আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)0%

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড) লেখক:
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক: আয়াতুল্লাহ্ মুহাম্মদ তাকী মিসবাহ্ ইয়াযদী
: মুহাম্মদ মাঈন উদ্দিন
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বিভাগ:

ভিজিট: 15565
ডাউনলোড: 4610

পাঠকের মতামত:

বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15565 / ডাউনলোড: 4610
সাইজ সাইজ সাইজ
আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

আকায়েদ শিক্ষা ( প্রথম খণ্ড)

লেখক:
প্রকাশক: আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা,কোম,ইরান
বাংলা

জ্ঞান :

জ্ঞান হল স্বতঃসিদ্ধতম ভাবার্থসমূহের একটি। তবে সৃষ্ট বিষয়াদির মধ্যে এর যে দৃষ্টান্ত আমরা লক্ষ্য করে থাকি তা সীমাবদ্ধ ও অসম্পূর্ণ। সুতরাং এ ধরনের বিশেষত্ব সহকারে মহান প্রভুর উপর তা আরোপযোগ্য হবে না। কিন্ত ইতিপূর্বে যেমনটি উল্লেখ হয়েছে যে,বুদ্ধিবৃত্তি (عقل ) এভাবার্থের পূর্ণতার জন্যে এমন কোন দৃষ্টান্তকে বিবেচনা করতে পারে,যার কোন প্রকার অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা থাকবে না এবং যা জ্ঞানীর অভিন্ন সত্তার অন্তগত হবে। আর তা-ই হল মহান প্রভুর সেই সত্তাগত গুণ।

প্রভুর জ্ঞানকে একাধিক উপায়ে প্রতিপাদন করা যেতে পারে,যাদের একটি হল সে পথ,যা সকল সত্তাগত গুণের প্রমাণের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ যেহেতু সৃষ্ট বিষয়াদির মধ্যে জ্ঞান বিদ্যমান,সেহেতু তাদের সৃষ্টিকর্তার মধ্যে ও (এ জ্ঞান) চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।

(প্রভুর প্রজ্ঞাকে প্রমাণের জন্যে) অপর পথটি সুবিন্যস্ততার দলিলের উপর নির্ভরশীল যা নিম্নরূপ :

কোন সৃষ্ট বিষয়ে যতোধিক শৃঙ্খলা ও বিন্যাস ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হবে,তা ততোধিক অস্তিত্বে আনয়নকারীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে প্রমাণ বহন করবে। যেমনঃ কোন তাত্ত্বিক বই অথবা কোন একটি সুন্দর কবিতা কিংবা অন্য যে কোন শিল্পকর্ম,প্রণয়নকারীর জ্ঞান,সুরুচি ও দক্ষতার প্রমাণ বহন করে এবং কখনোই কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষেই এটা ভাবা সম্ভব নয় যে,একটি তাত্ত্বিক অথবা দার্শনিক বই কোন এক অজ্ঞ ও নিরক্ষর ব্যক্তি কর্তৃক লিখিত হয়েছে। অতএব কিরূপে ধারণা করা যায় যে,এত রহস্য ও বিস্ময় সম্বলিত এ মহাবিশ্ব,কোন এক অজ্ঞ অস্তিত্ব কর্তৃক সৃজিত হয়েছে ?

সর্বশেষে (প্রভুর প্রজ্ঞাকে প্রমাণের জন্যে) তৃতীয় পন্থাটি,কতগুলো (অস্বতঃসিদ্ধ) পরোক্ষ (نظری ) দার্শনিক প্রতিজ্ঞার উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে। যেমন : প্রত্যেক স্বাধীন নির্বস্তুক (مجرد ) অস্তিত্বই জ্ঞানের অধিকারী।১১ (যা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থসমূহে প্রমানিত হয়েছে )

প্রভুর জ্ঞানের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করা আত্মগঠনের জন্যে অতীব গুরুত্বপর্ণ। এজন্যই পবিত্র কোরানে এ সম্পর্কে অনবরত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে । উদাহরণতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে :

) يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ(

মহান আল্লাহ প্রতারকদের চক্ষুসমূহ ও অন্তরের রহস্যসমূহ সম্পর্কে অবগত আছেন (সুরা মুমিন-১৯) ।

ক্ষমতা :

যদি কর্তা স্বীয় কর্মকে স্বেচ্ছায় সস্পন্ন করে থাকেন তবে বলা হয়ে থাকে যে,তার কর্ম সম্পাদনের ক্ষমতা (قدرت ) রয়েছে। অতএব ক্ষমতা বলতে বুঝায় সম্ভবপর সকল কার্যের জন্যে স্বাধীন কোন কর্তার সক্ষমতাকে। কর্তা অস্তিত্বের মর্যাদার দৃষ্টিতে যতবেশী পরিপূর্ণ হবে ততবেশী ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং যে অস্তিত্ব অসীম পূর্ণতার অধিকারী,তার ক্ষমতা হবে অপরিসীম।

( إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ)

-নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান (সুরা বাকারা-২০) ।এখানে কয়েকটি বিষয় স্মরণযোগ্য :

১। যে সকল কর্ম ক্ষমতার আওতায় বলে পরিগণিত সে সকল কর্মের বাস্তব রূপ লাভের সম্ভাব্যতা থাকা অনিবার্য। অতএব যা কিছু সত্তাগতভাবে অসম্ভব অথবা অপরিহার্যরূপে অসম্ভব তা ক্ষমতার আওতাধীন বলে পরিগণিত হয় না। আর সকল কিছুর উপর প্রভুর ক্ষমতা আছে’ তার মানে এ নয় যে,খোদা অন্য এক খোদাকে সৃষ্টি করতে পারেন (কারণ খোদাকে সৃষ্টি করা অসম্ভব) অথবা খোদা পারেন ২,সংখ্যাটি যে অর্থে ২ তাকে ৩ (যে অর্থে ৩) অপেক্ষা বৃহত্তর করতে অথবা সন্তানকে সন্তান হিসেবে পিতার পূর্বে সৃষ্টি করতে।

২। সকল কর্ম সাধনের ক্ষমতা থাকার অর্থ এ নয় যে,ঐ কর্মগুলোর সব ক টিই তিনি অপরিহার্যরূপে কার্যকর করবেন। বরং যা তিনি ইচ্ছা করবেন তা-ই করবেন এবং প্রজ্ঞাবান প্রভু যথোপযুক্ত ও জ্ঞানগর্ভ কর্ম ব্যতীত কোন কর্ম কামনা করেন না ও সম্পাদন করেন না -যদিও তিনি অনাকাঙ্খিত ও অপছন্দনীয় কর্ম সম্পাদনে সক্ষম । পরবর্তী পাঠসমূহে খোদার প্রজ্ঞা (حکمت ) সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখা প্রদান করা হবে ।

৩। ক্ষমতা,আলোচ্য অর্থে স্বাধীনতা বা নির্বাচন ক্ষমতাকেও সমন্বিত করে এবং মহান আল্লাহ চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি পূর্ণ স্বাধীনতারও অধিকারী। কোন কিছুই তাঁকে স্বীয় কর্মসম্পাদনে বাধাগ্রস্থ করতে পারে না বা তার স্বাধীনতাকে হরণ করতে পারেনা। কারণ সকল সৃষ্ট বিষয়েরই অস্তিত্ব ও শক্তি তাঁর থেকে প্রাপ্ত এবং যে শক্তি ও ক্ষমতা তিনি অপরকে দান করেছেন কখনোই সে শক্তি ও ক্ষমতার বশ্যতা তিনি স্বীকার করেন না ।

