আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)0%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 15558
ডাউনলোড: 4610

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15558 / ডাউনলোড: 4610
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

৪র্থ পাঠ

বিশ্বদৃষ্টি মৌলিক সমস্যাসমূহের সমাধান

ভূমিকা

যখনই মানুষ বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান এবং সত্য ধর্মের মূলনীতির পরিচিতি সম্পর্কে জানতে চাইবে,প্রথমেই এ প্রশ্নের সম্মুখীন হবে যে,কোন্ পথে এ বিষয়গুলোর সমাধান করতে হবে এবং কিরূপে সঠিক মৌলিক পরিচিতি সম্পর্কে জানা যেতে পারে? মূলতঃ পরিচিতির জন্যে কী কী উপায় বিদ্যমান? এদের কোনটিকে পরিচিতিসমূহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্যে নির্বাচন করতে হবে ?

এ বিষয়টির কৌশলগত ও পুঙ্খানুপঙ্খ আলোচনা ও পর্যালোচনার দায়িত্ব দর্শনের পরিচিতি বিজ্ঞান (Epistemology) বিভাগের। দর্শনের ঐ বিভাগে মানুষের বিভিন্ন পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করতঃ এদের মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এদের সবগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাব। সুতরাং আমাদের আলোচনা-সংশ্লিষ্ট যে বিষয়গুলো প্রয়োজনীয়,শুধুমাত্র সেগুলোর উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হব। তবে ঐ বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যলোচনা যথাস্থানে করা হবে।

পরিচিতির প্রকারভেদ :

পরিচিতিসমূহকে এক দৃষ্টিকোণ থেকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায় :

অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক পরিচিতি ( বিশেষ পারিভাষিক অর্থে ): এধরনের পরিচিতি ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাহায্যে লাভ করা যায়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বোধসমূহের বিমূর্তন (Abstraction)এবং সম্প্রসারণের (Generalization)ক্ষেত্রে স্বীয় ভূমিকা পালন করে থাকে অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক পরিচিতি বৈজ্ঞানিক বিষয়সমূহে যেমন : পদার্থ বিজ্ঞান , রসায়ণ বিজ্ঞান এবং জীব বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি : এধরনের পরিচিতি নির্বস্তুক ধারণার (মা কুলাতুচ্ছানিয়া) মাধ্যমে রূপ পরিগ্রহ করে এবং এ পরিচিতিতে বুদ্ধিবৃত্তি মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরীক্ষালব্ধ কোন কোন বিষয়,ধারণা লাভের উৎস অথবা যুক্তি পদ্ধতির কোন কোন প্রতিজ্ঞারূপে ব্যবহৃত হতে পারে। যুক্তিবিদ্যা,দর্শনশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র,এ পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত ।

ধর্মবিশ্বাসগত পরিচিতি : এধরনের পরিচিতি দ্বিস্তর বিশিষ্ট। বিশ্বস্ত উৎসের পূর্ব পরিচিতির—ভিত্তিতে এবং বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর বর্ণনা থেকে এধরনের পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকে। যে সকল বিষয়সমূহ সকল ধর্মের অনুসারীগণ ধর্মীয় নেতাগণের বক্তব্যের ভিত্তিতে গ্রহণ করে থাকেন,সে সকল বিষয়সমূহ এ পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত। কখনো কখনো এধরনের বিষয়বস্তর বিশ্বস্ততা,ইন্দ্রিয় ও পরীক্ষালব্ধ বিষয় বস্ত অপেক্ষা অধিকতর।

প্রত্যক্ষ অনুভূতিভিত্তিক পরিচিতি : এধরনের পরিচিতি পূর্ববর্তী সকল পরিচিতির ব্যতিক্রম এবং কোন প্রকার মস্তিষ্ক প্রসূত অনুধাবন ও আকৃতির মাধ্যম ব্যতীত অবিকল জ্ঞেয় সত্তার সাথেও সম্বন্ধ স্থাপন করে থাকে। এধরনের পরিচিতিতে কোন প্রকার ভুল-ত্রুটির স্থান নেই। তবে প্রত্যক্ষ অনুভূতিভিত্তিক ও আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক পরিচিতি বলে যা সাধারণতঃ বর্ণিত হয়ে থাকে,প্রকৃতপক্ষে তা হল এধরনের পরিচিতির মস্তিষ্কে অংকিত ব্যাখ্যারূপ যা ভুল-ত্রুটি বর্জিত নয়।

বিশ্বদৃষ্টির প্রকারভেদ :

