ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 11%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42384 / ডাউনলোড: 7058
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

আত্মিক শক্তি ও ক্ষমতা

এখানে আমরা রাসূল (সা.)-এর জীবনী হতে একটি ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতার মাপকাঠি কি- তা আলোচনা করব। হাদীস গ্রন্থসমূহে এসেছে,রাসূল (সা.) একদিন মদীনার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন,একদল মুসলমান যুবক পাথর উত্তোলনের (ভারত্তোলনের) মাধ্যমে নিজেদের শক্তি পরীক্ষা করছে। যে যত অধিক ওজনের পাথর উঠাতে পারে সে তত শক্তিশালী। সকলেই চেষ্টা করছিল অপর হতে অধিক ভার উত্তোলনের। নবী (সা.) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা চাইলে তোমাদের এ প্রতিযোগিতার আমি বিচারক হতে পারি। সবাইখুশী হয়ে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে যে, আপনি আমাদের এ প্রতিযোগিতার বিচারক হয়ে ঘোষণা করবেন আমাদের মধ্যে কে সবচেয়ে শক্তিশালী। নবী বললেন, প্রয়োজন নেই তোমরা এ জন্য পাথর উত্তোলন করবে। আমি তোমাদের হাতে শক্তি মাপার একটি মানদণ্ড দান করব। সবাই বলল, তা কি? নবী বললেন, কোন ব্যক্তির প্রবৃত্তি যখন তাকে গুনাহ করার জন্য প্ররোচিত করে তখন যদি সে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় ও যে গুনাহের প্রতি তার মন আকৃষ্ট হয়েছে তা থেকে বিরত হয় তাহলে সে-ই সবচেয়ে শক্তিশালী।

এখানে নবী (সা.) ইচ্ছাশক্তি ও মানসিক ক্ষমতাকে প্রবৃত্তির আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে উল্লেখ করেছেন। কারণ শক্তি ও ক্ষমতা শুধু এটাই নয় যে,মানুষ শারীরিক শক্তিতে ভারী পাথর উত্তোলন করবে যা ক্ষমতার দৈহিক প্রকাশ মাত্র এবং সকল প্রাণীই এ শক্তির অধিকারী। তাই এরূপ শক্তির ক্ষেত্রে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী একই পর্যায়ে রয়েছে। অবশ্যই আমরা এটা বলছি না যে,এরূপ শক্তি ও ক্ষমতা পূর্ণতা নয়। বরং আমরা বলছি এটাও এক প্রকার পূর্ণতা কিন্তু দৈহিক শক্তির যে পূর্ণতা তা হতে উচ্চতর পূর্ণতা হলো মানুষের ইচ্ছা ও মানসিক শক্তি যা তার আত্মিক ক্ষমতার প্রকাশ। মানুষের আত্মিক শক্তি তার প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার বিপরীতে তাকে দাঁড়ানোর শক্তি ও ক্ষমতা দান করে।

এ যুক্তিতেই ইসলামী নৈতিকতায় বিশেষত এরফানী সাহিত্যে আত্মিক শক্তিকেই প্রকৃত ক্ষমতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন, أشجع النّاس من غلب هواه মানুষের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি হলো সে-ই যে তার প্রবৃত্তির ইচ্ছার উপর জয়ী হয়েছে। এখানে সাহসিকতা,ক্ষমতা ও জয়ের কথা বলা হয়েছে। যেমন সা দী বলেন,

পৌরুষ তা নয় যা দ্বারা আঘাত হানা হয় পরের মুখে

পৌরুষ তা-ই যা প্রবৃত্তির মোকাবিলায় অপরকে রাখে সুখে।

পৌরুষ (শক্তি ও ক্ষমতা) এটা নয় যে,মানুষ তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দিয়ে কারো মুখে আঘাত হানবে,বরং পৌরুষ সেটাই যে,মানুষ তার প্রবৃত্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্যকে সন্তুষ্ট ও তার ইচ্ছা পূরণ করে।

মৌলভী (রুমী) বলেন,

ক্রোধ ও লালসায় সংযত সেই পুরুষ কোথায়?

যারে খুঁজে ফিরি আমি পর্বত হতে পর্বত চুড়ায়।

মাওলানা রুমী ক্ষমতাবান মানুষকে ক্রোধ ও লিপ্সার সময় খুজেছেন। যখন ক্রোধে মানুষ লেলিহান শিখায় পরিণত হয় তখন ক্ষমতাবান পুরুষ চরম আত্মিক শক্তির অধিকারী হওয়ায় এ ক্রোধাগ্নির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যখন প্রবৃত্তির লালসা তার মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে তখন সে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের চেষ্টায় রত হয়। এটাকেই ক্ষমতা ও শক্তি বলা হয়। নৈতিকতার যে সুন্দর বৈশিষ্ট্যসমূহের কথা নীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং নী চে দুর্বলতা বলে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন,যদি সঠিক ভাবে আমরা সেগুলো যাচাই করি তাহলে দেখব এ সবই ক্ষমতা। অবশ্য আমি বিশ্বাস করি,কখনো কখনো এমন অনেক বিষয় যা শক্তি ও ক্ষমতা নয় কিন্তু শক্তি ও ক্ষমতা বলে ভুল হয়। তাই নীতিশাস্ত্রবিদরা বলেন,স্নেহ-ভালোবাসা বুদ্ধিবৃত্তি ও ঈমান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। অর্থাৎ যেখানেই আমাদের স্নেহও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটবে দেখতে হবে তা যুক্তিসঙ্গত কিনা?

