ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41069
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41069 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

পৃথিবীতে আত্মার পূর্ণতা

ইসলাম-পূর্ব যুগে কোন কোন দেশে বিশেষত গ্রীস ও ভারতে একটি বিশেষ বিশ্বাস ছিল। তা হলো মানুষের আত্মা পূর্বে অন্য এক জগতে পূর্ণরূপে সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে একে পাখিকে যেরূপ খাঁচায় বন্দি করা হয় তদ্রূপ এ পৃথিবীতে এনে বন্দি করা হয়েছে। যদি প্রকৃতই এরূপ হয় তবে অবশ্যই মানুষের উচিত এ খাঁচা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা। কিন্তু কোরআনে সূরা মুমিনুনে এ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ আয়াতটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। মোল্লা সাদরা বলেন, আমি আমার দেহের উৎপত্তি ও আত্মার মাধ্যমে বেঁচে থাকা (স্থায়ী হওয়া) তত্ত্বটি এ আয়াত থেকে উদ্ঘাটন করেছি। এ আয়াতটি যখন মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করছে তখন প্রথমে মানুষের মাটি হতে সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে বীর্য,আলাকা (সংযুক্ত পিণ্ড),চর্বিত মাংসখণ্ড,অস্থিপাঁজর,অস্থিপাঁজর মাংস দ্বার আবৃত হওয়ার ধাপগুলো বর্ণনার পর বলছে,ثمّ أنشأناه خلقا آخر আমরা তাকে অন্য এক সৃষ্টিতে পরিবর্তন করে দিলাম। (সূরা মুমিনুন : ১৪) অর্থাৎ মৌল ও যৌগ সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক ও বস্তুগত এ জিনিসগুলোকে অন্য এক সৃষ্টিতে (অর্থাৎ রূহতে যা বস্তুগত নয়) পরিবর্তিত করে দিলাম অর্থাৎ রূহের উৎপত্তি এর প্রকৃতি থেকেই। রূহ বা আত্মা অবস্তুগত কিন্তু এ অবস্তুর উৎপত্তি বস্তু থেকেই। সুতরাং মানুষ অন্য জগতে পূর্ণরূপে কখনই ছিল না যার কারণে বলা যাবে যে,এ প্রথিবীতে তাকে খাঁচাবদ্ধ করা হয়েছে। বরং মানুষ এ পৃথিবীতে তার মায়ের কোলেই অবস্থান করছে। প্রকৃতি মানুষের আত্মার মাতা এবং মানুষ যখন এ প্রকৃতিতে জীবন যাপন করে তখন তার মায়ের কোলেই জীবন অতিবাহিত করছে। তাই তাকে এখানেই পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। সুতরাং মানুষ পূর্বেই পূর্ণতা লাভ করেনি ও পূর্ণতা লাভের পর এ পৃথিবীতে বন্দি বা কূপে পতিত নয় যে,তা থেকে মুক্তি পেতে হবে। এ চিন্তা ইসলামী নয়।

অবশ্য ইসলাম বলে তুমি সব সময় তোমার মাতৃক্রোড়ে থাকবে না। যদি সব সময় মাতৃক্রোড়ে থাকতে চাও তবে দুধের বাচ্চার মতই রয়ে যাবে,যুদ্ধের ময়দানের পুরুষ হতে পারবে না। যদি প্রকৃতি থেকে আরোহণ বা মাতৃক্রোড় থেকে উঠে উপরে না আস ও প্রকৃতিতেই থেকে যাও তবে

 ( ثُمَّ رَ‌دَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ ) ( সূরা ত্বীন : ৫ ও ৬) অতঃপর আমরা তাকে নিকৃষ্টতমদের মধ্যে নিকৃষ্টে পরিণত করি -এ আয়াতের নমুনায় পরিণত হবে।