ইতিপূর্বে পরিচিতির যে শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে,তার ভিত্তিতে বিশ্বদৃষ্টিকে নিম্নরূপে বিভক্ত করা যেতে পারে :

বৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টি : অর্থাৎ মানুষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হয়।

দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টি : যা যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে।

ধর্মীয় বিশ্বদৃষ্টি : যা ধর্মীয় নেতাগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাদের বক্তব্যকে গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে।

এরফানী বা আধ্যাত্মিক বিশ্বদৃষ্টি : যা উদ্ভাবন,অন্তর্জ্ঞান ও এশরাক্বীয় পথে অর্জিত হয়ে থাকে।

এখন,দেখতে হবে যে,বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়গুলোকে কি সত্যিকার অর্থে উল্লেখিত চার উপায়ে সমাধান করা সম্ভব? অতঃপর দেখতে হবে,এদের কোন একটির বিশেষত্ব ও অগ্রাধিকারের প্রশ্ন বিবেচনার পালা আসে কিনা ?

সমালোচনা ও ত্রুটিনিদের্শ :

ইন্দ্রিয় ও অভিজ্ঞতালব্ধ পরিচিতি বস্তুগত ও প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর সীমানায় কার্যকর। ফলে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত বিষয়বস্তুর আলোকে বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতিসমূহ ও তৎসংক্রান্ত বিষয়াদির শনাক্তকরণ সম্ভব নয়। কারণ,এধরনের বিষয়গুলো অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সীমাবহির্ভূত এবং কোন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই এ বিষয়গুলোর সস্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মন্তব্য করতে পারে না। যেমন : খোদার অস্তিত্বকে পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা বা বর্জন (আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন) করা অসম্ভব। কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার হস্ত এত ক্ষুদ্র যে,অতিপ্রকৃতির আঁচলকে স্পর্শ করতে অপারগ এবং আপন বস্তুগত বিষয়ের সীমাবহির্ভূত কোন কিছুকে প্রতিষ্ঠা বা বর্জন করতে অক্ষম।

অতএব, ধভিজ্ঞতালব্ধ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টি’ (পারিভাষিক অর্থে বিশ্বদৃষ্টি,যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) মরীচিকা বৈ কিছুই নয়। সুতরাং প্রকৃত অর্থে একে বিশ্বদৃষ্টি’ নামকরণ করা যায় না। তবে সর্বোপরি একে বস্তুজগত পরিচিতি বলা যেতে পারে। এছাড়া এধরনের পরিচিতি বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক প্রশ্নসমূহের জবাব দানেও অক্ষম।

কিন্ত যে সকল পরিচিতি ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে অর্জিত হয় (যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) সেগুলো দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এবং পূর্বেই ঐগুলোর উৎস বা উৎসসমুহের উপর আস্থা স্থাপন করতে হয়। অর্থাৎ প্রথমে কারো নবুওয়াত প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে;অতঃপর তার বাণী বৈধ বলে পরিগণিত হবে। তবে সর্বাগ্রে বাণী প্রেরক অর্থাৎ মহান আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে হবে । আর এটা সুস্পষ্ট যে,বাণী প্রেরকের মূল অস্তিত্ব এবং তদনুরূপ বাণী বাহকের নবুওয়াতকে বানী নির্ভর দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় না। যেমন : বলা যাবে না যে,যেহেতু কোরা ন বলে খোদা আছেন’ সেহেতু তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণিত হল। তবে খোদার অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর এবং ইসলামের নবীর শনাক্তকরণ ও কোরা নের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর,অন্যান্য গৌণ বিশ্বাসসমূহকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে কার্যকরী বিধি-নিষেধ সমূহও বিশ্বস্ত সংবাদদাতা ও বিশ্বস্তসূত্রের মাধ্যমে গৃহীত হতে পারে। কিন্ত মৌলিক বিশ্বাসমূহকে তৎপূর্বে অন্য কোন উপায়ে— সমাধান করতে হবে।

অতএব,ধর্মবিশ্বাসগত পরিচিতিও বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহের সমাধানে অক্ষম। তবে এরফানী ও এশরাক্বী (اشراقی ) পদ্ধতির ব্যাপারে অনেক বক্তব্য রয়েছে :

প্রথমতঃ বিশ্বদৃষ্টি হল এক প্রকার পরিচিতি,যা মস্তিষ্কপ্রসূত (ذهنی ) ভাবার্থসমূহ থেকে রূপ পরিগ্রহ করে। কিন্ত অন্তর্জ্ঞানের ক্ষত্রে মস্তিষ্কপ্রসূত বোধদ্বয়ের কোন স্থান নেই। অতএব এ ধরনের ভাবার্থসমূহকে অন্তর্জ্ঞানের বরাত দেয়া উদাসীনতা ও এর নামান্তর বৈ কিছুই নয়।

