১৪তম পাঠ
বস্তুগত বিশ্বদৃষ্টি এবং এর ত্রুটি নির্দেশ
বস্তুগত বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতিসমূহ
বস্তগত বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতিগুলোকে নিম্নলিখিতরূপে বর্ণনা করা যেতে পারে :
প্রথমতঃ অস্তিত্ব হল বস্তু ও বস্তসম্বন্ধীয় বিষয়ের সমান । ঐগুলোকেই অস্তিত্বশীল বলা যাবে,যেগুলো হল বস্তু এবং যারা ত্রিমাত্রিক (দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতা বিশিষ্ট) ও যাদের আয়তন আছে;অথবা যারা বস্তগত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে পরিগণিত। স্বভাবতঃই বস্তু স্বয়ং নির্দিষ্ট পরিমাণের অধিকারী যা বিভাজনযোগ্য। এ মূলনীতির ভিত্তিতে অবস্তগত ও অতিপ্রাকৃতিক অস্তিত্ব হিসেবে খোদার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয় ।
দ্বিতীয়তঃ বস্তু হল অনদি ও অনন্ত এবং অসৃষ্ট অস্তিত্ব যা কোন কারণের উপর নির্ভরশীল নয় । অর্থাৎ দার্শনিক পরিভাষায় আমরা যাকে বলি অনিবার্য অস্তিত্ব ।
তৃতীয়তঃ বিশ্বের জন্যে কোন চূড়ান্ত কারণ বা উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করা যায় না। কারণ এমন কোন সচেতন ও প্রত্যয়ী কর্তা নেই,যার প্রতি কোন উদ্দেশ্যকে আরোপ করা যাবে ।
চতূর্থতঃ বিশ্বে বিদ্যমান সৃষ্টিকুল (বস্তমল নয়) বস্তকণার গতির ফলে এবং তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রবর্তী সৃষ্টিসমূহকে উত্তরবর্তী সৃষ্টিসমূহের জন্যে একপ্রকার শর্ত ও সহায়ক কারণরূপে মনে করা যেতে পারে এবং বস্তগত বিষয়ের মধ্যে অন্ততঃপক্ষে একপ্রকার প্রাকৃতিক কর্তৃত্বকে মেনে নেয়া যায়। যেমন : বৃক্ষকে ফলের জন্যে প্রাকৃতিক কর্তা বলা যায়। অনুরূপ বস্তুগত ও রাসায়নিক বিষয়সমূহও নিজ নিজ নির্বাহকসমূহের সাথে সস্পর্ক যুক্ত । কিন্তু কোন সৃষ্ট বিষয়ই সৃষ্টিকর্তা বা অস্তিত্বদাতা কর্তার উপর নির্ভরশীল নয় ।
উপরোক্ত মূলনীতিসমূহের সাথে অপর একটি মূলনীতিকে পঞ্চম মূলনীতি রূপে উল্লেখ করা যেতে পারে,যা পরিচিতি বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং যা এক দৃষ্টিকোণ থেকে অপর সকল মূলনীতির শীর্ষে অবস্থান করে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল :
একমাত্র সে সকল পরিচিতিই গ্রহণযোগ্য,যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা শুধুমাত্র বস্তু ও বস্তগত বিষয়কেই প্রতিপাদন করে সেহেতু অন্য কোন কিছুরই গ্রহণযোগ্যতা থাকতে পারেনা।
কিন্তু এ মূলনীতির অসারতা পূর্ববর্তী পাঠে প্রতিভাত হয়েছে। সুতরাং নতুন করে একে খণ্ডনের প্রয়োজন নেই। ফলে এখানে আমরা অন্যান্য মূলনীতিসমূহের সমালোচনায় মনোনিবেশ করব ।
প্রথম মূলনীতির পর্যালোচনা
এ মূলনীতিটি,যা বস্তগত বিশ্বদৃষ্টির মৌলিকতম মূলনীতি হিসেবে পরিগণিত তা প্রকৃতপক্ষে নিরর্থক ও অযৌক্তিক দাবি ব্যতীত আর কিছুই নয়। বিশেষ করে বস্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত,তা অতিপ্রাকৃতিক বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করার মত কোন প্রমাণই উপস্থাপন করতে পারবে না। কারণ এটা স্পষ্ট যে,কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানই স্বীয় বস্তু ও বস্তগত পরিসীমাকে অতিক্রম করে,কোন কিছুর ব্যাপারে মন্তব্য অথবা কোন কিছুকে গ্রহণ বা বর্জন করতে পারবে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার যুক্তিতে সর্বোচ্চ যা বলা যাবে,তা হল এই যে,এর (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার) ভিত্তিতে অতিপ্রাকৃতিক বিষয়কে প্রমাণ করা যাবে না। অতএব কমপক্ষে তার (অতিপ্রকৃতিকে) অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে মেনে নেয়া উচিৎ।
