ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 7%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42386 / ডাউনলোড: 7058
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

মানুষের প্রকৃত সত্তা

এখানে আরেকটি বিষয় যা নব্য দার্শনিকদের মধ্যেও প্রশ্ন হিসেবে এসেছে তা হলো মানুষের প্রকৃতসত্তা কোনটি? এ ক্ষেত্রে দর্শনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তাদের মতে মানুষের সত্তা হচ্ছে তার আত্মা ও অহম যাকে সে অনুভব করে। মানুষ তার সত্তাকে অনুভব করে অর্থাৎ তার আত্মাকে অনুভব করে। যখন তাকে বলা হয়,আমিত্ব কি? তখন সে বলে,আমার আত্মা।

মনস্তত্ত্ব বা মনোবিজ্ঞান বর্তমানে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছে যে,মানুষ আমিত্ব বলতে যা বুঝে বা অনুভব করে তা তার আমিত্বের একটি অংশ মাত্র। মানুষের আমিত্বের একটি বিরাট অংশ তার এ সত্তার অসচেতন অংশ যেটা সম্পর্কে সে নিজেই সচেতন নয়। অর্থাৎ বাহ্যিক অনুভূতির পরিসীমায় এ আমিত্বের অস্তিত্ব নয়। আরেফগণ এ ক্ষেত্রে সত্যিই অলৌকিকত্ব দেখিয়েছেন। মনোবিজ্ঞান হতে তারা উচ্চ পর্যায়ে এবং গভীর ও যথার্থভাবে একে ব্যাখ্যা করেছেন। দার্শনিকদের বিরোধিতা করে তারা বলেছেন,দর্শন ভুল করে বলেছে যে,মানুষের সত্তা হলো তার আত্মা। বরং মানুষের আমিত্ব এর থেকে আরো সূক্ষ্ম বিষয়। শাবেস্তারী বলেছেন,

মানবাত্মা দেহ ও প্রাণ হতে ঊর্ধ্বে জেন,

দেহ ও প্রাণ তারই অংশ যদি তা মানো।

অবশ্য আরেফগণ বলেন,মানুষ তখনই তার প্রকৃত সত্তায় পৌছতে পারে যখন সে তার স্রষ্টাকে চিনতে ও তার পরিচয় লাভ করতে পারে। আমার আত্মপরিচয় কখনই স্রষ্টার আত্মপরিচয় থেকে ভিন্ন নয়। যেমন কোরআন বলছে,

) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّـهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ(

তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে,ফলে তিনিও তাদের আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। (সূরা হাশর : ১৯)

আরেফগণ বিশ্বাস করেন,মানুষের প্রকৃত সত্তা দর্শন যা বলে তা থেকে অনেক সূক্ষ্ম। শাবেস্তারী এরফানের জনক মহিউদ্দিন আরাবীর অনুকরণে তা-ই বলেছেন।

মাওলানা রুমী সুন্দরভাবে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,

যে জন আপন সত্তা যুদ্ধে হারায়

সে জন পারে না দিতে অন্যেরে আপন পরিচয়

যে রূপেই আসে সে দিতে পরিচয়

কসম করে বলতে পারি সে তা নয়।

যে ব্যক্তি তার সত্তাকে হারিয়েছে,বাজীতে সে সর্বোত্তম বস্তুকে হারিয়েছে। কোরআনও এরূপ বলেছে,قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِ‌ينَ الَّذِينَ خَسِرُ‌وا أَنفُسَهُمْ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সে সব ব্যক্তি যারা নিজেদের সত্তাকে হারিয়েছে। (সূরা যুমার : ১৫)

মাওলানা রুমী অতঃপর তার এ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে দলিল হিসেবে বলছেন,

ক্ষণিক যদি হয়ে পড়ে সে একা বঞ্চিত

জগতের কষ্ট করে তারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।

তিনি বলছেন,যখন একাকিত্ব বরণে সে বাধ্য হয় তখন এ একাকিত্বকে সে ভয় পায়। আমাদের মধ্যে ক জন এরূপ আছেন যে,দশ দিন একাকী থাকব কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়ব না। জেলখানার এক সেলে কাউকে একা বন্দি করে রাখলে তার জন্য তা সবচেয়ে বড় শাস্তি। যদি মানুষ নিজেকে প্রকৃতই চিনত তবে এরূপ অনুভব করত না।

কখন তুমি হবে সেই একক ব্যক্তি

আপন সত্তায় মুগ্ধ ও সুন্দর অভিব্যক্তি।

যদি তুমি নিজেকে উদাহরণ করতে পারতে তবে একাকিত্বের সময় কারো প্রয়োজন অনুভব করতেনা। বরং আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ ও বিভোর হতে। নিজেকে হারিয়েছ বলেই নিজের সত্তাকে অনুভব করনা ও একাকিত্বে ভয় পাও।

নিজের প্রকৃত সত্তাকে জানা ও উদ্ঘাটন আল্লাহর প্রতি মনঃসংযোগ ও ইবাদতের প্রাণ। মানুষ ইবাদতের মধ্যেই তার প্রকৃত সত্তা ও স্রষ্টার সান্নিধ্যকে অনুভব করে। সুতরাং আরেফগণ এ পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টিকে অনুধাবন করেছেন। কিন্তু নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়ে এরফান আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধের (মূলত যার উপর ভিত্তি করে মানুষ উচ্চ পর্যায়ে পৌছতে পারে) প্রতি খুব কমই দৃষ্টি দিয়েছেন। এত কম দৃষ্টি দিয়েছেন যে,বলা যায় একেবারেই নেই। যদি ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব আরেফগণ তাদের সকল দিক-নির্দেশনা ইসলাম থেকেই গ্রহণ করেছেন,কিন্তু এ দিক-নির্দেশনার প্রতি কম দৃষ্টি দিয়েছেন। সম্ভবত এ বিষয়টিকে তারা তেমনভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কোরআন ও হাদীসে আত্মমর্যাদাবোধ

ইসলামে যেমন প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামের নির্দেশ সম্বলিত বাণী- উদাহরণস্বরূপ-

