পূর্ণতায় পৌছার পথ
যখন আরেফ বিশ্বজগতের জন্য কেবল একটি সত্যের অস্তিত্বে বিশ্বসী যার নাম প্রেম তখন তার দৃষ্টিতে চিন্তা মানুষের জন্য কোন বাস্তব গুরুত্ব রাখে না। বরং মানুষের প্রকৃত সত্তা তার হৃদয় যা ঐশী ভালোবাসার কেন্দ্র। সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রেমের মতবাদের মধ্যে মানুষের অহম বা আমিত্বের বিষয়ে বিভেদ রয়েছে। মানুষের অহম কি- সেটা যা চিন্তা করে,নাকি যা ভালবাসে। আরেফ বলেন,তোমার আমিত্ব তোমার যে সত্তা ভালোবাসে- সে সত্তা নয় যা চিন্তা করে।
যদি মানুষ দার্শনিকের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় পৌছতে চায় তা কোন মাধ্যমের সাহায্যে? দার্শনিকের উত্তর হলো চিন্তা,যুক্তি,দলিল ও তর্কশাস্ত্রের নিজস্ব ছাঁচের মাধ্যমে। কিন্তু আরেফ বলেন,“
না। জ্ঞান,শিক্ষা,শ্রবণ,কথন,যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের কোন ভূমিকাই নেই।”
“
সুফীর খাতায় নেই কোন বর্ণমালার উপস্থিতি
শুভ্র অন্তর সেথা,শ্বেত বরফের সেথা আত্মগীতি।”
এত সকল কাজ বাদ দিয়ে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ কর। দার্শনিক বলেন,“
চিন্তা কর,শিক্ষকের নিকট গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ কর”
। কিন্তু আরেফ বলেন,“
পবিত্র হও,আত্মাকে পরিশুদ্ধ কর,অসৎ চরিত্রকে নিজের থেকে দূর কর,সত্য ব্যতীত যা কিছু আছে তা নিজের থেকে বিতাড়িত কর,আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ বৃদ্ধি কর,নিজের চিন্তার উপর প্রাধান্য লাভ কর। আল্লাহ্ ব্যতীত যা কিছু তোমার অন্তরে আসবে তা শয়তান। যদি শয়তানকে অন্তর থেকে দূর না কর তাহলে আল্লাহর নূরের ফেরেশতা তোমার অন্তরে প্রবেশ করতে পারবে না।”
“
সচেষ্ট আমি এ ধরায় সে মতি,পাই যেন এ শক্তি
দূর হয়ে যায় যত গ্লানি-ক্লিষ্ট,লভি যাতে মুক্তি
দূর কর অসুরে,দাও স্থান ফেরেশতায়।
জালেম শাসকের সহাবস্থান অমানিশার অন্ধকার এনেছে
যদি পেতে চাও আলো,চাও তা সূর্যের কাছে।
দুনিয়া প্রেমিক প্রভুর দরবারে আর কত ধরনা দেবে?
জালেমের দুয়ারে প্রতীক্ষা করে আর কত ভিক্ষা নেবে?
ভিক্ষার পথ কর না ত্যাগ যেথায় পাবে রতন
প্রতীক্ষা কর সেই পথে যে পথে মহাজন করে গমন।”
এ কবিতায় কবি ক্ষমতাবানদের দুয়ারে ধরনা দিতে নিষেধ করেছেন। আবার বলছেন,ভিক্ষার পথত্যাগ কর না,কিন্তু কার নিকট ভিক্ষুক হবে? বলছেন,একজন পূর্ণ মানবের নিকট।
যা হোক,এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতায় পৌছার যে পথ উপস্থাপন করে তা আত্মিক পরিশুদ্ধির পথ,স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার পথ। মানুষ যত বেশি খোদার প্রতি অনুরক্ত হবে,খোদা ভিন্ন অন্য সকল কিছুকে মন থেকে বিদূরিত করবে,নিজের অস্তিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে অন্য সকল বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে তত বেশি পূর্ণ মানবের মর্যাদার নিকটবর্তী হবে।
স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়,এরা যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন এবং তর্ক-বিতকের কোন মূল্য দেয় না। মাওলানা রুমী বলেন,
“
যুক্তির পা কাষ্ঠ নির্মিত
কাষ্ঠ পদের নেই কোন স্থায়িত্ব।”
অন্যস্থানে বলছেন,
“
যুক্তি যদি হয় মুক্তা ও পরশমনি
প্রেম তবে প্রাণের খনি
প্রাণের মর্যাদা রয়েছে ভিন্ন স্থানে
প্রাণের শরাব পানে পৌছে স্থায়ী আসনে।”
শেষ গন্তব্য কোথায়? দার্শনিকের দৃষ্টিতে মানুষের লক্ষ্য সে এক বিশ্বে পরিণত হবে- যে বিশ্ব চিন্তার বিশ্ব। দার্শনিকের ভাষায়-
صیرورة الإنسان عالما عقلیا مضاهبه للعالم العینیّ
“
