ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41164
ডাউনলোড: 6668

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41164 / ডাউনলোড: 6668
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের দু টি ত্রুটি

দার্শনিক মতে মানুষের প্রকৃত সত্তা হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি। এ ছাড়া বাকী যা আছে সেগুলো অপ্রধানৃএবং এগুলো মাধ্যম বৈ কিছু নয়। শরীর আকলের জন্য যেমনি একটি মাধ্যম,তেমনি চোখ,কান,ধারণক্ষমতা,কল্পনাশক্তি ও অন্য যে সকল যোগ্যতা আমাদের মধ্যে বর্তমান সেগুলোও আমাদের মূলসত্তা আকলের একেকটি মাধ্যম।

এখন প্রশ্ন হলো এ বক্তব্যের পক্ষে কোন দলিল ইসলামে রয়েছে কি? না,এ ধরনের বক্তব্য যে,আমাদের মূল সত্তা শুধু আকল- এর সপক্ষে কোন দলিল বা প্রমাণ ইসলামে নেই। ইসলাম এ ব্যাপারে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে যে,আকল মানুষের সমগ্র অস্তিত্বের একটি অংশ,তার সমগ্র অস্তিত্ব নয়।

দ্বিতীয় বিষয় হলো আমাদের অধিকাংশ দর্শনের গ্রন্থে ইসলামের ঈমানকে শুধু পরিচিতি জ্ঞান বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। তারা বলছেন,ইসলামে ঈমানের অর্থ বাস্তব পরিচিতি বা জ্ঞান। আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ আল্লাহর পরিচয়,তদ্রূপ রাসূল (সা.)-কে জানা। ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান অর্থ ফেরেশতাদের পরিচয় লাভ,আখেরাতের প্রতি ঈমানের অর্থ আখেরাতের পরিচয় জানা। কোরআনে যেখানেই ঈমান এসেছে এর অর্থ বাস্তব জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়া আর কিছু নয়। এ বিষয়টি কোনক্রমেই ইসলামের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। ইসলামে ঈমানের অর্থ শুধু পরিচিতি নয়,বরং এর চেয়ে বেশি কিছু। পরিচিতি অর্থ হলো জানা। যিনি পানিবিজ্ঞানী তিনি পানিকে চেনেন। যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী তিনি জ্যোতিষ্ক সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, তদ্রূপ যিনি সমাজবিজ্ঞানী তিনি জানেন সমাজকে,যিনি মনোবিজ্ঞানী তিনি মনকে বোঝেন,যিনি প্রাণীবিজ্ঞানী তিনি প্রাণীদের সম্পর্কে জানেন অর্থাৎ এঁরা সবাই নিজেদের সম্পৃক্ত বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন। ঈমানও কি কোরআনে এরূপ জানা অর্থেই এসেছে? আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ কি শুধুই তাকে বোঝা ও অনুভব করা? না,এমন নয়। এটা ঠিক যে,পরিচয় লাভ ঈমানের শর্ত ও অংশ। পরিচিতি ব্যতীত ঈমান অর্থহীন,এটা সত্য,কিন্তু শুধু জানাও ঈমান নয়। ঈমান এক প্রবণতা যার মধ্যে আনুগত্যের প্রবণতা রয়েছে,প্রেম ও ভালবাসার প্রবণতা রয়েছে,স্রষ্টার প্রতি আত্মনিবেদনের প্রবণতা রযেছে,কিন্তু পরিচিতির মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা অনুপস্থিত।

একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জ্যোতিষ্কমণ্ডলী সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন- এর অর্থ এটা নয় যে,তিনি জ্যোতিষ্কসমূহের প্রতি অনুরক্ত। তদ্রূপ একজন খনিজবিজ্ঞানী বা পানিবিজ্ঞানী- এর অর্থ এটা নয় যে,তিনি খনিজ বা পানির আসক্ত। বরং এ ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে যে,মানুষ কোন বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান রাখে,কিন্তু তা থেকে বিতৃষ্ণ। বিশেষত রাজনীতিতে শত্রুকে মানুষ নিজের থেকেও ভালোভাবে চেনে। উদাহরণস্বরূপ কোন ইসরাইলী হয়তো আরব ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ; হয়তো ইসলাম সম্পর্কেও তার জ্ঞান অত্যন্ত গভীর। ইসরাইলে মিশর,সিরিয়া,আলজেরিয়া বা ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মুসলমানদের মধ্যকার এরূপ বিশেষজ্ঞ অপেক্ষা অনেক বেশি এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন প্রশ্ন হলো এরূপ মিশর বিষয়ক ইসরাইলী বিশেষজ্ঞ কি মিশরের প্রতি আনুগত্যশীল? কখনই নয়। তদ্রূপ মিশরে কোন ইসরাইল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ থাকতে পারেন। কিন্তু তাই বলে তো তিনি ইসরাইলের প্রতি অনুরক্ত নন,বরং তিনি হয়তো ইসরাইলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। (যেহেতু ইসরাইল আরবদের প্রতি শত্রুপরায়ণ সেহেতু আরবরাও তাদের প্রতি সন্দেহ পরায়ণ।)