ইতিপূর্বে আমরা দেখিয়েছি যে,মানুষ এমন অনেক অবস্তগত বিষয়কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি করে থাকে,যেগুলো বস্তু বা বস্তগত কোন বৈশিষ্ট্যের অধিকারি নয় । যেমন : আত্মাকে
(روح
) মানুষ প্রত্যক্ষ জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি করে । অনুরূপ নির্বস্তুক বিষয়ের (امور مجرد
) স্বপক্ষে অনেক প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে,যা দর্শনের বিভিন্ন পুস্তকে সংরক্ষিত আছে। নির্বস্তুক আত্মার অস্তিত্বের সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ হিসেবে সত্য স্বপ্নসমূহ,যোগীদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড,
নবী-রাসুল ও ওলীগণের (আলাইহিমু ছালাম) বিভিন্ন মো’জেযা ও কিয়ামতের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সর্বোপরি মহান আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর বস্তগত না হওয়ার স্বপক্ষে,যে সকল দলিল,প্রমাণের অবতারণা হয়েছে তা-ই এ মূলনীতিটির অসারতা প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট।
দ্বিতীয় মূলনীতির পর্যালোচনা
এ মূলনীতিতে বস্তর অনাদি ও অনন্ত হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে যে,বস্তু হল অসৃষ্ট। কিন্তু,
প্রথমতঃ বস্তুর অনাদি ও অনন্ত হওয়া,বৈজ্ঞানিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রতিপাদনযোগ্য নয়। কারণ ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ এবং কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই স্থান ও কালের দৃষ্টিতে বিশ্বের অনন্ত হওয়ার কথা প্রমাণ করতে পারবে না ।
দ্বিতীয়তঃ বস্তকে অনাদি মনে করলেও,তার পারস্পরিক অর্থ এ নয় যে,তা সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল নয়। যেমন : কোন যান্ত্রিক গতির অনাদি হওয়ার কথা কল্পনা করার পারস্পরিক অর্থ হল,এক অনাদি উদ্দীপক শক্তিকে কল্পনা করা -উদ্দীপক শক্তির উপর এর অনির্ভরশীলতা নয়।
এ ছাড়া বস্তর অসৃষ্ট হওয়ার অর্থ হল,এর অনিবার্য অস্তিত্ব হওয়া । কিন্তু অষ্টম পাঠে আমরা প্রমাণ করেছি যে,বস্তর পক্ষে অনিবার্য অস্তিত্ব হওয়া অসম্ভব।
তৃতীয়
মূলনীতির
পর্যালোচনা
তৃতীয় মূলনীতিটি অস্বীকার করে যে,কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তা হতে স্বভাবতঃই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের অস্বীকৃতির প্রকাশ পায়। তাই প্রজ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে প্রমাণ করার মাধ্যমে যুগপৎ এ নীতিটির অসারতাও প্রমাণিত হয়।
এ ছাড়া প্রশ্ন আসে যে,কিরূপে বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারি কোন মানুষ মানব তৈরীকৃত কোন কিছুর পর্যবেক্ষণে তৈরীকারকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে,অথচ এক বিস্ময়কর সুবিন্যস্ত বিশ্বব্রম্মাণ্ড ও তাতে বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয়বস্তর পারস্পরিক বন্ধন ও অগণিত কল্যাণময় সৃষ্টিকে অবলোকন করেও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনবগত থাকবে ?
