আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)21%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16243 / ডাউনলোড: 4975
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

1

১৫তম পাঠ

দ্বান্দ্বিক বস্তবাদ ও তার ত্রুটি নির্দেশ

যান্ত্রিক বস্তুবাদ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ

বস্তবাদ একাধিক শাখায় বিভক্ত। এদের প্রতিটিই বিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা প্রদান করে। নবযুগের প্রারম্ভিক লগ্নে বস্তবাদীরা নিউটনের পদার্থ সস্পর্কীয় মতবাদের প্রয়োগে জাগতিক যাবতীয় সৃষ্টিসমূহকে যান্ত্রিক গতির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তারা প্রতিটি গতি (বা পরিবর্তনকেই) কোন বিশেষ গতিশক্তির ফল বলে মনে করেছেন যা বাইরে থেকে গতিশীল (পরিবর্তনশীল) বস্ততে প্রবেশ করে । অন্য কথায় : তারা বিশ্বব্রম্মাণ্ডকে এমন একটি বৃহৎ যানবাহনের সাথে তুলনা করেছেন যে,গতিশক্তি তার এক অংশ থেকে অন্য অংশে পরিচালিত হয় যার ফলে এ বৃহৎ যানবাহনটি গতিশীল হয়ে থাকে।

যান্ত্রিক বস্তবাদ’বলে পরিচিত এ মতবাদটির অনেক দুর্বলতা বিদ্যমান যেগুলো প্রতিপক্ষের সমালোচনার বিষয়বস্ততে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য একটি হল : যদি সকল প্রকার গতিই বাহ্যিক কোন শক্তির ফল হয়ে থাকে তবে প্রারম্ভিক বস্তর জন্যেও কোন শক্তিকে বিবেচনা করতে হবে,যা বাইরে থেকে তাতে প্রবেশ করেছে। আর এর অবিচ্ছেদ্য অর্থ হল কোন অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়া,যা ন্যূনতম পক্ষে বস্তজগতের প্রারম্ভিক গতির উৎস হয়ে থাকবে ।

অপরটি হল : শুধুমাত্র ঘুর্ণনগতি ও স্থানান্তরিক গতিকেই যান্ত্রিক গতিশক্তির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অথচ বিশ্বের সকল বিষয়কে কেবলমাত্র স্থানান্তরিতগতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলে মনে করা যায় না। সুতরাং এতদ্ভিন্ন অন্যান্য বিষয়ের উৎপত্তির জন্যে অপর এক কারণ ও নির্বাহীকে বিবেচনা করা অপরিহার্য ।

এ অনুপপত্তিসমূহের উত্তরদানে যান্ত্রিক বস্তবাদের অক্ষমতা,বস্তবাদীদেরকে জগতিক বিভিন্ন রূপান্তরের ব্যাখ্যার জন্যে অপর এক কারণের দারস্থ হতে বাধ্য করে এবং ন্যূনতম পক্ষে তারা কোন কোন গতিকে স্বয়ংক্রিয়তার ভিত্তিতে অর্থাৎ (Dynamically) ব্যাখ্যা করতে,বস্তুর জন্যে একপ্রকার স্বয়ংক্রিয় আন্দোলনকে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ করে দ্বান্দ্বিক বস্তবাদের পুরোধাগণ (মার্কস ও এ্যাংগেল্স) হেগেলের দার্শনিক ধারণার ভিত্তিতে গতির নির্বাহককে বস্তুর আভ্যন্তরীণ বিরোধরূপে ব্যাখ্যা করেছেন । তারা স্বীয় মতবাদের ব্যাখ্যার জন্যে,বস্তর অবিনাশিতাবাদ ও অসৃষ্ট-নীতি সার্বজনীন গতি এবং সৃষ্ট বিষয়সমূহের পারস্পরিক প্রভাবের মূলনীতিকে গ্রহণ করার পাশাপাশি নিম্নলিখিত তিনটি মৌলিক বিষয়কে বর্ণনা করেছেন :

১। আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যনীতি।

২। দৈবাৎনীতি বা সংখ্যাবাচক (کمی ) রূপান্তরের গুণবাচক রূপান্তরে পরিবর্তন।

৩। বিপ্রতীপদ্বয়ের বিবর্তননীতি বা প্রকৃতির বিকাশনীতি।

আমরা এখানে উল্লেখিত নীতিত্রয়ের প্রতিটির সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করব এবং পরিশেষে তাদের অসারতা প্রমাণে প্রয়াসী হব।

বৈপরীত্য নীতি :

দ্বান্দ্বিক বস্তবাদ বিশ্বাস করে যে,সকল যৌগই দু টি বিপ্রতীপ (Thesis Ges Anti-thesis) নিয়ে গঠিত। এ বিপ্রতীপদ্বয়ের বৈপরীত্যই বস্তর গতি ও রূপান্তরের কারণ । যখনই Anti-thesis বিজয়ী হয় তখনই নতুন এক বস্ত,যা তাদের Synthesis বলে পরিগণিত,তা অস্তিত্ব লাভকরে থাকে। যেমন : মুরগীর ডিমে (Thesis) শুক্রাণু (Anti-thesis) বিদ্যমান,যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং খাদ্যোপাদনসমুহকে নিজের অভ্যন্তরে হজম করে;অতঃপর মুরগীর বাচ্চা ঐগুলোর Synthesis হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করে থাকে।

বৈদ্যুতিক ধনাত্বকতা ও ঋণাত্বকতা হল পদার্থের আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তেমনি যোজন-বিয়োজন,প্রাথমিক পর্যায়ের গাণিতিক বৈপরীত্য এবং ডিফারেন্সিয়েশন ও ইণ্টিগ্র্যাশন উচ্চপর্যায়ের গাণিতিক বৈপরীত্য বলে পরিগণিত হয়ে থাকে ।

এ বিষয়টি সামাজিক ও ঐতিহাসিক ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে পুঁজি বাদী সমাজে কর্মজীবি শ্রেণী হল পুঁজিবাদীদের Anti -thesis যা প্রবৃদ্ধি লাভ করে এবং পর্যায়ক্রমে পুঁজি বাদের উপর বিজয়ী হয়ে তাদের Synthesis হিসেবে সমাজতান্ত্রিক (Socialistic) ও সাম্যবাদী (Communistic) সমাজ রূপ পরিগ্রহ করে থাকে।

মার্কসবাদের প্রবক্তার বলেন যে,এ বৈপরীত্য নীতিটি ম্যাটাফিজিক্যাল ধারণাকে (পারস্পরিক বৈপরীত্যের অসম্ভাব্যতা ) প্রত্যাখ্যান করে ।

সমালোচনা :

প্রারম্ভেই স্মরণযোগ্য যে,দু টি বস্তগত অস্তিত্ব যদি পরস্পর এমনভাবে অবস্থান করে যে, তাদের একটি অপরটিকে দুর্বল করে ফেলে অথবা নিশ্চিহ্ন করে ফেলে স্বীয় অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে;তবে এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। যেমনটি পানি ও আগুনের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করি। কিন্তু,

প্রথমতঃ এ ব্যাপারটি সার্বজনীন নয় এবং একে বিশ্বের সকল ঘটনার জন্যে কোন সূত্র হিসেবে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। কারণ এর ব্যতিক্রম এমন শত-সহস্র ঘটনা এ বিশ্বে বিদ্যমান ।

দ্বিতীয়তঃ কোন কোন বস্ততে প্রাপ্ত এ ধরনের বৈপরীত্যের সাথে যুক্তি-বিজ্ঞান ও পরাপ্রাকৃতিক দর্শনে বর্ণিত অসম্ভাব্যতার কোন সস্পর্ক নেই। কারণ অসম্ভব বলে যাকে গণনা করা হয়েছে,তা হল একই বিষয়ে পরস্পর বিপ্রতীপের সমাবেশ,(اجتماع الضدین فی موضوع واحد )। উপরোল্লিখিত উদাহরণসমূহের কোনটিতেই বিষয়বস্তু একক নয়। আর মার্কসবাদীদের হাস্যকর উদাহরণের কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখে না। যেমন : যোজন ও বিয়োজন অথবা ডিফারেন্সিয়েশন ও ইণ্টিগ্রেশনের সমাবেশ ইত্যাদি,অথবা পুঁজিবাদী সমাজে কর্মজীবি শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণীকরণ ।

তৃতীয়তঃ যদি সকল কিছুই দু টি বিপ্রতীপের সমন্বয়ে অস্তিত্বে এসে থাকে,তবে প্রতিটি Thesisএবং Anti -thesis-এর জন্যেও অপর একটি সমন্বয়কে বিবেচনা করতে হবে। কারণ এগুলোও দুটি স্বতন্ত্র বিষয়। ফলে বর্ণিত নীতি অনুসারে এরাও দু টি বিপ্রতীপের সমন্বয় হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। ফলশ্রুতিতে,প্রতিটি ক্ষুদ্রতম অস্তিত্বই অসীম সংখ্যক বিপ্রতীপের সমন্বয় হতে হবে।

অপরদিকে যান্ত্রিক বস্তবাদের দুর্বলতাকে দূরীকরণের নিমিত্তে,আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যকে যে গতি বা বিবর্তনের মূলনির্বাহক হিসেবে পরিচয় করানোর চেষ্টা করেছেন,তা ন্যূনতমপক্ষে যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হল,এ ধারণার স্বপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তিরই অস্তিত্ব নেই। তাছাড়া বাহ্যিক শক্তির প্রভাবে যে যান্ত্রিক গতির উৎপত্তি হয়,তা যে কোন অবস্থায়ই অনস্বীকার্য। নতুবা প্রশ্ন থেকে যায়,ফুটবলের গতিও কি তার আভ্যন্তরীণ বৈপরীত্যের ফলে সৃষ্ট বলতে হবে,না কি খেলোয়াড়ের পায়ের আঘাতে সৃষ্ট বলতে হবে !