১০ম পাঠ

ক্রিয়াগত গুণাবলী

ভূমিকা

পূর্ববর্তী পাঠে বর্ণিত হয়েছে যে,ক্রিয়াগত গুণসমূহ বলতে বুঝায় সে সকল ভাবার্থকেই,যা প্রভুসত্তাকে তাঁর সৃষ্ট বিষয়সমূহের সাথে তুলনা করতঃ এ দুয়ের পারস্পরিক বিশেষ সস্পর্ক থেকে বোধগম্য হয়ে থাকে। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্ট বিষয় এ দুয়ের সমন্বয়ে এ সস্পর্ক রূপ লাভ করে। যেমন : স্বয়ং সৃজন’যা মহান আল্লাহর উপর সৃষ্ট বিষয়ের অস্তিত্বের নির্ভরশীলতাকে বুঝায় এবং যদি এ সস্পর্ককে (সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি বিষয়ের যুগপৎ সস্পর্ক) বিবেচনা না করা হয়,তবে এ ধরনের ভাবার্থ আমাদের হস্তগত হয় না।

প্রভু এবং সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিবেচ্য সস্পর্কসমূহকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবে,এক দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ গুলোকে দু শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে :

এক শ্রেণীর সস্পর্ক আছে,যেগুলো প্রভু এবং সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে প্রত্যক্ষরূপে বিবেচ্য। যেমন : অস্তিত্ব দান,সৃষ্টি,অভূতপূর্ব সৃষ্টি ইত্যাদি। অপর এক শ্রেণীর সস্পর্ক হল,যা অন্য কোন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচ্য। যেমন : রিজক্ (অন্নদান )। কারণ সর্বাগ্রে অন্নগহণকারীর অস্ত্রিত্বকে,ঐ সকল উপাদান যেগুলো থেকে সে রুযী গ্রহণ করে সেগুলোর সাথে বিবেচনা করতঃ প্রভুর পক্ষ থেকে যে তা (রুযী) প্রদত্ত হয়ে থাকে,সেটা বিবেচিত হয়ে থাকে। আর কেবলমাত্র তখই অন্নদাতা (رازق ) ও প্রকৃত অন্নদাতার (رزّاق ) ধারণা অর্জিত হয়। এমনকি কখনো কখনো এমনও হতে পারে যে,প্রভুর ক্রিয়াগত গুণের ধারণা অর্জিত হওয়ার পূর্বেই স্বয়ং সৃষ্টিকুলের মধ্যে একাধিক সস্পর্ক বিবেচনায় আসে। অতঃপর ঐ গুলোর সস্পর্ককে মহান আল্লাহর সাথে সস্পর্কিত করা হয়,অথবা প্রভু ও সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান একাধিক আদি সম্পর্কের ফলশ্রুতিস্বরূপ কোন সস্পর্করূপে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন : ক্ষমা (مغفرة ) যা প্রভুর বিধিগত বা অনির্ধারিত প্রভুত্বু(ربوبیت تشریعی ),কার্যকরী আইন প্রণয়ন এবং বান্দার অবাধ্যতার সাথে সস্পর্কযুক্ত ।

অতএব প্রভুর ক্রিয়াগত গুণাবলী সম্পর্কে জানতে হলে মহান প্রভু ও তার সৃষ্ট জগতের মধ্যে তুলনা করতঃ এতদ্ভয়ের মধ্যে একপ্রকার সস্পর্ককে বিবেচনা করতে হবে,যাতে প্রভু ও সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের তাৎপর্য অনুধাবন করা যায়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে উল্লেখিত দ্বিপাক্ষিক সস্পর্ককে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রভুর পবিত্র সত্তাকে বিবেচনা করলে ক্রিয়াগত গুণাবলীর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না। আর এটাই হল প্রভুর সত্তাগত গুণাবলী ও ক্রিয়াগত গুণাবলীর মধ্যে মূল পার্থক্য।

তবে ইতিপূর্বে যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে যে,ক্রিয়াগত গুণসমূহকে তাদের উৎসের ভিত্তিতে বিবেচনা করলে,তারা সত্তাগত গুণে প্রত্যাবর্তন করে। যেমন : সৃষ্টিকর্তাকে যদি সৃষ্টি করতে সক্ষম’এমন কাউকে বোঝানোর ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় তবে তা ক্ষমতা নামক গুণের দিকে ফিরে যায় অথবা শ্রবণ ও দর্শন যদি শ্রবণযোগ্য ও দর্শনযোগ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত’অর্থে ব্যবহৃত হয়,তবে তা প্রজ্ঞা নামক গুণের দিকে প্রত্যাবর্তন করে ।