স্নেহও সহানুভূতির সঠিক ও অযাচিত প্রকাশ

প্রথমে সা দীর একটি কবিতা ও পরে কোরআনের একটি আয়াত আপনাদের জন্য পড়ব। সা দীতার কবিতায় বলেছেন,

যদি দেখাও সহানুভূতি ধারালো দাঁতের নেকড়ের প্রতি

জুলুম করলে তুমি নিরীহ মেষ শাবকের প্রতি।

কোন চিতা বা নেকড়ের প্রতি সহানুভূতি দেখানো মেষদের প্রতি জুলমের শামিল। অর্থাৎ শত শত মেষ হত্যাকারী কোন নেকড়েকে যদি হত্যা করা হয় আর তাতে কারো ঐ নেকড়ের প্রতি মায়া জন্মে, তবে মেষদের প্রতি অবিচার করা হলো। এটি অবশ্য সা দী উদাহরণ দিয়েছেন। মূলত তার উদ্দেশ্য অত্যাচারী এবং তার অধীন অসহায় ও বঞ্চিত মানুষরা। দুর্বল আত্মার লোকেরা অত্যাচারীদের প্রতি অজ্ঞতাবশত সহানুভূতি প্রদর্শন করে থাকে।

জেনাকারী পুরুষ ও নারীর ব্যপারে কোরআনে আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। যদি স্ত্রী রয়েছে এরূপ কোন পুরুষ বা স্বামী রয়েছে এরূপ কোন নারী জেনা করে ইসলামে তার শাস্তি হচ্ছে তাদেরকে পাথর ছুড়ে হত্যা করতে হবে। কোরআন বলছে,এদের শাস্তিদান ও হত্যার সময় একদল মুমিনকে সেখানে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে।

( وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَائِفَةٌ مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ ) এ রকম ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ যারা সমাজের উচ্চতর সঠিক কল্যাণের দিকটি লক্ষ্য করে না তাদের সহানুভূতি জেগে উঠে বলতে পারে,এ কাজ না করে তাদের প্রতি অনুগ্রহ দেখানো উচিত।

কোরআন বলছে,وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَ‌أْفَةٌ فِي دِينِ اللَّـهِ আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি তোমাদের মনে যেন দয়ার উদ্রেক না হয়।

এটা ঐশী বিধান কার্যকর করার স্থান যে ঐশী বিধান উচ্চতর কল্যাণ ও মানবতার সার্বিক শৃঙ্খলা বিধানের জন্য প্রণীত হয়েছে,তাই এখানে সহমর্মিতার স্থান নেই। কেউ এরূপ ক্ষেত্রে সহমর্মিতা দেখালে তা সমাজের প্রতি জুলমের শামিল।

এরূপ অপর একটি বিষয় যা অনেকেই বলে থাকেন তা হলো মৃত্যুদণ্ড আবার কেন? মৃত্যুদণ্ড অত্যন্তু অমানবিক বিষয়। অপরাধী যে অপরাধই করুক তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে না। এরা এদের এ কর্মকাণ্ডকে এভাবে ব্যাখ্যা করে যে,অপরাধীকে সংশোধন করতে হবে।

কত বড় ভুল কথা! এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে,মানুষকে সংশোধন করতে হবে,কিন্তু অবশ্যই তা অপরাধে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে যাতে করে কোন অপরাধ সংঘটিত না হয়। কিন্তু অধিকাংশ সমাজেই শিক্ষা ও নৈতিক প্রশিক্ষণের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই,বরং অনৈতিকতা ও বিশৃঙ্খলার উপাদান পুরো মাত্রায় বিদ্যমান। কিংবা ধরি,কোন সমাজে নৈতিক প্রশিক্ষণের সকল সুবিধা বিদ্যমান,কিন্তু সমাজে সব সময় একদল অপরাধ প্রবণ বিচ্যুত ব্যক্তি রয়েছে যারা ঐ সমাজেও অপরাধে লিপ্ত হয়। এদের জন্য কি করা উচিত? আমরা অপরাধীকে সংশোধন করব- এ অজুহাতে অপরাধীকে অপরাধ করার সুযোগ দেব আর তারপর যখন অপরাধ সংঘটিত হবে তখন তাকে সংশোধন করতে যাব। এভাবে সকল অপরাধীকে গ্রীন সিগনাল দেয়া হবে এবং তারা অপরাধ করতে উৎসাহিত হবে। সে নিজেকে বলবে,সমাজ এতদিন আমার সংশোধনের চিন্তায় ছিল না- যখন আমি কিশোর ছিলাম তখন আমার পিতা আমাকে প্রশিক্ষিত করার ও সংশোধনের পদক্ষেপ নেননি,যখন বড় হয়ে সমাজে প্রবেশ করেছি তখনও সমাজ তা করেনি,এখন অপরাধ করার পর জেলে আমাকে প্রশিক্ষিত ও সংশোধন করা হবে। তাই প্রথমে একটি অপরাধ করি তাহলে সমাজ আমাকে সংশোধনের সুযোগ পাবে।

