১০ম পাঠ
ক্রিয়াগত গুণাবলী
ভূমিকা
পূর্ববর্তী পাঠে বর্ণিত হয়েছে যে,ক্রিয়াগত গুণসমূহ বলতে বুঝায় সে সকল ভাবার্থকেই,যা প্রভুসত্তাকে তাঁর সৃষ্ট বিষয়সমূহের সাথে তুলনা করতঃ এ দুয়ের পারস্পরিক বিশেষ সস্পর্ক থেকে বোধগম্য হয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্ট বিষয় এ দুয়ের সমন্বয়ে এ সস্পর্ক রূপ লাভ করে। যেমন : স্বয়ং‘
সৃজন’যা মহান আল্লাহর উপর সৃষ্ট বিষয়ের অস্তিত্বের নির্ভরশীলতাকে বুঝায় এবং যদি এ সস্পর্ককে (সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি বিষয়ের যুগপৎ সস্পর্ক) বিবেচনা না করা হয়,তবে এ ধরনের ভাবার্থ আমাদের হস্তগত হয় না।
প্রভু এবং সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিবেচ্য সস্পর্কসমূহকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবে,এক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ গুলোকে দু‘
শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে :
এক শ্রেণীর সস্পর্ক আছে,যেগুলো প্রভু এবং সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষরূপে বিবেচ্য। যেমন : অস্তিত্ব দান,সৃষ্টি,অভূতপূর্ব সৃষ্টি ইত্যাদি। অপর এক শ্রেণীর সস্পর্ক হল,যা অন্য কোন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য। যেমন : রিজক্ (অন্নদান )। কারণ সর্বাগ্রে অন্নগহণকারীর অস্ত্রিত্বকে,ঐ সকল উপাদান যেগুলো থেকে সে রুযী গ্রহণ করে সেগুলোর সাথে বিবেচনা করতঃ প্রভুর পক্ষ থেকে যে তা (রুযী) প্রদত্ত হয়ে থাকে,সেটা বিবেচিত হয়ে থাকে। আর কেবলমাত্র তখই অন্নদাতা (رازق
) ও প্রকৃত অন্নদাতার (رزّاق
) ধারণা অর্জিত হয়। এমনকি কখনো কখনো এমনও হতে পারে যে,প্রভুর ক্রিয়াগত গুণের ধারণা অর্জিত হওয়ার পূর্বেই স্বয়ং সৃষ্টিকুলের মধ্যে একাধিক সস্পর্ক বিবেচনায় আসে। অতঃপর ঐ গুলোর সস্পর্ককে মহান আল্লাহর সাথে সস্পর্কিত করা হয়,অথবা প্রভু ও সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান একাধিক আদি সম্পর্কের ফলশ্রুতিস্বরূপ কোন সস্পর্করূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন : ক্ষমা (مغفرة
) যা প্রভুর বিধিগত বা অনির্ধারিত প্রভুত্বু(ربوبیت تشریعی
),কার্যকরী আইন প্রণয়ন এবং বান্দার অবাধ্যতার সাথে সস্পর্কযুক্ত ।
অতএব প্রভুর ক্রিয়াগত গুণাবলী সম্পর্কে জানতে হলে মহান প্রভু ও তার সৃষ্ট জগতের মধ্যে তুলনা করতঃ এতদ্ভয়ের মধ্যে একপ্রকার সস্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে,যাতে প্রভু ও সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লেখিত দ্বিপাক্ষিক সস্পর্ককে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রভুর পবিত্র সত্তাকে বিবেচনা করলে ক্রিয়াগত গুণাবলীর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না। আর এটাই হল প্রভুর সত্তাগত গুণাবলী ও ক্রিয়াগত গুণাবলীর মধ্যে মূল পার্থক্য।
তবে ইতিপূর্বে যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে যে,ক্রিয়াগত গুণসমূহকে তাদের উৎসের ভিত্তিতে বিবেচনা করলে,তারা সত্তাগত গুণে প্রত্যাবর্তন করে। যেমন : সৃষ্টিকর্তাকে যদি‘
সৃষ্টি করতে সক্ষম’এমন কাউকে বোঝানোর ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় তবে তা ক্ষমতা নামক গুণের দিকে ফিরে যায় অথবা শ্রবণ ও দর্শন যদি‘
শ্রবণযোগ্য ও দর্শনযোগ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত’অর্থে ব্যবহৃত হয়,তবে তা প্রজ্ঞা নামক গুণের দিকে প্রত্যাবর্তন করে ।
অপরদিকে সত্তাগত গুণের অন্তর্ভুক্ত কোন কোন ভাবার্থ সম্বন্ধসূচক বা ক্রিয়ামূলক অর্থে বিবেচিত হয় এবং এ অবস্থায় ঐগুলো ক্রিয়াগত গুণ বলে পরিগণিত হয়। যেমন : পবিত্র কোরানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রজ্ঞা (علم
