ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41082
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41082 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

প্রকৃতি বিমুখতা

আজকের আলোচনায় অন্য একটি বিষয় উপস্থাপন করব। সেটা হলো এরফানের যুক্তি হচ্ছে যা কিছু চাও তা নিজের থেকেই চাও অর্থাৎ এরফান অন্তর্মুখী মতবাদ। এ মতবাদে অন্তর হলো বৃহত্তর বিশ্ব। যদি সমগ্র বিশ্বকে একদিকে এবং মানুষের অন্তঃকরণকে (অন্তঃকরণ বলতে আল্লাহ্পাক তার থেকে যে রূহ মানুষের দেহে ফুৎকার করেছেন) অপরদিকে রাখা হয়,তবে অন্তঃকরণ তার থেকে বড় হবে।তারা বিশ্বকে ক্ষুদ্রমানুষ এবং অন্তঃকরণকে বৃহৎ মানুষ বলেন। যেহেতু তারা বিশ্ব এবং অন্তঃকরণকে একই ধরনের মনে করেন এ অর্থে যে,একটি অপরটির সদৃশ সেজন্য বিশ্বকে ক্ষুদ্র বিশ্ব এবং অন্তঃকরণকে বৃহৎ বিশ্ব বলে অভিহিত করে থাকেন। মানুষকে ক্ষুদ্র বিশ্ব এবং বহির্বিশ্বকে বৃহৎ বিশ্ব বলাকে তারা সমীচিন মনে করেন না। বরং যে বিশ্বকে আমরা বৃহৎ বিশ্ব বলি তাদের ভাষায তা ক্ষুদ্র বিশ্ব এবং যে বিশ্বকে আমরা ক্ষুদ্র বিশ্ব বলি অর্থাৎ মানুষের অভ্যন্তরীণ বিশ্ব তা তাদের ভাষায় বৃহৎ বিশ্ব।

মাওলানা রুমী বলেন,

এমন কিছু নেই পানির পাত্রে,যা থাকবে না নদীতে

এমন কিছু কি থাকবে ঘরেতে,যা থাকবে না শহরেতে?

এটা সম্ভব কি কোন বস্তু ঘরে রয়েছে,কিন্তু শহরে তা খুজে পাওয়া যাবে না। এটা সম্ভব নয়। কারণ ঘর শহরেরই অংশ। তাই যা ঘরে রয়েছে তা যা শহরে রয়েছে তারই নমুনা বৈ কিছু নয়। তেমনি এটাও সম্ভব নয় যে,একটি পাত্রে যে পানি রয়েছে তা নদীতে থাকবে না। যা পানির পাত্রে রয়েছে তা নদীর পানিরই একটি ক্ষুদ্র অংশ।

এ পৃথিবী পানির পাত্র,হৃদয় যেথায় ঝরনা ধারা

এ বিশ্ব ঘরের রূপ অন্তর শহরই যেন বিস্ময়ে ভরা।

তিনি এভাবে বলেননি যে,হৃদয় পানির পাত্র এবং পৃথিবী ঝরনা ধারা,বরং বলেছেন এ বিশ্ব পানির পাত্রস্বরূপ এবং হৃদয় ঝরনা ধারা। এ চিন্তাধারা মানুষকে কতটা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে! মানুষ ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটবে নাকি শহরের উদ্দেশ্যে? এখান থেকে বোঝা যায়,যা ঘরে রয়েছে তা যখন শহরেও রয়েছে তখন মানুষ শহরের দিকেই ছুটবে। মানুষ কি ক্ষুদ্র পাত্রের পানির দিকে ছুটবে নাকি পানির ঝরনার দিকে? স্বভাবতঃই ঝরনা ধারার দিকেই তার প্রবণতা থাকবে।

এরফানের ভিত্তি অন্তর ও অন্তর্মুখিতা এবং বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্তরের দিকে দৃষ্টিদান। এমনকি সত্য ও হাকীকতকে যে বহির্বিশ্ব থেকে আহরণ সম্ভব তাও তারা অস্বীকার করেন। তারা বলেন,অভ্যন্তর থেকেই তা আহরণ কর। হাফেজ শিরাজী বলেন,

