ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41092
ডাউনলোড: 6660

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41092 / ডাউনলোড: 6660
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

এরফানী মতবাদের ব্যাখ্যা

আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে,দার্শনিকের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানবের প্রতিকৃতি এক রকম আর এরফানের দৃষ্টিতে অন্য রকম। নব্য দার্শনিকদের দৃষ্টিতে আবার ভিন্ন রকম। পূর্ণ মানব সম্পর্কিত আলোচনায় যে মতবাদগুলোকে সংক্ষিপ্তভাবে আমরা তুলে ধরেছি সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা আমরা পরবর্তীতে দান করব। যে মতবাদগুলো আমরা আলোচনা করেছি তা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ,আত্মিক মতবাদ বা আরেফদের মতাদর্শ,ভালোবাসা বা প্রেমের মতবাদ,ক্ষমতার মতবাদ এবং সেবার মতবাদ। আজকের আলোচনায় আমরা এগুলোর একটিকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং এ মতবাদের বিভিন্ন অংশ নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব যেমনভাবে গত আলোচনায় বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছি।

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলো এরফানী ও তাসাউফী মতবাদের দৃষ্টিতে ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানব। এরফান ও তাসাউফের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানবের আলোচনাটি আমাদের নিকট বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এ্যারিস্টটল বা ইবনে সিনার মত দার্শনিকরা পূর্ণ মানবের প্রতিকৃতিকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে সেটা পরিচিত নয়,বরং তত্ত্ব হিসেবে দর্শনের গ্রন্থগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে- তার থেকে বের হয়ে আসেনি। কিন্তু এরফানী ও তাসাউফী মতাদর্শ পূর্ণ মানব সম্পর্কিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে কবিতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। এরফানী গ্রন্থসমূহ যেহেতু এ ষিয়টিকে লেখনী ও কবিতাতে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছে তাই তা সাধারণ মানুষের অন্তরে অধিক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। এ মতাদর্শেও দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তির মতবাদের মতো কিছু বিষয় রয়েছে যা ইসলাম গ্রহণ করে। তদুপরি এ মতবাদও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। ইসলামের পূর্ণ মানব এরফানের পূর্ণ মানবের সঙ্গে একশ ভাগ খাপ খায় না।

আরেফদের দৃষ্টি প্রেম

পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা বলেছি দর্শন আকল বা বুদ্ধিবৃত্তিকে মানুষের সত্তা ও মূল বলে জানে। আকল ব্যতীত অন্য সকল কিছুকে মানুষের সত্তা বহিভূত বলে জানে এবং মাধ্যম বলে মনে করে। মানুষের অহমকে (আমিত্ব) তার চিন্তাশক্তি বলে বিশ্বাস করে। আরেফগণ মানুষের আকল বা চিন্তাকে অহম বলে মনে করেন না। বরং চিন্তাশক্তিকে মাধ্যম বলে মনে করেন। তবে মাধ্যম হিসেবেও একে খুব নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করেন না। এরফানের দৃষ্টিতে মানুষের প্রকৃত সত্তা বা আমিত্ব হলো তার কালব বা হৃদয়। দার্শনিকের বুদ্ধিবৃত্তি কেন্দ্রিক আমিত্বের বিপরীতে আরেফ আমিত্বকে কালব বলে ব্যাখ্যা করেন। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়,আরেফ কালব বলতে মানব দেহের বাম পার্শ্বস্থিত ত্রিকোণাকার মাংসপিণ্ডকে বোঝান না যা সার্জন প্রফেসর বার্নার্ড অস্ত্রোপাচার করে পুনঃস্থাপন করেছেন। যেমনভাবে আকল চিন্তা ও বিশ্লেষণের কেন্দ্র তেমনি হৃদয় মানুষের আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র। আকল ও হৃদয় মানবদেহের ভিন্ন দু টি কেন্দ্র।