ইসলামী আলেম সমাজ যে বলেন,ঈমান অর্থ শুধু পরিচয় জ্ঞান নয় (যা দর্শন দাবি করে)- এর সপক্ষে সর্বোত্তম প্রমাণ খোদ কোরআন। যেহেতু কোরআন ঐ সকল ব্যক্তিকে আমাদের নিকট পরিচিত করিয়েছে যারা আল্লাহ্পাককে সবচেয়ে উত্তমরূপে চেনে,সে সকল নবী ও আউলিয়াকেও উত্তমরূপে চেনে,কিয়ামতকেও ভালোভাবে জানে,কিন্তু ঈমানদার নয় বরং কাফের। যেমন শয়তান। শয়তান কিআল্লাহকে চেনে না? শয়তান তো বস্তুবাদীদের মতো নয় যে,আল্লাহকে চেনে না,বরং সে আল্লাহকে চেনে,কিন্তু আল্লাহ্পাকের বিরোধী। শয়তান আমার বা আপনার থেকে অনেক ভালোভাবে আল্লাহকে চেনে। কয়েক হাজার বছর সে আল্লাহর ইবাদত করেছে। কোরআন আমাদের বলছে,ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আন এবং আমরাও ঈমান এনেছি। কিন্তু শয়তান কি ফেরেশতাদের চেনে না? না বরং সেফেরেশতাদের চেনে,তাদের সঙ্গে সহস্র বছর এক সঙ্গে ছিল,আমাদের তুলনায় হযরত জিবরাঈল(আ.)-কে সে উত্তমরূপে জানে। নবীদেরও তদ্রূপ খুব ভালোভাবে চেনে ও জানে। কিয়ামত সম্পর্কে আরো উত্তমরূপে জানে (এ কারণেই আল্লাহর নিকট কিয়ামত পর্যন্ত সময় চেয়েছে)। কিন্তু এত কিছু জানার পরেও কেন কোরআন তাকে কাফের বলে সম্বোধন করছে? কেন বলছে, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত ? (সূরা সোয়াদ : ৭৪)

যদি ঈমান (যেরূপ দর্শন বলছে) শুধু পরিচয় হতো,তবে শয়তান প্রথম মুমিন বলে পরিচিত হতো। কিন্তু পরিচয়-জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সে মুমিন নয়। কারণ সে অস্বীকারকারী জ্ঞানী অর্থাৎ যদিও সে সত্যকে জানে তদুপরি তার বিরোধীতা করে এবং সেটার প্রতি আনুগত্যশীল নয়। সে এ সত্যের প্রতি রুজু করে না বা তার প্রতি ভালোবাসাও অনুভব করে না। ফলশ্রুতিতে সে দিকে সে ধাবিতও হয় না।সুতরাং ঈমান কেবল পরিচয় নয়। এ জন্যই অনেক প্রজ্ঞাবান দার্শনিক সূরা ত্বীন-এর

) لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ ثُمَّ رَ‌دَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ(

এ আয়াতের তাফসীর এভাবে করেছেন যে,( إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا ) অর্থাৎ তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা ও

( عَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ) অর্থাৎ ব্যবহারিক প্রজ্ঞা। এটা ঠিক নয়।( إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا ) -এর মধ্যে তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা অপেক্ষা উচ্চতর অর্থ নিহিত রয়েছে। তবে তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা তার অংশ ও ভিত্তি হলেও প্রজ্ঞা,অনুধাবন,জ্ঞান,পরিচয় ও জানাই পূর্ণ ঈমান নয়,বরং ঈমান পরিচয় ও জ্ঞান থেকে বড় অন্য কিছু।

