ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 7%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42381 / ডাউনলোড: 7058
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

জীবন কি শুধুই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম ?

এ ধরনের কথা আমাদের মধ্যেও অজ্ঞাতসারে প্রচার লাভ করেছে। যেমন কখনো কখনো আমরা বলি,জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়। না,জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম নয়,বরং জীবন হলো সত্যের জন্য সংগ্রাম। কখনো কখনো কোনো কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্ব,যেমন ফরিদ ওয়াজেদী বলেছেন,যুদ্ধ মানুষের জন্য অপরিহার্য,যতদিন মানুষ আছে যুদ্ধও রয়েছে,যুদ্ধ যেন মানুষের জীবনের অঙ্গ। তিনি বিশ্বাস করেন কোরআনও তার বিভিন্ন আয়াতে এ কথাকে সত্যায়ন করেছে। যেমন সূরা হজ্বের এই আয়াতে- যদি মহান আল্লাহ্ মানুষের একদল দ্বারা অন্য দলকে প্রতিরোধ না করতেন তবে ইহুদী,নাছারাদের উপাসনালয়সহ সকল মসজিদ যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয় সব ধ্বংস হয়ে যেত। (সূরা হজ্ব : ৪০) এবং সূরা বাকারার এই আয়াতে- যদি আল্লাহ্ মানুষের মধ্যে এক দল দ্বারা অন্য দলকে প্রতিরোধ না করতেন,তবে প্রথিবীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। (সূরা বাকারা: ২৫১) তার মতে এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ যুদ্ধকে বৈধতা দান করেছেন। যেমনভাবে এ আয়াতগুলোতে বলছেন,যুদ্ধ না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত বা কোন উপাসনালয়ই অবশিষ্ট থাকত না।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সকল ব্যক্তি কোরআনের এ আয়াতকে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কোরআনের এ সকল আয়াত প্রতিরোধের ও জিহাদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছে। যেহেতু খ্রিষ্টানরা বলে,যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে নিন্দনীয় ও অন্যায়; আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী,কোরআন তাদের জবাবে বলছে,যে সকল যুদ্ধ অধিকার হরণ ও সীমালঙ্ঘনের জন্য ঘটে তা অন্যায়। কিন্তু যে যুদ্ধ সত্যকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তা অন্যায় নয়। হে খ্রিষ্টান পাদ্রীসকল! যদি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ না থাকত,তবে তোমরাও গীর্জায় বসে ইবাদতের সুযোগ পেতে না। কোন মুমীন ব্যক্তিও মসজিদে বসে ইবাদত করতে পারত না। জিহাদই সে বস্তু যা সত্য ও সত্যপথকে রক্ষা করছে। তাই পাদ্রীমহোদয়! আপনারও যে সৈনিক এজন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার নিকট কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

সুতরাং মানুষের পক্ষে সম্ভব পূর্ণতা ও প্রশিক্ষণের সে পর্যায়ে পৌছা যে পর্যায়ে প্রকৃতপক্ষে কোন সীমালঙ্ঘনকারীও থাকবে যার সঙ্গে যুদ্ধ বৈধ হবে। এ জন্যই যখন বলা হয জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়- যার অর্থ জীবনের জন্য যুদ্ধ ও সংগ্রাম অপরিহার্য কথাটি ঠিক নয় (সম্প্রতি ইসলামে আদর্শ সমাজ সম্পর্কিত যে আলোচনা হয় অর্থাৎ ইমাম মাহদী [আ.]-এর আবির্ভাবের পর সমাজের অবস্থা সেখানে বলা হচ্ছে,یصطلح سباع بهائم এমনকি হিংস্র প্রাণীরাও একে অপরের সঙ্গে শান্তিতে সহাবস্থান করবে এবং যুদ্ধ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে অর্থাৎ মানুষ পূর্ণতার এমন পর্যায়ে পৌছবে যে,সমাজে কোন সীমালঙ্ঘনকারীই থাকবে না যাতে করে যুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে)।

এ সম্পর্কে একটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। সম্ভবত অনেকেই তা শুনে কষ্ট পাবেন যেহেতু আমাদের যুবকদের মধ্যে অনেকেই যা কিছু তাদের পছন্দমত নয় তা শুনলে দুঃখ পায়।

একটি কথা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বলে প্রচার করা হয়। এ কথাটির না অর্থ সঠিক,না কোনগ্রন্থে এটা ইমাম হুসাইনের বাণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের বেশি নয় এ কথাটি বলা হচ্ছে যে,ইমাম হুসাইন বলেছেন,إنّ الحیاة عقیدة و جهاد অর্থাৎ জীবন হলো এক বিশ্বাসএবং সেই বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম করা। কথাটি পাশ্চাত্যের চিন্তার সাথে সংগতিশীল যেহেতু তারা বলে মানুষের একটি বিশ্বাস বা আকীদা থাকা দরকার এবং সে আকীদার জন্য সংগ্রাম করা উচিত। কোরআন সত্যের কথা বলে। জিহাদ ও জীবন কোরআনের দৃষ্টিতে সত্যের উপাসনা ও সত্যের জন্য জিহাদ। বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম নয় বা জীবনের অর্থও বিশ্বাস বা আকীদা নয়। কারণ আকীদা সঠিক হতে পারে আবার বাতিলও হতে পারে।

আকীদা হলো চিন্তাসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সংযুক্তি। মানুষের চিন্তায় হাজারো ধরনের চিন্তার সম্মিলন ও সংযুক্তি ঘটে। ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য মতাদর্শ বলে,মানুষের কোন এক বিশেষ বিশ্বাস,আদর্শ ও উদ্দেশ্য থাকা উচিত এবং সেই লক্ষ্য,উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এখন প্রশ্ন হলো সেই বিশ্বাস কি? তারা বলে,সেটা যা-ই হোক না কেন। কোরআনের কথাগুলো অত্যন্ত হিসেবী ও মাপা। কোরআন সব সময়ই বলছে,হক ও সত্য এবং সেই হক ও সত্যের জন্য জিহাদ। কোরআন এটা বলে না যে,তোমার আকীদা ও বিশ্বাসের জন্য জিহাদ কর,বরং বলছে,প্রথমে তোমার আকীদাকে সংশোধিত কর। প্রথমে তোমার আকীদার সঙ্গে যুদ্ধ করে সঠিক ও সত্য আকীদাকে গ্রহণ কর। তৎপর যখন সত্যকে উদ্ঘাটন করেছ তখন এ সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম ও জিহাদ কর।

যা হোক পূর্ণ মানুষ অর্থ ক্ষমতাবান মানুষ বা শক্তিবান মানুষ এ কথাটির মূল ভিত্তি এসেছে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের ডারউইনের যে তত্ত্ব (Struggle for the fittest) সেখান থেকে।

