৬ষ্ঠ পাঠ
খোদা পরিচিতির সরল উপায়
খোদাকে
চিনার
উপায়সমূহ
:
মহান প্রভুকে চিনার জন্যে একাধিক উপায় বিদ্যমান। দর্শনের বিভিন্ন বইয়ে,কালামশাস্ত্রে,ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন ভাষ্যে এবং ঐশী কিতাবসমূহেও এগুলো (উপায়) সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ যুক্তি-প্রমাণসমূহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পারস্পরিকভাবে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। যেমন : কোন কোন ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়সমূহ প্রতিজ্ঞা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে;যেখানে অন্য কোন ক্ষেত্রে খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়সমূহ ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কেউ কেউ সরাসরি প্রজ্ঞাবান প্রভুর অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন;যেখানে অন্যান্যরা শুধুমাত্র এমন এক অস্তিত্বময়কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যার অস্তিত্ব অপর কোন অস্তিত্বময়ের উপর নির্ভরশীল নয় (অর্থাৎ অবশ্যসম্ভাবী অস্তিত্ব)এবং তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে চিহ্নিত করার জন্যে অপর এক শ্রেণীর যুক্তির অবতারণা করে থাকেন।
এক দৃষ্টিকোণ থেকে খোদা পরিচিতির যুক্তি-প্রমাণসমূহকে কোন এক নদী পারাপারের জন্যে বিদ্যমান বিভিন্ন পথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এগুলোর কোন কোনটি কাঠের তৈরী সাধারণ পুল যা নদীর উপর দিয়ে চলে গিয়েছে এবং লঘু ভারবিশিষ্ট কোন ব্যক্তি খুব সহজেই একে অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। আবার কোন কোনটি হল প্রস্তর নির্মিত সুদৃঢ় এবং সুদীর্ঘ পুলের মত যার অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বেশী। কোন কোনটি আবার আঁকাবাঁকা,উঁচু-নীচু এবং সুদীর্ঘ টানেল বিশিষ্ট রেলপথের মত,যা গুরুভারের ট্রেনের জন্যে তৈরী করা হয়েছে।
যে সকল ব্যক্তি মুক্ত মস্তিষ্কের (خالی الذهن
) অধিকারী,তারা অত্যন্ত সহজ উপায়েই আপন প্রভুকে চিনে তাঁর (প্রভুর) উপাসনায় নিয়োজিত হতে পারে। কিন্ত যদি কেউ সন্দেহের গুরুভার স্কন্ধে ধারণ করে,তবে তাকে প্রস্তর নির্মিত পুল অতিক্রম করতে হবে। আবার যদি কেউ সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বোঝা বহন করে চলে,তবে তাকে এমন কোন পথ নির্বাচন করতে হবে যা শত উঁচ-নীচু ও আঁকা-বাঁকা সত্বেও মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্মিত।
আমরা এখানে সর্বপথমে খোদা-পরিচিতির সরল পথের প্রতি ইঙ্গিত করব। অতঃপর কোন একটি মাধ্যম সম্পর্কে বর্ণনা করব। কিন্ত দর্শনের মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আঁকা-বাঁকা পথটি শুধুমাত্র তাদেরকেই অতিক্রম করতে হবে,যাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য সন্দেহের দ্বারা সন্দিগ্ধ হয়ে আছে। অথবা তাদের মস্তিষ্ককে সন্দেহ মুক্তকরণের মাধ্যমে পশ্চাদ্ধাবন ও পথভ্রষ্টতার হাত থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করতে হবে ।
সরল
উপায়ের
বৈশিষ্ট্যসমূহ
:
খোদা-পরিচিতির সরলপথের একাধিক বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলির মধ্যে নিম্নলিখিতগুলো গুরুত্বপূর্ণ :
১। এ পথ কোন প্রকার জটিল ও কৌশলগত প্রতিজ্ঞার (مقدمة
) উপর নির্ভরশীল নয় এবং সরলতম বক্তব্যসমূহই এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে । ফলে,যে কোন স্তরের ব্যক্তিবর্গের পক্ষেই অনুধাবনযোগ্য।
২। এ পথ প্রত্যক্ষভাবে প্রজ্ঞাবান ও পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে থাকে,যা অনেক দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রগত যুক্তি-পথের ব্যতিক্রম। ঐ সকল কালামশাস্ত্র ও দার্শনিক যুক্তিতে সর্বপ্রথমেই‘