যুগ যুগ ধরে হৃদয় আমার সন্ধানে এক রত্ন আয়নার*

খুজছিল তা পরের কাছে যা রয়েছে অভ্যন্তরে আপনার

যে রত্নেরে পারে না করিতে ধারণ স্থান ও কাল

পথহারা সাগর যাত্রী হতে তা চাওয়া বৃথা আহবান

গিয়েছিলেম পীরের খানকায় এ সমস্যা নিয়ে গত রাতে

বললেন মাথা ঝুঁকে,এ সমস্যা রয়েছে পৃথিবীতে

দেখলাম তারে বসে হাসি মুখে হাতে নিয়ে শরাবের পেয়ালা**

রত্ন আয়নায় শতরূপে বিশ্বকে দেখছেন,করছেন খেলা

বললাম তারে,হে প্রজ্ঞাবান! কবে পেয়েছেন বিশ্বদৃষ্টির এ ভাণ্ডার

বললেন,যেদিন স্রষ্টা করেছেন বিশ্ব সৃষ্টি,দিয়েছেন তা আমায় উপহার

বুঝলাম আমি যদিও এ হৃদয়হারার নিকট রয়েছেন খোদা সর্বাবস্থায়

নিকটকে তিনি দেখেননি বলে ডেকে চলেছেন তারে দূরের আহ্বানে হায়।

আকলের সকল প্রচেষ্টা হয়েছে হেথায় ব্যর্থ

সামেরীর মত মূসার লাঠিও আলোকিত হাতের নিকট হয়েছে পরাস্ত।

বললেন পীর,বন্ধুকে*** আমার ঝুলানো হয়েছে ফাঁসির কাষ্ঠে

অপরাধ তার ছিল এটাই বলেছিল সে গোপন কথা প্রকাশ্যে।

(*পূর্ণ মানব যার মধ্যে খোদার গুণাবলী প্রতিফলিত হয়েছে,**সুফী বা আরেফের হৃদয়,***মানসুর হাল্লাজ)

