একটি হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। এতে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেনঃ“
ان
العلماء
ورثة
الانبياء
. -“
নিঃসন্দেহে আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী।”
এ হাদীছের ধারাবাহিকতায় নবী করীম (সা.) আরো এরশাদ করেনঃ“
নবী-রাসূলগণ উত্তরাধিকার হিসেবে দীনার ও দেরহাম রেখে যান নি; তারা উত্তরাধিকার হিসেবে জ্ঞান রেখে গেছেন। অতএব,যে তা অর্জন করলো সে বিরাট প্রাচুর্যের অধিকারী হলো।”
উপরোক্ত হাদীছে ওলামা বলতে বিশেষভাবে মা‘
ছূম ইমামগণ (আ.)-কে বুঝানো হয় নি। বরং এতে যে,মা‘
ছূম ইমামগণ (আ.) ছাড়া অন্যদেরকেও শামিল করা হয়েছে তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আর নবী-রাসূলগণ (আ.)-এর মূল দায়িত্ব-কর্তব্য ছিলো জনগণের সামষ্টিক কাজকর্ম আঞ্জাম দেয়া ও নিয়ন্ত্রণ করা যার মধ্যে সামাজিক,সাংস্কৃতিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সামরিক তথা সকল বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত। ওলামায়ে কেরাম নবী-রাসূলগণ (আ.)-এর এসব দায়িত্বের এবং ইসলামী সমাজ ও সমষ্টির নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে তাদের উত্তরাধিকারী। বস্তুতঃ নবী ও রাসূল পরিভাষার যে বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘
আলার বাণী বান্দাহ্দের কাছে পৌঁছে দেয়া,তা ছাড়াও এ পরিভাষার ভিতরে সমাজের দিকনির্দেশনা,পরিচালনা,নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের তাৎপর্যের প্রতিও ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে। একজন নবী একদিকে যেমন আল্লাহ্ তা‘
আলার নিকট থেকে ওহী লাভ করেন,অন্যদিকে তিনি আল্লাহ্ তা‘
আলার আদেশ-নিষেধ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। তিনি যেহেতু আল্লাহ্ তা‘
আলার বাণী লাভ করার ও মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেয়ার যোগ্যতার অধিকারী সে হিসেবে তিনি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে ওলী-আল্লাহ্,অন্যদিকে যেহেতু তিনি আল্লাহ্ তা‘
আলার আহ্কাম কার্যকর ও বাস্তবায়ন করেন এবং ইসলামী উম্মাহর সামষ্টিক বিষয়াদি পরিচালনা করেন সে দিক থেকে তিনি‘
মুসলমানদের কর্মসম্পাদনের অভিভাবক বা শাসক’
(ولی
امر
مسلمين
)।
একজন ফকীহ্ বা মুজতাহিদ নবী-রাসূলগণ (আ.)-এর এসব দায়িত্বেরই উত্তরাধিকার লাভ করে থাকেন। ফরয কাজ সমূহ,হালাল ও হারাম,কিছাছ,হুদূদ,তা‘
যিরাত্,জিহাদ,প্রতিরক্ষা ও এ ধরনের অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান নবী-রাসূলগণ (আ.)-এর পক্ষ থেকে ফকীহ্গণের নিকট স্থানান্তরিত হয়। এ থেকে তদনুযায়ী আমল করা ও তা কার্যকর করা এবং এসব আহকাম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব সুস্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ,এসব নির্বাহী ও প্রশাসনিক বিধি-বিধানের উত্তরাধিকার সেগুলোর কার্যকর করণ ও বাস্তবায়ন ছাড়া একদমই অর্থহীন। অতএব,বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই যে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ওপর এসব আহকাম নাযিল হয়েছিলো,তাতে সন্দেহ নেই। ঠিক সেভাবেই বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই তা তার উত্তরাধিকার হিসেবে ওলামায়ে দ্বীন ও মুজতাহেদীনে কেরামের নিকট স্থানান্তরিত হয়েছে এবং কোরআন মজীদ ও হাদীছের সূত্রে এসব আহকামের জ্ঞান লাভ করার পর তা বাস্তবায়ন করা তাদের দায়িত্ব। অতএব,যে সব আহকামে দ্বীন স্বয়ং নবী-রাসূলগণের (আ.) যুগে তদনুযায়ী আমল করা ও কার্যকর করার জন্য বলে পরিগণিত হতো,বর্তমানে নবী-রাসূলগণের (আ.) পরবর্তী যুগে তা কার্যকর করণের দায়িত্ব তাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে ওলামায়ে দ্বীন ও মুজতাহেদীনে কেরামের। তাই তারা এখন তাদের‘
