মানুষের এখ্তিয়ারের সাথে ক্বাযা ও ক্বাদারের সস্পর্ক
ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে,প্রত্যক্ষ ক্বাযা ও ক্বাদারের প্রতি বিশ্বাসের দাবি হল এই যে,সৃষ্টবিষয়ের অস্তিত্বকে,সৃষ্টির শুরু থেকে বিকাশকাল পর্যন্ত ও তৎপর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত,এমনকি দূরবর্তী প্রারম্ভিকার যোগান কালকেও প্রজ্ঞাবান প্রভুর জ্ঞানাধীন বলে বিশ্বাস করা। তেমনি সৃষ্টির শর্তসমূহের যোগান ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাকে প্রভুর ইচ্ছা বা ইরাদা সংশ্লিষ্ট বলে গণনা করা।
অন্যকথায় : সব কিছুরই অস্তিত্ব খোদার অনুমতি ও সুনির্ধারিত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল এবং তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন কিছুই অস্তিত্বের ময়দানে পা ফেলতে পারেনা। তেমনি সব কিছুই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদির ও ক্বাযার উপর নির্ভরশীল,যা ব্যতীত কোন অস্তিত্বশীলই স্বীয় আয়াতন,আকৃতি ও বিশেষত্ব প্রাপ্ত হয় না ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে না। এ সম্পর্কের বর্ণনা ও এর স্বপক্ষে সাক্ষ্যপ্রদান হল প্রকৃতপক্ষে‘
স্বাধীন প্রভাব’অর্থে তাওহীদেরই শিক্ষা,যা হল একত্ববাদের সর্বোচ্চস্তর এবং যা মানব সম্প্রদায়ের আত্মোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে -যেমনটি ইতিপূর্বে আমরা ইঙ্গিত করেছি।
বিষয়বস্তুর সংঘটন প্রভুর অনুমতি এবং তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল এর প্রমাণ অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য ও সহজবোধ্য। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায় এবং প্রভুর ক্বাযায় এর নিশ্চিত নির্ধারণের সাক্ষ্য, দুস্প্রাপ্যতার কারণে অধিকতর আলোচনা ও পর্যালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ এ ধরনের বিশ্বাসের সাথে,‘
আপন ভাগ্যলিপির পরিবর্তনে মানুষের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা’বা‘
এখতিয়ারের’স্বীকৃতির সমন্বয় খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এর ফলেই এক শ্রেণীর মোতাকাল্লেমিন (আশায়েরী) যারা মানুষের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রভুর ক্বাযাকে স্বীকার করেছিলেন,তারা জাবরবাদের দিকে ঝুকে পড়েছিলেন। আবার অপর এক শ্রেণীর মোতাকাল্লেমিন (মো’তাযেলী) যারা জাবর ও এর শোচনীয় পরিণতিকে গ্রহণ করতে পারেননি,তারা মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডকে প্রভুর ক্বাযার অন্তর্ভুক্ত বলে মেনে নেননি। উভয়দলই নিজেদের মতের বিরোধী আয়াত ও রেওয়ায়েতের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে স্বীয় মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যেগুলো জাবর ও তাফবিজ সম্পর্কে আলোচনায় কালমশাস্ত্রের বিভিন্ন পুস্তকে ও বিশেষ গবেষণাপত্রসমূহে সন্নিবেশিত আছে।
মূল সমস্যাটি হল : যদি মানুষের কর্মকাণ্ড প্রকৃতই তার স্বাধীন নির্বাচনাধীন ও তার ইচ্ছার সাথে সস্পর্কিত হয়,তবে কিরূপে একে প্রভুর ইচ্ছা ও ক্বাযার সাথে সস্পর্কিত বলে মনে করা সম্ভব? আবার যদি প্রভুর ক্বাযার সাথে সস্পর্কিত হয়ে থাকে,তবে কিরূপে তাকে মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীনও ইচ্ছাধীন বলে গণনা করা সম্ভব ?
