ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 11%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42389 / ডাউনলোড: 7058
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

আত্মপ্রবঞ্চনা

কখনো কখনো মানুষ নিজেই নিজেকে প্রতারণা করে। এটা কোন হিসেবেই বোঝা সম্ভব নয় কিরূপ মানুষ নিজের অভ্যন্তর হতে প্রতারিত হয়। কোরআন বলছে,بل سولت لکم أنفسکم বরং তোমরা নিজেরাই নিজেকে প্রবঞ্চিত কর। আত্মপ্রবঞ্চনা মনোবিজ্ঞান সম্মত একটি যথার্থ পরিভাষা যা কোরআনে এসেছে।

আত্মপ্রবঞ্চনা অর্থ মানুষ কখনো কখনো নিজের অভ্যন্তর হতে প্রতারিত হয়। এ ধরনের ব্যক্তির মন যদি কোন কিছু চায় তাহলে ঐ বস্তুকে তার অন্তর এমন আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তার নিকট প্রদর্শন করে যে,ঐ বস্তুর বিষয়ে অলীক চিন্তা ও কল্পনা শুরু করে যাকে অতিরঞ্জন বলা যেতে পারে। এ কাজটি মানুষের মনোজগত নিজের থেকেই করে তাকে প্রতারিত করার জন্য। আত্মপ্রবঞ্চনা বাস্তবিকই আশ্চর্যের বিষয়। বর্তমানে মনোবিজ্ঞান উন্নয়নের শিখরে আরোহণ করে যথার্থ ও গভীরভাবে এ বিষয়টি উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়েছে। মনোবিজ্ঞানিগণ এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে,কখনো কখনো দৈহিক বা স্নায়বিক বৈকল্য ব্যতীতই মানুষ পাগলামী করে যার কারণ তার অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থা। উদাহরণ স্বরূপ যখন দুঃখ সহ্য করা তার জন্য খুব কঠিন ও অসাধ্য হয়ে পড়ে তখন সে এ কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।

কবির ভাষায়-

হে সতর্কজন! জগতে যারেই দেখি কষ্ট সঙ্গী তার

হে মন! হও পাগল,কষ্ট তোমার সঙ্গী হবে না আর।

এটা একটা মনোবিজ্ঞানগত মৌলতত্ত্ব।

আত্মপ্রবঞ্চনার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এরফানে এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। স্বার্থপরতার তৃতীয় পর্যায় এবং আত্মপ্রবঞ্চনা-বিষয় দু টি মানুষকে নৈতিকতা বিরোধী করে তোলে,এটা একটা রোগ যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকেও নীচে নামিয়ে দেয়-এরফানে এ বিষয়গুলো সর্বোত্তমরূপে বর্ণিত হয়েছে এবং এমন অনেক বিষয় সেখানে উল্লিখিত হয়েছে যা মানুষকে আশ্চর্যান্বিত করে। আমাদের আশ্চর্য হতে হয় যে,ছয়-সাতশ বা হাজার বছর পূর্বে কিরূপে মনোবিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা কথা বলেছেন যা বিংশ শতাব্দীর মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন।

যা হোক আত্মপ্রবঞ্চনার এ বিষয়টি আরেফগণ কোরআন থেকেই গ্রহণ করেছেন। যেহেতু আরেফগণ যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন তাই খুব ভালোভাবেই কোরাআন থেকে এ বিষয়টি হস্তগত করতে পেরেছেন। আমরা নীচের শিরোনামে মাওলানা রুমী থেকে আত্মপ্রবঞ্চনার বিষয়ে কিছু আলোচনা করব।

গোপন মানসিক জটিলতা

বর্তমানে এ বিষয়টি সর্বসম্মত যে,কখনো কখনো মানুষের মনের গহীনে মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ তলানীর মত জমে থাকে (ঠিক চৌবাচ্চার নীচে জমে থাকা কাদার মত) যা বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়,এমনকি ঐ ব্যক্তি নিজেও এ সম্পর্কে সচেতন নয়। কোন বিশেষ এক অবস্থায় যখন তাতে নাড়া পড়ে,সে লক্ষ্য করে হঠাৎ করে তার অভ্যন্তর থেকে এ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করেছে,তখন সে নিজেই আশ্চর্যান্বিত হয়। মাঝে মাঝে সে বিশ্বাস করতে পারে না যে,তার মধ্যে এরূপ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। কখনো কখনো মানুষ নিজের প্রতি আস্থাবান হয় এ ভেবে যে,নিজের অন্তরে কোন কলুষতা নেই,কোন হিংসা-দ্বেষ নেই। কিন্তু কোন এক পরিস্থিতিতে (কোরআনের ভাষায় পরীক্ষার মুহর্তে) পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে দেখে তার আত্ম অহংকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে,হিংসা-দ্বেষ,পরশ্রীকাতরতার বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পাচ্ছে,অথচ এর কারণ অনুদ্ঘাটিত। মাওলানা রুমী বলেন,

প্রবৃত্তি তোমার সুপ্ত অজগর কখন ঘুমিয়েছে

উপায়হীন বলেই সে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

মানুষের প্রবৃত্তি বিষাক্ত সাপের মতো। বিষাক্ত সাপসমূহ শীতের সময় সুপ্তাবস্থায় নিশ্চল জীবন কাটায়। যদি কোন মানুষ তাকে স্পর্শ করে তবুও সে নড়াচড়া করে না। এমনকি কোন শিশু তাকে নিয়ে খেললেও তাকে কামড়ায় না। হয়তো কেউ ভাবতে পারে,এই সাপ খুব শান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যখন গ্রীষ্মকালের সূর্যালোক এর উপর পতিত হয় যেন হঠাৎ করেই এ সাপের মধ্যে এক পরিবর্তন লক্ষ্য করা য়ায়। এক শিকারী যে পাহাড় থেকে শীতকালে একটি সাপ ধরে এনেছিল তার গল্প বলতে গিয়ে মোল্লা রুমী উপরিউক্ত এ কবিতার চরণটি এনেছেন যে,

প্রবৃত্তি তোমার সুপ্ত অজগর কখন ঘুমিয়েছে

উপায়হীন বলেই সে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।

অর্থাৎ তুমি এটা ভেবো না,তোমার প্রবৃত্তি মৃত্যুবরণ করেছে বরং সে শত জরাগ্রস্ত অজগরের মতো,যদি গ্রীষ্মের উত্তাপ পায় তখন সে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে।

মাওলানা অন্য একটি স্থানে মানুষের নাফ্সকে (প্রবৃত্তির সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে) এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যা মনোবিজ্ঞানীদেরও আশ্চর্যান্বিত করে। তিনি বলেছেন,

প্রবৃত্তির বাসনা যেন জীবন্ত কুকর

লুক্কায়িত আছে স্বাভ্যন্তরে তার সুরাসুর

নেই শক্তি তাই ক্রিয়াহীন শান্ততম

অগ্নি হতে দূরে পড়ে আছে যেন জ্বালানী কাষ্ঠসম।

কখনো দেখেছেন,একদল কুকুর কোন স্থানে ঘুমিয়ে রয়েছে দু পায়ে মাথা রেখে,চোখ দু টি বন্ধ করে বিশ্রাম করছে,দেখে কেউ ভাববে একদল শান্ত ছাগলছানা বা মেষ যেন।

যদি কভু মিলে শবদেহের সন্ধান

সহসা ঘটবে প্রকাশ লালসা অনির্বাণ।

পথে এক গাধার মৃতদেহ পতিত হলো যখন

শত ঘুমন্ত কুকুর জাগ্রত হলো তখন।

কিন্তু যদি এদের সামনে (যে কুকরগুলো ঘুমিয়ে রয়েছে একদল মেষের মতো পায়ের উপর হাত রেখে) একটি মৃতদেহ রাখা হয় তাহলে দেখা যাবে হঠাৎ করে এদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে,চোখগুলো সজাগ হয়ে গেছে,গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করছে,ক্রমে হিংস্র হয়ে উঠছে যেন তাদের প্রতিটি লোম একেকটি ধারালো দাঁতে পরিণত হয়েছে।

সুপ্ত লালসা জেগে উঠেছে সহসা

পেয়েছে তাদের শবদেহের নেশা

প্রতিটি লোম যেন দাঁতে পরিণত হয়েছে

প্রতারণার ফন্দিীত তাই লেজ নাড়ছে।

এ পর্যন্ত উপমাস্বরূপ বলেছেন তারপর প্রকৃত উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলছেন,

শত কুকুর ঘুমিয়ে রয়েছে এ দেহে যে

শিকারই নেই তাই রয়েছে শান্তরূপে সে।

অত্যন্ত সূক্ষ্ম,বাস্তব ও যথার্থ এ উপমা।

কোরআন ও হাদীসে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম

এ পর্যন্ত এরফান যা বলেছে তা যথার্থ এবং পুরোপুরি ঠিক। কোরআন-হাদীসও এ বিষয়টিকে সমর্থন করে,যা আলোচনা করতে গেলে দীর্ঘ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলব,এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,মানুষ তার পশুত্বের প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবে এবং এ পর্যায়ে অন্যের মঙ্গল-অমঙ্গলের চিন্তা না করাটা তার জন্য স্বাভাবিক,যেহেতু তার মধ্যে লোভ নামক এক ব্যাধি রয়েছে যা আত্মিক ও মানসিক বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করে। এ সবই সত্য,তবে এ বিষয়ে আমাদের করণীয় কি? করণীয় এটাই যে,যখন প্রবৃত্তির মধ্যে লোভ জাগরিত হবে এবং প্রবৃত্তির বাসনা ঘুমন্ত কুকুরের মতো আত্মগোপন করে বা সুপ্তাবস্থায় থাকবে তখন তাকে বিনাশ করতে হবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে। অর্থাৎ যে প্রবৃত্তি নিকৃষ্ট কর্মের দিকে আহবান জানায়-কোরআনের ভাষায় নাফ্সে আম্মারা বিস্ সু -তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত হতে হবে। যে পর্যায়ে প্রবৃত্তি ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য এক টুকরা রুটি চায় তার এ চাওয়া নিকৃষ্ট কর্ম নয়,বরং তা প্রবৃত্তির সহজাত চাহিদা যা মঙ্গল করে। কিন্তু তার এ চাওয়া যখন লোভ,কৃপণতা,হিংসা,ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আকার লাভ করে তখন এ প্রবৃত্তিকে নিকৃষ্ট কর্মের প্রতি আহবানকারী বলা হবে। কোরআন এরূপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বলেছে-

) فَأَمَّا مَن طَغَىٰ وَآثَرَ‌ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَىٰ وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَ‌بِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ(

সুতরাং যে ব্যক্তি বিদ্রোহ করে এবং এ দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয় পরিণামে নিশ্চয় জাহান্নামই হবে তার আবাসস্থল। কিন্তু যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের মর্যাদাকে ভয় করে এবং স্বীয় আত্মাকে নীচ কামনা-বাসনা হতে বিরত রাখে নিশ্চয় জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল। (সূরা নাযিয়াত : ৩৭-৪১)

সুতরাং কোরআন কুপ্রবৃত্তিকে মোকাবিলা করার এবং আত্মাকে নীচ কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার আহবান জানায়। অন্য একস্থানে কোরআন বলছে,أَفَرَ‌أَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَـٰهَهُ هَوَاهُ   ঐ ব্যক্তিকে দেখেছ কি যে নিজের হীন প্রবৃত্তিকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে? অথবা হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ভাষায় কোরআন বলছে,وَمَا أُبَرِّ‌ئُ نَفْسِي إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَ‌ةٌ بِالسُّوءِ আমি আমার নাফ্সকে ত্রুটিমুক্ত মনে করি না। হযরত ইউসুফ যিনি নিজের উপর আস্থাবান হওয়া সত্ত্বেও বলছেন,

إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَ‌ةٌ بِالسُّوءِ নিশ্চয় প্রবৃত্তি মন্দ কাজের নির্দেশ প্রদানে অত্যন্ত তৎপর। এটা বলার অর্থ মানব প্রবৃত্তি বা সত্তা এত জটিল যে,সম্ভাবনা রয়েছে এর কোন এক স্থানে হয়তো কোন হীন বাসনা লুক্কায়িত রয়েছে যা সে নিজেই জানে না। তাই নিজের নাফসের উপর তিনি নির্ভর করেন না। প্রতিটি মুমিনই নাফসের মন্দ কাজের প্রতি ঝোঁকের কারণে তার প্রতি বিশ্বাস করেন না। সুতরাং ইসলাম প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শুধু সমর্থনই করে না,বরং বাস্তবে নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিভাষাটিই ইসলামের। একদা একদল সাহাবী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তন করে সমবেতভাবে রাসূল (সা.)-এর সাথে দেখা করতে আসলে তিনি এ বিষয়টি উপস্থাপন করেন। দেখুন রাসূল কতটা সুযোগসন্ধানী (হেদায়েতের জন্য)! তিনি জানেন কোন্ মুহর্তে কোন্ কথাটি বলতে হবে। একদল লোক যুদ্ধ হতে বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছে। রাসূল তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন সে সাথে সর্বোত্তম নৈতিক শিক্ষাটিও তাদের দিচ্ছেন-

مرحبا بقوم فضوا الجهاد الأصغر و بقی علیهم الجهاد الأکبر সাবাস হে ক্ষুদ্র দল যারা যুদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছ,তোমাদের সামনে বড় যুদ্ধ রয়ে গেছে। তারা প্রশ্ন করলেন, হে রাসূলাল্লাহ্! বড় যুদ্ধ কি? রাসূল বললেন, নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ। নাফ্সে আম্মারা বা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ অন্য মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতে কঠিন। সুতরাং নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ইসলামই বলেছে। তাই এ ক্ষেত্রে এরফানের বক্তব্য সঠিক।

তবে এরফানী বা সুফী মতবাদ নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ,স্বার্থপরতা ও প্রবৃত্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নামে ব্যক্তিসত্তার উপর এতটা আঘাত হেনেছে যে,ইসলাম তাকে সমর্থন করে না। তবে আমি বলছিনা যে,বড় আরেফগণও এ ভুলটি করেছেন,বরং আমার উদ্দেশ্য এটা বলা যে,এ মতবাদের প্রচুর ব্যক্তির মধ্যে এ ভুলটি লক্ষ্য করা যায়।

কঠিন সাধনার বিষয়টি যখন এতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌছায়- ইসলাম বলে তোমার দেহ তোমার উপর অধিকার রাখে- রাসূলের কোন কোন সাহাবী এরূপ কঠিন সাধনায় লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন,রাসূল তাদেরকে এ থেকে বিরত রাখতে কঠিন ভূমিকা নেন। তদুপরি,কখনো কখনো দেখা যায় কেউ কেউ এরূপ সাধনায় লিপ্ত হন যা ইসলাম সমর্থন করে না। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়।

প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম দু ধরনের। কখনো যোগ সাধনার মাধ্যমে অর্থাৎ দেহকে প্রচণ্ড কষ্ট দানের মাধ্যমে। খুব কম খাদ্য গ্রহণ করে ও অত্যন্ত কম ঘুমিয়ে দেহকে এমনভাবে প্রস্তত করা যাতে তাকে দিয়ে সব কিছু সহ্য করানো যায়। এরূপ যোগ সাধনার মাধ্যমে এমন অবস্থা করা সম্ভব যে,মানুষ দিনে মাত্র কয়েকটি বাদাম খেয়ে,২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৫ মিনিট ঘুমিয়ে অভ্যস্ত হতে পারে। দেহের উপর এরূপ যোগ সাধনা ভারতবর্ষের যোগীদের মধ্যে প্রচলিত। মুসলমানদের মধ্যে এটা কম দেখা যায়। কারণ ইসলাম এরূপ সাধনার প্রচলনকে অনুমতি দেয় না।

প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্য পথটি দেহের উপর কষ্ট প্রয়োগের মাধ্যমে নয়,বরং কুপ্রবৃত্তি ও বক্র মানসিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্থাৎ প্রবৃত্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করা। তবে এটাও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত। এ পদ্ধতিতেও কখনো কখনো এমন অনেক বিষয় লক্ষ্য করা যায় যা- ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের পূর্ণ মানব এরূপ নয়। এখানে এরূপ কিছু বিষয় আপনাদের জ্ঞাতার্থে উপস্থাপন করব।

নিজেকে মন্দরূপে প্রচারের পদ্ধতি

সুফীপন্থীদের অনেকের মধ্যে একটি রীতি প্রচলিত রয়েছে যা সবার মধ্যে কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে তা হলো বাহ্যিকভাবে নিজেকে মন্দ দেখানো বা মালামাতি পদ্ধতি । মালামাতি পদ্ধতি কি? মালামাতি পদ্ধতি ঠিক রিয়া বা লোক দেখানো ভালো কর্মের বিপরীত বিষয়। রিয়াকারী ব্যক্তির অন্তর কলুষিত,কিন্তু বাহ্যিকভাবে লোক দেখানোর জন্য সে ভাল কাজ করে। মালামাতকারী ব্যক্তি ভালোমানুষ,কিন্তু মানুষ যেন তাকে ভালো মনে না করে সেজন্য বাহ্যিকভাবে খারাপ কাজ করার ভান করে। যেমন হয়তো সে মদ্য পান করে না,কিন্তু মদ্যপায়ীর মতো ভাব দেখায় কিংবা জেনা করে না কিন্তু বাহ্যিকভাবে এমন স্থান দিয়ে চলাফেরা করে যাতে সবাই তাকে তা মনে করে। কিন্তু কেন সে এরূপ করে? জবাবে বলে,আমার নাফ্সকে ধ্বংস ও দমন করার জন্য আমি এরূপ করি। বাস্তবিক অর্থে অবশ্যই তার এ কাজ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রামের প্রতীক যেহেতু মানুষ চায় সাধারণের মধ্যে তার সম্মান থাকুক,মানুষ তাকে বিশ্বাস করুক,তদুপরি এরূপ ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করে যাতে কেউ তাকে বিশ্বাস না করে। কখনো বা মানুষের জিনিস নিয়ে অন্য স্থানে রাখে যাতে তাকে চোর মনে করে লোকে প্রহার করে। যদি কেউ বুঝতে না পারে তবে হয়তো সে জিনিস পূর্বের স্থানেই নিয়ে রাখত। কখনো মদের বোতল সঙ্গে বহন করে যদিও মদ্যপায়ী নয়।

এখন প্রশ্ন ইসলাম এরূপ কর্মকে সমর্থন করে কি? অবশ্যই নয়। ইসলাম বলে মুমিনের সম্মান একান্ত তার নিজের নয়। মুমিনের এ অধিকার নেই যে,এমন কাজ করবে যা মানুষের মধ্যে তার সম্মান ও মর্যাদার হানী ঘটাবে। ইসলাম যেরূপ লোক দেখানো ভালোর বেশ ধরা বা রিয়াকারীকে সমর্থন করে না তদ্রূপ বাহ্যিকভাবে মন্দ বেশ ধরাকেও সমর্থন করে না। ব্যবহারিক জীবনে এ দু ধরনের মিথ্যার প্রকাশই ইসলামী দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।

এরফানী সাহিত্য পবিত্র আধ্যাত্মিক অর্থসমূহকে বাহ্যিকভাবে অশালীন শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করেছে। যেমন মদ ও বাঁশী বা প্রেমিকা ও প্রেম প্রভৃতি। এটা এ কারণে যে,নিজেরা যা ছিলেন তা প্রদর্শন না করা। হাফেজ শিরাজী যিনি রিয়া ও মালামাত দু টিরই বিরোধী ছিলেন তদুপরি তিনি এগুলো বলেছেন-

এ হৃদয় চাও কি তোমায় করব পথ প্রদর্শন

কর না তবে দুশ্চরিত্রে অহংকার আর বকধার্মিকতার আকর্ষণ।

হাফেজ যে মালামাত বা রিয়াবাদী কোনটিই ছিলেন না- এ কবিতায় তা বলছেন। যা হোক মালামাতি বা আত্মনিন্দা প্রচার সুফী মতবাদে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের একটি পদ্ধতি যা ইসলাম গ্রহণ করে না। তবে সুফীদের মধ্যে সকলেই এরূপ ছিলেন না। সুফীদের মধ্যে অনেকেই খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারীর মতো শরীয়তের বাহ্যিক আচার রক্ষায় অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। তদুপরি কারো কারো মতে এ বিষয়টি লক্ষণীয়। কথিত আছে,খোরাসানের সুফীদের মধ্যে মালামাতের প্রচলন অধিক ছিল। আমাদের কথা হলো ইসলাম আত্মনিন্দা প্রচার বা মালামাতকে অনুমোদন করে না।

তাসাউফ ও আত্মমর্যাদাবোধ

কখনো কখনো তাসাউফ বা সুফী মতবাদ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ লাভের উদ্দেশ্যে (যাতে করে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করা যায় এবং সে কোন নির্দেশ দানে অপারগ হয়) আত্মসম্মানকে বিসর্জন দান করে। কিরূপে তা উদাহরণের মাধ্যমে বলছি। যেমন কোন ব্যক্তি হয়তো কোথায়ও নিজেকে আত্মমর্যাদা হানী হতে রক্ষা করতে পারে কিন্তু তা করে না। মুমিনের সম্মান বলে যে কিছু রয়েছে সুফী মতবাদের অনেকের কাছে এর অর্থ নেই।

এ মতবাদের অনেকের মধ্যেই একটি বিষয় প্রচলিত রয়েছে-যখন কোন মুরীদ (যে তাসাউফের পথে উস্তাদের অধীনে অগ্রসর হতে চায়) তার পীর বা শিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তখন সে পীর বা আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুরু তাকে খুবই নীচ পর্যায়ের কাজ করার নির্দেশ দেন। যেমন তাকে বলে অবশ্যই তোমাকে কিছুদিন মেথরের কাজ বা পশুর মল সংগ্রহের,কখনো এর থেকে নিম্ন শ্রেণীর কোন কাজ করতে হবে যাতে তার নাফসের মৃত্যু ঘটে। এটা ইসলাম সমর্থন করে না।

ইবরাহীম আদহাম যিনি তাসাউফের একজন গুরু তিনি বলেন, আমি আমার জীবনে কোন সময়েই তিনটি ঘটনায় যেরূপ খুশী হয়েছিলাম সেরূপ খুশী হতে পারিনি : একবার আমি অসুস্থ অবস্থায় মসজিদে শুয়েছিলাম। এতটা অসুস্থ ছিলাম যে,উঠবার মতো শক্তি ছিল না। এমন সময় মসজিদের খাদেম এসে সব ফকির ও মুসাফির যারা মসজিদে ঘুমিয়ে ছিল তাদের উঠিয়ে দিল। আমার নিকটও এসে রাগতস্বরে বলল : এ্যাই,উঠ! সেই সাথে পা দিয়ে আমাকে কয়েকটি লাথি মারল। যখন সে দেখল তবুও আমি উঠছি না তখন একটি মৃতদেহের মতো আমার পা ও হাত ধরে মসজিদের বাইরে ছুড়ে মারল। আমি এতে খুবই খুশী হলাম এ ভেবে যে,আমার নাফ্স যা সম্মানের আকাঙ্ক্ষা করে তা এ অসম্মানের ফলে লাঞ্ছিত হচ্ছে ।

