আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)0%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 15557
ডাউনলোড: 4610

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15557 / ডাউনলোড: 4610
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

জাবরবাদীদের ভ্রান্ত ধারণার জবাব

জাবরবাদীদের গুরুতর ভুলধারণাগুলো ও ঐগুলোর জাবাব নিম্নে বর্ণনা করা হল :

১। মানুষের ইচ্ছা,অভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তি বা কামনা জাগরণের মাধ্যমে রূপ পরিগ্রহ করে। আর এ ধরনের কামনা,একদিকে যেমন মানুষের নির্বাচনের ক্ষমতাধীন নয়,অপরদিকে তেমনি কোন বাহ্যিক কারণের প্রভাবেও আন্দোলিত হয় না। অতএব স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতার কোন স্থান থাকতে পারে না।

জবাব : আভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তির জাগরণ,স্বাধীন নির্বাচন ও সিদ্ধান্তের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র সৃষ্টি করে কোন কাজের সিদ্ধান্ত দেয় না,যার ফলে আভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তির জাগরণের মাধ্যমে প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে বাধ্যতামূলক কোন ফলে উপনীত হবে। এর প্রমাণ এই যে,অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয় এবং ঐ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে চিন্তা-ভাবনা ও ঐ কর্মের লাভ-লোকসানকে বিবেচনা করতে হয় এবং কখনো কখনো তা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

২। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায়,উত্তরাধিকার,গ্রন্থির ক্ষরণ,তদোনুরূপ পারিপার্শিক ও সামাজিক অবস্থাও মানুষের কোন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে এবং তাদের পারস্পরিক আচার-ব্যবহারের বৈসাদৃশ্যও এ কারণগুলোর বৈসাদৃশ্যের ফলে রূপপরিগ্রহ করে। যেমনটি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও মোটামুটি অনুমোদন পেয়েছে। অতএব মানুষের কীর্তি-কর্ম তার স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা থেকে পরিগৃহীত -এ কথা বলা যায় না।

জবাব : এখতিয়ার ও স্বাধীন ইচ্ছাকে স্বীকার করার অর্থ এ নয় যে,উল্লেখিত কারণগুলোর প্রভাবকে অস্বীকার করা। বরং এর অর্থ এই যে,এ কারণগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও মানুষ এগুলোকে প্রতিরোধ করতে পারে এবং যখন একাধিক প্রবৃত্তি বা কামনার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়,তখন সে তাদের একটিকে নির্বাচন করতে সক্ষম।

তবে এ কারণগুলোর কোন কোনটির তীব্রতা,কখনো কখনো ঐগুলোর ব্যতিক্রমী কোন কর্মের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু এ ধরনের প্রতিরোধ ও নির্বাচন,বিনিময়ে উৎকর্ষ ও পূর্ণতার ক্ষেত্রে অধিকতর প্রভাব ফেলে এবং পুরস্কারের জন্যে তার উপযুক্ততাকে অধিকতর করে থাকে,যেমন : নিদারুন উৎকন্ঠা ও অন্যান্য কঠিন অবস্থা,অপরাধ ও শাস্তি লাঘবের কারণ হয়ে থাকে।

৩। জাবরবাদীদের অপর একটি ভুল ধারণা হল : মহান আল্লাহ বিশ্বের সকল ঘটনা-দুঘটনা সম্পর্কে উদাহরণতঃ মানুষের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে,তা ঘটার পূর্বেই অবগত আছেন এবং প্রভুর জ্ঞান হল ভুল-ভ্রান্তি বিবর্জিত। সুতরাং সংগত কারণেই সকল ঘটনা মহান আল্লাহর অনাদি জ্ঞানানুসারেই ঘটে থাকবে যার ব্যতিক্রম করা অসম্ভব। অতএব স্বাধীন নির্বাচনের কোন সুযোগ নেই।

