অতীতে বিশেষজ্ঞ পরিষদ না থাকার কারণ কী? এর ভূমিকা কী?
বেলায়াতে ফকীহ্ যদি ইসলামের অকাট্য বিষয় সমূহের অন্যতম হয়ে থাকে এবং এ বিষয়ে শিয়া মাযহাবের মধ্যে ইজমা থেকে থাকে,তাহলে অতীতে মুজতাহিদ শাসককে পরিচিত করিয়ে দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ পরিষদ না থাকার কারণ কী? এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ পরিষদের ভূমিকা কী?
জবাবঃ এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও প্রত্যয় উৎপাদক জবাব দানের জন্য একটি ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে।
মরহূম মামেক্বানী
তার‘
ইলমে রিজাল বিষয়ক গ্রন্থে হিশাম বিন সালেমের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। এতে হিশাম বিন সালেম বলেনঃ
আমি হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর সামনে ছিলাম; তখন শামের
এক ব্যক্তি হযরত ইমামের নিকট (আসার জন্য) অনুমতি চাইলো। হযরত ইমাম তাকে অনুমতি দিলেন। সে প্রবেশ করলো এবং সালাম দিলো। হযরত ইমাম (আ.) জিজ্ঞেস করলেনঃ“
তোমার সমস্যা কী?”
শামী লোকটি বললোঃ“
আমার নিকট এ মর্মে খবর পৌঁছেছে যে,যে কোনো প্রশ্নের উত্তরই আপনার জানা আছে। এ কারণে,আপনার সাথে বিতর্ক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
হযরত ইমাম প্রশ্ন করলেনঃ“
কোন্ বিষয়ে?”
শামী লোকটি বললোঃ“
প্রথমে কোরআন সম্বন্ধে।”
তখন হযরত ইমাম হামরান নামক তার একজন শিষ্যকে - যিনি ছিলেন কোরআন বিশেষজ্ঞ - বললেনঃ“
এর সাথে বিতর্ক করো।”
হামরান শামী লোকটির সাথে বিতর্ক শুরু করলেন এবং বিতর্কে তাকে পরাভূত করলেন। এরপর শামী লোকটি বললোঃ“
আমি ফিকাহ্ সম্পর্কে বিতর্ক করতে চাচ্ছি।”
তখন হযরত ইমাম যুররেহ নামে তার অপর একজন শিষ্যকে নির্দেশ দিলেন ঃ“
এর সাথে বিতর্ক করো।”
এরপর হযরত ইমাম তার আরেক শিষ্য মু’
মিন ত্বাক্বকে কালাম শাস্ত্রে শামী লোকটির সাথে বিতর্ক করার জন্য নির্দেশ দিলেন। এরপর‘
ইলমে তাওহীদ সম্বন্ধে হিশাম বিন সালেম এবং ইমামত সম্বন্ধে হিশাম বিন হাকাম শামী লোকটির সাথে বিতর্ক করলেন। আর শামী লোকটি সকল বিতর্কেই পরাজিত হলো।
উপরোক্ত রেওয়ায়েত থেকে একটি বিষয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা হচ্ছে,যে কোনো বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যিনি বিশেষজ্ঞ তার শরণাপন্ন হতে হবে। এ কারণে হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) প্রতিটি বিষয়েই শামী লোকটিকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যিনি অন্যদের তুলনায় অধিকতর বিশেষজ্ঞ তার সাথে বিতর্ক করতে বলেন। বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার মানে এটাই।
বস্তুতঃ বেলায়াতে ফকীহ্ হচ্ছেন একজন বিশেষজ্ঞ শাসক। তেমনি বেলায়াতে ফকীহকে চিহ্নিতকরণ ও জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দেয়াও একটি বিশেষজ্ঞত্ব পর্যায়ের কাজ। জনগণ ইসলামী সমাজের নেতাকে চিনতে চাচ্ছে। এ কারণে তাদেরকে অবশ্যই সেই সব ব্যক্তির শরণাপন্ন হতে হবে যারা এ বিষয়ের জ্ঞানে অধিকতর পারদর্শী ও বিশেষজ্ঞ,যাতে তারা নেতা চেনার কাজে ভুলের শিকার হয়ে না পড়ে।
অতীতেও এ প্রক্রিয়াই প্রচলিত ছিলো। সাধারণ জনগণ অধিকতর‘
ইলমী যোগ্যতার অধিকারী মারজা-
এ তাক্বলীদকে চিনে নিতে সক্ষম ছিলো না। কারণ,তারা মারজা-
এ তাক্বলীদ চেনার জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলো না। তারা শুধু এতটুকুই জানতো যে,মারজা-এ তাক্বলীদের অনুসরণ করা অপরিহার্য। এ কারণে যখন কোনো মারজা-এ তাক্বলীদ ইন্তেকাল করতেন তখন একেক গ্রাম থেকে কয়েক জন লোক তেহরানে চলে আসতো এবং তারা বিভিন্ন মসজিদে যেতো ও ঐ সব মসজিদের ইমামদের নিকট জিজ্ঞেস করতো ঃ‘
সবচেয়ে বড় আলেম কে?’