মৌলভীর তুলনা

মৌলভী বা মাওলানা রুমী তার মাসনভীর ষষ্ঠ অধ্যায়ে একটি গল্প রূপক অর্থে এনেছেন। এক ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে সর্বদা আল্লাহর নিকট গুপ্তধন চাইত। এ অলস ব্যক্তিটি যার মনোবাঞ্ছাহলো হঠাৎ করে গুপ্তধন অর্জনের মাধ্যমে সারা জীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দেয়া। সে বলত, হে খোদা! পৃথিবীতে এত লোক এসেছে তাদের অনেকেই মাটির নীচে গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছে। কত শত গুপ্তধনের মালিক তা পৃথিবীতে রেখে চলে গেছে। তাদের মধ্যে একটিকে আমাকে দেখিয়ে দাও। দীর্ঘদিন দিবা-রাত্রি তার কাজ ছিল এ দোয়া করা। এক রাত্রিতে এ ব্যক্তি স্বপ্ন দেখল এক আগন্তুক তাকে ডেকে বলছে, আল্লাহ্ থেকে তুমি কি চাচ্ছ? সে বলল, গুপ্তধন। আগন্তুক বলল, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত,তোমাকে গুপ্তধনের সন্ধান দান করব। আমি তোমাকে যেভাবে নির্দেশনা দান করব ঠিক সেভাবে অমুক পাহাড়ের চূড়ায় তীর ও ধনুক নিয়ে উপস্থিত হও। পাহাড়ের অমুক স্থানে দাঁড়িয়ে তীর ধনুকে সংযোগ করলে যে স্থানে পড়বে সেখানেই গুপ্তধন রয়েছে। সে ঘুম থেকে জেগে ভাবল,বাহ্! স্বপ্নে কত স্পষ্টভাবে তাকে সব জানানো হয়েছে! সে স্বপ্নের নির্দেশনা অনুযায়ী তীর-ধনুক নিয়ে নির্দিষ্ট পাহাড়ে গিয়ে দেখল যে,সব চিহ্ন ঠিক আছে। এখন শুধু নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে তীর নিক্ষেপ করার পালা। তখন হঠাৎ করে তার মনে পড়ল আগন্তুক তাকে কোন্ দিকে তীর নিক্ষেপ করতে হবে তা বলেনি। তাই সিদ্ধান্ত নিল প্রথমে যে কোন একদিকে (ধরি পশ্চিম দিকে) তীর নিক্ষেপ করব। ইনশাল্লাহ্ সেখানেই গুপ্তধন পাওয়া যাবে। এ ভেবে ধনুকে তীর সংযোগ করে সর্বশক্তি দিয়ে নিক্ষেপ করল। তীর যেখানে পড়ল শাবল ও বেলচা দিয়ে সেখানে খুড়তে লাগল। কিন্তু যতইু খুড়ল কোন গুপ্তধন পেল না। মনে মনে ভাবল দিক নির্দিষ্ট করতে ভুল হয়েছে। তাই নির্দিষ্ট স্থানে ফিরে গিয়ে অন্য দিকগুলোতে একে একে অনুরূপভাবে তীর নিক্ষেপ করল। কিন্তু প্রতিবারই বিফল হলো।খুড়ে খুড়ে সমগ্র স্থানটিকে গর্তে পরিণত করেও কোন গুপ্তধন পেতে ব্যর্থ হয়ে অসন্তুষ্ট চিত্তে মসজিদে ফিরে এসে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে খোদা! কিরূপ নির্দেশনা দিলে যে,এত কষ্ট করেও কোন ফল পেলাম না। এভাবে কাকুতি-মিনতি করা শুরু করল। কিছুদিন পর পুনরায় সে স্বপ্নে ঐ আগন্তুককে দেখে বলল, আপনি আমাকে ভুল নির্দেশনা দিয়েছেন। আপনার কথা অনুযায়ী কাজ করে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আগন্তুক বলল, তুমি কি করেছ? সে বলল, আপনার দেখিয়ে দেয়া স্থানে গিয়ে তীর-ধনুক সংযোগ করে প্রথমে পশ্চিম দিকে সর্বশক্তি দিয়ে নিক্ষেপ করেছি। আগন্তুক বলল, আমি তো তোমাকে তা বলিনি। তুমি আমার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করনি। আমি বলেছিলাম তীর ধনুক সংযোগ করলে যেখানে পড়বে সেখানেই গুপ্তধন রয়েছে। বলিনি যে,সর্বশক্তি দিয়ে নিক্ষেপ কর। সে বলল, হ্যাঁ,তাই তো। পরের দিন তীর-ধনুক,শাবল ও বেলচা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। তীর ধনুকে সংযোগ করে ছেড়ে দিলে তা নিজের পায়ের নিকটেই পড়ল। খঁড়ে দেখল ঠিক সে স্থানেই গুপ্তধন রয়েছে। এখানে মাওলানা রুমী বলছেন,

শাহ রগেরও নিকট রয়েছেন মহাসত্য দ্রষ্টা

দূরে ছুঁড়ে চিন্তার তীর তারে পাওয়ার তোমার প্রচেষ্টা

মহাসত্যের অনুসন্ধানী এ তীর ধনুকধারী

গুপ্তধন তোমার কাছেই খুজে দেখ তারি।

এরফান নিজের থেকেই চাও , হৃদয় বিস্ময়ভরা শহর , বিশ্ব পানির পাত্র এবং অন্তর ঝরনা ধারা , বিশ্ব ঘরস্বরূপ এবং হৃদয় শহর প্রভৃতি পরিভাষার প্রতি অতিরিক্ত রকম নির্ভরশীল। অর্থাৎ বহির্বশ্ব এবং প্রকৃতিজগৎ এখানে অত্যন্ত বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে। এরফানী মতবাদে প্রকৃতি কখনো কখনো ক্ষুদ্র একটি গ্রন্থ অপেক্ষাও গুরুত্বহীন বলে পরিচিত হয়েছে। একটি কবিতা যেখানে বিশ্বকে ক্ষুদ্র বিশ্ব এবং হৃদয়কে বৃহৎ বিশ্ব বলা হয়েছে তা আমীরুল মুমিনীন আলী বিন আবি তালিব (আ.)-এর বলে প্রসিদ্ধ। কবিতাটি এরূপ-