জবাব : সকল ঘটনা যেরূপেই ঘটুক না কেন,প্রভুর জ্ঞান সকল কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে এবং মানুষ কর্তৃক স্বাধীনভাবে নির্বাচিত কর্মকাণ্ডগুলোও স্বাধীনত্বের বৈশিষ্ট্যসহ মহান আল্লাহর অবগতির আওতায় অবস্থান করে। অতএব যদি জাবরিয়াতের বৈশিষ্ট্য সহকারে কোন ঘটনা ঘটে,তবে তা খোদার জ্ঞান বহির্ভূত ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হবে। যেমন : মহান আল্লাহ অবগত আছেন যে,কোন বিশেষ শর্তাধীন,কোন বিশেষ ব্যক্তি কোন কর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নিবে এবং তা সস্পন্ন করবে। এরূপ নয় যে,আল্লাহর জ্ঞান,স্বাধীন নির্বাচন ও ইচ্ছার সাথে উক্ত কর্মের সস্পর্ককে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র ঘটনাটি ঘটা সম্পর্কেই অবগত। অতএব আল্লাহর অনাদি জ্ঞান,ইচ্ছা ও স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতার সাথে কোন বিরোধ সৃষ্টি করে না।

জাবরবাদীদের অপর একটি ভ্রান্ত ধারণা,ক্বাজা ও ক্বাদার সংশ্লিষ্ট যা তাদের মতে মানুষের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমরা পরবর্তী পাঠে এ বিষয়টি সম্পর্কে আলোচনার প্রয়াস পাব।

১৯তম পাঠ

ক্বাযা ও ক্বাদার

ক্বাযা ক্বাদরের তাৎপর্য :

ক্বাদার (قدر ) শব্দটির অর্থ হল পরিমাপ’এবং তাক্বদির (تقدیر ) শব্দটির অর্থ হল পরিমাপন বা কোন কিছুকে নির্দিষ্ট পরিমাপে তৈরী করা’আর ক্বাযা (قضاء ) শব্দটি চূড়ান্তভাবে সস্পন্নকরণ বা কর্ম সম্পাদন’(বুদ্ধিমত্তাগত প্রকারান্তরে) বা মীমাংসা’ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো এদুটি শব্দ সমার্থবোধক শব্দরূপে ভাগ্যলিপি’অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

প্রভু কর্তৃক পরিমাপন অর্থ হল;মহান আল্লাহ সকল কিছুর জন্যেই সংখ্যাগত ও গুণগত স্থান,কাল ও পাত্রগত পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন,যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারণ ও নির্বাহকের প্রভাবে বাস্তবরূপ লাভ করে থাকে। আর প্রভু কর্তৃক চূড়ান্তভাবে সস্পন্নকরণ বা মীমাংসার অর্থ হল এই যে,কোন ঘটনার ক্ষেত্র ও কারণ,ভূমিকাসমূহের উপযুক্ত যোগানের পর,মহান আল্লাহ ঐ ঘটনাকে নিশ্চিত ও চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেন।

উপরোক্ত ব্যাখ্যানুসারে,তাক্বদিরের স্তর হল ক্বাযার পূর্বে,যার কয়েকটি পর্যায় বিদ্যমান। এ‘তাক্বদির’দূরবর্তী প্রারম্ভিকা (مقدمة البعید ) মধ্যবর্তী প্রারম্ভিকা (مقدمة المتوسط ) ও নিকটবর্তী প্রারম্ভিকার (مقدمة القریب ) সমন্বয়ে রূপ পরিগ্রহ করে এবং কোন কোন শর্ত বা কারণের পরিবর্তনে পরিবর্তিত রূপ লাভ করে। যেমন : ভ্রূণের দশাগুলো হল,যথাক্রমে শুক্রাণু (نطفه ) জমাট রক্ত(علقه ) মাংসপিণ্ড (مضغه ) থেকে পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণে রূপান্তর। এ দশাগুলোই হল ভ্রূণের তাক্বদির,যা নির্দিষ্ট স্থান ও কালকেও সমন্বিত করে এবং এ পর্যায়গুলোর কোন একটির অনুপস্থিতি তার তাক্বদিরের পরিবর্তন বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু ক্বাযা হল একদশা বিশিষ্ট (دفعی ) এবং সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার শর্তও কারণের উপস্থিতির সাথে সস্পর্কযুক্ত -যা সুনিশ্চিত ও অলংঘনীয়।

) إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ(

তিনি যখন কিছু স্থির করেন,তখন শুধু বলেন হও’এবং তা হয়ে যায় (সূরা আলে ইমরান-৪৭)। এ সম্পর্কিত আরও অনেক আয়াত রয়েছে যেমন:সূরা বাক্বারা-১৭,সূরা মারিয়াম-৩৫,সূরা গাফির-৬৮।

কিন্তু ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে,কখনো কখনো ক্বাযা ও ক্বাদার সমার্থক শব্দরূপে ব্যবহৃত হয়। আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে তা সুনিশ্চিত ও অনিশ্চিত’এ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে। অপরদিকে সমার্থক অর্থে ব্যবহৃত হয় বলেই কোন কোন রেওয়ায়েত ও দোয়ায় ক্বাযাকে’পরিবর্তনশীল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন : সাদ্কাহ্,পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ,আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসস্পর্ক রক্ষা করা এবং দোয়া করা ইত্যাদি ক্বাযার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে বলে বর্ণিত হয়েছে।

তাত্ত্বিক এবং প্রত্যক্ষ ক্বাযা ও ক্বাদার :

কখনো কখনো ঐশী তাক্বদির ও ক্বাজা’কথাটি,ঘটনা সংঘটনের প্রারম্ভিকা,কারণ ও শর্তের যোগান সম্পর্কে,তদনুরূপ তার সুনিশ্চিত সংঘটন সম্পর্কে মহান আল্লাহর জ্ঞান ,অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর তখন একে তাত্ত্বিক ক্বাযা ও ক্বাদার'(القضا و القدر العلمی ) বলা হয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো কোন ঘটনার সাথে তার পর্যায়ক্রমিক দশাগুলোর সস্পর্ক এবং অনুরূপ তাদের প্রত্যক্ষ সংঘটনে মহান আল্লাহর সস্পর্ক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর তখন একে প্রত্যক্ষ ক্বাযা ও ক্বাদার। (القضا و القدر الغینی ) বলা হয়ে থাকে।

বিভিন্ন আয়াত ও রেওয়ায়েত থেকে যতটুকু জানা যায় তাতে পরিদৃষ্ট হয় যে,সকল ঘটনা ঠিক যেরূপ বাস্তব জগতে সংঘটিত হবে,সে সম্পর্কে প্রভুর জ্ঞান, লৌহে মাহফুজ’নামক পবিত্র ও সমুন্নত সৃষ্ট বিষয়ে সংরক্ষিত আছে। যিনি মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে এর সান্নিধ্যে পৌঁছবেন,তিনি অতীত ও ভবিষ্যতের সকল ঘটনা সম্পর্কে অবগত হবেন। অনুরূপ অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরের ফলকসমূহও (الواح )বিদ্যমান,যেখানে ঘটনাসমূহ অসমাপ্ত ও শর্তযুক্ত অবস্থায় লিপিবদ্ধ আছে। যদি কেউ (আল্লাহর অনুমতিক্রমে) এর নৈকট্যে সক্ষম হন তবে তিনি সীমাবদ্ধ সংবাদ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন,যা শর্তাধীন ও পরিবর্তনযোগ্য। সম্ভবতঃ নিম্নলিখিত আয়াতটি এ দু ধরনের ভাগ্যলিপি সম্পর্কেই সাক্ষী প্রদান করে :

) يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ(

আল্লাহর যা ইচ্ছা তা নিশ্চিহ্ন করেন এবং যা ইচ্ছা তাই প্রতিষ্ঠিত রাখেন আর তাঁরই নিকট আছে কিতাবের মূল। (সুরা রা দ-৩৯)

উল্লেখ্য অনিশ্চিত ও শর্তাধীন তাক্বদীরসমূহকে’ রেওয়ায়েতের ভাষায় বাদা (بداء ) নামকরণ করা হয়েছে।