موتوا قبل أن تموتوا، إنّ النّفس لامّارة بالسوء نهی النّفس عن الهوی এবংقَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا রয়েছে তেমনি আত্মমর্যাদাবোধের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। তার নমুনা হচ্ছে সূরা মুনাফিকুনের এ আয়াত-وَلِلَّـهِ الْعِزَّةُ وَلِرَ‌سُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ সম্মান আল্লাহ্,তার রাসূল ও মুমিনদের জন্য। কোরআন বলেনি যে,আত্মমর্যাদাবোধ আত্মপূজার শামিল। মানুষ যেহেতু প্রকৃতিগতভাবেই অন্য মানুষের মুখাপেক্ষী তাই প্রয়োজন উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি (আত্মসম্মানবোধ) লক্ষ্য রাখার জন্য উপদেশ দিয়ে রাসূল (সা.) বলেছেন,اطلبوا الحوائج بعزّة الآنفس তোমার প্রয়োজনকে আত্মসম্মান বজায় রেখে চাও অর্থাৎ কারো নিকট ব্যক্তিত্ব হানী করে কিছু চেয়োনা। তাতে তোমার সম্মান থাকবে না। প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অজুহাতে ভিক্ষুকের মতো কারো নিকট কিছু চাইবে না। কারণ ইসলাম তার অনুমতি দেয় না। যদি প্রয়োজনে মানুষের দ্বারস্থ হতে হয় তাহলে আত্মসম্মান বজায় রেখে তা চাও ও নাও।

লক্ষ্য করুন আলী (আ.) যুদ্ধের ময়দানে কি বলছেন,

فالموت فی حیاتکم مقهورین و الحیاة فی موتکم قاهرین

তোমাদের প্রকৃত মৃত্যু অন্যের আনুগত্যের মধ্যে বেঁচে থাকা এবং প্রকৃত জীবন হলো স্বাধীনভাবে মৃত্যু লাভের মধ্যে। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৫১) এখানে তিনি আত্মমর্যাদাবোধের কথাই বলেছেন।

কাঁদিয়ে বন্ধুদের তুমি মৃত্যুকে করেছ বরণ

হাসত দুশমন যদি বেঁচে করতে কারাবরণ।

আমার ঘৃণা সেই জীবনের প্রতি

যদি বেঁচে থেকে করি স্বীকার শত্রুর নতি।

ইমামা হুসাইন (আ.) বলেন,موت فی عزّ خیر من حیاة فی ذلّ সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু অসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা অপেক্ষা উত্তম। (মুলহাকাতু ইহকাকিল হাক্ব) ইমাম হুসাইনের দর্শন এটা বলে না যে,নাফসের সাথে সংগ্রামের অজুহাতে ইয়াযীদ ও ইবনে জিয়াদের নিকট আত্মসম্মানকে বিকিয়ে দিতে হবে। তাই তিনি বলছেন,

الا و انّ الدّعیّ ابن الدّعی قد رکز بین السلّة و و الذلّة و هیهات منّا الذلة یابی الله ذلک لنا و رسوله و المؤمنون و حجور طابت و طهرت

জিয়াদের পুত্র,এই কাপুরুষের পুত্র কাপুরুষ আমাকে এ দু শর্তের মধ্যে ফেলেছে,হয় অপমানকে গ্রহণ করব (বাইয়াত করব),নতুবা যুদ্ধ। অপমান আমাদের থেকে দূরে। আল্লাহ্,তার রাসূল (সা.)এবং মুমিনীন আমাদের জন্য তা কখনও মেনে নিতে পারে না। (লুহুফ ইবনে তাউস,পৃ. ৮৫)

এ কথার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করছেন না,বরং বলতে চাচ্ছেন,আমার দীন আমাকে এ অনুমতি দেয় না,আমার স্রষ্টা এ কাজকে অনুমোদন করেন না। নবীও তা চান না। যে পিতা-মাতার ক্রোড়ে আমি মানুষ হয়েছি তারা তা পছন্দ করেন না। আমি হযরত ফাতেমা যাহরার দুগ্ধে প্রতিপালিত হয়েছি। এ দুগ্ধ আমাকে এ কাজের অনুমতি দেয় না। ফাতেমা (আ.) আমাকে ডেকে যেন বলছেন : হুসাইন! তুমি আমার দুগ্ধে মানুষ হয়েছ,যে আমার দুগ্ধে প্রতিপালিত হয়েছে সে অপমানকে মেনে নিতে পারে না। তাই ইমাম হুসাইন বলেননি, ইবনে জিয়াদ যা করার করুক,চলো আমরা তার বাইয়াত গ্রহণ করি। সে তো আমাদের অপমান ছাড়া কিছু করবে না। যত অপমান হবে তত নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হবে। না,তিনি কখনই তা করতে পারেন না। বরং বলেছেন,لا والله لااعطیکم بیدی اعطاع الذّلیل و لا افرّ فرار العبید আমি কখনই তোমাদের দিকে অপমানের হাত প্রসারিত করব না। কোন দাসের মতো পলায়ন করব না। অন্য রেওয়ায়েতে কোন দাসের মতো স্বীকার করবনা এসেছে। এ ধরনের বক্তব্য কোরআনে এবং ইমামগণের বাণীতে বিশেষত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কথায় প্রচুর এসেছে।

যুবকদের প্রতি উপদেশ

জাভিদ মসজিদে আমি যে বিষয়টি বলেছি এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি। সেখানে এক বৈঠকে ইমাম হুসাইনের বাণী বলে প্রচারিত জীবন বিশ্বাস (আকীদা) ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় কথাটি যে ইমাম হুসাইনের নয় তা বলেছি। কারণ কোন ইসলামী গ্রন্থেই এর পক্ষে কোন দলিল নেই। এ বাক্যের অর্থও সঠিক নয় এবং ইমাম হুসাইনের যুক্তির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামের যুক্তি এরূপ নয় যে,মানুষ তার জীবনের জন্য কোন বিশ্বাসকে গ্রহণ করবে এবং তার জন্য সংগ্রাম করতে থাকবে। ইসলামে বিশ্বাসের চেয়ে সত্যের প্রতি গুরুত্ব অধিক। তাই জীবনের অর্থ সত্যের অনুসন্ধান এবং সত্যের জন্য সংগ্রাম। বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম একটি পাশ্চাত্য চিন্তাপ্রসূত বিষয় যা পাশ্চাত্যে ছিল এবং পরবর্তীতে মুসলমানদের মধ্যে প্রচার লাভ করেছে।

তোমার চিন্তাকে তোমার জীবনের জন্য হাতিয়ার হিসেবে ধর এবং এর দ্বারা সংগ্রামে লিপ্ত হও। জীবন আকীদা ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়- এ কথাগুলো যে ইমাম হুসাইন থেকে নয় তা বলায় কিছু যুবক মর্মাহত হয়েছে। কারণ এ বাক্যগুলোকে তারা পছন্দ করেছে এবং ভাবছে যদি তা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে হয় তাহলে কত উত্তম! প্রথমত আমি আমাদের পূর্বসূরিদের মতো যুবকদের ও সত্যানুসন্ধানী বলে সম্মানের পাত্র বলে মনে করি। যুক্তিহীনভাবে কোন বিশ্বাসের প্রতি গোঁড়ামি পছন্দনীয় নয়। যদি এমন হয় যে,নতুন প্রজন্মের মাথায় কিছু ঢুকলে তা বের করা সম্ভব হয় না,সে বিষয়ে কথা বলা যায় না,তবে এ প্রজন্মকে স্থবির প্রজন্ম বলতে হবে। তাহলে দেখা যাবে একজনের একটি কথা ভাল লেগেছে সে সেটা আঁকড়ে ধরবে,অন্য জন অন্য একটি কথাকে অনুরূপভাবে।