আরেক দল বলেন,চোরের হাত কাটা হবে কেন? যে সকল মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণ তারাই এ কথা বলেন। আপনারা দৈনিক পত্রিকার পাতাগুলো লক্ষ্য করুন,দেখবেন চুরি-ডাকাতির কারণে কি পরিমাণ সম্পদ মানুষের হাতছাড়া হয় শুধু তাই নয়। কত মানব হত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত হয় যদি চোরের যথাযথ শাস্তি হয় এবং চোর জানে যে,পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তার চার আঙ্গুল কাটা যাবে যা মৃত্যু পর্যন্ত তার দেহে চুরির সাক্ষ্য হিসেবে থাকবে তবে সে কখনই চুরি করবে না। যদি কয়েকজন,এমনকি একজন চোরকেও এ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়,তবে চুরির পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে।

যে সকল হাজী পঞ্চাশ-ষাট বছর (এ গ্রন্থটি প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বের) পূর্বে মক্কা গিয়েছিলেন তারা দেখেছেন,আর যারা না গিয়েছেন তারা হয়তো শুনেছেন যে,তখন সৌদি আরবে চুরি কিরূপ ভয়াবহ ছিল! সে সময় যেহেতু বাস বা প্লেন ছিল না,সবাই উট বা এরূপ অন্য কোন বাহনে হজ্ব করতে যেত। সশস্ত্র ব্যক্তিসহ দু হাজার ব্যক্তির কফেলা না হলে মরুপথে হাজীরা হজ্বে যাওয়ার সাহস পেতেন না। তদুপরি প্রতি বছর শোনা যেত অনেক ব্যক্তি মরুদস্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন,তাদের সম্পদসমূহ লুণ্ঠিত হয়েছে। যদিও দস্যুরাও অনেকেই নিহত হতো,কিন্তু মৃত্যু তাদের জন্য একটি সম্ভাবনা বিধায় তারা এ কাজ হতে সহজেই নিবৃত্ত হতো না। সৌদি সরকার অন্তত এ একটি বিষয়ে পৃথিবীতে সফল হয়েছে (তাদের অন্য কর্মকাণ্ড খারাপ কি ভালো সে আলোচনায় না গিয়ে)। শুধু এক বা দু বছর চোরের হাত কাটার কারণে চুরি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। পূর্বে প্রতি বছরই শত শত চোর ও হাজী নিহত হতেন তাতে কোন প্রভাব পড়ত না। কিন্তু যখন চোরকে আরাফাত বা মিনা বা অন্য কোথাও এনে প্রকাশ্যে হাত কাটার মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হলো এবং কয়েকবার এ কাজের পূনরাবৃত্তি করা হলো তখন দেখা গেল যারা এ কাজ করত তারা ভীত হয়ে এ কাজ হতে বিরত হলো এবং চুরি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। যে দেশটিতে চুরির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল সে দেশটিতেই হাজীদের সুটকেস ও মালপত্র কয়েকদিন এক স্থানে পড়ে থাকে,অথচ কেউ সাহস করে না তাতে হাত দেয়ার বা পা দিয়ে নেড়ে দেখার। যতক্ষণ পর্যন্ত এর মালিককে পাওয়া না যায় তা এভাবেই পড়ে থাকে। এর কারণ হলো চোরের যথাযথ শাস্তির বিধান কার্যকর করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,

( وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَ‌أْفَةٌ فِي دِينِ اللَّـهِ )

তাই এরূপ অপরাধীর প্রতি যে কোনরূপ সহমর্মিতা ও সহানুভূতি প্রদর্শন অযৌক্তিক অর্থাৎ তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন নিরপরাধ ব্যক্তিদের প্রতি নিষ্ঠুরতারই নামান্তর। তাই এরূপ সহানুভূতির কোন স্থান ইসলামে নেই,বরং এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ শক্তিমত্তার প্রকাশ।

সুতরাং ক্ষমতার মতবাদের অনুসারী যারা সব সময় বলে পূর্ণ মানব হলো শক্তিমান মানব,তারা অন্য সকল মানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষাই শুধু করেনি,স্বয়ং ক্ষমতাকে বুঝতে ও সনাক্ত করতেও ব্যর্থ হয়েছে।

হাদীসসমূহের প্রকৃত ক্ষমতা

ক্ষমতা হচ্ছে এটাই যে,মানুষ অন্যের সহযোগিতায় তার হাত প্রসারিত করবে। শক্তিমান আত্মার অধিকারী ব্যক্তি তার সন্তানকে বলেন, کونا للظالم خصما و للمظلوم عونا হযরত আলী (আ.) তার প্রিয় পুত্রদ্বয় ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, হে আমার সন্তানেরা! সব সময় তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতা মজলুমের সহযোগিতায় জালেমের প্রতিরোধে দ্রুত অগ্রসর হবে। এটা ক্ষমতার নিদর্শন। (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৭)

বাস্তবত হিংসা,বিদ্বেষ,অন্যের অকল্যাণ কামনা এরূপ যে সব বিষয় নী চে জন্মদানের চেষ্টা করেছেন এর সবই দুর্বলতাপ্রসূত।

