ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41079
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41079 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

মানুষের প্রকৃত সত্তা

এখানে আরেকটি বিষয় যা নব্য দার্শনিকদের মধ্যেও প্রশ্ন হিসেবে এসেছে তা হলো মানুষের প্রকৃতসত্তা কোনটি? এ ক্ষেত্রে দর্শনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তাদের মতে মানুষের সত্তা হচ্ছে তার আত্মা ও অহম যাকে সে অনুভব করে। মানুষ তার সত্তাকে অনুভব করে অর্থাৎ তার আত্মাকে অনুভব করে। যখন তাকে বলা হয়,আমিত্ব কি? তখন সে বলে,আমার আত্মা।

মনস্তত্ত্ব বা মনোবিজ্ঞান বর্তমানে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছে যে,মানুষ আমিত্ব বলতে যা বুঝে বা অনুভব করে তা তার আমিত্বের একটি অংশ মাত্র। মানুষের আমিত্বের একটি বিরাট অংশ তার এ সত্তার অসচেতন অংশ যেটা সম্পর্কে সে নিজেই সচেতন নয়। অর্থাৎ বাহ্যিক অনুভূতির পরিসীমায় এ আমিত্বের অস্তিত্ব নয়। আরেফগণ এ ক্ষেত্রে সত্যিই অলৌকিকত্ব দেখিয়েছেন। মনোবিজ্ঞান হতে তারা উচ্চ পর্যায়ে এবং গভীর ও যথার্থভাবে একে ব্যাখ্যা করেছেন। দার্শনিকদের বিরোধিতা করে তারা বলেছেন,দর্শন ভুল করে বলেছে যে,মানুষের সত্তা হলো তার আত্মা। বরং মানুষের আমিত্ব এর থেকে আরো সূক্ষ্ম বিষয়। শাবেস্তারী বলেছেন,

মানবাত্মা দেহ ও প্রাণ হতে ঊর্ধ্বে জেন,

দেহ ও প্রাণ তারই অংশ যদি তা মানো।

অবশ্য আরেফগণ বলেন,মানুষ তখনই তার প্রকৃত সত্তায় পৌছতে পারে যখন সে তার স্রষ্টাকে চিনতে ও তার পরিচয় লাভ করতে পারে। আমার আত্মপরিচয় কখনই স্রষ্টার আত্মপরিচয় থেকে ভিন্ন নয়। যেমন কোরআন বলছে,

) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّـهَ فَأَنسَاهُمْ أَنفُسَهُمْ أُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ(

তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছে,ফলে তিনিও তাদের আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। (সূরা হাশর : ১৯)

আরেফগণ বিশ্বাস করেন,মানুষের প্রকৃত সত্তা দর্শন যা বলে তা থেকে অনেক সূক্ষ্ম। শাবেস্তারী এরফানের জনক মহিউদ্দিন আরাবীর অনুকরণে তা-ই বলেছেন।

মাওলানা রুমী সুন্দরভাবে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন,

যে জন আপন সত্তা যুদ্ধে হারায়

সে জন পারে না দিতে অন্যেরে আপন পরিচয়

যে রূপেই আসে সে দিতে পরিচয়

কসম করে বলতে পারি সে তা নয়।

যে ব্যক্তি তার সত্তাকে হারিয়েছে,বাজীতে সে সর্বোত্তম বস্তুকে হারিয়েছে। কোরআনও এরূপ বলেছে,قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِ‌ينَ الَّذِينَ خَسِرُ‌وا أَنفُسَهُمْ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সে সব ব্যক্তি যারা নিজেদের সত্তাকে হারিয়েছে। (সূরা যুমার : ১৫)

মাওলানা রুমী অতঃপর তার এ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে দলিল হিসেবে বলছেন,

ক্ষণিক যদি হয়ে পড়ে সে একা বঞ্চিত

জগতের কষ্ট করে তারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।

তিনি বলছেন,যখন একাকিত্ব বরণে সে বাধ্য হয় তখন এ একাকিত্বকে সে ভয় পায়। আমাদের মধ্যে ক জন এরূপ আছেন যে,দশ দিন একাকী থাকব কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়ব না। জেলখানার এক সেলে কাউকে একা বন্দি করে রাখলে তার জন্য তা সবচেয়ে বড় শাস্তি। যদি মানুষ নিজেকে প্রকৃতই চিনত তবে এরূপ অনুভব করত না।