দ্বিতীয়তঃ অনর্—জ্ঞানের ব্যাখ্যা এবং ভাষা ও ভাবার্থের কলেবরে তাদের বর্ণনা বিশেষ মানস-দক্ষতার উপর নির্ভরশীল,যা সুদীর্ঘ সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা এবং দার্শনিক বিশ্লেষণ ব্যতিরেকেঅসম্ভব। যারা এধরনের অভিজ্ঞতার অধিকারী নন প্রকৃতপক্ষে তারা সদৃশ শব্দ ও ভাবার্থকে ব্যবহারকরে থাকেন যা বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার এক বৃহত্তর কারণ।       তৃতীয়তঃ প্রকৃতপক্ষে যা অন্তর্জ্ঞানের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়,তা মস্তিষ্কে অংকিত তার কল্পিত চিত্র ও বর্ণনা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এমনকি স্বয়ং অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির জন্যেও ত্রুটিযুক্ত হয়ে থাকে।

চতুর্থতঃ ঐ সকল বাস্তবতা,যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যাখ্যা বিশ্বদৃষ্টি বলে পরিচিত;তাতে উপনীত হওয়ার জন্যে বর্ষপরস্পরায় এরফানী সাধনার প্রয়োজন। আর গভীর সাধনালব্ধ এ প্রক্রিয়ার (যা বাস্তব পরিচিতিসমূহের অন্তর্ভূক্ত) অনুমোদন,তাত্ত্বিক ভিত্তি ও বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহের উপর নির্ভরশীল। অতএব,সাধনার প্রারম্ভেই এ বিষয়গুলোর সমাধান অনিবার্য। আর এ প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে অন্তর্জ্ঞানগত পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকে। মূলতঃ প্রকৃত এরফান তার জন্যেই প্রযোজ্য,যিনি মহান সৃষ্টিকর্তার দাসত্বের পথে বিনীতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন। আর এ ধরনের প্রচেষ্টা প্রভুর পরিচিতি,তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল ।

সিদ্ধান্ত :

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে,বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহের সমাধান যারা খুজে থাকেন তাদের জন্যে একমাত্র উন্মুক্ত পথ হল বুদ্ধিবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধির পথ। ফলে এর আলোকে বলতে হয়,দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিই হল প্রকৃত বিশ্বদৃষ্টি।

তবে মনে রাখা উচিৎ যে,উল্লেখিত বিষয়সমূহের সমাধানকে বুদ্ধিবৃত্তিক পথে সীমাবদ্ধকরণ ও দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিকেই একমাত্র বিশ্বদৃষ্টিরূপে পরিগণনের অর্থ এ নয় যে,সঠিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি লাভের জন্যে সকল দার্শনিক বিষয়েরই সমাধান করতে হবে। বরং কয়েকটি সরল দার্শনিক বিষয় যেগুলো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সেগুলোর সমাধানই খোদার অস্তিত্ব (যা বিশ্বদৃষ্টির মৌলিকতম বিষয় বলে পরিগণিত) প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট। তবে এ ধরনের বিষয়সমূহের উপর পারদর্শিতা এবং সকল প্রকার সমস্যা ও দ্বিধার উত্তরদানের ক্ষমতা অর্জনের জন্যে অধিকতর দার্শনিক পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার মৌলিক সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্যে অর্থপূর্ণ পরিচিতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতিতে সীমাবদ্ধকরণের অর্থ এ নয় যে,অন্যান্য জ্ঞাত বিষয়সমূহ,এ বিষয়গুলোর সমাধানের ব্যাপারে ব্যবহৃত হবে না। বরং অধিকাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ,ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে প্রতিজ্ঞারূপে প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমনঃ দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়সমূহ ও গৌণ বিশ্বাসগত বিষয়সমূহের সমাধানের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসগত পরিচিতিকে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এগুলোকে কিতাব ও সুন্নতের (দ্বীনের বিশ্বস্ত উৎস) বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে প্রমাণ করা যেতে পারে ।

পরিশেষে,সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শে উপনীত হওয়ার পর গভীর আধ্যাত্মিক সাধনার পর্যায়সমূহ অতিক্রম করতঃ উদ্ঘাটন ও পর্যবেক্ষণের (অন্তর্চক্ষু) স্তরে পৌঁছা যায় এবং বুদ্ধিবৃত্তির যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত এমন অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কে,মস্তিষ্কগত ভাবার্থসমূহের সাহায্য ব্যতীতই অবগত হওয়া সম্ভব।