দ্বিতীয়ত এখন তোমরা তোমাদেরই এক বন্ধুর মুখে শুনতে পেয়েছ যে,এ কথাটি ইসলামের যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং কোন ইসলামী গ্রন্থে এ কথার ভিত্তি নেই। ধরা যাক,তোমাদের শত্রু ও অমুসলমান কোন ব্যক্তি তোমাদের সব সময় বলতে থাকে জীবন বিশ্বাস ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় এ কথাটি ইমাম হুসাইনের। তোমাদের প্রশ্ন করা উচিত,জনাব,ইমাম হুসাইন যা যা বলেছেন তা কোননা কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে অবশ্যই রয়েছে। ইমাম হুসাইনের এ কথাটি কোন্ গ্রন্থে রয়েছে তা আমাকে দেখিয়ে দিন যাতে করে যারা বলে এ কথাটি ইমাম হুসাইনের নয় তাদের নিকট প্রমাণ করতে পারি যে,এটা ইমাম হতে। কিন্তু কোথাও তা খুজে না পেয়ে অবশেষে আমাকে যখন বলবে, আমাদের মধ্যে প্রচলিত এ কথাটি ইমাম হুসাইনের নয় তা কেন আমাদের জানাননি? কেন আপনারা (আলেমরা)এ বিষয়ে এতদিন নীরব থেকেছেন?

তৃতীয়ত তোমরা যদি বিপ্লবী বাণীসমূহের প্রতি আসক্ত হয়ে থাক,তবে জীবন বিশ্বাস ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় -এ কথা অপেক্ষা শতগুণ বিপ্লবী বাণী ইমাম হুসাইন হতে রয়েছে। আজকের বৈঠকে ইইমাম হুসাইনের যে বাণীটি- সম্মানের মধ্যে মৃত্যু অপমানের সঙ্গে বেঁচে থাকা হতে উত্তম -পড়েছি সেটি বেশি বিপ্লবী নাকি জীবন বিশ্বাস ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় এটি? অথবা অপমান হতে মৃত্যু শ্রেয়। অপমান জাহান্নামে প্রবেশ হতে উত্তম (নাফ্সিল হুমুম,পৃ. ১২৭; বিহারুল আনওয়ার,খণ্ড ৭৮,পৃ ২১৯.)-এ কথাটি অধিক বিপ্লবী।

এরূপ অসংখ্য বিপ্লবী বাণী,যেমন এই কাপুরুষের পুত্র কাপুরুষ আমাকে দু শর্তের মধ্যে ফেলেছে- অপমান নতুবা যুদ্ধ। অপমান আমাদের কখনও স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহ্,তার রাসূল ও মুমিনগণ আমাদের জন্য কখনও তা মেনে নিতে পারে না। আমাদের হারিম পাক ও পবিত্র। (লুহুফ,পৃ. ৮৫) এবং যারা জীবনকে আমাদের জন্য উৎসর্গ করবে এবং আল্লাহর সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্যের জন্য আগ্রহী তারা আমাদের সঙ্গে আস। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি যাত্রাশীল। (লুহুফ,পৃ.৫৩; কাশফুল গাম্মা,পৃ. ১৮৪)

সুতরাং আমাদের বিপ্লবী বাণীর দারিদ্র্য নেই। যদি বিপ্লবী বাণীর দারিদ্র্য থাকত তদুপরি বলা ঠিক হতো না যে,এ বাণীটি ইমাম হুসাইনের। আল্লাহর নিকট এরূপ কর্ম হতে আশ্রয় চাই। তবে বাস্তবতো এর বিপরীত কথাই বলে। আমাদের নিকট ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে,এমনকি তার পিতা,মাতা,সন্তানদের নিকট থেকেও এত অধিক বিপ্লবী বাণী রয়েছে যে,বিশ্ব তা থেকে ধার নিতে পারে। তাই কেন আমরা অন্যদের ভ্রান্ত বাণীকে ধার করব? নতুন প্রজন্মের তাই এ গোঁড়ামি থাকা উচিত নয়।

তদুপরি আমি দাবি করছি,যদি কেউ এসে প্রমাণ করতে পারেন এ বাণীটি ইমাম হুসাইনের তাহলে এ মিম্বারে এসেই আমি ভুল স্বীকার করব। কিন্তু আমাদের অবশ্যই উচিত প্রামাণ্য কথা বলা এবং অপ্রামাণ্য কথা বলা থেকে দূরে থাকা। যেহেতু সময় শেষ হয়ে গেছে (যদিও এ বিষয়ে প্রচুর কথা রয়েছে) সেহেতু এখানেই শেষ করছি।

আমাদের আলোচনার যা মূল ছিল তা হলো সুফী সাহিত্যে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে এতটা বাড়াবাড়ি করা হয়েছে যে,কখনো কখনো আত্মসম্মানবোধের হানী হয়েছে। যদি এ বিষয়টিকে ইসলামী মানদণ্ডের সঙ্গে যাচাই করি তবে দেখব এ বিষয়টির সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

ক্ষমতার মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

) وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِ‌بِّيُّونَ كَثِيرٌ‌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِ‌ينَ(

(সূরা আলে ইমরান : ১৪৬)