মসজিদের ইমামগণ তথা আলেমদের নিকট এ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করার কারণ এই যে,তারা এ বিষয়ে তথ্যাভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তারা মসজিদের ইমামগণ বা আলেমদের নিকট থেকে ইলমে অগ্রগণ্যতার ক্ষেত্রে যদি একাধিক ব্যক্তির উল্লেখ পেতো সে ক্ষেত্রে তারা দেখতো যে,যে সব আলেম কোনো না কোনো ব্যক্তিকে সবচেয়ে বড় আলেম বলে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এ সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে কে আমলের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ও বেশী তাকওয়া-পরহেযগারীর অধিকারী; তারা সাধারণতঃ তার কথার ওপরই আস্থা স্থাপন করতো। আর সাক্ষ্যদাতা আলেমগণ যদি দ্বীনী ইলম ও তাকওয়া-পরহেযগারীর ক্ষেত্রে সবাই সমান হতেন তাহলে তারা অধিকাংশের মতের অনুসরণ করতো এবং দেখতো যে,এদের মধ্যে বেশীর ভাগ কার পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা এভাবে লব্ধ ধারণাকেই মারজা-এ তাক্বলীদ হিসেবে কাউকে গ্রহণ করা ও তার অনুসরণের জন্য যথেষ্ট মনে করতো। কারণ,নির্ভরযোগ্য লোকদের অধিকাংশের মত অনুসরণের জন্য হুজ্জাত হিসেবে গণ্য।
ইতিহাসে দেখা যায় যে,শিয়া মাযহাবের অনুসারীরা যুগে যুগে তাদের মারজা-এ তাক্বলীদ ও ওয়ালীয়ে ফকীহ্ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সব সময়ই এ পদ্ধতিরই অনুসরণ করেছে। তারা হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনরত থাকার যুগে অধিকতর‘
ইলমী যোগ্যতার অধিকারী মারজা-এ তাক্বলীদ বেছে নেয়ার লক্ষ্যে এভাবেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ও মুজতাহিদগণের শরণাপন্ন হতো - যারা‘
অধিকতর ইলমী যোগ্যতার অধিকারী’
লোক চেনার ক্ষেত্রে যেমন বিশেষজ্ঞ,তেমনি এটাই চাইতেন যে,সর্বাধিক ইলমী যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তিই তাদের মারজা-এ তাক্বলীদ হোন।
রাষ্ট্রের পরিচালনার অর্থে যিনি বেলায়াতে ফকীহর দায়িত্ব পালন করবেন তার জন্য একদিকে যেমন কতগুলো ইলমী শর্ত অপরিহার্য,তেমনি কতগুলো‘
আমলী শর্তও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে ইলমী শর্তসমূহের মধ্যে ফকীহ্ হিসেবে তথা মুজতাহিদ হিসেবে তার যোগ্যতা অন্যতম,আর আমলী শর্তাবলীর মধ্যে আছে ন্যায়পরায়ণতা,চিন্তা ও আচরণে ভারসাম্য,দূরদৃষ্টি,সুপরিচালনার যোগ্যতা,সাহসিকতা ইত্যাদি। এসব বৈশিষ্ট্যের প্রতিটিরই বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এসব বিষয়ের প্রতিটি সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে সংশ্লিষ্ট বৈশিষ্ট্যের প্রভাবের ভিত্তিতে তার সম্বন্ধে ধারণায় উপনীত হয়ে থাকেন। এ কারণেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই বড় বড় আলেমগণ মারজা-এ তাক্বলীদের মধ্যে সেসব ইলমী ও আমলী বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তার ভিত্তিতে তাদের সম্পর্কে মতামত গঠন ও প্রকাশ করতেন।
হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)ও লোকদেরকে এ পন্থায় ইসলামী সমাজের নেতাকে খুঁজে নেয়ার জন্য পথনির্দেশ প্রদান করেন। ইয়াকুব বিন শু‘
আইব হযরত ইমামকে (আ.) জিজ্ঞেস করেনঃ“
ইমাম যদি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হন এবং এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন তখন জনগণের করণীয় কী?”