আর( إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে - এ আয়াতের নমুনায় পরিণত হতে পারবে না। যদি মানুষ হীনগ্রস্তদের মধ্যে হীনে পরিণত হয় অর্থাৎ প্রকৃতিতে বন্দি এ অর্থে যে,এর ঊর্ধ্বে আরোহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ না করে,এ অবস্থা অন্য দুনিয়ায় (আখেরাতে) তার জন্য জাহান্নাম তৈরি করবে। যেমন সূরা আল-কারিয়াতে বলা হয়েছে,فأمه هاویة জাহান্নাম তার জন্য মাতায় পরিণত হবে। আল্লাহ্পাক কোন শিশুকে প্রকৃতিরূপ এ মাতার গর্ভে জন্মদান করেছেন যাতে সে উপরে উঠে আসে,শিক্ষা গ্রহণ করে পূর্ণতা লাভ করে ঊর্ধ্বে আরোহণ করে। এখন যদি এ শিশু চিরকাল এখানে থাকতে চায় তবে তার অবস্থা এক বয়স্ক শিশুর মত (যদিও তুলনা সম্পূর্ণ ঠিক নয়) যার বয়স পঁচিশ বছর হওয়ার পরেও চায় মা তাকে পাশে শুইয়ে মুখে ফিডার দিয়ে ঘুম পাড়াক। এ ধরনের ব্যক্তির বাস্তবে কোন মূল্য নেই।

সুতরাং ইসলামের মানব ও বিশ্ব পরিচিতিতে এমন কোন কল্পিত মোরগের অস্তিত্ব নেই যে পবিত্র জগতে উন্মুক্ত পরিবেশে ঘুরে বেড়াত যাকে এ পৃথিবীতে এনে খাঁচাবদ্ধ করা হয়েছে। আরেফর ভাষায়-পবিত্র জগতের পাখি আমি শোনাব তোমায় বিচ্ছিন্নতার কাহিনী- আর তার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে এ বন্দিত্বের খাঁচা ভেঙ্গে ফেলার। ইসলাম এটা গ্রহণ করে না।

যদি আপনারা কখনো শুনে থাকেন আত্মার জগৎ বস্তু জগতের উপর প্রাধান্য রাখে সেটা এ অর্থে যে,আত্মার প্রকৃতিগত প্রাধান্য রয়েছে যা এ অস্তিত্ব জগতে বিচ্ছুরিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তার এ প্রকাশ ভিন্ন জগৎ থেকে উৎসারিত হয়েছে। কিন্তু এমন নয় যে,তার পূর্ণ রূপ সেখানে ছিল পরবর্তীতে তাকে এখানে এনে খাঁচাবদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের চিন্তা হিন্দু ধর্মের পুনর্জন্ম বা প্লেটোর চিন্তাধারার অনুরূপ। গ্রীকদের মধ্যে প্লেটো বিশ্বাস করতেন,মানবাত্মা এ বিশ্বজগতের পূর্বে অন্য এক সদৃশ জগতে ছিল,কোন এক কল্যাণমূলক উদ্দেশ্যে তাকে এখানে এনে বন্দি করা হয়েছে। তাই তাকে এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু ইসলাম প্রকৃতি জগতকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না।

এরফান ও সুফীতত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে অবগতদের জন্য বলছি আমার এ কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে,সকল আরেফই এ ভুলের মধ্যে ছিলেন বরং প্রসিদ্ধ আরেফগণের মধ্যে অনেকেই অন্ততঃপক্ষে নিজেদের লেখনীতে এ বিষয়ে লক্ষ্য রেখেছেন। তারা সমাজ বা প্রকৃতি কোনটিকেই ত্যাগ করেননি। কোরআন যে অন্তঃবিশ্ব ও বহিঃবিশ্ব দু টিকেই পাশাপাশি এনেছে এবং দু টিকেই স্রষ্টার নিদর্শন ও সৌন্দর্যের প্রতিফলন বলে মনে করে- এ বিষয়ে তাদের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তাদের অন্যতম মরহুম শাবেস্তারী যিনি মহান আরেফ তিনি তার সুন্দর কবিতার মাধ্যমে মানব জগতের এ দিকটি তুলে ধরেছেন। যেমন বলেছেন,

কর সেই মহান স্রষ্টার গুণকীর্তণ

যিনি দিয়েছেন দীক্ষা তোমায় চিন্তার

আর আপন নূরে করেছেন তোমার হৃদয়ে প্রদীপ সঞ্চার

তব অনুগহে তার দু জাহান হয়েছে সমুজ্জ্বল

মাটির মানুষ হয়েছে সেথায় পুষ্পভূবন।

অন্য এক স্থানে প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রেখে বলছেন,

যার হৃদয় হয়েছে উজ্জ্বল নূরে খোদার

বিশ্ব জগতেরে দেখে যেন গ্রন্থ তার

বর্ণমালা মূল তার,শাখা কারক চিহ্ন*

নির্দেশনা এ গ্রন্থের পর্যায় বিরাম চিহ্ন।

(*আরবীতে জবর,যের,পেশ ইত্যাদিকেإعرااب বা কারক চিহ্ন বলা হয়)