ডারউইন তার এ তত্ত্বে জীবনকে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন,সকল জীবই সর্বাবস্থায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আমরা বলতে চাই,মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী এ ধরনের বলে কি আমরা মানুষকেও বলব যে,মানুষও বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা বলে কিছু নেই। যদি তাই হয় তবে একতা,বন্ধুত্ব,সহযোগিতা,ভালোবাসা যা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান তাকে কি বলব? তখন তারা বলেন,ভুল করেছেন,প্রতিযোগিতাকে আপনারা সহযোগিতা বলে মনে করেছেন।এই সহযোগিতা,ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের অন্তরালেও প্রতিযোগিতা ও সংগ্রাম লুকিয়ে রয়েছে। কিরূপে? জবাব দেন,প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনে যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতাই মুখ্য,কিন্তু যখন মানুষ তার থেকে বড় কোন শত্রুর মোকাবিলায় দাঁড়ায় তখন বড় শত্রুটি বন্ধুতকে তার উপর চাপিয়ে দেয়। তাই এ বন্ধুত্ব প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্ব নয়,এ হৃদ্যতাও বাহ্যিকতা মাত্র। বড় শত্রুকে মোকাবিলার জন্য এ সহযোগিতার জন্ম ও হৃদ্যতার সৃষ্টি। যখনই এ বড় শত্রুকে দৃশ্য থেকে সড়ানো হবে তখন দেখা যাবে যারা এতক্ষণ বন্ধু ছিল তারাই বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে। যদি পুনরায় একদল নিশ্চিহ্ন হয়,অন্য যে অংশটি বেঁচে থাকবে তারা আবার বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বেও একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে লিপ্ত হবে। এভাবে যখন শুধু দু ব্যক্তি থাকবে,তৃতীয় কেউ তাদের মোকাবিলায় থাকবে না তখন এরা দু জন একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ মতবাদে বিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো সকল বন্ধুত,হৃদ্যতা,আন্তরিকতা,ভালোবাসা,ঐক্য ও সহযোগিতা শত্রুতা থেকেই সৃষ্টি। তাই তাদের মতে প্রতিযোগিতাই মুখ্য আর সহযোগিতা প্রতিযোগিতারই সৃষ্টি।

দুর্বলতার মতবাদ

যেমনিভাবে অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের বিরোধিতা করেছেন এবং অনেকেই প্রেমের মতবাদকে সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক বলে মনে করেছেন তেমনিভাবে ক্ষমতার মতবাদেরও অনেকে বিরোধিতা করেছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাকে বাড়াবাড়ি রকমভাবে সমালোচনা করেছেন এবং মানুষের পূর্ণতাকে প্রকৃতপক্ষে দুর্বল থাকার মধ্যেই মনে করেছেন। তাদের মতে পূর্ণ মানব হলো সে-ই যার কোন ক্ষমতা নেই। যেহেতু যদি ক্ষমতা থাকে তবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘনের সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ সা দী তার এক কবিতায় এ রকম একটি ভুল করেছেন। তিনি বলেছেন,

আমি সে পিপীলিকা,যে অন্যের পায়ে পদদলিত

হয় নই মৌমাছি যে তার আঘাতে অন্যকে কষ্ট দেয়।

আবার বলেছেন,

কিরূপে করিব আমি এ নেয়ামতের শোকর স্বর্গপতি?

সে শক্তি দাওনি আমায় করিব সৃষ্টির ক্ষতি।

না,জনাব সা দী,এমন নয় যে,মানুষকে হয় পিপীলিকা,না হয় মৌমাছি হতে হবে। ফলে আপনি এ দু য়ের মধ্যে পিপীলিকা হওয়াকে নিজের জন্য বেছে নিবেন। আপনার সেই পিপীলিকা হওয়ারও প্রয়োজন নেই যে অন্যের পায়ের নীচে পিষ্ট হয়,আবার মৌমাছি বা বোলতা হওয়ারও প্রয়োজন নেই যে অন্যকে কষ্ট দেয়। বরং আপনার এটা বলা উচিত,

আমি সে পিপীলিকাও নই,যে অন্যের পায়ে পিষ্ট হয়

নই মৌমাছিও,যে অন্যকে কষ্ট দেয়।

কিরূপে এ নেয়ামতের শোকর করব আমি?

রয়েছে শক্তি তবুও কষ্ট দেই না আমি।

যদি মানুষের শক্তি ও ক্ষমতা থাকে তদুপরি কাউকে কষ্ট না দেয় তখনই শোকরের প্রশ্ন আসে। নতুবা শক্তি না থাকার কারণে কাউকে কষ্ট দেয় না এরূপ হলে শিংবিহীন প্রাণীর মতো যে শিং না থাকার কারণে কাউকে গুঁতা দেয় না। যোগ্যতার প্রমাণ এখানেই যে,শিং থাকার পরও কাউকে গুঁতা দেয় না।

সা দী অন্য এক স্থানে বলেছেন,

দেখেছি এক সন্ন্যাসীকে থাকেন পর্বত চূড়ায়,

সন্তুষ্টির অন্বেষায় দুনিয়া ত্যাগীয়া নিয়েছেন আশ্রয় গুহায়।

জিজ্ঞাসিনু তারে কেন আসেন না মানুষের মাঝে

মানুষের বোঝা লাঘবের মহান কাজে?

এক সাধক যিনি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেখানে ইবাদতে মশগুল তার প্রশংসায় লিপ্ত হয়েছেন সা দী। (অবশ্য সা দী এ কবিতায় ভাবার্থের বিপরীতধর্মী কথাও অন্যস্থানে বলেছেন। যেমনবলেছেন,

খানকা থেকে এলেন এক বুজুর্গ মাদ্রাসায়,

ভেঙ্গে তার চুক্তি যা ছিল সে পথের পথিকের সাথে।

জিজ্ঞাসিনু তারে কি পার্থক্য রয়েছে আলেম ও আবেদের মাঝে

যে কারণে ছেড়েছেন সে পথ,ধরেছেন এ রথ?

বললেন,যে বাঁচাতে চায় নিজেরে শুধু,উত্তাল সমুদ্রের মাঝে,

সে আবেদ,আর যে অন্যকেও বাঁচাতে চায় তাকেই আলেম বলা সাজে।

তিনি বলছেন,তাকে প্রশ্ন করলাম, কেন আপনি শহরে আসেন না,মানুষের খেদমত করেন না? সাধক তার জবাবে এক অজুহাত পেশ করেন। সা দী এখানেই নীরব হয়ে যান। মনে হয় তিনি সাধকের এ অজুহাতকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। তিনি বলছেন,

বললেন সাধক,সেথায় রয়েছে অপরূপ রূপসিগণ

ভয় পাই,যদি দেখিয়া তাদের রূপ হারাই নিয়ন্ত্রণ।

(যেমনভাবে হাতী কাদাযুক্ত পথে চলতে ভয় পায়)

যেহেতু অপরূপ রূপসীরা সে শহরে বাস করে। তাদের প্রতি দৃষ্টিপাতে আমার স্খলন ঘটতে পারে। যেহেতু নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় আছে তাই এ গুহায় নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছি।