পূর্ণ,আদর্শ ও উচ্চতর মানুষের বিষয়ে অন্য যে মতবাদটি প্রচলিত তা হচ্ছে ক্ষমতার মতবাদ। এ মতবাদে পূর্ণ মানব অর্থ ক্ষমতাবান ও শক্তির অধিকারী মানুষ। অন্য অর্থে এ মতবাদে পূর্ণতা ও ক্ষমতা সমার্থক এবং অক্ষমতা ও অপারগতা অপূর্ণতার সমার্থক। যে ব্যক্তি যত ক্ষমতাবান সে তত বেশি পূর্ণ এবং যে ব্যক্তি যত দুর্বল সে তত ত্রুটিপূর্ণ। সত্য ও ন্যায় ক্ষমতা ও শক্তি ব্যতীত কিছু নয়। যদি দু শক্তি পরস্পরের মোকাবিলায় দাঁড়ায় তখন আমরা জয় পরাজয়ের ভিত্তিতে নয়,বরং অন্য মানদণ্ডে বলি এ পক্ষ সত্যপন্থী ও অন্য পক্ষ বাতিল বা অত্যাচারী। কোথাও হয়তো সত্য মিথ্যা ও জুলুমকে পরাস্ত করে,কোথাও বাতিল সত্যপন্থীদের পরাজিত করে। অবশ্য কোরআনের যুক্তিতে শেষ বিজয় সত্য ও হক্বের পক্ষে। বাতিল হয়তো সাময়িকভাবে জয়লাভ করতে পারে,তবে তা চিরস্থায়ী নয়। তবে দু শক্তি যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়,যে দল জয়ী হবে তাকেই কোরআন হক্ব বলে মনে করেনা বা যে দল পরাজিত হবে তাকেও বাতিল বলে মনে করে না। কিন্তু ক্ষমতার মতবাদের দৃষ্টিতে যেদল বিপরীত পক্ষকে পরাজিত করবে সে-ই ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। শক্তিধর পক্ষ যা করবে,সেটাই ন্যায়।

ক্ষমতার মতবাদের ইতিহাস

এ মতবাদ অনেক প্রাচীন এবং এর ইতিহাস সক্রেটিসের সময়েরও পূর্বের। সক্রেটিস হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের চারশ বছর পূর্বের মানুষ। তখন থেকে ২৪০০ অথবা ২৫০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সক্রেটিসের পূর্বে একদল লোক ছিলেন দর্শনে তাদেরকে সফিস্ট বা সন্দেহবাদী বলা হয়। এঁরা সামাজিক বিষয়ে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটো ও সক্রেটিসের আবির্ভাবের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়। হযরত ঈসার আবির্ভাবের মাধ্যমে এ মতবাদের সমাধি ঘটে,যেহেতু খ্রিষ্ট মতবাদএর ঠিক বিপরীত একটি মতবাদ। অর্থাৎ খ্রিষ্ট মতবাদ ক্ষমতার বিরুদ্ধেই শুধু প্রচার চালায় না,বরং দুর্বলের পক্ষে প্রচার চালায়। খ্রিষ্ট মতবাদে বলা হয়,কেউ তোমার ডান গালে চড় বসিয়ে দিলে বাম গালটিও এগিয়ে দাও,নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করো না। এটি দুর্বলতার মতবাদের পক্ষের একটি প্রচার বৈ কিছু নয়। পৃথিবীতে ইসলামের আগমনের ফলে ক্ষমতা ও শক্তির ক্ষেত্রে অপর এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে যা স্বভাবতঃই ক্ষমতার মতবাদের পরিপন্থী যেটা বলে,হক্ব ও ন্যায়,শক্তি ও ক্ষমতা বৈ কিছু নয়। এটা পাশ্চাত্যে উদ্ভূত একটি মতবাদ যা শক্তি ও ন্যায় একই বলে জানে।

পাশ্চাত্যে কয়েক শতাব্দী পূর্বে দ্বিতীয়বারের মতো এ মতবাদ পুনর্জীবিত হয়েছে। সত্য ও ক্ষমতা সমার্থক- এ ধারণাটি প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দর্শনে আবির্ভূত হয়েছে। ম্যাকিয়াভেলী ছিলেন একজন ইতালীয় দার্শনিক। তিনি তার রাজনৈতিক দর্শনকে এ মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলেন,রাজনীতির ক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রভূত্বের যোগ্যতা। রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌছবার জন্য (প্রভুত্ব লাভ) সকল কিছুই বৈধ। মিথ্যা,প্রতারণা,ধোঁকা,মিথ্যা প্রতিশ্রুতি প্রদান,ওয়াদা ভঙ্গ- এ সবই বৈধ। তার মতে রাজনীতিতে এ সকল বিষয়কে কখনই নিন্দনীয় বলা যাবে না।

ম্যাকিয়াভেলীর পরে অন্যান্য কিছু দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে যারা এ মতবাদকে রাজনীতির বাইরেও সাধারণভাবে প্রয়োগ করে একে একটি নৈতিক ও সাধারণ নিয়মে পরিণত করেন। ফলে সর্বোচ্চ মানবিক নৈতিকতা বলতে তাদের কাছে ক্ষমতা ও শক্তিই বুঝায়। এটা তাদের পক্ষ থেকে রাজনীতিকদের জন্য একটি সবুজ সংকেত যে,যা কিছু ইচ্ছা করতে পার। নৈতিকতার আলোচনায় প্রথম এ বিষয়টি আনেন জার্মান দার্শনিক নীচে বা নীট্সে। (নীট্সে তার শেষ জীবনে পাগল হয়ে যান। আমার মতে পাগলামীর আলামত তার প্রথম জীবনেই ছিল।)

আমীরুল মুমিনীন আলী - এর ভাষায় মানুষের বেদনা ( .)

কতই না অপূর্ব বলেছেন আলী (আ.) যখন কুমাইল বিন যিয়াদ নাখীর সাথে মরুভূমির দিকে যাচ্ছিলেন! কুমাইল বলেন, যেমাত্র বিজন মরুভূমিতে পৌছলাম আলী (আ.) এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এবং বললেন :

یا کمیل بن زیاد إنّ هذه القلوب اوعیة فخیرها اوعاها فاحفظ عنّی ما أقول لک

মানুষের অন্তর পাত্র সদৃশ; আর সবচেয়ে ভাল পাত্র সেটাই যার ধারণক্ষমতা সর্বাধিক অথবা ধারণকৃত বস্তুকে উত্তমরূপে রক্ষা করে। শ্রবণ কর যা আমি তোমাকে বলছি। (প্রথমে মানুষকে তিনভাগে ভাগ করেন,যেটা আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নয়) সবশেষে বলেন,এমন কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তি নেই যে,আমার হৃদয়ের গহীনে লুক্কায়িত বেদনাগুলোকে তার কাছে প্রকাশ করতে পারি। অতঃপর বলেন,এমনটি নয় যে,কেউই নেই,বরং সর্বদা প্রত্যেক যুগেই এ ধরনের ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান।

اللهم بلی لا تخلوا الارض من قائم لله بحجّة إمّا ظاهرا مشهورا او خائفا مغمورا...هجم بهم العلم علی حقیقة البصیرة

