ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41074
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41074 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

ক্ষমতার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

ক্ষমতার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কিরূপ? ইসলাম সবলতার পক্ষে নাকি দুর্বলতার পক্ষে প্রচার চালিয়েছে। নাকি সবলতার পক্ষেও নয় বা দুর্বলতার পক্ষেও নয়? এর জবাব হলো ইসলাম এক অর্থে ক্ষমতার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে তবে তা নী চের প্রচারিত ক্ষমতা নয়,বরং এমন ক্ষমতা যা মানবিকতার সব উচ্চ বোধকে ধারণ করে এবং দয়া,অনুগ্রহ,আত্মত্যাগ ও সকল উচ্চতর মানবীয় গুণাবলী হতে উৎসারিত।

ইসলামে নিঃসন্দেহে ক্ষমতা ও শক্তির দিকে আহবান জানানো হয়েছে। কোরআন ও হাদীস এর পক্ষে দলিল। অন্য যারা ইসলামের বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তারাও ইসলামকে সকল ধর্মের মধ্যে ক্ষমতার ব্যাপারে অধিকতর মনোযোগী দেখেছেন। কোন ধর্মই ইসলামের মতো এত অধিক ক্ষমতা ও শক্তির দিকে আহবান করেনি। উইল ডুরান্ট তার সভ্যতার ইতিহাস গ্রন্থের একাদশ খণ্ডে ইসলামী সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সেখানে এ উক্তিটি করেছেন, কোন ধর্মই ইসলামের মতো তার অনুসারীদের ক্ষমতা ও শক্তির দিকে আহবান করেনি।

এ বিষয়ে কোরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। এক স্থানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্পাক বলছেন,

) يَا يَحْيَىٰ خُذِ الْكِتَابَ بِقُوَّةٍ (

হে ইয়াহিয়া! কিতাবকে (বিধানকে) শক্তিমত্তার সঙ্গে গ্রহণ কর। (সূরা মারইয়াম : ১২)

আমার বক্তব্যের শুরুতে যে আয়াতটি তেলাওয়াত করেছি দেখুন তা কতটা বিপ্লবী ও মুমিনদের কিরূপ শক্তিমান ব্যক্তিরূপে বর্ণনা করে বলেছে,

) وَكَأَيِّن مِّن نَّبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِ‌بِّيُّونَ كَثِيرٌ‌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّـهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّـهُ يُحِبُّ الصَّابِرِ‌ينَ (

(সূরা আলে ইমরান : ১৪৬) .০৩১

কত ঐশী ব্যক্তি নবীদের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করেছে এবং আল্লাহর পথে যখন কোন কষ্ট তাদের স্পর্শ করেছে তখন কোন ক্লান্তি,দুর্বলতা ও অযোগ্যতা প্রদর্শন করেনি বা দমেও যায়নি। আর যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহ্ তাদের ভালোবাসেন।

অন্যত্র মহান আল্লাহ্ বলেছেন,

) إِنَّ اللَّـهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُم بُنْيَانٌ مَّرْ‌صُوصٌ (

যারা আল্লাহর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে তারা যেন সীসা ঢালা প্রাচীর। তিনি তাদের ভালোবাসেন। (সূরা ছফ : ৪)

তিনি আরো বলেছেন,

) مُّحَمَّدٌ رَّ‌سُولُ اللَّـهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ‌ رُ‌حَمَاءُ بَيْنَهُمْ (

মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং যারা তার সাথে রয়েছে তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর এবং নিজেদের (মুমিনদের) মধ্যে রহম দিল। (সূরা ফাত্হ : ২৯) এরূপ আয়াত কোরআনে প্রচুর রয়েছে।

ইসলামে সাহসিকতা একটি প্রশংসিত গুণ। সম্মানবোধ একটি উচ্চ মর্যাদার বিষয় যার অর্থ এ পরিমাণ ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী হওয়া যাতে কেউ তাকে দুর্বল ও লাঞ্ছিত করতে না পারে। দেখুন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুতির পক্ষে ইসলাম কি বলছে?

( وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّ‌بَاطِ الْخَيْلِ تُرْ‌هِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّـهِ وَعَدُوَّكُمْ )

শত্রুর মোকাবিলার জন্য সর্বোত্তম শক্তির প্রস্তুতি গ্রহণ কর,অস্ত্র ও বাহন (পালিত ঘোড়া) প্রস্তত কর যেন আল্লাহর ও তোমাদের শত্রুরা তোমাদের হতে ভীত হয় (তোমাদের প্রতি লোভের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে না পারে)। অন্য একটি আয়াতে বলেছেন,

( وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللَّـهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ)

তোমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর,কিন্তু সীমালঙ্ঘন করো না (অর্থাৎ শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধের সময়েও সত্য ও ন্যায়ের সীমাকে সংরক্ষণ কর) নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।

এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে,শত্রুর সঙ্গে ততক্ষণ যুদ্ধ কর যতক্ষণ সে যুদ্ধ করে। শত্রু যখন আত্মসমর্পণ করে অস্ত্রসংবরণ করবে তখন তোমরা আর অস্ত্রকে ব্যবহার করো না। কারণ তা সীমালঙ্ঘনের শামিল। বৃদ্ধ,নারী ও শিশুদের হত্যা করো না,তাদের প্রতি অত্যাচার করো না। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। এগুলো কোরআন কর্তৃক নির্দেশিত যুদ্ধের সীমা। এরূপ আয়াত কোরআনের অন্যান্য স্থানেও রয়েছে।

হাদীসসমূহে শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার বিষয়

এখানে আপনাদের জন্য কয়েকটি হাদীস পড়ছি যা থেকে বোঝা যাবে যে,ইসলাম ভীতি ও দুর্বলতাকে কতটা নিন্দনীয় এবং ক্ষমতা ও শক্তিকে কতটা প্রশংসনীয় মনে করেছে অবশ্য ইসলামের শক্তিমত্তা ও ক্ষমতা নী চের বর্ণিত ক্ষমতা নয়।

রাসূল (সা.) বলেছেন,لا ینبغی للمؤمن ان یکون بخیلا و لا جبانا মুমিনদের জন্য দু টি বিষয় অনাকাঙ্ক্ষিত (তার মধ্যে থাকতে পারে না) : একটি কৃপণতা (অর্থাৎ অর্থের প্রতি মোহ) এবং অন্যটি ভয়। (উসূলে কাফী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৬৩)

মুমিন কখনও ভীত নয় বরং সাহসী ও শক্তিশালী। রাসূল তার দোয়ার মধ্যে পড়তেন :

اللهم إنّی أعوذ بک من البخل و أعوذ بک من الجبن

হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট কৃপণতা ও ভীরুতা হতে আশ্রয় চাই।

আলী (আ.) মুমিনদের সম্পর্কে বলেছেন,المؤمن نفسه أصلب من الصّلد মুমিনদের আত্মা কঠিন শিলা হতেও কঠিনতর এবং দৃঢ়।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,

إنّ الله عزّ و جلّ فوّض إلی المؤمن أموره کلّها و لم یفوّض إلیه أن ذلیلا

আল্লাহ্ মুমিনকে সকল কিছুর অধিকার দান করেছেন শুধু একটি বিষয়ের অধিকার ব্যতীত এবং তা হচ্ছে নিজেকে অন্যের নিকট ছোট করার অধিকার (অর্থাৎ অপমানিত হওয়ার অধিকার ব্যতীত)।

أما تسمع قول الله تعالی یقول : ولله العزّة و لرسوله و للمؤمنین

তুমি আল্লাহর এ বাণী শোননি যে,তিনি বলেছেন : নিশ্চয় সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ্,তার রাসূল এবং মুমিনদের জন্য।

فالمؤمن یکون عزیزا و لا یکون ذلیلا

মুমিন সব সময়ই সম্মানিত এবং কখনই অপমানিত হতে পারে না।

إنّ المؤمن أعزّ من الجبل

মুমিন পর্বত হতেও সমুচ্চ এবং সম্মানিত।

কারণ পর্বতের একটি অংশকে বা পাথরগুলোকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব,কিন্তু মুমিন ব্যক্তির আত্মিক শক্তিকে খর্ব করা সম্ভব নয়।

إنّ الجبل یستقلّ عنه بالمعول، و المؤمن لا یستقلّ من دینه شئ

পর্বতকে কুঠার বা ক্রেন দিয়ে স্থানচ্যুত করা সম্ভব,কিন্তু মুমিনকে তার ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।