কখন তুমি হবে সেই একক ব্যক্তি

আপন সত্তায় মুগ্ধ ও সুন্দর অভিব্যক্তি।

যদি তুমি নিজেকে উদাহরণ করতে পারতে তবে একাকিত্বের সময় কারো প্রয়োজন অনুভব করতেনা। বরং আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ ও বিভোর হতে। নিজেকে হারিয়েছ বলেই নিজের সত্তাকে অনুভব করনা ও একাকিত্বে ভয় পাও।

নিজের প্রকৃত সত্তাকে জানা ও উদ্ঘাটন আল্লাহর প্রতি মনঃসংযোগ ও ইবাদতের প্রাণ। মানুষ ইবাদতের মধ্যেই তার প্রকৃত সত্তা ও স্রষ্টার সান্নিধ্যকে অনুভব করে। সুতরাং আরেফগণ এ পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টিকে অনুধাবন করেছেন। কিন্তু নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিষয়ে এরফান আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধের (মূলত যার উপর ভিত্তি করে মানুষ উচ্চ পর্যায়ে পৌছতে পারে) প্রতি খুব কমই দৃষ্টি দিয়েছেন। এত কম দৃষ্টি দিয়েছেন যে,বলা যায় একেবারেই নেই। যদি ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব আরেফগণ তাদের সকল দিক-নির্দেশনা ইসলাম থেকেই গ্রহণ করেছেন,কিন্তু এ দিক-নির্দেশনার প্রতি কম দৃষ্টি দিয়েছেন। সম্ভবত এ বিষয়টিকে তারা তেমনভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কোরআন ও হাদীসে আত্মমর্যাদাবোধ

ইসলামে যেমন প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামের নির্দেশ সম্বলিত বাণী- উদাহরণস্বরূপ-

موتوا قبل أن تموتوا، إنّ النّفس لامّارة بالسوء نهی النّفس عن الهوی এবংقَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا রয়েছে তেমনি আত্মমর্যাদাবোধের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। তার নমুনা হচ্ছে সূরা মুনাফিকুনের এ আয়াত-وَلِلَّـهِ الْعِزَّةُ وَلِرَ‌سُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ সম্মান আল্লাহ্,তার রাসূল ও মুমিনদের জন্য। কোরআন বলেনি যে,আত্মমর্যাদাবোধ আত্মপূজার শামিল। মানুষ যেহেতু প্রকৃতিগতভাবেই অন্য মানুষের মুখাপেক্ষী তাই প্রয়োজন উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি (আত্মসম্মানবোধ) লক্ষ্য রাখার জন্য উপদেশ দিয়ে রাসূল (সা.) বলেছেন,اطلبوا الحوائج بعزّة الآنفس তোমার প্রয়োজনকে আত্মসম্মান বজায় রেখে চাও অর্থাৎ কারো নিকট ব্যক্তিত্ব হানী করে কিছু চেয়োনা। তাতে তোমার সম্মান থাকবে না। প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের অজুহাতে ভিক্ষুকের মতো কারো নিকট কিছু চাইবে না। কারণ ইসলাম তার অনুমতি দেয় না। যদি প্রয়োজনে মানুষের দ্বারস্থ হতে হয় তাহলে আত্মসম্মান বজায় রেখে তা চাও ও নাও।

লক্ষ্য করুন আলী (আ.) যুদ্ধের ময়দানে কি বলছেন,

فالموت فی حیاتکم مقهورین و الحیاة فی موتکم قاهرین

তোমাদের প্রকৃত মৃত্যু অন্যের আনুগত্যের মধ্যে বেঁচে থাকা এবং প্রকৃত জীবন হলো স্বাধীনভাবে মৃত্যু লাভের মধ্যে। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ৫১) এখানে তিনি আত্মমর্যাদাবোধের কথাই বলেছেন।