যা হোক তাত্ত্বিক ক্বাযা ও ক্বাদারের’প্রতি বিশ্বাস,আল্লাহর অনাদি জ্ঞান সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা অপেক্ষা সমস্যাসংকুল নয়। পূর্ববর্তী পাঠে খোদার জ্ঞান সম্পর্কে,জাবরবাদীদের ভ্রান্ত ধারণার উপর আলোচনা করা হয়েছিল এবং সেখানে তাদের ধারণার অন্তঃসার শুন্যতা প্রতিপন্ন হয়েছিল।

কিন্তু প্রত্যক্ষ ক্বাযা ও ক্বাদারের’প্রতি বিশ্বাস বিশেষ করে সুনিশ্চিত ভাগ্যলিপির’প্রতি বিশ্বাস কঠোর সমস্যার সম্মুখীন হয়। সুতরাং ঐ সমস্যাগুলোর সমাধানে সচেষ্ট হব -যদিও এর সংক্ষিপ্ত উত্তর‘স্বাধীন প্রভাব’শিরোনামে একত্ববাদের আলোচনায় দেয়া হয়েছে।

মানুষের এখ্তিয়ারের সাথে ক্বাযা ও ক্বাদারের সস্পর্ক

ইতিমধ্যেই আমরা জেনেছি যে,প্রত্যক্ষ ক্বাযা ও ক্বাদারের প্রতি বিশ্বাসের দাবি হল এই যে,সৃষ্টবিষয়ের অস্তিত্বকে,সৃষ্টির শুরু থেকে বিকাশকাল পর্যন্ত ও তৎপর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত,এমনকি দূরবর্তী প্রারম্ভিকার যোগান কালকেও প্রজ্ঞাবান প্রভুর জ্ঞানাধীন বলে বিশ্বাস করা। তেমনি সৃষ্টির শর্তসমূহের যোগান ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাকে প্রভুর ইচ্ছা বা ইরাদা সংশ্লিষ্ট বলে গণনা করা।১৯

অন্যকথায় : সব কিছুরই অস্তিত্ব খোদার অনুমতি ও সুনির্ধারিত ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল এবং তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোন কিছুই অস্তিত্বের ময়দানে পা ফেলতে পারেনা। তেমনি সব কিছুই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদির ও ক্বাযার উপর নির্ভরশীল,যা ব্যতীত কোন অস্তিত্বশীলই স্বীয় আয়াতন,আকৃতি ও বিশেষত্ব প্রাপ্ত হয় না ও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে না। এ সম্পর্কের বর্ণনা ও এর স্বপক্ষে সাক্ষ্যপ্রদান হল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন প্রভাব’অর্থে তাওহীদেরই শিক্ষা,যা হল একত্ববাদের সর্বোচ্চস্তর এবং যা মানব সম্প্রদায়ের আত্মোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে -যেমনটি ইতিপূর্বে আমরা ইঙ্গিত করেছি।

বিষয়বস্তুর সংঘটন প্রভুর অনুমতি এবং তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল এর প্রমাণ অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য ও সহজবোধ্য। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায় এবং প্রভুর ক্বাযায় এর নিশ্চিত নির্ধারণের সাক্ষ্য, দুস্প্রাপ্যতার কারণে অধিকতর আলোচনা ও পর্যালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কারণ এ ধরনের বিশ্বাসের সাথে, আপন ভাগ্যলিপির পরিবর্তনে মানুষের স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা’বা এখতিয়ারের’স্বীকৃতির সমন্বয় খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এর ফলেই এক শ্রেণীর মোতাকাল্লেমিন (আশায়েরী) যারা মানুষের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রভুর ক্বাযাকে স্বীকার করেছিলেন,তারা জাবরবাদের দিকে ঝুকে পড়েছিলেন। আবার অপর এক শ্রেণীর মোতাকাল্লেমিন (মো’তাযেলী) যারা জাবর ও এর শোচনীয় পরিণতিকে গ্রহণ করতে পারেননি,তারা মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডকে প্রভুর ক্বাযার অন্তর্ভুক্ত বলে মেনে নেননি। উভয়দলই নিজেদের মতের বিরোধী আয়াত ও রেওয়ায়েতের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে স্বীয় মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন যেগুলো জাবর ও তাফবিজ সম্পর্কে আলোচনায় কালমশাস্ত্রের বিভিন্ন পুস্তকে ও বিশেষ গবেষণাপত্রসমূহে সন্নিবেশিত আছে।