ইমাম বাকির (আ.) বলেন, মহান আল্লাহ্ মুমিনকে তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন : এক দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান; দুই উভয় দুনিয়ায় সাফল্য এবং المهابة فی صدور الظالمین অত্যাচারী ও ইসলামের শত্রুদের তাদের বিষয়ে আতঙ্ক (অর্থাৎ মুমিনদের ব্যক্তিত্বের কারণে অন্যায়কারীর হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হয়)।

যেহেতু আত্মিক শক্তি হতেই গাইরাত (ধর্মীয় ও ব্যক্তিসত্তাগত আত্মমর্যাদাবোধ- পারিভাষিক অর্থে গাইরাত হলো ব্যক্তির মানবীয় আত্মসম্মানবোধ যে কারণে সে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-বিধান,স্ত্রী ও পরিবারের নারীদের সম্মান রক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় চেতনাবোধ সংরক্ষণের তাড়না অনুভব করে) সৃষ্টি হয় তেমনি দুর্বলতা হতে সৃষ্টি হয় ধর্মীয় ও ব্যক্তিসত্তার প্রতি অনীহা ও উপেক্ষার মানসিকতার।

রাসূল বলেছেন, হযরত ইবরাহীম (আ.) ধর্ম ও আত্মসম্মানবোধে ছিলেন খুবই সচেতন,আমি এ বিষয়ে তার থেকেও সচেতন। তেমনি রাসূল বলেছেন,

جدع الله أنف من لا یغار علی المؤمنین و المسلمین

আল্লাহ্পাক সেই ব্যক্তির নাসিকাকে কর্তন করুন যার গাইরাত নেই (অর্থাৎ তার সম্মুখে তার ধর্ম,পরিবার ও সমাজ লাঞ্ছিত হয়,অথচ সে তার প্রতিবাদ করে না- এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ্ লাঞ্ছিত করুন)।

তৎকালীন আরবে সা দ নামক এক আত্মসম্মানী ব্যক্তি ছিলেন। তার বিষয়েও রাসূল (সা.)বলেছেন, আমি তার থেকেও অধিক আত্মসম্মান রক্ষাকারী।

পাকিস্তানী কবি ইকবাল একটি সুন্দর কথা বলেছেন। সম্ভবত মুসোলিনীর কথার বিপরীতেই তিনি এ কথাটি বলেছেন। মুসোলিনী বলেছেন, যার হাতে লৌহ রয়েছে সে-ই রুটি পাবে। অর্থাৎ যদি খাদ্য পেতে চাও তবে তোমাকে অস্ত্র ও শক্তির অধিকারী হতে হবে। ইকবাল বলেন, যে নিজেই লৌহে পরিণত হয়েছে সে-ই রুটি পাবে। মুসোলিনী অস্ত্র ও বস্তুগত শক্তির উপর নির্ভর করেছেন,কিন্তু ইকবাল ব্যক্তির রূহ,প্রাণ ও মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করে বলেছেন,নিজকেই লৌহ হতে,তবেই রুটি পাবে। আমীরুল মুমিনীন (আলী) বলেছেন,

نفس المؤمن أصلب من الصّلد

মুমিনদের আত্মা কঠিনতম শিলা হতেও কঠিনতম।

এ সকল হাদীসে ইসলাম যে বিষয়ের প্রতি আহবান করেছে তা হচ্ছে শক্তিমত্ত ও ক্ষমতা।

লক্ষ্য করুন আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় শক্তি ও ক্ষমতার প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন এবং দুর্বলতাকে ইসলামী সমাজের জন্য অনুপযোগী মনে করেছেন যেমন তিনি বলেছেন,

فوالله ما غزی قوم قطّ فی عقر دارهم إلاّ ذلّوا

আল্লাহর কসম,যে জাতি তার ঘরের মধ্যে আক্রান্ত হয়,সে জাতি লাঞ্ছিত হতে বাধ্য। অন্যত্র বলেছেন,

و لا يمنع الضّیم الذّلیل و لا یدرک الحقّ إلاّ بالجدّ

ভীরু ও কাপুরুষ ব্যক্তি জুলমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না তেমনি পারে না তাকে প্রতিরোধ করতে এবং দৃঢ়তা ও কর্ম প্রচেষ্টা ব্যতীত সত্যে পৌছানোও সম্ভব নয় (অর্থাৎ অধিকার লাভ সম্ভব নয়)। (নাহজুল বালাগাহ্,খুতবা নং ২৭)

অধিকার অর্জন করতে হয় নাকি দিতে হয়?