অতএব এ সমস্যার সমাধানের জন্যে এবং মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন ও ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে দলিলের সাথে,প্রভুর ক্বাযা ও ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে দলিলের সমন্বয়ের জন্যে‘
একই কার্যের একাধিক কারণ’শিরোনামে একটি আলোচনা ও পর্যালোচনায় প্রয়াসী হব,যাতে মানুষের ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ড ও মহান প্রভুর ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে দলিল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হয়।
একাধিক কারণের প্রভাব :
কোন একটি বিষয়ের অস্তিত্বের জন্যে একাধিক কারণের প্রভাব বিভিন্নভাবে দৃষ্টিগোচর হয় :
১। একাধিক কারণ যুগপৎ ও পাশাপাশি ক্রিয়া করে থাকে। যেমন : বীজ,পানি ও তাপমাত্রা ইত্যাদির সমন্বয়ে বীজ বিদীর্ণ হয়ে অংকুরোদগম ঘটে।
২। কারণগুলো পালাক্রমে এরূপে ক্রিয়া করে যে,সৃষ্টের জীবদ্দশা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক ভাগ পালাক্রমে তাদের কোন একটি কারণের কার্যে (معلول
) পরিণত হয়ে থাকে। যেমন : বিমানের কয়েকটি মোটর পালাক্রমে পরিচালিত হয়ে একে গতি দান করে থাকে।
৩। তাদের প্রভাবগুলো হল পারস্পরিক। যেমন : কয়েকটি বল ঐগুলোর গতিগথে পরস্পরের সাথে যে সংঘর্ষ করে তাতে অথবা ধারাবাহিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও এরূপ পরিলক্ষিত হয়।এর অপর একটি উদাহরণ হল : হস্তের গতিতে মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রভাব,কলমের গতিতে হস্তের প্রভাব,লিখনের অস্তিত্বে কলমের প্রভাব ।
৪। পরস্পরের উল্লাম্বে অবস্থানকারী কারণসমূহের পারস্পরিক প্রভাব এরূপ যে,এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির উপর নির্ভরশীল (উচ্চক্রমানুসারে)। এটি পূর্ববর্তী (হস্ত,কলম ও ইচ্ছার) উদাহরণের ব্যতিক্রম,যেখানে কলমের অস্তিত্ব,হস্তের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল ছিল না;অনুরূপ হস্তের অস্তিত্ব,মানুষের ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল না।
যা হোক একক কার্যের উপর একাধিক কারণের প্রভাবের ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত সবগুলো অবস্থাই সম্ভব। তবে স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মানুষের ইরাদা ও মহান আল্লাহর ইরাদার প্রভাব শেষোক্ত প্রকারের মত। কারণ মানুষ ও তার ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব আল্লাহর ইরাদার উপর নির্ভরশীল।
একক কারণের উপর দু‘
টি কারণের সামষ্টিক প্রভাব,কেবলমাত্র তখনই অসম্ভব,যখন উভয়ই অস্তিত্বদাতা কারণ হবে,অথবা তাদের সমষ্টি নিষিদ্ধ এবং প্রতিস্থাপনযোগ্য হবে। যেমন : দু‘
ইরাদাকারীর (অনুভূমিক){
মানুষের ইচ্ছা খোদার ইচ্ছার উল্লাম্বে অবস্থান করে-আনুভূমিকা অবস্থানে বা খোদার সমন্তরালে নয়
}
একই ইরাদায় অনুপ্রবেশ অথবা একই সৃষ্ট বিষয়ের জন্যে দু‘
চূড়ান্ত্র কারণের প্রভাব।
ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন :
উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যার আলোকে ইতিমধ্যেই সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে যে,মানুষেরস্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের অস্তিত্বের সাথে মহান আল্লাহর ইরাদার কোন বিরোধ সৃষ্টি হয় না।কারণ এরা পরস্পর পরস্পরের উল্লাম্বে অবস্থান করে এবং পারস্পরিকভাবে কোন প্রকার বিরোধ বা সংঘর্ষ তাদের মধ্যে নেই।
অন্যকথায় : কোন কর্মের সাথে মানব কতৃত্বের সস্পর্ক এক স্তরে এবং ঐ কর্মের অস্তিত্বের সাথে খোদার সস্পর্ক অপেক্ষাকৃত উচ্চতর স্তরে অবস্থান করে। আর এ স্তরে মানুষের অস্তিত্ব,যে বস্তুর উপর মানুষ ক্রিয়া করে তার অস্তিত্ব,কর্ম-সম্পাদনের উপকরণসমূহের অস্তিত্ব ইত্যাদি সব কিছুই খোদার উপর নির্ভরশীল।
অতএব শেষোক্ত শ্রেণীর চূড়ান্ত কারণরূপে মানুষের কর্মকাণ্ডের উপর তার ইচ্ছাশক্তির প্রভাবের সাথে,খোদার উপর নির্ভরশীল চূড়ান্ত কারণের সকল সদস্যের অস্তিত্বের কোন বিরোধ নেই। এ বিশ্ব,মানুষ ও তার সকল মানবীয় মর্যাদার অস্তিত্ব মহান আল্লাহরই নিকট এবং তিনিই প্রতিনিয়ত ঐগুলোকে অস্তিত্ব প্রদান করে থাকেন;আর নতুন নতুন রূপে তাদেরকে সৃষ্টি করেন। কোন অস্তিত্বশীলই,কোন অবস্থায় ও কালেই তাঁর থেকে অনির্ভরশীল নয়। অতএব যে সকল কর্মকাণ্ড মানুষের নির্বাচনাধীন,সে সকল কর্মকাণ্ডও মহান আল্লাহর অমুখাপেক্ষী নয় এবং তাঁর ইচ্ছা ও ইরাদার সীমানাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অনুরূপ সৃষ্টির সকল বৈশিষ্ট্য,বিশেষত্ব,আয়তন,আকৃতিও মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদির ও ক্বাযার উপর নির্ভরশীল। এমন নয় যে,হয় মানুষের ইচ্ছার মুখাপেক্ষী,নতুবা মহান আল্লাহর ইরাদার মুখাপেক্ষী। কারণ এ ইরাদাদ্বয় পরস্পরের সমান্তরালে বা অনুভমে অবস্থান করে না বা নিষিদ্ধ সমন্বয় (مانع الجمع