দ্বিতীয় ঘটনা হলো,একবার প্রচুর লোকের সঙ্গে নৌকায় করে যাচ্ছিলাম। ভাঁড় টাইপের এক লোক এই নৌকায় ছিল যে তার ভাঁড়ামো ও গল্প বলার মাধ্যমে নৌকার যাত্রীদের হাসাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলল : একবার এক যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড যুদ্ধ করলাম,যুদ্ধে অনেক কাফের হত্যা করলাম। তার মধ্যে এক দাড়িওয়ালা ছিল। আমি তার দাড়ি টেনে ধরলাম। এ কথা বলে এদিক ওদিক লক্ষ্য করে দাড়ি টানার কায়দা দেখানোর জন্য আমাকে ছাড়া অন্য কোন লোক না পেয়ে এসে আমার দাড়ি ধরে টেনে দেখালো। এতে সবাই হাসল। এখানেও খুব খুশী হয়েছিলাম নাফসের অপমান ও দুদর্শা দেখে।

তৃতীয় ঘটনা : এক শীতকালে রৌদ্রের মধ্যে কম্বল বের করে দেখলাম ছার পোকার পরিমাণ এতবেশী যে,পশম অধিক না ছারপোকা অধিক তা বুঝতে পারছিলাম না। তখন খুব খুশী হয়েছিলাম।

হ্যাঁ,এ সবই নাফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা সংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত,কিন্তু এরূপ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে ইসলাম সমর্থন করে না। কেন করে না তা পরে বর্ণনা করব। যে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানুষকে অসম্মানিত করে,প্রথমত কারো সঙ্গে ভাঁড়ামী করে লোক হাসানো একটি বেহুদা ও অশালীন কাজ যা ইসলাম সমর্থন করে না। দ্বিতীয়ত আমাকে কেউ অসম্মানিত করুক,ইসলাম এটাও চায় না। এটা কেমন প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম যে,এক ব্যক্তি এসে আমার দাড়ি ধরে এদিক-ওদিক টানবে আর আমি কিছুই বলব না? ইসলাম বলে,মুমিনের দায়িত্ব তার সম্মান ও মর্যাদার সীমা রক্ষা করা। ইসলামের বিধান অনুযায়ী ইবরাহীম আদহামের উপর ফরজ ছিল সেই ভাঁড়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলা, ভাঁড়ামো বন্ধ কর। বিতাড়িত হও,বেয়াদব!

অন্য এক সুফী বলেন, এক রাত্রিতে এক ব্যক্তি তার বাড়িতে ইফতারের জন্য আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল,কিন্তু রাতে যখন তার দরজায় উপস্থিত হলাম তখন আমাকে তাড়িয়ে দিল। এরূপ দ্বিতীয়,তৃতীয় বার আমাকে দাওয়াত করেও আমার সঙ্গে এরূপ আচরণ করল। শেষে আশ্চর্য হয়ে বলল :আমি তোমাকে তিন বার দাওয়াত করে তিন বারই এরূপ আচরণ করেছি তারপরও আমি দাওয়াত করলে কেন আসো? আমি বললাম : কুকরও এরূপ,তাকে শতবার বিতাড়িত করলেও বার বার ফিরে আসে।

কিন্তু ইসলাম আত্মসম্মান ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করাকে বা অপমানিত হওয়াকে সমর্থন করতে পারে না। এর রহস্য এখানেই।

আমরা ইসলামে এক স্থানে দেখি যেখানে প্রবৃত্তির কথা এসেছে-তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা বলেছে,নাফ্স বা প্রবৃত্তিকে নিকৃষ্ট কর্মের দিকে আহবানকারী বলে উল্লেখ করেছে। অন্য স্থানে আবার নাফসের সম্মান বা আত্মমর্যাদাবোধের কথা একইভাবে বা আরো বেশি উল্লেখ করেছে। আসল কথা হলো মুমিনের নাফ্স সম্মানিত,স্বয়ং মুমিন মর্যাদার অধিকারী। তাই ইসলামী নৈতিকতা মান-মর্যাদার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। আর এজন্যই বলেছে নিজের আত্মসম্মানের হানী করো না।

এখন প্রশ্ন হলো এটা কিভাবে সম্ভব? ইসলাম একদিকে বলছে নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো আবার অন্য দিকে ব্যক্তিসত্তা ও মর্যাদাকে রক্ষার আহবান জানিয়ে বলছে আত্মসম্মানের হানী করো না। তাহলে কি দু টি নাফসের অস্তিত্ব রয়েছে যার একটির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে এবং অন্যটিকে সম্মানদান করতে হবে?

জবাবে বলব,দু টি নাফ্স এ অর্থে যে,ব্যক্তিসত্তা দু টি এরূপ নয়। বরং বাস্তবে নাফ্স একটিই তবে তার উচ্চতর ও নিম্নতর পর্যায় রয়েছে। নাফসের উচ্চতর পর্যায় সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী এবং এই নাফ্সই নিম্নতর পর্যায়ে যখন অসৎ পথে আহবান করে,তখন তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে। এ বিষয়টিতে যেমনভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল,এরফানী মতবাদের কারো কারো মধ্যে সেরূপ লক্ষ্য করা যায় না। তাদের অনেকেরই ভাষায় প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের স্থানে নাফসের সম্মানিত পর্যায়কেও আক্রমণ করা হয়েছে,শুধু নাফসের নিম্নতর পর্যায়ে তা সীমাবদ্ধ থাকেনি।

আরেফগণের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানুষের পথ পরিক্রমা

 আরেফগণ কেমন সুন্দর রূপে ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমাকে চিহ্নিত করেছেন! তারা বলেছেন,ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমায় চারটি সফর রয়েছে :

১. মানুষের নিজ থেকে খোদার দিকে যাত্রা।

২. আল্লাহর সঙ্গে আল্লাহর দিকে যাত্রা (আল্লাহর পরিচয় জানা)।

৩. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির যাত্রা (একা নয়)।

৪. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির মধ্যে সফর তার সৃষ্টিকে মুক্তিদানের জন্য।

এর চেয়ে সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। প্রথমত সফর হচ্ছে মানুষের আল্লাহর দিকে যাত্রা অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষ স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন ততক্ষণ সব কিছুই অর্থহীন। যখন সে খোদাকে জানবে ও চিনবে,তার নৈকট্য অনুভব করবে ও নিজের মধ্যে তাকে অনুভব করবে তখন খোদার সঙ্গে তার সৃষ্টির দিকে ফিরে আসবে এবং সে ব্যক্তিই স্রষ্টার সৃষ্টির মুক্তির জন্য সৃষ্টির মধ্যে ঘুরবে ও তাদেরকে স্রষ্টার নৈকট্যদানের জন্য চেষ্টা চালাবে।

যদি বলি মানুষের পথ পরিক্রমা সৃষ্টি থেকে খোদার দিকে,এখানেই থেমে গেলে মানুষকে চিনতে পারিনি। যদি বলি মানুষকে খোদার দিকে যাত্রা না করে বরং মানুষের দিকে যাত্রা করা উচিত (যেমন বিভিন্ন বস্তুবাদী মতবাদ বলে থাকে),তবে মানুষের মুক্তির জন্য কিছুই করতে পারবে না এবং একাজও নিছক ভাঁওতা হবে। তারাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন যারা নিজেরা পূর্বে মুক্তি পেয়েছেন। তাহলে মানুষের মুক্তির অর্থ কি? কি থেকে মানুষের মুক্তি? পৃথিবীর বন্দিত্ব থেকে,না অন্যান্য মানুষের বন্ধন থেকে? যার অর্থ মানুষ থেকে মানুষের মুক্তি। এগুলো ঠিক,তবে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের আমিত্ব ও নাফ্সে আম্মারা এবং নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। যতক্ষণ মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না পাবে ততক্ষণ পৃথিবীর বন্দিত্ব ও অন্যান্য মানুষের বন্দিত্ব থেকেও মুক্তিপাবে না।

বহিঃপ্রবণতা ও অন্তঃপ্রবণতার সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা

আমরা এখনও আমাদের আলোচনার প্রথম পর্যায়ে রয়েছি। আজ রাত মোবারক মাস রমযানের একুশের রাত্রি,রমযানের শেষ দশ রাত্রির প্রথম রাত্রি। যখন রমযানের শেষ দশ দিন আসত তখন রাসূল (সা.) নির্দেশ দিতেন শোবার বিছানা গুটিয়ে ফেলতে এবং শওয়াল মাসে তা খুলতে। অর্থাৎ রাসূল এ শেষ দশ দিনের কোন রাত্রিতেই ঘুমাতেন না। এ রাতগুলো ইবাদত,দোয়া,মোনাজাত ও আল্লাহর সঙ্গে একাকী কাটানোর রাত।

যা হোক আমরা যে বিষয় নিয়ে পূর্ববর্তী বৈঠকে আলোচনা করেছি,বলেছি যে,কখনো কখনো কোন কোন মূল্যবোধ অন্যান্য মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এক সময় ইসলামী সমাজ ইবাদতের মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে,অন্যান্য মূল্যবোধ ধ্বংস করছিল। বর্তমানে আমি লক্ষ্য করছি অন্য আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; কেউ কেউ ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধের দিকে দেখেন,কিন্তু এর খোদায়ী দিককে ভুলে যান। তারা আরেকটি ভুল ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়েছেন- এক আরবের গাধায় চড়ার মতো যে গাধায় উঠার জন্য এমন জোরে লাফদিল ফলে অন্য পার্শ্বে গিয়ে পড়ল। ফলে প্রথম প্রচেষ্টায় সে গাধায় উঠতে পারল না। দ্বিতীয় বারও সেতা-ই করল। তখন নিজেই বলল,ك الاوّل অর্থাৎ প্রথম বারের মতোই।

যদি এমন অবস্থা হয় যে,ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে যাব,তবে সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

দেখুন,মহান আল্লাহ্ সূরা ফাতহের শেষ রুকুতে কি বলছেন (এমন নমুনা কোরআনে আরও রয়েছে),

( مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ)

রাসূলল্লাহর প্রশিক্ষিত সাহাবীরা কিরূপ? মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠিন,কঠোর,দৃঢ় ও মজবুত যেমন সীশা ঢালা প্রাচীর।

) إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (

(সূরা ছফ : ৪)

কিন্তু এরা দু রূপের অধিকারী- ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবিলায় তারা কঠোর ও মজবুত,কিন্তু নিজেদের মধ্যে স্নেহশীল,দয়ালু,ঐক্যবদ্ধ,ভালবাসায় সম্পর্কিত। কোরআনের ভাষায় এটা ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য (আমরা কয়েক শতাব্দী হলো সেটাকে ভুলতে বসেছি)। কোরআন সূরা ফাতহের শেষ আয়াতে বলছে-

) تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ (

সাথে সাথেই খোদায়ী মূল্যবোধের কথা বলছে। ঐ ব্যক্তিটি যে সমাজমুখী সে ব্যক্তিটিই খোদার মোকাবিলায় নত,সেজদাবনত,নিজের মনের কথা ও বেদনা খোদার নিকট ব্যক্ত করে। তার নিকট থেকে এর থেকে উত্তরণের জন্য সাহায্য চায় যেন নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। যা তার আছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয়,বরং প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষী। তার সকল ইবাদতের লক্ষ্য স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্থাৎ ইবাদতের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাদের চেহারায় ইবাদতের চিহ্ন লক্ষণীয়।

) ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ(

অতঃপর ইসলামী সমাজকে বর্ণনা করছে এটা কেমন? বলছে,এটা এমন এক সমাজ যাকে তুলনা করা যায় একটি বৃক্ষের সঙ্গে; প্রাথমিক অবস্থায় তা দুর্বল ও ক্ষুদ্র থাকলেও পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে ফুলে-ফলে পূর্ণতা লাভ করে,কৃষকের চোখে আনন্দের জোয়ার আনে।