কাঁদিয়ে বন্ধুদের তুমি মৃত্যুকে করেছ বরণ

হাসত দুশমন যদি বেঁচে করতে কারাবরণ।

আমার ঘৃণা সেই জীবনের প্রতি

যদি বেঁচে থেকে করি স্বীকার শত্রুর নতি।

ইমামা হুসাইন (আ.) বলেন,موت فی عزّ خیر من حیاة فی ذلّ সম্মানের সঙ্গে মৃত্যু অসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা অপেক্ষা উত্তম। (মুলহাকাতু ইহকাকিল হাক্ব) ইমাম হুসাইনের দর্শন এটা বলে না যে,নাফসের সাথে সংগ্রামের অজুহাতে ইয়াযীদ ও ইবনে জিয়াদের নিকট আত্মসম্মানকে বিকিয়ে দিতে হবে। তাই তিনি বলছেন,

الا و انّ الدّعیّ ابن الدّعی قد رکز بین السلّة و و الذلّة و هیهات منّا الذلة یابی الله ذلک لنا و رسوله و المؤمنون و حجور طابت و طهرت

জিয়াদের পুত্র,এই কাপুরুষের পুত্র কাপুরুষ আমাকে এ দু শর্তের মধ্যে ফেলেছে,হয় অপমানকে গ্রহণ করব (বাইয়াত করব),নতুবা যুদ্ধ। অপমান আমাদের থেকে দূরে। আল্লাহ্,তার রাসূল (সা.)এবং মুমিনীন আমাদের জন্য তা কখনও মেনে নিতে পারে না। (লুহুফ ইবনে তাউস,পৃ. ৮৫)

এ কথার মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করছেন না,বরং বলতে চাচ্ছেন,আমার দীন আমাকে এ অনুমতি দেয় না,আমার স্রষ্টা এ কাজকে অনুমোদন করেন না। নবীও তা চান না। যে পিতা-মাতার ক্রোড়ে আমি মানুষ হয়েছি তারা তা পছন্দ করেন না। আমি হযরত ফাতেমা যাহরার দুগ্ধে প্রতিপালিত হয়েছি। এ দুগ্ধ আমাকে এ কাজের অনুমতি দেয় না। ফাতেমা (আ.) আমাকে ডেকে যেন বলছেন : হুসাইন! তুমি আমার দুগ্ধে মানুষ হয়েছ,যে আমার দুগ্ধে প্রতিপালিত হয়েছে সে অপমানকে মেনে নিতে পারে না। তাই ইমাম হুসাইন বলেননি, ইবনে জিয়াদ যা করার করুক,চলো আমরা তার বাইয়াত গ্রহণ করি। সে তো আমাদের অপমান ছাড়া কিছু করবে না। যত অপমান হবে তত নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হবে। না,তিনি কখনই তা করতে পারেন না। বরং বলেছেন,لا والله لااعطیکم بیدی اعطاع الذّلیل و لا افرّ فرار العبید আমি কখনই তোমাদের দিকে অপমানের হাত প্রসারিত করব না। কোন দাসের মতো পলায়ন করব না। অন্য রেওয়ায়েতে কোন দাসের মতো স্বীকার করবনা এসেছে। এ ধরনের বক্তব্য কোরআনে এবং ইমামগণের বাণীতে বিশেষত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কথায় প্রচুর এসেছে।

যুবকদের প্রতি উপদেশ

জাভিদ মসজিদে আমি যে বিষয়টি বলেছি এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি। সেখানে এক বৈঠকে ইমাম হুসাইনের বাণী বলে প্রচারিত জীবন বিশ্বাস (আকীদা) ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় কথাটি যে ইমাম হুসাইনের নয় তা বলেছি। কারণ কোন ইসলামী গ্রন্থেই এর পক্ষে কোন দলিল নেই। এ বাক্যের অর্থও সঠিক নয় এবং ইমাম হুসাইনের যুক্তির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলামের যুক্তি এরূপ নয় যে,মানুষ তার জীবনের জন্য কোন বিশ্বাসকে গ্রহণ করবে এবং তার জন্য সংগ্রাম করতে থাকবে। ইসলামে বিশ্বাসের চেয়ে সত্যের প্রতি গুরুত্ব অধিক। তাই জীবনের অর্থ সত্যের অনুসন্ধান এবং সত্যের জন্য সংগ্রাম। বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম একটি পাশ্চাত্য চিন্তাপ্রসূত বিষয় যা পাশ্চাত্যে ছিল এবং পরবর্তীতে মুসলমানদের মধ্যে প্রচার লাভ করেছে।