) নয় এবং কোন কর্ম সম্পাদনে এ ইরাদাদ্বয়ের প্রভাব পরস্পরের বিকল্প হিসাবে ক্রিয়া করে না। বরং মানুষের ইচ্ছাশক্তি তার মূল অস্তিত্বের মতই মহান আল্লাহর ইরাদার উপর নির্ভরশীল এবং মহান আল্লাহর এ ইরাদা তার অস্তিত্ব লাভের জন্যে অপরিহার্য।
)
وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ(
তোমরা ইচ্ছা করবে না,যদি না জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা করেন। (সূরা তাকভির-২৯)
ক্বাযা
ও
ক্বাদারের
প্রতি
বিশ্বাসের
সুফল :
আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ক্বাযা ও ক্বাদারের প্রতি বিশ্বাস,খোদা পরিচিতির সমুন্নত মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মানুষের উৎকর্ষের কারণ বলে পরিগণিত হওয়া ছাড়াও এর বহুবিধ কার্যকরী প্রভাব বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি সম্পর্কে ইতিপূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফলে এখানে আমরা অপর কিছুর বর্ণনা করব :
যদি কেউ ঘটনার সংঘটনকে মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন ও ক্বাযা-ক্বাদরের উপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন তবে তিনি যে কোন অপ্রীতিকর অবস্থায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন না এবং ঐ পরিস্থিতির কাছে পরাজয় বরণ করেন না ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন না। বরং মনে করেন যে এ ঘটনাও মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা বা হিকমাতপূর্ণ বিন্যাস-ব্যবস্থারই অংশ এবং কল্যাণ ও হিকমাতের ছায়াতলেই সংঘটিত হয়েছে বা হয়ে থাকবে। ফলে সানন্দে এ অবস্থাকে স্বাগতম জানায় এবং ধৈর্য,আস্থা,তুষ্টি ও মহান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মত কল্যাণের অধিকারী হয়ে থাকে।
অনুরূপ ক্বাযা ও ক্বাদারে বিশ্বাসীগণ জীবনে আমোদ-প্রমোদে মুহ্যমান,বিমোহিত কিংবা প্রতারিত হন না অথবা এগুলোর জন্যে অহংকার ও প্রাণ-চাঞ্চল্যতা প্রদর্শন করেন না বা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ামতসমূহকে আভিজাত্য ও আত্মম্ভরিতার বিষয়রূপে গণনা করেন না।
ক্বাযা ও ক্বাদরের প্রতি বিশ্বাসের এ মূল্যবান প্রভাব হল তা-ই যা নিম্নলিখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত হয়েছে :
)
مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ (২২) لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ(
পৃথিবীতে অথবা তোমাদের জীবনের উপর (অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে) কোন বিপর্যয় আসে না,কিন্তু এসবই পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বেই লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে;আর আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ কাজ। এটা এই জন্যে যে,যা কিছু তোমরা হারিয়েছ তাতে যেন বিমর্ষ এবং যা কিছু তিনি তোমাদেরকে দিয়াছেন তার প্রতি আসক্ত ও হর্ষোৎফুল্ল না হও,আল্লাহ উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে ভালবাসেন না। (সূরা হাদীদ- ২২,২৩)
কিন্তু স্মরণ রাখা উচিৎ যে,ক্বাযা ও ক্বাদার,আর স্বাধীন প্রভাবে একত্ববাদের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা যেন উদাসীনতা,অলসতা,হীনতা,অত্যাচারিত হওয়া এবং অন্যায়ের কাছে মাথা নত করার কারণ না হয়। আর এটাই সর্বদা স্মরণ করব যে,মানুষের চিরন্তন সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য স্বীয় নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতেই অর্জিত হয়ে থাকে।
)
لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ(
সে ভাল যা উপার্জন করে তা তারই এবং সে মন্দ যা উপার্জন করে তাও তারই। (সুরা বাকারা -২৮৬)
তদনুরূপ,
)
أَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى(
আর এই যে,মানুষ তাই পায় যা সে করে। (সুরা নাজম-৩৯)