আমার এ বিষয়গুলো উপস্থাপনের কারণ হলো আরেফগণ যে কখনো কখনো প্রকৃতির বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছেন তার নমুনা তুলে ধরা। এরূপ জামীর কবিতায় এসেছে-

তরীকতের পীরের দাওয়াত শরাবের আসরে

সাকী এসো দ্রুত,লোকসান যে তা খিরে (দেরীতে)

বিশ্ব আয়নাস্বরূপ যেথা সৌন্দর্যের প্রকাশ খোদার

দেখ এ প্রতিটি আয়নাতে রূপ যে তার।

যদি আমরা কোরআনকে একদিকে এবং এরফানকে অন্যদিকে রাখি তাহলে দেখব কোরআন প্রকৃতির বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে! আমরা বুঝতে পারব কোরআন প্রকৃতিকে এরফান অপেক্ষা অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে,অথচ মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার প্রতি বিশেষ লক্ষ্যদান থেকেও দূরে সরে আসেনি। সুতরাং কোরআনের পূর্ণ মানব বুদ্ধিবৃত্তি ও আন্তরিক প্রবণতার সাথে সমাজ ও প্রকৃতি প্রবণতার দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে। তবে এদের প্রতিটির গুরুত্ব কতটুকু তা সম্ভব হলে যখন ইসলামের পূর্ণ মানবের রূপ বর্ণনা করব সে আলোচনায় উপস্থাপন করব ইনশাল্লাহ্। এখানে শুধু এটুকই বলছি যে,কোরআনের পূর্ণ মানব আকল,হৃদয়,প্রকৃতি ও সমাজকেন্দ্রিক।

আত্মবিসর্জন

গত বৈঠকের শেষে যে বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম এ বৈঠকের শেষেও তা নিয়ে কিছু আলোচনা করব। কারণ এ আলোচনার কিছু ভূমিকা রয়েছে যা উপস্থাপন না করলে আমাদের আলোচনা অর্থহীন হয়ে পড়বে। শুধু যে বিষয়ে ইশারা করছি তা হলো আত্মবিসর্জন

এরফান হৃদয়কে সম্মান দান করে। হৃদয়ের পাশাপাশি নাফ্স বলে একটি বিষয় কোরআনে উপস্থাপিত হয়েছে যাকে এরফান হীন মনে করে। এরফানের দাওয়াতের একটি অংশ আত্মবিসর্জন , আত্মদূরী , নিজেকে বড় না দেখা , স্বার্থপরতা ত্যাগ ইত্যাদি নিয়ে। এ বিষয়গুলো সত্তাগতভাবে ঠিক এবং ইসলাম একে সমর্থন করে। আমরা আমাদের পরবর্তী বৈঠকে আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতায় এ বিষয়ে ইসলাম ও এরফানের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করব।

আমরা ইসলামে দু টি সত্তা ও দু টি নাফসের উল্লেখ দেখি। ইসলাম ব্যক্তির একটি সত্তাকে ক্ষুদ্রভাবে দেখে ও একে প্রত্যাখ্যান করে,আবার অন্য একটি সত্তাকে জীবিত ও প্রাণবন্ত করার জন্য চেষ্টা চালায়। বিষয়টি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। এ বিষয়টি এরূপ যে,এক বন্ধু ও এক শত্রু পাশাপাশি এক সীমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং বন্ধুটি বিপদগ্রস্ত। যদি বন্ধুকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ি তবে আমাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। অথবা এর উদাহরণ এক শিশুর মতো যে গাছে উঠেছে ফল পাড়ার জন্য। ঘটনাক্রমে এক বিষাক্ত সাপ তার মাথার নিকট আবির্ভূত হয়েছে। এখানে একজন অতি দক্ষ শিকারীর প্রয়োজন যে সাপকে লক্ষ্য করে তীর ছুড়বে,কিন্তু তাতে শিশুটির যাতে কোন ক্ষতি না হয়। যদি শিকারী বিন্দুমাত্র ভুল করে তাহলে তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে- সাপের গায়ে না লেগে হয়তো বাচ্চার গায়ে লাগবে। তাতে সাপের মৃত্যু না ঘটে শিশুটির মৃত্যু ঘটবে। সুতরাং শিকারীকে এতটা নির্ভুল হতে হবে যাতে শিশুর বিন্দুমাত্র ক্ষতি না হয়,অথচ সাপটির মৃত্যু ঘটে। এখানেও তা-ই যেন বন্ধু ও শত্রু পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত,তোমাকে এমনভাবে তরবারী চালনা বা তীর নিক্ষেপ করতে হবে যেন শত্রুর মৃত্যু হয়,কিন্তু বন্ধুর ক্ষতি না হয়।