পাশ্চাত্যের ধারণায় সত্য ও অধিকার অর্জন করতে হয়। সুতরাং এ বিষয়টি বিবেচ্য যে,অধিকার অর্জনীয় নাকি দেয় ? অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে কোনটি সঠিক- মানুষের অপরের অধিকারকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দেয়া উচিত নাকি ব্যক্তিকে তার অধিকার অর্জন করতে হয়? কোন কোন মতাদর্শের দৃষ্টিতে অধিকার দেয় ,তাই অবৈধ অধিকার দখলকারী ব্যক্তির উচিত অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। যদি সে না দেয় তবে কিছু করার নেই। অধিকার যেহেতু দেয় তাই দাবি করা বা এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া ঠিক নয়। খ্রিষ্ট ধর্মের অন্যতম মূলনীতি এটা যে,অধিকার হরণকারীকে বলব তোমার অধিকার ফিরিয়ে দিতে। এরপর তার সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা করো না। হে অধিকারহারা মানুষ! তোমাদের প্রতি আমাদের (খ্রিষ্টবাদের) উপদেশ ও অনুরোধ হলো যতক্ষণ অত্যাচারী ব্যক্তি তোমাদের অধিকার ফিরিয়ে না দেবে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করো না,কারণ তা মানবতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী কাজ।

আবার আরেক দল বলেন,অধিকার আদায় করে নিতে হয়। এটা সম্ভব নয় যে,যে ব্যক্তি অধিকার হরণ করেছে সে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অধিকার ফিরিয়ে দেবে। কারণ অধিকার হরণকারী ব্যক্তি মানবতা,বিবেক ও সহমর্মিতার বিরোধী।

কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে অধিকার যেমন অর্জনীয় তেমনি দেয় । অর্থাৎ ইসলাম অধিকার পাবার জন্য দু টি ফ্রন্টে সংগ্রাম করে। একটি ফ্রন্টে অধিকার হরণকারীকে প্রশিক্ষিত করে,যে অধিকারসমূহ সে হরণ করেছে সেগুলোকে ফিরিয়ে দেয়ার মানসিকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলাম এটুকু করেই তার কর্মের সমাপ্তি ঘটেছে বলে মনে করে না,বরং অন্য ফ্রন্টে অধিকারহৃত ব্যক্তিকে সচেতন করে বলে,অধিকার অর্জনীয়। তাই অধিকার আদায়ের জন্য প্রচেষ্টা চালাও এবং তা অর্জন কর।

আলী (আ.) তার প্রসিদ্ধ একটি পত্র যা মালিক আশতারকে লিখেছিলেন সেখানে বলেছেন, রাসূল(সা.)-কে বলতে শুনেছি-

فإنّی سمعت رسول الله (ص) یقول فی غیر موطن : لن نقدّس أمّة حتی یؤخذ للضّعیف حقّه من القویّ غیر متتعتع

কোন জাতিই সম্মান ও মর্যাদার পবিত্র স্থানে পৌছতে পারে না যতক্ষণ না তাদের দুর্বলরা শক্তিমানদের নিকট থেকে তাদের অধিকার আদায় করে নেবে,অথচ তাদের মধ্যে কোন দ্বিধা থাকবেনা।

যে দুর্বল নিজের অধিকার আদায়ের জন্য সোচ্চার হয় না ইসলাম তাকে অযোগ্য মুসলমান বলে মনে করে। যে সমাজে দুর্বলরা এতটা দুর্বল মনের যে,নিজের অধিকারের জন্য প্রচেষ্টা চালানোর সাহস পায় না সে সমাজকে মুসলিম সমাজ বলে মনে করে না।

আমাদের মুসলিম জাতির প্রাথমিক যুগের মহান ব্যক্তিবর্গ কিরূপ ছিলেন? স্বয়ং আমাদের নবী কিরূপ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন?

রাসূলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে,তিনি শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই শক্তিশালী ছিলেন। রাসূলের আত্মিক ও মানসিক শক্তির বর্ণনা তার জীবনেতিহাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

রাসূল (সা.)-এর আত্মিক ও শারীরিক ক্ষমতা

রোমান লেখক কুনেস্টান ভিরজিল গিওরগেভ তার নবী মুহাম্মদকে নতুন করে চিনুন গ্রন্থে দু টি বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন (যদিও গ্রন্থটিতে প্রচুর ভুল তথ্য রয়েছে। কারণ ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের কোন ব্যক্তির পূর্ণ ধারণা থাকাটা অস্বাভাবিক,তদুপরি এ দু টি বিষয়কে সুন্দরভাবে চিত্রিত করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন)। একটি হলো রাসূল (সা.)-এর দৃঢ়তা। রাসূল কখনো কখনো এমন অবস্থায় পড়তেন যে,সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনার দ্বার তার সম্মুখে বন্ধ হয়ে যেত,পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকুলে চলে যেত এবং আশার কোন আলোই অবশিষ্ট থাকত না,সে মুহূর্তেও তিনি অবিচল থাকতেন,তার ইচ্ছাশক্তি পর্বতের মতো অটল থাকতো। প্রকৃতই রাসূল (সা.)-এর তেইশ বছরের নবুওয়াতী জীবনে তার অপরিসীম মানসিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। মানুষ যখন তা অধ্যায়ন করে তখন আশ্চর্যান্বিত হয়। এ জন্যই কবি হাস্সান বিন সাবিত (রাসূলের সাহাবী ও প্রসিদ্ধকবি) বলেছেন,

له همم لا منتهی لکبارها

وهمّته الصّغری أجلّ من الدهر

 “ তার বড় হিম্মতের কোন সীমা নেই এবং তার ক্ষুদ্র হিম্মত কালের চেয়েও মহিমান্বিত।

রাসূল (সা.) বাহ্যিক শক্তি ও ক্ষমতায় যেমন শক্তিশালী মানুষ ছিলেন তেমনি তার সুঠাম দেহ সাহসিকতার স্বাক্ষর বহন করত। রাসূল মোটাও ছিলেন না আবার শীর্ণও ছিলেন না বরং মধ্যম শরীরের অধিকারী ছিলেন। তার পেশীসমূহ পরস্পর সংযুক্ত ও দৃঢ় ছিল,স্থল দেহের মানুষের মতো তার পেশী ঢিলা ছিল না।

রাসূলের সাহসিকতা এ পর্যায়ের ছিল যে,স্বয়ং আলী (আ.) বলেছেন,

وکنّا إذا احمرّ البأس اتّقینا برسول الله صلّی الله علیه و آله

কখনো কখনো পরিস্থিতি যখন আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ত,আমরা রাসূল (সা.)-এর আশ্রয় গ্রহণ করতাম। (নাহজুল বালাগাহ্,আলীর অপরিচিত বাণী নং ৯)

প্রায় আট বছর পূর্বে প্রথমবার যখন মক্কায় হজ্বে গিয়েছিলাম তখন সেখানে একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম যা আমার জন্য আশ্চর্যজনক কিন্তু সুখময় ছিল। যখন পেছন থেকে রাসূল (সা.)-কে দেখেছিলাম ঠিক তখনই আলী (আ.)-এর উপরিউক্ত বাণীর কথা স্বপ্নেই অজান্তে মনে হয়েছে। মুখে আওড়িয়েছিলাম আলী (আ.) অযথা এ কথা বলেননি।

রাসূল নিজে যেমন শক্তিমান ও সাহসী ছিলেন তেমনি শক্তিমত্তা ও সাহসিকতাকে প্রশংসা করতেন। সুতরাং ইসলামে ক্ষমতা ও শক্তির বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে এবং শক্তি ও ক্ষমতা ইসলামে অন্যতম মূল্যবোধ বলে গৃহীত হয়েছে।