মূল সমস্যাটি হল : যদি মানুষের কর্মকাণ্ড প্রকৃতই তার স্বাধীন নির্বাচনাধীন ও তার ইচ্ছার সাথে সস্পর্কিত হয়,তবে কিরূপে একে প্রভুর ইচ্ছা ও ক্বাযার সাথে সস্পর্কিত বলে মনে করা সম্ভব? আবার যদি প্রভুর ক্বাযার সাথে সস্পর্কিত হয়ে থাকে,তবে কিরূপে তাকে মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীনও ইচ্ছাধীন বলে গণনা করা সম্ভব ?

অতএব এ সমস্যার সমাধানের জন্যে এবং মানুষের স্বাধীন নির্বাচনাধীন ও ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে দলিলের সাথে,প্রভুর ক্বাযা ও ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে দলিলের সমন্বয়ের জন্যে একই কার্যের একাধিক কারণ’শিরোনামে একটি আলোচনা ও পর্যালোচনায় প্রয়াসী হব,যাতে মানুষের ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ড ও মহান প্রভুর ইচ্ছাধীন কর্মকাণ্ডের স্বপক্ষে দলিল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হয়।

একাধিক কারণের প্রভাব :

কোন একটি বিষয়ের অস্তিত্বের জন্যে একাধিক কারণের প্রভাব বিভিন্নভাবে দৃষ্টিগোচর হয় :

১। একাধিক কারণ যুগপৎ ও পাশাপাশি ক্রিয়া করে থাকে। যেমন : বীজ,পানি ও তাপমাত্রা ইত্যাদির সমন্বয়ে বীজ বিদীর্ণ হয়ে অংকুরোদগম ঘটে।

২। কারণগুলো পালাক্রমে এরূপে ক্রিয়া করে যে,সৃষ্টের জীবদ্দশা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে এবং প্রত্যেক ভাগ পালাক্রমে তাদের কোন একটি কারণের কার্যে (معلول ) পরিণত হয়ে থাকে। যেমন : বিমানের কয়েকটি মোটর পালাক্রমে পরিচালিত হয়ে একে গতি দান করে থাকে।

৩। তাদের প্রভাবগুলো হল পারস্পরিক। যেমন : কয়েকটি বল ঐগুলোর গতিগথে পরস্পরের সাথে যে সংঘর্ষ করে তাতে অথবা ধারাবাহিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও এরূপ পরিলক্ষিত হয়।এর অপর একটি উদাহরণ হল : হস্তের গতিতে মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রভাব,কলমের গতিতে হস্তের প্রভাব,লিখনের অস্তিত্বে কলমের প্রভাব ।

৪। পরস্পরের উল্লাম্বে অবস্থানকারী কারণসমূহের পারস্পরিক প্রভাব এরূপ যে,এদের একটির অস্তিত্ব অপরটির উপর নির্ভরশীল (উচ্চক্রমানুসারে)। এটি পূর্ববর্তী (হস্ত,কলম ও ইচ্ছার) উদাহরণের ব্যতিক্রম,যেখানে কলমের অস্তিত্ব,হস্তের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল ছিল না;অনুরূপ হস্তের অস্তিত্ব,মানুষের ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল না।

যা হোক একক কার্যের উপর একাধিক কারণের প্রভাবের ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত সবগুলো অবস্থাই সম্ভব। তবে স্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মানুষের ইরাদা ও মহান আল্লাহর ইরাদার প্রভাব শেষোক্ত প্রকারের মত। কারণ মানুষ ও তার ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব আল্লাহর ইরাদার উপর নির্ভরশীল।

