বেলায়াতে ফকীহ্ প্রশ্নে অতীত-বর্তমান আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রাচীন ও বর্তমান যুগের ওলামায়ে কেরাম বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব গ্রহণ করেন নি ধারণায় অনেকে তা প্রত্যাখ্যান ও এর চৈন্তিক ভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন; প্রকৃত পক্ষে এ ব্যাপারে প্রাচীন ও বর্তমান যুগের ওলামায়ে কেরামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
জবাবঃ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) তার‘
হুকুমাতে ইসলামী’
গ্রন্থের ৩ নং ও ১৭২ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
বেলায়াতে ফকীহর বিষয়টি কোনো নতুন বিষয় নয় যে,আমরা তা উদ্ভাবন করে থাকবো,বরং এ বিষয়টি শুরু থেকেই একটি আলোচ্য বিষয় ছিলো। তামাক বর্জনের জন্যে মীর্যায়ে শীরাযী যে আদেশ জারী করেছিলেন প্রকৃত পক্ষে তা ছিলো একটি রাষ্ট্রীয় আদেশেরই অনুরূপ এবং তার অনুসরণ অন্যান্য ফকীহ্গণের জন্যও ওয়াজেব বা অবশ্য কর্তব্য ছিলো। তৎকালে অল্প কয়েক জন বাদে ইরানের ওলামায়ে কেরামের সকলেই এ আদেশের অনুসরণ করেন। এটা কোনো বিচার বিষয়ক বিষয় ছিলো না,যে সম্পর্কে কয়েক জন লোকের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছিলো এবং তারাও তাদের জ্ঞান-বিবেচনা অনুযায়ী রায় প্রদান করেছিলেন। বরং এর সাথে মুসলিম জনগণের স্বার্থ জড়িত ছিলো এবং তারা রাষ্ট্রীয় আদেশ জারী করার ন্যায় এ রায় ঘোষণা করেছিলেন। ফলে যদ্দিন মূল প্রসঙ্গটি বিদ্যমান ছিলো তদ্দিন এ রায়ের কার্যকরিতাও ছিলো এবং মূল সমস্যাটি দূরীভূত হয়ে যাবার পর তারা তাদের রায়ে ঘোষিত আদেশও তুলে নেন।
“
মরহূম মীর্যা মোহাম্মাদ তাকী শীরাযী যখন জিহাদের আদেশ দেন - যদিও তার নাম দেয়া হয় প্রতিরক্ষা,তখন ওলামায়ে কেরামের সকলেই তার অনুসরণ করেন। কারণ,এটি ছিলো একটি হুকুমাত সংশ্লিষ্ট আদেশ।
“
(বিভিন্ন সূত্রে) যেমন উদ্ধৃত হয়েছে,মরহূম কাশেফুল গ্বেত্বা’
-ও এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। পরবর্তীকালীন ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মরহূম নারাক্বী ফকীহ্গণকে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সকল দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারের অধিকারী বলে মনে করেন। মরহূম নায়ীনীও বলেন যে,ওমর বিন হানযালাহ্ বর্ণিত‘
মাক্ববুলাহ্’
হিসেবে খ্যাত রেওয়ায়েত থেকে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।
“
মোদ্দা কথা,এ্ সংক্রান্ত আলোচনা নতুন কিছু নয়। আমরা এ বিষয়ে অধিকতর পর্যালোচনা করেছি এবং এর হুকুমাত সংক্রান্ত দিকটির কথা উল্লেখ করে তা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যাতে বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্ট হয়। আল্লাহ্ তা‘
আলা তার কিতাবে এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর যবানীতে যা এরশাদ করেছেন সেই সাথে আমরা যুগের প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে কিছু বিষয় যোগ করেছি,নচেৎ বিষয়টি তা-ই যা আরো অনেকেই বুঝতে পেরেছেন।”
হযরত ইমামের এ বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত আলোচনা একটি সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক বিষয়; কোনো নতুন বিষয় নয়।
আয়াতুল্লাহ্ ছানে‘
ঈ তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থের ৩০ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
