আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)0%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 15562
ডাউনলোড: 4610

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15562 / ডাউনলোড: 4610
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

দ্বীনের অনুসন্ধানের উদ্দীপকসমূহ

বাস্তবতা সম্পর্কে পরিচয় লাভ এবং সত্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সহজাত প্রবৃত্তি ও ফিতরাতগত চাহিদা মানুষের আত্মিক বিশেষত্বসমূহের অন্তর্ভুক্ত,যা প্রত্যেক মানুষের শৈশবে প্রকাশ লাভ করে এবং জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত বজায় থাকে। সত্যানুসন্ধিৎসু এ ফিতরাতকে কখনো কখনো অনুসন্ধিৎসু ইন্দ্রিয়ও বলা হয়ে থাকে। এ ফিতরাত মানুষকে দ্বীনের কাঠামোর অভ্যন্তরে বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে এবং সত্য ধর্মকে চিনার জন্যে উদ্যোগী করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখযোগ্য :

ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতা বহির্ভূত এবং অবস্তুগত (অদৃশ্য) কোন বিষয়ের অস্তিত্ব রয়েছে কি ? যদি থেকে থাকে,তবে অদৃশ্য জগৎ ও বস্তুজগৎ বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের মধ্যে কি কোন সস্পর্ক বিদ্যমান? যদি সস্পর্ক থেকে থাকে,তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা বহির্ভূত এমন কোন অস্তিত্ব কি বিদ্যমান,যা বস্তুজগতের সৃষ্টিকর্তা ?

মানুষের অস্তিত্ব কি শুধুমাত্র এ বস্তুগত দেহের সাথেই সংশ্লিষ্ট এবং তার জীবন কি শুধুমাত্র এ পার্থিব জীবনেরও মধ্যেই সীমাবদ্ধ,না কি অপর কোন জীবনের অস্তিত্বও রয়েছে ? যদি অপর কোন জীবনের অস্তিত্ব থেকে থাকে,তবে ইহ ও পারলৌকিক জীবনের মধ্যে কি কোন সস্পর্ক আছে? যদি সস্পর্ক থেকে থাকে তবে পার্থিব কোন্ কোন্ বিষয়গুলো পারলৌকিক বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলে থাকে ? কিভাবে মানুষের ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের নিশ্চয়তা দানকারী সঠিক কর্মসূচীর পরিচয় পাওয়া যেতে পারে? সর্বশেষে,ঐ কর্মসূচীটি কী ?

অতএব, সত্যানুসন্ধিৎসু সহজাত প্রবৃত্তিই হল প্রধান কারণ যা মানুষকে সকল বিষয়ের উপর বিশেষ করে ধর্ম সম্বন্ধীয় বিষয়ের উপর পর্যালোচনার এবং সত্য দ্বীনকে চিনার জন্যে উদ্যোগী করে।

অপর একটি কারণ,যা সত্যানুসন্ধানের প্রতি মানুষের আগ্রহকে বৃদ্ধি করে তা হল সত্যানুসন্ধিৎসা ভিন্ন অপর এক বা এশাধিক ফিতরাতগত কামনা সংশ্লিষ্ট অবশিষ্ট চাহিদাসমূহ পুরণের প্রবণতা,যা বিশেষ পরিচিতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যেমন : বিভিন্ন বস্তুগত ও পার্থিব বৈভব থেকে লাভবান হওয়ার প্রবণতা যা বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা ও অগ্রগতির মাধ্যমে মানুষকে তার কাংখিত চাহিদা পুরণে সহায়তা করে। অনুরূপ,দ্বীন যদি মানুষের আকাংখা পুরণের, স্বার্থ ও কল্যাণের এবং বিপদ-আপদ ও ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিতে পারে,তবে তার জন্যে তাও বাঞ্ছিত হবে।