নিশ্চয়ই বিশ্ব কখনই আল্লাহর হুজ্জাত (দলিল-প্রমাণ) বিহীন থাকে না- হোক প্রকাশিত,পরিচিত অথবা অপ্রকাশিত ও অপরিচিত... অবশেষে তাদের প্রকৃত জ্ঞান তাদের দৃষ্টির সীমানাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। তাদের বিশ্বাস তাদের আত্মার সাথে সংযুক্ত হয়েছে এবং আত্মা ও বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য অপনোদিত হয়েছে। যা সুবিধাবাদী ও বস্তুবাদীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর তা তাদের জন্য অত্যন্ত সহজ ও আরামদায়ক। যা মূর্খের (সত্য থেকে দূরে) জন্য ভীতির কারণ,তা তাদের জন্য ইপ্সিত ও কাঙ্ক্ষিত।

وصحبوا الدّنیا بابدان ارواحها معلّقة بالمحل الاعلی (نهج البلاغة)

তারা পৃথিবীতে মানুষের সাথী,তবে তাদের আত্মাসমূহ উর্ধ্বলোকের প্রতি মহনীয়। তারা পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীতে নেই। তারা এ পৃথিবীতে বসবাস করছে,আবার অন্য এক ভূবনেও রয়েছে।

আলী (আ.)-এর বেদনা যা আমাদের ভাষায় আলীর আধ্যাত্ম বেদনা। তার প্রার্থনা সম্পর্কীয় বেদনা এবং মোনাজাত এক দিব্য ও আলোকময় সত্য বিষয়। মহান প্রভুর উপাসনায় তিনি যখন মত্ত হতেন যেন আপনাকে ভুলে যেতেন,হারিয়ে যেতেন মহান প্রভুর প্রেমে,ভুলে যেতেন পারিপাশ্বিকতাকে,এমনকি বিদ্ধ তীর যখন তার দেহ থেকে মুক্ত করা হতো অনুভব করতেন না কিঞ্চিরত পরিমাণ ব্যথাও।

আর এটাই হলো মানুষের প্রকৃত বেদনা অর্থাৎ মহাসত্যের বিরহ বেদনা; মহান প্রভুর সান্নিধ্যৃ লাভের অভিপ্রায় এবং তার দিকে ধাবিত হওয়া ও তার নৈকট্য লাভ। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ তার প্রভুর সত্তায় লীন হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার এ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবকাশ নেই এবং এ অবস্থা তার মধ্যে সকল সময় বিদ্যমান। যদি মানুষ নিজেকে কোন কিছুর প্রতি ব্যস্ত করে,তবে তা মানুষের বিনোদনের কারণ হয়। তবে বাস্তবিকতা অন্য কিছু। কোরআন এ বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করে

) أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوب(

জেনে রাখ,একমাত্র মহান প্রভুর স্মরণের মাধ্যমেই অন্তরসমূহ (উদ্বেগ,দুশ্চিন্তুা থেকে) প্রশান্ত হয়। (সূরা রাদ : ২৮) মানুষের এ বেদনা (প্রভুর সান্নিধ্য লাভ) একমাত্র একটি জিনিসের মাধ্যমে বিদূরিত হয়। আর তা হলো মহান প্রভুর স্মরণ ও তার প্রেম। আধ্যাত্মিক সাধকগণ এ বেদনার উপরই নির্ভর করেন,অন্যান্য ব্যথার প্রতি তারা খুব একটা গুরুত্ব দেন না।

মৌলভীর দেয়া একটি উদাহরণ :

মৌলভী দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কথিত আছে যে,এক ব্যক্তি সব সময় নিজের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত ও আল্লাহ,আল্লাহ্ বলে চীৎকার করত। একদিন শয়তান সুযোগমত তার কাছে উপস্থিত হয়ে তাকে ধোঁকা দিল এবং এমন কাজ করল যে,ঐ ব্যক্তি চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। শয়তান লোকটিকে বলল, ওহে! প্রত্যহ প্রত্যুষে এই যে আকুল হৃদয়ে আল্লাহ্ ধ্বনিতে প্রভূকে ডাকছ,একবারও কি তার পক্ষ থেকে সাড়া পেয়েছ? তুমি যদি প্রত্যেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে আপন ফরিয়াদের কথা ব্যক্ত করতে অন্তত একবার কেউ না কেউ এর জবাব দিত। লোকটি ভাবল কথাটি তো যুক্তিসঙ্গত। অতঃপর সে চুপ হয়ে গেল; আর কখনো আল্লাহ্,আল্লাহ্ করে চীৎকার করল না। কল্পনার জগতে এক অদৃশ্য আহবানকারী তাকে বলল, কেন খোদার কাছে মোনাজাতকে ত্যাগ করেছ? লোকটি বলল, দেখলাম এত মোনাজাত,ব্যাকুলতা যে আমি প্রকাশ করে যাচ্ছি,একবারও তো তার জবাব শুনতে পেলাম না। অদৃশ্য আহবানকারী তখন বলল, কিন্তু আমি মহান প্রভু কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তোমার উত্তর দিচ্ছি এবং তোমার ঐ আল্লাহ্ ধ্বনিই আমাদের উপস্থিতি।

জান না যে,তোমার আল্লাহ্ ধ্বনিই আমাদের উপস্থিতির প্রমাণ

এই যে তোমার ব্যাকুলতা,অভাব-অভিযোগ সে তো আমাদেরই পাইক।

তুমি জান না,এই যে ব্যথা-বেদনা,আকুলতা যা আমরা তোমার হৃদয়ে স্থাপন করেছি,এই যে প্রেম ও প্রেমাদ্রতা যা তোমার হৃদয়ের গহীনে আলোড়িত হচ্ছে তা-ই আমাদের সাড়া দানের প্রমাণবহ। কেন আলী (আ.) দোয়া কুমাইলে বলেন,

اللهم اغفرلی الذنوب التی تحبسی الدعاء

হে প্রভূ! যে সকল গুনাহ আমার দোয়ার অন্তরায় হয় ও তোমার প্রতি আমার ব্যাকুলতাকে অপনোদন করে দেয়,আমার সে সকল গুনাহ ক্ষমা করে দাও। আর এটাই হলো প্রকৃত দোয়া- যা হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা ও যাঞ্চাকে যেরূপ প্রকাশ করে,সেরূপ গ্রহণযোগ্যতার কারণ সম্বলিতও। অর্থাৎ দোয়া সর্বদা গৃহীত হওয়ার জন্য নয়। তার গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও গৃহীত হয়েছে। দোয়া স্বয়ং কাম্য ও বাঞ্ছিত।

আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি মানুষের অনুভূতি

অপর এক দলের মতে যারা মানুষের ব্যথাকে সকল মূল্যবোধের মূল্যবোধ রূপে মনে করেন,তারা এ ব্যাপারে অন্য একটি বিষয়কে অনুধাবন করেছেন। তারা মনে করেন,মানুষের এ ব্যথা মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্কিত নয়,বরং তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত। তারা বলেন,মনুষ্যত্বের মাপকাঠি হলো অপরের ব্যথাকে উপলব্ধি করা অর্থাৎ অপরের উদ্বেগ ও মানসিক অশান্তি যা তার নিজের সাথে সম্পর্কহীন,তা তারও উদ্বেগ ও মানসিক অশান্তি সৃষ্টি করে। সে অপরের ব্যথায় ব্যথিত হয়।