এ প্রশ্নের জবাবে ইমাম (আ.) কোরআন মজীদের একটি আয়াত উদ্ধৃত করেন যাতে এরশাদ হয়েছে ঃ“
আর মু’
মিনদের জন্য এটা ঠিক নয় যে,তারা সকলেই (যুদ্ধাভিযানে) বেরিয়ে পড়ব। সুতরাং কেন তাদের (মু’
মিনদের) প্রত্যেক জনগোষ্ঠী থেকে একটি ছোট্ট দল বহির্গত হলো না যারা দ্বীন সম্পর্কে গভীর সমঝের অধিকারী হবে এবং তাদের কওমের কাছে প্রত্যাবর্তনের পর তাদেরকে সতর্ক করবে যাতে তারা নাফরমানী থেকে বিরত থাকে?”
ইমাম (আ.) এরপর বলেনঃ“
তারা যতদিন জ্ঞানার্জনে নিরত থাকবে ততদিন তাদের ওজর গ্রহণীয় এবং যে জনগণ তাদের কাছ থেকে জ্ঞান লাভের জন্য প্রতীক্ষায় থাকবে তারা ফিরে না আসা পর্যন্ত উক্ত জনগণের কাছ থেকেও ওজর গ্রহণীয় হবে।”
উক্ত রেওয়ায়েত অনুযায়ী কিছু সংখ্যক মুসলমানের দায়িত্ব গোটা মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে স্বীয় বাড়ীঘর ও জনপদ থেকে বেরিয়ে মুসলিম দেশের কেন্দ্রে গমন করবে এবং তারা ইসলামী সমাজের নেতার গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে ধারণা রাখে তার ভিত্তিতে ইসলামী সমাজের পরবর্তী নেতাকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করবে। নেতার যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা উচিৎ বলে তাদের জানা আছে তারা তার সাথে নেতৃত্বের যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের অবস্থা মিলিয়ে দেখবে। তারা ইসলামী সমাজের নেতাকে চিনতে পারার পর স্বীয় কওমের কাছে ফিরে যাবে এবং তাদের কাছে নেতাকে পরিচিত করিয়ে দেবে।
মুসলিম জনগণ সর্বাধিক ইলমী যোগ্যতার অধিকারী মুজতাহিদকে পাবার জন্যও এই একই পন্থার অনুসরণ করতো। কিন্তু সামাজিক সমস্যাবলী ফিক্বহী সমস্যাবলী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত সকলের জন্য একটিমাত্র মতে আসা অপরিহার্য,আর সকলকেই সে রায়ের প্রতি আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে ও তা মেনে চলতে হবে।
যেহেতু অতীতে মুসলিম জনগণ অধিকতর ইলমী যোগ্যতার অধিকারী মারজা-এ তাক্বলীদকে চেনার জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হতো,সেহেতু এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট বিষয় যে,বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টি কোনো অভিনব বা নতুন বিষয় নয়। আর বর্তমানে মুসলিম সমাজের জন্য উপযুক্ত সামাজিক-রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধিকারী দ্বীনী নেতা চিনে নেয়ার প্রয়োজন সমুপস্থিত। অর্থাৎ তাদেরকে তাদের রাষ্ট্রীয় ও সরকারী নেতা চিনে বের করতে হবে। তাদের জন্য এ ধরনের নেতার আনুগত্য হবে অপরিহার্য কর্তব্য।
বলা বাহুল্য যে,ইসলামী সমাজের জন্য রাষ্ট্রীয় ও সরকারী নেতা চিনে নেয়ার লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অধিকারী এমন এক বিশেষজ্ঞ মণ্ডলী থাকা অপরিহার্য যাদের সাক্ষ্য সকলের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে। এ বিশেষজ্ঞ মণ্ডলী আল্লাহ্ তা‘
আলা ও মা‘
ছূমগণের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করতে ও জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দিতে সক্ষম হবেন।
এখানে স্মর্তব্য যে,আল্লাহ্ তা‘
আলার পক্ষ থেকে মা‘