মানুষ চিন্তাগতভাবে বাস্তব বিশ্বের অনুরূপ বিশ্বে রূপান্তরিত হওয়া অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব সার্বিকভাবে তার বুদ্ধিবৃত্তির আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া এমনভাবে যে,সমগ্র বিশ্বকে তার অভ্যন্তরে অনুভব ও পর্যবেক্ষণ করবে। দার্শনিকের পথের সমাপ্তি বিশ্বকে দেখা ও জানার মাধ্যমে কিন্তু আরেফের পথের সমাপ্তি কোথায়? আরেফের শেষ লক্ষ্য জানা বা দেখা নয়,বরং পৌছতে চান সত্যের মূলে অর্থাৎআল্লাহ্য়। তিনি বিশ্বাস করেন যদি মানুষ তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং প্রেমের পথে যাত্রা করে (তবে এ যাত্রা অবশ্যই একজন ইনসানে কামেলের তত্ত্বাবধানে হতে হবে) তাহলে এ পথের শেষে স্রষ্টাও তার মধ্যে কোন পর্দা থাকবে না এবং সে আল্লাহ্য় পৌছে যাবে।
কোরআনে আল্লাহ্পাক তার দীদার বা সাক্ষাতের কথা বলেছেন। আরেফগণ আল্লাহর নৈকট্য ও দীদারের বিষয়ে প্রচুর আলোচনা করেছেন। বিষয়টি ব্যাপক বিধায় এ বিষয়ে প্রবেশ করতে চাচ্ছি না যে,এর অর্থ কি। যা হোক,আরেফ এটা বলেন না যে,আমি এমন স্থানে পৌছব যেখানে নিজেই চিন্তার এক বিশ্ব হব বা আয়না হব যাতে বিশ্ব প্রতিফলিত হবে,বরং বলেন আমি বিশ্বের কেন্দ্রে পৌছতে চাই।
)
يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَىٰ رَبِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ(
“
হে মানুষ! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট পৌছানো পর্যন্ত যে কঠোর সাধনা করছ অবশ্যই তুমিতার সাক্ষাৎ লাভ করবে।”
(সূরা ইনশিকাক : ৬)
যখন সেখানে পৌছেছ অর্থাৎ তার সাক্ষাৎ লাভ করেছ তখন তুমি সব কিছুর অধিকারী
العبودیّة جوهرة کنهها الربوبیّة
অর্থাৎ বন্দেগীই মূল যার মাধ্যমে সব কিছুর অধিকারী হওয়া যায়। কিন্তু তখন এ সব কিছুই তোমার নিকট মূল্যহীন,এটাই আশ্চর্যের বিষয়। এমন স্থানে পৌছেও তুমি কিছুই চাইবে না স্বয়ং তাকে ব্যতীত। আবু সাঈদ আবিল খাইর কত সুন্দর বলেছেন!
“
যে চিনেছে তোমায় কি হবে তার জীবন দিয়ে
কি হবে তার সন্তান,পরিবার আর ঘর নিয়ে মশগুল হয়ে?
স্বপ্রেমে আসক্ত করে যদি তারে কর দু’
জাহানের অধিপতি
এ জাহানকে উপেক্ষা করে সে ফিরে যাবেই তোমার প্রতি।”
প্রথমে নিজের প্রতি আসক্ত করে তাকে দু’
জাহানই উপহার দাও। কিন্তু এমতাবস্থায় তাকে দু’
জাহান দান কর যখন সে তা চায় না। যতদিন সে তোমাকে চিনতে পারেনি ততদিন সব কিছুই চায় কিন্তু তখন তাকে তা দাও না। যখন তোমাকে চেনে তখন তাকে সব কিছু দান কর কিন্তু সে সেগুলোর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না। কারণ তোমাকে পেয়েছে,ফলে দুনিয়া ও আখেরাত কোনটিই চায় না,বরং ও দু’
টির চেয়েও মূল্যবান তোমাকে চায়।
এখন আমরা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করে দেখব আরেফের দৃষ্টিতে যে ইনসানে কামেল তা ইসলামের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ পর্যায়ে আমরা বুঝতে পেরেছি আরেফের দৃষ্টিতে ইনসানে কামেল তিনিই যিনি আল্লাহ্য় পৌছেছেন। যখন তিনি আল্লাহতে পৌছেন তখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রকাশস্থলে পরিণত হন। আল্লাহর সত্তা তার মধ্যে প্রকাশিত ও বিচ্ছুরিত হওয়ার জন্য নিজে আয়নাস্বরূপ হন।
দার্শনিক মতবাদের আলোচনায় আমরা বলেছি যাকে দর্শন পূর্ণ মানব মনে করে ইসলামের দৃষ্টিতে তা পূর্ণ নয় বরং অপূর্ণ মানব। সে সাথে দর্শনের বিভিন্ন অংশ আলোচনা করে কোন্ অংশকে ইসলাম সমর্থন করে এবং কোন্ অংশকে ইসলাম সমর্থন করে না তা তুলে ধরেছি। এখানেও আমরা সেভাবেই আলোচনা পেশ করব। ইসলামে কি আত্মিক প্রশিক্ষণ ও পবিত্রতার বিষয উল্লিখিত হয়েছে? নিঃসন্দেহে বলা যায় অবশ্যই। যেহেতু কোরআনে এসেছে-
)
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا(
(সূরা শামছ : ৯ ও ১০)
উপর্যুপরি সাত বার কসম করার পর কোরআন বলছে,“
তারাই সফলতা লাভ করেছে যারা নাফ্সকে পবিত্র করেছে এবং দুর্ভাগ্যগ্রস্ত তারাই যারা নাফ্সকে (আত্মা ও অন্তঃকরণ) ধ্বংস করেছে।