লাভবান হওয়ার সহজাত প্রবণতা এবং ক্ষতির হাত থেকে পলায়ন প্রবণতা দ্বীন সম্পর্কে অনুসন্ধানের অপর একটি কারণ বলে পরিগণিত । তবে জ্ঞানের পরিধির বিস্তৃতি এবং সকল প্রকার বাস্তবতাকে জানার জন্য পর্যপ্ত শর্ত কার্যকর না থাকার ফলে সম্ভবতঃ মানুষ এমন কোন বিষয়কে অনুসন্ধানের জন্যে নির্বাচন করে থাকে যার সমাধান সহজতর এবং যার ফল সহজলভ্য ও অনুভবযোগ্য। অপর দিকে দ্বীন সস্পর্কিত বিষয়সমূহের সমাধান জটিলতর ও কার্যকর কোন গুরুত্বপূর্ণ ফল নেই। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তাদেরকে বিবেচনা করা থেকে বিরত থাকে। ফলে স্পষ্টতঃই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, দ্বীন সস্পর্কিত বিষয়সমূহই বিচার-বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ববহ। এমন কি কোন বিষয়ই বিচার-বিশ্লেষণের জন্যে এ বিষয়গুলোর সমতুল গুরুত্ব রাখে না।

এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে,কোন কোন মনোবিজ্ঞানী ও মনোসমীক্ষক বিশ্বাস করেন যে, খোদাভীরুতা হল মানুষের একটি প্রত্যক্ষ ফিতরাতগত চাহিদা এবং তার উৎসকে ধর্মানুভূতি (حس دینی ) নামকরণ করতঃ তাকে অনুসন্ধিৎসা,কল্যাণানুভূতি ও সৌন্দর্যানুভূতির পাশাপাশি চতুর্থ আত্মিক বৈশিষ্ট্যরূপে গণনা করেছেন।

তারা তাদের এ ধারণার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের জন্যে ইতিহাস ও প্রত্মতত্বের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং বলেছেন যে,খোদাভীরুতা সবর্দা কোন না কোনভাবে সর্বযুগের মানুষের মধ্যে সর্বদা প্রচলিত ছিল। আর এ সার্বজনীনতা ও চিরন্তনতাই খোদাভীরুতার ফিতরাতগত হওয়ার সপক্ষে প্রমাণ বহন করে ।

তবে ফিতরাতগত চাহিদার সার্বজনীন অর্থ এ নয় যে,এটা সর্বদা সর্বজনের মধ্যে জাগ্রত ও সজীব থাকবে এবং মানুষকে সতর্কতার সাথে আপন যাঞ্চার দিকে উদ্বুদ্ধ করবে। বরং তা পারিপার্শিক পরিবেশ ও ত্রুটিপূর্ণ পরিচর্যার কারণে নিস্প্রভ ও নিস্ক্রিয়ও হয়ে যেতে পারে কিংবা আপন সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে,যেমনি করে অন্যান্য সহজাত প্রবণতার ক্ষেত্রে এধরনের নিস্প্রভতা,বিচ্যুতি ও অবদমিত অবস্থা কমবেশী পরিলক্ষিত হয়।

এ মতবাদ অনুসারে,দ্বীনের অনুসন্ধানের উদ্দীপক হল প্রত্যক্ষভাবে ফিতরাতগত এবং যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে এর অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠার কোন প্রয়োজন নেই ।

এ মতবাদকে দ্বীনের ফিতরাতগত হওয়া সম্পর্কিত আয়াত এবং রেওয়ায়েতের উদ্বৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করা যেতে পারে। তবে এ ফিতরাতগত চাহিদা অবচেতন অবস্থায় প্রকাশ পায়’ এ ধারণার উপর ভিওি করে কেউ কেউ তর্ক-বিতর্কের খাতিরে নিজের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারে। তাই আমরা শুধুমাত্র এ যুক্তিতেই তুষ্ট হব না এবং দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্ব প্রমাণ করতে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের আশ্রয় গ্রহণ করব।

দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্ব

স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,একদিকে বাস্তবতাকে চিনার জন্যে ফিতরাতগত চাহিদা,অপরদিকে স্বার্থসিদ্ধি ও লাভবান হওয়ার,ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদে থাকার প্রবণতা হল চিন্তা করার জন্যে এবং গভীর জ্ঞানার্জনের জন্যে শক্তিশালী উদ্দীপক। অতএব,কোন ব্যক্তি অবহিত হল যে,যুগ যুগ ধরে একশ্রেণীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দাবী করেছেন যে, আমরা ইহ ও পরকালীন কল্যাণের দিকে মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্যে বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে প্রেরিত হয়েছি”সত্যের বাণী পৌঁছানোর পথে ও মানুষকে পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার চেষ্টা করা থেকে বিরত হন নি এবং যে কোন প্রকার দুঃখ-কষ্টকে সহ্য করেছেন;এমনকি এ পথে তারা নিজ জীবনও উৎসর্গ করেছেন। তখন ঐ ব্যক্তি পূর্বোল্লিখিত উদ্দীপকদ্বয়ের দ্বারা দ্বীন সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য উদ্দীপ্ত হয়ে জানতে চেষ্টা করে যে,পয়গাম্বরগণের দাবী কতটা সত্য এবং কতটা যুক্তিযুক্ত। বিশেষ করে কোন ব্যক্তি জানতে পারল যে,তাদের (নবীগণের ) আহ্বান অনন্ত সুখ ও বৈভবের সুসংবাদ এবং অনন্তদুঃখ-দুর্দশা ও শাস্তির ভীতি প্রদর্শন সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ তাদের আহবানে সাড়া দেয়ার মধ্যে চিরন্তন সুখ-সম্মৃদ্ধির সম্ভাবনা বিদ্যমান। আর তাদের আহ্বানের বিরোধিতা করার মধ্যে অনন্ত ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবে ঐ ব্যক্তি কোন্ অজুহাতে দ্বীন সম্পর্কে উদাসীনতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করবে এবং অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্যে উদ্যোগী হবে না ?

হ্যাঁ,সম্ভবতঃ কেউ অলসতা ও আরামপ্রিয়তার কারণে গবেষণা ও অনুসন্ধানের কাজে নিজেকে পরিশ্রান্ত করতে চান না অথবা দ্বীন গ্রহণ করার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা বা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হবে এবং তার কিছু কিছু স্বেচ্ছাচারী কর্ম থেকে তাকে বিরত রাখবে,এ কারণে দ্বীনের অনুসন্ধান থেকে সে নিজেকে দূরে রাখে ।

কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিরা অচিরেই এ অলসতা ও স্বেচ্ছাচারিতার শোচনীয় পরিণতি দেখতে পাবে এবং পরিশেষে অনন্ত শাস্তি ও অপরিসীম দুর্দশায় পতিত হবে ।

এ ধরনের ব্যক্তিদের অবস্থা অসুস্থ’ঐ নির্বোধ শিশুর চেয়েও খারাপ যে ঔষধের তিক্ততার ভয়ে চিকিৎসকের নিকট যায় না এবং নিশ্চিত মৃত্যর মুখে নিজেকে ঠেলে দেয়। কারণ ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ উক্ত শিশুর ঘটেনি। তবে চিকিৎসকের পরামর্শের বিরোধিতা করার ফলে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ থেকে বঞ্চিত হত্তয়া বৈ কিছু নয়। কিন্ত একজন বয়ঃপ্রাপ্ত ও সচেতন মানুষ,যে লাভ-লোকসান সম্পর্কে ভাবতে পারগ,সে তো স্বল্পস্থায়ী সুখের বিনিময়ে অনন্ত শাস্তিই ক্রয় করে থাকে ।

এ কারণেই,পবিত্র কোরান এ ধরনের উদাসীন মানুষকে চতুস্পদ প্রাণীর চেয়েও অধম বলে বর্ণনা করেছে। কোরান এ শ্রেণীর লোকদের সম্পর্কে বলে :

) أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ(

২- তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং তা থেকেও অধম;তারাই হচ্ছে গাফেল (সুরা আরাফ-১৭৯)।

অপর একস্থানে কোরান তাদেরকে নিকৃষ্টতম প্রানীরূপে পরিচয় করিয়ে বলে :

) إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ(

-নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই নিকৃষ্টতম জীব যারা বধির,বোবা ও যারা বিবেকহীন (সুরা আনফাল -২২) ।