আরেফ অনুভূতিকে,সার্বিকভাবে বললে প্রেমকে (যা অনুভূতির কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী) বিশেষভাবে গুরুত্ব ও মূল্য দান করেন। একজন বিজ্ঞ দার্শনিকের নিকট চিন্তা,যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনের গুরুত্ব যেরূপ,একজন আরেফের নিকট প্রেম ও ভালবাসার গুরুত্বও তদ্রূপ। অবশ্য আরেফগণ ইশক বা প্রেম বলতে যা বোঝান তার সঙ্গে আমাদের পত্র-পত্রিকার প্রেমের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের প্রেম দৈহিক। অপরপক্ষে প্রথমত আরেফগণের প্রেম মানুষের আত্মায় উদ্ভূত হয়ে খোদায় পৌছায় এবং আরেফের প্রকৃত প্রেমিক ও একমাত্র প্রেমাস্পদ শুধুই আল্লাহ্।

দ্বিতীয়ত আরেফগণের প্রেম মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আরেফ বিশ্বাস করেন সমগ্র সৃষ্টিজগতে প্রেম বিস্তৃত। কোন কোন এরফানী ও এরফানমুখী দর্শনের গ্রন্থে,যেমন আসফার -এ একটি অধ্যায় রয়েছে যার নাম ফি সিরইয়ানিল ইশক ফি জামিয়িল মাওজুদাত অর্থাৎ সমগ্র অস্তিত্বজগতে প্রেমের বিচরণ। তারা বিশ্বাস করেন প্রেম এক বাস্তবতা যা অস্তিত্ব জগতের অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বায়ু,পাথর,এমনকি বস্তুর ক্ষুদ্রতম এককের মধ্যেও প্রেম বিদ্যমান। প্রকৃতপক্ষে যা আসল ও মৌলিক তা প্রেম,প্রেম ব্যতীত অন্য সকল কিছুই এর উপমা ও অলংকার বিশেষ। মাওলানা রুমীর ভাষায়-

প্রেম দরিয়া যেন,আসমান তার ফেনা

জুলাইখার চোখে যেন ইউসুফের নেশা।

আসমান-জমিনসহ সমগ্র প্রকৃতি জগৎ আরেফদের চোখে প্রেমরূপ সমুদ্রের উপর ফেনা বৈ কিছু নয়।

হাফেজ শিরাজী বলেন,

আসিনি এ জগতে সম্মান ও মর্যাদা পেতে,

আশ্রয় নিয়েছি হেথায় দুর্ঘটনার ফলশ্রুতিতে।*

প্রেমের পথেই করেছেন সৃষ্টি অনস্তিত্ব হতে আমায়,

প্রেমের এ পথ পেরিয়েই চাই পৌছতে সেথায়।

(*হযরত আদম (আ.)-এর বেহেশত থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা।)

অত্যন্ত সুন্দর বলেছেন হাফেজ। বলা হয়ে থাকে এ পঙ্ক্তি দু টি সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ায় বর্ণিত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর প্রথম দোয়াটির অনুবাদ। মহান আল্লাহর প্রশংসার পর তিনি বলছেন,

إبتدع بقدرته الخلق إبتدعا و اخترعهم علی مشیّته اخترعا ثمّ سلک بهم طریق عبادته و بعثهم فی سبیل محبته

(সেই আল্লাহর প্রশংসা) যিনি তার ক্ষমতার মাধ্যমে অনস্তিত্ব থেকে (সৃষ্টি জগতকে) অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন যার পূর্বে কোন উদাহরণ ছিল না। তার ইচ্ছার মাধ্যমেই অনস্তিত্বের অন্ধকার থেকে তাকে অস্তিত্বের আলোয় আনয়ন করেছেন। অতঃপর তাকে পরিচালিত করেছেন তার বন্দেগীর দিকে এবং তার ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের জন্য তাকে নির্বাচিত করেছেন।

হাফেজও তা-ই বলছেন।

পূর্ণতায় পৌছার পথ

যখন আরেফ বিশ্বজগতের জন্য কেবল একটি সত্যের অস্তিত্বে বিশ্বসী যার নাম প্রেম তখন তার দৃষ্টিতে চিন্তা মানুষের জন্য কোন বাস্তব গুরুত্ব রাখে না। বরং মানুষের প্রকৃত সত্তা তার হৃদয় যা ঐশী ভালোবাসার কেন্দ্র। সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রেমের মতবাদের মধ্যে মানুষের অহম বা আমিত্বের বিষয়ে বিভেদ রয়েছে। মানুষের অহম কি- সেটা যা চিন্তা করে,নাকি যা ভালবাসে। আরেফ বলেন,তোমার আমিত্ব তোমার যে সত্তা ভালোবাসে- সে সত্তা নয় যা চিন্তা করে।