অন্য আরেকটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করছি। এর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ইনশাল্লাহ্ পরবর্তী বৈঠকে করব। শক্তি ও ক্ষমতা একটি মূল্যবোধ হিসেবে ইসলামের অন্যান্য অসংখ্য মূল্যবোধের পাশে অবস্থান করছে। তাই এ সকল মূল্যবোধ একত্রিতভাবে পূর্ণ মানব বা ইনসানে কামেল সৃষ্টি করে। জনাব নী চে সকল মূল্যবোধ হতে শুধু ক্ষমতার মূল্যবোধকে গ্রহণ করেছেন। যদি একটি বৃক্ষের সকল শাখা কর্তন করে শুধু একটি শাখা রেখে দেয়া হয় তবে শুধু ঐ শাখাটিরই বৃদ্ধি ঘটবে এবং অন্য সকল শাখার অবলুপ্তি হবে। ইসলাম ও নী চের মতবাদের মধ্যে পার্থক্য হলো নী চের মতে মানুষের মধ্যে শুধু একটি মূল্যবোধ রয়েছে এবং তা ক্ষমতা ও শক্তি। এ মূল্যবোধের জন্য অন্য সকল মূল্যবোধকে তিনি বিসর্জন দিতে বলেছেন। কিন্তু ইসলামে উচ্চ মর্যাদার মূল্যবোধগুলোর অন্যতম মূল্যবোধ হলো ক্ষমতাএবং এটা যখন অন্য মূল্যবোধগুলোর পাশে এসে দাঁড়ায় তখনই তা পূর্ণতা লাভ করে,নতুবা নয়।

ক্ষমতা ও প্রেমের মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

) إِنَّ اللَّـهَ يَأْمُرُ‌ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ‌ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُ‌ونَ (

 (সূরা নাহল : ৯০)

গত আলোচনায় আমাদের বিষয়বস্তু ছিল ক্ষমতার মতবাদে পূর্ণ মানব। আমরা জেনেছি এ মতবাদে পূর্ণতা ও ক্ষমতা একই বিষয় আর অক্ষমতাই হলো অপূর্ণতা। এমনকি ভালো-মন্দও এ মাপকাঠিতে মাপা হয়ে থাকে। ভালো অর্থ ক্ষমতা। তাই ভালোত্ব হচ্ছে ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। আর মন্দ হচ্ছে অক্ষমতা। তাই মন্দত্ব হলো ক্ষমতা ও শক্তির অনুপস্থিতি।

দর্শন সাধারণত যে কোন আলোচনা পূর্ণতা ও অপূর্ণতার আলোকে এবং ধর্মশাস্ত্রবিদগণ ভালো-মন্দের আলোকে ব্যাখ্যা করে থাকেন। ক্ষমতার মতবাদ পূর্ণত্ব ও অপূর্ণত্ব এবং ভালো ও মন্দের সকল বৈশিষ্ট্যকে ক্ষমতা ও অক্ষমতার মানদণ্ডে যাচাই করে। দর্শন যখন পূর্ণত্ব ও অপূর্ণত্বের কথা বলে তখন বলে,পূর্ণত্ব হলো ক্ষমতার অধিকারী হওয়া আর অপূর্ণত্ব হলো ক্ষমতাহীন হওয়া। ধর্মশাস্ত্রবিদগণ যখন বলেন ভালো ও মন্দ,তখন এরা বলেন ক্ষমতা আর অক্ষমতা। তাই এ মতবাদে সত্য ও মিথ্যা,ন্যায় ও অন্যায় এ মাপকাঠিতেই চিন্তা করা হয়। অর্থাৎ সত্য ক্ষমতা হতে বিচ্ছিন্ন কিছু নয় আর মিথ্যা ও অক্ষমতা ও পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। ন্যায় ও অন্যায়ও তা-ই। সুতরাং দু ব্যক্তি যদি পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং তাদের একজন অপর জন অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী হয়,তবে সে পূর্ণতর এবং উত্তমও বটে। তাই সত্য ও ন্যায়ও তার পক্ষে। আর যে পরাজিত ও অক্ষম সে এই পরাজয় ও অক্ষমতার কারণেই মন্দ,অপূর্ণ,মিথ্যা ও অন্যায়ের ধ্বজাধারী। কারণ পরাজয়,অক্ষমতা ও ত্রুটি অন্যায় ও মন্দ।