দৈবাৎনীতি :

জগতের সকল পরিবর্তনই পর্যায়ক্রমে ও একক রেখায় সজ্জিত নয়। অধিকাংশ সময়ই নতুন এমন কোন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে,যা পূর্ববর্তী সকল সৃষ্টবিষয় থেকে স্বতন্ত্র এবং তাকে পূর্ববর্তী গতি বা পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসাবে বর্ণনা করা যায় না । এ ধারণার উপর ভিত্তি করে,মার্কসবাদীরা,দৈবাৎনীতি বা পরিমাণবাচক পরিবর্তনের গুণবাচক পরিবর্তনে রূপান্তরের পথ’নামক অপর একটি নীতির প্রবর্তন করেছেন। এ নীতিতে তারা বলেন : সাংখ্যিক পরিবর্তন যখন কোন এক বিশেষ বিন্দুতে পৌঁছে,তখন গুণগত বা প্রকরণগত পরিবর্তনের উদ্ভব হয়। যেমন : পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে যখন একটি নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছে,তখন পানি,বাস্পে রূপান্তরিত হয়। অনুরূপ প্রতিটি ধাতব পদার্থের জন্যেই নির্দিষ্ট গলনাংক বিদ্যমান এবং যখন তাপমাত্রা ঐ গলনাংকে পৌঁছে উক্ত ধাতবপদার্থ তরল পদার্থে পরিণত হয় । মানব সমাজেও যখন বিরোধ বা মতপার্থক্যের তীব্রতা নির্দিষ্ট সীমানায় পৌঁছে,তখন বিপ্লব অস্তিত্বে আসে ।

সমালোচনা :

প্রথমতঃ কোন ক্ষেত্রেই সংখ্যাবাচকতা,গুণবাচকতায় রূপান্তরিত হয় না। সর্বোপরি যা ঘটে তাহল কোন নির্দিষ্ট বস্তুর উৎপত্তি নির্দিষ্ট সংখ্যাবাচকতার শর্তাধীন । যেমন : পানির তাপমাত্রা বাস্পে পরিণত হয় না। বরং পানির বাস্পে পরিণত হওয়াটা পানিতে বিদ্যমান তাপমাত্রার পরিমাণের শর্তাধীন।

দ্বিতীয়তঃ পরিবর্তনের জন্যে এ বাঞ্ছিত পরিমাণ,পর্যায়ক্রমিক পরিমাণগত বর্ধনের ফলে অর্জিত হওয়াটা অপরিহার্য নয়। বরং পূর্ববর্তী পরিমাণের হ্রাসের ফলে এ পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে । যেমন : বাস্পের পানিতে পরিবর্তীত হওয়াটা তাপমাত্রার হ্রাসের শর্তাধীন ।

তৃতীয়তঃ গুণগত পরিবর্তন সর্বদাই আকস্মিকভাবে ঘটে না । বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যায়ক্রমিকভাবে ঘটে থাকে। যেমন : মোম ও কাঁচের গলে যাওয়াটা পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকে।

অতএব গ্রহণযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে,প্রাকৃতিক কতকগুলি বিষয়ের বাস্তবায়নের জন্যে কোন বিশেষ পরিমাণের আবশ্যকতা রয়েছে। না,পরিমাণের গুণে পরিবর্তনের আবশ্যকতা আর না,পরিমাণের ক্রমশ বৃদ্ধির আবশ্যকতা রয়েছে এবং না,কোন গুণগত ও পরিমাণগত যাবতীয় পরিবর্তনের জন্যে অনুরূপ শর্তের সামগ্রীকতা আবশ্যক।

সুতরাং বিশ্বজগতে দৈবাৎ নীতি বা পরিমাণবাচক পরিবর্তনের গুণবাচক পরিবর্তনে রূপান্তরের পথ’ নামক কোন নীতির অস্তিত্ব নেই।

বিপ্রতীপদ্বয়ের বিবর্তননীতি

এ নীতিটি না-বোধকের না-বোধক নীতি বলে পরিচিত। কখনো কখনো একে প্রকৃতির বিবর্তন নীতিও বলা হয়ে থাকে। এ নীতির বক্তব্য হল : দ্বান্দ্বিকতার অসংখ্য রূপান্তরের ধারায় সর্বদা Thesis, Anti - thesis কর্তৃক অস্বীকৃত হয়ে থাকে। অনুরূপ Anti - thesis ও স্বয়ং Synthesis কর্তৃক অস্বীকৃত হয়। যেমন : বীজ,বৃক্ষকর্তৃক এবং তাও নতুন বীজসমূহ কর্তৃ অস্বীকৃত হয়। প্রাণ একক (نطفه ) ডিম কর্তৃক এবং স্বয়ং ডিম বাচ্চা কর্তৃক অস্বীকৃত হয়ে থাকে। কিন্তু সকল অনুজই,অগ্রজ অপেক্ষা পূর্ণতর। অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বিবর্তন-ধারা সর্বদা উন্নয়ন ও পূর্ণতার দিকে হয়ে থাকে। আর এ নীতির গুরুত্বও এখানেই সুপ্ত,যা রূপান্তর ধারাকে নির্দেশ করে এবং রূপান্তর ধারা উন্নয়ন ও পূর্ণতার দিকে বলে গুরুত্বারোপ করে।

সমালোচনা :

নিঃসন্দেহে প্রতিটি পরিবর্তন ও বিবর্তনেই পূর্ববর্তী অবস্থান ও অবস্থা বিলুপ্ত হয়ে থাকে এবং নতুন কোন অবস্থা ও অবস্থানের সূত্রপাত ঘটে। যদি না-বোধকের না-বোধক’নীতিকে উপরোল্লেখিত অর্থে বিবেচনা করি,তবে তা রূপান্তরের অবিচ্ছেদ্য বিষয়ের বর্ণনা ব্যতীত আর কিছুই নয়। কিন্তু এ নীতির যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এবং একে যে,গতি ও পূর্ণতার দিক-নির্দেশনা বলে মনে করা হয়েছে,সে প্রসঙ্গে বলতে হয় : বিশ্বের গতি ও রূপান্তর পূর্ণতার দিকে বলতে যদি এ অর্থকে বুঝায় যে,প্রতিটি নতুন বিষয়ই অপরিহার্যভাবে পূর্ববর্তী বিষয় অপেক্ষা পূর্ণতর তবে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না । ইউরেনিয়াম যে,অতি বিচ্ছুরণের প্রভাবে সীসায় পরিণত হয় তাও কি আর পূর্ণতাপ্রাপ্তি বলে পরিগণিত হয় ? পানি যে,বাস্পে পরিণত হয় অথবা বাস্প যে পানিতে পরিবর্তিত হয়,তাতেও কি পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে ? বৃক্ষ ও লতা-পাতা যে,শুষ্ক হয়ে যায় এবং কোন প্রকার বীজ ও ফলই তাতে অবশিষ্ট না থাকে তা-ও কি তাদের পূর্ণতা প্রাপ্তি?

অতএব শুধুমাত্র এটুকই গ্রহণযোগ্য যে,কোন কোন প্রাকৃতিক বিষয়বস্তু গতি ও পরিবর্তনের ফলে পূর্ণতর হয়ে থাকে (সকল বিষয়ই নয় )। সুতরাং বিবর্তনকেও বিশ্বের সকল সৃষ্ট বিষয়ের জন্যে একটি সার্বজনীন সূত্ররূপে গ্রহণ করা যায় না ।

পরিশেষে স্মরণ করব : এ সকল নীতিগুলো সার্বজনীনভাবে যদি গৃহীত ও স্বীকৃতও হয়ে থাকে,তারপরও প্রকৃতি বিজ্ঞানে প্রমাণিত সূত্রসমূহের মত শুধুমাত্র সৃষ্ট বিষয় বস্তর স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারত । কিন্তু,এমন কোন প্রতিষ্ঠিত সার্বজনীন নীতি ও সূত্রের অস্তিত্ব নেই যে,প্রমাণ করবে কোন বিষয় তার সৃষ্টিকর্তা বা অস্তিত্বদাতা কারণ ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে। যেমনি করে পূর্ববর্তী পাঠসমূহে আমরা বর্ণনা করেছি যে,যেহেতু বস্তু ও বস্তুগত বিষয়সমূহ হল সম্ভাব্য অস্তিত্ব,সেহেতু কোন অনিবার্য অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল থাকা অপরিহার্য ।

১৬তম পাঠ

আল্লাহর একত্ব

ভূমিকা :

পূর্ববর্তী পাঠসমূহে,বিশ্বসৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের অপরিহার্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যিনি সর্বজ্ঞ,পরাক্রমশালী এবং বিশ্বের অস্তিত্বদানকারী,রক্ষক ও পরিচালক । এ ছাড়া সাম্প্রতিক পাঠসমূহে আমরা বস্তবাদী বিশ্বদৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা পূর্বক তার বিভিন্ন সমস্যা ও ত্রুটি সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। ফলে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয়েছে যে,সৃষ্টিকর্তাবিহীন বিশ্বের ধারণা হল একটি অযৌক্তিক ধারণা এবং এর স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা নেই ।

এখন একত্ববাদ সম্পর্কে আলোচনার পালা এসেছে। এ পর্যায়ে আমরা অংশীবাদী ধারণার অসারতা প্রমাণ করার প্রয়াস পাব।

অংশীবাদী বিশ্বাস কিরূপে মানুষের মাঝে পত্তন এবং বিস্তার লাভ করেছিল,সে ব্যাপারে সমাজ বিজ্ঞানীরা একাধিক মতবাদ ব্যক্ত করেছেন । কিন্তু ঐগুলোর কোনটির স্বপক্ষেই সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য কোন যুক্তি নেই ।

সম্ভবতঃ অংশীবাদ এবং একাধিক খোদার বিশ্বাসের প্রথম কারণ ছিল বিশ্ব-ব্রমাণ্ডের বৈচিত্র্যময় ঘটনাবলীর পর্যবেক্ষণ । এ বৈচিত্র্যের পর্যবেক্ষণে মানুষের মধ্যে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে,প্রত্যেক প্রকারের ঘটনা,সংশ্লিষ্ট খোদার তত্ত্বাবধানে সস্পন্ন হয়ে থাকে । যেমন : কেউ কেউ ধারণা করেছেন যে,শুভ ঘটনাগুলো হল কল্যাণকামী প্রভুর কর্ম এবং মন্দ ঘটনাগুলো হল অকল্যাণকামী প্রভুর কর্ম। আর এ ভাবেই বিশ্বের জন্যে দু খোদার বিশ্বাস প্রবর্তিত হয়েছিল।

অপরদিকে সূর্যা লোক,চন্দ্র ও তারকাসমূহ যে,পার্থিব ঘটনাবলীর উপর প্রভাব ফেলে,তার আলোকে এ ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে,বিশ্বের বিষয়বস্তর উপর ঐগুলোর এক প্রকার প্রভুত্ব বিদ্যমান ।