আমরা যদ্দূর জানি,দুয়েক জনের বেশী বলেন নি যে,ফকীহ্ কিছুতেই বেলায়াতের অধিকারী নন।”
মরহূম নারাক্বী এ ব্যাপারে এর চেয়েও দৃঢ়তর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে,এ বিষয়ে ইজমা‘
রয়েছে। তিনি বলেনঃ“
মোদ্দা কথা,বেলায়াতে ফকীহ্ সম্পর্কে শিয়া মাযহাবের (অনুসারী ওলামায়ে কেরামের) মধ্যে ইজমা‘
রয়েছে। এজমালীভাবে বেলায়াতে ফকীহ্ সম্পর্কে ফকীহ্গণের মধ্যে কেউই দ্বিমত পোষণ করেন নি।”
আয়াতুল্লাহ্ শেখ জা‘
ফর কাশেফুল গ্বেত্বা তার“
কাশফুল্ গ্বেত্বা”
গ্রন্থে,শহীদ মোদাররেস তার“
উছূলে তাশ্কীলাতে‘
আদ্লিআহ্”
গ্রন্থে ও আয়াতুল্লাহ্ ফাযেল তার“
খাযায়েনুল আহ্কাম”
গ্রন্থে বেলায়াতে ফকীহ্ সম্বন্ধে আলোচনা করছেন। এছাড়া শেখ তুসী
,সাইয়েদ মোরতাযা ও মোকাদ্দাস আরদেবিলী
তাদের নিজ নিজ ফিকাহর কিতাবে বেলায়াতে ফকীহ্ সম্পর্কে আলোচনা ও পর্যালোচনা করেছেন। মরহূম সাবযেভারী তার“
কেফায়াতুল্ আহ্কাম”
গ্রন্থের ৮৩নং পৃষ্ঠায় বেলায়াতে ফকীহর গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে অত্যন্ত মূল্যবান আলোচনা পেশ করেছেন।
সমকালীন মুজতাহিদগণের মধ্য থেকে আয়াতুল্লাহ্ আল-‘
উয্মা বোরুজারদী মুজতাহিদ শাসকের জন্য ব্যাপক এখতিয়ারের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি মুজতাহিদের ব্যাপক এখতিয়ার প্রয়োগ করে কোমে এমন একটি রাস্তা নির্মাণের অনুকূলে মত প্রদান করেন যা করতে গিয়ে অনেক বাড়ীঘর ভাঙ্গতে হয়েছিলো। শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মোরতাযা মোতাহহারী
তার লেখা“
ইসলাম ও মোক্বতাযিয়াতে যামান”
(ইসলাম ও যুগের দাবী) শীর্ষক গ্রন্থে (২য় খণ্ড পৃঃ ৮৪) লিখেছেনঃ“
জনাব বোরুজারদী বলেছিলেন,যদি মসজিদ ভাঙ্গতে না হয় তো বাধা নেই; এ কাজ সম্পাদন করুন এবং মালিকদের সম্পদের মূল্যও তাদেরকে প্রদান করুন।”
এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আয়াতুল্লাহ্ আল-‘
উয্মা বোরুজারদী তার“
আল-হিদায়াতু ইলা মান্ লাহুল্ ভিলাইয়্যাহ্”
(বেলায়াতের অধিকারীর জন্য পথনির্দেশ) গ্রন্থে বেলায়াতে ফকীহ্ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
‘
ছাহেবে জাওয়াহের’
নামে সমধিক পরিচিত আল্লামা শেখ হাসান নাজাফী স্বীয় গ্রন্থের ২১তম খণ্ডের ৩৯৭ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
কেউ যদি স্বীয় ফিক্হী চিন্তা-গবেষণায় এমন এক উপসংহারে উপনীত হন যার ফলে তিনি ফকীহর জন্য সর্বজনীন বেলায়াত ও হুকুমাতের বিষয়টি অস্বীকার করেন তো নিঃসন্দেহে এ ধরনের লোকেরা ফিকাহর আস্বাদন করেন নি এবং মা‘
ছূমগণের (আ.) কথার তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি।”
ছাহেবে জাওয়াহের অন্যত্র বলেনঃ“
আছ্হাব অর্থাৎ ইমামিয়া ফকীহ্গণের বাহ্যিক আমল ও ফতোয়া হচ্ছে এই যে,তারা বেলায়াতে ফকীহর সর্বজনীনতা ও ব্যাপকতায় বিশ্বাসী এবং একে অকাট্য বিষয়,বরং অপরিহার্য বিষয় হিসেবে গণ্য করেন।
শেখ আনছারী যদিও তার“
মাকাসেব”
গ্রন্থে ওলীয়ে ফকীহর এখতিয়ার ও দায়িত্ব-কর্তব্যকে সীমিত বলে গণ্য করেছেন,কিন্তু তিনি তার যাকাত,খুমস,ইবাদতকারীর মুক্তি ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থাবলীতে বেলায়াতে ফকীহ্ বিষয়টি প্রমাণের জন্য দলীল উপস্থাপন করেছেন।
তিনি‘
হাকেম’
বা শাসক বলতে বিচার ও শাসন ক্ষমতার সমন্বিত ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিকে মনে করেন। এরপর তিনি বলেনঃ“