৫ম পাঠ

খোদাপরিচিতি

ভূমিকা :

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে,দ্বীনের মূলনীতিগুলো বিশ্ব-সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস থেকে রূপ পরিগ্রহ করে এবং ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টি ও বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির মধ্যে মূল পার্থক্যও এ বিশ্বাসের (সৃষ্টিকর্তার অস্তিত) উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে।

অতএব,সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্যে সর্বপথমেই যে প্রশ্নটি উপস্থাপিত হয় এবং সর্বাগ্রেই যার সঠিক উত্তর জানতে হয় তা হল,খোদার অস্তিত্ব আছে কিনা? আর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে (যা পূর্ববর্তী পাঠে আলোচিত হয়েছে) বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রয়োগ করতে হবে,যাতে করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়-চাই তার ফল হোক ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক।

যদি এ অনুসন্ধানের ফল ইতিবাচক হয়,তবে খোদা সংক্রান্ত গৌণ বিষয়গুলোকে (একত্ব,ন্যায়বিচার এবং খোদার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য) বিবেচনার পালা আসে। অনুরূপভাবে যদি অনুসন্ধানের ফল নেতিবাচক হয় তবে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর তখন দ্বীন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গৌণ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।

প্রত্যক্ষ পরোক্ষ পরিচিতি :

মহান আল্লাহ সম্পর্কে দু ধরনের পরিচিতির ধারণা পাওয়া যায় : একটি হল প্রত্যক্ষ পরিচিতি এবং অপরটি হল পরোক্ষ পরিচিতি ।

খোদার প্রত্যক্ষ পরিচিতি বলতে বুঝায়-মানুষ মস্তিষ্কগত ভাবার্থের সাহায্য ব্যতিরেকেই একধরনের অন্তর্জ্ঞান ও আভ্যন্তরীণ অনুভূতির মাধ্যমে খোদার সাথে পরিচিত হয় ।

এটা স্বতঃসিদ্ধ যে,যদি কেহ খোদা সম্পর্কে সচেতন অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকে (যেরূপ অনেক উচ্চপর্যায়ের আরেফগণ দাবী করে থাকেন তবে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। কিন্ত (যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে ) এধরনের প্রত্যক্ষজ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞান সাধারণ কোন ব্যক্তির জন্যে কেবলমাত্র তখনই সম্ভব,যখন সে আত্মগঠন ও আধ্যাত্মিক সাধনার পর্যায়গুলো অতিক্রম করবে। তবে এর দুর্বল পর্যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উপস্থিত থাকলেও যেহেতু অবস্থায় নেই,সেহেতু তা সচেতন বিশ্বদৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্যে যথেষ্ট নয়।

পরোক্ষ পরিচিতি বলতে বুঝায় যে,মানুষ সামগ্রিক ভাবার্থের (সৃষ্টিকর্তা,অমুখাপেক্ষী,সর্বশক্তিমান,সর্বজ্ঞা) মাধ্যমে মহান আল্লাহ সম্পর্কে মস্তিষ্কগত পরিচিতি ও এধরনের অদৃশ্যগত’অর্থ অনুধাবন করে থাকে। আর এভাবে সে বিশ্বাস করে যে,এধরণের অস্তিত্ব বিদ্যমান (যিনি এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন )। অতঃপর,অন্যান্য পরোক্ষ পরিচিতি এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে বিশ্বদৃষ্টির সাথে সংগতিপূর্ণ একশ্রেণীর বিশ্বাস প্রবর্তিত হয়ে থাকে।

যা সরাসরি বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যবেক্ষণ ও দার্শনিক যুক্তি-প্রামাণের মাধ্যমে অর্জিত হয় তা-ই হল পরোক্ষ পরিচিতি। কিন্ত যখন এধরণের পরিচিতি অর্জিত হয় কেবলমাত্র তখনই মানুষের জন্যে সাবগতিক প্রত্যক্ষ পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকে।

ফিতরাতগত পরিচিতি :

ধর্মীয় নেতাগণ,আরেফগণ এবং মনীষীগণের অধিকাংশ বক্তব্যেই আমরা খুজে পাই যে,খোদা পরিচিতি ফিতরাতগত,অর্থাৎ মানুষ ফিতরাতগতভাবেই খোদাকে চিনে থাকে। সুতরাং উপরোক্ত বিবরণসমূহের সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়ার নিমিত্তে ফিতরাত’শব্দটির ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন মনে করি।