অথবা স্পৃশ্য ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য খোদার প্রতি ঝুকে পড়ার কারণে কল্পিত প্রভুদের মূর্তি তৈরী এবং তাদের উপাসনায় নিয়োজিত হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। কালক্রমে স্বয়ং মূর্তিসমূহ স্বল্পবুদ্ধির জনসমষ্টির মাঝে মূখ্য রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং সকল জাতি এমনকি প্রতিটি গোত্র নিজ নিজ কল্পনার ভিত্তিতে মূর্তি-পূজার জন্যে একাধিক ধর্মের প্রবর্তন করেছে -যাতে একদিকে যেমনি প্রভুভক্তির ফিতরাতগত প্রবণতাকে ভিন্নরূপে উপস্থাপন করা যেতে পারে,তেমনি অপরদিকে,নিজেদের পাশবিক লোভ-লালসাকে পবিত্রতার রঙে রঞ্জিত করা যেতে পারে এবং তদনুরূপ এগুলোকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির কলেবরে রূপ দেয়া যেতে পারে। আজোবধি উচ্ছৃংখল নৃত্য,মদ্যপ ও কামুক উৎসবসমূহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান রূপে মূর্তিপজারীদের মধ্যে প্রচলিত আছে।

এ ছাড়া,স্বেচ্ছারী,শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার,প্রতিহিংসাপরায়ণ পাষণ্ডদের অভিলাষও সরলমনা জনসমষ্টির বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে প্রবঞ্চনার কারণ হয়েছিল। এভাবে স্বীয় রাজত্ব ও ক্ষমতার সম্প্রসারণের জন্যে তারা অংশীবাদী ধ্যান-ধারণার প্রচার ও প্রসারে প্রয়াসী হয়েছিল এবং নিজেদের জন্যে এক প্রকার প্রভুত্বে বিশ্বাসী ছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারা দূবত্তদের উপাসনাকে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত করেছে । মিশর,ভারত,চীন,পারস্য ইত্যাদি দেশে এর সুস্পষ্ট নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় ।

যাহোক অংশীবাদী ধর্মসমূহ,বিভিন্ন কারণ ও নির্বাহকের প্রভাবে,মানব সমাজে প্রথিত ও প্রচলিত হয়েছিল এবং ঐশীধর্ম ও একত্ববাদের ছায়ায় মানুষের প্রকৃত বিকাশ ও উৎকর্ষ লাভের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে নবীগণের (আঃ) প্রচেষ্টার এক বৃহত্তর অংশ জুড়ে স্থান পেয়েছিল অংশীবাদ ও অংশীবাদীদের বিরূদ্ধে সংগ্রাম। পবিত্র কোরানে পুনঃপৌনিকভাবে তাঁদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ।

অতএব অংশীবাদী বিশ্বাসের মূলভিত্তি,বিশ্বব্র¤মাণ্ডের কোন কোন ঘটনার জন্যে মহান প্রভু ভিন্ন অপর কোন অস্তিত্বের প্রতি প্রভুত্বের ধারণা থেকে রূপ লাভ করেছিল। তবে অংশীবাদীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বসৃষ্টি কর্তার একত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তারা সৃজনক্ষমতার একত্বকে স্বীকার করেছিলেন;কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে,দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রভুদের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন । তাদের ধারণানুসারে জগতের পরিচালনা ও রক্ষার ব্যাপারটি প্রত্যক্ষভাবে (এ দ্বিতীয় শ্রেণীর) প্রভুদের ইচ্ছাধীন। তারা সৃষ্টিকর্তা প্রভুকে বর্ণিত খোদাদের প্রভুরূপে নামকরণ করেছে। অর্থাৎ তিনি হলেন প্রভুদের প্রভু (رب الارباب )

কারো কারো মতে এ পরিচালক প্রভুরা হলেন ফেরেস্তাগণ । আরব অংশীবাদীরা এ ফেরেস্তুাগণকে আল্লাহর কন্যা বলে মনে করত । আবার কারো কারো মতে জ্বিন-পরীরা,কারো কারো মতে নক্ষত্র সমষ্টির আত্মারা অথবা প্রয়াত মানুষের আত্মারা কিংবা এক বিশেষ ধরনের অজ্ঞাত অস্তিত্ব হল এ পরিচালক প্রভুসকল।

দশম পাঠে আমরা ইঙ্গিত করেছিলাম যে,প্রকৃত সৃজনত্ব ও প্রতিপালনত্ব পরস্পর থেকে বিভাজনযোগ্য ও পৃথকীকরণযোগ্য নয় এবং আল্লাহর সৃজনত্বে বিশ্বাস (আল্লাহ ব্যতীত) অন্য কারো প্রতিপালনত্বের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। যারা এ ধরনের স্ববিরোধিতাপূর্ণ বিশ্বাস পোষণ করতেন তারা প্রকৃতপক্ষে বর্ণিত অবস্থাদ্বয়ের বৈপরীত্যের প্রতি লক্ষ্য রাখেননি এবং তাদের বিশ্বাসের বাতুলতা প্রমাণ করার জন্যে এ বৈপরীত্যের সুস্পষ্ট কারণই যথেষ্ট ।

খোদার একত্বকে প্রমাণ করার জন্যে একাধিক যুক্তির অবতারণা হয়েছে;যেগুলো কালামশাস্ত্রও দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। তবে আমরা এখানে এমন একটি যুক্তি উপস্থাপন করব,যাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিপালনত্বের একত্ববাদকে প্রতিপাদন করার পাশাপাশি,অংশীবাদী বিশ্বাসেরও অপনোদন হয়।

আল্লাহর একত্বের প্রমাণ

ধরা যাক বিশ্বের জন্যে দুই বা ততোধিক সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান। তাহলে তা নিম্নলিখিত অবস্থাসমূহের ব্যতিক্রম হবে না : হয় বিশ্বের প্রতিটি বিষয়ই তাদের ফলশ্রুতি বা সৃষ্ট বলে পরিগণিত হবে অথবা প্রতিটি শ্রেণীই কোন এক প্রভুর সৃষ্ট বলে পরিগণিত হবে কিংবা সবকিছুই এক প্রভুর সৃষ্ট;তবে অন্যান্য খোদারা বিশ্বের পরিচালক ও তত্তাবধায়ক রূপে পরিগণিত হবে ।

কিন্তু সকল সৃষ্টরই একাধিক সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান’এ ধারণাটি অসম্ভব। কারণ,দুই বা ততোধিক সৃষ্টিকর্তা (অস্তিত্বদাতা কারণ) কোন অস্তিত্বশীলকে সৃষ্টি করার অর্থ হল,তাদের প্রত্যেকেই একটি করে অস্তিত্ব’ঐ অস্তিত্বশীলকে দান করা। যার ফলশ্রুতি হল,একটি অস্তিত্বশীলের জন্যে একাধিক অস্তিত্বের ধারণা। অথচ প্রত্যেক অস্তিত্বশীলই কেবলমাত্র একটি অস্তিত্বেরই অধিকারী। নতুবা তা একক অস্তিত্বশীল হতে পারে না ।

অপরদিকে প্রতিটি সৃষ্ট বিষয়ের অথবা ঐ শ্রেণীর সৃষ্ট বিষয়ের জন্যে একজন করে সৃষ্টিকর্তা থাকার অপরিহার্য অর্থ হল : প্রত্যেক সৃষ্ট বিষয়ই স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল এবং কেবলমাত্র চূড়ান্ত নির্ভরশীলতা,যা স্বীয় সৃষ্টিকর্তায় পৌঁছে,তা ব্যতীত অপর কোন সৃষ্ট বিষয়ের তার কোন প্রয়োজন নেই। আর এ ধরনের নির্ভরশীলতা শুধুমাত্র স্বীয় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট বিষয়সমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

অন্যকথায় : বিশ্বের একাধিক সৃষ্টিকর্তা থাকার অপরিহার্য অর্থ হল একাধিক ও পরস্পর বিরোধী বিন্যাস ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকা। অথচ সৃষ্টির আদি থেকেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড একক বিন্যাস ব্যবস্থায় ও নিয়মানুবর্তিতায় পরিচালিত হচ্ছে। সমসাময়িক সৃষ্টিসমূহ পরস্পর সস্পর্কযুক্ত ও নির্ভরশীল এবং তারা পরস্পরের উপর প্রভাব ফেলে। অনুরূপ পূর্ববর্তী সৃষ্টিসমূহের সাথে উত্তরবর্তী সৃষ্টিসমূহের যেমন সস্পর্ক বিদ্যমান,তেমনি বিদ্যমান সৃষ্টিসমূহের সাথেও ভাবি সৃষ্টিসমূহের সস্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। আবার সকল পূর্ববর্তী সৃষ্টিসমূহই উত্তরবর্তী সৃষ্টিসমূহের আবির্ভাবের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

অতএব এ ধরনের কোন বিশ্ব,যা পরস্পর সস্পর্কযুক্ত ও সুসন্নিবেশিত এবং যা একক বিন্যাসব্যবস্থার অধীন পরিচালিত,তা কখনোই একাধিক অস্তিত্বদাতা কারণের ফলশ্রুতি হতে পারে না ।