অনিবার্য অস্তিত্ব’ নামে এক অস্তিত্বময় বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তারপর তার জ্ঞান,শক্তি,প্রজ্ঞা,সৃজন ক্ষমতা,প্রতিপালকত্ব এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে অপর কোন যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করা আবশ্যক।
৩। এ পথ,অন্য সকল কিছুর চেয়ে ফিতরাতকে জাগ্রত করা ও ফিতরাতগত জ্ঞানের অবহিতকরণের ব্যাপারে ভূমিকা রাখে। এ (ফিতরাতগত জ্ঞানের অবহিতকরণ) বিষয়গুলোর উপর চিন্তার ফলে এমন এক ইরফানী অবস্থা মানুষের দিকে হস্ত প্রসারিত করে যেন খোদার হস্তকে বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অবলোকন করে থাকে -সেই হস্ত যার সাথে তার ফিতরাত পরিচিত।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং ঐশী ধর্মসমূহের প্রবক্তাগণ এ পথকে সাধারণ জনসমষ্টির জন্য নির্বাচন করেছেন এবং সকলকে এ পথ অতিক্রম করার জন্যে আহবান জানিয়েছেন;আর অন্যান্য পদ্ধতিসমূহকে,হয় বিশেষ কোন ক্ষেত্রের জন্য একান্তভাবে বরাদ্দ করেছেন,অথবা নাস্তিক্য চিন্তাবিদ ও বস্তুবাদী দার্শনিকদের সাথে তর্ক-বিতর্কের সময় প্রয়োগ করেছেন।
পরিচিত
নির্শনসমূহ
:
খোদা পরিচিতির সরল পথ হল,এ বিশ্বে বিদ্যমান খোদার নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করা এবং কোরানের ভাষায়“
আল্লাহর আয়াতসমূহ সম্পর্কে চিন্তাকরণ”। বিশ্ববহ্মান্ডের সকল বিষয়বস্ত্র এবং মানব অস্তিত্বে উপস্থিত বিষয় গুলো যেন পরিচিতির কাঙ্খিত নিদর্শন এবং মানব মানসের সূচক,সে অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দুর দিকে পথ নির্দেশ করে,যে অস্তিত্ব সর্বদা সর্বস্থলে উপস্থিত।
পাঠকমন্ডলী,যে বইটি এখন আপনাদের হস্তে রয়েছে তাও তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনসমূহেরই একটি। যদি তা-ই না হবে তবে কেন এ বইটি পড়ার সময় এর সচেতন ও অভিপ্রায়ী লেখক সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারছেন? কখনো কি এটা সম্ভব বলে মনে করেছেন যে,এ বইটি এক শ্রেণীর বস্তুগত,উদ্দেশ্যহীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে অস্তিত্বে এসেছে এবং এর কোন অভিপ্রায়ী লেখক নেই? এটা ভাবা কি বোকামী নয় যে,কোন একটি ধাতব খণিতে বিস্ফোরণের ফলে ধাতব কণিকাগুলো বর্ণমালায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং ঘটনাক্রমে পত্রপৃষ্ঠে সন্নিবেশিত হয়ে লিখনের সৃষ্টি হয়েছে;অতঃপর অপর একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুশৃংখলিত ও বাঁধাইকৃত হয়ে একশত খণ্ডের একটি বিশ্বকোষের উৎপত্তি হয়েছে ?
কিন্ত জ্ঞাত ও অপ্সাত রহস্যময় ও পান্ডিত্যপূর্ণ এ মহাবিশ্বের উৎপত্তির ঘটনাকে নিছক দুঘটনা বলে মনে করা উপরোল্লিখিত বিশ্বকোষের উৎপত্তির ঘটনার চেয়ে সহস্রবার বোকামীর শামিল ।
হ্যাঁ,প্রতিটি পরিকল্পিত বিন্যাস ব্যবস্থাই তার পরিকল্পনাকারীর নিদর্শনস্বরূপ। আর এ ধরনের বিন্যাস ব্যবস্থা পৃথিবীর সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় এবং সর্বদা এমন এক সামগ্রিক শৃঙ্খলাই প্রকাশ করে যে,এক প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তা একে অস্তিত্বে এনেছেন এবং সর্বাবসস্থায় তিনি এর পরিচালনায় নিয়োজিত।
ফুলগুলো যে পুষ্পকাননে ফুটেছে,আর মাটি কর্দমার মাঝে রঙ বেরঙ সাজে ও সুগন্ধি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে;ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজ থেকে ফলবৃক্ষ যে অঙ্কুরিত হচ্ছে এবং প্রতিবছর অজস্র সংখ্যক সুবর্ণ,সুগন্ধ ও সুস্বাদু ফল ধারণ করছে;তদ্রূপ নানা বর্ণ,নানা বিশেষত্ব ও নানারূপের অন্যান্য বৃক্ষরাজি ইত্যাদি সকল কিছুই তাঁরই (খোদার ) অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে ।
অনুরূপ,পুষ্পশাখায় বুলবুলি যে গান গেয়ে যাচ্ছে;ডিম থেকে বের হয়ে মুরগীছানা যে পৃথিবীতে বিচরন করছে;নবজাতক গোবৎস যে মাতৃস্তন চোষণ করছে;দুগ্ধ মাতৃস্তনে নবজাতকের-পানের জন্যে যে সঞ্চিত হচ্ছে ইত্যাদি সর্বদা এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ বহণ করে থাকে।
সত্যিই,কি এক আশ্চর্য যোগসূত্র ও বিস্ময়কর অভিসন্ধি রয়েছে যুগপৎ শিশু জন্ম ও মাতৃস্তনে—দুগ্ধ সঞ্চারের মধ্যে।