উপশম তোমাতেই তা তুমি দেখ না।

আরোগ্যও তোমা হতে তা তুমি বোঝ না।

তুমি সেই স্পষ্ট কিতাব যার অক্ষর করে গোপনকে প্রকাশ।

তোমার দেহকে তাই ক্ষুদ্র ভাবার নেই অবকাশ।

তোমার এ দেহেই রক্ষিত হয়েছে তা

বৃহৎ এ বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে যা।

এখন যদি আমরা এ চিন্তাধারাকে কোরআনের চিন্তাধারার সঙ্গে তুলনা করি তাহলে দেখব যদিও এ চিন্তাধারার অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে তদুপরি এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে একে অপূর্ণ মনে হয়,কারণ কোরআন প্রকৃতির বিষয়ে এতটা উদাসীন নয়,বরং কোরআনের দৃষ্টিতে অন্তর ও বহির্বিশ্ব (প্রকৃতি) পাশাপাশি থাকা উচিত যেমনটি সূরা হা মীম সিজদায় এসেছে-

) سَنُرِ‌يهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ(

অতি নিকট ভবিষ্যতে আমরা আমাদের নিদর্শনসমূহ প্রকৃতিতে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে ব্যক্ত করব যাতে করে তাদের নিকট স্পষ্ট হয় যে তা (খোদা অথবা কোরআন) সত্য।

অবশ্য আমি বিশ্বাস করি যে,মানুষের সর্বোচ্চ মানের পরিচিতি তার অভ্যন্তরে বর্তমান এবং অভ্যন্তর থেকেই তা অর্জন করতে হয়। তবে এর অর্থ এটা নয় যে,বহির্বিশ্ব বা প্রকৃতিতে কিছুই নেই কিংবা বহির্বিশ্বে মহাসত্যের প্রতিফলন ঘটেনি এবং শুধু অন্তঃকরণই আল্লাহ্পাকের প্রতিফলন ক্ষেত্র। বরং অন্তর যেমন স্রষ্টার এক প্রতিফলন ক্ষেত্র তেমনি প্রকৃতিও।

মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক

এখানে এ বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে,প্রকৃতপক্ষে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির কিরূপ সম্পর্ক রয়েছে? মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক কি দু টি অপরিচিত সত্তার সম্পর্কের মতো? অথবা এ সম্পর্ক বন্দি ও জেলখানা বা পাখি ও খাঁচার মতো? বা ইউসুফের সঙ্গে কেনানের গর্তের সম্পর্ক? এটা উদ্ঘাটিত হওয়া আবশ্যক।

হয়তো কেউ বলবেন,বাস্তবে পৃথিবীতে মানুষের আগমন পাখির খাঁচায় বন্দি হওয়া বা কোন মুক্ত ব্যক্তিকে বন্দিশালায় বন্দি করা বা ইউসুফের কূপে বা গর্তে পতিত হওয়ার মতো বিষয়। বাস্তবিকই যদি প্রকৃতি আমাদের জন্য বন্দিশালা,খাঁচা বা কূপ হয় তবে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নির্দ্বিধায় বিপরীতমুখী।

সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা প্রকৃতিতে কিরূপ হওয়া উচিত? খাঁচায় বন্দি এক পাখির নিজেকে খাঁচা থেকে মুক্ত করা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নেই। তেমনি এক বন্দিরও জেলখানার সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই বরং সে চায় জেলখানার দেয়াল ভেঙ্গে নিজেকে মুক্ত করতে। হযরত ইউসুফও কূপে পড়ে এ প্রতীক্ষায়ই ছিলেন যে,কোন কাফেলা এসে পানি উঠানোর নিমিত্তে বালতি ফেলুক আর তিনি বালতিতে আরোহণ করে সেখান থেকে মুক্তি পান (সে ক্ষেত্রে কাফেলা পানির পরিবর্তে ইউসুফকে পাবে)।

