১১তম পাঠ
অন্যান্য ক্রিয়াগত গুণাবলী
ভূমিকা
কালামশাস্ত্রের একটি জটিলতম বিষয় হল প্রভুর ইচ্ছা বা প্রত্যয় (اراده
)। বিভিন্ন
দিক থেকে এ বিষয়টি আলোচনা ও মতবিরোধপূর্ণ বিষয় রূপে পরিগণিত। যেমন : ইচ্ছা বা প্রত্যয় কি সত্তাগত গুণ,না ক্রিয়াগত গুণ? প্রাচীন (قدیم
) ,না সৃষ্ট (حادث
) ? একত্ব,না বহুত্ব ? ইত্যাদি।
এতদসত্বেও দর্শনশাস্ত্রে‘
চূড়ান্ত প্রত্যয় বা ইচ্ছা’শিরোনামে একটি বিষয়ের অবতারণা হয়েছে,বিশেষ করে প্রভুর ইচ্ছা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ।
এটা অনস্বীকার্য যে,এ বইয়ের ক্ষুদ্র কলেবরে এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যুক্তিযুক্ত হবে না । সুতরাং প্রারম্ভেই ইচ্ছা বা প্রত্যয়ের তাৎপর্য তুলে ধরব । অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় মনোনিবেশ করব ।
ইচ্ছা
বা
প্রত্যয়
ইচ্ছা বা প্রত্যয় (اراده
) শব্দটি প্রচলিত ভাষায় কমপক্ষে দু‘
টি অর্থে ব্যবহৃত হয় : একটি হল‘
পছন্দ করা’আর অপরটি হল‘
কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া’।
প্রথম অর্থটি বিষয়ের ভিত্তিতে অত্যন্ত ব্যাপক এবং বাস্তব বস্তসমূহকে পছন্দকরণ
,ব্যক্তিগত কার্যকলাপ এবং অপরের কার্যকলাপকেও সমন্বিত করে। দ্বিতীয় অর্থটি হল এর ব্যতিক্রম,যা শুধুমাত্র স্বয়ং ব্যক্তিসংশ্লিষ্ট কার্যকলাপের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ।
ইরাদা শব্দটি প্রথম অর্থে পছন্দ (محبت
) যদিও মানুষের ক্ষেত্রে নফসের কামনারূপে পরিগণিত হয় তবু বুদ্ধিবৃত্তি এর ঘাটতিপূর্ণ দিকগুলোকে নিষ্কাশন করে একটি সাধারণ অর্থকে হস্তগত করতে পারে,যার পরিসীমা বস্তগত সত্তা থেকে শুরু করে মহান আল্লাহ পর্যন্ত বিস্তত হতে পারে। যেমনটি জ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । আর এ দৃষ্টিকোণ থেকে পছন্দ (حب
),যা স্বীয় সত্তা সম্পর্কে প্রভুর পছন্দকেও সমন্বিত করে,তাকে সত্তাগত গুণরূপে গণনা করা যেতে পারে।
অতএব,যদি প্রভুর‘
ইরাদা’বা (ইচ্ছা) বলতে পূর্ণতাকে পছন্দ করা বুঝায়,যা প্রথম পর্যায়ে প্রভুর অসীম পূর্ণতা সংশ্লিষ্ট হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে অন্যান্য অস্তিত্বময়,যারা প্রকারান্তুরে প্রভুর পূর্ণতারই নিদর্শন,তাদেরকে সমন্বিত করে তবে তা (ইরাদা) সত্তাগত গুণ রূপে পরিগণিত হতে পারে। আর তখন অন্যান্য সত্তাগত গুণের মতই ইরাদাকেও প্রাচীন (قدیم
) একক এবং প্রভুর পবিত্র সত্তার অভিন্ন রূপ বলে মনে করা যেতে পারে ।
কিন্ত‘
ইরাদা’(দ্বিতীয় অর্থে) কর্মসম্পাদনে সিদ্ধান্ত নেয়া অর্থে নিঃসন্দেহে ক্রিয়াগত গুণের অন্তর্ভুক্ত হবে,যা সৃষ্ট বিষয় সংশ্লিষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে কালের শর্তে আবদ্ধ হয় -যেমনটি পবিত্র কোরানে এসেছে ।