দেখুন,কোরআন অন্য একটি স্থানে এ দু প্রবণতার (বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী) সহাবস্থানের কথা কিভাবে বলছে,

) التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ(

খোদায়ী দিকগুলো,যেমন পরিশুদ্ধতা অবলম্বনকারী,ইবাদতকারী,খোদার প্রশংসাকারী,রোযা পালনকারী,রুকুকারী,সেজদাকারী বলার সাথে সাথে আবার উল্লেখ করছে,

) الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ(

তারাই সমাজের সংস্কারকারী,সমাজে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী।

অন্য আয়াতে বলছে,

) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ(

ধৈর্যধারণকারীরা (দৃঢ়তা অবলম্বনকারী বিশেষ করে যুদ্ধের মযদানে),সত্যবাদীরা,দানকারীরা,সত্যপন্থীরা।এর পরপরই বলছে,( وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ ) অর্থাৎ শেষ রাত্রিতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা। অর্থাৎ ইসলামে এ বৈশিষ্ট্যগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ যদি এগুলোর যে কোন একটিকে ছোট করে দেখে তবে অন্যগুলোকেও ছোট করে দেখছে।

ইমাম মাহদী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে (যা শুধু একটি নয় অনেক হাদীসেই আমি দেখেছি) বলছে,رهبان بالیل لیوث بالنّهار রাত্রিতে তারা দুনিয়াত্যাগী উপাসক অর্থাৎ রাত্রি যখন আসে তখন তাদেরকে দেখলে মনে হয় একদল খোদা উপাসক আবার যখন দিনে তাদেরকে দেখবে তখন তারা যেন একদল সিংহ।

ইসলামের ইতিহাসের নমুনা

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবীরা কিরূপ অবস্থায় ছিলেন সে ব্যাপারে আল কাফীর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস (মাওলানা রূমী তা কবিতায় বর্ণনা করেছেন) যা শিয়া-সুন্নী হাদীস বর্ণনাকারীরা সবাই বর্ণনা করেছেন,খুবই শিক্ষণীয়।

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফজরের নামাজের পর আসহাবে ছোফফার নিকট গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ প্রায়ই তাদের দেখতে যেতেন। সে দিন হঠাৎ এক যুবকের উপর রাসূলের চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন এ যুবকের মধ্যে অন্য রকম অবস্থা বিরাজ করছে- পা দু টি টলায়মান,চোখ দু টি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার রং ও স্বাভাবিক নেই।

তার কাছে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন,کیف أصبحت কিরূপে রাত কাটিয়েছ? সে জবাব দিল,أصبحت موقنا یا رسول الله হে রাসূলুল্লাহ্! এমনভাবে সকালে প্রবেশ করেছি যে,ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি। যা আপনি মুখে বলেছেন ও আমি কান দিয়ে শুনেছি তা এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাই। রাসূল চাইলেন সে আরো কিছু বলুক। তিনি বললেন, সব কিছুরই আলামত (চিহ্ন) থাকে। তোমার ইয়াকীনের আলামত কি?

সে বলল,إنّ یقینی یا رسول اله  هو الذی أحزننی و أسهر لیلی و أظمأ هوا جری আমার ইয়াকীনের আলামত হলো দিনগুলো আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে আর রাতগুলো আমাকে জাগ্রত করে রাখে (অর্থাৎ দিনে রোযা আর রাত্রিতে ইবাদত আমার ইয়াকীনের আলামত। আমার ইয়াকীন আমাকে রাত্রে বিছানায় শুতে দেয় না,আর দিনগুলোতে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।) রাসূল বললেন, এটা যথেষ্ট নয়,আরো কোন আলামত আছে কি? সে বলল, হে রাসূলুল্লাহ্! যদিও এখন এ পৃথিবীতে আছি কিন্তু ঐ দুনিয়াকে (অর্থাৎ আখেরাত) দেখতে পাই,সেখানকার শব্দ শুনতে পাই। বেহেশত থেকে বেহেশতবাসীদের কণ্ঠ আর জাহান্নাম থেকে দোযখবাসীদের চীৎকার শুনতে পাই। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি অনুমতি দেন,তবে আপনার সাহাবীদের একে একে পরিচয় বলে দিই,কে বেহেশতী,আর কেজাহান্নামী। রাসূল বললেন, নীরব হও। আর কোন কথা বল না। মাওলানা রূমী বলছেন,

বললেন রাসূল সাহাবী যায়েদকে কিভাবে রাত কাটিয়েছো বন্ধু হে!

ইয়াকীনের অধিকারী হয়ে বলল সে।

পুনঃ শুধায় চিহ্ন সে বাগানের দেখাও আমায়।

বলে তৃষ্ণার্ত আমি এই দিনগুলোতে হায়,

না ঘুমিয়ে কাটাই কষ্ট আর ভালবাসায়।

বললেন বল যা অর্জন করেছো তায়,

তা থেকে যেন বুঝতে পারে এরা সবাই।

বলল দু সৃষ্টি যখন দেখে এ আকাশ,

আমি দেখি তার অধিবাসীদের যেথায় বাস।

বলব কি কিছু কথা রয়েছে খাছ

ঠোঁট কামড়ে বলেন রাসূল,হয়েছে ব্যাস।

অতঃপর রাসূল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ইচ্ছা কি? কি করতে চাও? সে বলল, ইয়ারাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করতে চাই।

তার ইবাদত আর ইচ্ছা হলো এ রকম,তার রাত্রি হলো ইবাদত,আর দিন জিহাদ আর শাহাদাতের জন্য। এটাই ইসলামের কথিত মুমিন,ইসলামের মানুষ। দু টি ভিন্নমুখী কষ্ট,কিন্তু দ্বিতীয় কষ্টটি তার প্রথম কষ্ট থেকে উৎসারিত। আর সেটা হলো স্রষ্টাকে পাওয়ার বেদনা।

আমার বক্তব্যের শুরুতে যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছি তা হলো :

) وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ(

কোরআনের বর্ণনা সত্যিই আশ্চর্যজনক। বলছে, হে ঈমানদারগণ! নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য চাও। তাফসীরকারগণ বলছেন,ধৈর্যের অর্থ রোযা,যেহেতু রোযা এক ধরনের সবর। তাই নামায ও রোযা থেকে সাহায্য নাও। নামায থেকে কি ধরনের সাহায্য পাওযা যায়? আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার মাধ্যমে কি শক্তি পাওয়া যায়? উত্তর আল্লাহর ইবাদত নিজেই একটি শক্তি। প্রকৃত পক্ষে যেকোন প্রেরণাই এখান থেকে পাওযা যায়। যদি আপনি চান সমাজে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে থাকবেন,যদি চান একজন সংগ্রামী হতে,তবে অবশ্যই আপানাকে প্রকৃত নামাযী হতে হবে।

অনেকে বলেন,নামায পড়ার কি আছে? ইবাদতের প্রয়োজন কি? এগুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাজ। যুবকদের অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। এগুলো এক ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কথা যার নজীর ইতিহাসে পুরাতন। হয়তো জানেন,হযরত উমর (হাইয়া আলা খাইরিল আমাল) বাক্যটিকে আযান থেকে প্রত্যাহার করেন। কেন? তার নিজের যুক্তিতে মনে হয়েছে এটা করা দরকার। যেহেতু তার শাসনকাল ইসলামের বিজয় ও সংগ্রামের সময় এবং মুসলমানদের দলে দলে যুদ্ধে যোগদান করতে হচ্ছে,অল্প সৈনিক নিয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্যের মোকাবিলায় জয়ী হতে হবে (কখনো সমগ্র যোদ্ধা মুসলমানের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট হাজার আর তা নিয়ে রোম বা পারস্য সাম্রাজ্যের লক্ষসৈনিকের মোকাবিলায় দাঁড়াতে হয়েছে),তাই মুজাহিদদের নিকট যুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যখন মুয়াজ্জিন আযানের সময় চীৎকার করে আল্লাহু আকবার ও দু শাহাদাতের পর(হাইয়া আলাস সালাহ্-নামাযের দিকে এসো) এবং (হাইয়া আলাল ফালাহ-কল্যাণেরদিকে এসো) বলে,তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই কিন্তু হাইয়া আলা খাইরিল আমাল (সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের দিকে এসো) যার অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো নামায,এটা বলা হবে তখন মুজাহিদদের মনদুর্বল হয়ে যাবে। কেননা তাদের নিজেদের কাছে মনে হবে নামায যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আমরা যুদ্ধের ময়দানে বা জিহাদে যাওয়ার চেয়ে মদীনার মসজিদে বসে নামায পড়ি,কি প্রয়োজন অন্যদের হত্যা করে,নিজেদের নিহত হতে দিয়ে,আহত হয়ে,কারো চোখ অন্ধ হবে,কারো হাত বা পা কাটা যাবে,অভুক্ত থাকার কষ্ট করতে হবে,বরং আমরা এখানে স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের পাশে বসে চার রাকাত নামায পড়ে তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারি। তাই আযান থেকে এ অংশটি বাদ দিতে হবে। তার চেয়ে বরং বলব (আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-নামায ঘুম থেকে উত্তম)। যখন ঘুমাব তখন মনে করতে হবে ঘুমানোর চেয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ি।

কিন্তু এ রহস্য আমাদের জানতে হবে কোন্ শক্তির বলে মুসলমানরা (যাদের সংখ্যা এক লক্ষেরও কম) তাদের থেকে কয়েকগুণ শক্তিশালী (সংখ্যায় কয়েক লক্ষ) প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। এ জয় কিরূপে সম্ভব অনেকেই চিন্তা করে দেখেনি। এ জয় তো অস্ত্রের বলে নয়। যদি তাই হতো তবে আরবদের অস্ত্র কি রোমানদের বা পারসিকদের চেয়ে অধিক ধারালো ছিল? অবশ্যই নয়। বরং রোমান ও পারসিকরা সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রের অধিকারী ছিল। অপর পক্ষে আরবদের অস্ত্র সেরকম ছিল না। জাতি হিসেবেও আরবরা কি রোম ও ইরানের মোকাবিলায় শক্তিশালী ছিল? অবশ্যই নয়। শাপুর জুল আকতাফ ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের পদদলিত করেছিল। শত-সহস্র আরবকে বন্দিকরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কপালে কালিমা লেপন করে দিয়েছিল। তখন আরবদের শক্তি কোথায়ছিল? কিন্তু মাত্র একশ বছর পর সেই আরবরাই ইরানকে পরাজিত করেছিল। তাহলে কোন্ শক্তির বলে আরবরা ইরান ও রোমের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের মালা পড়েছিল আর তাদের মুখে পরাজয়ের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল? এ শক্তি ঈমানের শক্তি ছিল। যে শক্তি সেحی علی خیر العمل থেকে লাভ করেছে। তার নামায থেকে সে এ শক্তি অর্জন করেছে স্রষ্টার কাছে একান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে। কোরআনে বর্ণিত মানুষ রাত্রিতে তার স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনের গোপন আকাঙ্ক্ষাপেশ করে,তার নিকট এ শক্তি চায়। সেই মহান প্রভু থেকেই সে এ আত্মিক শক্তি লাভ করেছে অর্থাৎ আরবরা যখন স্রষ্টার নিকট থেকে এ আত্মিক শক্তি অর্জন করেছে তখন এর বলেই সে ইরান ও রোমকে পরাজিত করেছে। এ আত্মিক শক্তি সে কিভাবে পেয়েছে? তার ঈমান থেকে পেয়েছে। নামায কি? নামায হলো ঈমানের ঝালাই। নামাযের আল্লাহু আকবার থেকেই সে এ শক্তি অর্জন করেছে। যখন সে নামাযে কয়েকবার বলে, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ,তখনই অনুভব করে বাকী সকল কিছুই তুচ্ছ। যখন যুদ্ধের ময়দানে কয়েকলক্ষ যোদ্ধাকে তাদের মোকাবিলায় দেখে তখন বলে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিলআলিয়্যিল আজিম। সকল ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। মানুষের অবশ্যই তার উপর নির্ভর করা উচিত। তার থেকে শক্তি ও সাহায্য চাওয়া উচিত। নামাযই তাকে এ শক্তি ও সাহস দান করেছে। যদি এ নামায না থাকতো তবে এ ধরনের মুজাহিদ (জিহাদকারী) যোদ্ধা তৈরি হতো না।