এখন প্রশ্ন হলো কোরআন ও ইসলাম মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ককে বন্দি ও জেলখানা,ইউসুফ ও কূপ বা পাখি ও খাঁচার মতো মনে করে কিনা? অবশ্য এরফানে এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সানায়ী বলেছেন, খাঁচা ভেঙ্গে এ ময়ূর উড়ে যাও আকাশে। অন্য একজন আরেফ বলেছেন, ইউসুফ! মিশরের সম্রাট হওয়ার জন্য কূপ থেকে বেরিয়ে আস। বন্দি ও বন্দিশালার তুলনাও এক্ষেত্রে প্রচুর এসেছে।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কৃষকের সঙ্গে ক্ষেতের বা ব্যাবসায়ীর সঙ্গে ব্যবসা ক্ষেত্র অথবা উপাসক ও উপাসনালয়ের মতো। কৃষকের জন্য কৃষিক্ষেত্র লক্ষ্য নয় বরং মাধ্যম। তার জীবনযাত্রার স্থান তার ঘর কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে কাজ করার মাধ্যমেই সে তার এ ঘরের সাফল্য ও আনন্দ হস্তগত করে। একজন কৃষককে অবশ্যই কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে লাঙ্গল চালাতে হবে,বীজ বপন করতে হবে,পানি সেচের মাধ্যমে জমিকে ফসলের উপযোগী করতে হবে,যদি আগাছা জন্মে তা পরিষ্কার করতে হবে। তারপরেই সে শস্য ঘরে তুলতে পারবে।

الدنیا مزرعة الآخرة দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র।(কুনযল হাকায়িক,মানায়ী,দাল অধ্যায়)

তবে কোন কৃষকের কৃষিক্ষেত্র ও ঘর চিনতে ভুল করা উচিত নয়। যদি কেউ তা করে তবে বড় ভুল করবে। তেমনি বাজার ব্যাবসায়ীর জন্য কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ যেখানে সে তার পুজি ও কর্মপ্রচষ্টাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করবে। যে হাদীসটি আমি পড়েছি তা রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর নিকট থেকে অপর একটি হাদীস আছে যা হচ্ছে,الدّنیا متجر اولیاء الله দুনিয়া আল্লাহর ওলীদের ব্যাবসাক্ষেত্র।

একদিন এক ব্যক্তি আলী (আ.)-এর সম্মুখে দুনিয়াকে তিরস্কার করছিল। লোকটি জানত আলী দুনিয়াকে তিরস্কার করেন,কিন্তু কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে তা সে জানত না। হয়তো সে ভেবেছে আলীর দুনিয়াকে তিরস্কার করা প্রকৃতি জগতকে তিরস্কার করার মতো,কিন্তু জানত না যে,আলী দুনিয়া প্রেমে নিমজ্জিত হওয়া যা সত্য ও আল্লাহ্পাকের উপাসনা থেকে মানুষকে বিরত রাখে এবং মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে সেটাকে তিরস্কার করেন (খোদ দুনিয়াকে নয়)। আলী (আ.) ঐ ব্যক্তির দুনিয়াকে তিরস্কার করাকে লক্ষ্য করে বললেন,

أیّها الذامّ للدنیا، المغترّ بغرورها، المخدوع بأباطیلها أتغتّر بالدّنیا ثمّ تذمّها ؟ أنت المتجرّم علیها أم هی المتجرّمة علیک ؟

হে দুনিয়াকে তিরস্কারকারী ব্যক্তি! যে দুনিয়ার প্রতারণায় পড়েছ,দুনিয়া তোমাকে প্রতারিত করেনি; বরং তুমি নিজেই প্রতারিত হয়েছ। সে তোমার উপর জুলুম করেছে নাকি তুমি তার উপর জুলুম করেছ? সুতরাং দুনিয়া মানুষকে প্রতারিত করে না,বরং মানুষ নিজেই প্রতারিত হয়।

এ ক্ষেত্রে আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। কখনো হয়তো এক বৃদ্ধা মহিলা কৃত্রিম সাজ ও প্রসাধনীর মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে প্রতারিত করে। দাঁতহীন মুখে কৃত্রিম দাঁত,চুলবিহীন মাথায় কৃত্রিম লাগিয়ে আসে। আরব কবির ভাষায়-