অনুরূপ যদি ধারণা করা হয় যে,সকল প্রকার সৃষ্টির জন্যে একই সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান,কিন্তু তাদের তত্তাবধান ও পরিচালনার দায়িত্ব অন্যান্যদের উপর ন্যস্ত,তবে তা-ও সঠিক হতে পারে না। কারণ সকল সৃষ্ট বিষয়ই,তার অস্তিত্বের জন্যে সার্বিকভাবে অস্তিত্বদাতা কারণের উপর নির্ভরশীল-অপর কোন স্বাধীন অস্তিত্বেরই,তার উপর কোন অধিকার বা প্রভাব নেই। তবে কেবলমাত্র ঐ সকল প্রভাবই বিদ্যমান যা কোন এক কারণের কার্যসমূহের (معلومات ) মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। তদুপরি সকল কিছুই অস্তিত্বদাতা কর্তার প্রভাব বলয়ে এবং আধিপত্যের আওতায় অবস্থান করে এবং তাঁরই সুনির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট অনুমতিক্রমে সকল কর্ম সম্পাদিত হয়। আর এ অবস্থায় বর্ণিত তত্তাবধায়কদের কেউই প্রকৃত রাব্ব (رب ) হতে পারে না। কারণ রাব্বের (رب ) স্বরূপ হল স্বীয় আধিপত্যের আওতায় স্বাধীনভাবে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। যদি মনে করা হয় যে,এ ধরনের প্রভাব ও আধিপত্য স্বাধীন নয়;বরং সকলেই সৃষ্টিকর্তার প্রতিপালনের অধীন এবং যে ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক অর্পিত হয় সে ক্ষমতার আলোকে কার্যসম্পাদন করে থাকে। তবে এ ধরনের কোন প্রভুত্ব ও তত্তাবধানের ধারণা,প্রভুত্বের একত্ববাদের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না। অনুরূপ যে সৃজনকর্ম আল্লাহর অনুমতিক্রমে সম্পাদিত হয় বলে মনে করা হয়,তা-ও সৃজনক্ষমতার একত্বের সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না। পবিত্র কোরান ও রেওয়ায়েতসমূহে এ ধরনের অনুচরিত ও পরাধীন সৃষ্টি ও তত্তাবধানের কথা আল্লাহর কোন কোন বান্দাগণের ক্ষেত্রে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন : হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে :

-আর যখন তুমি কাদামাটি দ্বারা আমার অনুমতিক্রমে পাখীসদৃশ আকৃতি গঠন করতে এবং তাতে ফুৎকার দিতে,ফলে আমার অনুমতিক্রমে তা পাখী হয়ে যেত। (সূরা মায়িদাহ্ -১১০) অনুরূপ আরও বলা হয় : -শপথ তাদের যারা সকল কর্ম নির্বাহ করে। (সূরা নাযিয়াত-৫)

উপসংহারে বলা যায়,বিশ্বের জন্যে একাধিক খোদার ধারণা,বস্তগত কারণ ও সহায়ক কারণসমূহকে খোদার সাথে তুলনা করা থেকে রূপ লাভ করেছে এবং একক কার্যের জন্যে তাদের (কারণের) বহুত্বে কোন সমস্যা নেই। অপরদিকে অস্তিত্বদাতা কারণকে এ ধরনের কারণের সাদৃশ্য বলে কল্পনাই করা যায় না এবং কোন একক কার্যের জন্যই একাধিক অস্তিত্বদাতা কারণ বা প্রভু কিংবা স্বাধীন তত্তাবধায়কের ধরণা করা যায় না ।

অতএব এ ধরনের ভুল ধারণার অপসারণের জন্যে,একদিকে অস্তিত্বদাতা কারণের অর্থ ও এ ধরনের কারণত্বের বিশেষত্ব সম্পর্কে সূক্ষ্ণদৃষ্টি দিতে হবে যাতে অবগত হওয়া যায় যে,কোন একক কার্যের জন্যে এক ধরনের কারণত্বের বহুত্ব অসম্ভব। অপরদিকে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সুশৃংখল বিন্যাসব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে যাতে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে,এ ধরনের সুশৃংখল বিন্যাসব্যবস্থা এশাধিক সৃষ্টিকর্তা অথবা এশাধিক স্বাধীন রাব্বের তত্তাবধানে হতে পারে না।

প্রসংগক্রমে স্পষ্ট হয়েছে যে,মহান আল্লাহর কোন কোন বান্দার জন্যে সৃজন ক্ষমতা ও প্রতিপালনত্ব যদি স্বাধীন বা অনির্ভরশীল অর্থে না হয় তবে সুনির্ধারিত বিলায়াত একত্ববাদের সাথে কোন অসঙ্গতি সৃষ্টি করে না । যেমন : মহানবী (সঃ) ও পবিত্র ইমামগণের (আঃ) বিধিগত বিলয়াত(الولایة التشریعة ) মহান আল্লাহর বিধিগত বিলায়াতের সাথে কোন বিরোধ বা অসঙ্গতি সৃষ্টি করেনা। কারণ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই তা অনুমোদিত হয়েছে।

কোরআনের ভাষাগত রূপ আল্লাহর

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে তাঁর নবুওয়াতের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা ও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য আদেশ আসার পূর্বেও তিনি আসমান-যমীনের নিগূঢ় সত্য অবলোকন করতেন। এর বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অতএব , অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে , এ নিগূঢ় সত্যের প্রত্যক্ষকরণ তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছিলো। কিন্তু তাঁকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত করা হলো এবং নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো , তখন তাঁর জন্য বড় সমস্যা ছিলো এই যে , যে মহাসত্য ( ইলমে হুযূরী রূপে অবস্তুগত কোরআন মজীদ) তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলো - যা কোনো কালির হরফে লেখা কিতাব্ ছিলো না (সম্ভবতঃ এ কারণেই - লাওহে মাহ্ফূযে সংরক্ষিত কিতাব্ পাঠের জন্য অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো না বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে নিরক্ষর রেখেছিলেন) , তা মানুষের কাছে প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা তাঁর জানা ছিলো না। তাই আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল ( আঃ) ভাষার আবরণে পর্যায়ক্রমে এ মহাসত্যকে তাঁর মুখে জারী করেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর মুখে এ কোরআন ভাষার আবরণে জারী হলো বটে , কিন্তু এর ভাষা তাঁর নিজের নয়। বিশেষ করে তিনি তৎকালীন আরবের কোনো কবি , সাহিত্যিক , বাগ্মী , বা অলঙ্কারবিদ্যাবিশারদ ছিলেন না ; এমনকি তিনি লিখতে-পড়তেও জানতেন না। অতএব , মানুষের সকল ভাষার মধ্যে প্রকাশক্ষমতার বিচারে শ্রেষ্ঠতম ভাষা আরবী ভাষার এ শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের ভাষা ও বক্তব্য তাঁর নিজের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এ গ্রন্থ যার পক্ষ থেকে তাঁর হৃদয়পটে নাযিল্ হয়েছিলো তথা প্রবেশ করেছিলো তিনি স্বয়ং একে সম্ভাব্য সর্বোত্তমরূপে মানুষের বোধগম্য ভাষায় পরিবর্তিত করে হযরত জিবরাঈল ( আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে ও মন-মগযে গ্রথিত করে দেন এবং তাঁর মুখে অন্যদের নিকট প্রকাশ করেন।

কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে যে সত্য প্রবেশ করেছিলো এবং তিনি যে সত্য অহরহ প্রত্যক্ষ করছিলেন এভাবে মানুষের ভাষার আবরণে প্রকাশের মাধ্যমে কি সে সত্যের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ সম্ভব ছিলো ? বস্তুতঃ শ্রবণ কখনোই প্রত্যক্ষকরণের - শুধু চক্ষু দ্বারা নয় , পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষকরণের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। অভিজ্ঞতার বিবরণ পাঠে কোনোদিনই অভিজ্ঞতা হাছ্বিল হয় না।

তাছাড়া প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষাগত সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ , আরবী ভাষা মানুষের ভাষাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী ভাষা হলেও তা মানুষের ভাষা বৈ নয়। মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিষয়াদির জন্যে কোনো ভাষায়ই যথোপযুক্ত শব্দাবলী ও প্রকাশকৌশল থাকতে পারে না , তা সে ভাষা যতোই না প্রায় সীমাহীন প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী হোক। এমতাবস্থায় , মানুষের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত জগতের সত্যসমূহকে মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের শব্দাবলী ও পরিভাষা সমূহ ব্যবহার করে মোটামুটি এজমালীভাবে প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , ভাষার আবরণে যে কোরআন মজীদ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হলো তা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদের একটি পর্যায়গত ও মাত্রাগত অবতরিত রূপ বৈ নয়। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের দ্বিতীয় দফা নাযিল্ বা মানগত অবতরণ। কোরআন মজীদের এ পর্যায়গত বা মানগত অবতরণ ঘটে সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম রূপে ।

নুযূলের আরো পর্যায়

কিন্তু কোরআন মজীদের নুযূল বা গুণগত অবতরণ এখানেই শেষ নয়। আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর আরো নুযূল দেখতে পাই - যা অবশ্য প্রচলিত পারিভাষিক অর্থে নুযূল্ -এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।

বস্তুতঃ কোনো কিছুকেই তার স্থান , কাল ও প্রেক্ষাপট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো বক্তার বক্তব্য বিভিন্নভাবে শোনা যায় , যেমন : সরাসরি বক্তার সামনে বসে শোনা হয় , বা তার রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যায় , বা সরাসরি শুনেছে এমন কোনো শ্রোতার কাছ থেকে হুবহু শোনা যায় , অথবা মুদ্রিত আকারে পড়া যায়। এর প্রতিটির প্রভাব শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকার ওপর স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে , বক্তা এবং তাঁর বক্তব্যের শ্রোতা বা পাঠকের মাঝে স্থানগত ও কালগত ব্যবধানও এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাবশালী। এ ক্ষেত্রে বক্তা ও লেখক থেকে শ্রোতা ও পাঠকের স্থানগত ও কালগত ব্যবধান যতো বেশী হবে বক্তব্যের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ততোই মাত্রাগত অবনতি ঘটবে। অতএব , এ-ও এক ধরনের নুযূল বা অবতরণ তথা মানগত অবনয়ন বটে , যদিও ঐতিহ্যিকভাবে কোরআন বিশেষজ্ঞগণ এ জন্য নুযূল্ পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। তার চেয়েও বড় কথা , কোরআন মজীদের নুযূলের এ ধরনের পর্যায়সমূহ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পর্যায় থেকে অনেক নীচে বিধায় তা বাঞ্ছিত পর্যায় নয়। সুতরাং কোরআনকে সঠিকভাবে তথা আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত বাঞ্ছিত পর্যায়ে অনুধাবনের জন্য এবং সে লক্ষ্যে স্বীয় অনুধাবনক্ষমতার কাম্য পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা অপরিহার্য কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কোনো বক্তার বক্তব্যের তাৎপর্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্রহণের উপায় কী ? নিঃসন্দেহে এর উপায় হচ্ছে , জ্ঞানগতভাবে শ্রোতাকে বা পাঠককে স্থান , কাল , ভাষা ও পরিবেশগত ব্যবধান সমূহ অতিক্রম করে বক্তার সম্মুখে উপবিষ্ট শ্রোতার পর্যায়ে এবং গুণগতভাবে যতো বেশী সম্ভব বক্তার কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। এ কারণেই , সে যুগের যে সব যথোপযুক্ত ব্যক্তি কোরআন মজীদকে সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে শুনে অনুধাবন করেন সেভাবে বোঝার জন্য এ যুগের মানুষকে অনেক কিছু অধ্যয়ন করে জ্ঞানগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থান-কালে উপনীত হতে হবে এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক মাত্রায় বুঝতে হলে আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে সব ছ্বাহাবী তাঁর সর্বাধিক কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন এ সব দিক থেকে শ্রোতা বা পাঠককে তাঁদের স্তরে উন্নীত হতে হবে।