ইসলাম কি এটা বলে না যে,ইসলামের বিধি-বিধান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে তার নামাযের জন্য মদীনার মসজিদে পড়ে থাকা হারাম। তাকে অবশ্যই জিহাদের জন্য যেতে হবে। তার নামায কবুল হওয়ার শর্ত হলো জিহাদ। আবার জিহাদ কবুল হওয়ার শর্তও নামায। কোন মুজাহিদের জন্য শর্তাবলী উপস্থিত হলে তার জন্য জিহাদ ফরয। কিন্তু তাকে বলতে হবে,ইসলাম বলে নামায ব্যতীত জিহাদ বাতিল ও মূল্যহীন,তেমনি জিহাদ ব্যতীত নামাযও বাতিল। তখন এটা খাইরুল আমাল বা সর্বোত্তম ইবাদত না হয়ে শাররুল আমাল বা নিকৃষ্ট ইবাদতে পরিণত হবে। নামায মুসলমানকে ইসলাম কি তা শেখায়। যে নামায মুসলমানকে জিহাদ থেকে পালানোর জন্য মসজিদে বসে থাকার কথা বলে সেটা ইসলামের নামায নয়। ইসলামের নামায সর্বোত্তম কর্ম (খাইরুল আমাল)। তাই এটা ঠিক নয় যে,حی علی خیر العمل -কে আযান থেকে এ যুক্তিতে বাদ দেয়া হবে যে,এর খারাপ প্রভাব রয়েছে,যেহেতু মুসলমানরা জিহাদ বাদ দিয়ে নামায পড়তে যাবে। এটা ভুল। এটাই ইসলামের যুক্তি। বর্তমানের পরিভাষায় যদি বলি,ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতে সকল মূল্যবোধের মূল্য ইবাদতে নিহিত,তবে বলতে হবে সে ইবাদত হলো শর্তযুক্ত ইবাদত। কোরআন আমাদের বলছে নামায তখনই নামায হবে যখন তার প্রভাব স্বতঃপ্রকাশিত। কিরূপে তা প্রকাশিত হবে? নিশ্চয়ই নামায মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। প্রকৃত নামায এটাই যা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যদি দেখ নামায পড়ছ সে সাথে অন্যায় কাজও করছ,তবে জেনে রাখ,তোমার নামায নামায নয়। সুতরাং তোমার নামাযকে ঠিক কর। নামায তোমাকে সকল মূল্যবোধ দান করবে এ শর্তে যে,তোমার নামায প্রকৃতই নামায হয়।

এ সকল শিক্ষা হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে শিক্ষণীয়। আলী (আ.) ইসলামের সকল মূল্যবোধের সমষ্টি। নাহজুল বালাগাহ্ তার বাণী। যা এমন এক গ্রন্থ মানুষ এর যেখানেই লক্ষ্য করে যেন নতুন এক যুক্তি খুজে পায়,খুজে পায় নতুন এক মানুষকে- এর প্রতিটি অধ্যায়ে যেন নতুন নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিটি স্থানেই আলী (আ.) সামগ্রিক মূল্যবোধের প্রতিভূ এক ব্যক্তিত্ব। কোথাও তার যুক্তি বীরোচিত যেন এক নবযুবক যে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে সমর নেতা হয়েছে;যে সমরবিদ্যা ছাড়া কিছুই বোঝে না। কোথাও সে আলীকেই মনে হবে এক আরেফ ও সূফী যে স্রষ্টার সঙ্গে গভীর প্রেমে লিপ্ত,অন্য কিছুর প্রতি তার খেয়াল নেই।

আলী (আ.)-এর পৌরুষত্ব ও সাহসিকতা

আজ একুশে রমযানের রাত হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের রজনী। যাতে ইসলামের বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারি এজন্য নাহজুল বালাগায় দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের আলীর পরিচয় রয়েছে এমন দু টি অংশ থেকে আলাচনা রাখছি। সিফফিনের যুদ্ধে আলী (আ.)-এর সৈন্যরা ফোরাত কিনারায় পৌছার পূর্বেই মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী সেখানে পৌছায়। মুয়াবিয়া নির্দেশ দেয় পানির পথগুলো আলী ও তার সৈন্যদের জন্য বন্ধ করে রাখতে। আলীর সৈন্যদের পরাস্ত করার খুব ভালো এক কৌশল হস্তগত করেছে এটা ভেবে মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী মনে মনে খুব আনন্দিত হলো। হযরত আলী যখন সেখানে পৌছে এ অবস্থা দেখলেন তখন বললেন,পরস্পর আলোচনা করে বিষয়টি ফয়সালা করবেন যাতে করে এ বিষয়টি নিয়ে দু পক্ষের মুসলমানদের মধ্যে রক্তক্ষয় না হয়। তাই মুয়াবিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা এখনও এসে পৌছাইনি,তুমি এ ধরনের কাজ করলে! (পানি পথ ছেড়ে দাও যাতে এ পক্ষও পানি পায়)। মুয়াবিয়া পরামর্শ সভা ডেকে নিজের সেনাপ্রধানদের কাছে পরামর্শ চাইল। কেউ বলল পানির পথ ছেড়ে দেয়াই উত্তম,কেউ বলল,না। আমর ইবনে আস বলল, ছেড়ে দাও। কারণ যদি তুমি না ছাড় তবে বল প্রয়োগে তোমার নিকট থেকে সে নিয়ে নেবে। তখন তোমার সম্মান ভূলুন্ঠিত হবে। কিন্তু মুয়াবিয়া সিদ্ধান্ত নিল পানি পথ ছাড়া হবে না। তখন হযরত আলী (আ.) তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক বিপ্লবী ভাষণ দিলেন যার প্রভাব শত রণতুর্য আর দামামা থেকেও অনেক বেশি। তিনি বললেন, তারা যুদ্ধ চায়,এখন তোমরা ভেবেদেখ অপমান ও অমর্যাদাকে গ্রহণ করে সাহস ও সম্মান হারাবে,নাকি তোমাদের তরবারীকে তাদের রক্তে পূর্ণ করে নিজেরা পানির তৃষ্ণা মেটাবে। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৫১)

মুয়াবিয়া তোমাদের জন্য পানি বন্ধ করেছে। আমার সহযোগীরা! তোমরা তৃষ্ণার্ত। পানি চাও। আমার কাছে এসেছ,পানি চাও। যদি পানি চাও তবে কি করা উচিত? তোমাদের তরবারীগুলোকে প্রথমে এই শত্রুদের দূষিত রক্ত দ্বারা পূর্ণ কর। তারপর নিজেরা তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারবে। এর পর এমন এক বাক্য উচ্চারণ করলেন যা সবার মধ্যে উত্তেজনা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। জীবন ও মৃত্যুকে যুদ্ধ ও বিপ্লবের ভাষায় সংজ্ঞায়িত করলেন। হে জনগণ! জীবন কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি? মৃত্যু কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি পৃথিবীর উপর বিচরণ,খাদ্য গ্রহণ আর বিশ্রাম? মৃত্যুর অর্থ কি কবরে শয়ন? না,ঐ জীবনকেও জীবন বলা যায় না,ঐ মৃত্যুকেও মৃত্যু বলা যায় না।

فالموت فی حیاتکم مقهورین و الحیات فی موتکم فاهرون

  জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর মৃত্যু হলো বেঁচে থাকা,কিন্তু অপরের অধীনে থাকা।

এ বাক্যটি কতটা বিপ্লবী ও উঁচু পর্যায়ের! এরপর কি শক্তির মাধ্যমে আলী (আ.)-এর সৈনিকদের প্রতিরোধ করা সম্ভব? কিছুক্ষণের মধ্যেই আলীর সেনাবাহিনী হামলার মাধ্যমে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীকে নদীকূল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিতাড়িত করল। আলীর সহযোগীরা নদীকূলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। এবার মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী পানির জন্য আবেদন করল। আলীর সৈন্যরা বলল, অসম্ভব। আমরা পানি দিতে রাজী নই। আমরা প্রথমে এ ধরনের কাজ করিনি,বরং তোমরাই এ পথ বেছে নিয়েছিলে। হযরত আলী এ কথা শুনে বললেন, না,আমি পানি বন্ধ করতে রাজী নই। কারণ এ কাজ কাপুরুষোচিত। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাথে মোকাবিলা ভিন্ন কথা। কিন্তু এপথে জয়লাভ করা কোন সম্মানিত মুসলমানের জন্য ঠিক নয়। এটাকেই বলে পৌরুষত্ব। পৌরুষত্ব সাহসিকতার থেকেও উচ্চ পর্যায়ের। হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে মাওলানা রুমী কত সুন্দর বলেছেন (হযরত আলীর শানে ও প্রশংসায় রচিত তার শ্রেষ্ঠ কবিতা)!

সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি

পৌরুষত্বে কি তুমি,জানেন শুধু অন্তর্যামী।

অর্থাৎ সাহসিকতায় তিনি শেরে খোদা সকলে জানলেও পৌরুষত্বে কেউই আলীকে চিনতে পারেনি। এখানে আমরা হযরত আলীকে তার এক বিশেষ রূপে দেখতে পাই।

হযরত আলী (আ.)-এর মোনাজাত

যখন আলী (আ.) মানুষ থেকে দূরে- একান্তে স্রষ্টার সাথে ইবাদত ও গোপন সংলাপে লিপ্ত তখন দেখি অন্য এক আলী। যেমন নাহজুল বালাগায় পাই

اللهم انّک آنس الآنسین لاولیائک

হে আল্লাহ্! আপনি আপনার আউলিয়াদের নিকটতম বন্ধুর থেকেও নিকটে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ কোন বন্ধুর সঙ্গেই আপনার মতো নৈকট্য অনুভব করি না। আপনি আমার নিকটতম সাথী। আপনি ব্যতীত যার সঙ্গেই থাকি যেন একাকিত্ব অনুভব করি। শুধু যখন আপনার সঙ্গে থাকি তখনই অনুভব করি নিকটতম কারো সঙ্গে আছি।

و احضرهم بالکفایة للمتوکلین علیک

যে কেউ আপনার প্রতি নির্ভর করে,অনুভব করে অন্য সকল কিছুর থেকে আপনি তার নিকটতর উপস্থিত অস্তিত্ব যেন আপনি আপনার উপর নির্ভরকারী ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হন।

تشاهدهم فی سرائرهم و تطلع علیهم فی ضمائرهم و تعلم مبلغ بصائرهم

হে প্রভূ! আপনি আপনার বন্ধু ও প্রেমিকদের হৃদয়ের অন্তস্তলের রহস্যও পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের অন্তঃকরণের অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কেও অবহিত। তাদের জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি কোন্ পর্যায়ে অবস্থান করছে তাও আপনার জানা।