অপরদিকে সত্তাগত গুণের অন্তর্ভুক্ত কোন কোন ভাবার্থ সম্বন্ধসূচক বা ক্রিয়ামূলক অর্থে বিবেচিত হয় এবং এ অবস্থায় ঐগুলো ক্রিয়াগত গুণ বলে পরিগণিত হয়। যেমন : পবিত্র কোরানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রজ্ঞা (علم ) শব্দটি ক্রিয়াগত গুণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।১২

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করা সমীচীন বলে মনে করছি। নিম্নে তা বর্ণিত হল :

যখন প্রভু ও বস্তুগত অস্তিত্বের মধ্যে কোন সস্পর্ককে বিবেচনা করা হয় এবং এর ভিত্তিতে মহান আল্লাহর জন্যে বিশেষ ক্রিয়াগত গুণের ধারণার প্রকাশ ঘটে,তখন উল্লেখিত গুণ,বস্তুগত অস্তিত্বসমূহ,যেগুলো (দ্বিপাক্ষিক) সম্পর্কের এক পক্ষের ভূমিকায় অবস্থান করে,তাদের সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে স্থান ও কালের শর্তাধীন হয়ে পড়ে। তবে (দ্বিপাক্ষিক ) সম্পর্কের অপরপক্ষ,মহান আল্লাহর সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে (উল্লেখিত গুণগুলো) এ ধরনের (উপরে বর্ণিত) কোন শর্ত ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকবে।

উদাহরণস্বরূপ,অন্নগ্রাহককে অন্নদান,কোন এক বিশেষ স্থান ও কালে সস্পন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এ শর্তগুলো প্রকৃতপক্ষে অন্নগ্রাহক-অস্তিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট-অন্নদাতার সাথে নয়। আর প্রভুরৃ পবিত্র সত্তা কোন প্রকার স্থান ও কালের শর্ত থেকে পবিত্র।

এটি একটি অতি সূক্ষ¥ ব্যাপার এবং মহান আল্লাহর বিভিন্ন গুণ ও কর্ম কাণ্ডের পরিচিতির ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠিস্বরূপ,যেগুলো সম্পর্কে বিভিন্ন তার্কিক ও মধ্যে তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।

সৃজনক্ষমতা

সম্ভাব্য অস্তিত্বসমূহের উৎপত্তির ক্ষেত্রে,প্রারম্ভিক কারণরূপে অনিবার্য অস্তিত্বের প্রমাণের পর এবং সম্ভাব্য অস্তিত্বসমূহ স্বীয় অস্তিত্বের জন্যে সর্বদা ঐ অনিবার্য অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল এটা বিবেচনার পর,অনিবার্য অস্তিত্বের জন্যে সৃজনক্ষমতা’এবং সম্ভাব্য অস্তিত্বের জন্যে সৃজিত’ গুণ হিসেবে প্রকাশ পায়। সৃষ্টিকর্তার ধারণা,যা অস্তিত্বের এ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রকাশ পায়,তা অস্তিত্বদানকারী কারণের বা অস্তিত্বে আনয়নকারীর সমান এবং সকল সম্ভাব্য ও নির্ভরশীল অস্তিত্ব তাঁর সাথে সস্পর্কযুক্ত পক্ষ হিসেবে সৃজিত’বলে গুণান্বিত হয়ে থাকে ।

তবে কখনো কখনো সৃজন (خلق ) শব্দটি,কিছুটা সীমাবদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং শুধুমাত্র ঐ সকল অস্তিত্বের সাথেই সংশ্লিষ্ট হয়,যারা প্রারম্ভিক বস্তু থেকে অস্তিত্ব লাভ করেছে। আর এর বিপরীতে অভূতপূর্ব সৃষ্টি’(ابداع ) নামক অপর এক ভাবার্থ,যা ঐ সকল অস্তিত্ব যারা কোন প্রাথমিক বস্তু থেকে অস্তিত্বপ্রাপ্ত নয়,তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে (যেমন : নির্বস্তুকসমূহ¡‘এবং প্রারম্ভিক বস্তসমূহ)। আর এরূপে অস্তিত্বদান-সৃষ্টিকরণ (خلق ) ও অভূতপূর্ব সৃষ্টিকরণ (ابداع ),এদু ভাগে বিভক্ত হয়ে থাকে।