সা দীর মতে,যদি অন্যের ব্যথায় কেউ ব্যথিত হয়,তবে অন্যের ক্ষুধা তার নিদ্রাকে দূরীভূত করে। তার জন্য আপন ক্ষুধা অপরের ক্ষুধার চেয়ে সহজতর হয়। যদি অন্যের পায়ে কাঁটা ফোটে তবে তা যেন তার চোখে বিদ্ধ হয়েছে। বলা হয়,মানুষের ব্যথা তা-ই যা মানুষকে ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধ দিয়ে থাকে। আর এটাই হলো মানুষের সকল মূল্যবোধের উৎস। অধুনা আমরা দেখতে পাই,যারা অনবরত বলে থাকেন যে,অমুক বিষয়টি মানবিক; প্রকৃতপক্ষে তারা মানবতাকে ঐ স্থান ছাড়া অপর কোন স্থানে প্রয়োগ করেন না। যে সকল বিষয় মানুষের দায়িত্ববোধ ও অন্য সকল মানুষের প্রতি আপন বেদনাবোধের দিকে প্রত্যাবর্তন করে,ঐ সকল বিষয়কেই তারা মানবিক বলে মূল্যায়ন করেন। এটা ছাড়া অন্য কোন বিষয়কে তারা মানবিক বলে মনে করেন না। যা হোক,এটাও মূল্যবোধসমূহের অপর এক মূল্যবোধে বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনা।

ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যথা

ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতেও কি মানুষ সে-ই যে অপরের ব্যথায় ব্যথিত হয়? অথবা সে শুধু খোদাপ্রেমের অধিকারী? প্রকৃতপক্ষে ইসলামী মূল্যবোধের দৃষ্টিতে মানুষ হলো সে-ই,যে খোদাপ্রেমের অধিকারী। আর এ খোদাপ্রেমের কারণেই অপর মানুষের প্রতিও রয়েছে তার অনুরাগ।

লক্ষ্য করুন,কোরআন অপরের সমব্যথী হওয়া সম্পর্কে কিরূপ কথা বলে। মহানবী (সা.) সম্পর্কে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে-.

) فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَفْسَكَ عَلَى آثَارِهِمْ إِنْ لَمْ يُؤْمِنُوا بِهَذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا(

অতঃপর তুমি তাদের আচরণে এতই অসন্তুষ্ট হয়েছ যদি তারা এ কথাগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে যেন তুমি নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলবে। (সূরা কাহাফ : ৬)

নবী (সা.) মানুষের সৌভাগ্য ও সঠিক পথ প্রদর্শন এবং পার্থিব ও পরজীবনের বন্দীদশা থেকে মানুষকে মুক্তিদানের জন্য এতই ব্যাকুল ছিলেন যেন নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলবেন। ঘোষণা করা হলো কি হয়েছে,তুমি যেন মানুষের জন্য নিজেকে শেষ করে ফেলবে?

) طه مَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَى إِلَّا تَذْكِرَةً لِمَنْ يَخْشَى(

আমি তোমার প্রতি কোরআন এজন্য নাযিল করিনি যে,তোমাকে ক্লেশ দিব; বরং যারা ভয় করে কেবল তাদের উপদেশার্থে (নাযিল করেছি)। (সূরা ত্বাহা : ১-৩)

অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে,

) لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ(

তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসূল এসেছে। তোমাদের যা বিপন্ন করে তা তার জন্য খুবই কষ্টদায়ক। সে তোমাদর পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী; মুমিনদের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। (সূরা তাওবাহ্ : ১২৮)

লক্ষ্য করুন,কোরআনের ব্যাখ্যা কতটা বিস্ময়কর ও চমৎকার! হে লোক সকল! তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের শ্রেণীরই একজন তোমাদের জন্য নবীরূপে আবির্ভূত হয়েছে; যার প্রধান বিশেষত্ব হলো عزیز علیه ما عنتّم (عنت অর্থ দুঃখ,কষ্ট) তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাকে ব্যথাতুর করে এবং তিনি তোমাদের সমব্যথী। তাহলে (প্রকৃত) মুসলমান কে? মুসলমান সে-ই যার মধ্যে যেমন রয়েছে সৃষ্টিকর্তার প্রেম তেমনি রযেছে সৃষ্টির প্রতি অনুরাগ।حریص علیکم  কোরআনের এ  আয়াতাংশে حریص শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন পিতাকে দেখা যায় আপন সন্তানকে আলেম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এতটা বাড়াবাড়ি করে যে,লোকজন তাকে সন্তান শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে লালায়িত (حریص ) বলে অভিহিত করে- পার্থিব ধন-সম্পদের প্রতি লোভাতুর কোন ব্যক্তি অথবা অর্থপূজারী কোন ব্যক্তির মতো যে অর্থ মজুদের জন্য লালায়িত।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মানুষের মুক্তির জন্য লালায়িত,তিনি লালায়িত মানুষের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে তাকে মুক্তি দিত। আর এটাই হলো প্রকৃত সৃষ্টিপ্রেম।

স্বয়ং আলী (আ.) কি উপরিউক্ত ব্যাখ্যানুরূপ ব্যাখ্যা করেননি? ব্যথা সম্পর্কে স্বয়ং আলী কি কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেননি?

(এ প্রসঙ্গে) বহুল প্রচলিত একটি ঘটনা সম্ভবত আপনারা শুনে থাকবেন। বাসরায় উসমান বিন হুনাইফ নামে এক ব্যক্তি কোন এক নিমন্ত্রণ সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ নিমন্ত্রণ সভার অবস্থা কি ছিল? (আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই) মদ্যপ ছিল? না । জুয়ার আড্ডা ছিল? না। ব্যভিচার-অশ্লীলতা? না,তাও নয়। তাহলে কি ছিল? উসমান বিন হুনাইফের অপরাধ ছিল এটাই যে,সার্বিকভাবে অভিজাতদের জন্য একটা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন অর্থাৎ দরিদ্র শ্রেণীর কেউ ঐ অনুষ্ঠানে ছিল না। হজরত আলীর কাছে সংবাদ পৌছল যে,আপনার প্রতিনিধি ও প্রশাসক এমন এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন যেখানে শুধু ধনিক,বনিক ও পুঁজিপতিগণের উপস্থিতি ছিল,অথচ দরিদ্রদের মধ্যে কেউই সেখানে ছিল না। আলী (আ.) বললেন,

