আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)21%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 16222 / ডাউনলোড: 4961
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

৮ম পাঠ

আল্লাহর গুণসমূহ

ভূমিকা :

পূর্ববর্তী পাঠসমূহে বলা হয়েছে যে,অধিকাংশ দার্শনিক যুক্তির সারবত্তা হল অনিবার্য অস্তিত্ব’নামক এক অস্তিত্বশীলকে প্রতিপাদন করা। আর অপর এক শ্রেণীর যুক্তির অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তা‘হ্যাঁ-বোধক’ও না-বোধক’গুণগুলো প্রমাণিত হয়ে থাকে। এরূপে মহান আল্লাহকে তাঁর বিশেষগুণসমূহ অর্থাৎ যেগুলো তাঁকে সকল সৃষ্টি থেকে স্বতন্ত্র করে সেগুলোসহ শনাক্ত করা হয়ে থাকে। অন্যথায় শুধুমাত্র অনিবার্য অস্তিত্ব’হওয়াই তাঁর (আল্লাহর) পরিচিতির জন্যে যথেষ্ট নয়। কারণ কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে,পদার্থ অথবা শক্তির মত বিষয়গুলোও অনিবার্য অস্তিত্বের দৃষ্টান্ত হতেপারে। আর এ কারণে একদিকে যেমনি,প্রভুর না-বোধক’গুণগুলোকে প্রমাণ করতে হবে যাতে বোধগম্য হয় যে অনিবার্য অস্তিত্ব’বস্তুর জন্যে নিদিষ্ট গুণে গুণান্বিত হওয়া থেকে পবিত্র এবং কোন সৃষ্টির সদৃশ হতে পারে না;তেমনি অপর দিকে তাঁর হ্যাঁ- বোধক’গুণগুলোকে ও প্রমাণ করতে হবে,যাতে উপাসনার জন্যে তাঁর উপযুক্ততা প্রতিভাত হয় এবং অন্যান্য বিশ্বাস যেমন : নবুওয়াত,কিয়ামত ও এদের শাখাসমূহকে প্রমাণ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

পূর্ববর্তী যুক্তিগুলো থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, অনিবার্য অস্তিত্ব’কারণের উপর নির্ভরশীল নয় এবং সম্ভাব্য অস্তিত্বসমূহের জন্যই কারণ’প্রয়োজন। অর্থাৎ অনিবার্য অস্তিত্বের দু টি গুণ প্রতিষ্ঠিত হল : একটি হল,অপর যে কোন অস্তিত্বশীলের উপর তাঁর অনির্ভরশীলতা। কেননা যদি অপর কোন অস্তিত্বশীলের উপর ন্যূনমত নির্ভরশীলতাও থাকে,তবে ঐ অস্তিত্বশীল তাঁর কারণ রূপে পরিগণিত হবে। যেহেতু আমরা জেনেছি যে,কারণের অর্থই (দর্শনের পরিভাষায়) হল,অপর কোন অস্তিত্বশীল তার উপর নির্ভরশীল হবে। আর অপর প্রতিষ্ঠিত গুণটি হল,সকল সম্ভাব্য অস্তিত্বই,তার (অনিবার্য অস্তিত্ব) কার্য (معلول )এবং তার উপর নির্ভরশীল এবং তিনিই হলেন তাদের সৃষ্টির জন্যে সর্বপথম কারণ ।

এখন,উপরোল্লিখিত দু উপসংহার থেকে তাদের প্রত্যেকের অবিয়োজ্য বিষয়সমূহকে বর্ণনা করব এবং অনিবার্য অস্তিত্বের’ হ্যাঁ-বোধক’ও না-বোধক’গুণসমূহকে প্রতিপাদন করব। তবে তাদের (হ্যাঁ-বোধক ও না-বোধক গুণ) প্রতিটির জন্যে দর্শন ও কালামশাস্ত্রে একাধিক প্রমাণের উল্লেখ রয়েছে। কিন্ত আমরা সহজে আয়ত্তকরণের নিয়মাধীন ও পূর্ববর্তী বিষয়বস্তুসমূহের সাথে পারস্পরিক সস্পর্ক বজায় রাখার জন্যে ঐ সকল যুক্তিকেই নির্বাচন করব যেগুলো পূর্বোল্লিখিত যুক্তিসমূহের সাথে তাদের সস্পর্ককে সংরক্ষণ করবে।

আল্লাহর অনাদি অনন্ত হওয়া :

যদি কোন অস্তিত্বশীল অপর কোন অস্তিত্বশীলের (কারণ ) কার্য (معلول ) ও ঐ অস্তিত্বশীলের উপর র্নিভরশীল হয় তবে তার অস্তিত্ব ঐ অস্তিত্বশীলাধীন হবে এবং ঐ কারণের অনুপস্থিতিতে তা অস্তিত্বে আসতে পারবে না । অর্থাৎ কোন এক সময় কোন এক অস্তিত্বশীলের অস্তিত্বহীনতা তার¡নির্ভরশীলতা ও সম্ভাব্য অস্তিত্ব হওয়ারই প্রমাণবহ। যেহেতু অনিবার্য অস্তিত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিদ্যমান এবং কোন অস্তিত্বের উপরই নির্ভরশীল নয় সেহেতু সর্বদাই বিরাজমান থাকবে।

এ প্রক্রিয়ায় অনিবার্য অস্তিত্বের জন্যে অপর দু টি গুণ প্রমাণিত হল। একটি হল অনাদি’অর্থাৎ ইতিপূর্বে কখনোই অস্তিত্বহীন ছিল না এবং অপরটি হল অনন্ত'অর্থাৎ ভবিষ্যতেও কখনো বিলুপ্ত হবেনা। কখনো কখনো এ দু টি গুণকে সম্মিলিত ভাবে চিরন্তনত্ব’(سرمدی ) বলা হয়ে থাকে।

অতএব,যে অস্তিত্বশীলের অস্তিত্বহীনতার পূর্বদৃষ্টান্ত অথবা বিলুপ্তির সম্ভাবনা থাকবে,সে অস্তিত্বশীল অনিবার্য অস্তিত্ব’হবে না। সুতরাং বস্তুগত বিষয়ের অনিবার্য অস্তিত্ব’হওয়ার ধারণার অসারতা প্রতিপন্ন হল।

না- বোধক গুণ :

অনিবার্য অস্তিত্বের অপর একটি অবিয়োজ্য বিষয় হল অবিভাজ্যতা (بساطة ) অর্থাৎ যৌগিক বা অংশসমূহের সমন্বয় না হওয়া। কারণ,সকল যৌগই এর অংশগুলির উপর নির্ভরশীল। আর অনিবার্য অস্তিত্ব সকল প্রকার নির্ভরশীলতা থেকে পবিত্র ও মুক্ত ।

যদি মনে করা হয় যে, অনিবার্য অস্তিত্বের’অংশগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অস্তিত্বশীল নয়,যেন একটি কল্পিত সরলরেখার দু টি অংশ,তবে এ ধরনের ধারণাও পরিত্যাজ্য। কারণ যদি কোন কিছু অংশে বিভক্ত হওয়ার সামর্থ্য রাখে,তবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তা বিভাজ্য হবে,যদিও বাস্তবে তার প্রকাশনা-ও ঘটে থাকে। আর বিভাজ্যতার সম্ভাবনা মানে হল বিলুপ্তির সম্ভাবনা। যেমন : যদি এক মিটার রেখা,দুটি অর্ধমিটারে বিভক্ত হয়,তবে আর এক মিটার রেখার’অস্তিত্ব থাকবে না। অপর দিকে আমরা ইতিপূর্বে জানতে পেরেছি যে,অনিবার্য অস্তিত্বের বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই ।

আবার যেহেতু তাৎক্ষণিক (بالفعل ) ও সামর্থ্যগতভাবে (بالقوة ) এশাধিক অংশের সমন্বয় হল বস্তুর বিশেষত্ব,সেহেতু প্রমাণিত হয় যে,কোন বস্তুগত অস্তিত্বই অনিবার্য অস্তিত্ব হতে পারে না। অর্থাৎ খোদার অবস্তুগত হওয়া (تجرد ) প্রমাণিত হল। অনুরূপ স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,মহান আল্লাহ (বাহ্যিক) চোখের মাধ্যমে দর্শনযোগ্য নন এবং অপর কোন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেও অনুধাবনযোগ্য নন। কারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা হল বস্তু ও বস্তুগত বিশেষত্ব।

অপরদিকে বস্তুগত হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করার সাথে সাথে বস্তু ও অন্যান্য বস্তুগত বিশেষত্ব যেমন : নিদিষ্ট স্থান ও কালও অনিবার্য অস্তিত্ব’থেকে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কারণ স্থান এমন কিছুর¡জন্যেই ভাবা যায় যা আয়তন ও বিস্তার বিশিষ্ট হয়। অনুরূপ নির্দিষ্ট কালবিশিষ্ট সকল কিছুই আয়ুষ্কালের বস্তারের দৃষ্টিতে বিভাজনযোগ্য। আর এটাও এক ধরনের সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যগতভাবে (بالقوة ) অংশের সমন্বয়রূপে পরিগণিত। অতএব মহান আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট স্থান ও কালকে কল্পনা করা যায় না এবং নির্দিষ্ট স্থান ও কালবিশিষ্ট কোন অস্তিত্বই অনিবার্য অস্তিত্ব হতে পারে না। সর্বশেষে,অনিবার্য অস্তিত্ব থেকে নির্দিষ্ট কালের অস্বীকৃতির মাধ্যমে গতি,বিবর্তন এবং বিকাশও তাঁর থেকে নিষিদ্ধ হয়। কারণ কোন গতি ও পরিবর্তনই কালাতিক্রম ব্যতীত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না ।

অতএব যারা আল্লাহর জন্যে আরশ’নামক নির্দিষ্ট স্থানের কথা বলে থাকেন অথবা আসমান থেকে অধঃগমন ও স্থানান্তরিত হন বলে মনে করেন অথবা চর্মচক্ষুর মাধ্যমে দর্শনযোগ্য বলে বিশ্বাস করে থাকেন;অথবা তাঁকে বিবর্তন ও বিকাশমান বলে গণনা করে থাকেন,তারা প্রকৃতপক্ষেৃ মহান আল্লাহকে সঠিকরূপে চিনতে পারেননি ।