ইসলামের মোজেযা এখানেই যে,এ দ্বৈত সত্তাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছে,এ ক্ষেত্রে কোন ভুলই করেনি। আরেফগণের মধ্যে কখনো কখনো লক্ষ্য করলে দেখা যায়,ভুলক্রমে অভ্যন্তরীণ শত্রুসত্তার স্থলে বন্ধুসত্তাকে আক্রমণ করে বসেছেন। অর্থাৎ কখনো তারা নাফ্স বা প্রবৃত্তিকে হত্যা না করে যাকে তারা হৃদয় বা মনুষ্যত্ব বলেন তাকে হত্যা করে বসেছেন। এ সূক্ষ্ম বিষয়টি ইনশাল্লাহ পরবর্তী বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করব।

এরফানী মতবাদের পর্যালোচনা

) فَأَمَّا مَن طَغَىٰ وَآثَرَ‌ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَىٰ وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَ‌بِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ  فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ(

(সূরা নাযিয়াত : ৩৭-৪১)

পূর্ণ মানুষের বিষয়ে এরফানে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে,আর তা হলো মানুষের তার আপন সত্তার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। অবশ্য এ বিষয়টি ইসলামীও বটে। তাসাউফ ও এরফানের ভাষায় যেমন স্বার্থপরতা,আত্মকেন্দ্রিকতা,প্রবৃত্তির অনুসরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয় রয়েছে তেমনি ইসলামেও; অবশ্য ইসলামী এরফান এ বিষয়গুলো ইসলাম থেকেই নিয়েছে এবং পরিভাষাগুলোও ইসলামী। কিন্তু এ পরিভাষাগুলোর কোন কোনটি সঠিক নয়। আজকের আলোচনায় আমরা এ বিষয়টিব্যাখ্যা করব।

আত্মশুদ্ধির বিষয়ে নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয় রয়েছে- আরবী নাফ্স শব্দের বাংলা অর্থ হবে আত্ম বা নিজ। তাই যখন বলা হবে নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তখন নাফ্স মানুষের অভ্যন্তরীণ শত্রু বলে পরিগণ্য। যেমন সা দী বলছেন,

করছ শত্রু প্রবৃত্তির সঙ্গে একত্রে বাস

বৃথা কেন বহিঃশত্রুতে শক্তি নাশ।

নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিভাষাটি মহানবী (সা.)-এর পবিত্র বাণী থেকে নেয়া। তিনি বলছেন,أعدی عدوّک نفسک نفسک التی بین جنبیک (মেহজাতুল বাইদা,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬)

তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু তোমার নাফ্স বা প্রবৃত্তি যা তোমার দু বক্ষ ও পৃষ্ঠের মধ্যে রয়েছে। সা দী গুলিস্তান গ্রন্থে বলেছেন, একজন আরেফকেأعدی عدوّک نفسک نفسک التی بین جنبیک এ হাদীসটির অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন : তোমার সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক শত্রু হলো তোমার নাফ্স। কারণ তুমি তোমার যে কোন শত্রুর প্রতি সদাচরণ কর এবং সে যা চায় তুমি তাকে তা দান কর,সে তোমার মিত্রতে পরিণত হবে। কিন্তু নাফ্স বা প্রবৃত্তি এমন যে,সে যা চায় তা তাকে যত দিবে সে তত বেশি তোমার শত্রুতে পরিণত হবে। সেজন্য নাফ্সকে একজন শত্রু হিসেবে দেখা হয়েছে। এখানে নাফ্স বলতে আত্ম ও প্রবৃত্তি পূজার কথা বলা হয়েছে।

এখন বিষয়টিকে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখব,যে আত্মপূজা,স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তির তাড়নাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হয় তা প্রকৃতপক্ষে কি?