যে ব্যক্তি সব সময় অন্যদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় এবং অন্যদের কষ্ট দেয়ার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে এগুলো ক্ষমতাপ্রসূত নয়,বরং দুর্বলতাপ্রসূত। মানুষ যত শক্তিমান হবে তার মধ্য হিংসা-দ্বেষ তত কমে আসবে।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একটি হাদীস খুবই আকর্ষণীয়। তিনি বলেছেন, القدرة تذهت الحفیظة   ক্ষমতা মন হতে বিদ্বেষ দূর করে। অর্থাৎ যখন মানুষ নিজের মধ্যে ক্ষমতা অনুভব করে তখন অন্যদের প্রতি তার বিদ্বেষ আর থাকে না। (বালাগাতুল হুসাইন,পৃ. ৮৯)

দুর্বল ব্যক্তিরাই কেবল বিদ্বেষ পোষণ করে এবং হিংসাকে লালন করে থাকে। ইমাম হুসাইনের এ কথাটি যথার্থ মনোতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

হযরত আলীর গীবত সম্পর্কে একটি বাণী রয়েছে। তাকে প্রশ্ন করা হলো কিরূপ ব্যক্তি গীবত করে অর্থাৎ মানুষের অনুপস্থিতিতে তার নিন্দা ও দোষ ত্রুটি বর্ণনা করে আনন্দ পায়? আলী (আ.) বলেন, দুর্বল ও অক্ষমরা الغیبة جهد العاجز অর্থাৎ গীবত অক্ষমদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা। (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ৪৬১)

একজন শক্তিমান মানুষ যে আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান,গীবত তার নিকট লজ্জার বিষয় এবং সে এ কাজকে নিকৃষ্ট ও দুর্বলদের কাজ বলে মনে করে। তাই প্রকৃত ক্ষমতাবান মানুষ যেমন অন্যদের গীবত করেন না তেমনি শুনতেও চান না। আলী (আ.) তাই গীবতকে দুর্বলতাপ্রসূত বলে উল্লেখ করে বলেছেন,শক্তিমান আত্মার অধিকারী মানুষ কখনও গীবত করে না।

ইমাম আলী (আ.) এমনকি জেনাকেও দুর্বলতাপ্রসূত মনে করেন। তিনি বলেছেন,ما زنی غیور قطّ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি জেনা করতে পারে না। পৃথিবীতে যে ব্যক্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র আত্মসম্মানবোধ রয়েছে সে কান নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে পারে না। তাই কেবল আত্মসম্মানহীন ব্যক্তি যে নিজের মধ্যে এ বিষয়ে দুর্বলতা অনুভব করে সে-ই এরূপ কাজ করে। কারণ আত্মসম্মানহীন ব্যক্তি স্ত্রীর সঙ্গে যদি অন্য পুরুষ অনুরূপ কাজ করে তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হয়না। এ জন্যই আলী (আ.) বলেছেন,ما زنی غیور قطّ (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ৩০৫)

কিন্তু জনাব নী চে এরূপ ক্ষমতাকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার দৃষ্টিতে ক্ষমতা পেশী শক্তি ও অস্ত্রবল অর্থাৎ তরবারী ধারণ করতঃ অন্যের উপর আঘাত হানা। তার দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ হচ্ছে মানুষরূপী শক্তিধর কোন পশু যার বাহুর শক্তি অধিক। তাই তার নিকট আত্মিক শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান নেই। অতএব,ইসলামী মতাদর্শে নিঃসন্দেহে ক্ষমতা একটি মানবীয় মূল্যবোধ এবং মানুষের পূর্ণতার পথের অন্যতম পূর্ণরূপ। তাই ইসলাম দুর্বল ব্যক্তিকে পছন্দ করে না। إنّ الله یبغض المؤمنین الضعیف  অর্থাৎ দুর্বল ও অক্ষম মুমিনকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। (কাফী,৫ম খণ্ড,পৃ. ৫৯)

সুতরাং প্রথমত ইসলাম ক্ষমতাকে মানুষের একমাত্র মূল্যবোধ বলে মনে করে না বরং এর পাশাপাশি পূর্ণতার অন্যান্য মূল্যবোধ রয়েছে বলে বিশ্বাস করে। দ্বিতীয়ত ইসলাম ক্ষমতা বলতে যা বুঝে তা নী চে,সংশয়বাদী দার্শনিক ম্যকিয়াভেলী এবং অন্যদের ধারণা হতে পৃথক। ইসলাম মানুষের মধ্যে এমন অনেক ক্ষমতায় বিশ্বাসী এবং সেগুলোর বিকাশে প্রয়াসী যার ফল নী চের ধারণার বিপরীত এবং যা সমাজের জন্য কল্যাণকর।

নী চে বলেন,দুর্বলের জন্য সহমর্মিতা দুর্বলতা হতে উদ্ভূত। তাকে বলতে চাই,সহমর্মিতা শুধু নয়,এখানে ভালোবাসা,ক্ষমা,দানশীলতা- সর্বোপরি কল্যাণকামিতা রয়েছে। কেন প্রতিটি বিষয়কে এক চোখে দেখেন? আপনার নিকট প্রশ্ন একজন ক্ষমতাবান মানুষের দান ও অনুগ্রহ অন্যদের নিকট পৌছে নাকি এক দুর্বলের? তাই জবাব দিন অনুগ্রহ ক্ষমতা হতে উৎসারিত নাকি দুর্বলতা হতে? অবশ্যই ক্ষমতা হতে,দুর্বলতা হতে নয়। যা হোক আমরা এখন অন্য আলোচনা শুরু করব।