একক কারণের উপর দু টি কারণের সামষ্টিক প্রভাব,কেবলমাত্র তখনই অসম্ভব,যখন উভয়ই অস্তিত্বদাতা কারণ হবে,অথবা তাদের সমষ্টি নিষিদ্ধ এবং প্রতিস্থাপনযোগ্য হবে। যেমন :  দু ইরাদাকারীর (অনুভূমিক){ মানুষের ইচ্ছা খোদার ইচ্ছার উল্লাম্বে অবস্থান করে-আনুভূমিকা অবস্থানে বা খোদার সমন্তরালে নয় } একই ইরাদায় অনুপ্রবেশ অথবা একই সৃষ্ট বিষয়ের জন্যে দু চূড়ান্ত্র কারণের প্রভাব।

ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন :

উপরোল্লিখিত ব্যাখ্যার আলোকে ইতিমধ্যেই সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে যে,মানুষেরস্বাধীন নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের অস্তিত্বের সাথে মহান আল্লাহর ইরাদার কোন বিরোধ সৃষ্টি হয় না।কারণ এরা পরস্পর পরস্পরের উল্লাম্বে অবস্থান করে এবং পারস্পরিকভাবে কোন প্রকার বিরোধ বা সংঘর্ষ তাদের মধ্যে নেই।

অন্যকথায় : কোন কর্মের সাথে মানব কতৃত্বের সস্পর্ক এক স্তরে এবং ঐ কর্মের অস্তিত্বের সাথে খোদার সস্পর্ক অপেক্ষাকৃত উচ্চতর স্তরে অবস্থান করে। আর এ স্তরে মানুষের অস্তিত্ব,যে বস্তুর উপর মানুষ ক্রিয়া করে তার অস্তিত্ব,কর্ম-সম্পাদনের উপকরণসমূহের অস্তিত্ব ইত্যাদি সব কিছুই খোদার উপর নির্ভরশীল।

অতএব শেষোক্ত শ্রেণীর চূড়ান্ত কারণরূপে মানুষের কর্মকাণ্ডের উপর তার ইচ্ছাশক্তির প্রভাবের সাথে,খোদার উপর নির্ভরশীল চূড়ান্ত কারণের সকল সদস্যের অস্তিত্বের কোন বিরোধ নেই। এ বিশ্ব,মানুষ ও তার সকল মানবীয় মর্যাদার অস্তিত্ব মহান আল্লাহরই নিকট এবং তিনিই প্রতিনিয়ত ঐগুলোকে অস্তিত্ব প্রদান করে থাকেন;আর নতুন নতুন রূপে তাদেরকে সৃষ্টি করেন। কোন অস্তিত্বশীলই,কোন অবস্থায় ও কালেই তাঁর থেকে অনির্ভরশীল নয়। অতএব যে সকল কর্মকাণ্ড মানুষের নির্বাচনাধীন,সে সকল কর্মকাণ্ডও মহান আল্লাহর অমুখাপেক্ষী নয় এবং তাঁর ইচ্ছা ও ইরাদার সীমানাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অনুরূপ সৃষ্টির সকল বৈশিষ্ট্য,বিশেষত্ব,আয়তন,আকৃতিও মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত তাক্বদির ও ক্বাযার উপর নির্ভরশীল। এমন নয় যে,হয় মানুষের ইচ্ছার মুখাপেক্ষী,নতুবা মহান আল্লাহর ইরাদার মুখাপেক্ষী। কারণ এ ইরাদাদ্বয় পরস্পরের সমান্তরালে বা অনুভমে অবস্থান করে না বা নিষিদ্ধ সমন্বয় (مانع الجمع ) নয় এবং কোন কর্ম সম্পাদনে এ ইরাদাদ্বয়ের প্রভাব পরস্পরের বিকল্প হিসাবে ক্রিয়া করে না। বরং মানুষের ইচ্ছাশক্তি তার মূল অস্তিত্বের মতই মহান আল্লাহর ইরাদার উপর নির্ভরশীল এবং মহান আল্লাহর এ ইরাদা তার অস্তিত্ব লাভের জন্যে অপরিহার্য।

) وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ(

তোমরা ইচ্ছা করবে না,যদি না জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ ইচ্ছা করেন। (সূরা তাকভির-২৯)

ক্বাযা ক্বাদারের প্রতি বিশ্বাসের সুফল :

আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ক্বাযা ও ক্বাদারের প্রতি বিশ্বাস,খোদা পরিচিতির সমুন্নত মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মানুষের উৎকর্ষের কারণ বলে পরিগণিত হওয়া ছাড়াও এর বহুবিধ কার্যকরী প্রভাব বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি সম্পর্কে ইতিপূর্বেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। ফলে এখানে আমরা অপর কিছুর বর্ণনা করব :

যদি কেউ ঘটনার সংঘটনকে মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন ও ক্বাযা-ক্বাদরের উপর নির্ভরশীল বলে মনে করেন তবে তিনি যে কোন অপ্রীতিকর অবস্থায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন না এবং ঐ পরিস্থিতির কাছে পরাজয় বরণ করেন না ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন না। বরং মনে করেন যে এ ঘটনাও মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা বা হিকমাতপূর্ণ বিন্যাস-ব্যবস্থারই অংশ এবং কল্যাণ ও হিকমাতের ছায়াতলেই সংঘটিত হয়েছে বা হয়ে থাকবে। ফলে সানন্দে এ অবস্থাকে স্বাগতম জানায় এবং ধৈর্য,আস্থা,তুষ্টি ও মহান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মত কল্যাণের অধিকারী হয়ে থাকে।

অনুরূপ ক্বাযা ও ক্বাদারে বিশ্বাসীগণ জীবনে আমোদ-প্রমোদে মুহ্যমান,বিমোহিত কিংবা প্রতারিত হন না অথবা এগুলোর জন্যে অহংকার ও প্রাণ-চাঞ্চল্যতা প্রদর্শন করেন না বা আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ামতসমূহকে আভিজাত্য ও আত্মম্ভরিতার বিষয়রূপে গণনা করেন না।

ক্বাযা ও ক্বাদরের প্রতি বিশ্বাসের এ মূল্যবান প্রভাব হল তা-ই যা নিম্নলিখিত আয়াত শরীফে বর্ণিত হয়েছে :

) مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ (২২) لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ(

পৃথিবীতে অথবা তোমাদের জীবনের উপর (অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে) কোন বিপর্যয় আসে না,কিন্তু এসবই পৃথিবী সৃষ্টির পূর্বেই লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে;আর আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ কাজ। এটা এই জন্যে যে,যা কিছু তোমরা হারিয়েছ তাতে যেন বিমর্ষ এবং যা কিছু তিনি তোমাদেরকে দিয়াছেন তার প্রতি আসক্ত ও হর্ষোৎফুল্ল না হও,আল্লাহ উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে ভালবাসেন না। (সূরা হাদীদ- ২২,২৩)

কিন্তু স্মরণ রাখা উচিৎ যে,ক্বাযা ও ক্বাদার,আর স্বাধীন প্রভাবে একত্ববাদের ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা যেন উদাসীনতা,অলসতা,হীনতা,অত্যাচারিত হওয়া এবং অন্যায়ের কাছে মাথা নত করার কারণ না হয়। আর এটাই সর্বদা স্মরণ করব যে,মানুষের চিরন্তন সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য স্বীয় নির্বাচনাধীন কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতেই অর্জিত হয়ে থাকে।

) لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ(

সে ভাল যা উপার্জন করে তা তারই এবং সে মন্দ যা উপার্জন করে তাও তারই। (সুরা বাকারা -২৮৬)

তদনুরূপ,

) أَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى(

আর এই যে,মানুষ তাই পায় যা সে করে। (সুরা নাজম-৩৯)