মৎসসমূহ যে প্রতিবছর ডিম পাড়ার জন্যে শত শত কিলোমিটার পথ প্রথমবারের মত অতিক্রম করে;সামুদ্রিক প্রাণীসমূহ যে অসংখ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদের মাঝে আপন নীড়কে চিনে নেয়,এমনকি একবারের জন্যেও ভুলবশতঃ অপরের বাসায় প্রবেশ করে না,মৌমাছি যে,প্রত্যহ প্রাতে মৌচাক থেকে বের হয়ে যায় আর সুগন্ধযুক্ত ফুলে-ফলে বিচরণ করার জন্যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর গোধুলী লগ্নে যে পুনরায় স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে ইত্যাদি তাঁরই নিদর্শন ।
বিস্ময়ের ব্যপার হল,যেমনি মৌমাছিরা তেমনি দুগ্ধবতী গাভী ও ছাগলরা প্রত্যেকেই সর্বদা নিজের প্রয়োজনের চেয়েও অধিক মধু ও দুগ্ধ উৎপাদন করে থাকে,যাতে করে মানুষ এ সুস্বা দু উপাদেয় থেকে উপকৃত হতে পারে!
কিন্তু পরিহাস,অকৃতজ্ঞ মানুষ নিজ বৈভবের পরিচিত মালিককে অপরিচিত বলে মনে করে এবং তাঁর সম্পর্কে তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়!
স্বয়ং এ মানবদেহেও বিস্ময়কর ও সুনিপূন কীর্তির প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। সংশ্লিষ্ট অঙ্গের মাধ্যমে শরীরীয় সংগঠন;সংশ্লিষ্ট উপাঙ্গের মাধ্যমে অঙ্গ সংগঠন;সংশ্লিষ্ট মিলিয়ন মিলিয়ন বিশেষ জীবন্ত কোষের মাধ্যমে উপাঙ্গ সংগঠন;প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের নির্দিষ্ট পরিমাণের সমন্বয়ে কোষ সংগঠন;শরীরের যথাস্থানে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সংস্থাপন;অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের অভিপ্রেত কর্মতৎপরতা। যেমন : ফুসফুসের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ ও লোহিত রক্তকণিকার মাধ্যমে তা দেহের বিভিন্ন কোষে সঞ্চালন,যকৃতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গ্লুকোজ উৎপাদন,নূতন কোষ সমূহের সরবরাহের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের নিরাময় সাধন;শ্বেতকোষের মাধ্যমে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়া ও রোগজীবাণুকে প্রতিহতকরণ;একাধিক গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ,যেগুলো প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশের কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ইত্যাদি সকল কিছু তাঁরই অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে ।
এই যে বিস্ময়কর বিন্যাস ব্যবস্থা যার সঠিক রহস্য উদঘাটনে শতসহস্র সংখ্যক বিজ্ঞানী কয়েক দশকাব্দী পথ অতিক্রম করার পরও ব্যর্থ হয়েছে -কার মাধ্যমে তা সৃষ্টি হয়েছে ?
প্রতিটি কোষই একটি ক্ষুদ্র ব্যবস্থার সংগঠনে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং এক শ্রেণীর কোষসমষ্টি উপাঙ্গসমূহের সংগঠনে অংশ নেয়,যা অপেক্ষাকৃত এক বৃহৎ ব্যবস্থার সংগঠনে অংশ নেয়;অনুরূপ এ ধরনের একাধিক জটিল ব্যবস্থার সমন্বয়ে অভিপ্রেত শারীরিক সামগ্রিক ব্যবস্থারূপ পরিগ্রহ করে। কিন্ত এখানেই এ ঘটনার শেষ নয়,বরং অগণিত প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ অস্তিত্বের সমন্বয়ে বিশ্ব পকৃতি নামে অশুল-প্রান্তহীন এক বৃহত্তম ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়,যা একক পান্ডিত্যপূর্ণ পরিকল্পনার ছায়াতলে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
)
ذَلِكُمُ اللَّهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ(
তিনিই;অতএব কিভাবে তোমরা সত্য হতে বিচ্যুত হও (সূরা আনআম-৯৫)!
এটা নিশ্চিত যে,মানুষের জ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তার লাভ করবে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়বস্তুর মধ্যে সমন্বয় ও নীতি যতই আবিস্কৃত হবে,ততই সৃষ্টির রহস্য উন্মোচিত হতে থাকবে। তবে প্রকৃতির এ সরল সৃষ্টিসমূহ ও সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করাই নিষ্কলুষ ও নির্মল হৃদয়ের জন্যে যথেষ্ট।