একটি ভুল ধারণার অপনোদন

হয়ত কেউ কেউ এমন কোন বাহানা দাঁড় করাতে পারেন যে,কোন সমস্যা সমাধানে মানুষ তখনই প্রচেষ্টা চালায়,যখন তা সমাধানের কোন পথ খুজে পাবার আশা থাকে। কিন্তু আমরা দ্বীন ও দ্বীন সস্পর্কিত কোন বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে,কোন ফল পাবার ব্যপারে খুব একটা আশাবাদী নই। ফলে সে সকল কর্মের পেছনেই আমাদের সময় ও শ্রম ব্যয় করায় প্রাধান্য দিব,যেগুলো থেকে ফল পাওয়ার ব্যাপারে আমরা অপেক্ষাকৃত বেশী আশাবাদী।

জবাবে এ ধরনের লোকদেরকে বলতে হয় :

প্রথমতঃ দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোর সমাধানের প্রত্যাশা কোনভাবেই অন্য সকল বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুর সমাধানের চেয়ে কম নয়। আমরা জানি যে,এমন অনেক বৈজ্ঞানিক বিষয় আছে যে,কয়েক দশক অবিরাম প্রচেষ্টার পর সেগুলোর সমাধান করা সম্ভব হয়েছে ।

দ্বিতীয়তঃ সম্ভাবনার (Probablity)গুরুত্ব কেবলমাত্র এক নির্বাহীর ( সম্ভাবনার পরিমাণ ) উপরই নির্ভর করে না , বরং সম্ভাব্যতার (Probable)পরিমাণও বিবেচনা করতে হয়। উদাহরণতঃ যদি কোন একটি ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা % এবং অপর একটিতে সম্ভাবনা ১০ % হয় ; কিন্ত যদি প্রথম ব্যবসায় সম্ভাব্য লাভের পরিমাণ ১০০০ টাকা এবং দ্বিতীয় ব্যবসায় সম্ভাব্য লাভের পরিমাণ ১০০ টাকা হয়,তবে প্রথম ব্যবসাটি দ্বিতীয় ব্যবসার উপর পাঁচগুণ বেশী গুরুত্ব পাবে,যদিও প্রথম ব্যবসায় সম্ভাবনার পরিমাণ ৫% ছিল যা দ্বিতীয় ব্যবসার সম্ভাবনার (১০%) অর্ধেক ।

যেহেতু দ্বীনের অনুসন্ধানে সম্ভাব্য লাভের পরিমাণ অসীম,সুতরাং চূড়ান্ত ফল লাভের সম্ভাবনা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তার সম্পর্কে অনুসন্ধান প্রচেষ্টার গুরুত্ব অন্য যে কোন বিষয়ের চেয়ে বেশী। কারণ,ঐগুলোর ফল সীমাবদ্ধ ।

অতএব,একমাত্র তখনই দ্বীন সম্পর্কে অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে,যখন মানুষ দ্বীনের অসারতা সম্পর্কে অথবা দ্বীন সস্পর্কিত বিষয়সমূহ সমাধান যোগ্য নয় বলে নিশ্চিত হবে। কিন্তু এ ধরনের নিশ্চয়তা কোথা হতে অর্জিত হবে ?

৩য় পাঠ

প্রকৃত মানুষ হওয়ার শর্ত

ভূমিকা

ইতিপূর্বে আমরা দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্ব এবং সত্য ধর্মকে চিনার জন্যে প্রচেষ্টা করার প্রয়োজনীয়তাকে সরল বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছি,যা লাভবান হওয়ার ফিতরাতগত চাহিদা এবং ক্ষতি থেকে দূরে থাকার প্রবণতার উপর নির্ভরশীল ছিল। এ প্রবণতা প্রত্যেকেরই আভ্যন্তরে বিদ্যমান এবং পারিভাষিক অর্থে,নির্ভুল প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্বলিত।

এখন আমরা ঐ বিষয়টিকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব। তবে এ প্রমাণটি যথার্থ ভূমিকাসমূহের উপর নির্ভরশীল। ঐ ভূমিকাসমূহের অবশেষ হল এরূপ :