فاسرارهم لک مکشوفه و قلوبهم إلیک ملهوفة

তাদের রহস্য আপনার নিকট প্রকাশিত ও তাদের অন্তর আপনার প্রতি উড্ডয়নশীল।

আলী (আ.)-এর দোয়াগুলোর মধ্যে দোয়ায়ে কুমাইল জুমআর রাতগুলোতে পড়বেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ দোয়াটি পড়ুন। দেখবেন,না এর মধ্যে দুনিয়া আছে,না আখেরাত (আখেরাত বলতে বেহেশত ও দোযখ)। যা দেখবেন তা দুনিয়া ও আখেরাতের ঊর্ধ্বে। স্রষ্টার সাথে একজন খাঁটি বান্দা,উপাসক ও প্রেমিকের সম্পর্ক এটাই যে,তার প্রেমে নিমগ্ন থাকবে। প্রকৃত ইবাদত এটাই। আলী নিজেই তা বলছেন। দোয়ায়ে কুমাইলে আলী (আ.) নিজের স্রষ্টার সাথে কিরূপে কথোপকথন করছেন লক্ষ্য করুন,কিভাবে মোনাজাত করছেন দেখুন,তেমনিভাবে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) রমযানমাসের সুবহে সাদিকের পূর্বে সেহরীর সময় কিভাবে আল্লাহর নিকট আবেদন-নিবেদন করছেন তা আবু হামযা সোমালীর দোয়ায় লক্ষ্য করুন। মুসলমানের প্রথম ধাপ এটাই যে,সে তার স্রষ্টার নিকটবর্তী হবে। স্রষ্টার নৈকট্যের মাধ্যমেই অন্যান্য দায়িত্ব,বিশেষ করে সামাজিক দায়িত্বসমূহ সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতে পারব।

আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদের প্রবণতাগুলো এককেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে- যে সমস্যায় বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ্ আক্রান্ত। আমাদের এ এককেন্দ্রিকতা পরিহার করে সামগ্রিকতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। ইবাদতের গুরুত্বকে কম করে দেখলে চলবে না। ইমাম সাদিক (আ.) তার মৃত্যুলগ্নে তার সকল নিকটাত্মীয়কে ডেকে সমবেত করে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে বিদায় নেন। তিনি বলেন, যারা নামাযকে ছোট করে দেখে (কম গুরুত্ব দেয়),আমার শাফায়াত তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

আরেফগণের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানুষের পথ পরিক্রমা

 আরেফগণ কেমন সুন্দর রূপে ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমাকে চিহ্নিত করেছেন! তারা বলেছেন,ইনসানে কামেলের পথ পরিক্রমায় চারটি সফর রয়েছে :

১. মানুষের নিজ থেকে খোদার দিকে যাত্রা।

২. আল্লাহর সঙ্গে আল্লাহর দিকে যাত্রা (আল্লাহর পরিচয় জানা)।

৩. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির যাত্রা (একা নয়)।

৪. আল্লাহর সঙ্গে তার সৃষ্টির মধ্যে সফর তার সৃষ্টিকে মুক্তিদানের জন্য।

এর চেয়ে সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। প্রথমত সফর হচ্ছে মানুষের আল্লাহর দিকে যাত্রা অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষ স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন ততক্ষণ সব কিছুই অর্থহীন। যখন সে খোদাকে জানবে ও চিনবে,তার নৈকট্য অনুভব করবে ও নিজের মধ্যে তাকে অনুভব করবে তখন খোদার সঙ্গে তার সৃষ্টির দিকে ফিরে আসবে এবং সে ব্যক্তিই স্রষ্টার সৃষ্টির মুক্তির জন্য সৃষ্টির মধ্যে ঘুরবে ও তাদেরকে স্রষ্টার নৈকট্যদানের জন্য চেষ্টা চালাবে।

যদি বলি মানুষের পথ পরিক্রমা সৃষ্টি থেকে খোদার দিকে,এখানেই থেমে গেলে মানুষকে চিনতে পারিনি। যদি বলি মানুষকে খোদার দিকে যাত্রা না করে বরং মানুষের দিকে যাত্রা করা উচিত (যেমন বিভিন্ন বস্তুবাদী মতবাদ বলে থাকে),তবে মানুষের মুক্তির জন্য কিছুই করতে পারবে না এবং একাজও নিছক ভাঁওতা হবে। তারাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারেন যারা নিজেরা পূর্বে মুক্তি পেয়েছেন। তাহলে মানুষের মুক্তির অর্থ কি? কি থেকে মানুষের মুক্তি? পৃথিবীর বন্দিত্ব থেকে,না অন্যান্য মানুষের বন্ধন থেকে? যার অর্থ মানুষ থেকে মানুষের মুক্তি। এগুলো ঠিক,তবে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের আমিত্ব ও নাফ্সে আম্মারা এবং নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি। যতক্ষণ মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি না পাবে ততক্ষণ পৃথিবীর বন্দিত্ব ও অন্যান্য মানুষের বন্দিত্ব থেকেও মুক্তিপাবে না।

বহিঃপ্রবণতা ও অন্তঃপ্রবণতার সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা

আমরা এখনও আমাদের আলোচনার প্রথম পর্যায়ে রয়েছি। আজ রাত মোবারক মাস রমযানের একুশের রাত্রি,রমযানের শেষ দশ রাত্রির প্রথম রাত্রি। যখন রমযানের শেষ দশ দিন আসত তখন রাসূল (সা.) নির্দেশ দিতেন শোবার বিছানা গুটিয়ে ফেলতে এবং শওয়াল মাসে তা খুলতে। অর্থাৎ রাসূল এ শেষ দশ দিনের কোন রাত্রিতেই ঘুমাতেন না। এ রাতগুলো ইবাদত,দোয়া,মোনাজাত ও আল্লাহর সঙ্গে একাকী কাটানোর রাত।

যা হোক আমরা যে বিষয় নিয়ে পূর্ববর্তী বৈঠকে আলোচনা করেছি,বলেছি যে,কখনো কখনো কোন কোন মূল্যবোধ অন্যান্য মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এক সময় ইসলামী সমাজ ইবাদতের মূল্যবোধের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে,অন্যান্য মূল্যবোধ ধ্বংস করছিল। বর্তমানে আমি লক্ষ্য করছি অন্য আরেক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে; কেউ কেউ ইসলামের সামাজিক মূল্যবোধের দিকে দেখেন,কিন্তু এর খোদায়ী দিককে ভুলে যান। তারা আরেকটি ভুল ও বিচ্যুতির মধ্যে পড়েছেন- এক আরবের গাধায় চড়ার মতো যে গাধায় উঠার জন্য এমন জোরে লাফদিল ফলে অন্য পার্শ্বে গিয়ে পড়ল। ফলে প্রথম প্রচেষ্টায় সে গাধায় উঠতে পারল না। দ্বিতীয় বারও সেতা-ই করল। তখন নিজেই বলল,ك الاوّل অর্থাৎ প্রথম বারের মতোই।

যদি এমন অবস্থা হয় যে,ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থেকে বের হয়ে যাব,তবে সমাজবিমুখ ইবাদতকারী আর ইবাদতবিমুখ সমাজমুখিতার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

দেখুন,মহান আল্লাহ্ সূরা ফাতহের শেষ রুকুতে কি বলছেন (এমন নমুনা কোরআনে আরও রয়েছে),

( مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ)

রাসূলল্লাহর প্রশিক্ষিত সাহাবীরা কিরূপ? মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবিলায় কঠিন,কঠোর,দৃঢ় ও মজবুত যেমন সীশা ঢালা প্রাচীর।

) إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (

(সূরা ছফ : ৪)

কিন্তু এরা দু রূপের অধিকারী- ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবিলায় তারা কঠোর ও মজবুত,কিন্তু নিজেদের মধ্যে স্নেহশীল,দয়ালু,ঐক্যবদ্ধ,ভালবাসায় সম্পর্কিত। কোরআনের ভাষায় এটা ইসলামী সমাজের বৈশিষ্ট্য (আমরা কয়েক শতাব্দী হলো সেটাকে ভুলতে বসেছি)। কোরআন সূরা ফাতহের শেষ আয়াতে বলছে-

) تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ (

সাথে সাথেই খোদায়ী মূল্যবোধের কথা বলছে। ঐ ব্যক্তিটি যে সমাজমুখী সে ব্যক্তিটিই খোদার মোকাবিলায় নত,সেজদাবনত,নিজের মনের কথা ও বেদনা খোদার নিকট ব্যক্ত করে। তার নিকট থেকে এর থেকে উত্তরণের জন্য সাহায্য চায় যেন নিজের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। যা তার আছে তাতে সে সন্তুষ্ট নয়,বরং প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষী। তার সকল ইবাদতের লক্ষ্য স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্থাৎ ইবাদতের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থায় সে আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাদের চেহারায় ইবাদতের চিহ্ন লক্ষণীয়।

) ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ(

অতঃপর ইসলামী সমাজকে বর্ণনা করছে এটা কেমন? বলছে,এটা এমন এক সমাজ যাকে তুলনা করা যায় একটি বৃক্ষের সঙ্গে; প্রাথমিক অবস্থায় তা দুর্বল ও ক্ষুদ্র থাকলেও পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে ফুলে-ফলে পূর্ণতা লাভ করে,কৃষকের চোখে আনন্দের জোয়ার আনে।

দেখুন,কোরআন অন্য একটি স্থানে এ দু প্রবণতার (বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী) সহাবস্থানের কথা কিভাবে বলছে,

) التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ(

খোদায়ী দিকগুলো,যেমন পরিশুদ্ধতা অবলম্বনকারী,ইবাদতকারী,খোদার প্রশংসাকারী,রোযা পালনকারী,রুকুকারী,সেজদাকারী বলার সাথে সাথে আবার উল্লেখ করছে,

) الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنْكَرِ(

তারাই সমাজের সংস্কারকারী,সমাজে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধকারী।

অন্য আয়াতে বলছে,

) الصَّابِرِينَ وَالصَّادِقِينَ وَالْقَانِتِينَ وَالْمُنْفِقِينَ(

ধৈর্যধারণকারীরা (দৃঢ়তা অবলম্বনকারী বিশেষ করে যুদ্ধের মযদানে),সত্যবাদীরা,দানকারীরা,সত্যপন্থীরা।এর পরপরই বলছে,( وَالْمُسْتَغْفِرِينَ بِالْأَسْحَارِ ) অর্থাৎ শেষ রাত্রিতে ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা। অর্থাৎ ইসলামে এ বৈশিষ্ট্যগুলো একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কেউ যদি এগুলোর যে কোন একটিকে ছোট করে দেখে তবে অন্যগুলোকেও ছোট করে দেখছে।

ইমাম মাহদী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে (যা শুধু একটি নয় অনেক হাদীসেই আমি দেখেছি) বলছে,رهبان بالیل لیوث بالنّهار রাত্রিতে তারা দুনিয়াত্যাগী উপাসক অর্থাৎ রাত্রি যখন আসে তখন তাদেরকে দেখলে মনে হয় একদল খোদা উপাসক আবার যখন দিনে তাদেরকে দেখবে তখন তারা যেন একদল সিংহ।

ইসলামের ইতিহাসের নমুনা

রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবীরা কিরূপ অবস্থায় ছিলেন সে ব্যাপারে আল কাফীর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস (মাওলানা রূমী তা কবিতায় বর্ণনা করেছেন) যা শিয়া-সুন্নী হাদীস বর্ণনাকারীরা সবাই বর্ণনা করেছেন,খুবই শিক্ষণীয়।

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ফজরের নামাজের পর আসহাবে ছোফফার নিকট গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ প্রায়ই তাদের দেখতে যেতেন। সে দিন হঠাৎ এক যুবকের উপর রাসূলের চোখ আটকে গেল। তিনি দেখলেন এ যুবকের মধ্যে অন্য রকম অবস্থা বিরাজ করছে- পা দু টি টলায়মান,চোখ দু টি কোটরের মধ্যে ঢুকে গেছে। তার রং ও স্বাভাবিক নেই।

তার কাছে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্ জিজ্ঞেস করলেন,کیف أصبحت কিরূপে রাত কাটিয়েছ? সে জবাব দিল,أصبحت موقنا یا رسول الله হে রাসূলুল্লাহ্! এমনভাবে সকালে প্রবেশ করেছি যে,ইয়াকীনের অধিকারী হয়েছি। যা আপনি মুখে বলেছেন ও আমি কান দিয়ে শুনেছি তা এখন চোখ দিয়ে দেখতে পাই। রাসূল চাইলেন সে আরো কিছু বলুক। তিনি বললেন, সব কিছুরই আলামত (চিহ্ন) থাকে। তোমার ইয়াকীনের আলামত কি?