ফকীহ্গণ যে বিচারকার্যের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এটা অসম্ভব নয় যে,ধর্মীয় দৃষ্টিতে এটা অপরিহার্য পর্যায়ে উপনীত হয়ে থাকবে। হয়তো এর মূল ভিত্তি হচ্ছে ওমর বিন হানযালাহর‘
মাক্ববুলাহ্’
ও আবি খাদীজাহর‘
মাশহূরাহ্’
(বিখ্যাত হাদীছ) এবং সমুন্নত তাওক্বী‘
...। পূর্বে উল্লিখিত রেওয়ায়েত সমূহের বাহ্যিক তাৎপর্য অনুযায়ী ফকীহর রায়ে শরয়ী আহ্কামের সকল বৈশিষ্ট্যই নিহিত রয়েছে,...কারণ,“
হাকেম”
(حاکم
- শাসক) শব্দটি ব্যবহারের ফলে এটাই বুঝায় যে,তিনি নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের অধিকারী। এটা এর সর্বজনীনতাই প্রতিপন্ন করে। অর্থাৎ এখানে“
বিচারক”
(حَکَم
) শব্দ ব্যবহার না করে“
হাকেম”
শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আর বাক্যের ধারাবাহিকতায় যে বলা হয়েছে,‘
সে যা হুকুম দেয় তা মেনে নাও’
-এর দ্বারা কার্যতঃ বলতে চাওয়া হয়েছে যে,তাকে আমি ফয়সালাকারী (حَکَم
) নিয়োগ করেছি।”
শেখ আনছারী তার কিতাবুল্ ক্বাযা’
য় এ ব্যাপারে অনেক আলোচনা করেছেন,যা তার কিতাবুল্ বাই‘
-এ সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয় নি। এ প্রসঙ্গে তিনি যে সব বিষয় উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে ঃ ১) সুস্পষ্ট ভাষায় মাক্ববুলাহ্ রেওয়ায়েতের সনদের নির্ভরযোগ্যতা ও তার হুজ্জাত হওয়ার স্বীকারোক্তি,২) পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদের হুকুমের সর্বজনীন বা সর্বাত্মক কার্যকরিতার সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি এবং ৩) বিচারক বা ফয়সালাকারী (حَکَم
) শব্দের সাথে ব্যাপক অর্থবোধক“
হাকেম”
(حاکم
) শব্দটির সম্পর্ক।
শেখ আনছারী তার‘
মাকাসেব্’
গ্রন্থে (পৃঃ ১৫৪) লিখেছেনঃ“
বিখ্যাত ফকীহ্গণ বেলায়াতে ফকীহতে বিশ্বাস পোষণ করেন।”
তিনি আরো লিখেছেন (প্রাগুক্ত,পৃঃ ১৫৫) ঃ“
আছ্হাব (অর্থাৎ ইমামিয়া ফকীহ্গণ)-এর মধ্যে বেলায়াতে ফকীহ্ একটি বিখ্যাত আলোচ্য বিষয়।”
যে সব ফকীহ্ বেলায়াতে ফকীহ্ সম্বন্ধে সুবিন্যস্ত ও প্রামাণ্য আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে মরহূম নারাক্বী অন্যতম। তিনি তার‘
আওয়াদেুল আইয়াম্ গ্রন্থে (পৃঃ ১৮৭) লিখেছেনঃ“
জনগণের ওপর শাসন-কর্তৃত্ব পরিচালনা ও ইসলামের হেফাযতের অধিকারের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও মা‘
ছূম ইমামগণ (আ.) জনগণের ওপর যে অধিকার রাখতেন,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে ফকীহ্গণ সেই একই এখতিয়ারের অধিকারী,যদি না পঠনীয় দলীল (نص
) বা ইজমা‘
দ্বারা কোনো কিছু এই সর্বজনীন ও সর্বাত্মক এখতিয়ারের বহির্ভূত বলে প্রমাণিত হয়। তেমনি জনগণের দ্বীন ও দুনিয়ার হেফাযতের জন্য এবং সমাজ ব্যবস্থার জন্য যে সব বিষয় বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে অপরিহার্য এবং শরীয়ত যে সব কাজের আঞ্জাম হওয়া দাবী করে,কিন্তু সে জন্য বিশেষ কাউকে সম্বোধন করে নি বা দায়িত্ব দেয় নি,তা আঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব ফকীহর। তিনি এসব কাজের সবগুলোর দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিতে পারেন এবং এ ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার বা তাকে বাধা দেয়ার অধিকার কারো নেই।”
মরহূম আরদেবিলী তার“
মাজমা‘
উল্ ফায়েদাহ্ ওয়াল্ বুরহান”