সর্বোপরি যে কোন প্রকারের ভাবার্থ যা এক ধরনের ঘাটতি,সীমাবদ্ধতা ও নির্ভরশীলতার প্রমাণবহ,তা মহান আল্লাহর জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে থাকে এবং আল্লাহর না-বোধক’গুণ বলতে এটাই বুঝানো হয়েছে ।

অস্তিতদানকারী কারণ :

পূবর্বতী যুক্তিসমূহ থেকে আমরা এ উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, অনিবার্য অস্তিত্বই’হল সকল সম্ভাব্য অস্তিত্বের’কারণ। এখন আমরা এ উপসংহারের অবিচ্ছেদ্য বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করব। তবে প্রথমেই কারণের প্রকরণগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করব। অতঃপর প্রভুর কারণত্বের বিশেষত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।

কারণের সাধারণ অর্থ,সকল অস্তিত্বশীল অর্থাৎ যেগুলোর উপর অপর কোন অস্তিত্ব নির্ভরশীল,সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। এমনকি শর্তসমূহ এবং সহায়কসমূহকেও সমন্বিত করে থাকে। সুতরাং মহান আল্লাহর জন্যে কারণ না থাকার অর্থ হল,অন্য কোন অস্তিত্বের উপর কোন প্রকারের নির্ভরশীলতা না থাকা। এমনকি কোন প্রকারের শর্ত ও সহায়কও তাঁর জন্যে কল্পনা করা যায় না।

কিন্ত সৃষ্টির জন্যে আল্লাহর কারণ হওয়ার অর্থ হল,অস্তিত্বদাতা অর্থে,যা কতৃকারণের 

( علت فعلی ) এক বিশেষ শাখা। এর ব্যাখ্যা প্রদানের জন্যে বিভিন্ন প্রকার কারণের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করব এবং এদের বিস্তারিত ব্যাখ্যার দায়িত্ব দর্শনশাস্ত্রের উপর প্রদান করব।

আমরা জানি যে,বৃক্ষ উদ্গত হওয়ার জন্যে বীজ,উপযুক্ত মাটি এবং আবহাওয়ার প্রয়োজন। অনুরূপ একটি প্রাকৃতিক বা মানবীয় কার্যনির্বাহীরও প্রয়োজন,যে বীজটিকে মাটিতে বপন করবে এবং তাতে পানি সরবরাহ করবে। এদের প্রত্যেকেই উল্লেখিত কারণের সংজ্ঞানুসারে বৃক্ষের উদ্গতির কারণ।

এ বিভিন্ন প্রকারের কারণসমূহকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্ত করা যেতে পারে। যেমন : যে সকল কারণ কার্যের বিদ্যমানতার জন্যে সর্বদাই অপরিহার্য সেগুলোকে প্রকৃত কারণ (علل الحقیقیة ) বলা হয়ে থাকে এবং যে সকল কারণ কার্যের বিদ্যমানতার জন্যে অপরিহার্য নয় ( যেমন : কৃষক ফসলের জন্যে) সেগুলোকে সহায়ক কারণ (علل الاعدادی অথবাمعدات ) বলা হয়ে থাকে। অনুরূপ প্রতিস্থাপনযোগ্য কারণকে প্রতিস্থাপিত কারণ (علل البدلی ) এবং অন্যান্য কারণসমূহকে স্বতন্ত্র কারণ(علل الانحصاری ) বলা হয়ে থাকে।

এ ছাড়া অপর একশ্রেণীর কারণ আছে,যেগুলো উপরোক্ত বৃক্ষের উদ্গতি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা থেকে স্বতন্ত্র এবং এদের দৃষ্টান্তকে আত্মা (النفس ) বিষয়ক ক্ষেত্রে বা কোন কোন আত্মিক বিষয়ে পরিলক্ষণ করা যেতে পারে। উদাহরণতঃ যখন মানুষ তার মস্তিষ্কে একটি চিত্র গঠন করে অথবা কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন,মস্তিষ্ক পসূত চিত্র ও ইচ্ছা নামক এমন একধরনের আত্মিক ও মানস সৃষ্টি রূপ পরিগ্রহ করে,যাদের অস্তিত্ব আত্মার উপর নির্ভরশীল এবং দৃষ্টিকোণ থেকে ঐগুলো আত্মার কার্য (معلول ) বলে পরিগণিত। কিন্ত এ ধরনের কার্য (معلول ) এমন যে,কখনই তাদের কারণ থেকে স্বাধীনরূপে বিরাজ করে না এবং উক্ত কারণ ব্যতীত স্বতন্ত্ররূপে অস্তিত্ব লাভ করতে পারেনা। এছাড়া মস্তিষ্কে অংকিত ছবি অথবা ইচ্ছার ক্ষেত্রে আত্মার ভূমিকা এমন সকল শর্তের অধীন যে,তার ঘাটতি,সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাব্য অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ।

অতএব,এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিতে অনিবার্য অস্তিত্বের ভূমিকা আত্মিক বিষয়ের ক্ষেত্রে আত্মার ভূমিকা অপেক্ষাও বৃহত্তর ও পূর্ণতর এবং অতুলনীয়। কারণ,তিনি কোন প্রকারের সাহায্য ব্যতিরেকেই তাঁর সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করে থাকেন এবং ঐ সৃষ্টি সমস্ত সত্তা নিয়েই তাঁর উপর নির্ভরশীল ।

অস্তিত্বদানকারী কারণের বিশেষত্ব :

পূর্ববর্তী আলোচনার উপর ভিত্তি করে অস্তিত্বদানকারী কারণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্বের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যেতে পারে :

১। অস্তিত্বদাতা কারণকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সকল কার্যের (معلول ) পূর্ণতার (کملات ) অধিকারী হতে হবে যাতে প্রত্যেক সৃষ্টিকে (موجود ) তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী দান করতে পারে -যা সহায়কও অন্যান্য বস্তুগত কারণের ব্যতিক্রম । কারণ ঐ কারণগুলো শুধুমাত্র কার্যের (معلول ) পরিবর্ধন ও বিবর্তনের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং ঐগুলোর (বিবর্তন ও পরিবর্ধন) চূড়ান্তরূপের অধিকারী হওয়া তাদের জন্যে অপরিহার্য নয়। যেমন : মাটিকে উদ্ভিজ্জ পূর্ণতার অধিকারী হওয়া অপরিহার্য নয় অথবা পিতার-মাতাকে সন্তানের পূর্ণতা বা উৎকর্ষের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু অস্তিত্বদানকারী স্রষ্টাকে তাঁর অবিভাজ্যতা ও অবিশ্লিষ্টতা গুণের পাশাপাশি অস্তিত্বগত সকল পূর্ণতার অধিকারী হতে হবে।১০

২। অস্তিত্বদানকারী কারণ স্বীয় কার্যকে (معلول ) অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনয়ন করে থাকে। এক কথায় তাকে সৃষ্টি করে থাকে এবং এ সৃষ্টির ফলে তার অস্তিত্ব থেকে কিছুই হ্রাস পায়না। অথচ প্রাকৃতিক নিয়ামকসমূহের ভূমিকা শুধুমাত্র কার্যের (معلول ) রূপান্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ,যার জন্যে শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করতে হয়। অনিবার্য অস্তিত্বের সত্তা থেকে কোন কিছুর বিয়োজনের অর্থ হল,সৃষ্টিকর্তার সত্তাগত বিভাজ্যতা ও পরিবর্তনশীলতা -যার অসারতা ইতিপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে ।

৩। অস্তিত্বদানকারী কারণ হল একটি প্রকৃত কারণ (علت الحقیقیة ) । ফলে কার্যের (معلول )বিদ্যমানতার জন্যেও তার অস্তিত্ব অনিবার্য। কিন্ত সহায়ক কারণের (علة الاعدادی ) অস্তিত্ব,কার্যের (معلول ) জন্যে অপরিহার্য নয়।

অতএব,আহলে সুন্নতের কোন কোন কালামশাস্ত্রবিদগণ থেকে যে বর্ণিত হয়েছে এ বিশ্ব,তার বিদ্যমানতার জন্যে স্রষ্টার উপর নির্ভরশীল নয়’তা সঠিক নয়। অনুরূপ পাশ্চাত্যের কোন কোন দার্শনিক যে বলে থাকেন, প্রকৃতি জগৎ ঘড়ির মত সর্বকালের জন্যে একবার দমকৃত হয়েছে এবং গতিময়তার জন্যে আর খোদার উপর তার কোন নির্ভরতা নেই’তাও সত্যবহির্ভূত। বরং এ অস্তিত্ব জগৎ সর্বদা সর্বাবস্থায় মহান স্রষ্টার উপর নির্ভরশীল এবং তিনি যদি এক মুহূর্তের জন্যেও অস্তিত্বপ্রদান থেকে বিরত হন,তবে আর কোন কিছুই বাকী থাকবে না ।

যদি হবেন বিস্মৃত

ধ্বংস হবে সমস্ত।

৯ম পাঠ

সত্তাগত গুণাবলী

ভূমিকা :

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে,মহান স্রষ্টা আল্লাহ,যিনি এ মহাবিশ্বের অস্তিত্বদানকারী কারণ,তিনি অস্তিত্বের সকল প্রকার পূর্ণতার (کملات ) অধিকারী এবং সকল অস্তিত্বশীলে প্রাপ্ত যে কোন প্রকারের উৎকর্ষ তাঁর থেকেই,যার জন্যে তাঁর পূর্ণতা থেকে কোন প্রকার ঘাটতি হয়নি। সহজবোধ্যতার জন্যে কিঞ্চিৎ নিম্নলিখিত উদাহরণটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে :

শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে স্বীয় জ্ঞান থেকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এর ফলে তার জ্ঞানের কোন ঘাটতি হয় না । তবে মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক দানকৃত অস্তিত্ব ও অস্তিত্বগত উৎকর্ষ এ উদাহরণ অপেক্ষা বহুগুণে সমোন্নত এবং সম্ভবতঃ এ ক্ষেত্রে এটাই বলা শ্রেয় যে,অস্তিত্বজগৎ হল পাবিত্র প্রভু সত্তারই দ্যুতি। যেমনটি নিম্নলিখিত কোরানের আয়াত থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি:

) اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ(

আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি (সুরা নূর -৩৫ )

মহান প্রভুর অসীম পূর্ণতা বা কামালতের আলোকে যে সকল ভাবার্থ পূর্ণতার প্রমাণ বহন করবে এবং অপরিহার্যভাবে যে কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা ও ঘাটতি থেকে মুক্ত হবে সে সকল ভাবার্থই মহান আল্লাহর জন্যে সত্য হবে। যেমনটি,কোরআনের বিভিন্ন আয়াত,রেওয়ায়েত ও হযরত মাসূমগণের (আঃ) দোয়া ও মোনাজাতসমূহে মহান আল্লাহকে নূর,কামাল,সুন্দর,প্রেমময়,সদানন্দ ইত্যাদি বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে ভূষিত করতে দেখা যায়। কিন্ত ইসলামের আক্বায়েদ,দর্শন ও কালামশাস্ত্রে আল্লাহর গুণরূপে যা বর্ণিত হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে খোদার গুণসমূহের মধ্যে নির্বাচিত কয়েকটি গুণ। যেগুলো দু শ্রেণীতে বিভক্ত (সত্তাগত গুণ ও ক্রিয়াগত গুণ)।

অতএব,সর্বাগ্রে (গুণসমূহের) এ শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করব এবং অতঃপর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি গুণের উল্লেখ ও সেগুলির প্রতিপাদনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করব।

সত্তাগত ও ক্রিয়াগত গুণাবলী :

খোদার উপর আরোপিত গুণগুলো,হয় খোদার সত্তা সংশ্লিষ্ট এক প্রকার কামাল বা পূর্ণতার ভাবার্থ হবে যেমন : জীবন,প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা অথবা মহান প্রভুর সাথে তাঁর সৃষ্টির সস্পর্ক-সংশ্লিষ্ট ভাবার্থ যেমন : সৃজনক্ষমতা ও জীবিকাদানের ক্ষমতা হবে। প্রথম শ্রেণীর ভাবার্থকে সত্তাগত গু এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ভাবার্থকে ক্রিয়াগত গুণ’বলা হয়ে থাকে।

এ দু'শ্রেণীর গুণসমূহের মধ্যে মূল পার্থক্য এই যে প্রথম শ্রেণীর গুণগুলো হল প্রভুর পবিত্র সত্তার অভিন্নরূপ;কিন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর গুণগুলো হল মহান প্রভু ও তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সম্পর্কের প্রকাশক,যেগুলো প্রভুসত্তা ও সৃষ্টিসত্তার দ্বিপাক্ষিক সস্পর্করূপে বিবেচিত হয়। যেমনঃ সৃজন ক্ষমতা,যা প্রভুসত্তার উপর সৃষ্টিসত্তার অস্তিত্বগত সস্পর্ক সংশ্লিষ্ট গুণ এবং প্রভু ও সৃষ্টিকুলের সংশ্লিষ্টতায় এ সস্পর্ক রূপ লাভ করে । কিন্ত বাস্তবজগতে প্রভুর পবিত্র সত্তা ও সৃষ্টিকুলসত্তা ব্যতীত সৃষ্টিকরণ নামক অপর কোন স্বতন্ত্র সত্তার অস্তিত্ব নেই। তবে মহান প্রভু তাঁর স্বীয় সত্তায় সৃজন ক্ষমতার অধিকারী । কিন্ত ক্ষমতা’(قدرت ) হল প্রভুর সত্তাগত গুণের অন্তর্ভূক্ত। অপরদিকে সৃষ্টিকরণ’অতিরিক্ত গুণের তাৎপর্য বহন করে,যা কার্যক্ষেত্রে বিবেচিত হয়ে থাকে। অতএব এ দৃষ্টিকোণ থেকে সৃজন’প্রভুর ক্রিয়াগত গুণ বলে পরিগণিত হয় -যদিও তা সৃজনে সক্ষম’অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যা ক্ষমতার অন্তর্নিহিত বিষয়।

মহান আল্লাহর সত্তাগত গুণগুলোর মধ্যে জীবন (حیات ) জ্ঞান (علم ) ও ক্ষমতা (قدرت ) হল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত শ্রবণ ও দর্শন যদি শ্রবণীয় ও দার্শনীয় বিষয়সমূহ সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী বলতে বা শ্রবণ ও দর্শন ক্ষমতার অধিকারী বুঝানো হয়,তবে তার মূল প্রজ্ঞাবান ও ক্ষমতাবান এ (সত্তাগত) গুণদ্বয়ের দিকেই ফিরে যায়। আবার যদি এদের (শ্রবণ ও দর্শন) অর্থ কার্যগত শ্রবণ ও দর্শন হয়ে থাকে,যা শ্রবণকারী ও দর্শনকারীর সত্তা এবং শ্রবণীয় ও দর্শনীয় বস্তুর মধ্যকার সস্পর্ক থেকে বিবেচিত হয়ে থাকে,তবে তা ক্রিয়াগত গুণ বলে পরিগণিত হবে। যেমন :কখনো কখনো জ্ঞানও (علم ) এরূপ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং তখন তাকে কার্যগত জ্ঞান(علم الفعلی ) বলে নামকরণ করা হয় ।

কোন কোন কালামশাস্ত্রবিদ ভাষা (الکلام ) ও ইচ্ছাকেও (الارادة ) সত্তাগত গুণের অন্তর্ভূক্ত বলে মনে করেন। এ সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব।

সত্তাগত গুণের প্রমাণ :

জীবন,ক্ষমতা ও জ্ঞানকে প্রমাণের জন্যে সর্বাপেক্ষা সরলতম পথটি হল এই যে,এ ভাবার্থগুলোকে যখন সৃষ্ট বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় তখন এগুলো ঐ সৃষ্ট বিষয়সমূহের পূর্ণতাকে প্রকাশ করে। অতএব ঐগুলো (জীবন,প্রজ্ঞা,ক্ষমতা) অস্তিত্বদানকারী কারণের মধ্যে পূর্ণতম পর্যায়ে থাকা আবশ্যক। কারণ যে কোন সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যেই যে কোন প্রকার উৎকর্ষের সন্ধান পাওয়া যাবে,তা প্রকৃতপক্ষে মহান প্রতিপালক আল্লাহ থেকেই প্রাপ্ত এবং এটা কখনোই সম্ভব নয় যে,যিনি জীবন দান করবেন,তিনি জীবনের অধিকারী নন। অনুরূপ,যিনি সৃষ্টিকে জ্ঞান ও ক্ষমতা দিবেন তিনি স্বয়ং অজ্ঞ (جاهل ) ও ক্ষমতাহীন হবেন -তাও অসম্ভব ।

অতএব কোন কোন সৃষ্টির মধ্যে প্রাপ্ত এ পূর্ণতা,মহান সৃষ্টিকর্তার মধ্যে এদের চূড়ান্ত পর্যায়ের সমাহারের প্রমাণ বহন করে থাকে। অর্থাৎ (ঐ গুণগুলোর) কোন প্রকার সীমাবদ্ধতা ও কিঞ্চিৎ পরিমাণের ঘাটতি ছাড়াই মহান সৃষ্টিকর্তার মধ্যে বিদ্যমান। অন্যভাবে বলা যায় : মহান প্রভু অসীম ক্ষমতা,জ্ঞান ও জীবনের অধিকারী। এখন আমরা এদের প্রতিটির জন্যে বিস্তারিত আলোচনায় মনোনিবেশ করব।

জীবন :

জীবনের ধারণাটি দু শ্রেণীর সৃষ্টবস্তর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এদের একটি হল উদ্ভিদকুল,যারা বিকাশ ও বর্ধনক্ষম এবং অপরটি হল প্রাণী ও মানবকুল,যারা প্রত্যয় ও বোধের অধিকারী। কিন্ত প্রথম প্রকারের ক্ষেত্রে ঘাটতি ও নির্ভরশীলতা অপরিহার্য। কারণ বিকাশ ও বর্ধনের অবিচ্ছেদ্যতা হল যে,বিকাশপ্রাপ্ত অস্তিত্বময়,শুরুতে অপূর্ণাঙ্গ থাকে এবং কোন বহিঃনির্বাহকের প্রভাবে এদের মধ্যে পরিবর্তন সৃষ্টি হয়;অতঃপর পর্যায়ক্রমে নতুন এক পূর্ণতায় পৌঁছে। সতরাং এধরনের কোন বিষয়কে মহান সৃষ্টিকর্তারূপে আখ্যায়িত করা যায় না ( যার আলোচনা ইতিপূর্বে না-বোধক গুণের ক্ষেত্রে করা হয়েছে)।

জীবনের দ্বিতীয় অর্থটি হল,পূর্ণতার তাৎপর্যমণ্ডিত। যদিও এর সম্ভাব্য দৃষ্টান্ত (مصداق ) ঘাটতি ও সীমাবদ্ধতা সমন্বিত;কিন্ত তার জন্যে অসীম এক মর্যাদাকে বিবেচনা করা যেতে পারে -যেখানে কোন প্রকার ঘাটতি ও নির্ভরশীলতাই আর থাকেনা। অস্তিত্ব ও পূর্ণতার তাৎপর্যও অনুরূপ।