বাহ্! কত সুন্দর এ পূর্ণতা! নিজেকে এক স্থানে বন্দি করে পূর্ণতায় পৌছার পথ খোঁজাকে কি পূর্ণতা বলা যায়? জনাব সা দী কোরআন আপানার জন্য সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছে। এ কাহিনী হযরত ইউসুফ (আ.)-এর। এ কাহিনী কোরআনের ভাষায় তাদের জন্য যারা তাকওয়া (খোদাভীতি) ও ধৈর্য অবলম্বন করে; যেহেতু কোরআন বলছে, নিশ্চয়ই যে তাকওয়া ও ধৈর্য অবলম্বন করে (অবশেষে সে সফলকাম হবে),যেহেতু আল্লাহ্পাক সৎকর্মশীলদের কর্মকে বিফল করেন না। (সূরা ইউসুফ : ৯০)অর্থাৎ কোরআন বলছে,তুমিও ইউসুফের মতো হও। প্রবৃত্তির ক্ষুধা মেটানোর সকল উপায়-উপকরণ প্রস্তত ছিল,এমনকি পালানোর পথও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তদুপরি তিনি নিজের পবিত্রতাকে রক্ষা করেছেন। মহান আল্লাহ্ তার জন্য বন্ধ দুয়ারগুলোও খুলে দিয়েছেন। যেহেতু হযরত ইউসুফ (আ.)অবিবাহিত এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে ছিলেন অপূর্ব,সেহেতু তিনি নারীদের পেছনে নন,বরং নারীরাই তার পেছনে ছুটত। এমন দিন তার জন্য অতিবাহিত হতো না যে,কোন নারী তাকে পত্র দেয়নি বা তার খোঁজে আসেনি। তাও যেমন তেমন নারী নয়,বরং মিশরের শ্রেষ্ঠ ও কূলনারীরা তার জন্য চরমভাবে আসক্ত ছিল। স্বয়ং মিশরের অধিপতির স্ত্রী জুলাইখা তার প্রেমে বিভোর। তাকে পাওয়ার জন্য সব উপকরণ প্রস্তত করেছে। তার জন্য মরণ ফাঁদ পেতেছে- হয় তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত করতে হবে,নতুবা তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু হযরত ইউসুফ কি করলেন? আল্লাহর প্রতি হাত উঠিয়ে বললেন, হে পরওয়ারদিগার! যে বস্তুর প্রতি এরা আমাকে আহবান করছে তার থেকে জেলখানায় বন্দিত্ববরণকে আমি অধিক পছন্দ করি। (সূরা ইউসুফ : ৩৩)

অর্থাৎ এ স্ত্রীলোকদের ইচ্ছা পূরণ করার চেয়ে আমাকে বন্দিত্ব বরণের সুযোগ দিন যাতে করে এদের হাত থেকে রক্ষা পাই। যদিও আমার এ অপরাধ করার সামর্থ্য ও সুযোগ রয়েছে তদুপরি তা আমি করব না।

সুতরাং মানুষের পূর্ণতা তাদের দুর্বলতার মধ্যে নয়। যদিও আমাদের সাহিত্যে কখনো কখনো কেউ দুর্বলতাকে মানুষের পূর্ণতা মনে করেছেন। অন্য এক কবি বাবা তাহেরও এ রকম বলেছেন,

আমার এ চোখ ও অন্তর হতে আমি বাঁচতে চাই,

যা কিছু দেখে এ চোখ,অন্তর স্মরণ করে তা-ই।

এ পর্যন্ত কথা ঠিকই আছে,কিন্তু এরপর বলছেন,

বানাব এক তরবারী যা লৌহ কঠিন শক্ত

হানব আঘাত এ চক্ষুতে অন্তর হবে মুক্ত।

অর্থাৎ যা কিছুই চক্ষু দেখে অন্তর তা পেতে চায়। তাই অন্তরকে মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য এক তরবারী চাই যা দিয়ে এ চক্ষুকে অন্ধ করে দিব যাতে অন্তর কিছু না চাইতে পারে। যদি এমনই হয় তবে এমন অনেক অনেক কিছু আছে যা কর্ণ শুনে ও অন্তর পেতে চায় তাই কর্ণের মধ্যেও এক তরবারী প্রবেশ করান। আর পুরোদমে মুক্তি পেতে চাইলে খোজাও হতে হবে যাতে জৈবিক চাহিদার কথাও মনে না হয়। শেষ পর্যন্ত মাওলানা রুমীর মাসনভীর মাথা,পেট ও লেজবিহীন সিংহের গল্পের মতো হবে। বাবা তাহের অদ্ভুত এক ইনসানে কামেল তৈরি করেছেন। এই ইনসানে কামেলের না হাত আছে,না পা আছে,না চোখ,কান বা অন্য কিছু।

এ ধরনের দুর্বল চারিত্রিক প্রশিক্ষণের নির্দেশনা আমাদের সাহিত্যে প্রায়ই দেখা যায়। তাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে মানুষ সব সময়ই ভুল করে। কখনো অতিরিক্ত,কখনো পরিহার তার জীবনে লক্ষণীয়। ইসলামে যেহেতু ত্রুটি নেই তাই বোঝা যায়,এটা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোথাও থেকে আসেনি। যদি মানুষ সক্রেটিস হয় তাহলে মূল্যবোধগুলোর হয়তো একটি দিক ধরে থাকেন ও ভুল করেন,প্লেটো হলে অন্য একটি দিক ধরে থাকেন ও ভুল করেন। তেমনিভাবে ইবনে সিনা একদিক,মহিউদ্দিন আরাবী ও মাওলানা রুমী অন্যদিক ধরে থাকেন। কার্ল মার্কস,জাপসে সারটার সকলেই এরূপ একদিক ধরে বসে রয়েছেন। তাই এঁদের পক্ষে কিরূপে সম্ভব মানুষের পথ প্রদর্শক হওয়া? নবীয়ানী ও মতাদর্শ তো সর্বজনীন,সর্বব্যাপী ও পূর্ণ হতে হবে। তাই প্রকৃতপক্ষে এ সকল ব্যক্তি যেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে একদল ছাত্র- নিজেদের চিন্তা-ভাবনা থেকে কিছু বলেছে। অবশেষে বিজ্ঞ শিক্ষকের কথা শুনলে বোঝা যাবে শিক্ষকের কথা তাদের থেকে কত উন্নত ও উত্তম!

প্রেম ও ভালবাসার মতাদর্শ (আত্মপরিচিতির মতবাদ)

পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্য আরেকটি মতবাদ যাকে প্রেম ও ভালবাসার মতবাদও বলা যায়। কয়েক হাজার বছর পূর্বে পূর্ব-এশিয়ায় চিন্তা ও জ্ঞানের উচ্চ পর্যায়ের চর্চা ছিল। অনেক পুরাতন ভারতীয় গ্রন্থ (ফার্সী ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে) যেমন উপনিষদ এ ধরনের উচ্চ মার্গের গ্রন্থ।

আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আল্লামা তাবাতাবায়ী কয়েক বছর পূর্বে যখন প্রথম উপনিষদ পড়েছিলেন তখন মন্তব্য করতেন,প্রচুর মূল্যবান কথা এ গ্রন্থে আছে,কিন্তু কমই এ গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।

এ মতাদর্শে মানুষের পূর্ণতার কেন্দ্রবিন্দু হলো আত্মপরিচয়। এ মতাদর্শ বলে, নিজেকে জান । অবশ্যই নিজেকে জান- এটা সক্রেটিসও বলেছেন,সকল নবীও বলেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে তার প্রতিপালককে চিনতে পেরেছে। কিন্তু এ মতাদর্শে যে বিষয়ের প্রতিই কেবল দৃষ্টি দেয়া হয়েছে তা হলো আত্মপরিচয়।

মহাত্মা গান্ধীর লেখা কিছু প্রবন্ধ ও পত্র এটাই আমার ধর্ম শিরোনামে ফার্সীতে গ্রন্থাকারে ছাপানো হয়েছে। এ অনুবাদ গ্রন্থটি আমার মতে বেশ ভালো। গান্ধী এ গ্রন্থে বলেছেন, আমি উপনিষদগুলো পড়ে তিনটি মৌলিক বিষয় পেয়েছি যা আমার সারা জীবনের দিক-নির্দেশনা হিসেবে রয়েছে। প্রথম মৌল বিষয় যা গান্ধী উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে পৃথিবীতে শুধু একটি সত্য রয়েছে,তা হলো নিজেকে চেনা ও জানা। নিজেকে জান এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই গান্ধী সুন্দরভাবে পাশ্চাত্যের উপর হামলা করেছেন। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্য বিশ্বকে জেনেছে,কিন্তু নিজেকে চিনেনি। যেহেতু নিজেকে চিনেনি তাই নিজেও যেমন দুর্ভাগা হয়েছে বিশ্বকেও দুর্ভাগ্যে নিপতিত করেছে। তার এ কথা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ও খুবই সুন্দর।