গ্রন্থে যাকাত,জিহাদ,বিচারকার্য,সাক্ষ্য,রক্তমূল্য,ব্যবসায়,বন্ধক ইত্যাদি বিষয়ক আলোচনায় এসব বিষয়ের আহকাম ও দায়িত্ব-কর্তব্য পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদের বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার এ গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদকে মাছূম ইমামের (আ.) নায়েব বা প্রতিনিধি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ
لانه
قائم
مقام
الامام
(عليه
السلام
)و
نائب
عنه
. -“
যেহেতু তিনি ইমাম (আ.)-এর স্থলাভিষিক্ত এবং তার প্রতিনিধি।”
অর্থাৎ তার মতে,পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে তার সাধারণ ও সার্বিক প্রতিনিধি হিসেবে স্বয়ং ইমাম (আ.)-এর সকল কাজকর্মেরই দায়িত্বশীল। অতএব,তিনি যেমন ফতোয়া দেয়ার জন্য দায়িত্বশীল ঠিক সেভাবেই আহকাম কার্যকর করার এবং জনগণের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনার জন্যেও দায়িত্বশীল।
মরহূম আরদেবিলী তার উক্ত গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে বেলায়াতে ফকীহ্ ও ইসলামী শাসকের দায়িত্ব-কর্তব্য ও এখতিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং এ প্রসঙ্গে এমন বহু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন যা থেকে ইসলামী শাসকের এখতিয়ারের ব্যাপকতা প্রমাণিত হয়।
শেখ মুফীদ
তার“
আল-মাক্বনা‘
আহ্”
গ্রন্থের ৮১০ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ“
ইসলামের সুনির্দিষ্ট শাস্তি-বিধান ও শান্তি-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি-বিধান কার্যকর করণ আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে নিয়োজিত ইসলামী শাসকের দায়িত্ব। আর এখানে‘
শাসক’
বলতে আলে মুহাম্মাদের (সা.) সঠিক পথানুসারী ইমামগণ (আ.) অথবা তাদের পক্ষ থেকে মনোনীত ব্যক্তিগণ। ইমামগণও এ দায়িত্ব শিয়া ফকীহ্গণের ওপর অর্পণ করেছেন যাতে সম্ভব হলেই তারা যেন তা কার্যকর করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।”
আল্লামা হিল্লী
তার“
ফাওয়ায়েদ”
গ্রন্থে লিখেছেনঃ“
বর্তমান যুগে আইন-শৃঙ্খলা ও সমাজ পরিচালনা সংক্রান্ত আহকাম কার্যকর করণের দায়িত্ব মা‘
ছূম ইমামের (আ.) বা তার পক্ষ থেকে মনোনীত ব্যক্তির এবং ইমামের আত্মগোপনরত থাকার যুগে এ দায়িত্ব শিয়া ফকীহ্গণের।”
শহীদে আউয়াল
তার“
ইযাহুল্ ফাওয়ায়েদ”
গ্রন্থে (১ম খণ্ড,পৃঃ ৩১৮) লিখেছেনঃ“
আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি-বিধান (সুনির্দিষ্ট দণ্ডবিধি ও রাষ্ট্র নির্ধারিত শাস্তি) কার্যকর করার দায়িত্ব ইমামের (আ.) ও তার প্রতিনিধির।”
তিনি তার গ্রন্থের ১৬৫ নং পৃষ্ঠায় বলেনঃ“
হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে এ দায়িত্ব পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদের,আর জনগণ তাকে শক্তির অধিকারী করবে ও তাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে এবং সম্ভব হলে এ দায়িত্ব জবর দখলকারীদেরকে তারা প্রতিহত করবে। আর ফকীহর দায়িত্ব হচ্ছে নিরাপদ পরিস্থিতি হলে আইনগত মতামত (ফতোয়া) দেবেন এবং জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের মতবিরোধীয় বিষয়গুলোকে তার সমীপে পেশ করবে।”
আয়াতুল্লাহ্ মীর ফাত্তাহ্ হোসেনী মারাগ্বেয়ী তার‘
আনাভীনুল উছূল্ গ্রন্থে (পৃঃ ৩৫৮) বলেনঃ“
ইমাম (আ.) ফকীহকে যে বেলায়াত প্রদান করেছেন,উক্ত বেলায়াতে ফকীহ্ তথা মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্বের সপক্ষের যুক্তি সমূহের অন্যতম হচ্ছে এই যে,যেহেতু শরীয়াতের দৃষ্টিতে ফকীহ্ বেলায়াতের অধিকারী সেহেতু ইমাম (আ.) তাকে বেলায়াত প্রদান করেছেন। অতএব,ইমাম (আ.) কর্তৃক এ দায়িত্ব অর্পণ কার্যতঃ শরয়ী হুকুমের উদ্ঘাটনকারী।”