যদি মানুষ দার্শনিকের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানুষের মর্যাদায় পৌছতে চায় তা কোন মাধ্যমের সাহায্যে? দার্শনিকের উত্তর হলো চিন্তা,যুক্তি,দলিল ও তর্কশাস্ত্রের নিজস্ব ছাঁচের মাধ্যমে। কিন্তু আরেফ বলেন, না। জ্ঞান,শিক্ষা,শ্রবণ,কথন,যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের কোন ভূমিকাই নেই।

সুফীর খাতায় নেই কোন বর্ণমালার উপস্থিতি

শুভ্র অন্তর সেথা,শ্বেত বরফের সেথা আত্মগীতি।

এত সকল কাজ বাদ দিয়ে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ কর। দার্শনিক বলেন, চিন্তা কর,শিক্ষকের নিকট গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ কর । কিন্তু আরেফ বলেন, পবিত্র হও,আত্মাকে পরিশুদ্ধ কর,অসৎ চরিত্রকে নিজের থেকে দূর কর,সত্য ব্যতীত যা কিছু আছে তা নিজের থেকে বিতাড়িত কর,আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ বৃদ্ধি কর,নিজের চিন্তার উপর প্রাধান্য লাভ কর। আল্লাহ্ ব্যতীত যা কিছু তোমার অন্তরে আসবে তা শয়তান। যদি শয়তানকে অন্তর থেকে দূর না কর তাহলে আল্লাহর নূরের ফেরেশতা তোমার অন্তরে প্রবেশ করতে পারবে না।

সচেষ্ট আমি এ ধরায় সে মতি,পাই যেন এ শক্তি

দূর হয়ে যায় যত গ্লানি-ক্লিষ্ট,লভি যাতে মুক্তি

দূর কর অসুরে,দাও স্থান ফেরেশতায়।

জালেম শাসকের সহাবস্থান অমানিশার অন্ধকার এনেছে

যদি পেতে চাও আলো,চাও তা সূর্যের কাছে।

দুনিয়া প্রেমিক প্রভুর দরবারে আর কত ধরনা দেবে?

জালেমের দুয়ারে প্রতীক্ষা করে আর কত ভিক্ষা নেবে?

ভিক্ষার পথ কর না ত্যাগ যেথায় পাবে রতন

প্রতীক্ষা কর সেই পথে যে পথে মহাজন করে গমন।

এ কবিতায় কবি ক্ষমতাবানদের দুয়ারে ধরনা দিতে নিষেধ করেছেন। আবার বলছেন,ভিক্ষার পথত্যাগ কর না,কিন্তু কার নিকট ভিক্ষুক হবে? বলছেন,একজন পূর্ণ মানবের নিকট।

যা হোক,এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতায় পৌছার যে পথ উপস্থাপন করে তা আত্মিক পরিশুদ্ধির পথ,স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার পথ। মানুষ যত বেশি খোদার প্রতি অনুরক্ত হবে,খোদা ভিন্ন অন্য সকল কিছুকে মন থেকে বিদূরিত করবে,নিজের অস্তিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে অন্য সকল বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে তত বেশি পূর্ণ মানবের মর্যাদার নিকটবর্তী হবে।

স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়,এরা যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন এবং তর্ক-বিতকের কোন মূল্য দেয় না। মাওলানা রুমী বলেন,

যুক্তির পা কাষ্ঠ নির্মিত

কাষ্ঠ পদের নেই কোন স্থায়িত্ব।

অন্যস্থানে বলছেন,

যুক্তি যদি হয় মুক্তা ও পরশমনি

প্রেম তবে প্রাণের খনি

প্রাণের মর্যাদা রয়েছে ভিন্ন স্থানে

প্রাণের শরাব পানে পৌছে স্থায়ী আসনে।

শেষ গন্তব্য কোথায়? দার্শনিকের দৃষ্টিতে মানুষের লক্ষ্য সে এক বিশ্বে পরিণত হবে- যে বিশ্ব চিন্তার বিশ্ব। দার্শনিকের ভাষায়-