যা হোক,আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্টিকরণ,মানুষ কর্তৃক একাধিক বস্তুর সমন্বয়ে কোন কৃত্রিম সৃষ্টির মত নয় যে,গতি এবং দৈহিক অঙ্গ - প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনের উপর নির্ভরশীল হবে এবং গতি‘ক্রিয়া’নামে ও এর ফলে অর্জিত বিষয় ক্রিয়ার ফল’নামে পরিচিত হবে । অনুরূপ,এমন নয় যে,সৃষ্টিকরণ এক ব্যাপার আর সৃষ্ট বিষয়’অন্য ব্যাপার। কারণ মহান আল্লাহ বস্তুগত গতি ও বস্তুগত বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র। যদি সৃষ্টিকরণ’সৃষ্ট সত্তার উপর বর্তিত অতিরিক্ত কোন স্বতন্ত্র দৃষ্টান্ত (مصداق ) হত,তবে তা সম্ভাব্য অস্তিত্ব’ও সৃষ্ট বিষয়সমূহের’মধ্যে একটি বলে পরিগণিত হয়। ফলে এর (সৃষ্টিকরণের) সৃষ্টি সম্পর্কে একাধিক বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটত। অথচ ক্রিয়াগত গুণের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে,এ ধরনের গুণ প্রভু ও সৃষ্ট বিষয়ের সস্পর্ককে বিবেচনা করে বোধগম্য হয়ে থাকে। আর এ সস্পর্ক বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অনুধাবনযোগ্য।

প্রতিপালনক্ষমতা

বিশেষ করে স্রষ্টা এবং সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়,তা হল : সৃষ্ট বিষয়সমূহ শুধুমাত্র মূল অস্তিত্ব ও উৎপত্তির জন্যেই আল্লাহর উপর নির্ভরশীল নয়;বরং সমস্ত অস্তিত্বের জন্যেই মহান প্রভুর উপর নির্ভরশীল এবং কোন প্রকারেই স্বাধীন নয় । মহান প্রভু যেভাবেই ইচ্ছা করেন,সেভাবেই সৃষ্ট বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং তিনিই ঐগুলোর যাবতীয় বিষয়ে তত্বাবধান করে থাকেন ।

যখন এ সস্পর্ককে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা হয় তখন প্রতিপালন ক্ষমতার ধারণা পাওয়া যায়,যার ফলশ্রুতি হল তত্বাবধান এবং এর দৃষ্টান্ত অনেক। যেমন : রক্ষা,পরিচর্যা,জীবনদান ও মৃত্যদান,অন্নদান,বিকাশ ও উৎকর্ষে পৌঁছানো,পথ প্রদর্শন এবং আদেশ-নিষেধের বিষয়রূপে স্থান দান ইত্যাদি।

প্রকরণভেদে প্রতিপালনের পর্যায়গুলোকে দু শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে সুনির্ধারিত ও বিধিগত ।

সুনির্ধারিত প্রতিপালন (ربوبیت تکوینی ) সকল সৃষ্ট বিষয় ও ঐ গুলোর প্রয়োজন ও চাহিদাকে পূরণ তথা সমগ্র বিশ্ব পরিচালনাকে সমন্বিত করে। আর বিধিগত প্রতিপালন (ربوبیت تشریعی ) শুধুমাত্র সচেতন ও ইচ্ছার অধিকারী অস্তিত্বের জন্যে নির্দিষ্ট এবং ঐশী কিতাবসমূহ ও নবী-রাসূল প্রেরণ,দায়িত্ব নির্ধারণ ও আদেশ -নিষেধ প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট ।