সে বলল,إنّ یقینی یا رسول اله  هو الذی أحزننی و أسهر لیلی و أظمأ هوا جری আমার ইয়াকীনের আলামত হলো দিনগুলো আমাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে আর রাতগুলো আমাকে জাগ্রত করে রাখে (অর্থাৎ দিনে রোযা আর রাত্রিতে ইবাদত আমার ইয়াকীনের আলামত। আমার ইয়াকীন আমাকে রাত্রে বিছানায় শুতে দেয় না,আর দিনগুলোতে খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত রাখে।) রাসূল বললেন, এটা যথেষ্ট নয়,আরো কোন আলামত আছে কি? সে বলল, হে রাসূলুল্লাহ্! যদিও এখন এ পৃথিবীতে আছি কিন্তু ঐ দুনিয়াকে (অর্থাৎ আখেরাত) দেখতে পাই,সেখানকার শব্দ শুনতে পাই। বেহেশত থেকে বেহেশতবাসীদের কণ্ঠ আর জাহান্নাম থেকে দোযখবাসীদের চীৎকার শুনতে পাই। ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি অনুমতি দেন,তবে আপনার সাহাবীদের একে একে পরিচয় বলে দিই,কে বেহেশতী,আর কেজাহান্নামী। রাসূল বললেন, নীরব হও। আর কোন কথা বল না। মাওলানা রূমী বলছেন,

বললেন রাসূল সাহাবী যায়েদকে কিভাবে রাত কাটিয়েছো বন্ধু হে!

ইয়াকীনের অধিকারী হয়ে বলল সে।

পুনঃ শুধায় চিহ্ন সে বাগানের দেখাও আমায়।

বলে তৃষ্ণার্ত আমি এই দিনগুলোতে হায়,

না ঘুমিয়ে কাটাই কষ্ট আর ভালবাসায়।

বললেন বল যা অর্জন করেছো তায়,

তা থেকে যেন বুঝতে পারে এরা সবাই।

বলল দু সৃষ্টি যখন দেখে এ আকাশ,

আমি দেখি তার অধিবাসীদের যেথায় বাস।

বলব কি কিছু কথা রয়েছে খাছ

ঠোঁট কামড়ে বলেন রাসূল,হয়েছে ব্যাস।

অতঃপর রাসূল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ইচ্ছা কি? কি করতে চাও? সে বলল, ইয়ারাসূলাল্লাহ্! আল্লাহর পথে শাহাদাত বরণ করতে চাই।

তার ইবাদত আর ইচ্ছা হলো এ রকম,তার রাত্রি হলো ইবাদত,আর দিন জিহাদ আর শাহাদাতের জন্য। এটাই ইসলামের কথিত মুমিন,ইসলামের মানুষ। দু টি ভিন্নমুখী কষ্ট,কিন্তু দ্বিতীয় কষ্টটি তার প্রথম কষ্ট থেকে উৎসারিত। আর সেটা হলো স্রষ্টাকে পাওয়ার বেদনা।

আমার বক্তব্যের শুরুতে যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছি তা হলো :

) وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ(

কোরআনের বর্ণনা সত্যিই আশ্চর্যজনক। বলছে, হে ঈমানদারগণ! নামাজ ও ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য চাও। তাফসীরকারগণ বলছেন,ধৈর্যের অর্থ রোযা,যেহেতু রোযা এক ধরনের সবর। তাই নামায ও রোযা থেকে সাহায্য নাও। নামায থেকে কি ধরনের সাহায্য পাওযা যায়? আল্লাহর ইবাদত ও উপাসনার মাধ্যমে কি শক্তি পাওয়া যায়? উত্তর আল্লাহর ইবাদত নিজেই একটি শক্তি। প্রকৃত পক্ষে যেকোন প্রেরণাই এখান থেকে পাওযা যায়। যদি আপনি চান সমাজে প্রকৃত মুসলমান হিসেবে থাকবেন,যদি চান একজন সংগ্রামী হতে,তবে অবশ্যই আপানাকে প্রকৃত নামাযী হতে হবে।

অনেকে বলেন,নামায পড়ার কি আছে? ইবাদতের প্রয়োজন কি? এগুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাজ। যুবকদের অবশ্যই সামাজিক হতে হবে। এগুলো এক ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কথা যার নজীর ইতিহাসে পুরাতন। হয়তো জানেন,হযরত উমর (হাইয়া আলা খাইরিল আমাল) বাক্যটিকে আযান থেকে প্রত্যাহার করেন। কেন? তার নিজের যুক্তিতে মনে হয়েছে এটা করা দরকার। যেহেতু তার শাসনকাল ইসলামের বিজয় ও সংগ্রামের সময় এবং মুসলমানদের দলে দলে যুদ্ধে যোগদান করতে হচ্ছে,অল্প সৈনিক নিয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্যের মোকাবিলায় জয়ী হতে হবে (কখনো সমগ্র যোদ্ধা মুসলমানের সংখ্যা পঞ্চাশ বা ষাট হাজার আর তা নিয়ে রোম বা পারস্য সাম্রাজ্যের লক্ষসৈনিকের মোকাবিলায় দাঁড়াতে হয়েছে),তাই মুজাহিদদের নিকট যুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যখন মুয়াজ্জিন আযানের সময় চীৎকার করে আল্লাহু আকবার ও দু শাহাদাতের পর(হাইয়া আলাস সালাহ্-নামাযের দিকে এসো) এবং (হাইয়া আলাল ফালাহ-কল্যাণেরদিকে এসো) বলে,তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই কিন্তু হাইয়া আলা খাইরিল আমাল (সর্বশ্রেষ্ঠ আমলের দিকে এসো) যার অর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো নামায,এটা বলা হবে তখন মুজাহিদদের মনদুর্বল হয়ে যাবে। কেননা তাদের নিজেদের কাছে মনে হবে নামায যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আমরা যুদ্ধের ময়দানে বা জিহাদে যাওয়ার চেয়ে মদীনার মসজিদে বসে নামায পড়ি,কি প্রয়োজন অন্যদের হত্যা করে,নিজেদের নিহত হতে দিয়ে,আহত হয়ে,কারো চোখ অন্ধ হবে,কারো হাত বা পা কাটা যাবে,অভুক্ত থাকার কষ্ট করতে হবে,বরং আমরা এখানে স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের পাশে বসে চার রাকাত নামায পড়ে তাদের চেয়ে উত্তম হতে পারি। তাই আযান থেকে এ অংশটি বাদ দিতে হবে। তার চেয়ে বরং বলব (আস সালাতু খাইরুম মিনান নাওম-নামায ঘুম থেকে উত্তম)। যখন ঘুমাব তখন মনে করতে হবে ঘুমানোর চেয়ে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ি।

কিন্তু এ রহস্য আমাদের জানতে হবে কোন্ শক্তির বলে মুসলমানরা (যাদের সংখ্যা এক লক্ষেরও কম) তাদের থেকে কয়েকগুণ শক্তিশালী (সংখ্যায় কয়েক লক্ষ) প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। এ জয় কিরূপে সম্ভব অনেকেই চিন্তা করে দেখেনি। এ জয় তো অস্ত্রের বলে নয়। যদি তাই হতো তবে আরবদের অস্ত্র কি রোমানদের বা পারসিকদের চেয়ে অধিক ধারালো ছিল? অবশ্যই নয়। বরং রোমান ও পারসিকরা সমসাময়িক যুগের শ্রেষ্ঠ অস্ত্রের অধিকারী ছিল। অপর পক্ষে আরবদের অস্ত্র সেরকম ছিল না। জাতি হিসেবেও আরবরা কি রোম ও ইরানের মোকাবিলায় শক্তিশালী ছিল? অবশ্যই নয়। শাপুর জুল আকতাফ ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদের পদদলিত করেছিল। শত-সহস্র আরবকে বন্দিকরে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কপালে কালিমা লেপন করে দিয়েছিল। তখন আরবদের শক্তি কোথায়ছিল? কিন্তু মাত্র একশ বছর পর সেই আরবরাই ইরানকে পরাজিত করেছিল। তাহলে কোন্ শক্তির বলে আরবরা ইরান ও রোমের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ের মালা পড়েছিল আর তাদের মুখে পরাজয়ের চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল? এ শক্তি ঈমানের শক্তি ছিল। যে শক্তি সেحی علی خیر العمل থেকে লাভ করেছে। তার নামায থেকে সে এ শক্তি অর্জন করেছে স্রষ্টার কাছে একান্ত প্রার্থনার মাধ্যমে। কোরআনে বর্ণিত মানুষ রাত্রিতে তার স্রষ্টার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মনের গোপন আকাঙ্ক্ষাপেশ করে,তার নিকট এ শক্তি চায়। সেই মহান প্রভু থেকেই সে এ আত্মিক শক্তি লাভ করেছে অর্থাৎ আরবরা যখন স্রষ্টার নিকট থেকে এ আত্মিক শক্তি অর্জন করেছে তখন এর বলেই সে ইরান ও রোমকে পরাজিত করেছে। এ আত্মিক শক্তি সে কিভাবে পেয়েছে? তার ঈমান থেকে পেয়েছে। নামায কি? নামায হলো ঈমানের ঝালাই। নামাযের আল্লাহু আকবার থেকেই সে এ শক্তি অর্জন করেছে। যখন সে নামাযে কয়েকবার বলে, আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ ,তখনই অনুভব করে বাকী সকল কিছুই তুচ্ছ। যখন যুদ্ধের ময়দানে কয়েকলক্ষ যোদ্ধাকে তাদের মোকাবিলায় দেখে তখন বলে, লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিলআলিয়্যিল আজিম। সকল ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। মানুষের অবশ্যই তার উপর নির্ভর করা উচিত। তার থেকে শক্তি ও সাহায্য চাওয়া উচিত। নামাযই তাকে এ শক্তি ও সাহস দান করেছে। যদি এ নামায না থাকতো তবে এ ধরনের মুজাহিদ (জিহাদকারী) যোদ্ধা তৈরি হতো না।

ইসলাম কি এটা বলে না যে,ইসলামের বিধি-বিধান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার উপর জিহাদ ফরয করা হয়েছে তার নামাযের জন্য মদীনার মসজিদে পড়ে থাকা হারাম। তাকে অবশ্যই জিহাদের জন্য যেতে হবে। তার নামায কবুল হওয়ার শর্ত হলো জিহাদ। আবার জিহাদ কবুল হওয়ার শর্তও নামায। কোন মুজাহিদের জন্য শর্তাবলী উপস্থিত হলে তার জন্য জিহাদ ফরয। কিন্তু তাকে বলতে হবে,ইসলাম বলে নামায ব্যতীত জিহাদ বাতিল ও মূল্যহীন,তেমনি জিহাদ ব্যতীত নামাযও বাতিল। তখন এটা খাইরুল আমাল বা সর্বোত্তম ইবাদত না হয়ে শাররুল আমাল বা নিকৃষ্ট ইবাদতে পরিণত হবে। নামায মুসলমানকে ইসলাম কি তা শেখায়। যে নামায মুসলমানকে জিহাদ থেকে পালানোর জন্য মসজিদে বসে থাকার কথা বলে সেটা ইসলামের নামায নয়। ইসলামের নামায সর্বোত্তম কর্ম (খাইরুল আমাল)। তাই এটা ঠিক নয় যে,حی علی خیر العمل -কে আযান থেকে এ যুক্তিতে বাদ দেয়া হবে যে,এর খারাপ প্রভাব রয়েছে,যেহেতু মুসলমানরা জিহাদ বাদ দিয়ে নামায পড়তে যাবে। এটা ভুল। এটাই ইসলামের যুক্তি। বর্তমানের পরিভাষায় যদি বলি,ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতে সকল মূল্যবোধের মূল্য ইবাদতে নিহিত,তবে বলতে হবে সে ইবাদত হলো শর্তযুক্ত ইবাদত। কোরআন আমাদের বলছে নামায তখনই নামায হবে যখন তার প্রভাব স্বতঃপ্রকাশিত। কিরূপে তা প্রকাশিত হবে? নিশ্চয়ই নামায মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। প্রকৃত নামায এটাই যা মানুষকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যদি দেখ নামায পড়ছ সে সাথে অন্যায় কাজও করছ,তবে জেনে রাখ,তোমার নামায নামায নয়। সুতরাং তোমার নামাযকে ঠিক কর। নামায তোমাকে সকল মূল্যবোধ দান করবে এ শর্তে যে,তোমার নামায প্রকৃতই নামায হয়।