তোমার চিন্তাকে তোমার জীবনের জন্য হাতিয়ার হিসেবে ধর এবং এর দ্বারা সংগ্রামে লিপ্ত হও। জীবন আকীদা ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়- এ কথাগুলো যে ইমাম হুসাইন থেকে নয় তা বলায় কিছু যুবক মর্মাহত হয়েছে। কারণ এ বাক্যগুলোকে তারা পছন্দ করেছে এবং ভাবছে যদি তা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে হয় তাহলে কত উত্তম! প্রথমত আমি আমাদের পূর্বসূরিদের মতো যুবকদের ও সত্যানুসন্ধানী বলে সম্মানের পাত্র বলে মনে করি। যুক্তিহীনভাবে কোন বিশ্বাসের প্রতি গোঁড়ামি পছন্দনীয় নয়। যদি এমন হয় যে,নতুন প্রজন্মের মাথায় কিছু ঢুকলে তা বের করা সম্ভব হয় না,সে বিষয়ে কথা বলা যায় না,তবে এ প্রজন্মকে স্থবির প্রজন্ম বলতে হবে। তাহলে দেখা যাবে একজনের একটি কথা ভাল লেগেছে সে সেটা আঁকড়ে ধরবে,অন্য জন অন্য একটি কথাকে অনুরূপভাবে।

দ্বিতীয়ত এখন তোমরা তোমাদেরই এক বন্ধুর মুখে শুনতে পেয়েছ যে,এ কথাটি ইসলামের যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং কোন ইসলামী গ্রন্থে এ কথার ভিত্তি নেই। ধরা যাক,তোমাদের শত্রু ও অমুসলমান কোন ব্যক্তি তোমাদের সব সময় বলতে থাকে জীবন বিশ্বাস ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় এ কথাটি ইমাম হুসাইনের। তোমাদের প্রশ্ন করা উচিত,জনাব,ইমাম হুসাইন যা যা বলেছেন তা কোননা কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে অবশ্যই রয়েছে। ইমাম হুসাইনের এ কথাটি কোন্ গ্রন্থে রয়েছে তা আমাকে দেখিয়ে দিন যাতে করে যারা বলে এ কথাটি ইমাম হুসাইনের নয় তাদের নিকট প্রমাণ করতে পারি যে,এটা ইমাম হতে। কিন্তু কোথাও তা খুজে না পেয়ে অবশেষে আমাকে যখন বলবে, আমাদের মধ্যে প্রচলিত এ কথাটি ইমাম হুসাইনের নয় তা কেন আমাদের জানাননি? কেন আপনারা (আলেমরা)এ বিষয়ে এতদিন নীরব থেকেছেন?

তৃতীয়ত তোমরা যদি বিপ্লবী বাণীসমূহের প্রতি আসক্ত হয়ে থাক,তবে জীবন বিশ্বাস ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় -এ কথা অপেক্ষা শতগুণ বিপ্লবী বাণী ইমাম হুসাইন হতে রয়েছে। আজকের বৈঠকে ইইমাম হুসাইনের যে বাণীটি- সম্মানের মধ্যে মৃত্যু অপমানের সঙ্গে বেঁচে থাকা হতে উত্তম -পড়েছি সেটি বেশি বিপ্লবী নাকি জীবন বিশ্বাস ও সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয় এটি? অথবা অপমান হতে মৃত্যু শ্রেয়। অপমান জাহান্নামে প্রবেশ হতে উত্তম (নাফ্সিল হুমুম,পৃ. ১২৭; বিহারুল আনওয়ার,খণ্ড ৭৮,পৃ ২১৯.)-এ কথাটি অধিক বিপ্লবী।