এখানে আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যে তিনটি বিষয় তুলে ধরেছি। প্রথমত আকল প্রামাণ্য দলিল,আকল দ্বারা গৃহীত বিষয় বিশ্বাসযোগ্য এবং আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে সঠিক পরিচয় লাভ সম্ভব- এ বিষয়গুলো সত্য এবং ইসলাম তা গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত আকল মানুষের একক মূলসত্তা- ইসলাম এটাকে গ্রহণ করে না। তৃতীয়ত ঈমানের অর্থ বুদ্ধিবৃত্তিক অনুধাবন,জানা ও পরিচয় লাভ ব্যতীত অন্যকিছু নয়- ইসলামের দৃষ্টিতে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

ঈমানের মৌলিকত্ব

ঈমান ও পরিচয়কে একই জানি অথবা পরিচয়কে ঈমানের একাংশ জানি,এখন যে বিষয়টি আমাদের নিকট লক্ষণীয় তা হলো ঈমান ও পরিচিতির মৌলিকত্ব রয়েছে কি? নাকি মৌলিকত্ব নেই বরং এ দু টি আমলের (কার্যের) পূর্বশর্ত মাত্র। এ ক্ষেত্রেও দু টি বড় মতাদর্শের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

ঈমানের মৌলিকত্বের অর্থ কি? এর অর্থ ইসলাম যেভাবে ঈমানকে আমাদের জন্য বর্ণনা করেছে তা এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে,ঈমান মানুষের আমলের বিশ্বাসগত ভিত্তি। অর্থাৎ মানুষ পৃথিবীতে অবশ্যই চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে এবং কাজ করবে এবং এ চেষ্টা ও কার্যক্রম এক বিশেষ পরিকল্পনা,উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি অনুযায়ী হতে হবে যার ভিত্তি বিশেষ চিন্তা ও বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। অন্যভাবে বর্ণনা করলে যেহেতু মানুষ চায় বা না চায় তার সকল কর্মকাণ্ড চিন্তাগত এবং যদি সে তার ব্যবহারিক জীবনে নিজের উদ্দেশ্যে পৌছতে সঠিক একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে চায় তবে তা চিন্তা ও বিশ্বাসের বিশেষ ভিত্তি ব্যতীত সম্ভব নয়। এ কারণেই তাকে চিন্তা ও বিশ্বাসের একটি ভিত্তি দিতে হবে যাতে তার উপর ভিত্তি করে সে তার চিন্তার কাঠামো নির্মাণ করতে পারে। যেমন কোন ব্যক্তি যদি একটি দালান নির্মাণ করতে চায় তাহলে তার লক্ষ্য চার দেয়াল,ছাদ,দরজা-জানালা বিশিষ্ট ঘর নির্মাণ করা,কিন্তু সে এগুলো নির্মাণের পূর্বে ভিত্তি বা স্তম্ভ তৈরি করে যার বেশ কিছু অংশ মাটির নীচে গ্রোথিত করে যদিওএটি তার লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু সে এটা করে যাতে করে দালানের ভিত্তি মজবুত হয় এবং তা ভেঙ্গে না পড়ে। এজন্যই ভিত্তি নির্মাণ করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ কমিউনিজম কতগুলো চিন্তা ও বিশ্বাসের সমষ্টি যার ভিত্তি বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর সমাজ,রাজনীতি,অর্থনীতি এবং নৈতিকতা সম্পর্কিত মৌলিক কাঠামোটি বস্তুবাদের মৌলিক চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তির উপর নির্মিত হয়েছে। কিন্তু একজন কমিউনিস্টের এটা লক্ষ্য নয় অর্থাৎ বস্তুবাদ তার লক্ষ্যও নয় এবং তার নিকট এর মৌলিকত্বেরও মূল্য নেই। (প্রকৃতপক্ষে যারা বস্তুবাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন তা গীর্জাসমূহের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাসমূহ,বিশেষত স্বাধীন চিন্তার বিরুদ্ধে যুক্তিহীন দ্বন্দ্বের কারণে। যার ফলে ইউরোপে এ চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল যে,হয় মানুষ স্বাধীন হয়ে সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ঈশ্বরকে দূরে ছুড়ে ফেলুক নতুবা নিজেকে অধিকারহীন ও বন্দি বলে জানুক। এর জন্য সর্বোত্তম পথ হিসেবে ধর্মের মূলোৎপাটনকে গ্রহণ করেছিল।)