ইল্ম্কে আমলে তথা জ্ঞানকে কাজে পরিণত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ১৩৩ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
العلماء
ورثة
الانبياء
(আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী) - এ কথাটিকে যদি‘
সর্বজনীনভাবে প্রচলিত’
(عرف
) অর্থে বিবেচনা করি এবং প্রচলিত অর্থেই সাধারণ মানুষের নিকট প্রশ্ন করি যে (উক্ত হাদীছের আলোকে) অমুক ফকীহ্ হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)-এর অবস্থানের অধিকারী কিনা? তাহলে তারা জবাব দেবে ঃ উক্ত হাদীছ অনুযায়ী,হ্যা। কারণ,হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) নবী-রাসূলগণের (আ.) অন্তর্ভুক্ত,সুতরাং আমরা‘
নবী-রাসূলগণ’
(الانبياء
) কথাটিকে কেবল খেতাব বাচক অর্থে গ্রহণ করতে পারি না,বিশেষ করে যেহেতু শব্দটি বহু বচনে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি শব্দটি এক বচনে ব্যবহার করা হলেও তা থেকে একই অর্থ গ্রহণ করা সম্ভব ছিলো,কিন্তু যখন বহু বচন ব্যবহৃত হয়েছে তখন এতে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক নবী-রাসূল (আ.)ই শামিল রয়েছেন।”
আমরা যদি এ হাদীছে“
আম্বিয়া”
শব্দের ব্যবহারকে স্রেফ সম্মানসূচক খেতাব বাচক বলে গ্রহণ করতাম তাহলে এ থেকে ওলামায়ে কেরাম ও মুজতাহিদগণের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্ব প্রমাণিত হতো না। কিন্তু কথাটির সাধারণ ও‘
সর্বজনীনভাবে প্রচলিত’
(عرف
) অর্থ অনুযায়ী ফকীহ্ বা মুজতাহিদের অবস্থান হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)-এর অবস্থানের পর্যায়ভুক্ত। আর যেহেতু তাদের যে সব মর্যাদা,দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ক্ষমতা ও এখতিয়ার ছিলো তার মধ্যে নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্ব (বেলায়াত) অন্যতম,সেহেতু ওলামায়ে কেরাম বিশেষ করে মুজতাহিদগণের অন্যতম মর্যাদা হচ্ছে উক্ত বেলায়াতের মর্যাদা। এ বেলায়াত হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) নিকট এবং তাদের মাধ্যমে ফকীহ্ বা মুজতাহিদগণের নিকট পৌঁছেছে।
আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আ.) বলেনঃالعلماء
حکام
علی
الناس
. -“
আলেমগণ হচ্ছেন জনগণের ওপর নিয়োজিত শাসক।”
এ হচ্ছে বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত হাদীছ সমূহের মধ্য থেকে কয়েকটি মাত্র। এ সংক্রান্ত সকল হাদীছ ও রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করা এ গ্রন্থের সীমিত আয়তনে সম্ভব নয় এবং তা হয়তো পাঠক-পাঠিকাদের বিরক্তির কারণ হবে। তবে এ সীমিত সংখ্যক হাদীছ ও রেওয়ায়েতের উদ্ধৃতিই যথেষ্ট বলে মনে করি। কারণ,কথায় বলে ঃ ঘরে কোনো লোক আছে কিনা তা বুঝার জন্য এক অক্ষর উচ্চারণই যথেষ্ট।
বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্ব প্রমাণের জন্য বিচারবুদ্ধি যে দলীল উপস্থাপন করে তার সত্যতার বিষয়টিকে অধিকতর শক্তিশালী করার জন্যে উপরোক্ত হাদীছ ও রেওয়ায়েত সমূহই যথেষ্ট। বিচারবুদ্ধির দলীল ও উদ্ধৃতিযোগ্য দলীল - এ উভয় ধরনের দলীল থেকে বেলায়াতে ফকীহ্ প্রমাণিত হবার ফলে এ ব্যাপারে সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আর বিন্দুমাত্রও অবকাশ থাকে না,বরং প্রত্যয় দৃঢ়তর হয়।