ভালোবাসার মতবাদ

অন্য যে মতবাদটি মূলত ভারতে এবং অন্য স্থানে খ্রিষ্টবাদের মধ্যে প্রচলিত তা হলো ভালোবাসা বা প্রেমের মতবাদ। অবশ্য খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসা এবং প্রেমের ধর্ম বলে প্রচার করে। এক্ষেত্রে তারা এতটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়েছে যে,তাদের ধর্মকে দুর্বলতার মতবাদ -এর অন্তুর্ভুক্ত বলা যায়। অর্থাৎ তাদের এ মতবাদকে প্রেমের মতবাদ না বলে দুর্বলতার মতবাদ বলাই শ্রেয়। ভারতীয়দের মতবাদকে প্রেমের মতবাদ বলা যেতে পারে (আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু তত্ত্ব নিয়ে,বাস্তবে তাদের আচরণ নিয়ে নয়)। এখন প্রশ্ন হলো প্রেমের মতবাদ কি?

প্রেমের মতবাদ মানুষের পূর্ণতাকে মানুষ ও সৃষ্টির সেবার মধ্যে নিহিত বলে মনে করে। এটা নী চের মতবাদের ঠিক বিপরীতে অবস্থান করছে। নী চে যে বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন তারা সে বিষয়গুলোকে গ্রহণীয় বলে মনে করেন। তাই তারা বলেন,প্রকৃত পূর্ণ মানব সেই ব্যক্তি যার থেকে সৃষ্টি কল্যাণ লাভ করে। মানবতার অর্থও তাই সৃষ্টির কল্যাণ করা। পাশ্চাত্যের মতবাদগুলো যখন মানবতার কথা বলে তখন মানব সেবা ও মানব প্রেমই তাদের লক্ষ্য যদিও কার্যত এ কথার প্রতি তারা তেমন দৃঢ় নয়। আমাদের পত্রিকা ও সাময়িকীগুলোও যখন বলে,এ বিষয়টি মানবিক,ঐ বিষয়টি অমানবিক তখন ঐ অর্থের প্রতিই ইঙ্গিত করে। মানবিক বিষয়গুলো তাদের জন্য অকল্যাণকর। সুতরাং তাদের দৃষ্টিতে মানবতা হলো মানুষ ও সৃষ্টির সেবা।

কখনো কখনো আমাদের কবিদের মধ্যেও এ বিষয়ে অতিরঞ্জন লক্ষ্য করা যায়। যেমন সা দীবলেছেন,

ইবাদত সৃষ্টির সেবা বৈ কিছু নয়

তাসবিহ,জায়নামাজ ও আলখাল্লা নয়।

অবশ্য সা দীর উদ্দেশ্য এখানে ভিন্ন। একদল দুনিয়াত্যাগী সুফীর প্রতি তার এ কথা- যাদের কাজ তাসবীহ,জায়নামাজ আর দরবেশী পোশাক নিয়ে। মানবকল্যাণমূলক কাজ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে তারা এ সব নিয়ে ব্যস্ত। যদিও সা দী নিজে একজন সুফী তদুপরি এরূপ দরবেশদের কাজে তিনি বীতশ্রদ্ধ ও অসন্তুষ্ট। তাই অনেকটা অতিরঞ্জনের ভাষায় বলেছেন,ইবাদত সৃষ্টির সেবা বৈ কিছু নয়।

কেউ কেউ এ বিষয়টি অন্যভাবে বলে থাকেন যা ঠিক নয়। তারা বলেন, শরাব পানে মাতাল হয়ে পড়ে থাক,তবুও মানুষকে কষ্ট দিও না। তাদের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে শুধু একটি অকল্যাণ বিদ্যমান আর সেটা হচেছ অপরকে কষ্ট দান,আর কল্যাণও একটি,তা হলো মানুষের সেবা ও সৃষ্টির কল্যাণ। প্রেমের মতবাদের বাণী একটি,আর তা হলো মানবতার কল্যাণ করো। তাদের দৃষ্টিতে ত্রুটিও একটি,তা হলো মানুষকে কষ্ট দান।

সৃষ্টির কল্যাণ সাধন ও আত্মত্যাগের প্রতি কোরআনের আহবান

এ বিষয়ে ইসলামী মতবাদেরও একটি পর্যালোচনা দরকার। ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সেবা ও কল্যাণ যে স্বয়ং একটি স্বর্গীয় ও মানবীয় মূল্যবোধ এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মানব প্রেম ও সেবা,মানুষের কষ্ট অনুধাবন ও সহমর্মিতা ইসলামের দৃষ্টিতে এক প্রকার পূর্ণতা ও মূল্যবোধ,তাই এর মর্যাদাও অনেক বেশি,কিন্তু ইসলাম সীমাবদ্ধতায় বিশ্বাসী নয়। বক্তব্যের শুরুতে আমি এ আয়াতটি পাঠ করেছি,

( إِنَّ اللَّـهَ يَأْمُرُ‌ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْ‌بَىٰ وَيَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ‌ وَالْبَغْيِ )