দ্বিতীয় মৌল বিষয় : যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে স্রষ্টাকেও চিনতে পেরেছে। সে সুবাদে সব কিছুকেই চিনতে পেরেছে।

তৃতীয় মৌল বিষয় : শুধু একটি শক্তিরই অস্তিত্ব রয়েছে আর তা হলো নিজের উপর পূর্ণ আধিপত্যও নিয়ন্ত্রণ। যে কেউ নিজের অধিপতি হবে অন্য সকল কিছুর উপরও আধিপত্য লাভ করবে। বিশ্বে একটি পুণ্য কাজ রয়েছে। আর তা হলো ভালোবাসা,অন্যদেরকে ভালোবাসা যেমনভাবে মানুষ নিজেকে ভালোবাসে। অন্যভাবে বললে অন্যদেরকেও নিজের মত করে দেখতে হবে।

তাদের ভাষায় পরিচিতি অর্থ আত্মপরিচয়। নিশ্চয়ই জানেন,হিন্দু দর্শনে মোরাকাবা বা আত্মনিয়ন্ত্রণ,নিজের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়ার বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে (যদিও এখন এই আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে যোগীদের কঠিন অনুশীলন ও অন্যান্য বিষয় যোগ হয়েছে সেগুলো আমার উদ্দেশ্য নয়)। হিন্দু দর্শনের মূলে আত্মপরিচয়,আত্মনিয়ন্ত্রণ,নিজেকে উদ্ঘাটনের মাধ্যমে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।

সুতরাং এ মতবাদের মতে পূর্ণ মানব হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে চিনেছে। যখন সে নিজেকে চিনবে তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে। আর যখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে তখন অন্যদেরকে ভালোবাসতে শুরু করবে। এখন এ মতবাদকে আমরা আত্মপরিচিতির মতবাদও বলতে পারি,আবার প্রেম ও ভালবাসার মতবাদও বলতে পারি।

পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্য দু টি মতবাদ

গত দু তিন শতাব্দীতে বেশ কিছু মতাদর্শের জন্ম হয়েছে যারা মূলত সামাজিকতার দিকটিকে প্রাধান্য দান করেছেন। অর্থাৎ তাদের এ প্রবণতা ব্যক্তির থেকে সমাজের দিকে বেশি। তাদের এক দল মনে করেন পূর্ণ মানব হলো শ্রেণীহীন মানুষ। যদি কোন মানুষ এক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়,বিশেষ করে আধুনিক ও উচ্চশ্রেণীর,তবে সে মানুষ ত্রুটিযুক্ত মানুষ। শ্রেণীকেন্দ্রিক সমাজে সঠিক ও ত্রুটিহীন মানুষ জন্মগ্রহণ করতে পারে না। এ মতাদর্শ আদর্শিক পূর্ণ মানবে বিশ্বাসী নয়,যেহেতু মানুষের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কোন মর্যাদা আছে বলে মনে করে না। এ মতবাদের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব সে যে শ্রেণীহীন সমাজে অন্যান্য মানুষের সমপর্যায়ে জীবন যাপন করে।

অন্য আরেকটি দল বিশেষত মানুষের সচেতনতা ও স্বাধীনতার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেন। সচেতনতা বলতে তারা সামাজিক সচেতনতাকেই বুঝান। অস্তিত্ববাদীরা মূলত স্বীধীনতা,সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধকে মানুষের মূল বলে মনে করেন। এঁদের মতে পূর্ণ মানব হলো যে মানুষ স্বাধীন,সচেতন,দায়িত্ববান ও প্রতিশ্রুতবদ্ধ। তাদের স্বাধীনতার অর্থও দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও বিদ্রোহ বৈ কিছু নয়।

সুবিধা ও অধিকারের মতবাদ

অন্য একটি মতবাদ যা ক্ষমতার মতবাদের কাছাকাছি তা হলো অধিকারের মতবাদ। তারা বলেন, ইনসানে কামেলকে প্রজ্ঞাবান হতে হবে , তাকে স্রষ্টায় পৌছতে হবে - এ ধরনের কথাগুলো অর্থহীন। প্রকৃতপক্ষে যদি পূর্ণ মানুষ হতে চাও তবে চেষ্টা কর কোন কিছুর অধিকারী হতে,সৃষ্টির যত বেশি বস্তুর অধিকারী হতে পার তত বেশি পূর্ণতা লাভ করেছ অর্থাৎ ইনসানে কামেল সব কিছুর অধিকারী। এ কারণে তারা মানুষের পূর্ণতাকে প্রজ্ঞায় না দেখে জ্ঞান বা বিজ্ঞানে দেখেন। জ্ঞান বলতে তারা বলেন,জ্ঞান হলো প্রকৃতিকে জানা এ উদ্দেশ্যে যে,এর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা ও মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারের লক্ষ্যে তা থেকে সকল সুবিধা ভোগ করা। তাদের এ কথার শেষ অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞানের মূল্য মানুষের নিকট একটা মাধ্যমের মতো এবং প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের সত্তাগত কোন মূল্য নেই। জ্ঞান এজন্য মূল্যবান যে,এর মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে ও প্রকৃতি মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসে। আর যখন প্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণে আসে তখন সে প্রকৃতিকে ভালোভাবে ব্যবহার ও তার থেকে লাভবান হতে পারে। তাই যদি চাও মানুষকে পূর্ণতায় পৌছাতে তবে প্রকৃতি থেকে অধিকতর সুবিধা গ্রহণের জন্য চেষ্টা চালাও। জ্ঞানকেও এজন্য ব্যবহার কর। জ্ঞান তাদের নিকট একটি মাধ্যম ছাড়া কিছু নয়। যেমন ভাবে শিং গরুর জন্য প্রতিরক্ষার,সিংহের জন্য দাঁত আক্রমণের তেমনিভাবে জ্ঞানও মানুষের জন্য প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের একটি উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।

এতক্ষণ যে বিষয়গুলো আমরা আলোচনা করলাম এ মতবাদগুলোর পর্যালোচনার পর আমরা এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করে ব্যাখ্যা করব। ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তিকে কতটা মূল্য দেয়,প্রেমও ভালোবাসাকে ইসলাম কতটা প্রাধান্য দেয়,সে সাথে ক্ষমতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ ও শ্রেণীহীন সমাজের মূল্য ইসলামের নিকট কিরূপ?

