ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টি ও বস্তুগত বিশ্বদৃষ্টি
মানুষের মধ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিশ্বদৃষ্টি বিদ্যমান ছিল এবং এখনও বর্তমান। তবে অতি প্রাকৃতিক বিষয়কে গ্রহণ ও বর্জনের উপর ভিত্তি করে এগুলোকে দু’
ভাগে বিভক্ত করা যায় :
ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টি এবং বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি।
পূর্বে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির অনুসারীদেরকে প্রকৃতিবাদী,এ্যাথিষ্ট (Atheist) কখনো কখনো দ্বৈতবাদী (Dualist) ও নাস্তিক বলা হত। বর্তমানে তাদেরকে বস্তুবাদী বা Materialist নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
বস্তুবাদের
বিভিন্ন
শাখা
-
প্রশাখা
রয়েছে।
তবে
,
অধুনা
এগুলোর
মধ্যে
দান্দ্বিক
বস্তুবাদ
(Dialectic Materialism)সর্বাধিক
পরিচিত
,
যা
মার্কসিজমের
দর্শনকে
রূপদান
করেছে।
ইতিমধ্যেই
স্পষ্ট
হয়েছে যে,বিশ্বদৃষ্টির পরিধি দ্বীনের বিশ্বাসগত অংশ অর্থাৎ আক্বায়েদ অপেক্ষা বিস্তৃততর। কারণ,তা নাস্তিক্যবাদী ও বস্তুবাদী বিশ্বাসকেও সমন্বিত করে থাকে। অনুরূপ,মতাদর্শ পরিভাষাটিও শুধুমাত্র দ্বীনের সমগ্র বিধি-নিষেধের জন্যেই ব্যবহৃত হয়না ।
ঐশী ধর্মসমূহ এবং তাদের মূলনীতিসমূহ
বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তির স্বরূপ সম্পর্কে ঐতিহাসিক,সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান । তবে,ইসলামী উৎস থেকে যতটুকু জানা সম্ভব,তার ভিত্তিতে বলা যায় : মানুষের আবির্ভাবের সাথে সাথেই ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং মানব জাতির প্রথম সদস্য হযরত আদম (আঃ) স্বয়ং আল্লাহর নবী ,তাওহীদের প্রবক্তা এবং একেশ্বরবাদী ছিলেন। আর অংশীবাদী ধর্মসমূহ সর্বদা বিচ্যুতি এবং সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ফলে উৎপত্তি লাভ করেছিল ।
একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহ, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে ঐশ্বরিক ধর্মসমূহও বটে, সেগুলো সত্যধর্ম বলে পরিগণিত। এ ধর্মগুলো তিনটি সামগ্রিক মূলে অভিন্ন । যথাঃ
(১) একক প্রভুর প্রতি বিশ্বাস।
(২)প্রতিটি মানুষের জন্যে পরকালীন অনন্ত জীবন আছে বলে বিশ্বাস ও পার্থিব কর্মের জন্যে অর্জিত কর্মফল গ্রহণের (দিবসের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন।
(৩) পরম উৎকর্ষ সাধন এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের পথে মানুষকে পরিচালনার জন্যে মহান প্রভুর নিকট থেকে নবীগণ প্রেরিত হয়েছেন বলে বিশ্বাস স্থাপন।
এ মূলত্রয় প্রকৃতপক্ষে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন, যা প্রত্যেক বিবেক সম্পন্ন মানুষের বিবেকেই বিদ্যমান তারই জবাব মাত্র। প্রশ্নত্রয় নিম্নরূপ :
(১) অস্তিত্ব দান করেন কে ?
(২)জীবনের শেষে কী রয়েছে ?
(৩) কিরূপে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট কর্মসূচীর পরিচয় পাওয়া যেতে পারে ?