চতুর্থ
মূলনীতির
পর্যালোচনা
বস্তগত বিশ্বদৃষ্টির চতুর্থ মূলনীতিটি হল কারণত্বকে শুধুমাত্র বস্তগত সৃষ্টিসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা,যা প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। এ সমস্যাগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ হল :
প্রথমতঃ এ মূলনীতি অনুসারে কখনোই কোন নব অস্তিত্বের আবির্ভাব ঘটা উচিৎ না। অথচ প্রতিনিয়ত আমরা বিশেষ করে মানব ও প্রাণীজগতে নব নব অস্তিত্বের সংযোজন লক্ষ্য করছি । এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হল জীবন,চেতনা,অনুভূতি,আবেগ,সৃজনশীলতা ও প্রত্যয়।
বস্তবাদীরা বলেন,উল্লেখিত বিষয়গুলোও বস্তগত বৈশিষ্ট্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
উত্তরে
বলব
:
প্রথমতঃ উল্লেখিত বিষয়গুলো খণ্ডনযোগ্য নয়। অথচ বস্তু ও বস্তগত বিষয়গুলো হল খণ্ডন ও বিভাজনযোগ্য এবং আকৃতি বিশিষ্ট। কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলো এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী নয়।
দ্বিতীয়তঃ এ বিষয়গুলো যেগুলোকে‘
বস্তগত বৈশিষ্ট্য’বলে উল্লেখ করা হয়েছে নিঃসন্দেহে এগুলো কোন নির্জীব বস্ততে বিদ্যমান ছিলনা । অন্য কথায় : কোন এক সময় বস্তু এগুলোর অভাবে ছিল এবং পরবর্তীতে এ গুলোর অধিকারী হয়েছে । অতএব বস্তগত বৈশিষ্ট্য বলে পরিচিত এ বিষয়গুলোকে অস্তিত্বে আসার জন্যে এমন এক অস্তিত্বদানকারীর উপর নির্ভর করতে হয়,যে এগুলোকে অস্তিত্বদান করে। আর তা-ই হল সৃষ্টিকারী বা অস্তিত্বদাতা কারণ ।
এ মতবাদটির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল যে,এ নীতি অনুসারে বিশ্বের সকল কিছু বাধ্যতামূলক হতে হবে । কারণ বস্তুর আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে স্বীয় নির্বাচন ও—স্বাধীনতার কোন স্থান নেই।
স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যতিক্রম,যার পারস্পরিক অর্থ হল,যে কোন প্রকার দায়িত্ব-পরায়ণতা এবং চারিত্রিক ও আত্মিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করা। আর দায়িত্ব পরায়ণতা ও মূল্যবোধসমূহকে অস্বীকার করা যে,মানবিক জীবন ব্যবস্থার জন্যে কতটা হুমকিস্বরূপ তা বলাই বাহুল্য ।
সর্বোপরি বস্তু অনিবার্য অস্তিত্ব হতে পারে না,(ইতিপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে) এ যুক্তির আলোকে বলতে হয়,কোন এক কারণকে জাগতিক বিষয়সমূহের জন্যে বিবেচনা করতে হবে এবং এ ধরনের কোন কারণ প্রাকৃতিক বা সহায়ক কারণের মত হবে না। কারণ এ ধরনের শৃঙ্খলা বা পারস্পরিক সস্পর্ক শুধুমাত্র বস্তগত বিষয়সমূহের পরস্পরের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় বটে,কিন্তু সমগ্রবস্তু স্বীয় কারণের সাথে এ ধরনের সস্পর্ক ( অর্থাৎ একটি অপরটির কারণ) বজায় রাখতে পারবে না। অতএব যে কারণ বস্তকে অস্তিত্বে এনেছে তা হল সৃষ্টিকারী কারণ -যা অতি বস্তগত বিষয়।