و ما ظننت أنّک تجیب إلی طعام قوم عائلهم مجفوّ و غنِیّهم مدعوّ

আমি বিশ্বাস করতে পরিনি যে,তুমি এমন এক দস্তরখানায় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছ যেখানেপুঁজি পতিগণ নিমন্ত্রিত হয়েছে,অথচ দরিদ্রগণ নিমন্ত্রিত না হয়ে গৃহদ্বারের পশ্চাতে অবস্থান করছিল। অতঃপর আলী আপন হৃদয়ের ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করতে শুরু করলেন এবং এক পর্যায়ে নিজ সম্পর্কে বলেন,

و لو شئت لا هتدیت الطریق إلی مضفی هذا العسل و لباب هذا القمح و نسائج هذا القزّ

যদি আমি চাই তবে আমার জন্য ভোগ ও বিলাস সামগ্রীর রয়েছে প্রাচুর্য,সর্বোৎকৃষ্ট খাবার,পানীয়,সর্বোত্তম পরিচ্ছদ; যা চাইব তা-ই আমার জন্য উপস্থিত।

ولکن هیهات أن یغلبنی هوای و یقودنی جشعی إلی تخیّر الاطعمه

দূর হোক আমা হতে এ অবস্থা যে,আমি এমনটি করব। অসম্ভব,আমি আমার লাগামকে কখনই নাফসের চাহিদা ও লোভের নিকট সমর্পণ করব না।

এখন,কেন আলী এরূপ বলেছেন? তবে কি আল্লাহ্ এ সকল নিয়ামত নিষিদ্ধ করেছিলেন? আলী (আ.) স্বয়ং এ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন যাতে কেউ মনে না করেন যে,ভালো পোশাক পড়া নিষেধ,স্বচ্ছ মধু পান নিষেধ। না,মোটেই তা নয়। বরং ব্যপারটি হলো এর ব্যতিক্রম। এগুলো হারাম নয়,হালাল।

و لعل بالحجاز او الیمامة من لا طمع له فی القروص و لا عهد له بالشّبع

যদি এখানে আমি আপন উদর পূর্ণ করি,তবে ইরাক,কুফা,ইয়ামামাহ্ এবং পারস্যপোসাগরের উপকূলে এমন কেউ হয়তো থাকবে যে এক টুকরা রুটির আশাও করতে পারে না।

او ابیت مبطانا و حولی بطون غرثی و أکباد حرّی

আমি কি আপন উদর পূর্ণ করে ঘুমাব। আর আমার চারিদিকে অসংখ্য ক্ষুধার্ত পেট ও তৃষ্ণার্তবক্ষ অবস্থান করবে? আমি কি কবির সে কাব্যের মতো হব যে কবি বলেন,

حسبك داء أن تبیت ببطنة و حولک أکباد تحنّ إلی القدّ

তোমার চারিদিকে যে অসংখ্য ক্ষুধার্ত পেট অবস্থান করছে,তাদের জন্য তোমার সমবেদনাই যথেষ্ট,আর তুমি উদর পূর্ণ করে ঘুমাও।

এই যে সমবেদনা,এটাই হলো সৃষ্টির প্রতি অনুরাগ। একেই বলে মানবতার মানদণ্ড। সর্ঠিকভাবে বললে বলতে হয়,মূল্যবোধসমূহের দ্বিতীয় মা।অতঃপর আলী (আ.) বলেন,

أ أقنع من نفسی بأن یقال أمیر المؤمنین و لا أشارکهم فی مکاره الدّهر ؟

আমি কি নাম-পদবিতেই পরিতৃপ্ত হব? আমাকে যে সম্বোধন করা হয় : হে আমীরুল মুমিনীন! আমাকে যে খলিফা বলে আখ্যায়িত করা হয় অথবা পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত মুসলিমরাজ্যের অধিপতি বলা হয়,এতেই কি আত্মতুষ্ট হব এবং নিজেকে আমীরে মুমিনীন বলে জানব,অথচ মুমিনগণের কষ্টে অংশীদার হব না? (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৫)

আলী (আ.)-এর উপরিউক্ত বক্তব্যগুলো থেকে একটি বিষয় স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়- সমবেদনা,অপরের কষ্টকে অনুভব করা।

কাঙ্ক্ষিত ব্যথা

এখন আপনাদের কাছে জানতে চাই,এটা কি মানুষের জন্য ভালো যে,সে বিকলাঙ্গ হবে,তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হবে অসাড় ও শক্তিহীন অথবা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো হবে সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর,ফলে সে এ ব্যথাকে উপলব্ধি করতে পারবে?

এ ব্যথা যেমনি ব্যথা তেমনি উপভোগ্যও বটে। কারণ অপরের তরে যে ব্যথা,সে ব্যথা সর্বদাই উপভোগ্য হয়ে থাকে। এর মানে কি? সৃষ্টিকর্তাই স্বয়ং জানেন। অপরের নিমিত্তে ব্যথা যেমন কাঙ্ক্ষিত ও উপভোগ্য তেমনি সত্য-প্রভুর বিচ্ছেদ ব্যথাও কাঙ্ক্ষিত ও উপভোগ্য।

বু আলী (ইবনে সিনা) তার ইশারাত গ্রন্থে এ বিষয়ের উপর (কোন ব্যথা যেমনি ব্যথা তেমনি উপভোগ্য) একটি উদাহরণ এনেছেন। তিনি বলেন, এ ধরনের ব্যথা হলো শরীর চুলকানোর মত। শরীর যখন চুলকায় তখন যন্ত্রণাদায়ক হয়। যখন মানুষ তার শরীরের উক্ত স্থানে আঁচর কাটে তখন ব্যথা অনুভব করে এবং এ ব্যথা অনুভবের পাশাপাশি সে পরিতৃপ্তিও লাভ করে। এ ব্যথা তিক্ত নয়। (বু-আলী বলেন,তার এ উদাহরণটি আবর্তনিক।)