صیرورة الإنسان عالما عقلیا مضاهبه للعالم العینیّ

মানুষ চিন্তাগতভাবে বাস্তব বিশ্বের অনুরূপ বিশ্বে রূপান্তরিত হওয়া অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব সার্বিকভাবে তার বুদ্ধিবৃত্তির আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া এমনভাবে যে,সমগ্র বিশ্বকে তার অভ্যন্তরে অনুভব ও পর্যবেক্ষণ করবে। দার্শনিকের পথের সমাপ্তি বিশ্বকে দেখা ও জানার মাধ্যমে কিন্তু আরেফের পথের সমাপ্তি কোথায়? আরেফের শেষ লক্ষ্য জানা বা দেখা নয়,বরং পৌছতে চান সত্যের মূলে অর্থাৎআল্লাহ্য়। তিনি বিশ্বাস করেন যদি মানুষ তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে এবং প্রেমের পথে যাত্রা করে (তবে এ যাত্রা অবশ্যই একজন ইনসানে কামেলের তত্ত্বাবধানে হতে হবে) তাহলে এ পথের শেষে স্রষ্টাও তার মধ্যে কোন পর্দা থাকবে না এবং সে আল্লাহ্য় পৌছে যাবে।

কোরআনে আল্লাহ্পাক তার দীদার বা সাক্ষাতের কথা বলেছেন। আরেফগণ আল্লাহর নৈকট্য ও দীদারের বিষয়ে প্রচুর আলোচনা করেছেন। বিষয়টি ব্যাপক বিধায় এ বিষয়ে প্রবেশ করতে চাচ্ছি না যে,এর অর্থ কি। যা হোক,আরেফ এটা বলেন না যে,আমি এমন স্থানে পৌছব যেখানে নিজেই চিন্তার এক বিশ্ব হব বা আয়না হব যাতে বিশ্ব প্রতিফলিত হবে,বরং বলেন আমি বিশ্বের কেন্দ্রে পৌছতে চাই।

) يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ إِنَّكَ كَادِحٌ إِلَىٰ رَ‌بِّكَ كَدْحًا فَمُلَاقِيهِ(

হে মানুষ! তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট পৌছানো পর্যন্ত যে কঠোর সাধনা করছ অবশ্যই তুমিতার সাক্ষাৎ লাভ করবে। (সূরা ইনশিকাক : ৬)

যখন সেখানে পৌছেছ অর্থাৎ তার সাক্ষাৎ লাভ করেছ তখন তুমি সব কিছুর অধিকারী

العبودیّة جوهرة کنهها الربوبیّة অর্থাৎ বন্দেগীই মূল যার মাধ্যমে সব কিছুর অধিকারী হওয়া যায়। কিন্তু তখন এ সব কিছুই তোমার নিকট মূল্যহীন,এটাই আশ্চর্যের বিষয়। এমন স্থানে পৌছেও তুমি কিছুই চাইবে না স্বয়ং তাকে ব্যতীত। আবু সাঈদ আবিল খাইর কত সুন্দর বলেছেন!

যে চিনেছে তোমায় কি হবে তার জীবন দিয়ে

কি হবে তার সন্তান,পরিবার আর ঘর নিয়ে মশগুল হয়ে?

স্বপ্রেমে আসক্ত করে যদি তারে কর দু জাহানের অধিপতি

এ জাহানকে উপেক্ষা করে সে ফিরে যাবেই তোমার প্রতি।

প্রথমে নিজের প্রতি আসক্ত করে তাকে দু জাহানই উপহার দাও। কিন্তু এমতাবস্থায় তাকে দু জাহান দান কর যখন সে তা চায় না। যতদিন সে তোমাকে চিনতে পারেনি ততদিন সব কিছুই চায় কিন্তু তখন তাকে তা দাও না। যখন তোমাকে চেনে তখন তাকে সব কিছু দান কর কিন্তু সে সেগুলোর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করে না। কারণ তোমাকে পেয়েছে,ফলে দুনিয়া ও আখেরাত কোনটিই চায় না,বরং ও দু টির চেয়েও মূল্যবান তোমাকে চায়।

এখন আমরা ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করে দেখব আরেফের দৃষ্টিতে যে ইনসানে কামেল তা ইসলামের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ পর্যায়ে আমরা বুঝতে পেরেছি আরেফের দৃষ্টিতে ইনসানে কামেল তিনিই যিনি আল্লাহ্য় পৌছেছেন। যখন তিনি আল্লাহতে পৌছেন তখন আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর প্রকাশস্থলে পরিণত হন। আল্লাহর সত্তা তার মধ্যে প্রকাশিত ও বিচ্ছুরিত হওয়ার জন্য নিজে আয়নাস্বরূপ হন।