কিন্তু সে চিন্তা করে (ভুল চিন্তা করে) বস্তবাদ ব্যতীত সামাজিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মৌলচিন্তাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আর তা ব্যাখ্যা করার জন্যই বস্তবাদের মৌলিক চিন্তাকে গ্রহণ করে। সম্প্রতি পৃথিবীতে কয়েকজন কমিউনিস্ট ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে যারা বস্তুবাদকে কমিউনিজম থেকে পৃথক মনে করেন। তারা বলেন, আমাদের জন্য বস্তুবাদ কোন মৌলিকত্ব তো রাখেই না,বরং বস্তুবাদকে এক অখণ্ডনীয় মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার কোন প্রয়োজনই নেই। আমরা কমিউনিজম চাই যদিও তাতে বস্তুবাদের অস্তিত্ব না থাকে। বর্তমানে পৃথিবীর আনাচে কানাচে অনেক কমিউনিস্ট নেতাই ধর্মের সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়টি পরিহার করার কথা বলছেন।

এটা এ কারণে যে,তাদের জন্য এ মৌল চিন্তার প্রতি বিশ্বাসের কোন মৌলিকত্ব নেই। এটা শুধু চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তি ব্যতীত কিছু নয়। যেহেতু জীবনাদর্শ (Ideology) বিশ্বদৃষ্টি ব্যতীত সম্ভব নয় সেহেতু এ বিশ্ব দৃষ্টিকে (বস্তুবাদ) দালানের নীচে স্থাপন করা হয় যাতে করে জীবনাদর্শ স্থাপিত ও অগ্রসর হতে পারে। কিন্তু মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো জীবনাদর্শ।

কিন্তু ইসলামে কিরূপ? ইসলাম কি ইসলামী বিশ্বাস,যেমন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস,নবী ও ওলীদের প্রতি বিশ্বাস,কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস এগুলোকে শুধু এজন্য বর্ণনা করেছে যে,চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে? ইসলাম কি এজন্য এ মৌল চিন্তাসমূহকে উপস্থাপন করেছে যাতে করে জীবনাদর্শকে এ মৌল চিন্তার উপর ভিত্তি করে স্থাপন করতে পারে এবং এটাই (জীবনাদর্শই) তার উদ্দেশ্য? যদি তা-ই হয় তবে এ মৌল চিন্তার (ঈমান) কোন মৌলিকত্ব নেই। না,এমনটি নয়। এ মৌল চিন্তা ইসলামী জীবনাদর্শিক (Ideology) চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তি বটে,তবে তার মূল্য শুধু ভিত্তি হিসেবে নয়। ইসলামের ঈমান চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তি এবং ইসলামী জীবনাদর্শ এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কিন্তু ঈমান ভিত্তি হিসেবে মূল্য ছাড়াও মৌলিকত্বের অধিকারী ও লক্ষ্য হিসেবেও পরিগণিত।

সুতরাং এ ক্ষেত্রে দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক যে,ঈমান শুধু আমলের পূর্বশর্ত হিসেবে নয় বরং এর মৌলিকত্বের কারণে মূল্যের অধিকারী। এ রকম নয় যে,শুধু কর্ম ও প্রচেষ্টাই সব কিছু। বরং যদি আমল থেকে ঈমানকে বিচ্ছিন্ন করা হয়,একটি ভিত্তিকে নষ্ট করা হলো। তেমনিভাবে যদি আমলকে ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় অন্য স্তম্ভটি ধ্বংস করা হলো। এজন্যই কোরআন সব সময় বলেছে,

( إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ)

যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে। যদি আমলহীন ঈমান হয়,তবে সাফল্যের একটি স্তম্ভ আছে অন্যটি অনুপস্থিত। অপর দিকে ঈমানহীন আমলও তদ্রূপ। সাফল্যের তাবু একটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমানের সত্তাগত মূল্য ও মৌলিকত্ব রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের পূর্ণতা এ পৃথিবীতে এবং বিশেষত আখেরাতে এটাই যে,সে ঈমানের অধিকারী। কারণ ইসলামে আত্মা স্বাধীন এবং নিজে পূর্ণতার অধিকারী- তার মৃত্যু নেই। যদি আত্মা (ঈমানের মাধ্যমে) পূর্ণতায় না পৌছায়,অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত হয় তাহলে কখনই সফলতায় পৌছতে পারে না।