যদি কেউ দ্বীন সম্পর্কে না ভাবে এবং সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাস পোষণ না করে তবে মানবিক উৎকর্ষে পৌঁছতে পারবে না। এমনকি তাকে মূলতঃ প্রকৃত মানুষরূপেও মনে করা যাবে না। অর্থাৎ প্রকৃত মানুষ হওয়ার শর্ত হল সঠিক বিশ্বদৃষ্টি এবং মতাদর্শের অনুসারী হওয়া ।

এ প্রমাণটি তিনটি ভূমিকার উপর নির্ভরশীল । যথা :

ক) মানুষ,এমন এক অস্তিত্ব,যে উৎকর্ষে পৌঁছতে চায়।

খ) মানুষের উৎকর্ষ বুদ্ধিবৃত্তি নির্ভর ঐচ্ছিক আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে ।

গ) বুদ্ধিবৃত্তি নির্ভর কার্যকরী বিধি-বিধান বিশেষ তাত্ত্বিক পরিচিতির আলোকে রূপ লাভ করে। এগুলোর মধ্যে বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতিত্রয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ অস্তিত্বের উৎস,জীবনের পরিণতি (পুনরুত্থান) এবং কল্যাণকামী কর্মসূচী লাভের জন্যে অনুমোদিত পথের (নবুয়্যত) শনাক্তকরণ । অর্থাৎ অস্তিত্ব পরিচিতি,মানব পরিচিতি,পথ পরিচিতি।

এখন আমরা উপরোক্ত ভূমিকাত্রয়ের প্রত্যেকটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

মানুষ, উৎকর্ষ সাধনে ইচ্ছুক :

যে কেউ তার আভ্যন্তরীণ ও আত্মিক প্রবণতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে,সে দেখতে পাবে যে,এগুলোর অধিকাংশের মূলে রয়েছে উৎকর্ষ সাধন। প্রকৃতপক্ষে কেউই পছন্দ করেনা যে,তার অস্তিত্বে কোন প্রকার ত্রুটি থাকুক। আর তাই সে নিজ থেকে সকল প্রকার স্বল্পতা,অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে কাংখিত উৎকর্ষে পৌঁছতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্যের কাছ থেকে তা গোপন করে রাখে।

মানুষের এ প্রবণতা যখন তার আপন ফিত্রাতের পথে পরিচালিত হয় তখন তা তার সকল প্রকার বস্তুগত ও আত্মিক বিকাশের কারণ রূপে প্রতীয়মান হয়। আর যদি কোন কারণে বা অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষের এ প্রবণতা বিচ্যুতির পথে পতিত হয় তবে তা অহংকার,অপরের তুলনায় নিজেকে বড় করে দেখা,প্রশংসা পাগল ইত্যাদি কুবৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশের কারণে পরিণত হয়।

যা হোক,উৎকর্ষ সাধনেচ্ছা হল মানব আত্মার গহীনে অবস্থিত এক শক্তিশালী ফিতরাতগত কারণ। অধিকাংশ সময়ই এর বা এর শাখাসমূহের স্বরূপ সচেতনভাবে বিবেচ্য হয়ে থাকে। কিন্তু কিঞ্চিৎ চিন্তা করলেই স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হবে যে,এদের সকলেরই মূলে রয়েছে উৎকর্ষ অনুসন্ধিৎসা ।

বুদ্ধিবৃত্তির অনুসরণের মাধ্যমেই মানুষ উৎকর্ষে পৌঁছতে পারে :

বৃক্ষরাজির পূর্ণতা লাভ,পারিপর্শিক অবস্থা ও বাহ্যিক কারণের উপর নির্ভরশীল এবং অপরিহার্যরূপে ঘটে থাকে। কোন উদ্ভিদই স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারে না এবং আপন ইচ্ছানুযায়ী ফল দিতে পারে না। কারণ তারা জ্ঞান ও প্রত্যয়ের অধিকারী নয় ।

প্রাণীদের পূর্ণতা লাভের ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও পছন্দের কিছুটা স্থান রয়েছে। তবে এ প্রত্যয় প্রাণীর সীমাবদ্ধ পারিপার্শিক চাহিদা ও অন্ধ সহজাত প্রবৃত্তির উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক প্রাণীরই ইন্দ্রিয়ানুভূতি অনুযায়ী স্বল্প বোধশক্তির আলোকে তা পরিগ্রহ করে থাকে ।