অন্যদিকে কোনো অনারব ব্যক্তিকে এ পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই তৎকালীন আরবী ভাষা-সাহিত্যের ওপর সে যুগের কবি-সাহিত্যিক-বাগ্মীদের সমপর্যায়ের দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। কোরআন মজীদের পাঠক-পাঠিকা এ সব ক্ষেত্রে যেদিক থেকেই যতোখানি পশ্চাদপদ হবেন সেদিক থেকেই কোরআন মজীদের তাৎপর্য তাঁর নিকট পর্যায়গত দিক থেকে ততোখানি নিম্নতর মাত্রায় প্রকাশিত হবে। এ-ও এক ধরনের নুযূল্ বা অবতরণ , তবে তা বাঞ্ছিত মাত্রা ও পর্যায়ের অবতরণ নয়।

এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ নীচের উদাহরণটি প্রযোজ্য হতে পারে :

অঙ্কশাস্ত্রের একজন ডক্টরেট , একজন মাস্টার ডিগ্রীধারী , একজন গ্রাজুয়েট , একজন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী - এদের প্রত্যেকেই অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাঁদের অঙ্কজ্ঞানের মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডক্টরেটের জ্ঞানের তুলনায় মাস্টার ডিগ্রীধারীর জ্ঞান নিম্নতর ....। অথবা অন্যভাবে বলা যায় , ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে যে অঙ্কজ্ঞান দিয়েছেন - যা লাভ করে ঐ ছাত্র মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেছেন তা মাত্রাগত দিক থেকে ঐ শিক্ষকের সমপর্যায়ের অঙ্কজ্ঞান নয় , বরং পর্যায়গত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নতর। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী পর্যন্ত ক্রমেই নীচে নেমে এসেছে।

এ ব্যাপারে সম্ভবতঃ নিম্নোক্ত উপমাটি অধিকতর উপযোগী :

মানব প্রজাতির ইতিহাসের জ্ঞান বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। কোনো ইতিহাসবিশারদের জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে যতো বেশী হবে ও গুণগত দিক থেকে যতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হবে তাঁর জ্ঞান ততো উচ্চতর স্তরের এবং যার জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়ার বিচারে যতো কম হবে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান অপেক্ষাকৃত ততো নিম্নতর স্তরের হবে।

আমরা সাধারণতঃ মনে করি যে , কোনো জাতির বা সমগ্র মানব প্রজাতির ভাগ্য নির্ধারণে কেবল বড় বড় ব্যক্তিত্ব ও বড় বড় ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয় , বরং একান্তই মামূলী ধরনের মানুষের দৈনন্দিন অরাজনৈতিক কাজ ও ছোট ছোট ঘটনাও ইতিহাসের বড় ধরনের গতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

শুধু মানুষের ভূমিকা নয় , ইতর প্রাণীর ভূমিকা , এমনকি জড় বস্তুর অবস্থাও এ ব্যাপারে প্রভাবশালী হতে পারে। ইতিহাসে এ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। পাথরে আঘাত লেগে ঘোড়ার পা ভেঙ্গে গিয়ে সেনাপতি বা রাজার পড়ে গিয়ে শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার ফলে যুদ্ধের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এমন ঘটনার কথাও জানা যায়। লেডি যোশেফাইনের দুর্ব্যবহার জনিত মানসিক অশান্তি নেপোলিয়ান বোনাপার্টির যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হয়েছিলো বলে জানা যায়। এমনকি বেশী খাওয়া বা কম খাওয়ার প্রতিক্রিয়াও যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের একটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় যে , ফিলিপাইনে একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর ফলে বাংলাদেশে ঝড় হতে পারে। অতএব , কোনো সাধারণ মানুষকে , এমনকি কোনো ইতর প্রাণীকে একটি পিঁপড়ার কামড়ের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণের কারণ হতে পারে। সুতরাং মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে যিনি মানব প্রজাতির সূচনা থেকে শুরু করে মানুষ , প্রাণীকুল , উদ্ভিদ ও জড়পদার্থের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ; এরূপ জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা আলারই রয়েছে।

এবার এমন একজন কাল্পনিক ইতিহাসবিদের কথা ধরা যাক যিনি হযরত আদম ( আঃ)-এর যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন এবং বর্তমান যুগে জ্ঞান আহরণের যে সব অত্যুন্নত উপায়-উপকরণ আছে (যেমন : কৃত্রিম উপগ্রহ , ইন্টারনেট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি) শুরু থেকেই তিনি সে সবের অধিকারী , তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়রূপে বেশী। কিন্তু বলা বাহুল্য যে , এরূপ ইতিহাসজ্ঞানী প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি জড় পদার্থের ভিতর ও বাইরের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। অতএব , মানবপ্রজাতির গোটা ইতিহাস সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের তুলনায় তাঁর জ্ঞান হবে খুবই নিম্ন মানের , যদিও আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে উঁচু মানের।

এখন এ ধরনের কাল্পনিক ইতিহাসবিজ্ঞানী যদি আমাদের যুগের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জ্ঞান দিতে চান তাহলে নিঃসন্দেহে লক্ষ লক্ষ বছরে আহরিত জ্ঞান তাঁকে হুবহু প্রদান করা সম্ভব হবে না , বরং সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন করে এ জ্ঞান দিতে হবে। ধরুন একাধারে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এই দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তি অন্য কোনো কাজে সময় ব্যয় না করে কেবল প্রথমোক্ত ব্যক্তির নিকট থেকে মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে প্রথমোক্ত ব্যক্তির তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। এভাবে এ জ্ঞান পর্যায়ক্রমে সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন হয়ে একটি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রকে মানবপ্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান দেয়া হয় তার অবস্থা চিন্তা করুন। এভাবে প্রতিটি স্তরেই একটি বিষয়ের জ্ঞান পরবর্তী স্তরে স্থানান্তরিত হতে গিয়ে পরিমাণগত , মানগত ও গুণগত দিক থেকে নীচে নেমে আসছে ; একেই বলে জ্ঞানের নুযূল্ ঘটা।

কোরআন মজীদের জ্ঞান স্থানগত , কালগত ও গ্রহণকারীর মানগত দিক থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে যতো দূরে এসেছে ততোই তার মান নীচে নেমেছে। এভাবে তার বিভিন্ন স্তরের অবতরণ বা নিম্নগমন (নুযূল) ঘটেছে। আর , আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআনের জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন জ্ঞানে এবং আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে জ্ঞানগত ও মানগত দিক থেকে নিজেকে যতোই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবেন ততোই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কোরআন-জ্ঞান ও তাঁর কোরআন-জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে। শুধু তা-ই নয় , পরবর্তীকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ হওয়ার ফলে স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর মজলিসে হাযির থেকে কোরআন শ্রবণকারীদেরও অনেকের তুলনায় ঐ ব্যক্তির কোরআন-জ্ঞান বেশী হবে। অবশ্য যারা আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে ইলহামের অধিকারী হয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছেন - তা তাঁরা যে যুগেরই হোন না কেন , তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

সাত যাহের্ ও সাত বাত্বেন্

একই প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে , কোরআন বিষয়ক পণ্ডিতগণ ও মুফাসসিরগণের অনেকের অভিমত অনুযায়ী , কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য ও সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রথম যাহেরী তাৎপর্য হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে সর্বজনীনভাবে কোরআন মজীদ থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হতো তা-ই। কিন্তু কোরআন মজীদ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এ থেকে আরো বহু বাহ্যিক তাৎপর্য বেরিয়ে এসেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সে সব তাৎপর্য এমনই বিস্ময়কর যা অতীতে কল্পনাও করা যেতো না। উদাহরণস্বরূপ , সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর 261 নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) مثل الذين ينفقون اموالهم فی سبيل الله کمثل حبة انبتت سبع سنابل فی کل سنبلة مائة حبة. و الله يضاعف لمن يشاء. و الله واسع عليم( .

যারা আল্লাহর পথে তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাদের (এ কাজের) উপমা হচ্ছে , যেন একটি শস্যদানায় সাতটি শীষ উদ্গত হলো - যার প্রতিটি শীষে একশ টি করে দানা হলো। আর আল্লাহ্ যাকে চান বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ্ অসীম উদার ও সদাজ্ঞানময়।

বলা বাহুল্য যে , এ আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে যা আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্য (যাহের্) থেকে সুস্পষ্ট। কিন্তু একই সাথে এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যেই একটি তথ্য ও একটি ভবিষ্যদ্বাণীও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তা হচ্ছে , একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হবে।

উক্ত আয়াত থেকে যে আমরা এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করছি তার কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় অসম্ভব এমন কিছুর উপমা দেবেন - তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের কৃষিব্যবস্থায় একটি ধান বা গম অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় শস্য থেকে সাতশ দানা উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিলো অকল্পনীয় , কিন্তু সে যুগেও একটি ফলের বীজ থেকে গজানো গাছে শুধু এক বার নয় , বরং প্রতি বছর সাতশ বা তার বেশী ফলের উৎপাদন অসম্ভব ছিলো না। আরব দেশে উৎপন্ন খেজুর ছিলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমতাবস্থায় যদি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হতো শুধু আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা তাহলে এ ক্ষেত্রে ফলের বীজের উদাহরণই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা দানা জাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর পিছনে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে ; হয়তো বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে , তবে অন্ততঃ উপরোক্ত তথ্য বা ভবিষ্যদ্বাণী যে তার অন্যতম উদ্দেশ্য তাতে সন্দেহ নেই ।