মূলতঃ জীবন যে অর্থে জ্ঞান ও ঐচ্ছিক কার্যসমন্বিত হয়,সে অর্থে অবস্তুগত এক অস্তিত্বতার জন্যে অপরিহার্য । কারণ যদিও জীবন্ত বস্তুর প্রতি জীবনকে অরোপ করা হয়,তথাপি তা( জীবন) হল প্রকৃতপক্ষে এদের (জীবন্ত বস্তুর ) আত্মার (روح ) বৈশিষ্ট্য। কিন্ত যেহেতু ঐ বস্তু আত্মার অধিকারী হয়,তাই ভুলবশতঃ তা জীবন্ত বলে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। অর্থাৎ যেমন করে বস্তর জন্যে বিস্তুার অপরিহার্য,তেমনি নির্বস্তুকের ( مجرد বা অবস্তুগত) জন্যও আত্মা (روح ) অপরিহার্য । আর এ আলোচনার উপর ভিত্তি করে মহান স্রষ্টার জীবন সম্পর্কে অপর,একটি দলিল আমাদের হস্তগত হয় । যথা : প্রভুর পবিত্র অস্তিত্ব হল নির্বস্তুক (مجرد ) বা অবস্তুগত-যা পূর্ববর্তী পাঠে প্রমাণিত হয়েছে। আর প্রত্যেক নির্বস্তুক অস্তিত্বই সত্তাগতভাবে জীবনের অধিকারী। অতএব মহান আল্লাহও সত্তাগতভাবে জীবনের অধিকারী।

হযরত আলী (আ.)-এর গুণাবলী

যদি হযরত আলীকে আমাদের আদর্শ ও নেতা হিসেবে গ্রহণ করি,তবে একজন পূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ মানুষকে যার মধ্যে সকল মানবিক মূল্যবোধ সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছে আমাদের অগ্রগামী হিসেবে গ্রহণ করেছি।

যখন রাত্রি নেমে আসে,রাত্রির নিস্তব্ধতা চারিদিক আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন কোন সাধক বা আরেফই আলী (আ.)-এর পদমর্যাদায় পৌছতে পারে না। এমন প্রাণবন্ত ইবাদত যেন স্রষ্টার সাধনায় নিমগ্ন ও পরমাকৃষ্ট,তার দিকে ধাবমান প্রবলভাবে। আবার যখন তিনি অন্য কোন বিষয়ে মশগুল,উদাহরণস্বরূপ যখন তিনি যুদ্ধ ও সংগ্রামে লিপ্ত (যুদ্ধক্ষেত্রে) তরবারীর আঘাতে তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত,শরীর থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে এক দিকে পড়ে গেছে,কিন্তু এতটা নিমগ্ন যে,অনুভব করেন নি একটুকরা মাংস তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গভীর মনসংযোগের কারণে সে দিকে লক্ষ্যই নেই। আলী ইবাদতের সময় এতটা উষ্ণ হয়ে উঠেন যে,আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসায় তার অস্তিত্ব যেন এক প্রজ্বলিত শিখা যার অবস্থান এ পৃথিবীতে নয়। নিজেই এক দল ব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন,

هَجَمَ بِهِمُ الْعِلْمُ عَلَى حَقِيقَةِ الْبَصِيرَةِ، وَ بَاشَرُوا رُوحَ الْيَقِينِ، وَ اسْتَلاَنُوا مَا اسْتَوْعَرَهُ الْمُتْرَفُونَ، وَ اءَنِسُوا بِمَا اسْتَوْحَشَ مِنْهُ الْجَاهِلُونَ، وَ صَحِبُوا الدُّنْيَا بِاءَبْدَانٍ اءَرْوَاحُهَا مُعَلَّقَةٌ بِالْمَحَلِّ الْاءَعْلَى ،

জ্ঞান তাদের দিকে তার দিব্যতাসহ প্রকৃতরূপে ধাবিত হয়েছে,ইয়াকীনের প্রাণকে তারা কর্মে নিয়োজিত করেছে,যা দুনিয়াদারদের জন্য কঠিন ও অসহ্য তা তাদের নিকট সহজ হয়ে গেছে,জাহেলরা যা থেকে ভীত তারা তার প্রতি আকৃষ্ট,যদিও তারা মানুষের মাঝে শারীরিকভাবে অবস্থান করছে তদুপরি তাদের আত্মা উচ্চতর এক স্থানে সংযুক্ত। (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ১৩৯)

ইবাদতরত অবস্থায় তার দেহ থেকে তীর খুলে ফেলা হয়েছে,অথচ তিনি এমনভাবে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট ও ইবাদতে নিমগ্ন যে অনুভবও করেননি। ইবাদতের মেহরাবে তিনি এতটা ক্রন্দনশীল যার নজীর কেউ দেখেনি। আবার দিনের বেলায় আলী যেন ভিন্ন কোন মানুষ। সঙ্গীদের সাথে যখন বসেন তখন হাসি মুখ,খোলা-মেলা তার আচরণ। তার চেহারা সব সময় হাস্যোজ্জ্বল। আলী (আ.) এত বেশি মুক্ত মনের ছিলেন যে,আমর ইবনে আস আলীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতো যে,আলী খেলাফতের উপযুক্ত নয়। কারণ হাসিমুখ ও মনখোলা মানুষ খেলাফতের জন্য অনুপযোগী।

খেলাফতের জন্য কঠিন মুখাবয়বের প্রয়োজন যাতে মানুষ তাকে ভয় পায়। এটা নাহজুল বালাগায় আলী নিজেই বর্ণনা করেছেন-

عجبا لابن النابغة یزعم لاهل الشام أنّ فی دعابة و انّی امر تلعبة

নাবেগার সন্তানের কথায় আশ্চর্যান্বিত হই যে বলে,আলী মানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলে,খুবহাসি-ঠাট্টা করে,মজাদার লোক।

যখন আলী শত্রুর সাথে যুদ্ধের ময়দানে একজন যোদ্ধার বেশে আবির্ভূত তখনও তিনি মন খোলা ও হাসি মুখ। কবি বলছেন,

هو البکّاء فی المحرب لیلا

هو الضحّاک اذا اشدّ الضرب

তিনি ইবাদতের মেহরাবে যেমন অত্যন্ত ক্রন্দনশীল তেমনি যুদ্ধের ময়দানে হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।

তিনি কেমন মানুষ? এটাই কোরআনী মানুষ। কোরআন এমন মানুষই চায়।

انّ ناشیة اللیل هی اشدّ وطا وّاقوم قیلا انّ لک فی النّهار سبحا طویل

  নিশ্চয় (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) রাত্রিকালের উত্থান আত্মশুদ্ধির জন্য সর্বাধিক কঠিন পন্থা এবং বাক্যালাপে সর্বাধিক দৃঢ়তা দানকারী। নিশ্চয় দিবসে তুমি দীর্ঘ কর্ম ব্যস্ততায় নিমগ্ন থাক। অর্থাৎ রাতকে ইবাদতের জন্য রাখ আর দিনকে সামাজিক কাজকর্মের জন্য। আলী যেন রাত্রিতে এক ব্যক্তিত্ব,আর দিনে অন্য এক ব্যক্তিত্ব।

হাফেজ শিরাজী যেহেতু একজন মুফাস্সির ছিলেন সেহেতু কোরআনের রহস্যকে বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতেন। নিজস্ব ভঙ্গিতে ভাষার গাঁথুনীতে এ বিষয়টি তিনি কবিতায় এনেছেন-

দিনে রত হও অর্জনের চেষ্টায়

রাত তো সময় মাতাল হওয়ার শরাবের নেশায়।

হৃদয়রূপ আয়নায় মরিচা তো পড়বেই

মরিচা সরানোর সময় তো রাতের আঁধারেই।

 আলী (আ.)-এর দিবারাত্রি এমনই ছিল। বিপরীত চরিত্রের সমন্বয়-যা পূর্ণ মানবের জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য তা হাজার বছর পূর্বের আলীর মধ্যে দেখা যায়। সাইয়্যেদ রাজী নাহজুল বালাগার ভূমিকায় বলছেন, যে বিষয়টি সব সময় বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং যাতে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হই তা হলো আলী (আ.)-এর বক্তব্যগুলোর যে কোন একটিতে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন এক বিশ্বে প্রবেশ করেছি। কখনো কোন আবেদের জগতে,কখনো বা যাহেদের জগতে,কখনো দর্শনের জগতে,কখনো আধ্যাত্মিকতার জগতে,কখনো সৈনিক বা সামরিক কর্মকর্তার জগতে,কখনো ন্যায়পরায়ণ বিচারক বা শাসকের বা ধর্মীয় নেতার জগতে। সকল বিশ্বেই আলীর উপস্থিত। মানব বিশ্বের কোন স্থানেই আলী অনুপস্থিত নন।

সাফিউদ্দিন হিল্লী যিনি অষ্টম হিজরী শতাব্দীর একজন কবি ছিলেন তিনি বলেছেন,

جمعت فی صفاتک الاضداد

فلهذا عزّت لک الانداد

 “ বিপরীত বৈশিষ্ট্য হয়েছে তোমায় সমন্বিত

তাই তুমি হয়েছ মহিমান্বিত।

زاهد حاکم حلیم شجاع

ناسک فاتک فقیر جواد

 “ আত্মসংযমী শাসক তুমি,সহনশীল বীর

ফকির তুমি,দুনিয়াত্যাগী পীর।

যেমন সহনশীলতা ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে তুমি সর্বোচ্চ পর্যায়ে তেমনি সাহসিকতার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। রক্তপাতের ক্ষেত্রে যেখানে কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তির রক্ত ঝরাতে হবে সেখানে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা,আবার ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। নিঃস্ব ও সম্পদহীন তিনি,অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। দানশীল ছিলেন বলেই সম্পদ তার হাতে গচ্ছিত থাকত না।

দাতা কভু পারে না সম্পদ সঞ্চয় করতে

প্রেমিক অন্তর পারে না কভু ধৈর্য ধরতে,

পানিরে পারা যায় না কভু ছাকনিতে আটকাতে।

তেমনি আলী (আ.)-কে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

خلق یخجل النسیم من العطف

و بأس یذوب منه الجماد

কোথাও তোমার চরিত্র এমন যে,তোমার কোমলতা দেখে মৃদুমন্দ বাতাসও লজ্জা পায় কখনো তোমার দৃঢ়তা পাথরকেও হার মানায়  

অর্থাৎ সাহসিকতা,শৌর্য আর সংগ্রামী তার আত্মার মোকাবিলায় পাথর,শীলা বা ধাতুও গলে যায়। আবার তার চারিত্রিক কোমলতাই মৃদমন্দ বাতাসকেও লজ্জা দেয়। একই ব্যক্তির মধ্যে কোমলতা ও কঠোরতার এক অপূর্ব সমন্বয়। তুমি কেমন আশ্চর্য সৃষ্টি?