এরূপ অসংখ্য বিপ্লবী বাণী,যেমন এই কাপুরুষের পুত্র কাপুরুষ আমাকে দু শর্তের মধ্যে ফেলেছে- অপমান নতুবা যুদ্ধ। অপমান আমাদের কখনও স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহ্,তার রাসূল ও মুমিনগণ আমাদের জন্য কখনও তা মেনে নিতে পারে না। আমাদের হারিম পাক ও পবিত্র। (লুহুফ,পৃ. ৮৫) এবং যারা জীবনকে আমাদের জন্য উৎসর্গ করবে এবং আল্লাহর সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্যের জন্য আগ্রহী তারা আমাদের সঙ্গে আস। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি যাত্রাশীল। (লুহুফ,পৃ.৫৩; কাশফুল গাম্মা,পৃ. ১৮৪)

সুতরাং আমাদের বিপ্লবী বাণীর দারিদ্র্য নেই। যদি বিপ্লবী বাণীর দারিদ্র্য থাকত তদুপরি বলা ঠিক হতো না যে,এ বাণীটি ইমাম হুসাইনের। আল্লাহর নিকট এরূপ কর্ম হতে আশ্রয় চাই। তবে বাস্তবতো এর বিপরীত কথাই বলে। আমাদের নিকট ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে,এমনকি তার পিতা,মাতা,সন্তানদের নিকট থেকেও এত অধিক বিপ্লবী বাণী রয়েছে যে,বিশ্ব তা থেকে ধার নিতে পারে। তাই কেন আমরা অন্যদের ভ্রান্ত বাণীকে ধার করব? নতুন প্রজন্মের তাই এ গোঁড়ামি থাকা উচিত নয়।

তদুপরি আমি দাবি করছি,যদি কেউ এসে প্রমাণ করতে পারেন এ বাণীটি ইমাম হুসাইনের তাহলে এ মিম্বারে এসেই আমি ভুল স্বীকার করব। কিন্তু আমাদের অবশ্যই উচিত প্রামাণ্য কথা বলা এবং অপ্রামাণ্য কথা বলা থেকে দূরে থাকা। যেহেতু সময় শেষ হয়ে গেছে (যদিও এ বিষয়ে প্রচুর কথা রয়েছে) সেহেতু এখানেই শেষ করছি।

আমাদের আলোচনার যা মূল ছিল তা হলো সুফী সাহিত্যে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে এতটা বাড়াবাড়ি করা হয়েছে যে,কখনো কখনো আত্মসম্মানবোধের হানী হয়েছে। যদি এ বিষয়টিকে ইসলামী মানদণ্ডের সঙ্গে যাচাই করি তবে দেখব এ বিষয়টির সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।

ক্ষমতার মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

) وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِ‌بِّيُّونَ كَثِيرٌ‌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِ‌ينَ(

(সূরা আলে ইমরান : ১৪৬)

পূর্ণ,আদর্শ ও উচ্চতর মানুষের বিষয়ে অন্য যে মতবাদটি প্রচলিত তা হচ্ছে ক্ষমতার মতবাদ। এ মতবাদে পূর্ণ মানব অর্থ ক্ষমতাবান ও শক্তির অধিকারী মানুষ। অন্য অর্থে এ মতবাদে পূর্ণতা ও ক্ষমতা সমার্থক এবং অক্ষমতা ও অপারগতা অপূর্ণতার সমার্থক। যে ব্যক্তি যত ক্ষমতাবান সে তত বেশি পূর্ণ এবং যে ব্যক্তি যত দুর্বল সে তত ত্রুটিপূর্ণ। সত্য ও ন্যায় ক্ষমতা ও শক্তি ব্যতীত কিছু নয়। যদি দু শক্তি পরস্পরের মোকাবিলায় দাঁড়ায় তখন আমরা জয় পরাজয়ের ভিত্তিতে নয়,বরং অন্য মানদণ্ডে বলি এ পক্ষ সত্যপন্থী ও অন্য পক্ষ বাতিল বা অত্যাচারী। কোথাও হয়তো সত্য মিথ্যা ও জুলুমকে পরাস্ত করে,কোথাও বাতিল সত্যপন্থীদের পরাজিত করে। অবশ্য কোরআনের যুক্তিতে শেষ বিজয় সত্য ও হক্বের পক্ষে। বাতিল হয়তো সাময়িকভাবে জয়লাভ করতে পারে,তবে তা চিরস্থায়ী নয়। তবে দু শক্তি যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়,যে দল জয়ী হবে তাকেই কোরআন হক্ব বলে মনে করেনা বা যে দল পরাজিত হবে তাকেও বাতিল বলে মনে করে না। কিন্তু ক্ষমতার মতবাদের দৃষ্টিতে যেদল বিপরীত পক্ষকে পরাজিত করবে সে-ই ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। শক্তিধর পক্ষ যা করবে,সেটাই ন্যায়।