অবশ্য কোরআন মজীদের নাযিলের যুগের পাঠক-পাঠিকাগণ উক্ত আয়াতের প্রথম যাহের্ বা প্রথম বাহ্যিক তাৎপর্য নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের নিকট হয়তো এটি এ আয়াতের একমাত্র বাহ্যিক তাৎপর্য বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান যুগে ধান ও গমের বহু উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই একটি দানা থেকে সাতশ দানা বা তার বেশী উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে , এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যে শুধু আল্লাহর পথে দানের শুভ প্রতিফলই বর্ণনা করা হয় নি , বরং একটি বাস্তবতা সম্পর্কে তথ্য ও ভবিষ্যদ্বাণীও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য রয়েছে বলে অনেক কোরআন-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও মুফাসসির মনে করেন।

একইভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। যেমন : সমগ্র কোরআন মজীদের অন্যতম বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিলোক অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শুরু করে সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টিলোক এবং এর সকল কর্মকাণ্ড। কোরআন মজীদ তার নিজের ভাষায়تبيانا لکل شيء (সকল কিছুর সুবর্ণনা) - এ থেকে তা-ই বুঝা যায়। কারণ ,کل شيء (প্রতিটি জিনিস) বলতে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাকী থাকে না।

অবশ্য এ হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের অবস্থা এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে যা কিছু ঘটেছে ও কোরআন মজীদ নাযিল্-কালে যা কিছু অনিবার্যভাবে ও শর্তাধীনে ঘটিতব্য ছিলো তার সবই তাতে নিহিত ছিলো ও রয়েছে , আর ঘটিতব্যগুলো পরবর্তীকালে ঘটেছে ও অবশ্যই ঘটবে। এ কারণেই লাওহে মাহ্ফূয্ তথা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদ হচ্ছে কিতাবুম্ মুবীন (সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ)। আর আমাদের কাছে যে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন রয়েছে তা হচ্ছে উক্ত কোরআনেরই নুযূলপ্রাপ্ত (অবতরণকৃত তথা মানগত দিক থেকে নীচে নেমে আসা) রূপ।

কোরআন মজীদের আরেক বাত্বেন হলেন স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)। কারণ , তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত রূপ। এর মানে শুধু এ নয় যে , কোরআন পাঠ করলে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর চরিত্র ও জীবনধারা জানা যাবে , বরং এর মানে হচ্ছে , সমগ্র কোরআন মজীদে তিনি প্রতিফলিত। ফলে যিনি কোরআন মজীদের সাথে পরিচিত হলেন তিনি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সাথেই পরিচিত হলেন এবং কোরআন মজীদকে যতোটুকু জানলেন স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে ততোটুকু জানতে পারলেন।

অবশ্য কারো যেন এরূপ ধারণা না হয় যে , হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর দৈনন্দিন পার্থিব জীবন অর্থাৎ তিনি কোনদিন কখন কী খেলেন , কখন ঘুমালেন , কখন কোথায় গেলেন ইত্যাদি কোরআন মজীদের গভীর অধ্যয়ন থেকে বিস্তারিত ও পুরোপুরি জানা যাবে। কারণ , মানুষকে এ সব বিষয় জানানো ঐশী কালামের উদ্দেশ্য হতে পারে না , বরং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে ছোট-বড় এবং গ্রহণীয়-বর্জনীয় যা কিছু শিক্ষণীয় ছিলো তার সবই কোরআন মজীদ থেকে জানা যাবে। আর হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) , অন্যান্য নবী-রাসূল ( আঃ) , এমনকি কাফের-মোশরেবকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব ঘটনা কোরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে সে সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে সবে নিহিত শিক্ষা পৌঁছে দেয়া।

লাওহে মাহ্ফূযে ও স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদে সকল কিছুর বর্ণনা এভাবেই নিহিত রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান ও কোরআন মজীদের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকে সকল কিছু খুটিনাটি সহ সব কিছুই , প্রতিটি সৃষ্টির প্রতিটি কর্ম , এমনকি যার মধ্যে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় কিছু নেই তা সহ , আল্লাহর জ্ঞানে প্রতিফলিত। কিন্তু কোরআন মজীদে অর্থাৎ লাওহে মাহ্ফূযে বা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় কেবল করণীয় ও বর্জনীয় এবং মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি-অবনতিতে প্রভাব বিস্তারক বিষয়াদির জ্ঞান ও তদসম্বলিত ঘটনাবলী নিহিত রাখা হয়েছে বলে মনে হয় (নিশ্চিত জ্ঞান স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার কাছে)।

কোরআন মজীদের গভীরতম বাত্বেন্ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা। কারণ , কোরআন মজীদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্ তা আলা কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন। অতএব , তাঁর পক্ষে মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বরং কেবল তাঁর গুণাবলী ও তাঁর কাজের মাধ্যমে তাঁকে জানা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কাজের সাথে যিনি যতো বেশী পরিচিত তিনি ততো বেশী মাত্রায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার সাথে পরিচিত।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে সৃষ্টির মাধ্যমে , সমগ্র সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির মাধ্যমে ও লাওহে মাহ্ফূযে বা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যার নুযূলপ্রাপ্ত বা মানের অবতরণকৃত রূপ হচ্ছে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন।

অতএব , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার মহান সত্তার অস্তিত্বের তাজাল্লী - তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন। অর্থাৎ কোরআন মজীদে যা কিছু আছে তার সব কিছু মিলে এক মহাসত্যের সাক্ষ্য বহন করছে , সে মহাসত্য হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা।

কোরআনের ভাষাগত রূপ আল্লাহর

বিভিন্ন সূত্রের বর্ণনা অনুযায়ী , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে তাঁর নবুওয়াতের বিষয় আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করা ও নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য আদেশ আসার পূর্বেও তিনি আসমান-যমীনের নিগূঢ় সত্য অবলোকন করতেন। এর বহু ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। অতএব , অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে , এ নিগূঢ় সত্যের প্রত্যক্ষকরণ তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছিলো। কিন্তু তাঁকে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য অভিষিক্ত করা হলো এবং নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো , তখন তাঁর জন্য বড় সমস্যা ছিলো এই যে , যে মহাসত্য ( ইলমে হুযূরী রূপে অবস্তুগত কোরআন মজীদ) তাঁর হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলো - যা কোনো কালির হরফে লেখা কিতাব্ ছিলো না (সম্ভবতঃ এ কারণেই - লাওহে মাহ্ফূযে সংরক্ষিত কিতাব্ পাঠের জন্য অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো না বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাঁকে নিরক্ষর রেখেছিলেন) , তা মানুষের কাছে প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা তাঁর জানা ছিলো না। তাই আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল ( আঃ) ভাষার আবরণে পর্যায়ক্রমে এ মহাসত্যকে তাঁর মুখে জারী করেন।

হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর মুখে এ কোরআন ভাষার আবরণে জারী হলো বটে , কিন্তু এর ভাষা তাঁর নিজের নয়। বিশেষ করে তিনি তৎকালীন আরবের কোনো কবি , সাহিত্যিক , বাগ্মী , বা অলঙ্কারবিদ্যাবিশারদ ছিলেন না ; এমনকি তিনি লিখতে-পড়তেও জানতেন না। অতএব , মানুষের সকল ভাষার মধ্যে প্রকাশক্ষমতার বিচারে শ্রেষ্ঠতম ভাষা আরবী ভাষার এ শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থের ভাষা ও বক্তব্য তাঁর নিজের হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এ গ্রন্থ যার পক্ষ থেকে তাঁর হৃদয়পটে নাযিল্ হয়েছিলো তথা প্রবেশ করেছিলো তিনি স্বয়ং একে সম্ভাব্য সর্বোত্তমরূপে মানুষের বোধগম্য ভাষায় পরিবর্তিত করে হযরত জিবরাঈল ( আঃ)-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে ও মন-মগযে গ্রথিত করে দেন এবং তাঁর মুখে অন্যদের নিকট প্রকাশ করেন।

কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়ে যে সত্য প্রবেশ করেছিলো এবং তিনি যে সত্য অহরহ প্রত্যক্ষ করছিলেন এভাবে মানুষের ভাষার আবরণে প্রকাশের মাধ্যমে কি সে সত্যের পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ সম্ভব ছিলো ? বস্তুতঃ শ্রবণ কখনোই প্রত্যক্ষকরণের - শুধু চক্ষু দ্বারা নয় , পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষকরণের পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না। অভিজ্ঞতার বিবরণ পাঠে কোনোদিনই অভিজ্ঞতা হাছ্বিল হয় না।

তাছাড়া প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষাগত সীমাবদ্ধতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ , আরবী ভাষা মানুষের ভাষাসমূহের মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী ভাষা হলেও তা মানুষের ভাষা বৈ নয়। মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বহির্ভূত বিষয়াদির জন্যে কোনো ভাষায়ই যথোপযুক্ত শব্দাবলী ও প্রকাশকৌশল থাকতে পারে না , তা সে ভাষা যতোই না প্রায় সীমাহীন প্রকাশসম্ভাবনার অধিকারী হোক। এমতাবস্থায় , মানুষের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত জগতের সত্যসমূহকে মানুষের অভিজ্ঞতার জগতের শব্দাবলী ও পরিভাষা সমূহ ব্যবহার করে মোটামুটি এজমালীভাবে প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , ভাষার আবরণে যে কোরআন মজীদ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হলো তা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর হৃদয়স্থ কোরআন মজীদের একটি পর্যায়গত ও মাত্রাগত অবতরিত রূপ বৈ নয়। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের দ্বিতীয় দফা নাযিল্ বা মানগত অবতরণ। কোরআন মজীদের এ পর্যায়গত বা মানগত অবতরণ ঘটে সাধারণ মানুষের জন্য সম্ভাব্য সর্বোত্তম রূপে ।

নুযূলের আরো পর্যায়

কিন্তু কোরআন মজীদের নুযূল বা গুণগত অবতরণ এখানেই শেষ নয়। আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এর আরো নুযূল দেখতে পাই - যা অবশ্য প্রচলিত পারিভাষিক অর্থে নুযূল্ -এ অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি।