অতএব,পূর্ণ মানব অর্থ সেই মানুষ যিনি সকল মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান। মানবতার সকল ময়দানে তিনি শ্রেষ্ঠ। এখান থেকে আমরা কি শিক্ষাগ্রহণ করব? এ শিক্ষাগ্রহণ করব যে,ভুল করে শুধু একটি মূল্যবোধকে গ্রহণ করে অন্যান্য মূল্যবোধকে যেন আমরা ভুলে না যাই। যদিও আমরা সকল মূল্যবোধের ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারব না,কিন্তু নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সকল মূল্যবোধই একত্রে ধারণ তো করতে পারি। যদি পূর্ণ মানুষ নাও হই অন্তত ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ তো হতে পারি। আর তখনই একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে সকল ময়দানে আমরা উপস্থিত হতে পারব। সুতরাং এটাই পূর্ণ মানুষের রূপ। ইনশাল্লাহ্ আমরা পরবর্তী বৈঠকে বাকী অংশ আলোচনা করব।

হযরত আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ দিনগুলো

আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ রমযান মাস অন্য এক রকম রমযান যা ভিন্ন এক পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছিল। আলীর পরিবারের জন্যও এ রমযান প্রথম দিক থেকেই অন্য রকম ছিল। ভয় ও শঙ্কার একটি মিশ্রিত অবস্থা বিরাজমান ছিল। (খাওয়ারেজ আলী (আ.)-কে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিল) সেহেতু আলীর জীবনধারা এ রমযানে অন্য রমযানের থেকে অন্য রকম ছিল।

হযরত আলীর শক্তিমত্তার একটি বর্ণনা নাহজুল বালাগা থেকে এখানে বর্ণনা করব। আলী (আ.) বলেছেন,

لما انزل الله سحانه قوله ( الم أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ ) علمت انّ الفتنة لا بنا و رسل الله (ص) بین اظهرنا 

যখন এ আয়াত মানুষ কি ভেবে নিয়েছে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না (আনকাবুত ১-২) নাযিল হলো তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মৃত্যুর পর এ উম্মতের জন্য ফেতনা ও কঠিন পরীক্ষা আসবে।

فقلت: یارسول الله (ص) ما هذه الفتنة التی اخبرک الله تعالی بها

তখন রাসূলকে প্রশ্ন করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! এ আয়াতে আল্লাহ্ যে ফেতনার কথা বলছেন সেটা কি? তিনি বললেন :

یا علی إنّ امتی سیفتون من بعدی

হে আলী! আমার পর আমার উম্মত পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যখন আলী শুনলেন রাসূল মৃত্যুবরণ করবেন এবং তার পরে কঠিন পরীক্ষা আসবে তখন ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে বললেন,

یا رسول الله او لیس قد قلت لی یوم احد حیث استشهد من استشهد من المسلمین و خیّزت عنّی الشهادة

ইয়া রসুলাল্লাহ্! ওহুদের দিনে যারা শহীদ হওয়ার তারা শহীদ হলেন (মুসলমানদের মধ্যে সত্তরজন শহীদ হয়েছিলেন যাদের নেতা ছিলেন হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং আলী ওহুদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের একজন ছিলেন) অর্থাৎ তারা শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করলেন এবং শাহাদাত আমার থেকে দূরে চলে গেল,আমি এর থেকে বঞ্চিত হলাম এবং খুবই দুঃখ পেয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলাম,কেন এ মর্যাদা আমার ভাগ্যে ঘটল না। (আলী এ সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন এবং এক বছর হলো হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-কে বিবাহ করেছেন এবং এক সন্তানের জনক। এ বয়সের যুবক যখন জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখে তখন আলী শাহাদাতের প্রত্যাশী।) আপনি বললেন,ابشر فإنّ الشهادة من ورائک যদিও এখানে শহীদ হওনি কিন্তু অবশেষে শাহাদাত তোমার ভাগ্যে ঘটবে। তারপর মহানবী বললেন,

إنّ ذلک لکذلک فکیف صبرک اذن

অবশ্যই এমনটি হবে তখন তুমি কিরূপে ধৈর্যধারণ করবে। এখানে ধৈর্যের স্থান নয়,বরং শোকরকরার স্থান। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ১৫৪)

রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে নিজের শাহাদাত সম্পর্কে যে খবর তিনি শুনেছিলেন সে সাথে বিভিন্ন আলামত যা তিনি দেখতেন,কখনো কখনো তা বলতেন যা তার পরিবারের সদস্য এবং নিকটবর্তী শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাহাবীদের মধ্যে শঙ্কা ও কষ্ট বৃদ্ধি করত। তিনি আশ্চর্যজনক কিছু কথা বলতেন। এ রমযান মাসে নিজের ছেলে-মেয়েদের ঘরে ইফতার করতেন। প্রতি রাতে যে কোন এক ছেলে বা মেয়ের ঘরে মেহমান হতেন- কোন রাতে ইমাম হাসানের ঘরে,কোন রাতে ইমাম হুসাইনের ঘরে,কোন রাতে হযরত যয়নাবের ঘরে (যিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে জা ফরের স্ত্রী ছিলেন)। এ মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে কম খাবার খেতেন। সন্তানরা এতে খুবই কষ্ট পেতেন। তারা কখনো প্রশ্ন করতেন, বাবা,কেন এত কম খান? তিনি বলতেন, আল্লাহর সাথে এমনাবস্থায় মিলিত হতে চাই যে উদর ক্ষুধার্ত থাকে। সন্তানরা বুঝতেন তাদের পিতা কিছুর জন্য যেন অপেক্ষমান। কখনো কখনো তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন, আমার ভাই ও বন্ধু রাসূল (সা.) আমাকে যে খবর দিয়েছেন তা অবশ্যই সত্য। তার কথা কখনো মিথ্যা হতে পারে না। খুব নিকটেই তা সত্যে পরিণত হবে।

তের রমযান এমন কিছু বললেন যা অন্য সব দিনের চেয়ে পরিবেশকে বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলল। সম্ভবত জুমআর দিন খুতবা পড়লেন। ইমাম হুসাইন (আ.)-কে প্রশ্ন করলেন, বাবা এ মাসের কত দিন বাকি রয়েছে? উত্তর দিলেন, পিতা,১৭ দিন। তিনি বললেন, তাহলে আর দেরি নেই। এ মাথা আর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হবে। এ শ্মশ্রু রঙ্গিন হওয়ার সময় নিকটেই।

ঊনিশে রমযান আলী (আ.)-এর সন্তানরা রাতের একটি অংশ আলীর সঙ্গে কাটালেন। ইমাম হাসান নিজের ঘরে চলে গেলেন। আলী জায়নামাজে বসলেন। শেষ রাতে উদ্বিগ্নতার কারণে (অথবা প্রতি রাতই হয়তো এ রকম করতেন) ইমাম হাসান আলীর নামাযের স্থানে গিয়ে বসলেন। (ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন হযরত ফাতেমা যাহরার সন্তান বলে ইমাম আলী এঁদের প্রতি আলাদা রকম স্নেহ দেখাতেন। কারণ এঁদের প্রতি স্নেহ রাসূলুল্লাহ্ ও ফাতেমা যাহরার প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলে মনে করতেন) যখন ইমাম হাসান তার কাছে আসলেন তখন তিনি বললেন,

ملکتنی عینی و انا جالس فسنح لی رسول الله (ص) فقلت یا رسول الله ماذا لقیت من امّتک من الاود و اللدد فقال ادع علیهم فقلت ابدلنی الله بهم خبرا منهم و ابدلهم بی شرّ لهم منّی

পুত্র,হঠাৎ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলকে আবির্ভূত হতে দেখলাম। যখন রাসূলকে দেখলাম তখন বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার এ উম্মতের হাতে আমার অন্তর রক্তাক্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তার সঙ্গে মানুষের অসহযোগিতা এবং তার নির্দেশিত পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের অনীহা আলী (আ.)-কে তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছে। উষ্ট্রের যুদ্ধের বায়আত ভঙ্গকারীরা,সিফফিনে মুয়াবিয়ার প্রতারণা (মুয়াবিয়া অত্যন্ত ধুর্ত ছিল,ভালোভাবেই জানত কি করলে আলীর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করা যাবে। আর সে তা-ই করত),সবশেষে খারেজীদের রূহবিহীন আকীদা-বিশ্বাস যারা ঈমান ও এখলাছ মনে করে আলী(আ.)-কে কাফের ও ফাসেক বলত। আমরা জানি না আলীর সঙ্গে এরা কি আচরণ করেছে! প্রকৃতই যখন কেউ আলীর উপর আপতিত মুসিবতগুলো দেখে,আশ্চর্যান্বিত বোধ করে। একটি পাহাড়ও এ পরিমাণ মুসিবত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। এমন অবস্থা যে,আলী তার এই মুসিবতের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এখন যখন রাসূলে আকরাম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলেন তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার এ উম্মত আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এদের নিয়ে আমি কি করব? তারপর ইমাম হাসানকে বললেন, পুত্র,তোমার নানা আমাকে নির্দেশ দিলেন এদের প্রতি অভিশাপ দিতে। আমিও স্বপ্নের মধ্যেই অভিশাপ দিয়ে বললাম : হে আল্লাহ্! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে মৃত্যুদান কর এবং এদের উপর এমন ব্যক্তিকে প্রভাব ও প্রতিপত্তি দান কর এরা যার উপযুক্ত।

বোঝা যায়,এ বাক্যের সাথে কতটা হৃদয়ের বেদনা ও দুঃখ জড়িয়ে রয়েছে! আলী (আ.) সুবহে সাদিকের সময় ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলেন বাড়ির হাঁসগুলো অসময়ে ডেকে উঠল। আলী বললেন,