আল্লাহ্ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন ন্যায়বিচার (মানুষের অধিকারকে রক্ষা করার),সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার এবং নিষেধ করছেন অশ্লীলতা,অসঙ্গত কাজ এবং অবাধ্য হতে।

এখানে আল্লাহ্ শুধু মানুষের অধিকার রক্ষার কথাই বলেননি,বরং নিজের অধিকার হতেও তাদের প্রতি দান করা ও সদাচরণের নির্দশ দিয়েছেন।

আত্মত্যাগ কোরআনের একটি মৌলিক বিষয়। আত্মত্যাগ অর্থ নিজের অধিকার ত্যাগ করা এবং যে বস্তু তার নিজের ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অন্যের প্রয়োজনে তার উপর ঐ ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া। আত্মত্যাগ মনুষত্বের এক মহৎ ও গৌরবময় প্রকাশ এবং কোরআন আত্মত্যাগকে আশ্চর্যজনকরূপে প্রশংসা করেছে। রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে আনসাররা মুহাজিরদের নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয়টি কোরআন এভাবে বলেছে-

( وَيُؤْثِرُ‌ونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ)

এবং সূরা দাহরে হযরত আলী,ফাতেমা এবং ইমাম হাসান ভ্রাতৃদ্বয়ের আত্মত্যাগের বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

( وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرً‌ا إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّـهِ لَا نُرِ‌يدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورً‌ا )

তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত,এতিম ও বন্দিদের আহার্য দান করে। তারা বলে : কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। এ আয়াতের শানে নুযূল এরূপ যে,ইমাম হাসান ও হুসাইন অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত আলী ও ফাতিমা (আ.) তিন দিন রোযা রাখার জন্য নযর করেন। হযরত আলী কাজ করে কিছু যবের আটা যোগাড় করেন এবং হযরত ফাতিমা তা দিয়ে রুটি তৈরি করেন। ইফতারের সময় একজন মিসকিন এসে খাদ্য চাইলে তারা পুরো আহার্যই তাকে দান করেন। এরূপ দ্বিতীয় দিনএকজন এতীম এবং তৃতীয় দিন একজন বন্দি এসে খাদ্য চাইলে পরপর তিন দিন তারা এ আত্মত্যাগ করেন এবং নিজেরা অভুক্ত থাকেন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়।

আত্মত্যাগ মানব মর্যাদার এক গৌরবময় ও মহান বিষয় যা ইসলাম প্রশংসা করেছে এবং ইসলামের ইতিহাসে আত্মত্যাগের এরূপ অসংখ্য নমুনা রয়েছে।

স্নেহ-ভালোবাসার একটি উদাহরণ :

স্নেহ,ভালবাসা ও অনুগ্রহ সব সময় ইসলামে পুণ্য কর্ম হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ঘটনাটি হয়তো শুনে থাকবেন যে,একদিন এক জাহেলিয়াতের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর নিকট এসে লক্ষ্য করল তিনি তার এক নাতীকে কোলে বসিয়ে আদর করে চুমু খাচ্ছেন। লোকটি রাসূলকে লক্ষ্য করে বলল, আমার দশটি সন্তান রয়েছে। কিন্তু আমার সারা জীবনে তাদের কাউকে একবারও চুমু খাইনি। একটি বর্ণনায় এসেছে,فالتمع وجه رسول الله তার এ কথায় রাসূল এতটা অসন্তুষ্ট হলেন যে,তার মুখের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং ঐ লোকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন,من لا یَرحم لا یُرحم যে অন্যকে দয়া ও অনুগ্রহ করে না,আল্লাহ্ও তার প্রতি দয়া করেন না। (জামেয়ুস সাগীর,২য় খণ্ড,পৃ. ১৮৩)

অন্য বর্ণনায় এসেছে- আল্লাহ্ যদি তোমার হৃদয় হতে দয়া উঠিয়ে নেন তাহলে আমি কি করব?

এ বিষয়ে প্রচুর হাদীস বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর জীবন দয়া ও মহানুভবতার উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি প্রকৃতই দয়া ও রহমতের প্রতীক। দুর্বলের মুখোমুখি দাঁড়ালে দয়া ও অনুগ্রহ তার মধ্যে ফল্গুর ন্যায় প্রবাহিত হতে শুরু করত।

মৃত্যুকে কিভাবে গ্রহণ করব?

মৃত্যুকে গ্রহণ করা সন্দেহাতীতভাবে মানুষের পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। যেহেতু মৃত্যুভয় মানুষের জন্য একটি বড় দুর্বলতা সেহেতু মানুষের অধিকাংশ দুর্ভাগ্যের মূলে রয়েছে এটি। যেমন অপমানকে গ্রহণ,অসম্মানজনক অধীনতা গ্রহণ করা এরূপ হাজারো দুর্গতি। যদি কেউ মৃত্যুকে ভয় না পায় তাহলে তার পুরো জীবনই পাল্টে যাবে। মহৎ ব্যক্তিরা মৃত্যুর মুখোমুখি হলে সাহসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। (অবশ্য আত্মহত্যার ফল আমরা বলছি না। বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে দায়িত্ব মনে করে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কথা বলছি। যারা আত্মহত্যা করে তারা তো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এ কাজ করে।)

যদি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু উপস্থিত হয় তবে মানুষের জন্য তা সাফল্য। ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন,