আল্লামা সাইয়েদ মোহাম্মাদ আলে বাহরুল‘
উলূম্ তার লিখিত“
বালাগ্বাতুল্ ফাক্বীহ্”
গ্রন্থে বেলায়াত সংক্রান্ত আলোচনায় (পৃঃ ২৯৭) লিখেছেনঃ“
যে সব দলীল-প্রমাণ থেকে ফকীহ মাছূম ইমাম (আ.)-এর সাধারণ প্রতিনিধি বলে প্রমাণিত হয় তার দাবী হচ্ছে এই যে,ন্যায়বান মুজতাহিদ যখন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তখন অন্যান্য ফকীহর পক্ষ থেকে তার বিরোধিতা জায়েয নয়। কারণ,প্রতিনিধিত্বের দাবী অনুযায়ী,শাসন-কর্তৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণকারী ন্যায়বান ফকীহর বিরোধিতা করা মা‘
ছূম (আ.)-এর বিরোধিতার সমতুল্য বলে পরিগণিত হবে।”
মরহূম আল্লামা নায়িনী তার“
তাম্বিয়াতুল্ উম্মাহ্”
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ফিক্হী দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতি ও তাৎপর্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তিনি তার গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এ মর্মে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে,যদি ধরে নেয়া হয় যে,কোনো এক ব্যক্তি ফকীহর সর্বজনীন কর্তৃত্ব বা শাসন কর্তৃত্বকে অপরিহার্য গণ্য করেন না; সে ক্ষেত্রেও তার জন্য অ-ফকীহর যুলুম-অত্যাচার ভিত্তিক হুকুমাতের ওপর ফকীহর হুকুমাতকে অগ্রাধিকার প্রদান ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মরহূম আয়াতুল্লাহ্ আল-‘
উয্মা খুয়ী
ও বলেনঃ“
দ্বীনী শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের আইন-শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের পিছনে যে সব কারণ নিহিত রয়েছে তা এর সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংশ্লিষ্ট। এসব আইন-কানুন ও বিধিবিধানকে বিশেষ যুগ বা বিশেষ অবস্থার সাথে শর্তাধীন করে দেখা সম্ভব নয়। ইসলামের সাথে এসবের এ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের দাবী হচ্ছে এই যে,এসব আইনকে সকল যুগেই বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে,তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কার ওপর অর্পণ করা হয়েছে? উল্লিখিত কারণ সমূহ থেকে তা জানা যায় না। এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে,প্রতিটি ব্যক্তিকে এসব আইন-কানুন বাস্তবায়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয় নি। কারণ,সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। অন্যদিকে তাওক্বী শরীফে বলা হয়েছে ঃ
و
اما
الحوادث
الواقعة
فارجعوا
فيها
الی
رواة
احاديثنا
فانهم
حجتی
عليکم
و
انا
حجة
الله
عليهم
. -“
আর উদ্ভূত ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে তোমরা আমাদের হাদীছ বর্ণনাকারীদের নিকট গমন করো,কারণ,তারা হচ্ছেন তোমাদের ওপর আমার হুজ্জাত এবং আমি তাদের ওপর আল্লাহর হুজ্জাত।”
এছাড়া হাফছ্ বিন গিয়াসের রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে ঃاقامة
حدود
الی
من
اليه
الحکم
-“
খোদায়ী দণ্ডবিধি কার্যকর করণের দায়িত্ব তার যে এ বিষয়ে ফতোয়া দেয়ার যোগ্যতা রাখে।”
অতএব,আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে বাধ্য যে,হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে ইসলামী আইন-কানুন বাস্তবায়নের দায়িত্ব উপযুক্ত ফকীহ্গণের।”
আল্লামা তাবাতাবায়ী
১৩৪১ ফার্সী সালে (১৯৬২ খৃস্টাব্দে)“
বেলায়াত ভা যা‘
আমাত্”