এ সকল শিক্ষা হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে শিক্ষণীয়। আলী (আ.) ইসলামের সকল মূল্যবোধের সমষ্টি। নাহজুল বালাগাহ্ তার বাণী। যা এমন এক গ্রন্থ মানুষ এর যেখানেই লক্ষ্য করে যেন নতুন এক যুক্তি খুজে পায়,খুজে পায় নতুন এক মানুষকে- এর প্রতিটি অধ্যায়ে যেন নতুন নতুন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রতিটি স্থানেই আলী (আ.) সামগ্রিক মূল্যবোধের প্রতিভূ এক ব্যক্তিত্ব। কোথাও তার যুক্তি বীরোচিত যেন এক নবযুবক যে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ করে সমর নেতা হয়েছে;যে সমরবিদ্যা ছাড়া কিছুই বোঝে না। কোথাও সে আলীকেই মনে হবে এক আরেফ ও সূফী যে স্রষ্টার সঙ্গে গভীর প্রেমে লিপ্ত,অন্য কিছুর প্রতি তার খেয়াল নেই।

আলী (আ.)-এর পৌরুষত্ব ও সাহসিকতা

আজ একুশে রমযানের রাত হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের রজনী। যাতে ইসলামের বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারি এজন্য নাহজুল বালাগায় দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের আলীর পরিচয় রয়েছে এমন দু টি অংশ থেকে আলাচনা রাখছি। সিফফিনের যুদ্ধে আলী (আ.)-এর সৈন্যরা ফোরাত কিনারায় পৌছার পূর্বেই মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী সেখানে পৌছায়। মুয়াবিয়া নির্দেশ দেয় পানির পথগুলো আলী ও তার সৈন্যদের জন্য বন্ধ করে রাখতে। আলীর সৈন্যদের পরাস্ত করার খুব ভালো এক কৌশল হস্তগত করেছে এটা ভেবে মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনী মনে মনে খুব আনন্দিত হলো। হযরত আলী যখন সেখানে পৌছে এ অবস্থা দেখলেন তখন বললেন,পরস্পর আলোচনা করে বিষয়টি ফয়সালা করবেন যাতে করে এ বিষয়টি নিয়ে দু পক্ষের মুসলমানদের মধ্যে রক্তক্ষয় না হয়। তাই মুয়াবিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা এখনও এসে পৌছাইনি,তুমি এ ধরনের কাজ করলে! (পানি পথ ছেড়ে দাও যাতে এ পক্ষও পানি পায়)। মুয়াবিয়া পরামর্শ সভা ডেকে নিজের সেনাপ্রধানদের কাছে পরামর্শ চাইল। কেউ বলল পানির পথ ছেড়ে দেয়াই উত্তম,কেউ বলল,না। আমর ইবনে আস বলল, ছেড়ে দাও। কারণ যদি তুমি না ছাড় তবে বল প্রয়োগে তোমার নিকট থেকে সে নিয়ে নেবে। তখন তোমার সম্মান ভূলুন্ঠিত হবে। কিন্তু মুয়াবিয়া সিদ্ধান্ত নিল পানি পথ ছাড়া হবে না। তখন হযরত আলী (আ.) তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক বিপ্লবী ভাষণ দিলেন যার প্রভাব শত রণতুর্য আর দামামা থেকেও অনেক বেশি। তিনি বললেন, তারা যুদ্ধ চায়,এখন তোমরা ভেবেদেখ অপমান ও অমর্যাদাকে গ্রহণ করে সাহস ও সম্মান হারাবে,নাকি তোমাদের তরবারীকে তাদের রক্তে পূর্ণ করে নিজেরা পানির তৃষ্ণা মেটাবে। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৫১)

মুয়াবিয়া তোমাদের জন্য পানি বন্ধ করেছে। আমার সহযোগীরা! তোমরা তৃষ্ণার্ত। পানি চাও। আমার কাছে এসেছ,পানি চাও। যদি পানি চাও তবে কি করা উচিত? তোমাদের তরবারীগুলোকে প্রথমে এই শত্রুদের দূষিত রক্ত দ্বারা পূর্ণ কর। তারপর নিজেরা তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারবে। এর পর এমন এক বাক্য উচ্চারণ করলেন যা সবার মধ্যে উত্তেজনা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করল। জীবন ও মৃত্যুকে যুদ্ধ ও বিপ্লবের ভাষায় সংজ্ঞায়িত করলেন। হে জনগণ! জীবন কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি? মৃত্যু কি? বেঁচে থাকার অর্থ কি পৃথিবীর উপর বিচরণ,খাদ্য গ্রহণ আর বিশ্রাম? মৃত্যুর অর্থ কি কবরে শয়ন? না,ঐ জীবনকেও জীবন বলা যায় না,ঐ মৃত্যুকেও মৃত্যু বলা যায় না।

فالموت فی حیاتکم مقهورین و الحیات فی موتکم فاهرون

  জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর মৃত্যু হলো বেঁচে থাকা,কিন্তু অপরের অধীনে থাকা।

এ বাক্যটি কতটা বিপ্লবী ও উঁচু পর্যায়ের! এরপর কি শক্তির মাধ্যমে আলী (আ.)-এর সৈনিকদের প্রতিরোধ করা সম্ভব? কিছুক্ষণের মধ্যেই আলীর সেনাবাহিনী হামলার মাধ্যমে মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনীকে নদীকূল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিতাড়িত করল। আলীর সহযোগীরা নদীকূলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল। এবার মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী পানির জন্য আবেদন করল। আলীর সৈন্যরা বলল, অসম্ভব। আমরা পানি দিতে রাজী নই। আমরা প্রথমে এ ধরনের কাজ করিনি,বরং তোমরাই এ পথ বেছে নিয়েছিলে। হযরত আলী এ কথা শুনে বললেন, না,আমি পানি বন্ধ করতে রাজী নই। কারণ এ কাজ কাপুরুষোচিত। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাথে মোকাবিলা ভিন্ন কথা। কিন্তু এপথে জয়লাভ করা কোন সম্মানিত মুসলমানের জন্য ঠিক নয়। এটাকেই বলে পৌরুষত্ব। পৌরুষত্ব সাহসিকতার থেকেও উচ্চ পর্যায়ের। হযরত আলীকে উদ্দেশ্য করে মাওলানা রুমী কত সুন্দর বলেছেন (হযরত আলীর শানে ও প্রশংসায় রচিত তার শ্রেষ্ঠ কবিতা)!

সাহসিকতায় তুমি শেরে খোদা জানি

পৌরুষত্বে কি তুমি,জানেন শুধু অন্তর্যামী।

অর্থাৎ সাহসিকতায় তিনি শেরে খোদা সকলে জানলেও পৌরুষত্বে কেউই আলীকে চিনতে পারেনি। এখানে আমরা হযরত আলীকে তার এক বিশেষ রূপে দেখতে পাই।

হযরত আলী (আ.)-এর মোনাজাত

যখন আলী (আ.) মানুষ থেকে দূরে- একান্তে স্রষ্টার সাথে ইবাদত ও গোপন সংলাপে লিপ্ত তখন দেখি অন্য এক আলী। যেমন নাহজুল বালাগায় পাই

اللهم انّک آنس الآنسین لاولیائک

হে আল্লাহ্! আপনি আপনার আউলিয়াদের নিকটতম বন্ধুর থেকেও নিকটে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ কোন বন্ধুর সঙ্গেই আপনার মতো নৈকট্য অনুভব করি না। আপনি আমার নিকটতম সাথী। আপনি ব্যতীত যার সঙ্গেই থাকি যেন একাকিত্ব অনুভব করি। শুধু যখন আপনার সঙ্গে থাকি তখনই অনুভব করি নিকটতম কারো সঙ্গে আছি।

و احضرهم بالکفایة للمتوکلین علیک

যে কেউ আপনার প্রতি নির্ভর করে,অনুভব করে অন্য সকল কিছুর থেকে আপনি তার নিকটতর উপস্থিত অস্তিত্ব যেন আপনি আপনার উপর নির্ভরকারী ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হন।

تشاهدهم فی سرائرهم و تطلع علیهم فی ضمائرهم و تعلم مبلغ بصائرهم

হে প্রভূ! আপনি আপনার বন্ধু ও প্রেমিকদের হৃদয়ের অন্তস্তলের রহস্যও পর্যবেক্ষণ করেন এবং তাদের অন্তঃকরণের অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কেও অবহিত। তাদের জ্ঞান ও অন্তদৃষ্টি কোন্ পর্যায়ে অবস্থান করছে তাও আপনার জানা।

فاسرارهم لک مکشوفه و قلوبهم إلیک ملهوفة

তাদের রহস্য আপনার নিকট প্রকাশিত ও তাদের অন্তর আপনার প্রতি উড্ডয়নশীল।

আলী (আ.)-এর দোয়াগুলোর মধ্যে দোয়ায়ে কুমাইল জুমআর রাতগুলোতে পড়বেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ দোয়াটি পড়ুন। দেখবেন,না এর মধ্যে দুনিয়া আছে,না আখেরাত (আখেরাত বলতে বেহেশত ও দোযখ)। যা দেখবেন তা দুনিয়া ও আখেরাতের ঊর্ধ্বে। স্রষ্টার সাথে একজন খাঁটি বান্দা,উপাসক ও প্রেমিকের সম্পর্ক এটাই যে,তার প্রেমে নিমগ্ন থাকবে। প্রকৃত ইবাদত এটাই। আলী নিজেই তা বলছেন। দোয়ায়ে কুমাইলে আলী (আ.) নিজের স্রষ্টার সাথে কিরূপে কথোপকথন করছেন লক্ষ্য করুন,কিভাবে মোনাজাত করছেন দেখুন,তেমনিভাবে ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) রমযানমাসের সুবহে সাদিকের পূর্বে সেহরীর সময় কিভাবে আল্লাহর নিকট আবেদন-নিবেদন করছেন তা আবু হামযা সোমালীর দোয়ায় লক্ষ্য করুন। মুসলমানের প্রথম ধাপ এটাই যে,সে তার স্রষ্টার নিকটবর্তী হবে। স্রষ্টার নৈকট্যের মাধ্যমেই অন্যান্য দায়িত্ব,বিশেষ করে সামাজিক দায়িত্বসমূহ সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতে পারব।

আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে আমাদের প্রবণতাগুলো এককেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে- যে সমস্যায় বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ্ আক্রান্ত। আমাদের এ এককেন্দ্রিকতা পরিহার করে সামগ্রিকতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। ইবাদতের গুরুত্বকে কম করে দেখলে চলবে না। ইমাম সাদিক (আ.) তার মৃত্যুলগ্নে তার সকল নিকটাত্মীয়কে ডেকে সমবেত করে একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে বিদায় নেন। তিনি বলেন, যারা নামাযকে ছোট করে দেখে (কম গুরুত্ব দেয়),আমার শাফায়াত তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।


8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27