সুতরাং প্রভুর নিরংকুশ প্রতিপালন ক্ষমতার অর্থ হল : সৃষ্ট বিষয়সমূহ তাদের অস্তিত্বের সকলস্তরেই মহান প্রভুর উপর নির্ভরশীল এবং তাদের পারস্পরিক যে নির্ভরশীলতা,পরিশেষে তার পরিসমাপ্তি মহান সৃষ্টিকর্তাতেই ঘটে। তিনিই সে সত্তা,যিনি তাঁর সৃষ্টির এক অংশ দিয়ে অপর অংশকে তত্ত্বাবধান করেন,অন্নগ্রাহককে সৃষ্ট অন্ন থেকে অন্ন দান করেন,সচেতন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাকে আভ্যন্তরীণ মাধ্যম (যেমন : আক্বল বা বুদ্ধিবৃত্তি এবং অন্যান্য বোধশক্তি) এবং বাহ্যিক মাধ্যম (যেমন : নবীগণ ও ঐশী কিতাবসমূহ) দ্বারা পথনির্দেশ করেন এবং মানুষের জন্যে নীতি প্রণয়ন,দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করেন।

প্রতিপালনও সৃজনক্ষমতার মত সম্বন্ধীয় (ضافی ) ভাবার্থযুক্ত। তবে পার্থক্য হল এই যে,প্রতিপালনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান বিশেষ সস্পর্ককেও বিবেচনা করা হয়,যা রিয্ক প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে ।

প্রতিপালন ও সৃজনের অর্থের আলোকে এবং তাদের সম্বন্ধযুক্ত হওয়া থেকে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে,এ দু টি গুণ পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সস্পর্কযুক্ত। আর এটা অসম্ভব যে,বিশ্বের প্রতিপালক এর সৃষ্টিকর্তা ভিন্ন অন্য কেউ হবেন,বরং তিনিই হবেন এ বিশ্বের পরিচালক ও রক্ষাকর্তা,যিনি এ সকল সৃষ্টিকে সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সহকারে এবং পারস্পরের উপর নির্ভরশীল করে সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রতিপালন ক্ষমতা,পরিচালন ক্ষমতার তাৎপর্য,সৃষ্টি প্রক্রিয়া ও সৃষ্ট বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সংহতি থেকে প্রকাশ লাভ করে।

প্রভুত্ব

ইলাহ ও উলুহিয়্যাতের (الوهیت ) স্বরূপ সম্পর্কে চিন্তাবিদগণের মধ্যে একাধিক বক্তব্য প্রচলিত,যা কোরানের বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থে বিদ্যমান । যে অর্থটি আমাদের মতে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য তা হল : ইলাহ্ (اله ) অর্থ উপাস্য অথবা আনুগত্য ও উপাসনার যোগ্য । যেমন : বইয়ের অর্থ হল লেখ্য এবং যা লিখনযোগ্যতা রাখে ।

এ অর্থানুসারে উলুহিয়্যাত হল এমন এক গুণ,যার ধারণা লাভের জন্যে বান্দাগণের উপাসনা ও আনুগত্যকেও বিবেচনা করতে হবে। যদিও পথভ্রষ্টরা মিথ্যা মাবুদগুলোকে নিজেদের উপাস্যরূপে নির্বাচন করেছে,তবু তিনিই হলেন প্রকৃত উপাসনা ও আনুগত্যের যোগ্য -যিনি তাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। বিশ্বাসের এ ন্যূনতম সীমা,যা আপন প্রভুর প্রতি সকল বান্দারই থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ মহান আল্লাহকে অনিবার্য অস্তিত্ব,সৃষ্টিকারী,বিশ্বের স্বনির্ভর পরিচালক হিসেবে চিনার পাশাপাশি তাঁকে উপাসনা ও আনুগত্যের যোগ্য হিসেবেও জানতে হবে। আর এ কারণেই ইসলাম (لا اله الا الله ) অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই,এ ধ্বনিকে স্বীয় শ্লোগানরূপে নির্বাচন করেছে।