মূল্যবোধগুলোর বিকাশে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা

 মানুষের পূর্ণতা তার ভারসাম্যতার মধ্যেই নিহিত। অর্থাৎ মানুষ বহুবিধ যে যোগ্যতা ও শক্তির অধিকারী তা তাকে তখনই পূর্ণ মানুষে পরিণত করে যখন সে শুধু একদিকে ঝুকে না পড়ে এবং অন্যান্য দিকগুলোকে উপেক্ষা বা নিষ্ক্রিয় করে না রাখে,বরং সবগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সামঞ্জস্য রক্ষা করে এবং সমভাবে এগুলোর বিকাশে সচেষ্ট ও মনোযোগী হয়। যেমনভাবে জ্ঞানীরা বলেন প্রকৃতপক্ষে আদল বা সুবিচারের প্রত্যাবর্তন ভারসাম্য ও সমন্বয়ের দিকেই। এখানে ভারসাম্য ও সমন্বয়ের উদ্দেশ্য এটাই যে,মানুষের যোগ্যতাসমূহের বিকাশের সাথে সাথে সেগুলোর মধ্যে যেন সমন্বয় থাকে। একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে আপনাদের নিকট সেটা পরিষ্কার করছি। একটি শিশুর যে দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে,যেমন তার হাত,পা,মাথা,কান,নাক,জিহ্বা,মুখ,দাঁত,চোখ,হৃৎপিণ্ড,কলিজা,পেট,পরিপাকতন্ত্র এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকাশ অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। সে শিশুই সুস্থ ও সম্পূর্ণ যার এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে বিকাশ লাভ করেছে। ধরি একজন মানুষের শুধু নাক বিকাশ লাভ করেছে এবং অন্যান্য অঙ্গ বিকাশ লাভ করেনি (যেমন কার্টুনে দেখা যায়) অথবা শুধু চোখ অথবা মাথার বৃদ্ধি ঘটেছে,কিন্তু দেহের বিকাশ হয়নি অথবা এর উল্টোটা। এমনিভাবে কারো হয়তো হাতের বৃদ্ধি ঘটেছে,কিন্তু পায়ের বৃদ্ধি ঘটেনি বা পায়ের বৃদ্ধি হয়েছে,কিন্তু হাতের হয়নি- এমন মানুষের বিকাশ ঘটেছে,তবে তা ভারসাম্যপূর্ণ নয়।

পরিপূর্ণ মানুষ সে-ই যার মধ্যে সকল মূল্যবোধেরই বিকাশ ঘটবে এবং কোন মূল্যবোধই বিকাশহীন অবস্থায় থাকবে না,সে সাথে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় রেখে মূল্যবোধগুলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছবে। পূর্ণ মানুষ সেই মানুষ যাকে কোরআন ইমাম বলে সম্বোধন করেছে-

 ) وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا(

এবং যখন ইবরাহীমকে তার প্রভু কতিপয় আদেশবাণী দ্বারা পরীক্ষা করলেন এবং তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন,(তখন) বলা হলো নিশ্চয় আমি তোমাকে মানব জাতির জন্য ইমাম ও নেতা নিযুক্ত করলাম। (সূরা বাকারাহ্ : ১২৪)

ইবরাহীম (আ.) যখন কয়েকটি বিচিত্র ও বড় ঐশী পরীক্ষায় অবতীর্ণ ও উত্তীর্ণ হলেন এবং সর্বোচ্চ নম্বর প্রাপ্ত হলেন তখনই পূর্ণ মানব বা ইমামতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হলেন। ইবরাহীম (আ.)-এর অন্যতম বড় পরীক্ষা ছিল আল্লাহর আদেশে তার পথে নিজ সন্তানকে নিজের হাতে কুরবানী করার প্রস্তুতি। তার আনুগত্য এ পর্যায়ে ছিল যে,যখন তিনি জানলেন আল্লাহ্ তাকে এমন নির্দেশ দিয়েছেন তখন কোন দ্বিধা ছাড়াই তা করতে রাজী হলেন।

) أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا  (

অতঃপর তারা উভয়েই (আল্লাহর সমীপে) আত্মসমর্পণ করলেন এবং তিনি তাকে যবেহ করার জন্য কপালের উপর উপুড় করে শোয়ালেন। অর্থাৎ ইবরাহীম (আ.) যেমন কুরবানী করার জন্য প্রস্তুত ইসমাইল (আ.)ও তেমন কুরবানী হওয়ার জন্য প্রস্তত। তখন আল্লাহ্ তাকে আহবান করে বললেন,‘“ হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে অবশ্যই পূর্ণ করেছ। তোমার নিকট আমরা যা চেয়েছি তা এপর্যন্তই। আমরা প্রকৃতই চাইনি তুমি তোমার সন্তানকে যবেহ কর,বরং শুধু দেখতে চেয়েছি তোমার অনুগত্যের সীমা আমার নির্দেশ ও সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে কতটুকু।

অতঃপর যখন ইবরাহীম (আ.) আগুনে নিক্ষেপ থেকে ও সন্তানকে কুরবানীর প্রস্তুতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন এবং একাই এক গোত্র ও জাতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো আমরা তোমাকে মানব জাতির জন্য ইমাম মনোনীত করলাম। তুমি এখন সে পর্যায়ে পৌছেছো যে,আদর্শ হতে পার। অন্যদের ইমাম ও নেতা হতে পার। ভিন্নভাবে বলা যায়,তুমি পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত হয়েছ,তাই অন্য সকল মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ হতে চাইলে তোমাকে অনুসরণ করবে।

হযরত আলী (আ.) একজন পূর্ণ মানব। এজন্য যে,সকল মানবিক মূল্যবোধ তার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এবং সম্পূর্ণ ভারসাম্য সহকারে বিকাশ লাভ করেছে অর্থাৎ তিনটি শর্তই তার মধ্যে পূর্ণ হয়েছে।

এখন সামঞ্জস্য ও সমন্বয়ের বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করব। সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা অনেকে না দেখে থাকলেও অবশ্যই এর কথা শুনেছেন। সমুদ্রে সব সময়ই জোয়ার-ভাটা হয়। কখনো পানি একদিকে আকর্ষিত হয় কখনো অন্য দিকে। সমুদ্র সব সময়ই উত্তাল ও গর্জনশীল। মানুষের আত্মাও সব সময় অস্থির,কখনো তা একদিকে কখনো অন্যদিকে আকর্ষিত হয়। সমাজও তেমনি,কখনো একদিকে কখনো অন্যদিকে ধাবিত হয়। সমাজের প্রবণতার উৎস হয়তো কোন ব্যক্তিবর্গ বা আন্দোলন বা অন্যকোন কারণ,কিন্তু আকর্ষণ যে আছে এটা সত্য।

এমনকি মানুষের মানবিক মূল্যবোধসমূহও এরূপ। যেমন আপনারা এক শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গকে দেখেন যাদের প্রবণতা প্রকৃতই মানবীয় প্রবণতা। কিন্তু কখনো কখনো তাদের মধ্যে কোন কোন মানবিক মূল্যবাধ একপেশেভাবে একদিকে এমনভাবে ধাবিত হয় যে,অন্যান্য সকল মূল্যবোধকে তারা ভুলে যায়। তখন এর আকৃতি সেই ব্যক্তির মত হয় যার শুধু কান,নাক বা হাত বিকাশ লাভ করেছে।

এটি একটি লক্ষণীয় বিষয় যে,প্রায়ই সমাজ কোন প্রবণতার দ্বারা আকর্ষিত হয়ে একশ ভাগ বিচ্যুতি বা পথভ্রষ্টতার দিকেই শুধু ধাবিত হয় না,বরং বাড়াবাড়ির মাধ্যমে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। অধিকাংশ মানুষ এভাবেই সে দিকে ঝুকে পড়ে।