) শব্দটি ক্রিয়াগত গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করা সমীচীন বলে মনে করছি। নিম্নে তা বর্ণিত হল :
যখন প্রভু ও বস্তুগত অস্তিত্বের মধ্যে কোন সস্পর্ককে বিবেচনা করা হয় এবং এর ভিত্তিতে মহান আল্লাহর জন্যে বিশেষ ক্রিয়াগত গুণের ধারণার প্রকাশ ঘটে,তখন উল্লেখিত গুণ,বস্তুগত অস্তিত্বসমূহ,যেগুলো (দ্বিপাক্ষিক) সম্পর্কের এক পক্ষের ভূমিকায় অবস্থান করে,তাদের সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে স্থান ও কালের শর্তাধীন হয়ে পড়ে। তবে (দ্বিপাক্ষিক ) সম্পর্কের অপরপক্ষ,মহান আল্লাহর সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে (উল্লেখিত গুণগুলো) এ ধরনের (উপরে বর্ণিত) কোন শর্ত ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকবে।
উদাহরণস্বরূপ,অন্নগ্রাহককে অন্নদান,কোন এক বিশেষ স্থান ও কালে সস্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এ শর্তগুলো প্রকৃতপক্ষে অন্নগ্রাহক-অস্তিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট-অন্নদাতার সাথে নয়। আর প্রভুরৃ পবিত্র সত্তা কোন প্রকার স্থান ও কালের শর্ত থেকে পবিত্র।
এটি একটি অতি সূক্ষ¥ ব্যাপার এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন গুণ ও কর্ম কাণ্ডের পরিচিতির ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠিস্বরূপ,যেগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন তার্কিক ও মধ্যে তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
সৃজনক্ষমতা
সম্ভাব্য অস্তিত্বসমূহের উৎপত্তির ক্ষেত্রে,প্রারম্ভিক কারণরূপে অনিবার্য অস্তিত্বের প্রমাণের পর এবং সম্ভাব্য অস্তিত্বসমূহ স্বীয় অস্তিত্বের জন্যে সর্বদা ঐ অনিবার্য অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল এটা বিবেচনার পর,অনিবার্য অস্তিত্বের জন্যে‘
সৃজনক্ষমতা’এবং সম্ভাব্য অস্তিত্বের জন্যে‘
সৃজিত’ গুণ হিসেবে প্রকাশ পায়। সৃষ্টিকর্তার ধারণা,যা অস্তিত্বের এ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রকাশ পায়,তা অস্তিত্বদানকারী কারণের বা অস্তিত্বে আনয়নকারীর সমান এবং সকল সম্ভাব্য ও নির্ভরশীল অস্তিত্ব তাঁর সাথে সস্পর্কযুক্ত পক্ষ হিসেবে‘
সৃজিত’বলে গুণান্বিত হয়ে থাকে ।
তবে কখনো কখনো সৃজন (خلق
) শব্দটি,কিছুটা সীমাবদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং শুধুমাত্র ঐ সকল অস্তিত্বের সাথেই সংশ্লিষ্ট হয়,যারা প্রারম্ভিক বস্তু থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে। আর এর বিপরীতে‘
অভূতপূর্ব সৃষ্টি’(ابداع
) নামক অপর এক ভাবার্থ,যা ঐ সকল অস্তিত্ব যারা কোন প্রাথমিক বস্তু থেকে অস্তিত্বপ্রাপ্ত নয়,তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে (যেমন : নির্বস্তুকসমূহ¡‘এবং প্রারম্ভিক বস্তসমূহ)। আর এরূপে অস্তিত্বদান-সৃষ্টিকরণ (خلق
) ও অভূতপূর্ব সৃষ্টিকরণ (ابداع
),এদু‘
ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে।
যা হোক,আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্টিকরণ,মানুষ কর্তৃক একাধিক বস্তুর সমন্বয়ে কোন কৃত্রিম সৃষ্টির মত নয় যে,গতি এবং দৈহিক অঙ্গ - প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনের উপর নির্ভরশীল হবে এবং গতি‘ক্রিয়া’নামে ও এর ফলে অর্জিত বিষয়‘
ক্রিয়ার ফল’নামে পরিচিত হবে । অনুরূপ,এমন নয় যে,সৃষ্টিকরণ এক ব্যাপার আর‘
সৃষ্ট বিষয়’অন্য ব্যাপার। কারণ মহান আল্লাহ বস্তুগত গতি ও বস্তুগত বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র। যদি‘
সৃষ্টিকরণ’সৃষ্ট সত্তার উপর বর্তিত অতিরিক্ত কোন স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত (مصداق
) হত,তবে তা‘