)
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ(
তার ব্যাপার শুধু এই,তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন,তিনি তাকে বলেন‘
হও’ফলে তা
হয়ে যায় (সুরা ইয়াসিন -৮২)।
তবে মনে রাখতে হবে যে,মহান আল্লাহ ক্রিয়াগত গুণাবলী গুণান্বিত,তা এ অর্থে নয় যে,তার সত্তায় কোন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে অথবা কোন উপজাত (عوارض
) তার জাত বা সত্তায় সংযোজিত হয়েছে । বরং এ অর্থে যে,নির্দিষ্ট শর্তে ও বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভুসত্তা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে একটি সস্পর্ককে বিবেচনা করা হয় এবং বিশেষ এক সম্পর্কের ভাবার্থকে প্রভুর ক্রিয়াগত গুণ হিসাবে গণনা করা হয় ।
‘
ইরাদার’ক্ষেত্রে এ সস্পর্ককে বিবেচনা করা হয় যে,সকল সৃষ্ট বিষয়ই যে দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণতা,স্বাচ্ছন্দ্য ও কল্যাণের অধিকারী সে দৃষ্টিকোণ থেকেই সৃষ্ট হয়েছে। অতএব,তার অস্তিত্ব বিশেষ স্থান ও কাল অথবা বিশেষ অবস্থা,প্রভুর পছন্দ ও জ্ঞানের অধীনে হয়েছে এবং মহান আল্লাহ স্বেচ্ছায় তাকে সৃষ্টি করেছেন -অন্য কারো কর্তৃক বাধ্য হয়ে নয়। এ সস্পর্ক বিবেচনার ফলে ইরাদা নামক এক সম্বন্ধযুক্ত ভাবার্থ প্রকাশ লাভ করে,যা সীমাবদ্ধ ও শর্তাধীন কোন বস্তুর সংশ্লিষ্ট হলে সীমাবদ্ধও শর্তাধীন হয়ে থাকে এবং এ সম্বন্ধযুক্ত ভাবার্থই তখন সৃজিত (حدوث
) ও বহুত্ব (کثرت
) বলে গুণান্বিত হয়ে থাকে। কারণ সম্বন্ধ (اضافه
),দু‘
পক্ষের (طرفین
) অধীন হয়ে থাকে এবং সৃজিত(حدوث
) ও বহুত্ব (کثرت
) হল দু‘
পক্ষের মধ্যে একপক্ষ। এদিক থেকে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ(সীমাবদ্ধ ও শর্তাধীন ) সম্বন্ধের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়াই যুক্তিসংগত ।
প্রজ্ঞা :
‘
ইরাদার’উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে ইতিমধ্যেই সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে যে,প্রভুর এ ইরাদা বা ইচ্ছা অর্থহীন ও পরিকল্পনাবিহীন কোন কর্মকে অন্তর্ভুক্ত করে না। বরং যা কিছু মূলতঃ প্রভুর ইরাদার অন্তর্ভুক্ত হয় তাই বস্তুর পূর্ণতা ও কল্যাণের কারণ হয়ে থাকে। যেহেতু বস্তুসমষ্টির এক অংশ অপর অংশের ক্ষতির কারণ হয় সেহেতু প্রভুর পূর্ণতাপ্রীতির দাবী হল সৃষ্টিকুল এমনভাবে অস্তিত্বমান হবে যে,সমষ্টিগত কল্যাণ ও পূর্ণতার লদ্ধি সর্বাধিক হবে। এ ধরনের সস্পর্কসমূহকে বিবেচনা করলে কল্যাণ নামক ভাবার্থের সন্ধান মেলে। নতুবা কল্যাণ (مصلحت
) সৃষ্টিকুলের অস্তিত্ব থেকে এমন কোন
স্বাধীন বিষয় নয় যে তাদের বিদ্যমানতায় কোন প্রভাব ফেলবে। সুতরাং এটা কিছুতেই সম্ভব নয় যে,তা প্রভুর ইরাদায় প্রভাব ফেলবে ।