(বেলায়াত ও শাসন-কর্তৃত্ব) শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যা পরবর্তী কালে তার“
বাহাছী র্দাবরে মারজা‘
ঈয়াত্ ওয়া রূহানিয়্যাত্”
(মারজা‘
ঈয়াত ও ওলামা সংক্রান্ত বিতর্ক) শীর্ষক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রবন্ধে তিনি বেলায়াতে ফকীহ্ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ“
প্রশ্ন হচ্ছে,বেলায়াত কি সকল মুসলমানের,নাকি তাদের মধ্যকার যোগ্য ব্যক্তিদের বা ফকীহ্গণের (আজকের পরিভাষায়)? ইসলামের প্রথম যুগে ফকীহ্ বলা হতো এমন ব্যক্তিকে যিনি দ্বীনের মৌলিক নীতিমালা,বিস্তারিত বিধিবিধান ও চারিত্রিক শিক্ষা তথা সমগ্র দ্বীনী জ্ঞানের অধিকারী হতেন। বর্তমানে যে কেবল দ্বীনের বিস্তারিত বিধি-বিধান সম্পর্কে দক্ষতার অধিকারী ব্যক্তিকে ফকীহ্ বলা হয়,তৎকালে তা বলা হতো না। এই তৃতীয় ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে,এটা কি সকল ফকীহর দায়িত্ব,নাকি এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ বহু সংখ্যক হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সকলেরই দায়িত্ব এবং তাদের মধ্যে প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী এ দায়িত্ব পালন করবেন ও তাদের প্রত্যেকেরই হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য ও অনস্বীকার্য? অথবা তা তাদের মধ্যকার সর্বাধিক জ্ঞানী ফকীহর দায়িত্ব? এ হচ্ছে এমন কতগুলো বিষয় যা আমাদের বর্তমান আলোচনার আওতা বহির্ভূত এবং ফিকাহর আলোচনায় এ সব প্রশ্নের জবাব বের করতে হবে। অত্র প্রবন্ধের আলোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে যে উপসংহারে উপনীত হওয়া যায় তা হচ্ছে,মানবিক প্রকৃতির দাবী অনুযায়ী প্রতিটি সমাজের জন্য একটি শাসন-কর্তৃত্বের কেন্দ্রের অস্তিত্ব অপরিহার্য যার কাজ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সমাজের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা। ইসলামও মানুষের প্রকৃতির দাবী মিটানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ভূমিকা স্বরূপ উপস্থাপিত এ দু’
টি বিষয়ের উপসংহার হচ্ছে এই যে,যে ব্যক্তি তাকওয়া,সুপরিচালনা ও পরিস্থিতির জ্ঞানে সকলের চেয়ে অগ্রসর,তিনিই বেলায়াত বা শাসন-কর্তৃত্বের জন্য অগ্রাধিকার লাভ করবেন এবং তাকেই এ দায়িত্বে বসাতে হবে। বস্তুতঃ রাষ্ট্রের অভিভাবকত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের দায়িত্বে যিনি অধিষ্ঠিত হবেন তিনি হবেন সমাজের শ্রেষ্ঠতম ও যোগ্যতম ব্যক্তি - এ ব্যাপারে কেউই সন্দেহ পোষণ করে না।”
এ ব্যাপারে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর মতামত অত্যন্ত সুস্পষ্ট।‘
ছাহীফায়ে নূর’
গ্রন্থের দশম খণ্ডের ২৭ নং পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত হযরত ইমামের উক্তি ঃ“
বেলায়াতে ফকীহ্ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সেই বেলায়াতই। বর্তমান যুগে ফকীহ্গণ লোকদের ওপরে হুজ্জাত। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যেরূপ আল্লাহর হুজ্জাত ছিলেন এবং সকল বিষয়ই তার দায়িত্বে অর্পিত হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই ফকীহ্গণ জনগণের ওপর ইমাম (আ.)-এর হুজ্জাত; মুসলমানদের সকল বিষয়ই তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে।”