কোমর বাঁকা বৃদ্ধা হারিয়েছে লাবণ্য

তবুও হতে চায় যুবতী বলে গণ্য।

এখন যদি কোন অভাগা ব্যক্তি এ বৃদ্ধাকে যুবতী মনে করে তার পানি গ্রহণ করে ও বুঝতে পারে যে,সে ভুল করেছে তবে এ ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধা তাকে প্রতারিত করেছে। কিন্তু কোন বৃদ্ধা যদি নিজেই বলে, জনাব,আমার বয়স ঊনষাট বছর ছয় মাস ছয় দিন। নিজের দাঁত ও চুল দেখিয়ে বলে, আমার দাঁত ও চুল নেই। আমার এ দাঁত ও চুল কৃত্রিম। এভাবে সত্যকে বর্ণনা করে বলে, আমাকে গ্রহণ করতে আপনি রাজী আছেন? এমতাবস্থায় যদি সে ব্যক্তি তাকে বলে, তোমার দাঁতহীন ঐ মুখের জন্য আমি উৎসর্গীকৃত। তোমার চুল নেই তাতে কি হয়েছে,তোমার চুলহীন মাথার জন্যই আমি নিবেদিত। সে সত্য বলার পরও এ ব্যক্তি তাকে বলে, বুঝতে পারছি তুমি নিজেকে গোপন করছ। তখন কি বলা যাবে এ বৃদ্ধা তাকে প্রতারিত করেছে? না,বরং সে নিজেই প্রতারিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে নিজেকে প্রতারিত করেছে।

আলী (আ.) বলছেন, দুনিয়া কারো নিকট কোন কিছুই গোপন করেনি। দুনিয়া যখন কোন কিছুই গোপন করেনি কিভাবে তাকে বল : আমাকে প্রতারিত করেছে। যে দিন নিজ হাতে নিজের পিতাকে দাফন করেছ সে দিন কি দুনিয়া বলেনি : আমাকে যেরূপ দেখছ অমি এরূপই পরিবর্তনীয়,আমার স্থায়িত্ব নেই। আমাকে যেরূপ দেখছ সেরূপ অনুধাবন কর। আমি যেরূপ নই সেরূপ আমাকে ভেব না। আমার রূপ সব সময় একই এবং সব সময় আমি তা প্রকাশ করছি,কিন্তু আমি যেরূপ নই তুমি সেরূপ ভাব। তাই দুনিয়া কাউকে প্রতারিত করে না,বরং মানুষ প্রতারিত হয়।أنت المتجرّم علیها أم هی المتجرّمة علیک ؟ (চিন্তা করে দেখ) দুনিয়া তোমার উপর জুলুম করেছে নাকি তুমি দুনিয়ার উপর জুলুম করেছ? দুনিয়া তোমার প্রতি খেয়ানত করেছে নাকি তুমি দুনিয়ার প্রতি খেয়ানত করেছ?متی غرّتک  দুনিয়া কখন তোমাকে প্রতারিত করল?

متی استهوتک কখন দুনিয়া তোমাকে প্রবৃত্তির চাহিদায় মশগুল করল?

أ بمصارع ابائک من البلی ؟ أم بمضاجع أمّهاتک تحت الثری যে সময় তোমাদের পিতারা (পিতৃপরুষ) ভূলুন্ঠিত এবং মাতারা মাটির নীচের বিছানায় শায়িত (এবং তাদের দেহ পঁচে গেছে) সে সময়ও কি দুনিয়া তোমাকে প্রতারিত করেছে? অতঃপর বললেন,الدنیا مسجد احباء لله দুনিয়া আল্লাহর বন্ধুদের জন্য মসজিদ। যদি মসজিদ না থাকে তাহলে বান্দা কোথায় আল্লাহর ইবাদত করবে?ومصلی ملائکة الله و مهبط وحی الله متجر أولیاء الله দুনিয়া ফেরেশতাদের নামায স্থল,আল্লাহর ওহী নাযিলের স্থানএবং আল্লাহর ওলীদের জন্য ব্যাবসাস্থল। যদি বাজার না থাকে ব্যাবসায়ীরা ব্যাবসা করতে ও মুনাফা অর্জন করতে পারে কি?

যে চিন্তা দুনিয়াকে মানুষের জন্য বন্দিশালা,খাঁচা বা কূপ বলে জানে ও ভাবে যে,মানুষের দায়িত্ব হলো এই বন্দিশালা বা খাঁচা ভেঙ্গে মুক্ত হওয়া বা কূপ থেকে বেরিয়ে আসা সে চিন্তা আত্মপরিচিতি ও আত্মাপরিচিতির ক্ষেত্রে অন্য একটি মৌল বিষয়ে বিশ্বাস রাখে যা ইসলামে গ্রহণীয় নয়।