দার্শনিক মতবাদের আলোচনায় আমরা বলেছি যাকে দর্শন পূর্ণ মানব মনে করে ইসলামের দৃষ্টিতে তা পূর্ণ নয় বরং অপূর্ণ মানব। সে সাথে দর্শনের বিভিন্ন অংশ আলোচনা করে কোন্ অংশকে ইসলাম সমর্থন করে এবং কোন্ অংশকে ইসলাম সমর্থন করে না তা তুলে ধরেছি। এখানেও আমরা সেভাবেই আলোচনা পেশ করব। ইসলামে কি আত্মিক প্রশিক্ষণ ও পবিত্রতার বিষয উল্লিখিত হয়েছে? নিঃসন্দেহে বলা যায় অবশ্যই। যেহেতু কোরআনে এসেছে-

) قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا(

(সূরা শামছ : ৯ ও ১০)

উপর্যুপরি সাত বার কসম করার পর কোরআন বলছে, তারাই সফলতা লাভ করেছে যারা নাফ্সকে পবিত্র করেছে এবং দুর্ভাগ্যগ্রস্ত তারাই যারা নাফ্সকে (আত্মা ও অন্তঃকরণ) ধ্বংস করেছে।

আরোপিত জ্ঞান

ইসলামে কি আত্মিক পবিত্রতা অর্জনকে পরিচিতি ও জ্ঞান লাভের অন্যতম পথ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে? কোরআন যে বলছে, যে ব্যক্তি আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করল সে সফলকাম হলো তাতে আত্মিক পবিত্রতা অর্জনকে বাস্তব জ্ঞান অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়েছে কি? নাকি পরিচিতি ও জ্ঞান অর্জনের একমাত্র পদ্ধতি হলো যুক্তি ও দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন যা দর্শন বলছে।

এটা যে (আত্মিক পবিত্রতা অর্জন) ইসলাম কতৃক সমর্থিত তা নিঃসন্দেহে সত্য। রাসূল (সা.) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যা শিয়া-সুন্নী সবাই নকল করেছে এবং একটি প্রতিষ্ঠিত হাদীস তা হলো:

من أخلص لله اربعین صباحا جرت ینابیع الحکمة من قلبه علی لسانه

যে কেউ চল্লিশ দিবা-রাত্রি আল্লাহর জন্য খালেস করবে অর্থাৎ চল্লিশ দিন তার মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্য কিছুই না থাকে (আল্লাহর জন্য কথা বলে,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই নীরবতা পালন করে,আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তাকায়,চোখ বন্ধ করে,খাদ্য গ্রহণ করে,ঘুমায়,জেগে থাকে এবংএমন সুশৃঙ্খলভাবে পরিকল্পনা করে ও আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য চেষ্টা চালায় যে,প্রকৃতই আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো জন্য কাজ না হয়) তবে আল্লাহ্পাক সে ব্যক্তির অন্তঃকরণ হতে হেকমত ও জ্ঞানের এক ফল্গুধারা তার জিহ্বায় প্রবাহিত করেন। অর্থাৎ হযরত ইবরাহীম খলীল (আ.)-এর ভাষায়-

 ( إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّـهِ رَ‌بِّ الْعَالَمِين)

আমার নামায,আমার কোরবানী,আমার জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর জন্য । (সূরা আনআম : ১৬২)

এরূপ যদি কেউ হতে পারে (চল্লিশ দিন তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ দমন করে এবং আল্লাহর ব্যতীত আর কারো জন্য কাজ না করে ও আল্লাহর জন্যই বেঁচে আছে এমনভাবে কাজ করে) রাসুল (সা.)বলেছেন,আল্লাহ্ তার অন্তঃকরণ হতে জ্ঞানের ধারা সৃষ্টি করবেন।