বস্তুতঃ কোনো কিছুকেই তার স্থান , কাল ও প্রেক্ষাপট থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো বক্তার বক্তব্য বিভিন্নভাবে শোনা যায় , যেমন : সরাসরি বক্তার সামনে বসে শোনা হয় , বা তার রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যায় , বা সরাসরি শুনেছে এমন কোনো শ্রোতার কাছ থেকে হুবহু শোনা যায় , অথবা মুদ্রিত আকারে পড়া যায়। এর প্রতিটির প্রভাব শ্রোতা বা পাঠক-পাঠিকার ওপর স্বতন্ত্র। অনুরূপভাবে , বক্তা এবং তাঁর বক্তব্যের শ্রোতা বা পাঠকের মাঝে স্থানগত ও কালগত ব্যবধানও এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাবশালী। এ ক্ষেত্রে বক্তা ও লেখক থেকে শ্রোতা ও পাঠকের স্থানগত ও কালগত ব্যবধান যতো বেশী হবে বক্তব্যের তাৎপর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ততোই মাত্রাগত অবনতি ঘটবে। অতএব , এ-ও এক ধরনের নুযূল বা অবতরণ তথা মানগত অবনয়ন বটে , যদিও ঐতিহ্যিকভাবে কোরআন বিশেষজ্ঞগণ এ জন্য নুযূল্ পরিভাষা ব্যবহার করেন নি। তার চেয়েও বড় কথা , কোরআন মজীদের নুযূলের এ ধরনের পর্যায়সমূহ আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পর্যায় থেকে অনেক নীচে বিধায় তা বাঞ্ছিত পর্যায় নয়। সুতরাং কোরআনকে সঠিকভাবে তথা আল্লাহ্ তা আলার নাযিলকৃত বাঞ্ছিত পর্যায়ে অনুধাবনের জন্য এবং সে লক্ষ্যে স্বীয় অনুধাবনক্ষমতার কাম্য পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করা অপরিহার্য কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে , কোনো বক্তার বক্তব্যের তাৎপর্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রায় গ্রহণের উপায় কী ? নিঃসন্দেহে এর উপায় হচ্ছে , জ্ঞানগতভাবে শ্রোতাকে বা পাঠককে স্থান , কাল , ভাষা ও পরিবেশগত ব্যবধান সমূহ অতিক্রম করে বক্তার সম্মুখে উপবিষ্ট শ্রোতার পর্যায়ে এবং গুণগতভাবে যতো বেশী সম্ভব বক্তার কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হতে হবে। এ কারণেই , সে যুগের যে সব যথোপযুক্ত ব্যক্তি কোরআন মজীদকে সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছ থেকে শুনে অনুধাবন করেন সেভাবে বোঝার জন্য এ যুগের মানুষকে অনেক কিছু অধ্যয়ন করে জ্ঞানগত দিক থেকে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর স্থান-কালে উপনীত হতে হবে এবং সম্ভাব্য সর্বাধিক মাত্রায় বুঝতে হলে আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে যে সব ছ্বাহাবী তাঁর সর্বাধিক কাছাকাছি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন এ সব দিক থেকে শ্রোতা বা পাঠককে তাঁদের স্তরে উন্নীত হতে হবে।

অন্যদিকে কোনো অনারব ব্যক্তিকে এ পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে তাঁকে অবশ্যই তৎকালীন আরবী ভাষা-সাহিত্যের ওপর সে যুগের কবি-সাহিত্যিক-বাগ্মীদের সমপর্যায়ের দক্ষতার অধিকারী হতে হবে। কোরআন মজীদের পাঠক-পাঠিকা এ সব ক্ষেত্রে যেদিক থেকেই যতোখানি পশ্চাদপদ হবেন সেদিক থেকেই কোরআন মজীদের তাৎপর্য তাঁর নিকট পর্যায়গত দিক থেকে ততোখানি নিম্নতর মাত্রায় প্রকাশিত হবে। এ-ও এক ধরনের নুযূল্ বা অবতরণ , তবে তা বাঞ্ছিত মাত্রা ও পর্যায়ের অবতরণ নয়।

এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ নীচের উদাহরণটি প্রযোজ্য হতে পারে :

অঙ্কশাস্ত্রের একজন ডক্টরেট , একজন মাস্টার ডিগ্রীধারী , একজন গ্রাজুয়েট , একজন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী - এদের প্রত্যেকেই অঙ্কশাস্ত্রের জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাঁদের অঙ্কজ্ঞানের মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ডক্টরেটের জ্ঞানের তুলনায় মাস্টার ডিগ্রীধারীর জ্ঞান নিম্নতর ....। অথবা অন্যভাবে বলা যায় , ডক্টরেট ডিগ্রীধারী শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে যে অঙ্কজ্ঞান দিয়েছেন - যা লাভ করে ঐ ছাত্র মাস্টার ডিগ্রী লাভ করেছেন তা মাত্রাগত দিক থেকে ঐ শিক্ষকের সমপর্যায়ের অঙ্কজ্ঞান নয় , বরং পর্যায়গত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত নিম্নতর। এভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী পর্যন্ত ক্রমেই নীচে নেমে এসেছে।

এ ব্যাপারে সম্ভবতঃ নিম্নোক্ত উপমাটি অধিকতর উপযোগী :

মানব প্রজাতির ইতিহাসের জ্ঞান বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। কোনো ইতিহাসবিশারদের জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে যতো বেশী হবে ও গুণগত দিক থেকে যতো সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হবে তাঁর জ্ঞান ততো উচ্চতর স্তরের এবং যার জ্ঞান পরিমাণগত দিক থেকে ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হওয়ার বিচারে যতো কম হবে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান অপেক্ষাকৃত ততো নিম্নতর স্তরের হবে।

আমরা সাধারণতঃ মনে করি যে , কোনো জাতির বা সমগ্র মানব প্রজাতির ভাগ্য নির্ধারণে কেবল বড় বড় ব্যক্তিত্ব ও বড় বড় ঘটনা প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তা নয় , বরং একান্তই মামূলী ধরনের মানুষের দৈনন্দিন অরাজনৈতিক কাজ ও ছোট ছোট ঘটনাও ইতিহাসের বড় ধরনের গতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

শুধু মানুষের ভূমিকা নয় , ইতর প্রাণীর ভূমিকা , এমনকি জড় বস্তুর অবস্থাও এ ব্যাপারে প্রভাবশালী হতে পারে। ইতিহাসে এ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে। পাথরে আঘাত লেগে ঘোড়ার পা ভেঙ্গে গিয়ে সেনাপতি বা রাজার পড়ে গিয়ে শত্রুর হাতে বন্দী হওয়ার ফলে যুদ্ধের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছে এমন ঘটনার কথাও জানা যায়। লেডি যোশেফাইনের দুর্ব্যবহার জনিত মানসিক অশান্তি নেপোলিয়ান বোনাপার্টির যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হয়েছিলো বলে জানা যায়। এমনকি বেশী খাওয়া বা কম খাওয়ার প্রতিক্রিয়াও যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ হতে পারে। সাম্প্রতিক কালের একটি বৈজ্ঞানিক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয় যে , ফিলিপাইনে একটি প্রজাপতির পাখা ঝাপটানোর ফলে বাংলাদেশে ঝড় হতে পারে। অতএব , কোনো সাধারণ মানুষকে , এমনকি কোনো ইতর প্রাণীকে একটি পিঁপড়ার কামড়ের প্রতিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণের কারণ হতে পারে। সুতরাং মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে যিনি মানব প্রজাতির সূচনা থেকে শুরু করে মানুষ , প্রাণীকুল , উদ্ভিদ ও জড়পদার্থের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী ; এরূপ জ্ঞান কেবল আল্লাহ্ তা আলারই রয়েছে।

এবার এমন একজন কাল্পনিক ইতিহাসবিদের কথা ধরা যাক যিনি হযরত আদম ( আঃ)-এর যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বেঁচে আছেন এবং বর্তমান যুগে জ্ঞান আহরণের যে সব অত্যুন্নত উপায়-উপকরণ আছে (যেমন : কৃত্রিম উপগ্রহ , ইন্টারনেট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি) শুরু থেকেই তিনি সে সবের অধিকারী , তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়রূপে বেশী। কিন্তু বলা বাহুল্য যে , এরূপ ইতিহাসজ্ঞানী প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি জড় পদার্থের ভিতর ও বাইরের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। অতএব , মানবপ্রজাতির গোটা ইতিহাস সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞানের তুলনায় তাঁর জ্ঞান হবে খুবই নিম্ন মানের , যদিও আমাদের ইতিহাসজ্ঞানের তুলনায় অকল্পনীয়ভাবে উঁচু মানের।

এখন এ ধরনের কাল্পনিক ইতিহাসবিজ্ঞানী যদি আমাদের যুগের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর জ্ঞান দিতে চান তাহলে নিঃসন্দেহে লক্ষ লক্ষ বছরে আহরিত জ্ঞান তাঁকে হুবহু প্রদান করা সম্ভব হবে না , বরং সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন করে এ জ্ঞান দিতে হবে। ধরুন একাধারে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে এই দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তি অন্য কোনো কাজে সময় ব্যয় না করে কেবল প্রথমোক্ত ব্যক্তির নিকট থেকে মানব প্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাসজ্ঞান হবে প্রথমোক্ত ব্যক্তির তুলনায় নিম্নতর পর্যায়ের। এভাবে এ জ্ঞান পর্যায়ক্রমে সংক্ষেপণ ও সঙ্কোচন হয়ে একটি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রকে মানবপ্রজাতির ইতিহাস সম্বন্ধে যে জ্ঞান দেয়া হয় তার অবস্থা চিন্তা করুন। এভাবে প্রতিটি স্তরেই একটি বিষয়ের জ্ঞান পরবর্তী স্তরে স্থানান্তরিত হতে গিয়ে পরিমাণগত , মানগত ও গুণগত দিক থেকে নীচে নেমে আসছে ; একেই বলে জ্ঞানের নুযূল্ ঘটা।

কোরআন মজীদের জ্ঞান স্থানগত , কালগত ও গ্রহণকারীর মানগত দিক থেকে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ) থেকে যতো দূরে এসেছে ততোই তার মান নীচে নেমেছে। এভাবে তার বিভিন্ন স্তরের অবতরণ বা নিম্নগমন (নুযূল) ঘটেছে। আর , আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , কোরআনের জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক বিভিন্ন জ্ঞানে এবং আত্মিক , নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলীতে সজ্জিত হয়ে জ্ঞানগত ও মানগত দিক থেকে নিজেকে যতোই হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারবেন ততোই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর কোরআন-জ্ঞান ও তাঁর কোরআন-জ্ঞানের মধ্যে ব্যবধান কমে আসবে। শুধু তা-ই নয় , পরবর্তীকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ হওয়ার ফলে স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর মজলিসে হাযির থেকে কোরআন শ্রবণকারীদেরও অনেকের তুলনায় ঐ ব্যক্তির কোরআন-জ্ঞান বেশী হবে। অবশ্য যারা আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে ইলহামের অধিকারী হয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেছেন - তা তাঁরা যে যুগেরই হোন না কেন , তাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

সাত যাহের্ ও সাত বাত্বেন্

একই প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে , কোরআন বিষয়ক পণ্ডিতগণ ও মুফাসসিরগণের অনেকের অভিমত অনুযায়ী , কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য ও সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে। এর প্রথম যাহেরী তাৎপর্য হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর যুগে সর্বজনীনভাবে কোরআন মজীদ থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করা হতো তা-ই। কিন্তু কোরআন মজীদ নিয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণার ফলে এ থেকে আরো বহু বাহ্যিক তাৎপর্য বেরিয়ে এসেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সে সব তাৎপর্য এমনই বিস্ময়কর যা অতীতে কল্পনাও করা যেতো না। উদাহরণস্বরূপ , সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর 261 নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

) مثل الذين ينفقون اموالهم فی سبيل الله کمثل حبة انبتت سبع سنابل فی کل سنبلة مائة حبة. و الله يضاعف لمن يشاء. و الله واسع عليم( .