স্বার্থপরতার প্রথম পর্যায়

স্বার্থপরতার একটি পর্যায় হচ্ছে মানুষ তখন আত্মকেন্দ্রিক হয় এ অর্থে যে,শুধু নিজের জন্যই কাজ করে,তার সকল কর্মকাণ্ড নিজেকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার প্রচেষ্টা নিজের জীবনকে নিয়ে। যেমন কিভাবে উদর পূর্তি হবে,কিভাবে দেহের জন্য পোশাকের,মাথা গোঁজার জন্য ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা হবে এরূপ। এ পর্যায় পর্যন্ত চেষ্টা চালানো কি মন্দ? এটা কি নৈতিকতার দৃষ্টিতে মন্দ বা নৈতিকতার পরিপন্থী যে,মানুষ এ পর্যায়ের জন্য চেষ্টা চালাবে? জবাবে আমরা বলব,অবশ্যই এরূপ চেষ্টা নৈতিক নয় বা এ চেষ্টা মানবিক মূল্যবোধ বলে গণ্য হতে পারে না। কিন্তু আবার এটাও বলা যায় না যে,এ ধরনের প্রচেষ্টা নৈতিকতার পরিপন্থী বা এক নৈতিক অসুস্থতা।

এখানে নৈতিকতা ও নৈতিকতার বিরোধিতা নিয়ে কিছু কথা বলব। কোরআন মানুষের জন্য পশুর থেকে উত্তম এক মর্যাদায় বিশ্বাসী,সে সাথে মানুষের পশুর সম পর্যায়ের এবং পশুর থেকে নিম্ন পর্যায়ের অবস্থাও রয়েছে বলে মনে করে। অর্থাৎ মানুষ কখনো কখনো পশুত্বের পর্যায়ে,কখনো মূল্যবোধের মাধ্যমে পশুর থেকে উত্তম,কখনো বা ফেরেশতাদের থেকেও উত্তম অবস্থায় পৌছে। আবার কখনো মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মাধ্যমে শূন্যের নীচে নেমে আসে অর্থাৎ পশু থেকেও নিকৃষ্টে পরিণত হয়।

মানুষের কর্ম তিন ধরনের :

১. নৈতিক কর্ম অর্থাৎ পশু হতে উন্নত পর্যায়ের কর্ম।

২. নৈতিকতা বিরোধী কর্ম অর্থাৎ পশু হতে নিকৃষ্ট পর্যায়ের কর্ম।

৩. অনৈতিক কর্ম অর্থাৎ নৈতিক নয় কিন্তু আবার নৈতিকতা বিরোধীও নয় যা এক সাধারণ প্রাণীর কর্ম।

পৃথিবীতে আপনি এ ধরনের ব্যক্তিবর্গকে প্রচুর পরিমাণে পাবেন যাদের স্বভাব কবুতর বা ছাগলের মতো অর্থাৎ শুধু নিজের চিন্তায় আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এ চেষ্টায় মগ্ন হয় কিভাবে নিজের উদরপূর্ণ হবে- রাত অবধি কাজ করে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। এ ধরনের ব্যক্তির কর্ম নৈতিক নয়,কিন্তু তাকে নৈতিকতা বিরোধীও বলা যায় না।

স্বার্থপরতার দ্বিতীয় পর্যায়

আবার কখনো মানুষ নিজের বিষয়ে শুধু এ পর্যায়ে নেই যে,নিজের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান পেলেই ক্ষান্ত হয়,বরং তার মনুষ্য সত্তা এ ক্ষেত্রে তার পশু সত্তার খেদমতে নিয়োজিত হয় এবং এক ধরনের মানসিক রোগে পরিণত হয়। তখন সে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী শুধু নয়,বরং আরো অধিক সঞ্চয় অর্থাৎ আধিক্যের নেশায় মত্ত হয়ে সর্বাকাঙ্ক্ষীতে পরিণত হয়।