বিশেষ মূল্যবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির নমুনা

১. ইবাদত : অন্যতম মানবিক মূল্যবোধ ইসলাম যাকে শত ভাগ গূরুত্ব দেয় তা হলো ইবাদত। এখানে ইবাদত যে বিশেষ অর্থে সাধারণত ব্যবহৃত হয় সেটা বলাই আমাদের লক্ষ্য। যেমন একান্তভাবে খোদার সঙ্গে বসা,নামায,দোয়া,মোনাজাত,তাহাজ্জুদ ও এ ধরনের অন্যান্য যে বিষয় ইসলামে রয়েছে এবং ইসলাম থেকে যেগুলো বিচিছন্ন করা যায় না।

ইবাদত প্রকৃতপক্ষেই একটি মূল্যবোধ। কিন্তু যদি সাবধানতা অবলম্বন না করা হয় তবে সমাজ এ মূল্যবোধের চরম বাড়াবাড়ির দিকে ধাবিত হবে অর্থাৎ ইসলাম বলতে বুঝাবে শুধু ইবাদত করা,মসজিদে যাওয়া,মুস্তাহাব নামায পড়া,দোয়া করা,মিলাদ পড়া,মুস্তাহাব গোসল করা,কোরআন তেলাওয়াত। কোন কোন সমাজ এ পথে বাড়াবাড়ির এমন পর্যায়ে পৌছায় যে,অন্য সকল মূল্যবোধকে প্রায় মুছে ফেলে। এর উদাহরণ আমরা ইসলামের ইতিহাসে দেখেছি। এ ধরনের প্রবণতা ইসলামী সমাজে,এমনকি ব্যক্তির মধ্যেও ছিল। এজন্য শত ভাগ অনুভূতিহীন এই সকল ব্যক্তিকে একেবারে দায়ী করা যায় না। কারণ এরা এক মরুভূমিতে জীবন যাপন করত এবং যখন এ রাস্তায় তাদেরকে টেনে আনা হয়েছে তখন তারা এর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি। এমন ব্যক্তি বুঝতে সক্ষম নয় যে,আল্লাহ্ তাকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন,ফেরেশতা হিসেবে নয়। যদি সে ফেরেশতা হতো তাহলে এ পথে চলতে পারত। তাই মানুষের উচিত তার বিভিন্ন মূল্যবোধকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ ঘটানো।

রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নিকট খবর পৌঁছল যে,কিছু সংখ্যক সাহাবী ইবাদতে মশগুল হয়েছেন। রাসূল রাগান্বিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে মসজিদে আসলেন এবং কিছুটা উচ্চৈঃস্বরে বললেন,  ما بال اقوام؟ এই দলের কি হয়েছে? (যদি আমাদের ভাষায় বলি,তাহলে বলতে হয়-এদের কি অসুখ হয়েছে?) শুনলাম এমন সব ব্যক্তি আমার উম্মতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে,আমি তো তোমাদের নবী,তদুপরি এমন নই। কখনই রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ইবাদত করি না,বরং এর কিছু অংশ বিশ্রাম করি এবং কিয়দংশ ঘুমাই। আমি আমার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য সময় দিই। আমি প্রতিদিন রোযা রাখি না,কোন কোন দিন রোযা রাখি,কোন কোন দিন ছেড়ে দিই। যারা এ ধরনের পথকে বেছে নিয়েছে অর্থাৎ দুনিয়াত্যাগী হয়েছে তারা আমার সুন্নাত থেকে বের হয়ে গেছে।

নবী (সা.) যখন অনুভব করেছেন একটি মূল্যবোধ অন্য সকল ইসলামী মূল্যবোধকে নিঃশেষ করে দিচেছ এবং ইসলামী সমাজ একদিকে ঝুকে পড়েছে তখন শক্তভাবে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।

আমর ইবনে আসের দু জন পুত্র ছিল। একজনের নাম মুহাম্মদ যে তার পিতার মতই দুনিয়াদার এবং দুনিয়াপূজারী,অন্যটির নাম আবদুল্লাহ্ যে তুলনামুলকভাবে শান্ত,ভালো ও ভদ্র। সাধারণত এ দু পুত্রের সঙ্গে পিতা যে পরামর্শ করত তাতে আবদুল্লাহ্ পিতাকে আলী (আ.)-এর দিকে দাওয়াত করত এবং মুহাম্মদ পিতাকে বলত আলীর পক্ষে থেকে কোন লাভ নেই,তাই মুয়াবিয়ার দিকে যাও। রাসূল (সা.) একবার আবদুল্লাহর নিকট গিয়ে বললেন, আমাকে খবর দেয়া হয়েছে যে,তুমি রাত্র হতে সকাল পর্যন্ত ইবাদত কর আর দিনের বেলা রোযা রাখ। তিনি বললেন, হ্যাঁ,ইয়া রাসূলাল্লাহ্। রাসূল বললেন, আমি এরূপ করি না এবং এটা ঠিকও নয়। তুমি এটা ত্যাগ কর।

কখনো সমাজ যুহদ (দুনিয়াবিমুখতা বা আত্মসংযম) অবলম্বন করতে গিয়ে বৈরাগ্যের দিকে ধাবিত হয়। যুহদ একটি প্রয়োজনীয় বস্তু যা অস্বীকার করা যায় না। এটি একটি মূল্যবোধ যার উপকারী ও ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এটি ব্যতীত সমাজ সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌছতে পারে না। যে সমাজে এটি নেই সে সমাজকে ইসলামী সমাজ বলা যায় না। কিন্তু কখনো কখনো এই মূল্যবোধ সমাজকে এমনভাবে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যায় তখন সমাজে যুহদ ছাড়া কিছুই থাকে না।

২. সৃষ্টির সেবা : ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য মূল্যবোধ আল্লাহর সৃষ্টির সেবা যা প্রকৃতই একটি মানবীয় মূল্যবোধ। এ বিষয়ে রাসূল (সা.) অত্যন্ত তাকিদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন একে অপরকে সহযোগিতা ও সাহায্য করার ব্যপারে বলছে,

) لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ(

এটা পুণ্যকর্ম নয় যে,তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডলকে পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে ফেরাও,বরং প্রকৃত পুণ্যবান ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহ্,পরকাল,ফেরেশতাগণ,কিতাবসমূহ এবং নবিগণের উপর ঈমান রাখে এবং তারই প্রেমে আত্মীয়-স্বজন,এতীম,মিসকীন,মুসাফির,সাহায্যপ্রার্থীদের এবং বন্দী মুক্তির জন্য ধন-সম্পদ খরচ করে। (সূরা বাকারাহ্ : ১৭৭)।