কোরআন ও নাহজুল বালাগাহ্ থেকে এর সপক্ষে দলিল

কোরআন এ বিষয়ে বলছে,

) وَمَن كَانَ فِي هَـٰذِهِ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِي الْآخِرَ‌ةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًا(

যে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে অন্ধ,আখেরাতেও সে অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট। (সূরা ইসরা : ৭২)

ইমামগণ এবং অন্যান্য মুফাস্সিরও এর তাফসীরে বলেছেন,এর অর্থ এমন নয় যে,কারো বাহ্যিক এ চক্ষু পৃথিবীতে অন্ধ হলে আখেরাতেও সে অন্ধ থাকবে। যদি এরূপ হতো,তবে আবু বাসির যিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর একজন অন্ধ সাহাবী ছিলেন তিনি পরকালীন দুনিয়াতেও শোচনীয় অবস্থায় পড়বেন। না,বরং এর অর্থ হলো যে,কারো অন্তুর্চক্ষু যদি সত্যকে,তার স্রষ্টাকে,মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলী এবং অন্যান্য যে সব বিষয়ে ঈমান বা বিশ্বাস থাকা উচিত তা থেকে অন্ধ হয়,তবে সে আখেরাতে অন্ধ হিসেবে পুনরুত্থিত হবে,এর অন্যথা সম্ভব নয়। যদি ধরে নিই,এ পৃথিবীতে একজন মানুষ যত প্রকার ভালো কাজ করা সম্ভব তা করে,সৎকর্মের আদেশ ও অসৎ কর্মের নিষেধের দায়িত্ব পালন করে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দুনিয়া বিরাগী ব্যক্তির ন্যায় জীবন যাপন করে,সে সাথে নিজের জীবনকে আল্লাহর সৃষ্টির জন্য নিবেদিত করে,কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না,পরকাল ও ইহকালকে চেনেনা- এরূপ ব্যক্তি অন্ধ,তাই পরকালীন দুনিয়াতেও সে অন্ধ।

সুতরাং এটা ঠিক নয় যে,ঈমান শুধু চেষ্টা-প্রচেষ্টার পূর্ব প্রস্তুতি এবং ব্যক্তির আমল ঠিক হলেই চলবে,ঈমানের প্রয়োজন নেই। এ ধরনের কথা অর্থহীন। ফখরে রাজী বলেন,

আশংকা আমার চলে যাব বিশ্বের প্রাণ না দেখে

চলে যাব বিশ্ব ছেড়ে বিশ্বকে না দেখে

দেহের বিশ্ব ছেড়ে যাব মনের বিশ্বে ও প্রাণে

দেহের বিশ্বে মনের বিশ্ব না দেখেই তার পানে।

অর্থাৎ আমার আশংকা এটি যে, এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব,অথচ তা এ বিশ্বকে না দেখেই। তার এ কথার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, বিশ্ব বলতে পৃথিবীর মাটি,পাহাড়,সমুদ্র,তারকারাজি আর ঘর বাড়ি বোঝাচ্ছেন এবং এ সব না দেখেই চলে যাওয়ার জন্য চিন্তিত,বরং তার আশংকা হলো এখানে যে,তার অন্তুর্চক্ষু উন্মোচিত যদি না হয় তবে বিশ্বের প্রাণ,এর উৎস ও সৃষ্টিকর্তাকে অনুধাবন- যাকে ইসলাম ঈমান বলেছে তা না করেই এ বিশ্ব ছেড়ে চলে যাবেন। তিনি বলছেন,যদি এ দেহের বিশ্বে মনের বিশ্বকে অনুভব না করি,তবে কিরূপে যখন দেহের বিশ্ব ছেড়ে প্রাণ ও মনের বিশ্বে গমন করব তা অনুভব করব? যেখানে সম্ভব ছিল সেখানেই পারিনি,তাই আফসোস। এ দু টি পঙ্ক্তিতে কোরআনের