কিন্ত মানুষ উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ বৈশিষ্ট্য ছাড়াও দু টি স্বতন্ত্র আত্মিক বিশেষত্বের অধিকারী। অর্থাৎ একদিকে মানুষের ফিতরাতগত চাহিদা শুধুমাত্র পারিপার্শিক আসস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়,অপরদিকে তা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে ব্যবহার করে আপন জ্ঞানের পরিধিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তত করতে পারে। আর এ স্বতন্ত্র আত্মিক বিশেষত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষের প্রত্যয় সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সীমানাকে ছাড়িয়ে অসীমে পৌঁছে যেতে পারে।

যেমনি করে উদ্ভিদের বিশেষ উদ্ভিজ্জ শক্তির মাধ্যমে তার বিশেষ উৎকর্ষ সাধিত হয়;যেমনি করে প্রাণিজ উৎকর্ষ তার স্বভাবজাত প্রত্যয় এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির আশ্রয়ে ঘটে থাকে;তেমনি মানুষের বিশেষ মানবীয় উৎকর্ষ যা প্রকৃতপক্ষে তার আত্মিক বিকাশ,তাও তার সচেতন প্রত্যয়ের আশ্রয়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে অর্জিত হয়ে থাকে । আর মানুষের এ বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের চাহিদার বিভিন্ন স্তরকে শনাক্ত করতে পারে এবং একাধিক চাহিদার সমাহারে,সর্বোৎকৃষ্টকে প্রাধান্য দিতে পারে।

অতএব,আচার-আচরণ,মানবীয় হওয়ার অর্থ হল,মানবীয় বিশেষ ঐচ্ছিক প্রত্যয়ের ভিত্তিতে এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক নির্দেশনায় কার্যকর হওয়া। আর মানুষের যে সকল আচরণ শুধুমাত্র পাশবিক প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে সম্পাদিত হয়,সে সকল আচরণ পাশবিক আচরণরূপে পরিগণিত হয়। যেমন :গতিশক্তির প্রভাবে মানুষের শরীরে যে গতির সঞ্চার হয়,তা শারীরিক শক্তিরূপে বহিঃপ্রকাশ লাভ করে থাকে ।

বুদ্ধিবৃত্তি প্রসূত বিধি- বিধান তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর নির্ভরশীল :

ঐচ্ছিক কর্ম হল,কাংখিত ফলে উপনীত হওয়ার জন্য একটি মাধ্যম। আর তার ঐচ্ছিক মূল্যমান বিবেচিত উদ্দেশ্যের কাম্যতার মর্যাদা এবং আত্মিক উৎকর্ষের ক্ষেত্রে প্রভাবের মাত্রার অনুগামী। অনুরূপ যদি কোন কর্ম আত্মিক উৎকর্ষহীনতার কারণ হয়,তবে ঐ কমের্র মূল্যমান হবে নেতিবাচক।

অতএব,বুদ্ধিবৃত্তি কেবলমাত্র তখনই ঐচ্ছিক কর্ম সম্পর্কে বিচার ও তার মূল্যমান নির্ধারণ করতে পারবে যখন মানুষের উৎকর্ষ ও এর বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে অবগত থাকবে। র্অথাৎ যখন জানবে যে,মানুষ কীরূপ অস্তিত্ব? তার জীবন-পরিধির বিস্তৃতি কতটুকু ? সে উৎকর্ষের কোন স্তরে পৌঁছতে সক্ষম? জানবে যে,মানুষের অস্তিত্বের স্বরূপ কী এবং তার সৃষ্টির পিছনে কী উদ্দেশ্য বিদ্যমান ?