কিন্তু মানুষ হঠাৎ করে শেখ সা দীর মতো হয়ে (যদিও ব্যবহারিক জীবনে সা দী এরূপ ছিলেন না) কবিতার ভাষায় বলে ওঠে, ইবাদত সৃষ্টির সেবা ছাড়া কিছুই নয়। শুধু এটা করলেই যথেষ্ট। কেউ কেউ এটা বলার মাধ্যমে ইবাদতের গুরুত্বকে অস্বীকার করে। আত্মসংযমের মূল্যবোধকে অস্বীকার করে। জ্ঞানার্জন ও জিহাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করে। এ সকল মহামূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ যা ইসলামে রয়েছে তা অস্বীকার করে বসে। বলে যে, জানেন মনুষ্যত্ব কি? মনুষ্যত্ব হলো আল্লাহর সৃষ্টির সেবা। বিশেষ করে আজকালের কিছু বুদ্ধিজীবী মনে করেন একটি অত্যন্ত শক্তিশালী যুক্তি হাতে পেয়েছেন যার নাম মানবতাবাদ ও মানবপ্রেম। মানবপ্রেম কি? তারা বলেন,সৃষ্টির সেবা করা। আমরা আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করছি। আমরা বলি,অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টির সেবা করতে হবে। কিন্তু ঐ খোদারসৃষ্টি নিজে কি হবে? ধরে নিলাম যে,আল্লাহর সৃষ্টির উদরকে পূর্ণ করলাম,তার দেহকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করলাম তাতে স্রষ্টার সৃষ্টির সেবা একটি পশুকে সেবা দানের সমান হয়েছে,এর বেশি কিছু নয়। যদি আমরা মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় কোন মূল্যবোধকে গ্রহণ না করে শুধু সৃষ্টির সেবার মূল্যবোধকে গ্রহণ করি তাহলে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মূল্য ছাগল বা ঘোড়ার সমপর্যায়ের হবে। যদি মানুষ একটি প্রণীকে খাদ্য দেয়,তবে অবশ্যই সে একটি কাজ করেছে। কিন্তু মানুষের সর্বোচ্চ মর্যাদা কি এটা যে,আমার মতো অন্যান্য প্রাণীকে সেবা করব? না,মানব সেবার এর থেকেও বড় মূল্যবোধ রয়েছে। কিন্তু শর্ত হলো মানুষ কি সেটা জানতে হবে। সব সময়ই (এ কথা বলে উদাহরণ দিই) :লুলুম্বাও একজন মানুষ,মুসা চুম্বাও একজন মানুষ। যদি বিষয়টি শুধু সৃষ্টির সেবা হয় তবে মুসা চুম্বাও এক সৃষ্টি লুলুম্বাও অন্য এক সৃষ্টি এদের মধ্যে কেন পার্থক্য করব। আবু যার (রা.) ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সেবার দৃষ্টিতে কি দু জনকেই সেবা করতে হবে?

সুতরাং মানবিকতা অর্থাৎ সৃষ্টির সেবাকে যদি একমাত্র মূল্যবোধ ধরা হয়,তবে তা এক ধরনের বাড়াবাড়িই হবে।

৩. স্বাধীনতা : স্বাধীনতা একটি বড় ও উচ্চ পর্যায়ের মানবিক মূল্যবোধ। অন্যভাবে বলা যায়,এটা মানুষের নৈতিকতা ও আত্মিকতার বিষয় অর্থাৎ পশু পর্যায়ের অনেক উপরের বিষয়। স্বাধীনতা মানুষের বস্তুগত মূল্যবোধের ঊর্ধ্বের একটি মূল্যবোধ। কোন মানুষের মধ্যে যদি মনুষ্যত্বের কিছুমাত্র থাকে,তবে সে ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত,বস্ত্রহীন বা সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় জীবন যাপন করতে পারে,কিন্তু কারো দাস হতে রাজী নয়। সে কারো অধীনে থাকতে চায় না,বরং স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চায়।

নিশ্চয় জানেন দুঃখজনকভাবে ইবনে সিনা কিছুদিন বাদশাহর উজির ছিলেন। তার জীবনের তৎসময়ের একটি চমৎকার গল্গ নামেহ্-ই-দানেশওয়ারান গ্রন্থে এসেছে- একদিন তিনি রাজকীয় আভিজাত্যময় পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাচিছলেন। তিনি দেখলেন এক মেথর পঁচা ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করছে আর এ কবিতা পড়ছে-

  আমি গর্বিত আমার আত্মসম্মানকে নিয়ে,

যেহেতু আমার হৃদয়ের জন্য এ বিশ্বকে সহজ করে দিয়েছে।

 আবু আলী সিনা এটা শুনে মুচকি হেসে চিৎকার করে ডেকে তাকে বললেন, বাস্তবে সম্মান ও মর্যাদার সীমা কি এটাই যা তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বলছ। চিন্তা করেছ কি যার আত্মমর্যাদাবোধতাকে নর্দমার গর্তে নিকৃষ্ট মেথরের কাজে নিয়োজিত করেছে। যার ইজ্জত ও সম্মান এটাই যে,অসম্মান ও অমর্যাদার মধ্যে পড়ে আছে,মূল্যবান জীবনকে মানবেতর পথে ধ্বংস করছে,তাকে নিয়ে তুমি গর্ব করছ? মেথর লোকটি কাজ বন্ধ করে সংক্ষেপে জবাব দিল, পৃথিবীতে সম্মান এটাই যে,খাদ্যের জন্য নীচ পর্যায়ের কাজ হলেও করা,কিন্তু কোন প্রভুর অধীনে না থাকা (অর্থাৎ স্বাধীনতার অর্থ কোন প্রভুর মন যুগিয়ে চলা নয়)। আবু আলী লজ্জিত হয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

আবু আলী দেখলেন বাস্তবিকই এটি এমন যুক্তি যার কোন জবাব নেই। বস্তুগত ও পাশবিক দৃষ্টিতে এর কোন অর্থ হয় না যে,মানুষ মুরগী,পোলাও,দাস-দাসী,অশ্ব ও অর্থকে ত্যাগ করে মেথর হয়ে স্বাধীনতা লাভ ও আত্মতৃপ্তির কথা বলে। স্বাধীনতা ও মুক্তি কি? এটা কি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করার মত বিষয়? না,এ রকম কিছু নয়। কিন্তু মানুষের বিবেকের কাছে স্বাধীনতার গুরুত্ব এত অধিক যে,বন্দিত্ব থেকে মেথর হওয়াকে প্রাধান্য দেয়।

স্বাধীনতা প্রকৃতই একটি বড় মূল্যবোধ। কখনো দেখা যায় একটি সমাজে এই মূল্যবোধ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। কখনো দেখা যায় এই অনুভুতি জেগে উঠেছে। কেউ কেউ বলেন মানুষের মনুষ্যত্বতার স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। তাদের মতে এটি ছাড়া অন্য কোন মূল্যবোধই যেন নেই অর্থাৎ তারা চান সকল মূল্যবোধকেই এই এক মূল্যবোধের মধ্যে মুছে ফেলতে। কিন্তু স্বাধীনতা একমাত্র মূল্যবোধ নয়। ন্যায়পরায়ণতা,সুবিচার,প্রজ্ঞা স্বতন্ত্রভাবে একেকটি মূল্যবোধ। জ্ঞান একটি মূল্যবোধ,আধ্যাত্মিকতা একটি মূল্যবোধ,এরূপ অন্য সকল মূল্যবোধ। . ইশ্ক বা ভালবাসা : কখনো কখনো ইশ্ক বা প্রেম একমাত্র মূল্যবোধে পরিণত হয় যেরূপ এরফান (আধ্যাত্মিক),তাসাউফ ও সুফী গজলগুলোতে দেখা যায়।

  ফেরেশতা জানে না ভালবাসা কি এই সাকী,

ঢালতে যদি চাও শরাব তবে ঢাল আদমেরই পায়।

তখন তারা অন্যান্য সকল মূল্যবোধকে,এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যবোধকেও ভুলে যায়। আরেফগণ ইশ্কের প্রতি যে টান অনুভব করেন অনেক সময় তা পুরোপুরি বুদ্ধিবৃত্তির বিরোধী ও এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাফেজ শিরাজী বলেন,

  সুফীর কাছেই রয়েছে রহস্যকে জানার আলো

সব কিছুর গোপন ভেদ এর থেকেই জানো,

ভোরে ডাকা মোরগই জানে সকল ফুলের * ব্যাখ্যা

প্রতিটি কুক কুরুকের অর্থ তার জানা।

(*সকল ফুল অর্থ আল্লাহর সত্তা যা সকল পূর্ণতার সমষ্টি।)