 ( وَمَن كَانَ فِي هَـٰذِهِ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِي الْآخِرَ‌ةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلًا ) এ আয়াতেরই অর্থ করেছেন। কোরআন অন্য একটি আয়াতে বলছে,

 ) قَالَ رَ‌بِّ لِمَ حَشَرْ‌تَنِي أَعْمَىٰ وَقَدْ كُنتُ بَصِيرً‌ا قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ(

(সূরা ত্বাহা:১২৫-১২৬)

কিয়ামতের দিন যে বান্দাকে অন্ধ হিসেবে পুনরুত্থিত করা হবে সে প্রতিবাদ করে বলবে, প্রভূ! কেন আমাকে অন্ধ করে পুনরুত্থিত করেছেন? আমি ঐ পৃথিবীতে চক্ষুষ্মান ছিলাম,কিন্তু কেন আমি এখানে অন্ধ? তার প্রতি বলা হবে,ঐ পৃথিবীতে তুমি যে চক্ষুর অধিকারী ছিলে তা এখানের জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে অন্য রকম চক্ষুর প্রয়োজন। তোমার যে চক্ষু ছিল তা নিজেই অন্ধ করেছ তাই তুমি এখানে অন্ধ। أقتک آیاتنا আমাদের নিদর্শনসমূহ এ পৃথিবীতে ছিল,তুমি এ নিদর্শন সমূহের মাধ্যমে আমাদের দেখা,অনুধাবন এবং সত্যকে উদ্ঘাটনের পরিবর্তে সেখানে নিজেকে অন্ধ করে রেখেছিলে। সেজন্যই প্রকৃত বিশ্বে এসে অন্ধ হিসেবে পুনরুত্থিত হয়েছ।

সূরা মুতাফ্ফিফীন বলছে,

 ) كَلَّا إِنَّهُمْ عَن رَّ‌بِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَّمَحْجُوبُونَ(

কখনই নয়,নিশ্চয়ই তারা তাদের প্রতিপালক হতে সেদিন পর্দাবৃত থাকবে। (সূরা মুতাফ্ফিফীন: ১৫) অর্থাৎ এদের পরিত্যাগ কর। এদের উচিত ছিল পৃথিবীতে তাদের চক্ষুর সম্মুখ হতে গাফিলতির পর্দা উন্মোচন করা ও দেখা। ঈমানের অর্থ এটাই- হে মানুষ! তুমি এ পৃথিবীতে আগমন করেছ যাতে এ পৃথিবীতেই চক্ষুর মাধ্যমে ঐ পৃথিবীকে দেখতে ও কর্ণের মাধ্যমে ঐ পৃথিবীকে শ্রবণ কর।

আমি সব সময়ই এজন্য আনন্দিত যে, আমাদের যুবকরা বিশেষ করে নাহজুল বালাগার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দান করছে। নাহজুল বালাগার বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। দেখবে নাহজুল বালাগাহ্ এরূপ চক্ষু ও কর্ণ সম্পর্কে কি বলে।

নাহজুল বালাগাহ্ ঈমানের ক্ষেত্রে মৌলিকত্বে বিশ্বাসী। ঈমানের মূল্য শুধু চিন্তা ও বিশ্বাসের ভিত্তি হিসেবে নয়,বরং চিন্তা ও ভিত্তি ছাড়াও মৌলিক হিসেবে নাহজুল বালাগাহ্ ঈমানকে উল্লেখ করেছে।

আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের (আহলুল্লাহ্) সম্পর্কে বলেন,

یتنسّمون بدعائه روح التجاوز

এরা এমন বান্দা যে,যখন তারা দোয়া করে ও তওবায় নিমজ্জিত হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির সমীরণ নিজেদের মধ্যে অনুভব করে।

আলী (আ.) আরো বলেন,

إنَّ اَللَّهَ سُبْحَانَهُ وَ تَعَالَى جَعَلَ اَلذِّكْرَ جِلاءً لِلْقُلُوبِ تَسْمَعُ بِهِ بَعْدَ اَلْوَقْرَةِ وَ تُبْصِرُ بِهِ بَعْدَ اَلْعَشْوَةِ وَ تَنْقَادُ بِهِ بَعْدَ اَلْمُعَانَدَةِ وَ مَا بَرِحَ لِلَّهِ عَزَّتْ آلاَؤُهُ فِي اَلْبُرْهَةِ بَعْدَ اَلْبُرْهَةِ وَ فِي أَزْمَانِ اَلْفَتَرَاتِ عِبَادٌ نَاجَاهُمْ فِي فِكْرِهِمْ وَ كَلَّمَهُمْ فِي ذَاتِ عُقُولِهِمْ

নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ তার স্মরণকে মানুষের আত্মার উজ্জ্বলতার কারণস্বরূপ করেছেন,যে কারণে (আত্মার স্বচ্ছতার কারণে) সে বধিরতার পর শ্রবণশক্তি,অন্ধত্বের পর দৃষ্টিশক্তি লাভ করে এবং নাফরমানীর পর আনুগত্যের পথ গ্রহণ করে,সকল অবস্থায় অফুরন্ত নেয়ামত দানকারী আল্লাহর জন্য নিজেকে নিবেদিত করে। সকল কালেই একদল ব্যক্তি রয়েছে যাদের চিন্তার মাধ্যমে আল্লাহ্ গোপন রহস্যের ভেদ উন্মোচন করেন। আর আকলের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ২২২)

সুতরাং আমি এখানে যে বিষয়টি বলতে চাই তা হলো আল্লাহর পরিচয় জানা,তার ফেরেশতাদের পরিচয় জানা (যারা অস্তিত্বজগতের জন্য মাধ্যম),তার প্রেরিত নবী ও আউলিয়াগণের পরিচয় জানা (যারা অন্য একভাবে আল্লাহর নেয়ামত সৃষ্টির নিকট পৌছানোর মাধ্যম),আমাদের এ পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্যকে জানা,আখেরাত ও আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তনকে জানা এ সবই মৌলিক। সত্যের প্রতি ঈমান যেমন মৌলিক তেমনি তা চিন্তা,বিশ্বাস ও ইসলামী জীবনাদর্শের ভিত্তিও বটে। কেবল একশ ভাগ মৌলিক এরূপ কোন ঈমানই পারে একটি জীবনাদর্শের জন্য সর্বোত্তম চিন্তা ও বিশ্বাসগত ভিত্তি হতে। সুতরাং কখনই আমলের জন্য যেমন ঈমানকে বিসর্জন দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় তেমনি ঈমানের জন্য আমলকে বিসর্জন দেয়াও অযৌক্তিক। এদের কোনটিকেই অন্যটির জন্য বিসর্জন দেয়া যাবে না।

সুতরাং দর্শনের পূর্ণ মানব,পূর্ণ মানব নয় বরং অপূর্ণ মানব। অপূর্ণ মানবের অর্থ কি? অপূর্ণ মানব সে,যে পূর্ণতার অংশবিশেষ ধারণ করে। দর্শন বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্ণতার ক্ষেত্রে মৌলিকত্বে বিশ্বাসী তা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু দর্শনের পূর্ণ মানব মানবের পূর্ণতার অন্যান্য দিকগুলোকে উপেক্ষা করে শুধু আকলের পূর্ণতার মধ্যে তার পূর্ণতাকে খোঁজে। তাই এ মানব অপূর্ণ অথবা অর্ধপূর্ণ যা জ্ঞানের এক প্রতিমূর্তি বৈ কিছু নয়,জ্ঞান ব্যতীত সকল কিছু তার নিকট অনুপস্থিত। এরূপ মানব এমন এক অস্তিত্বযে শুধু জানে,কিন্তু আবেগ,উত্তাপ ও গতিহীন এবং সৌন্দর্য বিমুখ। যে অস্তিত্বের সমগ্র শিল্প শুধু জ্ঞানের মধ্যে নিহিত সে অস্তিত্ব এক বিচ্ছিন্ন বিশ্বের মত পরিত্যক্ত। এটি ইসলামের পূর্ণ মানব নয় বরং ইসলামের অর্ধ মানব।

আকল ও বুদ্ধিবৃত্তির মূল্যের ক্ষেত্রে ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর হাদীসটি আপনাদের জন্য ব্যাখ্যা করার সময় হলো না। এ প্রসঙ্গে প্রচুর কথা রয়েছে। যদি এ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই তাহলে আরো দু টি বৈঠক প্রয়োজন। সে সময় হাতে নেই বলে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ সম্পর্কিত আলোচনা এখানেই শেষ করছি।

و لا حول ولا قوّة إلا بالله العلیّ العظیم