সুতরাং বোঝা যায়,এরফান যে জ্ঞানকে অরোপিত জ্ঞান বলছে যা মানুষের অন্তঃকরণ হতে উৎসারিত হয়- ইসলাম তা গ্রহণ করে। যেমনভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকেও সে মেনে নেয়। যেমন হযরত মূসা (আ.)-কে আল্লাহ্পাক বলেছেন,عَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا   (সূরা কাহাফ ৬৫) আমরা সেই বান্দাকে আমাদের নিকট হতে ইলম দান করেছি অর্থাৎ এই ইলম বা জ্ঞানকে সে মানুষের নিকট থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেনি বরং তার অন্তঃকরণ হতে এ জ্ঞানের ধারা আমরা প্রবাহিত করেছি। (কালামশাস্ত্রে ইলমে লাদুন্নি শব্দের ব্যবহার কোরআনের এ আয়াত থেকেই এসেছে।)

কবি হাফেজ শিরাজী তার কবিতায় ইঙ্গিতের মাধ্যমে এ হাদীসের বাণীর দিকেই ইশারা করেছেন,

ভোরের যাত্রী এ পথে যেতে

বলেছে এক ধাঁধাঁয় ইশারা ও ইঙ্গিতে

হে সুফী! শরাব তখনই হয় পানের উপযুক্ত

যখন থাকে চল্লিশ দিবা-রাত্রি শিশিতে আবদ্ধ।

রাসূল (সা.) বলেছেন,

لو لا أنّ الشیاطین یحومون حول قلوب بنی آدم لنظروا إلی ملکوت السّموات

যদি শয়তান আদমের সন্তানদের হৃদয়ের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ না করত (যে কারণে অন্তরে কালিমাও আবরণের সৃষ্টি হয়) তবে হৃদয়ের চক্ষু দিয়ে সে অকাশমণ্ডলীর পরিচালন ব্যবস্থা (অর্থাৎ ফেরেশতামণ্ডলীর তত্ত্বাবধানে যে বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে) দেখতে পেত। (মোহাজ্জাবাতুল বাইদা,২য়খণ্ড,পৃ. ১২৫)

এ হাদীসটি আমাদের কোন কোন গ্রন্থে,যেমন জামেয়াস্ সায়াদাতে এসেছে। অন্য স্থানে নবী(সা.) বলেছেন,

لو لا تکثیر فی کلامکم و تمریج فی قلوبکم لرأیتم ما أری و لسمعتم ما اسمع

যদি তোমাদের কথায় বাচালতা ও অন্তর তৃণ ও আগাছা দ্বারা আবৃত না থাকত (যার ফলে যেকোন প্রাণীই সেখানে চরে বেড়ায়) তাহলে যা আমি দেখতে ও শুনতে পাই তোমরাও তা দেখতে ও শুনতে পেতে। (জামেয়াস্ সায়াদাত)

রাসূল (সা.) বলতে চাচ্ছেন এ বস্তু দেখার জন্য নবী বা রাসূল হওয়ার প্রয়োজন নেই। কখনো কখনো অন্যরাও তা দেখতে পায়। যেমন হযরত মরিয়ম (আ.)।

রাসূল (সা.) যখন হেরা পর্বতের গুহায় ছিলেন তখন আলী (আ.)ও তার সাথে ছিলেন। কিন্তু তার বয়স তখন ১০ বছরের বেশি ছিল না। প্রথম বার যখন রাসূলের উপর ওহী অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলের নিকট বিশ্ব পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সে মুহর্তে রাসূল অদৃশ্য (গায়েব) ও মালাকুত থেকে যা শুনতে পাচ্ছিলেন আলীও তা শুনতে পেয়েছিলেন। স্বয়ং আলী (আ.) নাহজুল বালাগাতে বলেছেন,

ولقد سمعت رنّة الشیطان حین نزول الوحی علیه

প্রথম বার যখন তার (রাসূলের) উপর ওহী অবতীর্ণ হয় তখন শয়তানের আর্তনাদ শুনতে পাই। রাসূলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন :

إنّک تسمع ما اسمع و تری ما اری انّک لست بنبیِ

হ্যাঁ,আমি যা শুনছি তুমিও তা শুনতে পাচ্ছ,আমি যা দেখছি তুমিও তা দেখতে পাচ্ছ,তবে তুমি নবী নও। (খুতবা নং ১৯০)

অতএব,আত্মিক পরিশুদ্ধি,নিষ্ঠা এবং প্রবৃত্তিকে দমন শুধু মানুষের হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতাই দান করেনা বরং এর প্রভাবে মানুষের হৃদয় হতে জ্ঞান ও হেকমতের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়।