এ ব্যথা এমন এক ব্যথা যা অন্তরকে জ্বালায়,অশ্রুর ধারা বইয়ে দেয়। কিন্তু প্রিয়জনের তরে এ বেদনা- কাঙ্ক্ষিত বেদনা। মানুষ এক ধরনের দুঃখ-কষ্ট থেকে সর্বদা পলায়ন করে। কিন্তু আমরা লক্ষ্যকরি যে,আমাদেরকে যখন বলা হয়,ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উপর মর্সিয়া পাঠের অনুষ্ঠান হবে,দারুণ মর্মস্পর্শী অনুষ্ঠান,তখন আমরা সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করি। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের হৃদয় দাহ হয়,ব্যথা অনুভব করে ততক্ষণ পর্যন্ত তার কপল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে না।এতদসত্ত্বেও আমরা দেখি,মানুষ এ মর্মস্পর্শী অনুষ্ঠানে যায়,এ বেদনাকে উপলব্ধি করে,অশ্রুসম্বরণ করে। যখন মানুষের এ আঁখি বারি ঝড়ায়,এমন এক নির্মূল প্রশান্তিও তখন অনুভব করে থাকে যে,উক্ত ব্যথা এর তুলনায় অতি নগণ্য। আর এটাই হলো মনুষ্য বেদনা।

ধন্য হোক ঐ সকল দেহ যাদের আত্মা শুধু তাদেরই দেহের ব্যথা অনুভব করে। ধন্য হোক ঐ দেহ যার আত্মা শুধু আপন দেহের ব্যথাই অনুভব করে। কারণ ঐ আত্মা সর্বদা আপন দেহের ব্যথা নিবারণ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু সমস্যা হলো সে দেহের যার আত্মা আপন দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়,সে আত্মা সকল দেহের। এক আত্মা সকল দেহের ব্যথা একাকীই অনুভব করে। এ দেহই সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধার আধিক্য থাকা সত্ত্বেও শুধু দু লোকমা যবের রুটিতে তুষ্ট হতে বাধ্য। কারণ তার ভয় হয়,হয়তো হিজাজ অথবা ইয়ামামায় এমন কেউ থাকতে পারে যে যবের রুটি খেয়ে থাকে। এ দেহই তালি দেয়া জুতা পরতে বাধ্য। কারণ এ আত্মা হযরত আলী (আ.)-এর আত্মার সমতুল্য। আরব কবির ভাষায়-

و إذا کانت النفوس کبارا تبعت مردها الاجسام

দুঃখ হয় সে আত্মার তরে যে লভিল বিকাশ।

আত্মা যখন বিকাশ লাভ করে তখন সকল দেহের আত্মা হয়ে যায় এবং অনুভব করে সকল দেহের বেদনাকে। তখন তার কর্ম এমন এক অবস্থায় গিয়ে পৌছে যে কর্মফল দেখতে পায়; কিন্তু কেন? এজন্য যে,সে এক বিধবা নারী ও কয়েকটি অনাথ সন্তানের অবস্থা সম্পর্কে উদাসীন ছিল। কোন এক গলির মধ্য দিয়ে যেতে দেখা গেল এক নারী কলসী কাঁধে হেঁটে যায়। আলী (আ.) এমন মানুষ নন যে,এ দৃশ্য অবলোকন করলেন,অথচ কোন গুরুত্ব দিলেন না। এটা হতে পারে না যে,এক নারী স্বয়ং পানি বহন করবে। নিশ্চয়ই তার কেউ নেই অথবা থাকলেও তাকে সাহায্য করতে পারে না। তিনি সাহায্য করার জন্য দ্রুত সামনে এগিয়ে যান। বলেন না যে- হে অনুচর! হে প্রহরী! হে গোলাম! হে জনাব! এদিকে এসো; বরং স্বয়ং এগিয়ে যান। পূর্ণ মর্যাদা বজায় রেখে বলেন, হে ভদ্রমহিলা! আপনিকি আমাকে অনুমতি দেবেন,আপনাকে সাহায্য করব? আপনার পানির কলসী আমাকে বহন করতে অনুমতি দিবেন? এ পরিশ্রম আমাকে করতে দিন। উক্ত মহিলা বলেন; আল্লাহ্ আপনার পিতা-মাতাকে ক্ষমা করুন। তিনি ঐ বিধবা মহিলার গৃহে যান। কলসী রেখেই জানতে চান, কেন আপনি স্বয়ং পানি বহন করে আনেন? সম্ভবত কোন পুরুষ আপনার গৃহে নেই। মহিলা বলেন, জী, ঘটানাক্রমে আমার স্বামী আলী বিন আবি তালিবের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। আমি আমার কয়েকটি অনাথ বাচ্চা নিয়ে আছি। যখনই আলী (আ.) এ কথাগুলো শুনলেন আপাদমস্তকে তার অগ্নি সঞ্চার হলো। ঐ রাতে আলী ফিরে আসলেন,কিন্তু প্রভাত অবধি ঘুমাতে পারলেন না। প্রাতেই রুটি,মাংস,খোর্মা নিয়ে খুব দ্রুত উক্ত বিধবার দ্বারে উপস্থিত হলেন। যখন দ্বারে আঘাত করলেন তখন মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? জবাবে তিনি বললেন, আমি আপনার শতকালের মুমিন ভাই। খুব দ্রুত মাংসগুলোকে স্বহস্তে কাবাব করলেন ও অনাথ শিশুদের মুখে তুলে দিলেন। অনাথ বাচ্চাদেরকে আপন জানুর উপর বসিয়ে চুপিসারে বললেন, আলীর অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে দাও যে তোমাদের সম্পর্কে উদাসীন ছিল। অতঃপর চুল্লীতে আগুন দিলেন। যখন চুল্লী অগ্নিতে উত্তপ্ত হলো তখন তার নিকটবর্তী হয়ে অগ্নত্তাপ উপলব্ধি করেন আর আপন মনে বলেন, আলী! পার্থিব আগুনের তাপ উপলব্ধি কর যাতে করে নরকের আগুনের কথা স্মরণ করতে পার। ফলে আর কখনও জনগণের অবস্থা সম্পর্কে উদাসীন হবে না। যে দেহকে কষ্ট সহ্য করতে হয় এ ধরনেরই হয়ে থাকে। যে দেহের আত্মা সকলের,সকল মানুষের- তার অবস্থা এমনি হয়ে থাকে।.

باسمک العظیم الاعظم الاعز الاجل الاکرم یا الله

প্রভু হে! তোমাকে আলী (আ.)-এর কসম,আমাদের অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি কর। আমাদের সকলকে শুভ পরিণতির অধিকারী কর। তোমার প্রেম,পরিচিতি,অনুগত্য ও উপাসনার অনুরাগ আমাদের অন্তরে দান কর। তোমার সৃষ্টির প্রতি সমবেদনা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি কর। আলীর বেলায়েতের আলোতে আমাদের আলোকিত কর। আমাদেরকে ঐ মহান ব্যক্তির সত্যিকারের অনুসারী হিসেবে পরিগণিত কর। আমাদের অন্তরগুলোকে ঈমানের আলোতে আলোকিত কর। আমাদেরকে ইসলামের স্বরূপের সাথে পরিচিত কর।.

و لا حول ولا قوة الا بالله العلی العظیم


7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27