সম্ভাব্য অস্তিত্ব’ও‘
সৃষ্ট বিষয়সমূহের’মধ্যে একটি বলে পরিগণিত হয়। ফলে এর (সৃষ্টিকরণের) সৃষ্টি সম্পর্কে একাধিক বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটত। অথচ ক্রিয়াগত গুণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে,এ ধরনের গুণ প্রভু ও সৃষ্ট বিষয়ের সস্পর্ককে বিবেচনা করে বোধগম্য হয়ে থাকে। আর এ সস্পর্ক বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অনুধাবনযোগ্য।
প্রতিপালনক্ষমতা
বিশেষ করে স্রষ্টা এবং সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়,তা হল : সৃষ্ট বিষয়সমূহ শুধুমাত্র মূল অস্তিত্ব ও উৎপত্তির জন্যেই আল্লাহর উপর নির্ভরশীল নয়;বরং সমস্ত অস্তিত্বের জন্যেই মহান প্রভুর উপর নির্ভরশীল এবং কোন প্রকারেই স্বাধীন নয় । মহান প্রভু যেভাবেই ইচ্ছা করেন,সেভাবেই সৃষ্ট বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং তিনিই ঐগুলোর যাবতীয় বিষয়ে তত্বাবধান করে থাকেন ।
যখন এ সস্পর্ককে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা হয় তখন প্রতিপালন ক্ষমতার ধারণা পাওয়া যায়,যার ফলশ্রুতি হল তত্বাবধান এবং এর দৃষ্টান্ত অনেক। যেমন : রক্ষা,পরিচর্যা,জীবনদান ও মৃত্যদান,অন্নদান,বিকাশ ও উৎকর্ষে পৌঁছানো,পথ প্রদর্শন এবং আদেশ-নিষেধের বিষয়রূপে স্থান দান ইত্যাদি।
প্রকরণভেদে প্রতিপালনের পর্যায়গুলোকে দু‘
শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে সুনির্ধারিত ও বিধিগত ।
সুনির্ধারিত প্রতিপালন (ربوبیت تکوینی
) সকল সৃষ্ট বিষয় ও ঐ গুলোর প্রয়োজন ও চাহিদাকে পূরণ তথা সমগ্র বিশ্ব পরিচালনাকে সমন্বিত করে। আর বিধিগত প্রতিপালন (ربوبیت تشریعی
)
শুধুমাত্র সচেতন ও ইচ্ছার অধিকারী অস্তিত্বের জন্যে নির্দিষ্ট এবং ঐশী কিতাবসমূহ ও নবী-রাসূল প্রেরণ,দায়িত্ব নির্ধারণ ও আদেশ -নিষেধ প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ।
সুতরাং প্রভুর নিরংকুশ প্রতিপালন ক্ষমতার অর্থ হল : সৃষ্ট বিষয়সমূহ তাদের অস্তিত্বের সকলস্তরেই মহান প্রভুর উপর নির্ভরশীল এবং তাদের পারস্পরিক যে নির্ভরশীলতা,পরিশেষে তার পরিসমাপ্তি মহান সৃষ্টিকর্তাতেই ঘটে। তিনিই সে সত্তা,যিনি তাঁর সৃষ্টির এক অংশ দিয়ে অপর অংশকে তত্ত্বাবধান করেন,অন্নগ্রাহককে সৃষ্ট অন্ন থেকে অন্ন দান করেন,সচেতন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাকে আভ্যন্তরীণ মাধ্যম (যেমন : আক্বল বা বুদ্ধিবৃত্তি এবং অন্যান্য বোধশক্তি) এবং বাহ্যিক মাধ্যম (যেমন : নবীগণ ও ঐশী কিতাবসমূহ) দ্বারা পথনির্দেশ করেন এবং মানুষের জন্যে নীতি প্রণয়ন,দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করেন।
প্রতিপালনও সৃজনক্ষমতার মত সম্বন্ধীয় (ضافی
) ভাবার্থযুক্ত। তবে পার্থক্য হল এই যে,প্রতিপালনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান বিশেষ সস্পর্ককেও বিবেচনা করা হয়,যা রিয্ক প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে ।
প্রতিপালন ও সৃজনের অর্থের আলোকে এবং তাদের সম্বন্ধযুক্ত হওয়া থেকে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,এ দু‘
টি গুণ পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সস্পর্কযুক্ত। আর এটা অসম্ভব যে,বিশ্বের প্রতিপালক এর সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন অন্য কেউ হবেন,বরং তিনিই হবেন এ বিশ্বের পরিচালক ও রক্ষাকর্তা,যিনি এ সকল সৃষ্টিকে সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহকারে এবং পারস্পরের উপর নির্ভরশীল করে সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রতিপালন ক্ষমতা,পরিচালন ক্ষমতার তাৎপর্য,সৃষ্টি প্রক্রিয়া ও সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সংহতি থেকে প্রকাশ লাভ করে।