তিনি বলতে চান,কেবল আরেফই পারে ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহতে পৌছতে। কয়েক ছত্র পরেই বলছেন,

এই আকলের খাতা থেকে প্রেমের যে বাণী শিখেছ হায়,

শংকিত আমি জান না সত্যিই-যা জানার তায়।

এ ছত্রে তার লক্ষ্য আবু আলী সিনার পুস্তক ইশারাত যাতে তিনি ইশ্কের ব্যাপারে কথা বলেছেন।সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে মানুষ ও মনুষ্যত্বের অর্থ হলো ইশ্ক এবং আকল একটি হাতকড়া,বেড়ী বা শৃঙ্খল বৈ কিছু নয়; তাই তা সম্পূর্ণরূপে নিন্দিত।

এক সময় দেখা যায় একমাত্র মূল্যবোধ বলতে হয়ে যায় শুধুই আকল এবং চিন্তা। বলা হয় এগুলো (ভালবাসা ও অন্যান্য মূল্যবোধ) আবার কি? এগুলো খেয়ালী ও গুরুত্বহীন যেমন-তেমন বিষয়। আবু আলী সিনা কখনো তার বক্তব্যে বলেছেন, এ শব্দগুলো সুফীদের খেয়ালী ও কল্পিত বস্তু,আমাদের উচিত আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির উপর ভর করে এগিয়ে যাওয়া।

এ সকল প্রকার মূল্যবোধই মানুষের মধ্যে রয়েছে,যেমন বুদ্ধিবৃত্তি,স্নেহ-ভালবাসা,আকর্ষণ,ন্যায়বিচার,খেদমত (মানুষের জন্য কাজ করা),ইবাদত,স্বাধীনতা এবং অন্যান্য। এখন প্রশ্ন হলো কি ধরনের মানুষ পূর্ণ মানুষ? সে ব্যক্তি যে শুধুই উপাসক? নাকি যে ব্যক্তি স্বাধীন? নাকি যে ব্যক্তি শুধুই প্রেমিক? অথবা সে ব্যক্তি যে শুধু চিন্তাশীল? না,প্রকৃতপক্ষে এদের কেউই পূর্ণ মানব নয়। পূর্ণ মানব সেই ব্যক্তি যার মধ্যে এ সকল প্রকার মূল্যবোধই সর্বোচ্চ পর্যায়ে ও ভারসাম্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছে। আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তেমন একজন মানুষ।

নাহজুল বালাগার সার্বিকতা

নাহজুল বালাগাকে হযরত আলী (আ.)-এর সম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি সম্পন্ন গ্রন্থ বলতে পারছি না,তারপরও এটা কেমন গ্রন্থ? (প্রকৃতপক্ষে সাইয়্যেদ রাজী আলী [আ.]-এর বিভিন্ন বক্তব্যের অংশ বিশেষ এনেছেন। যেহেতু তিনি সাহিত্যিক ছিলেন তাই শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণের বিষয়গুলোই এনেছেন,অথচ মাসউদী [যিনি রাজীর একশ বছর পূর্বের] বলেছেন তৎকালীন সময়ে মানুষের নিকট আলী (আ.)-এর ৪৮০টি খুতবা লিখিত ছিল।) আমরা লক্ষ্য করব,নাহজুল বালাগায় বৈচিত্রময় বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। যখন কেউ নাহজুল বালাগাহ্ পড়ে তখন কখনো মনে করে সম্ভবত আবু আলী সিনা কথা বলছেন। অন্যস্থানে দৃষ্টিপাত করে মনে করেন মাওলানা রুমী অথবা মহিউদ্দীন আরাবী কথা বলছেন। কোথাও দেখে যে,কবি ফেরদৌসীর মতো কথা অথবা কোন স্বাধীনতাকামী যার মাথায় স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুই আসে না এরূপ কেউ যেন কথা বলছে,কখনো লক্ষ্য করে,ঘরের কোণে অথবা মসজিদে বসা কোন আবেদ বা যাহেদ (যুহদ অবলম্বনকারী ) অথবা কোন ধর্মীয় নেতা বক্তব্য রাখছেন। অর্থাৎ সকল মূল্যবোধই আলী (আ.)-এর মধ্যে লক্ষ্য করে,যেহেতু বক্তব্য ব্যক্তির আত্মার প্রতিফলন। তখন বুঝি হযরত আলী কত বড় আর আমরা কত ক্ষুদ্র!

প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বের কথা যখন আমাদের সমাজের (ইরানী) দীনি ও মাযহাবী প্রবণতা শুধু যুহদও ইবাদতের দিকে ছিল,দেখা যেত কোন বক্তা মিম্বারে গিয়ে নাহজুল বালাগার বিশেষ অংশই শুধু পড়তেন। দশ-বিশটি খুতবা যা সাধারণত পড়া হতো সেগুলো ওয়াজ-নসিহত ও যুহদ অবলম্বনের আহবান দিয়ে শুরু হয়েছে। যেমন হে মানব সম্প্রদায়! নিশ্চয় দুনিয়া তোমাদের অস্থায়ী বাসস্থান এবং আখেরাত চিরস্থায়ী বাসস্থান। সুতরাং অস্থায়ী বাসস্থানের পরিবর্তে স্থায়ী বাসস্থানকে গ্রহণ কর। নাহজুল বালাগার অন্যান্য খুতবাগুলো পড়া হতো না। যেহেতু সমাজ সেগুলো গ্রহণে সক্ষম ছিলো না। সমাজ এক বিশেষ মূল্যবোধের দিকে ঝুকে পড়েছিল এবং নাহজুল বালাগার সেই অংশ যা এ মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই প্রচলিত ছিল। শত বছর অতিক্রান্ত হয়ে যেত,কিন্তু একজন ব্যক্তিকে খুজে পাওয়া যেত না যে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর মালেক আশতারের প্রতি লিখিত পত্র যা সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনার এক ভাণ্ডার সেটি পড়বে,যেহেতু সমাজের আত্মা এর জন্য আগ্রহী ও পিপাসু ছিল না। অথবা যেখানে আলী (আ.) বলছেন,

فانی سمعت رسول الله (ص) یقول فی غیر موطن: لن تقدّس امّة لا یؤخذ للضّعیف فیها حقّه من القویّ غیر متتعتع

  নিশ্চয় আমি রাসূলল্লাহকে অনন্তর বলতে শুনেছি যে,কোন উম্মতই সম্মান ও মর্যাদার পবিত্র স্থানে পৌছতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের ক্ষমতাশীলদের হস্ত হতে দুর্বলদের অধিকার আদায় করবে (অর্থাৎ উম্মতের দুর্বলরা ক্ষমতাশীলদের বিরুদ্ধে তাদের অধিকারের জন্য রুখে দাঁড়াবে) কোন দ্বিধা ও শংকা ছাড়াই। (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৫৩)

পঞ্চাশ বছর পূর্বের ইরানের সমাজ এ কথার মূল্যকে অনুধাবন করতে পারত না। যেহেতু সমাজ একটি মূল্যবোধের দিকে ঝুকে পড়েছিল। অথচ হযরত আলীর বাণীর মধ্যে সকল মূল্যবোধ স্থান লাভ করেছে এবং এ মূল্যবোধগুলো তার ব্যক্তি জীবনের ইতিহাসেও আমরা দেখতে পাই।


4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27