অতএব,সঠিক মতাদর্শের (অর্থাৎ ঐ মূল্যমান ব্যবস্থা যা ঐচ্ছিক কর্মসমূহের মূল্যমান নির্ধারণ করে থাকে) অনুসরণ সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও তার বিভিন্ন বিষয়ের সমাধানের উপর নির্ভর করে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়গুলো (অর্থাৎ সঠিক বিশ্বদৃষ্টির বিষয়সমূহ) সমাধান না করতে পারবে,ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের আচার-আচরণের মূল্যমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে না । যেমন : গন্তব্য জ্ঞাত না হওয়া পর্যন্ত তার জন্যে কোন পথ নির্ধারণ করাও অসম্ভব ।

অতএব,তাত্ত্বিক পরিচিতিসমূহ যেগুলো বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহকে রূপায়িত করে থাকে,প্রকৃতপক্ষে সেগুলো,মূল্যমান ব্যবস্থা ও বুদ্ধিবৃত্তি প্রসূত বিধি-বিধানের ভিত্তিরূপে পরিগণিত ।

উপসংহার :

এখন আমরা উপরোক্ত আলোচনার আলোকে দ্বীনের অনুসন্ধানের এবং সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শকে খুজে বের করার জন্যে,প্রচেষ্টার গুরুত্বকে নিম্নরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারি :

মানুষ ফিতরাতগতভাবেই স্বীয় উৎকর্ষ পিয়াস এবং নিজ কর্মের মাধ্যমে প্রকৃত উৎকর্ষে পৌঁছতে ইচ্ছুক। কিন্ত যে কর্মগুলো তাকে কাঙ্খিত উদ্দেশ্যের নিকটবর্তী করবে,সেগুলো সম্পর্কে জানার জন্যে সর্বপথমে তাকে আপন চূড়ান্ত উৎকর্ষকে চিনতে হবে। আর এ চূড়ান্ত উৎকর্ষের পরিচিতি,আপন অস্তিত্বের স্বরূপ এবং তার শুরু ও শেষ সম্পর্কে জানার উপর নির্ভর করে। অনুরূপ,বিভিন্ন কর্মের মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক সস্পর্ক ও উৎকর্ষের বিভিন্ন স্তরকে চিহ্নিত করতে হবে,যাতে স্বীয় মানবীয় উৎকর্ষ সাধনের জন্যে সঠিক পথকে বেছে নিতে পারে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত সে এ তাত্ত্বিক পরিচিতি (বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতি) সম্পর্কে অবহিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক আচার ও রীতি ব্যবস্থাকে (মতাদর্শ) গ্রহণ করতে পারবে না।

অতএব,সত্যধর্মকে শনাক্ত করার প্রচেষ্টা অতি গুরুত্বপর্ণ,যা সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শকেও সমন্বয় করে থাকে এবং এটি ব্যতিরেকে মানবীয় উৎকর্ষে পৌঁছা অসম্ভব। অনুরূপ যে সকল আচার-ব্যবহার উপরোল্লিখিত মূল্যবোধ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে সম্পন্ন না হয়,সে সকল আচার-ব্যবহার মানবীয় বলে পরিগণিত হতে পারে না। যারা সত্য ধর্মকে শনাক্তকরণের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে চেষ্টা করেন না অথবা শনাক্তকরণের পরও আক্রোশ ও অবাধ্যতাবশতঃ অস্বীকার করার চেষ্টা করেন এবং শুধুমাত্র পাশবিক চাহিদা ও ক্ষণস্থায়ী বস্তুগত আকর্ষণেই তুষ্ট থাকেন,প্রকৃত পক্ষে তারা পশু বৈ কিছুই নন। যেমন পবিত্র কোরআন এদের সম্পর্কে বলে :-

) يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ(

চতুষ্পদ প্রাণীর মত ভোগ ও ভক্ষণ করে (সুরা মুহাম্মদ (সঃ) - ১২)।

যেহেতু এ ধরনের ব্যাক্তিরা আপন মানবীয় যোগ্যতাসমূহের বিনাশ ঘটিয়ে থাকে ,সেহেতু তারা যথোপযুক্ত কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে । পবিত্র কোরানের ভাষায় :

) ذَرْهُمْ يَأْكُلُوا وَيَتَمَتَّعُوا وَيُلْهِهِمُ الْأَمَلُ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ(

তাদের ভোগ ও ভক্ষণ করতে দাও এবং পার্থিব যত স্বাধ-আকাঙ্খা পূরণ করতে দাও,অচিরেই তারা (এর পরিণাম ) দেখতে পাবে (সুরা হিজর-৩ )।”