دعو هنّ فانّهنّ صوائح تتبعها نوائح

  এখন পাখির কান্না শোনা যাচ্ছে,বেশি দেরি নয় এরপর এখান থেকেই মানুষের কান্না শোনা যাবে। উম্মে কুলসুম আমিরুল মুমিনীনের সামনে এসে বাঁধা দিলেন। তিনি বললেন, বাবা,আপনাকে মসজিদে যেতে দেব না। অন্য কাউকে আজ নামায পড়াতে বলুন। প্রথমে বললেন, জুদাহ ইবনে হুবাইরাকে বলুন জামাআত পড়াতে। পরক্ষণেই আলী বললেন, না আমি নিজেই যাব। বলা হলো,অনুমতি দিন আপনার সঙ্গে কেউ যাক। তিনি বললেন, না,আমি চাই না কেউ আমার সঙ্গে যাক।

হযরত আলীর জন্য রাতটি অত্যন্ত পবিত্র ছিল। আল্লাহ্ জানেন আলীর মধ্যে সে রাত্রে কেমন উত্তেজনা ছিল! তিনি বলছেন, আমি অনেক চেষ্টা করেছি এ আকস্মিক শিহরণের রহস্য উদ্ঘাটন করব। যদিও ধারণা ছিল কোন বড় ঘটনা ঘটবে যা অপেক্ষায় আছে। যেমন নাহজুল বালাগায় আলী(আ.) নিজেই বলছেন,

کم اطردت الایام عن مکنون هذا الامر فابی الله الا اخفاءه

অনেক চেষ্টা করেছি এ রহস্যের গোপনীয়তা উদ্ঘাটন করব,কিন্তু আল্লাহ্ চাননি,বরং তিনি এটা গোপন রেখেছেন।

নিজেই ফজরের আজান দিতেন। সুবহে সাদিকের সময় নিজেই মুয়াজ্জিনের স্থানে দাঁড়িয়ে (আল্লাহু আকবার বলে) উচ্চৈঃস্বরে আজান দিলেন। সেখান থেকে নামার সময় সুবহে সাদেকের সাদা আভাকে বিদায় জানালেন। তিনি বললেন, হে সাদা আভা! এ ফজরে একদিন আলী এ পৃথিবীতে চোখ খুলেছিল। এমন কোন ফজর কি আসবে যে,তুমি থাকবে আর আলী ঘুমিয়ে থাকবে। নাকি এবার আলীর চোখ চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে। যখন তিনি নেমে এলেন তখন বললেন,

خلو سبیل المومن المجاهد

فی الله ذی الکتب وذی المشاهد

فی الله لا یعبد غیر الواحد

و یوقظ الناس الی المساجد

  এই মুমিন ও মুজাহিদের জন্য রাস্তা খুলে দাও (নিজেকে মুমিন ও মুজাহিদ বলে উল্লেখ করেছেন) যে গ্রন্থ ও শাহাদাতের অধিকারী,একক খোদা ব্যতীত কারো ইবাদত করেনি এবং মানুষকে মসজিদে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠাতো।

পরিবারের কাউকে অনুমতি দেননি বাইরে যাওয়ার। আলী বলেছিলেন, পাখিদের কান্নার পর মানুষের আহাজারি শুনতে পাবে। স্বাভাবিকভাবেই হযরত যয়নাব কোবরা,উম্মে কুলসুম ও পরিবারের বাকী সদস্যরা উদ্বিগ্ন অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ করে এক প্রচণ্ড চীৎকারে সবাই বুঝতে পারলেন। একটি আওয়াজ চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল-

تهدّمت و الله ارکان الهدی و انطمست اعلام التّقی و انفصمت العروة قتل ابن عمّ المصطفی قتل الوصیّ المجتبی قتل علیّ المرتضی قتله اشقی الشقیا

দীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে,তাকওয়ার ধ্বজা ভূলুন্ঠিত হয়েছে,মজবুত বন্ধন ছিন্ন হয়ে পড়েছে,আলী মোর্তজাকে হত্যা করা হয়েছে,তাকে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হত্যা করেছে।

لا حول و لا قوّة الا بالله العلی العظیم

বিবিধ দৃষ্টিকোণে মানুষের বেদনার অনুভূতি

) وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ(

মানব সত্তা ও তার স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। সর্বোপরি দু টি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিই একটি অপরটির বিপরীতে অবস্থান করছে : রূহবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। রূহবাদীদের দৃষ্টিতে মানুষ হলো প্রকৃতপক্ষে দেহ ও আত্মার সমষ্টি এবং মানুষের আত্মা চিরন্তন অমর-যা তার মৃত্যুর ফলে নিঃশেষ হয়ে যায় না। একইভাবে ধর্মীয় যুক্তিতে বিশেষ করে ইসলামের অকাট্যভাষ্যে এরই যৌক্তিকতা নির্দেশিত হয়েছে। অপর মতবাদটি হলো মানুষ আসলে যান্ত্রিক দেহ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং মৃত্যুর ফলে সম্পূর্ণ বিলীন ও নিঃশেষ হয়ে যায়। আর দৈহিক বিনাশের অর্থই হলো মানবসত্তার বিনাশ।

হযরত আলী (আ.)-এর গুণাবলী

যদি হযরত আলীকে আমাদের আদর্শ ও নেতা হিসেবে গ্রহণ করি,তবে একজন পূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ মানুষকে যার মধ্যে সকল মানবিক মূল্যবোধ সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছে আমাদের অগ্রগামী হিসেবে গ্রহণ করেছি।

যখন রাত্রি নেমে আসে,রাত্রির নিস্তব্ধতা চারিদিক আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন কোন সাধক বা আরেফই আলী (আ.)-এর পদমর্যাদায় পৌছতে পারে না। এমন প্রাণবন্ত ইবাদত যেন স্রষ্টার সাধনায় নিমগ্ন ও পরমাকৃষ্ট,তার দিকে ধাবমান প্রবলভাবে। আবার যখন তিনি অন্য কোন বিষয়ে মশগুল,উদাহরণস্বরূপ যখন তিনি যুদ্ধ ও সংগ্রামে লিপ্ত (যুদ্ধক্ষেত্রে) তরবারীর আঘাতে তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত,শরীর থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে এক দিকে পড়ে গেছে,কিন্তু এতটা নিমগ্ন যে,অনুভব করেন নি একটুকরা মাংস তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গভীর মনসংযোগের কারণে সে দিকে লক্ষ্যই নেই। আলী ইবাদতের সময় এতটা উষ্ণ হয়ে উঠেন যে,আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসায় তার অস্তিত্ব যেন এক প্রজ্বলিত শিখা যার অবস্থান এ পৃথিবীতে নয়। নিজেই এক দল ব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন,

هَجَمَ بِهِمُ الْعِلْمُ عَلَى حَقِيقَةِ الْبَصِيرَةِ، وَ بَاشَرُوا رُوحَ الْيَقِينِ، وَ اسْتَلاَنُوا مَا اسْتَوْعَرَهُ الْمُتْرَفُونَ، وَ اءَنِسُوا بِمَا اسْتَوْحَشَ مِنْهُ الْجَاهِلُونَ، وَ صَحِبُوا الدُّنْيَا بِاءَبْدَانٍ اءَرْوَاحُهَا مُعَلَّقَةٌ بِالْمَحَلِّ الْاءَعْلَى ،

জ্ঞান তাদের দিকে তার দিব্যতাসহ প্রকৃতরূপে ধাবিত হয়েছে,ইয়াকীনের প্রাণকে তারা কর্মে নিয়োজিত করেছে,যা দুনিয়াদারদের জন্য কঠিন ও অসহ্য তা তাদের নিকট সহজ হয়ে গেছে,জাহেলরা যা থেকে ভীত তারা তার প্রতি আকৃষ্ট,যদিও তারা মানুষের মাঝে শারীরিকভাবে অবস্থান করছে তদুপরি তাদের আত্মা উচ্চতর এক স্থানে সংযুক্ত। (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ১৩৯)

ইবাদতরত অবস্থায় তার দেহ থেকে তীর খুলে ফেলা হয়েছে,অথচ তিনি এমনভাবে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট ও ইবাদতে নিমগ্ন যে অনুভবও করেননি। ইবাদতের মেহরাবে তিনি এতটা ক্রন্দনশীল যার নজীর কেউ দেখেনি। আবার দিনের বেলায় আলী যেন ভিন্ন কোন মানুষ। সঙ্গীদের সাথে যখন বসেন তখন হাসি মুখ,খোলা-মেলা তার আচরণ। তার চেহারা সব সময় হাস্যোজ্জ্বল। আলী (আ.) এত বেশি মুক্ত মনের ছিলেন যে,আমর ইবনে আস আলীর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতো যে,আলী খেলাফতের উপযুক্ত নয়। কারণ হাসিমুখ ও মনখোলা মানুষ খেলাফতের জন্য অনুপযোগী।

খেলাফতের জন্য কঠিন মুখাবয়বের প্রয়োজন যাতে মানুষ তাকে ভয় পায়। এটা নাহজুল বালাগায় আলী নিজেই বর্ণনা করেছেন-

عجبا لابن النابغة یزعم لاهل الشام أنّ فی دعابة و انّی امر تلعبة

নাবেগার সন্তানের কথায় আশ্চর্যান্বিত হই যে বলে,আলী মানুষের সাথে হাসি মুখে কথা বলে,খুবহাসি-ঠাট্টা করে,মজাদার লোক।

যখন আলী শত্রুর সাথে যুদ্ধের ময়দানে একজন যোদ্ধার বেশে আবির্ভূত তখনও তিনি মন খোলা ও হাসি মুখ। কবি বলছেন,

هو البکّاء فی المحرب لیلا

هو الضحّاک اذا اشدّ الضرب

তিনি ইবাদতের মেহরাবে যেমন অত্যন্ত ক্রন্দনশীল তেমনি যুদ্ধের ময়দানে হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।