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই,যেহেতু প্রভুর ক্রিয়া তাঁর সত্তাগুণ(যেমন : জ্ঞান,ক্ষমতা,পূর্ণতা ও কল্যাণপ্রীতি) থেকে উৎসারিত,সেহেতু সর্বদা এরূপে বাস্তবায়িত হয় যখন তা কল্যাণকর হয়। অর্থাৎ সৃষ্ট বিষয় সর্বাধিক কল্যাণ ও পূর্ণতার অধিকারী হবে। আর এ ধরনের ইরাদা বা ইচ্ছাকেই প্রজ্ঞাপূর্ণ ইরাদা বলা হয়ে থাকে। এখানে মহান আল্লাহর জন্যে কার্যক্ষেত্রে প্রজ্ঞা নামক অপর একটি গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে,যা অন্যান্য ক্রিয়াগত গুণের মতই প্রভুর সত্তাগত গুণের দিকে প্রত্যাবর্তন করে ।
তবে মনে রাখতে হবে যে,কল্যাণের জন্যে কর্মসম্পাদনের অর্থ এ নয় যে,কল্যাণই হল প্রভুর জন্যে চূড়ান্ত কারণ। বরং তা এক ধরনের গৌণ ও অধঃস্তন উদ্দেশ্য বলে পরিগণিত হয় । অপরদিকে কর্ম সম্পাদনের জন্যে চূড়ান্ত কারণ হল,সে অনন্ত সত্তাগত পূর্ণতার অনুরাগ,যা আনুসঙ্গিকভাবে তার ফলশ্রুতি অর্থাৎ অস্তিত্বময় বিষয়সমূহের পূর্ণতাকেও সমন্বিত করে। আর এ জন্যেই বলা হয়,প্রভুর কর্মকাণ্ডের জন্যে সে কর্তৃকারণই হল চূড়ান্ত কারণ এবং মহান আল্লাহ তাঁর সত্তা বহিঃভূত কোন উদ্দেশ্যও আকাঙ্খা পোষণ করেন না। তবে সৃষ্ট বিষয়ের পূর্ণতা,স্বাচ্ছন্দ্য ও কল্যাণ,গৌণ উদ্দেশ্য বা অধঃস্তন উদ্দেশ্য বলে পরিগণিত হলেও তা উল্লেখিত বিষয়টির সাথে কোন বিরোধ রাখেনা। আর এ জন্যেই প্রভুর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পবিত্র কোরানে এমন সকল বিষয়কে কারণরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে,যাদের প্রত্যেকেরই মূলে রয়েছে সৃষ্ট বিষয়ের পূর্ণতা ও কল্যাণ
। যেমন : পরীক্ষীত কর্মসমূহকে নির্বাচন,আল্লাহর দাসত্ব করা এবং প্রভুর বিশেষ ও অপরিসীম অনুগ্রহের অধিকারী হওয়া ইত্যাদিকে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যরূপে বর্ণনা করা হয়েছে,যাদের প্রত্যেকেই যথাক্রমে অপরের প্রারম্ভিকা(مقدمه
)।
প্রভুর
ভাষা
মহান আল্লাহর উপর আরোপিত ভাবার্থসমূহের মধ্যে একটি হল কথোপকথন বা কালাম(كلام
)। প্রভুর কথোপকথন সম্পর্কে,প্রাচীনকাল থেকেই কালামশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে আলোচনা প্রচলিত ছিল। কথিত আছে‘
কালামশাস্ত্র’নামকরণের কারণও হল এটাই যে,এ শাস্ত্রের পণ্ডিতগণ প্রভুর ভাষা বা কালাম সম্পর্কে আলোচনা করতেন। আশায়েরীরা এটাকে সত্তাগত গুণ এবং মুতাযেলীরা ক্রিয়াগত গুণ বলে মনে করতেন। এ দু‘
দলের মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিষয়সমূহের মধ্যে একটি হল উল্লেখিত বিষয়টি । বলা হয় কোরান যে,আল্লাহর কালাম বা ভাষা,তা কি সৃষ্ট,না সৃষ্ট নয় ? আর এ বিষয়টির জন্যে এমনকি পরস্পর পরস্পরকে কাফের পর্যন্ত আখ্যা দিয়েছেন!