ফিতরাত,একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হল সৃষ্টি প্রকরণ’এবং কোন বিষয় ফিতরাত সংশ্লিষ্ট (ফিতরাতের সাথে সম্বন্ধযুক্ত) বলে পরিগণিত হবে তখনই,যখন বিদ্যমান সৃষ্টি এদেরকে ধারণ করবে। সুতরাং এদের জন্যে তিনটি বিশেষত্ব বিবেচনা করা যেতে পারে :

১। প্রত্যেক শ্রেণীর ফিতরাগত বিশেষত্ব ঐ শ্রেণীর সকল সদস্যের মধ্যে পাওয়া যায়,যদিও তীব্রতা ও ক্ষীণতার দৃষ্টিকোণ থেকে এদের মাত্রাভেদ পরিলক্ষিত হয় ।

২। ফিতরাতগত বিষয়সমূহ তাদের ইতিহাস পরিক্রমায় সর্বদা স্থির এবং এমন নয় যে,ইতিহাসের একাংশে সৃষ্টির ফিতরাত এক বিশেষত্ব বিশিষ্ট,আর অন্য অংশে অপর এক বিশেষত্ব বিশিষ্ট।

৩। ফিতরাতগত বিষয়সমূহ যে দৃষ্টিকোণে ফিতরাত সম্বন্ধীয় এবং সৃষ্টি প্রকৃতি কর্তৃক ধারণকৃত সে দৃষ্টিকোণে শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নেই,যদিও এদের দৃঢ়ীকরণ ও দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

মানুষের ফিতরাতগত বিশেষত্বকে দু শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে :

ক) ফিতরাতগত পরিচিতি,যার সাথে প্রত্যেক মানুষই কোন প্রকার শিক্ষা-দীক্ষা ব্যতিরেকেই পরিচিত হয়ে থাকে।

খ) ফিতরাতগত প্রবণতা ও চাহিদা যা সৃষ্টির প্রত্যেক সদস্যের মধ্যেই বিদ্যমান।

অতএব,যদি এমন এক ধরনের খোদা পরিচিতি প্রত্যেকের মধ্যেই থেকে থাকে যে,প্রশিক্ষণও আয়ত্তকরণের প্রয়োজন নেই তবে,তাকে ফিতরাতগত খোদা পরিচিতি”নামকরণ করা যেতে পারে। আর যদি,খোদার প্রতি এবং খোদার উপাসনার প্রতি এক ধরনের প্রবণতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে,তবে তাকে খোদার ফিতরাতগত উপাসনা’বলা যেতে পারে।

দ্বিতীয় পাঠে আমরা উল্লেখ করেছি যে,অধিকাংশ পন্ডিতগণ দ্বীন এবং খোদার প্রতি মানুষের প্রবণতাকে মানুষের মানসিক বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং একে ধর্মানুভূতি’ বা‘ধর্মানুরাগ’নামকরণ করেছেন। এখন আমরা সংযোজন করব যে,খোদা পরিচিতিও মানুষের ফিতরাতগত চাহিদারূপে জ্ঞাত হয়েছে। কিন্ত খোদার ফিতরাতগত উপাসনা’ যেমন সচেতন প্রবণতা নয় তেমনি ফিতরাতগত খোদা পরিচিতিও”সচেতন পরিচিতি নয় যে,কোন সাধারণ ব্যক্তিকে খোদার শনাক্তকরণের জন্যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা থেকে অনির্ভরশীল করবে।

তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে,যেহেতু প্রত্যেকেই অন্ততঃ এক ক্ষীণ মাত্রায় ফিতরাতগত প্রত্যক্ষ পরিচিতির অধিকারী সেহেতু সামান্য একটু চিন্তা ও যুক্তির অবতারণাতেই খোদার অস্তিতকে স্বীকার করে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে অবচেতন স্তরের অন্তর্জ্ঞান ভিত্তিক পরিচিতিকে সুদৃঢ় করে সচেতন স্তরে পৌঁছাতে পারে ।

উপসংহারে বলা যায় : খোদা পরিচিতি ফিতরাতগত হওয়ার অর্থ হল এই যে,মানুষের অন্তর খোদার সাথে পরিচিত এবং তার আত্মার গভীরে খোদার সজ্ঞাত পরিচিতির জন্যে এক বিশেষ উৎস বিদ্যমান,যা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হতে সক্ষম। কিন্তু এ ফিতরাতগত উৎস সাধারণ ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে এমন অবস্থায় নেই যে,তাদেরকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি থেকে অনির্ভরশীল করবে।