إنّی لا أری الموت إلا سعادة و لا الحیاة مع الظالمین إلا برما

আমি মৃত্যুকে সাফল্য ছাড়া কিছু মনে করি না আর জালেমদের সঙ্গে বেঁচে থাকাকে অপমান ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। (লুহুফ,পৃ. ৬৯)

মৃত্যুকে এভাবে গ্রহণকে আল্লাহ প্রেমিক ব্যতীত কেউ দাবি করতে পারে না। যাদের কাছে মৃত্যু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থান পরিবর্তনের মতো। ইমাম হুসাইনের ভাষায় একটি সাঁকো অতিক্রম করার মতো,এ ছাড়া কিছু নয়। ইমাম হুসাইন আশুরার দিন সকালে তার সাথীদের বলেন,

ما الموت إلا قنطرة تعبر بکم عن البؤس و الضّرّاء إلی الجنان

মৃত্যু একটি পুলের মত যার উপর দিয়ে তোমরা অতিক্রম করবে ও জান্নাতকে আলিঙ্গন করবে (কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে)। (মায়ানী আল আখবার সাদুক,পৃ. ২৮৯)৮৬

হে আমার সাথীরা! আমাদের সম্মুখে শুধু একটি সাঁকো রয়েছে যার নাম মৃত্যু- এটা অতিক্রম করলেই আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব। প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যু নিকটবর্তী হচ্ছিল ইমাম হুসাইনের চেহারা তত সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল হচ্ছিল।

যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যখন ইমাম হুসাইন ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন উমর ইবনে সা দের একজন সহযোগী যে এ দৃশ্য লক্ষ্য করছিল সে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে উমর ইবনে সা দকে বলল, অনুমতি দাও,ওর জন্য কিছু পানি নিয়ে আসি। এখন তো ও মারাই যাচ্ছে,পানি খেলেও কিছু করতে পারবে না। উমর ইবনে সা দ অনুমতি দিলে সে যখন পানি নিয়ে ফিরছিল তখন দেখল পাষণ্ড ও অভিশপ্ত শিমার ইমামের মাথা নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে দেখার অভিব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছে-

و لقد شغلتی نور وجهه عن الفکرة فی قتله

  তার চেহারার নূরে এতটা মোহিত হয়েছিলাম যে,তার নিহত হওয়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

পূর্ণ মানব সে-ই যার উপর কোন পরিস্থিতিই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না (ক্ষমতা,প্রভাব,দুঃখ,কষ্ট,আনন্দ কোন অবস্থাতেই সে তার ভারসাম্য ও ব্যক্তিত্বকে হারায় না)। যেমন আলী (আ.) এরূপ এক নমুনা যিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ ও মর্যাদার সকল স্তরেই অবস্থান করেছেন; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদ খেলাফত থেকে সর্বনিম্ম পদ শ্রমিকের কাজও তিনি করেছেন। আলী আলওয়ারদী বলেছেন, আলী (আ.) কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। আলীর কুড়ে ঘরেরঁ জীবনের সঙ্গে (শ্রমিক অবস্থায়) প্রাসাদের জীবনের (খেলাফতের সময়কাল,যদিও প্রকৃতপক্ষে আলী প্রাসাদে বাস করতেন না,তবে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে) কোন পার্থক্য ছিল না। শ্রমিক আলীর চিন্তার সঙ্গে খলিফা আলীর চিন্তার কোন পার্থক্য ছিল না। এজন্যই আলী (আ.) পূর্ণ মানব।

আলী (আ.)-এর গোপনে দাফন

আমরা কেন আজকে এখানে সমবেত হয়েছি? সমবেত হয়েছি এক পূর্ণ মানব-এর শোক পালন করতে। যেহেতু এ পূর্ণ মানবকে গোপনে দাফন করতে হয়েছে। কেন? কারণ তার যেরূপ পরম বন্ধু রয়েছে সেরূপ পরম শত্রুও রয়েছে। আলী (আ.)-এর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ গ্রন্থে (বাংলায় অনূদিত হয়েছে) আমরা উল্লেখ করেছি এ ধরনের ব্যক্তিরা যেমন প্রচণ্ড আকর্ষণ ক্ষমতার অধিকারী তেমনি বিকর্ষণ ক্ষমতারও। তাদের বন্ধুও যেমনি থাকে চরম অন্তরঙ্গ ও উচ্চ পর্যায়ের যারা যে কোন সময়ে তার জন্য প্রাণ দিতে অকুণ্ঠিত তেমনি শত্রুও থাকে যারা তার রক্তের জন্য পিপাসার্ত বিশেষত অভ্যন্তরীণ ও নিকটতম শত্রু। যেমন খারেজীরা দীনের বাহ্যিক কাঠামোতে বিশ্বাসী ও ঈমানের অধিকারী,কিন্তু দীনের মূল শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। আলী (আ.) নিজেই বলেছেন,এরা ঈমানদার,কিন্তু অজ্ঞ। তার ভাষায়-