তিনি কেমন মানুষ? এটাই কোরআনী মানুষ। কোরআন এমন মানুষই চায়।

انّ ناشیة اللیل هی اشدّ وطا وّاقوم قیلا انّ لک فی النّهار سبحا طویل

  নিশ্চয় (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) রাত্রিকালের উত্থান আত্মশুদ্ধির জন্য সর্বাধিক কঠিন পন্থা এবং বাক্যালাপে সর্বাধিক দৃঢ়তা দানকারী। নিশ্চয় দিবসে তুমি দীর্ঘ কর্ম ব্যস্ততায় নিমগ্ন থাক। অর্থাৎ রাতকে ইবাদতের জন্য রাখ আর দিনকে সামাজিক কাজকর্মের জন্য। আলী যেন রাত্রিতে এক ব্যক্তিত্ব,আর দিনে অন্য এক ব্যক্তিত্ব।

হাফেজ শিরাজী যেহেতু একজন মুফাস্সির ছিলেন সেহেতু কোরআনের রহস্যকে বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতেন। নিজস্ব ভঙ্গিতে ভাষার গাঁথুনীতে এ বিষয়টি তিনি কবিতায় এনেছেন-

দিনে রত হও অর্জনের চেষ্টায়

রাত তো সময় মাতাল হওয়ার শরাবের নেশায়।

হৃদয়রূপ আয়নায় মরিচা তো পড়বেই

মরিচা সরানোর সময় তো রাতের আঁধারেই।

 আলী (আ.)-এর দিবারাত্রি এমনই ছিল। বিপরীত চরিত্রের সমন্বয়-যা পূর্ণ মানবের জন্য প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য তা হাজার বছর পূর্বের আলীর মধ্যে দেখা যায়। সাইয়্যেদ রাজী নাহজুল বালাগার ভূমিকায় বলছেন, যে বিষয়টি সব সময় বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং যাতে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যান্বিত হই তা হলো আলী (আ.)-এর বক্তব্যগুলোর যে কোন একটিতে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন এক বিশ্বে প্রবেশ করেছি। কখনো কোন আবেদের জগতে,কখনো বা যাহেদের জগতে,কখনো দর্শনের জগতে,কখনো আধ্যাত্মিকতার জগতে,কখনো সৈনিক বা সামরিক কর্মকর্তার জগতে,কখনো ন্যায়পরায়ণ বিচারক বা শাসকের বা ধর্মীয় নেতার জগতে। সকল বিশ্বেই আলীর উপস্থিত। মানব বিশ্বের কোন স্থানেই আলী অনুপস্থিত নন।

সাফিউদ্দিন হিল্লী যিনি অষ্টম হিজরী শতাব্দীর একজন কবি ছিলেন তিনি বলেছেন,

جمعت فی صفاتک الاضداد

فلهذا عزّت لک الانداد

 “ বিপরীত বৈশিষ্ট্য হয়েছে তোমায় সমন্বিত

তাই তুমি হয়েছ মহিমান্বিত।

زاهد حاکم حلیم شجاع

ناسک فاتک فقیر جواد

 “ আত্মসংযমী শাসক তুমি,সহনশীল বীর

ফকির তুমি,দুনিয়াত্যাগী পীর।

যেমন সহনশীলতা ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে তুমি সর্বোচ্চ পর্যায়ে তেমনি সাহসিকতার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। রক্তপাতের ক্ষেত্রে যেখানে কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তির রক্ত ঝরাতে হবে সেখানে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা,আবার ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। নিঃস্ব ও সম্পদহীন তিনি,অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। দানশীল ছিলেন বলেই সম্পদ তার হাতে গচ্ছিত থাকত না।

দাতা কভু পারে না সম্পদ সঞ্চয় করতে

প্রেমিক অন্তর পারে না কভু ধৈর্য ধরতে,

পানিরে পারা যায় না কভু ছাকনিতে আটকাতে।

তেমনি আলী (আ.)-কে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

خلق یخجل النسیم من العطف

و بأس یذوب منه الجماد

কোথাও তোমার চরিত্র এমন যে,তোমার কোমলতা দেখে মৃদুমন্দ বাতাসও লজ্জা পায় কখনো তোমার দৃঢ়তা পাথরকেও হার মানায়  

অর্থাৎ সাহসিকতা,শৌর্য আর সংগ্রামী তার আত্মার মোকাবিলায় পাথর,শীলা বা ধাতুও গলে যায়। আবার তার চারিত্রিক কোমলতাই মৃদমন্দ বাতাসকেও লজ্জা দেয়। একই ব্যক্তির মধ্যে কোমলতা ও কঠোরতার এক অপূর্ব সমন্বয়। তুমি কেমন আশ্চর্য সৃষ্টি?

অতএব,পূর্ণ মানব অর্থ সেই মানুষ যিনি সকল মানবিক মূল্যবোধে বলীয়ান। মানবতার সকল ময়দানে তিনি শ্রেষ্ঠ। এখান থেকে আমরা কি শিক্ষাগ্রহণ করব? এ শিক্ষাগ্রহণ করব যে,ভুল করে শুধু একটি মূল্যবোধকে গ্রহণ করে অন্যান্য মূল্যবোধকে যেন আমরা ভুলে না যাই। যদিও আমরা সকল মূল্যবোধের ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারব না,কিন্তু নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত সকল মূল্যবোধই একত্রে ধারণ তো করতে পারি। যদি পূর্ণ মানুষ নাও হই অন্তত ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ তো হতে পারি। আর তখনই একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে সকল ময়দানে আমরা উপস্থিত হতে পারব। সুতরাং এটাই পূর্ণ মানুষের রূপ। ইনশাল্লাহ্ আমরা পরবর্তী বৈঠকে বাকী অংশ আলোচনা করব।

হযরত আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ দিনগুলো

আলী (আ.)-এর জীবনের শেষ রমযান মাস অন্য এক রকম রমযান যা ভিন্ন এক পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছিল। আলীর পরিবারের জন্যও এ রমযান প্রথম দিক থেকেই অন্য রকম ছিল। ভয় ও শঙ্কার একটি মিশ্রিত অবস্থা বিরাজমান ছিল। (খাওয়ারেজ আলী (আ.)-কে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েছিল) সেহেতু আলীর জীবনধারা এ রমযানে অন্য রমযানের থেকে অন্য রকম ছিল।

হযরত আলীর শক্তিমত্তার একটি বর্ণনা নাহজুল বালাগা থেকে এখানে বর্ণনা করব। আলী (আ.) বলেছেন,

لما انزل الله سحانه قوله ( الم أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ ) علمت انّ الفتنة لا بنا و رسل الله (ص) بین اظهرنا 

যখন এ আয়াত মানুষ কি ভেবে নিয়েছে আমরা ঈমান এনেছি এ কথা বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না (আনকাবুত ১-২) নাযিল হলো তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মৃত্যুর পর এ উম্মতের জন্য ফেতনা ও কঠিন পরীক্ষা আসবে।

فقلت: یارسول الله (ص) ما هذه الفتنة التی اخبرک الله تعالی بها

তখন রাসূলকে প্রশ্ন করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! এ আয়াতে আল্লাহ্ যে ফেতনার কথা বলছেন সেটা কি? তিনি বললেন :

یا علی إنّ امتی سیفتون من بعدی

হে আলী! আমার পর আমার উম্মত পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যখন আলী শুনলেন রাসূল মৃত্যুবরণ করবেন এবং তার পরে কঠিন পরীক্ষা আসবে তখন ওহুদের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে বললেন,

یا رسول الله او لیس قد قلت لی یوم احد حیث استشهد من استشهد من المسلمین و خیّزت عنّی الشهادة

ইয়া রসুলাল্লাহ্! ওহুদের দিনে যারা শহীদ হওয়ার তারা শহীদ হলেন (মুসলমানদের মধ্যে সত্তরজন শহীদ হয়েছিলেন যাদের নেতা ছিলেন হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং আলী ওহুদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের একজন ছিলেন) অর্থাৎ তারা শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করলেন এবং শাহাদাত আমার থেকে দূরে চলে গেল,আমি এর থেকে বঞ্চিত হলাম এবং খুবই দুঃখ পেয়ে আপনাকে প্রশ্ন করলাম,কেন এ মর্যাদা আমার ভাগ্যে ঘটল না। (আলী এ সময় পঁচিশ বছরের যুবক ছিলেন এবং এক বছর হলো হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-কে বিবাহ করেছেন এবং এক সন্তানের জনক। এ বয়সের যুবক যখন জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর স্বপ্ন দেখে তখন আলী শাহাদাতের প্রত্যাশী।) আপনি বললেন,ابشر فإنّ الشهادة من ورائک যদিও এখানে শহীদ হওনি কিন্তু অবশেষে শাহাদাত তোমার ভাগ্যে ঘটবে। তারপর মহানবী বললেন,

إنّ ذلک لکذلک فکیف صبرک اذن

অবশ্যই এমনটি হবে তখন তুমি কিরূপে ধৈর্যধারণ করবে। এখানে ধৈর্যের স্থান নয়,বরং শোকরকরার স্থান। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ১৫৪)

রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে নিজের শাহাদাত সম্পর্কে যে খবর তিনি শুনেছিলেন সে সাথে বিভিন্ন আলামত যা তিনি দেখতেন,কখনো কখনো তা বলতেন যা তার পরিবারের সদস্য এবং নিকটবর্তী শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাহাবীদের মধ্যে শঙ্কা ও কষ্ট বৃদ্ধি করত। তিনি আশ্চর্যজনক কিছু কথা বলতেন। এ রমযান মাসে নিজের ছেলে-মেয়েদের ঘরে ইফতার করতেন। প্রতি রাতে যে কোন এক ছেলে বা মেয়ের ঘরে মেহমান হতেন- কোন রাতে ইমাম হাসানের ঘরে,কোন রাতে ইমাম হুসাইনের ঘরে,কোন রাতে হযরত যয়নাবের ঘরে (যিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে জা ফরের স্ত্রী ছিলেন)। এ মাসে অন্যান্য সময়ের চেয়ে কম খাবার খেতেন। সন্তানরা এতে খুবই কষ্ট পেতেন। তারা কখনো প্রশ্ন করতেন, বাবা,কেন এত কম খান? তিনি বলতেন, আল্লাহর সাথে এমনাবস্থায় মিলিত হতে চাই যে উদর ক্ষুধার্ত থাকে। সন্তানরা বুঝতেন তাদের পিতা কিছুর জন্য যেন অপেক্ষমান। কখনো কখনো তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতেন, আমার ভাই ও বন্ধু রাসূল (সা.) আমাকে যে খবর দিয়েছেন তা অবশ্যই সত্য। তার কথা কখনো মিথ্যা হতে পারে না। খুব নিকটেই তা সত্যে পরিণত হবে।