ছূমগণকে (আ.) নিয়োগের ন্যায় মুজতাহিদ শাসকের নিয়োগ সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নিয়োগ নয়,বরং প্রকৃত পক্ষে এ নিয়োগ হচ্ছে বিশেষ শর্তাবলী ভিত্তিক অনির্দিষ্ট নিয়োগ। তাই যে ব্যক্তির মধ্য উক্ত শর্তাবলী সর্বাধিক মাত্রায় তথা অন্য যে কারো চাইতে বেশী মাত্রায় পাওয়া যাবে এ নিয়োগ তার বেলায়ই প্রযোজ্য হবে এবং এ পদ ও দায়িত্ব তাকেই অর্পণ করতে হবে। কারণ,শরীয়তদাতা এ ব্যাপারে শুধু কতগুলো বিশেষ মানদণ্ড প্রদান করেছেন; যিনি এসব মানদণ্ডের বিচারে উপযুক্ততার অধিকারী হবেন তিনিই নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের অধিকার লাভ করবেন। যেহেতু এ কাজ সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও মানদণ্ডের ভিত্তিতে সম্পাদিত হতে হবে,সেহেতু যারা মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করবেন ও জনগণের সামনে পরিচিত করিয়ে দেবেন এবং তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবেন,তাদের মধ্যে মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা অপরিহার্য: এতদ্ব্যতীত তাদের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। অতএব,সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে এ দায়িত্ব পালনের উদ্যোগ নিতে হবে। আর বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের এক জায়গায় জমায়েত হওয়া ও পারস্পরিক চৈন্তিক বিনিময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্থিতিশীলতা ও নিশ্চিন্তার সৃষ্টি করে। জনগণ যখন তাদের আস্থাভাজন ন্যায়বান মহান মুজতাহিদগণকে এক জায়গায় সমবেত হতে ও মুজতাহিদ শাসক সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে দেখে তখন তারা নিশ্চিন্ততা অনুভব করে।
সাধারণ জনগণ জানে যে,পরিপূর্ণ শর্তাবলীর অধিকারী মুজতাহিদ শাসকের দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার বিষয়টি হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর পক্ষ থেকে সম্পাদিত হয়েছে এবং এর ভিত্তিতেই মুজতাহিদ শাসক তার দায়িত্ব লাভ করেছেন। আর এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণের সাক্ষ্যের মর্যাদা হচ্ছে এই যে,তারা ইমাম (আ.) যে গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিকে শাসক নিয়োগ করার কথা বলেছেন সে গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে জনগণের সামনে পরিচয় করিয়ে দেবেন। উদাহরণ স্বরূপ,তারা যেভাবে হযরত আয়াতুল্লাহ্ আল-উযমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ীকে ইমাম (আ.) কর্তৃক বর্ণিত গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে পেয়েছেন এবং আল্লাহ্ তা‘
আলা ও মা‘
ছূমগণের পক্ষ থেকে নিয়োজিত শাসক হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু তারা তাকে‘
যোগ্যতম’
হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন সেহেতু এ ক্ষেত্রে কেবল‘
যোগ্য’
হওয়াই কারো জন্যে এ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার বৈধতা তৈরী করবে না। বিশেষজ্ঞগণ যখন তাকে যোগ্যতম বলে সাক্ষ্য দেন তখন এ ব্যাপারে জনগণের করণীয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে যায় এবং তারা এ মুজতাহিদ শাসকের আদেশ-নিষেধ মেনে চলার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করে।