যারা আল্লাহর পথে তাদের ধনসম্পদ ব্যয় করে তাদের (এ কাজের) উপমা হচ্ছে , যেন একটি শস্যদানায় সাতটি শীষ উদ্গত হলো - যার প্রতিটি শীষে একশ টি করে দানা হলো। আর আল্লাহ্ যাকে চান বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ্ অসীম উদার ও সদাজ্ঞানময়।

বলা বাহুল্য যে , এ আয়াতে আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে যা আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্য (যাহের্) থেকে সুস্পষ্ট। কিন্তু একই সাথে এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যেই একটি তথ্য ও একটি ভবিষ্যদ্বাণীও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। তা হচ্ছে , একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন একটি শস্যদানা থেকে সাতশ বা তার বেশী শস্যদানা উৎপন্ন হবে।

উক্ত আয়াত থেকে যে আমরা এরূপ তাৎপর্য গ্রহণ করছি তার কারণ এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় অসম্ভব এমন কিছুর উপমা দেবেন - তাঁর সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে , কোরআন মজীদ নাযিলের যুগের কৃষিব্যবস্থায় একটি ধান বা গম অথবা অন্য কোনো দানা জাতীয় শস্য থেকে সাতশ দানা উৎপন্ন হওয়ার বিষয়টি ছিলো অকল্পনীয় , কিন্তু সে যুগেও একটি ফলের বীজ থেকে গজানো গাছে শুধু এক বার নয় , বরং প্রতি বছর সাতশ বা তার বেশী ফলের উৎপাদন অসম্ভব ছিলো না। আরব দেশে উৎপন্ন খেজুর ছিলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এমতাবস্থায় যদি উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হতো শুধু আল্লাহর পথে ব্যয়ের শুভ প্রতিফল বর্ণনা করা তাহলে এ ক্ষেত্রে ফলের বীজের উদাহরণই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা দানা জাতীয় শস্যের উদাহরণ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এর পিছনে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে ; হয়তো বা একাধিক বিশেষ উদ্দেশ্যও থাকতে পারে , তবে অন্ততঃ উপরোক্ত তথ্য বা ভবিষ্যদ্বাণী যে তার অন্যতম উদ্দেশ্য তাতে সন্দেহ নেই ।

অবশ্য কোরআন মজীদের নাযিলের যুগের পাঠক-পাঠিকাগণ উক্ত আয়াতের প্রথম যাহের্ বা প্রথম বাহ্যিক তাৎপর্য নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাঁদের নিকট হয়তো এটি এ আয়াতের একমাত্র বাহ্যিক তাৎপর্য বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমান যুগে ধান ও গমের বহু উচ্চফলনশীল জাত আবিষ্কৃত হওয়ায় ইতিমধ্যেই একটি দানা থেকে সাতশ দানা বা তার বেশী উৎপন্ন হচ্ছে। ফলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে , এ আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্যে শুধু আল্লাহর পথে দানের শুভ প্রতিফলই বর্ণনা করা হয় নি , বরং একটি বাস্তবতা সম্পর্কে তথ্য ও ভবিষ্যদ্বাণীও এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি যাহের্ বা বাহ্যিক তাৎপর্য রয়েছে বলে অনেক কোরআন-বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত ও মুফাসসির মনে করেন।

একইভাবে কোরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের , প্রতিটি সূরাহর ও সামগ্রিকভাবে পুরো কোরআন মজীদের সাতটি বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। যেমন : সমগ্র কোরআন মজীদের অন্যতম বাত্বেন্ বা গূঢ় তাৎপর্য হচ্ছে সমগ্র সৃষ্টিলোক অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শুরু করে সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র সৃষ্টিলোক এবং এর সকল কর্মকাণ্ড। কোরআন মজীদ তার নিজের ভাষায়تبيانا لکل شيء (সকল কিছুর সুবর্ণনা) - এ থেকে তা-ই বুঝা যায়। কারণ ,کل شيء (প্রতিটি জিনিস) বলতে ছোট-বড় কোনো কিছুই বাকী থাকে না।

অবশ্য এ হচ্ছে হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের অবস্থা এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে যা কিছু ঘটেছে ও কোরআন মজীদ নাযিল্-কালে যা কিছু অনিবার্যভাবে ও শর্তাধীনে ঘটিতব্য ছিলো তার সবই তাতে নিহিত ছিলো ও রয়েছে , আর ঘটিতব্যগুলো পরবর্তীকালে ঘটেছে ও অবশ্যই ঘটবে। এ কারণেই লাওহে মাহ্ফূয্ তথা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদ হচ্ছে কিতাবুম্ মুবীন (সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ)। আর আমাদের কাছে যে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন রয়েছে তা হচ্ছে উক্ত কোরআনেরই নুযূলপ্রাপ্ত (অবতরণকৃত তথা মানগত দিক থেকে নীচে নেমে আসা) রূপ।

কোরআন মজীদের আরেক বাত্বেন হলেন স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)। কারণ , তিনি ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত রূপ। এর মানে শুধু এ নয় যে , কোরআন পাঠ করলে রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর চরিত্র ও জীবনধারা জানা যাবে , বরং এর মানে হচ্ছে , সমগ্র কোরআন মজীদে তিনি প্রতিফলিত। ফলে যিনি কোরআন মজীদের সাথে পরিচিত হলেন তিনি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সাথেই পরিচিত হলেন এবং কোরআন মজীদকে যতোটুকু জানলেন স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)কে ততোটুকু জানতে পারলেন।

অবশ্য কারো যেন এরূপ ধারণা না হয় যে , হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর দৈনন্দিন পার্থিব জীবন অর্থাৎ তিনি কোনদিন কখন কী খেলেন , কখন ঘুমালেন , কখন কোথায় গেলেন ইত্যাদি কোরআন মজীদের গভীর অধ্যয়ন থেকে বিস্তারিত ও পুরোপুরি জানা যাবে। কারণ , মানুষকে এ সব বিষয় জানানো ঐশী কালামের উদ্দেশ্য হতে পারে না , বরং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে ছোট-বড় এবং গ্রহণীয়-বর্জনীয় যা কিছু শিক্ষণীয় ছিলো তার সবই কোরআন মজীদ থেকে জানা যাবে। আর হযরত নবী করীম (ছ্বাঃ) , অন্যান্য নবী-রাসূল ( আঃ) , এমনকি কাফের-মোশরেবকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব ঘটনা কোরআন মজীদে বর্ণনা করা হয়েছে সে সবের উদ্দেশ্য হচ্ছে সে সবে নিহিত শিক্ষা পৌঁছে দেয়া।

লাওহে মাহ্ফূযে ও স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদে সকল কিছুর বর্ণনা এভাবেই নিহিত রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার জ্ঞান ও কোরআন মজীদের জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকে সকল কিছু খুটিনাটি সহ সব কিছুই , প্রতিটি সৃষ্টির প্রতিটি কর্ম , এমনকি যার মধ্যে মানুষের জন্য শিক্ষণীয় কিছু নেই তা সহ , আল্লাহর জ্ঞানে প্রতিফলিত। কিন্তু কোরআন মজীদে অর্থাৎ লাওহে মাহ্ফূযে বা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় কেবল করণীয় ও বর্জনীয় এবং মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি-অবনতিতে প্রভাব বিস্তারক বিষয়াদির জ্ঞান ও তদসম্বলিত ঘটনাবলী নিহিত রাখা হয়েছে বলে মনে হয় (নিশ্চিত জ্ঞান স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার কাছে)।

কোরআন মজীদের গভীরতম বাত্বেন্ হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা। কারণ , কোরআন মজীদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে মানুষের কাছে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ্ তা আলা কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা নন। অতএব , তাঁর পক্ষে মানুষের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যভাবে নিজেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বরং কেবল তাঁর গুণাবলী ও তাঁর কাজের মাধ্যমে তাঁকে জানা যেতে পারে। আল্লাহ্ তা আলার গুণাবলী ও কাজের সাথে যিনি যতো বেশী পরিচিত তিনি ততো বেশী মাত্রায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলার সাথে পরিচিত।

আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম্ (ছ্বাঃ)কে সৃষ্টির মাধ্যমে , সমগ্র সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির মাধ্যমে ও লাওহে মাহ্ফূযে বা নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর সত্তায় নিহিত কোরআন মজীদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন যার নুযূলপ্রাপ্ত বা মানের অবতরণকৃত রূপ হচ্ছে পঠনীয় ও শ্রবণীয় কোরআন।

অতএব , কোরআন মজীদ হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার মহান সত্তার অস্তিত্বের তাজাল্লী - তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন। অর্থাৎ কোরআন মজীদে যা কিছু আছে তার সব কিছু মিলে এক মহাসত্যের সাক্ষ্য বহন করছে , সে মহাসত্য হলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14