ক্ষমতার মতবাদের ইতিহাস

এ মতবাদ অনেক প্রাচীন এবং এর ইতিহাস সক্রেটিসের সময়েরও পূর্বের। সক্রেটিস হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের চারশ বছর পূর্বের মানুষ। তখন থেকে ২৪০০ অথবা ২৫০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সক্রেটিসের পূর্বে একদল লোক ছিলেন দর্শনে তাদেরকে সফিস্ট বা সন্দেহবাদী বলা হয়। এঁরা সামাজিক বিষয়ে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি প্লেটো ও সক্রেটিসের আবির্ভাবের মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়। হযরত ঈসার আবির্ভাবের মাধ্যমে এ মতবাদের সমাধি ঘটে,যেহেতু খ্রিষ্ট মতবাদএর ঠিক বিপরীত একটি মতবাদ। অর্থাৎ খ্রিষ্ট মতবাদ ক্ষমতার বিরুদ্ধেই শুধু প্রচার চালায় না,বরং দুর্বলের পক্ষে প্রচার চালায়। খ্রিষ্ট মতবাদে বলা হয়,কেউ তোমার ডান গালে চড় বসিয়ে দিলে বাম গালটিও এগিয়ে দাও,নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করো না। এটি দুর্বলতার মতবাদের পক্ষের একটি প্রচার বৈ কিছু নয়। পৃথিবীতে ইসলামের আগমনের ফলে ক্ষমতা ও শক্তির ক্ষেত্রে অপর এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে যা স্বভাবতঃই ক্ষমতার মতবাদের পরিপন্থী যেটা বলে,হক্ব ও ন্যায়,শক্তি ও ক্ষমতা বৈ কিছু নয়। এটা পাশ্চাত্যে উদ্ভূত একটি মতবাদ যা শক্তি ও ন্যায় একই বলে জানে।

পাশ্চাত্যে কয়েক শতাব্দী পূর্বে দ্বিতীয়বারের মতো এ মতবাদ পুনর্জীবিত হয়েছে। সত্য ও ক্ষমতা সমার্থক- এ ধারণাটি প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দর্শনে আবির্ভূত হয়েছে। ম্যাকিয়াভেলী ছিলেন একজন ইতালীয় দার্শনিক। তিনি তার রাজনৈতিক দর্শনকে এ মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলেন,রাজনীতির ক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রভূত্বের যোগ্যতা। রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌছবার জন্য (প্রভুত্ব লাভ) সকল কিছুই বৈধ। মিথ্যা,প্রতারণা,ধোঁকা,মিথ্যা প্রতিশ্রুতি প্রদান,ওয়াদা ভঙ্গ- এ সবই বৈধ। তার মতে রাজনীতিতে এ সকল বিষয়কে কখনই নিন্দনীয় বলা যাবে না।

ম্যাকিয়াভেলীর পরে অন্যান্য কিছু দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে যারা এ মতবাদকে রাজনীতির বাইরেও সাধারণভাবে প্রয়োগ করে একে একটি নৈতিক ও সাধারণ নিয়মে পরিণত করেন। ফলে সর্বোচ্চ মানবিক নৈতিকতা বলতে তাদের কাছে ক্ষমতা ও শক্তিই বুঝায়। এটা তাদের পক্ষ থেকে রাজনীতিকদের জন্য একটি সবুজ সংকেত যে,যা কিছু ইচ্ছা করতে পার। নৈতিকতার আলোচনায় প্রথম এ বিষয়টি আনেন জার্মান দার্শনিক নীচে বা নীট্সে। (নীট্সে তার শেষ জীবনে পাগল হয়ে যান। আমার মতে পাগলামীর আলামত তার প্রথম জীবনেই ছিল।)