বিশেষজ্ঞদের কাজ এটাই। বিশেষজ্ঞ পরিষদ হচ্ছে এই বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের একত্রিত হওয়ার ব্যবস্থা যাতে একটি সুনির্দিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে তাদের সাক্ষ্য দানের বিষয়টি সম্পাদিত হতে পারে এবং যাদের মনে খুঁতখুঁতে ভাব আছে তারা যাতে মুজতাহিদ শাসককে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে ত্রুটি সন্ধান করতে না পারে,সেই সাথে জনগণের পক্ষে নিশ্চিন্ত মনে সামাজিক ও সামষ্টিক ব্যাপারে তার শরণাপন্ন হওয়া সম্ভব হয়,ইসলামী সমাজে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং বিশ্ব কুফরী শক্তির মোকাবিলায় মুসলমানরা সম্মান,মর্যাদা ও শক্তির অধিকারী হতে পারে,আর স্বীয় দ্বীনী দায়িত্ব যধাযথভাবে পালন করতে পারে।
এর পরিবর্তে অন্য কোনো পন্থা গ্রহণ করা হলে খোদায়ী হুকুমাতের লক্ষ্য অর্জনের মূলনীতি বাস্তবায়িত হবে না,বরং সামজে মতানৈক্য দেখা দেবে। বিশেষজ্ঞগণ তাদের মতামত অকাট্যভাবে প্রকাশের মাধ্যমে মুজতাহিদ শাসককে সমাজের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন এবং ইসলামী সমাজের এ নেতাও দৃঢ়তার সাথে স্বীয় মতামত ও সিদ্ধান্ত ঘোষণার মাধ্যমে এ সমাজের ঐক্য সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেন এবং বলদর্পী ও জালেম বিশ্বগ্রাসী শক্তির মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ইসলামী উম্মাহ্ গঠন করেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য এখানেই নিহিত। বস্তুতঃ একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে সব কিছুই ঐশী। এরূপ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্বও খোদায়ী মনোনয়নের মাধ্যমে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। আর বিশেষজ্ঞগণ এ সত্যের সপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে এতদসংক্রান্ত মানদণ্ডের ভিত্তিতে যোগ্যতম ব্যক্তিকে ইসলামী সমাজের নেতা ও শাসক হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেন।
অনেকের ধারণার বিপরীতে,প্রকৃত পক্ষে বিশেষজ্ঞগণ ইসলামী সমাজের নেতা ও শাসককে আইনগত বৈধতা প্রদান করেন না,ঠিক যেভাবে আলেমগণ মুজতাহিদগণের স্বীকৃতি ও অনুসরণের মাধ্যমে তাদের অধিকতর যোগ্য আলেম বা দ্বীনী বিষয়ে সার্বিকভাবে অনুসরণীয় মারজা-এ তাক্বলীদ বানিয়ে দেন না। বরং তারা ইসলামী সমাজের নেতা ও শাসকের যোগ্যতার মানদণ্ড সম্পর্কে যে জ্ঞানের অধিকারী তার ভিত্তিতে,মা‘
ছূম ইমামগণের (আ.) পক্ষ থেকে মনোনীত মুজতাহিদ নেতা ও শাসককে চিহ্নিত করেন ও সমাজের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। এভাবে তারা জনগণের সামনে তাদের করণীয় বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দেন।
বিশেষজ্ঞগণের এ কাজ অত্যন্ত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি কে বিশেষজ্ঞগণ তা চিহ্নিত করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। বস্তুতঃ ইসলামী সমাজের নেতা ও শাসককে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘
আলাই বৈধতা প্রদান করেন,আর বিশেষজ্ঞ পরিষদ হচ্ছে যথাযথ মানদণ্ডের সাথে মিলিয়ে তাকে খুঁজে বের করার একমাত্র কর্তৃপক্ষ। আর জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞগণের মতামতের অনুসরণ করা। কারণ,কেবল তারাই আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত নেতা ও শাসককে খুঁজে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অধিকারী। এ কারণে,বিষয়টির এ ধরনের বিশেষ গুরুত্বের কারণে সাধারণ জনগণ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নির্বাচিত করে যাতে তারা একটি প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রিত হন এবং নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের ব্যাপারে জনগণের করণীয় সুস্পষ্ট করে দেন।
অতীতেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) জনগণকে এ পদ্ধতি অনুসরণের জন্য আহ্বান জানান। তবে বিশেষজ্ঞ পরিষদ গঠন এ কাজটিকে সহজতর করে দিয়েছে এবং এ কারণে তা জনগণের জন্য নিশ্চিন্ততা সৃষ্টি করেছে। অতীতে লোকেরা মারজা-এ তাক্বলীদ সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের নিকট অনুসন্ধান করতো। আর বর্তমানে তার পরিবর্তে বিশেষজ্ঞগণ এক জায়গায় সমবেত হয়ে আল্লাহ্ তা‘
আলা ও মা‘
ছূমগণের পক্ষ থেকে মনোনীত নেতা ও শাসককে চিহ্নিত করার জন্য পরস্পর পরামর্শ ও মতামত বিনিময় করছেন এবং এভাবে তাকে চিহ্নিত করার পর তাকে জনগণের সামনে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। ফলে জনগণের পক্ষে খুব সহজেই তার সম্পর্কে অবহিত হয়ে তার আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করা সম্ভব হচ্ছে। বস্তুতঃ অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানে যে কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে তা অধিকতর পরিপক্ব। নিঃসন্দেহে এটা প্রশংসনীয় কাজ।
বর্তমানে বিশেষজ্ঞ পরিষদের উপস্থিতি থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে,বেলায়াতে ফকীহ্ বা মুজতাহিদের নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্ব বর্তমান কালে উদ্ভাবিত একটি তত্ত্ব। যারা এ তত্ত্বকে এ যুগের উদ্ভাবন বলে দাবী করছেন তারা বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্বের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে অবগত নন। এ কারণেই কিছু লোক বলেন যে,বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) কর্তৃক উদ্ভাবিত হয়েছে। এ দাবী এদের এ বিষয় সম্পর্কে জানা না থাকা হতে উৎসারিত।
আবার দেখা যায় যে,কতক লোক বলছে,বিশেষজ্ঞ পরিষদে সমাজের সকল শ্রেণী থেকেই প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন। এ বক্তব্যের উৎসও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে এ সব লোকের সঠিক ধারণার অভাব। কারণ,যে কোনো বিষয়ে কেবল তাদেরই মতামত দেয়া উচিৎ যারা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এ কারণে মুজতাহিদ নেতা ও শাসক চিহ্নিতকরণ সম্বন্ধেও কেবল তাদের পক্ষেই মতামত দেয়া সম্ভব যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। অতএব,কেবল এ ধরনের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণেরই বিশেষজ্ঞ পরিষদে প্রবেশাধিকার থাকা উচিৎ। তারা যদি বেলায়াতে ফকীহ্ তত্ত্ব এবং অতীতে ওয়ালীয়ে ফকীহ্ বা মারজা-এ তাক্বলীদ খুঁজে বের করার ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল থাকতো তাহলে তারা এ ধরনের কথা বলতো না। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ দাবী করে যে,বিশেষজ্ঞ পরিষদের বিষয় একটি নতুন বিষয়। এসব লোকের উচিৎ এ বিষয়ে আরো বেশী জানা ও গবেষণার চেষ্টা করা। তারা যদি অতীতে ইমাম,মারজা-এ তাক্বলীদ ও ওয়ালীয়ে ফকীহ্ চিহ্নিতকরণ ও পরিচয় করিয়ে দেয়ার ইতিহাস সম্বন্ধে অবহিত হয় এবং তা নিয়ে পর্যালোচনা করে তাহলে আর তাদের মনে এ ধরনের প্রশ্নের উদয় হবে না,বা হলেও তা বহুলাংশেই হ্রাস পাবে।