সত্তাগত ও ক্রিয়াগত গুণাবলীর সংজ্ঞার আলোকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে,কথোপকথন হল ক্রিয়াগত গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত,যাকে অনুধাবনের জন্যে এমন এক শ্রোতাকেও বিবেচনা করতে হবে,যিনি বক্তার উদ্দেশ্যকে শব্দ শ্রবণের মাধ্যমে বা লিখিত অবস্থায় দেখার মাধ্যমে অথবা স্বীয় মস্তিষ্কে কোন ভাবার্থ অনুধাবনের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোন ভাবে বুঝতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে এ ভাবার্থটি প্রভু (যিনি এক সত্যকে কারো কাছে প্রকাশ করতে চান) এবং শ্রোতার (যিনি ঐ সত্যকে অনুধাবন করেন) সস্পর্ক থেকে প্রকাশ লাভ করে (যা ক্রিয়াগত গুণের প্রমাণবহ)। কিন্তু যদি কথোপকথনের জন্যে অন্যকোন অর্থকে বিবেচনা করা হয়;যথা : কথনক্ষমতা,বক্তব্যের সারবত্তা সম্পর্কে জ্ঞান,এধরনের অর্থের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়,তবে এ অবস্থায় এ গুণটি (কথোপকথন ) পূর্বোল্লেখিত কোন কোন ক্রিয়াগতগুণের মতই সত্তাগত গুণের দিকে প্রত্যাবর্তন করবে ।
কিন্তু কোরান বলতে আক্ষরিক লিপি বা শব্দসমষ্টি বা মস্তিষ্কে বিদ্যমান ভাবার্থসমূহ অথবা তার (কোরানের) জ্যোতির্ময় ও নির্বস্তুক বাস্তবরূপকে বুঝানো হলে,তা সৃষ্ট বিষয় বলে পরিগণিত হবে।‘তবে যদি কেউ আল্লাহর সত্তাগত জ্ঞানকে কোরানের বাস্তবরূপ বলে মূল্যায়ন করে থাকেন,তাহলে তার প্রত্যাবর্তন প্রভুর সত্তাগত গুণ জ্ঞানের দিকে ঘটবে । কিন্তু এ ধরনের ব্যাখ্যা সর্বজন স্বীকৃত নয় বলে পরিত্যাজ্য ।
সত্যবাদিতা
প্রভুর কথন যদি আদেশ,নিষেধ ও প্রশ্নবোধক হয়,তবে তা বান্দাগণের কর্তব্যকে নির্দেশ করে থাকে এবং তখন তার উপর সত্য বা মিথ্যা আরোপিত হয় না। কিন্তু যদি প্রভুর কথন বিবৃতিমূলক হয়,যা বাস্তব অস্তিত্বসমূহ অথবা পরবর্তী ও পূর্ববর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সংবাদ বহন করে তবে তা সত্য বলে অভিষিক্ত হয়। যেমন পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে :
)
وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا(
কে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী (সুরা নিসা- ৮৭) ?
সুতরাং কেউই ঐগুলোকে কোন অজুহাতেই অগ্রাহ্য করতে পারবে না।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে,আলোচ্য গুণ,বিশ্বদৃষ্টির গৌণ বিষয়গুলোকে এবং অধিকাংশ মতাদর্শগত বিষয়কে প্রতিপাদন করার জন্যে অপর এক শ্রেণীর যুক্তির (বিশ্বাস ও বিবৃতিমূলক) বৈধতা দান করে। উল্লেখিত গুণটির প্রমাণের জন্যে,বিশেষ করে যে বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিটির অবতারণা করা যায় তাহল :
প্রভুর কথা বলা,প্রতিপালকত্বের মর্যাদায় এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে,মানুষ ও বিশ্বজগতের পরিচালনার ক্ষেত্রে,সৃষ্ট বিষয়ের জন্যে পথনির্দেশনার ও সঠিক পরিচিতির ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যে—অপরিহার্য। যদি এর ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে বর্ণিত বিষয়গুলোর কোন বিশ্বস্ততা থাকবে—না । কারণ তা উদ্দেশ্যের ব্যতিক্রম ও প্রজ্ঞার পরিপন্থী।