এ মতবাদের ত্রুটি

ক্ষমতার মতবাদে দু টি বড় ত্রুটি রয়েছে। প্রথমত মানবের সকল মূল্যবোধের মধ্যে ক্ষমতার মূল্যবোধ ব্যতীত বাকি সকল মূল্যবোধকে এ মতবাদ উপেক্ষা করেছে। ক্ষমতা একটি মানবিক মূল্যবোধ হিসেবে বর্তমানের পরিভাষায় একটি valeur (ফ্রেঞ্চ শব্দ) এবং দর্শনের পরিভাষায় তা যে একটি পূর্ণত্ব তাতে সন্দেহ নেই। নিঃসন্দেহে ক্ষমতা একটি পূর্ণত্বের সমান,কিন্তু সমগ্র পূর্ণত্ব ক্ষমতার সমান নয়। এ জন্যই দার্শনিক ও প্রাজ্ঞরা বলেছেন, ওয়াজিবুল উজুদ বা অপরিহার্য চিরন্তন অস্তিত্বের সত্তা যা শুধুই অস্তিত্ব সে অস্তিত্ব পূর্ণতার সমান। তাই যা কিছুই পূর্ণত্বের সমান আল্লাহর সত্তার জন্য তা প্রমাণ করে। এজন্যই বলা হয় পূর্ণত্বের মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতা এবং ক্ষমতা নিজেই একটা পূর্ণতা যেরূপ জ্ঞান,ইচ্ছা এবং স্বাধীনতা ও জীবন পূর্ণতা সেরূপ ক্ষমতাও।

সুতরাং ক্ষমতা যে মানুষের জন্য একটি পূর্ণতা তাতে সন্দেহ নেই। এ কারণেই দুর্বলতার মতবাদ দুর্বলতার পক্ষে যে প্রচারণা চালায় তা সম্পূর্ণরূপে ভুল। কিন্তু কথা হচ্ছে ক্ষমতা একমাত্র পূর্ণতা নয়। যেমনটি মহান আল্লাহর পূর্ণত্বের মধ্যে আমরা দেখি যে,ক্ষমতা একমাত্র পূর্ণতা নয় বরং তার মধ্যে পূর্ণতার সকল গুণাবলী রয়েছে। অথবা তার যে অসংখ্য সুন্দর নাম (আসমায়ে হুসনা) রয়েছে সেই সব সুন্দর নামের একটি হলো কাদীর বা সর্ব শক্তিমান এবং তার এ অসীম ক্ষমতার মধ্যে সকল পূর্ণর্তা সীমিত নয়।

দ্বিতীয় যে ভুলটি এ মতবাদের রয়েছে তা প্রথমটি হতে বড় না হলেও ছোট নয়। তারা ক্ষমতার অর্থেই ভুল করেছেন। এ মতবাদে শুধু অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধকে অস্বীকারই করা হয়নি বরং তারা ক্ষমতার দাবিদার হিসেবেও ক্ষমতাকে সঠিকভাবে চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা ক্ষমতা ও শক্তির একটি দিককে চিনেছেন আর সেটা হচ্ছে পশু শক্তি। পশু শক্তি হচ্ছে সেই শক্তি বা ক্ষমতা যা পশুর দেহে রয়েছে। পশুর সকল ক্ষমতা তার দেহের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং পশুর সকল চাওয়া-পাওয়া তার প্রবৃত্তির অনুগত। মানুষের গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সেখানেই যে,তার মধ্যে দৈহিক শক্তির বাইরেও এক শক্তি রয়েছে। তাই ইসলামের মতবাদ যদি ক্ষমতার মতবাদ হতো তাহলে তার ফলাফল নী চে যা বলেন তা হতো না। নী চে বলেন, মানুষের ক্ষমতার অনুগত হওয়া উচিত। ক্ষমতা অর্জনের জন্য তাকে প্রচেষ্টা চালাতে হবে , যখন ক্ষমতা অর্জন করবে তখন দুর্বলের উপর তা প্রয়োগ করবে , প্রবৃত্তির বিরোধিতা না করে তার অনুসরণ করো, দুনিয়ার বস্তুগত সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করো । দৈহিক ক্ষমতার বাইরের ক্ষমতায় বিশ্বাস করলে তার ফল এগুলো হবে না।