প্রসঙ্গতঃ ওহীর মাধ্যমে জীবন-কর্মসূচীর যে বিষয়-বস্তু নিশ্চিতরূপ লাভ করেছে,সত্যিকার অর্থে তা-ই হল সে ধর্মীয় মতাদর্শ যা ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টির উপর প্রতিষ্ঠিত ।
অপরিহার্য বিষয়সমূহ ,অবিচ্ছেদ্য বিষয়সমূহ ,নির্ভরশীল বিষয়সমূহ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসমূহ, যেগুলি সামগ্রিকভাবে দ্বীনের বিশ্বাস সমষ্টিকে রূপায়িত করে সেগুলির সমন্বয়ে মৌলিক মতবিশ্বাস গঠিত। আর বিশ্বাসসমূহের বৈসাদৃশ্যই হল একাধিক ধর্ম,ধর্মীয় দল-উপদল ও মাযহাবের উৎপত্তির কারণ। যেমন : কোন কোন নবীগণের (আঃ) নবুয়্যতের ব্যাপারে মতানৈক্যের কারণেই ইহুদি,খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে এবং তাদের মতবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। এমনকি কোন কোন বিষয়,মৌলিক মতবিশ্বাসের (প্রকৃত) সাথেও অসঙ্গতি সৃষ্টি করেছে। যেমন : খ্রীষ্টানদের ত্রিত্ববাদ,একেশ্বরবাদের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিহীন;যদিও তারা এর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। অনুরূপ রাসুল (সঃ) -এর উত্তরসূরী নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ‘
আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হবেন,না জনগণ নির্বাচন করবে?’
এ বিষয়ের উপর মতবিরোধের ফলেই শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে ।
উপসংহারে বলা যায়,তাওহীদ,নবুয়্যত এবং পুনরুত্থান দিবস,এ তিনটি হচ্ছে প্রত্যেক ঐশ্বরিক ধর্মেরই মৌলিকতম বিশ্বাস। তবে এ মূলত্রয়ের বিশ্লেষণের ফলে অর্জিত অথবা তাদের অধীনস্থ অন্যান্য বিশ্বাসসমূহকেও বিশেষ পারিভাষিক অর্থে মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করা যেতে পারে । যেমন : খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাসকে একটি মৌলিক বিশ্বাস এবং তাঁর একত্বকে অপর একটি মৌলিক বিশ্বাস হিসাবে মনে করা যেতে পারে । অথবা নবুয়্যতের বিশ্বাসকে সকল ধর্মেরই মৌলাংশ এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর নবুয়্যতের প্রতি বিশ্বাসকে ইসলামের অপর একটি মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করা যেতে পারে । যেমন : কোন কোন শিয়া পন্ডিত ন্যায়পরায়ণতাকে (العدل
) একটি স্বতন্ত্র মূল হিসাবে মনে করেন, যদিও এটা তাওহীদেরইএকটি শাখা । অনুরূপ, নবুয়্যতের অধীন হওয়া সত্বেও ইমামতকে আলাদা একটি মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এধরনের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে‘
মৌলিক’
শব্দটির ব্যবহার একান্তই পারিভাষিক ও পারস্পরিক সম্মতিভিত্তিক। ফলে,এ ব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই ।
অতএব,‘
দ্বীনের মৌলাংশ’ শব্দটিকে সাধারণ ও বিশেষ এ দু‘
টি অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে।‘
মৌলাংশ’পরিভাষাটির সাধারণ অর্থ‘
দ্বীনের গৌণাংশ’অর্থাৎ বিধি-নিষেধ অংশের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং নির্ভরযোগ্য সকল মতবিশ্বাসকে সমন্বয় করে থাকে। আর তার বিশেষ অর্থটি দ্বীনের মৌলিকতম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়ে থাকে। অনুরূপ,মৌলিক বিশ্বাসত্রয়ের মত সকল ঐশী ধর্মের অভিন্ন বিশ্বাসকে (তাওহীদ,নবুয়্যত,পুনরুত্থন দিবস) দ্বীনের মৌলাংশ (নিরঙ্কুশভাবে) এবং তাদের সাথে অপর এক বা একাধিক মৌলিক বিশ্বাসের সমন্বয়ে‘
দ্বীনের বিশেষ মৌলাংশ’অথবা এক বা একাধিক বিশ্বাস ,যেগুলো মাযহাব বা ফিরকার বিশেষত্ব, সেগুলোর সংযোজনের মাধ্যমে কোন মাযহাবের মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করা হয়।