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর মতামতের ভিত্তি হচ্ছে বিচারবুদ্ধিজাত ও উদ্ধৃতিযোগ্য দলীল ও পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের ইজমা। তার শিষ্য ও অনুসারীগণও একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখেছেন। হযরত ইমাম (রহ্ঃ) ওয়ালীয়ে ফকীহ্ (মুজতাহিদ শাসক)-এর রাষ্ট্রীয় এখতিয়ারকে মা‘
ছূমগণের (আ.) হুকুমাতী এখতিয়ারের সমপর্যায়ভুক্ত বলে মনে করেন।
আল্লামা শহীদ মোতাহ্হারীও তার“
ইসলাম ওয়া মোক্বতাযিয়াতে যামান্”
(ইসলাম ও যুগের দাবী) গ্রন্থে (পৃঃ ২ ও ৯১) লিখেছেনঃ“
এ এখতিয়ার সমূহ রাসূলুল্লাহ্ (সা.) থেকে ইমাম (আ.)-এর নিকট এবং ইমাম (আ.)-এর নিকট থেকে শরয়ী শাসকের নিকট স্থানান্তরিত হয়। মুজতাহিদগণ যে সব বিষয়কে হারাম বা হালাল বলে রায় দিয়েছেন - বর্তমানে যার সাথে সকলেই একমত - এরই ভিত্তিতে দিয়েছেন। মীর্যায়ে শীরাযী কোন্ শরয়ী অনুমতিপত্রের ভিত্তিতে তামাক বর্জনের ফতোয়া দিলেন; তা-ও আবার সাময়িক বর্জন? তিনি এ কারণে এ ফতোয়া দেন যে,তিনি জানতেন,শরয়ী শাসক কতগুলো এখতিয়ারের অধিকারী এবং প্রয়োজনবোধে তিনি সে এখতিয়ার ব্যবহার করতে পারেন। তিনি যদি প্রয়োজন মনে করেন তো মূল শরীয়তে যা হারাম করা হয় নি বা অন্ততঃ যার হারাম হওয়ার পক্ষে দলীল পাওয়া যায় না,এমন জিনিসকে তিনি বিশেষ ক্ষেত্রে নিষদ্ধ করতে পারেন।”
আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী অমোলী অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে বেলায়াতে ফকীহ্ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি তার‘
বেলায়াতে ফকীহ্’
গ্রন্থে (পৃঃ ২৫১) লিখেছেনঃ“
বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছে ইসলামী সমাজের ওপরে পরিচালনা সংশ্লিষ্ট এক ধরনের শাসন-কর্তৃত্ব যার উদ্দেশ্য হচ্ছে দ্বীনী আহকামের বাস্তবায়ন,দ্বীনী মূল্যবোধ সমূহের বাস্তব রূপায়ন,সমাজের ব্যক্তিদের প্রতিভা ও সম্ভাবনার বিকাশ সাধন এবং তাদেরকে ইসলাম ও কোরআন মজীদের বাঞ্ছিত পূর্ণতায় উপনীত করে দেয়া।”
আয়াতুল্লাহ্ তাকী মেসবাহ্ ইয়াযদী তার“
নেগাহী গোযারা বে নাযারিয়ে বেলায়াতে ফাক্বীহ্”
(বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের ওপর সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত) গ্রন্থের“
ওয়ালীয়ে ফাক্বীহ্”
(মুজতাহিদ শাসক) অধ্যায়ে (পৃঃ ৯১) বলেনঃ“
মুজতাহিদ শাসক হচ্ছেন সেই সর্বোত্তম ব্যক্তি,জনগণ যখন মা‘
ছূম নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয় না,সে যুগে যিনি ইসলামী আহকাম কার্যকর করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত।”
আয়াতুল্লাহ্ মেসবাহ্ ইয়াযদীর মতে মা‘
ছূম ইমাম (আ.) মুজতাহিদ শাসককে উক্ত অনুমতি প্রদান করেন। কারণ,তিনি মনে করেন যে,“
মুলমানদের সামষ্টিক কাজকর্মের ব্যাপারে বেলায়াতে ফকীহর ভিত্তি হচ্ছে এই যে,তিনি মা‘
ছূম ইমামের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত ও দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।”
আর মা‘
ছূম এ অনুমতি পেয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলার নিকট থেকে।‘
ছাহীফায়ে নূর’
গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে (পৃঃ ৯৫) হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তিনি বলেনঃ“
বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলা তৈরী করেছেন।”
উপরোক্ত উদ্ধৃতি সমূহের প্রেক্ষাপটে এটা কি গ্রহণযোগ্য যে,মুজতাহিদগণ এ গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিটিকে উপেক্ষা করবেন বা এর প্রতি মনোযোগ দেবেন না?
ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্‘
উয্মা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী ২০০৬ সালের ৪ঠা জুন তারিখে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেনঃ“
বেলায়াতে এলাহী (মানুষের ওপর আল্লাহ্ তা‘
আলার শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার) মুজতাহিদের নিকট স্থানান্তরিত হয়।”
অতএব,এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে,বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের শাসন-কর্তৃত্ব এ যুগে উদ্ভাবিত কোনো নতুন আলোচ্য বিষয় নয়,বরং এটির একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক অতীত রয়েছে। এ ঐতিহাসিকতার অংশবিশেষ উপরোল্লিখিত প্রশ্নের জবাবে এখানে উল্লেখ করা হলো। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাইলে তা এ পুস্তকের সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়,বরং সে জন্য স্বতন্ত্র বিরাট গ্রন্থ রচনার জন্য আলাদা আয়োজন প্রয়োজন।
এখানে যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো তা থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,ওলামায়ে কেরাম,মারজা‘
য়ে তাকলীদগণ,মুজতাহিদগণ ও বুযুর্গানে দ্বীনের মতামত,বিশেষতঃ তাদের বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত মতামত সম্পর্কে কতক লোক একেবারেই বেখবর। এ কারণেই তারা মনে করেন যে,ওলামায়ে কেরাম কোনো যুগেই বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব গ্রহণ করেন নি। কিন্তু সকল যুগেই যে শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন এখানে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ১৯৯৯ সালের ৫ই জুন বলেনঃ“
বেলায়াতে ফকীহ্ শিয়া মাযহাবের অকাট্য বিষয় সমূহের অন্যতম।”
তিনি তার“
উজুবাতুল্ ইস্তিফ্তাআত্”
গ্রন্থে (প্রথম খণ্ড,পৃঃ ২৬) বলেনঃ“
বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছে বেলায়াত ও ইমামতের অন্যতম দিক - যা ধর্মের অন্যতম মূলনীতি।”
এমতাবস্থায় এটা কি কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধির পক্ষে স্বীকার করা সম্ভব যে,এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ওলামায়ে ইসলাম আলোচনা ও চর্চা করবেন না অথবা এটিকে প্রত্যাখ্যান করবেন? কতক লোক যে ওলামায়ে কেরাম সম্পর্কে দাবী করছেন যে,তারা বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছেন,স্বয়ং সেই ওলামায়ে কেরামই অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের বেলায়াতের মর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে আদেশ জারী করেছেন। আমরা উপরোক্ত সংশয় নিরসনের ও উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দানের লক্ষ্যে তাদের কয়েক জনের এতদসংক্রান্ত মতামত এখানে উদ্ধৃত করেছি। পাঠক-পাঠিকাগণ যদি এ প্রসঙ্গে শেখ আনছারী,আল্লামা তাবাতাবায়ী ও আয়াতুল্লাহ্‘
উযমা বোরুজার্দীর মতামত অধ্যয়ন করেন তাহলে আর এ ব্যাপারে কোনোই সংশয় থাকবে না। প্রশ্ন হচ্ছে,যারা এ ব্যাপারে সংশয়ের বিস্তার ঘটাচ্ছেন তারা কি উক্ত মনীষীদের এসব মাতামতের কথা আদৌ শোনেন নি? উক্ত মনীষীদের অন্যান্য বক্তব্যও এরই ওপর ভিত্তিশীল। বস্তুতঃ সঠিক পথ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ইতিহাস এবং কালাম শাস্ত্র ও ফিকাহর গ্রন্থ সমূহ এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের উপস্থাপিত যুক্তি-প্রমাণে পরিপূর্ণ।