কবুতর পরিতৃপ্ত হওয়ার জন্য শস্যদানা জমা করে,এটি তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। একটি অশ্ব তৃণভূমিতে বিচরণ করে এ উদ্দেশ্যে যে,তার উদর পূর্তি হবে,এটাও প্রকৃতিগত। এখন কোন মানুষ যদি এ পর্যায়ে থাকে সে এ রকম একটি প্রাণীর পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু মানুষ কখনো কখনো লোভ ও লালসার হাতে বন্দি হয়ে পড়ে,তখন শুধু নিজের জীবনের জন্য সে কাজ করে না,বরং শুধু সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যেই কাজ করে। যত সঞ্চয় করতে থাকে তত অধিক পেতে চায়,এমনকি তা চাওয়ার আর সীমা থাকে না। এ অবস্থাকে আধিক্যের লালসা বলা হয়। এরূপ ব্যক্তি যেখানে দান করা উচিত সেখানে কৃপণতা করে। এটা একটি রোগ। রাসূল (সা.)-এর ভাষায়-شحّ مطاع সম্পদের কৃপণ। (সূরা হাশরের ৯ম আয়াতে এসেছে,شحّ مطاع এ ধরনের ব্যক্তির নিয়ন্ত্রক তার ইচ্ছা,চিন্তাশক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তি নয়,বরং এ মানসিক অবস্থাই (আধিক্যের লালসা) তার নিয়ন্ত্রক। অর্থ-সম্পদ তার হৃদয়ের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। তখন যুক্তি,চিন্তা সব কিছুই অর্থহীন। যদি যুক্তি,চিন্তা তার উপর ক্রিয়াশীল হতো,তবে সে বুঝত যে,কল্যাণ,মঙ্গল ও সাফল্যের জন্য কোন্ কোন্ স্থানে খরচ করা উচিত। কিন্তু আধিক্যের আকাঙ্ক্ষা তাকে এরূপ কর্মে উৎসাহ যোগায় না। লোভ ও আধিক্যের লালসা নৈতিকতা ও চরিত্র বিরোধী যা নৈতিকতার অবক্ষয় ও অসুস্থতার শামিল।

স্বার্থপরতার তৃতীয় পর্যায়

মানুষের মধ্যে তৃতীয় একটি পর্যায়ও রয়েছে। মানুষের আত্মিক রোগ শুধু লোভ ও আধিক্যের লালসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় যা মানুষকে কৃপণ করে তোলে। বরং কখনো কখনো মানুষ এর থেকে জটিল আত্মিক রোগে আক্রান্ত হয় যা শারীরিক রোগ হতে জটিলতর। এ রোগ বুদ্ধি ও যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং শুধু রোগীর আত্মিক অবস্থার সঙ্গেই সংগতিপূর্ণ। বর্তমান সময়ে এরূপ অসুস্থতাকে মানসিক জটিলতা বলা হয়। যেমন হিংসা এরূপ একটি রোগ। হিংসা মানুষের মধ্যে যুক্তির বিরোধিতার প্রবণতা সৃষ্টি করে অর্থাৎ মানুষের মধ্যে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় যে,মানুষ নিজের সাফল্যের চিন্তাকেও ভুলে যায় এবং কেবল অন্যের অকল্যাণের চিন্তায় মগ্ন থাকে। তার আকাঙ্ক্ষা নিজের সৌভাগ্য নয়। যদিও নিজের সৌভাগ্যের চিন্তা করে,তবে তার দ্বিগুণ অন্যের অকল্যাণের চিন্তা করে। এটা কোন যুক্তিতেই বোধগম্য নয়। কোন প্রাণীর মধ্যেই এ বৈশিষ্ট্য নেই যে,অন্য প্রাণীর দুর্ভাগ্যের আকাঙ্ক্ষা করে। অন্য প্রাণী নিজের পেটের চিন্তায়ই ক্ষান্ত হয়,কিন্তু মানুষের মধ্যে এ অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।

কখনো কখনো মানুষের মধ্যে অহংকারের জন্ম হয় বা তার আত্মার গভীরে এমন অনেক মানসিক জটিলতার সৃষ্টি হয় যা সে নিজেই জানে না। মানুষের প্রবৃত্তি তার মধ্যে এ সমস্যাগুলো সৃষ্টি করে।