তের রমযান এমন কিছু বললেন যা অন্য সব দিনের চেয়ে পরিবেশকে বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলল। সম্ভবত জুমআর দিন খুতবা পড়লেন। ইমাম হুসাইন (আ.)-কে প্রশ্ন করলেন, বাবা এ মাসের কত দিন বাকি রয়েছে? উত্তর দিলেন, পিতা,১৭ দিন। তিনি বললেন, তাহলে আর দেরি নেই। এ মাথা আর দাড়ি রক্তে রঞ্জিত হবে। এ শ্মশ্রু রঙ্গিন হওয়ার সময় নিকটেই।

ঊনিশে রমযান আলী (আ.)-এর সন্তানরা রাতের একটি অংশ আলীর সঙ্গে কাটালেন। ইমাম হাসান নিজের ঘরে চলে গেলেন। আলী জায়নামাজে বসলেন। শেষ রাতে উদ্বিগ্নতার কারণে (অথবা প্রতি রাতই হয়তো এ রকম করতেন) ইমাম হাসান আলীর নামাযের স্থানে গিয়ে বসলেন। (ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন হযরত ফাতেমা যাহরার সন্তান বলে ইমাম আলী এঁদের প্রতি আলাদা রকম স্নেহ দেখাতেন। কারণ এঁদের প্রতি স্নেহ রাসূলুল্লাহ্ ও ফাতেমা যাহরার প্রতি সম্মান প্রদর্শন বলে মনে করতেন) যখন ইমাম হাসান তার কাছে আসলেন তখন তিনি বললেন,

ملکتنی عینی و انا جالس فسنح لی رسول الله (ص) فقلت یا رسول الله ماذا لقیت من امّتک من الاود و اللدد فقال ادع علیهم فقلت ابدلنی الله بهم خبرا منهم و ابدلهم بی شرّ لهم منّی

পুত্র,হঠাৎ স্বপ্নের মধ্যে রাসূলকে আবির্ভূত হতে দেখলাম। যখন রাসূলকে দেখলাম তখন বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার এ উম্মতের হাতে আমার অন্তর রক্তাক্ত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তার সঙ্গে মানুষের অসহযোগিতা এবং তার নির্দেশিত পথে চলার ক্ষেত্রে তাদের অনীহা আলী (আ.)-কে তীব্র যন্ত্রণা দিয়েছে। উষ্ট্রের যুদ্ধের বায়আত ভঙ্গকারীরা,সিফফিনে মুয়াবিয়ার প্রতারণা (মুয়াবিয়া অত্যন্ত ধুর্ত ছিল,ভালোভাবেই জানত কি করলে আলীর হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করা যাবে। আর সে তা-ই করত),সবশেষে খারেজীদের রূহবিহীন আকীদা-বিশ্বাস যারা ঈমান ও এখলাছ মনে করে আলী(আ.)-কে কাফের ও ফাসেক বলত। আমরা জানি না আলীর সঙ্গে এরা কি আচরণ করেছে! প্রকৃতই যখন কেউ আলীর উপর আপতিত মুসিবতগুলো দেখে,আশ্চর্যান্বিত বোধ করে। একটি পাহাড়ও এ পরিমাণ মুসিবত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না। এমন অবস্থা যে,আলী তার এই মুসিবতের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এখন যখন রাসূলে আকরাম (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলেন তখন বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনার এ উম্মত আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এদের নিয়ে আমি কি করব? তারপর ইমাম হাসানকে বললেন, পুত্র,তোমার নানা আমাকে নির্দেশ দিলেন এদের প্রতি অভিশাপ দিতে। আমিও স্বপ্নের মধ্যেই অভিশাপ দিয়ে বললাম : হে আল্লাহ্! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে মৃত্যুদান কর এবং এদের উপর এমন ব্যক্তিকে প্রভাব ও প্রতিপত্তি দান কর এরা যার উপযুক্ত।

বোঝা যায়,এ বাক্যের সাথে কতটা হৃদয়ের বেদনা ও দুঃখ জড়িয়ে রয়েছে! আলী (আ.) সুবহে সাদিকের সময় ঘর থেকে যখন বের হচ্ছিলেন বাড়ির হাঁসগুলো অসময়ে ডেকে উঠল। আলী বললেন,

دعو هنّ فانّهنّ صوائح تتبعها نوائح

  এখন পাখির কান্না শোনা যাচ্ছে,বেশি দেরি নয় এরপর এখান থেকেই মানুষের কান্না শোনা যাবে। উম্মে কুলসুম আমিরুল মুমিনীনের সামনে এসে বাঁধা দিলেন। তিনি বললেন, বাবা,আপনাকে মসজিদে যেতে দেব না। অন্য কাউকে আজ নামায পড়াতে বলুন। প্রথমে বললেন, জুদাহ ইবনে হুবাইরাকে বলুন জামাআত পড়াতে। পরক্ষণেই আলী বললেন, না আমি নিজেই যাব। বলা হলো,অনুমতি দিন আপনার সঙ্গে কেউ যাক। তিনি বললেন, না,আমি চাই না কেউ আমার সঙ্গে যাক।

হযরত আলীর জন্য রাতটি অত্যন্ত পবিত্র ছিল। আল্লাহ্ জানেন আলীর মধ্যে সে রাত্রে কেমন উত্তেজনা ছিল! তিনি বলছেন, আমি অনেক চেষ্টা করেছি এ আকস্মিক শিহরণের রহস্য উদ্ঘাটন করব। যদিও ধারণা ছিল কোন বড় ঘটনা ঘটবে যা অপেক্ষায় আছে। যেমন নাহজুল বালাগায় আলী(আ.) নিজেই বলছেন,

کم اطردت الایام عن مکنون هذا الامر فابی الله الا اخفاءه

অনেক চেষ্টা করেছি এ রহস্যের গোপনীয়তা উদ্ঘাটন করব,কিন্তু আল্লাহ্ চাননি,বরং তিনি এটা গোপন রেখেছেন।

নিজেই ফজরের আজান দিতেন। সুবহে সাদিকের সময় নিজেই মুয়াজ্জিনের স্থানে দাঁড়িয়ে (আল্লাহু আকবার বলে) উচ্চৈঃস্বরে আজান দিলেন। সেখান থেকে নামার সময় সুবহে সাদেকের সাদা আভাকে বিদায় জানালেন। তিনি বললেন, হে সাদা আভা! এ ফজরে একদিন আলী এ পৃথিবীতে চোখ খুলেছিল। এমন কোন ফজর কি আসবে যে,তুমি থাকবে আর আলী ঘুমিয়ে থাকবে। নাকি এবার আলীর চোখ চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে। যখন তিনি নেমে এলেন তখন বললেন,

خلو سبیل المومن المجاهد

فی الله ذی الکتب وذی المشاهد

فی الله لا یعبد غیر الواحد

و یوقظ الناس الی المساجد

  এই মুমিন ও মুজাহিদের জন্য রাস্তা খুলে দাও (নিজেকে মুমিন ও মুজাহিদ বলে উল্লেখ করেছেন) যে গ্রন্থ ও শাহাদাতের অধিকারী,একক খোদা ব্যতীত কারো ইবাদত করেনি এবং মানুষকে মসজিদে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠাতো।

পরিবারের কাউকে অনুমতি দেননি বাইরে যাওয়ার। আলী বলেছিলেন, পাখিদের কান্নার পর মানুষের আহাজারি শুনতে পাবে। স্বাভাবিকভাবেই হযরত যয়নাব কোবরা,উম্মে কুলসুম ও পরিবারের বাকী সদস্যরা উদ্বিগ্ন অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ করে এক প্রচণ্ড চীৎকারে সবাই বুঝতে পারলেন। একটি আওয়াজ চারিদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল-

تهدّمت و الله ارکان الهدی و انطمست اعلام التّقی و انفصمت العروة قتل ابن عمّ المصطفی قتل الوصیّ المجتبی قتل علیّ المرتضی قتله اشقی الشقیا

দীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছে,তাকওয়ার ধ্বজা ভূলুন্ঠিত হয়েছে,মজবুত বন্ধন ছিন্ন হয়ে পড়েছে,আলী মোর্তজাকে হত্যা করা হয়েছে,তাকে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হত্যা করেছে।

لا حول و لا قوّة الا بالله العلی العظیم

বিবিধ দৃষ্টিকোণে মানুষের বেদনার অনুভূতি

) وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ(

মানব সত্তা ও তার স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। সর্বোপরি দু টি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিই একটি অপরটির বিপরীতে অবস্থান করছে : রূহবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। রূহবাদীদের দৃষ্টিতে মানুষ হলো প্রকৃতপক্ষে দেহ ও আত্মার সমষ্টি এবং মানুষের আত্মা চিরন্তন অমর-যা তার মৃত্যুর ফলে নিঃশেষ হয়ে যায় না। একইভাবে ধর্মীয় যুক্তিতে বিশেষ করে ইসলামের অকাট্যভাষ্যে এরই যৌক্তিকতা নির্দেশিত হয়েছে। অপর মতবাদটি হলো মানুষ আসলে যান্ত্রিক দেহ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং মৃত্যুর ফলে সম্পূর্ণ বিলীন ও নিঃশেষ হয়ে যায়। আর দৈহিক বিনাশের অর্থই হলো মানবসত্তার বিনাশ।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14