لا تقولوا الخوارج بعدی فلیس من طلب الحق فأخطاه کمن طلب الباطل فأدرکه

খারেজীদের আমার মৃত্যুর পর আর হত্যা করো না,যেহেতু যারা সত্যের সন্ধানী,কিন্তু ভুল করছে তারা যারা অসত্যকে জানার পরও তার অনুসরণ করছে এক সমান নয়। খারেজীদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের তুলনা করে বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর এদের হত্যা করো না। এদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের পার্থক্য রয়েছে,এরা সত্যকে চায়,কিন্তু বোকা (তাই অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়) ও ভুল করে। কিন্তু মুয়াবিয়াপন্থীরা সত্যকে জেনেই তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।

তাই কেন আলীকে এত বন্ধু ও সুহৃদ থাকা সত্ত্বেও রাত্রিতে গোপনে দাফন করা হয়েছে? এই খারেজীদের ভয়ে। যেহেতু তারা বলত আলী মুসলমান নয়,তাই ভয় ছিল তারা জানতে পারলে কবর থেকে তার লাশ বের করে অপমান করত।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ের শেষ দিকে প্রায় শত বছর পর্যন্ত নবী পরিবারের ইমামরা ব্যতীত কেউই জানত না যে,ইমাম আলী (আ.)-কে কোথায় দাফন করা হয়েছে।

একুশে রমযানের ভোরে ইমাম হাসান (আ.) জানাযার আকৃতিতে সাজিয়ে একটি খাটিয়া কিছু ব্যক্তির হাতে দেন মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যাতে লোকজন মনে করে আলী (আ.)-কে মদীনায় দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু ইমাম আলীর সন্তানগণ ও কিছু সংখ্যক অনুসারী যারা তার দাফনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা জানতেন তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। বর্তমানে কুফার নিকটে নাজাফে যে স্থানে আলীর সমাধি রয়েছে সেখানে তারা গোপনে যিয়ারতে আসতেন। ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময় যখন খারেজীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং আলীর প্রতি অসম্মানের সম্ভাবনা রহিত হয় তখন ইমাম সাদিক তার এক সাহাবী সাফওয়ান (রহ.)-কে সে স্থান চিহ্নিত করে গাছ লাগিয়ে দিতে বলেন। এরপর থেকে সবাই জানতে পারে ইমাম আলীর কবর সেখানে এবং তার ভক্ত ও অনুসারীরা তার কবর যিয়ারত করতে শুরু করে।

যে রাতে আলীকে দাফন করা হয় খুব কম সংখ্যক লোক তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন,সে সাথে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবী। তাদের মধ্যে সামায়া ইবনে সাওহান যিনি আলী (আ.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অনুসারী ছিলেন তিনি একজন তুখোর বক্তাও ছিলেন। আলীকে দাফনের সময় তাদের অন্তর যেরূপ বিরাগ বেদনায় স্তব্ধ ও কণ্ঠ বায়ুরূদ্ধ হচ্ছিল,সে সাথে মনে অনুভূত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। এরূপ অবস্থায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যখন সবাই কাঁদছিলেন সামায়া যার হৃদয় প্রচণ্ড কষ্টে মুষড়ে পড়ছিল তিনি কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মাথা ও সারা শরীরে মাখতে শুরু করলেন। কবরের মাটিকে বুকে চেপে ধরে বললেন,

السلام علیک یا أمیر المؤمنین لقد عشت سعیدا و متّ سعیدا

হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পক্ষ থেকে সালাম। আপনি সৌভাগ্যের সাথে জীবন যাপন করেছেন,সৌভাগ্যের সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আপনার সম্পূর্ণ জীবন ছিল সাফল্যমণ্ডিত,আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করেছেন,আল্লাহর ঘর মসজিদেই শাহাদাত বরণ করেছেন। জীবনের শুরুও আল্লাহর ঘরে,জীবনের পরিসমাপ্তিও আল্লাহর ঘরে। হে আলী! আপনি কতটা মহৎ ছিলেন আর এ মানুষরা কতটা হীন!

যদি এ সম্প্রদায় আপনার কথা মতো চলতلاکلوا فوقهم و من تحت أرجلیهم তবে আসমান ও তাদের পায়ের নীচে থেকে নেয়ামত বর্ষিত হতো। তারা আখেরাতে ও দুনিয়ার সাফল্য লাভ করত। কিন্তু আফসোস! এ জনগণ আপনার মর্যাদা বোঝেনি। আপনার অনুসরণ না করে বরং আপনাকে কষ্ট দিয়েছে,আপনার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আপনাকে এ অবস্থায় কবরে পাঠিয়েছে।

لا حول و لا قوّة إلا بالله العلیّ العظیم

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের পর্যালোচনা

পূর্ণ মানব (বর্তমানের ভাষায় আদর্শ মানব) কে,তা জানা একটি অপরিহার্য বিষয়। ব্যক্তির প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠনের জন্য প্রতিটি মতাদর্শেই আদর্শ মানবের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। যেহেতু আমরা ইসলামের পূর্ণ ও আদর্শ মানবের প্রতিকৃতি ও স্বরূপ জানতে চাই সেহেতু প্রচলিত অন্য সব মতবাদের আদর্শ মানবের প্রকৃতির পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব। গত দিনের আলোচনায় বিভিন্ন মতবাদ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছি। আজকে আমাদের আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ দিয়ে শুরু করব।

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের সার-সংক্ষেপ

প্রাচীন দার্শনিক ভাবনায় মানুষের অস্তিত্বের মূল বিষয় ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তি। তাদের মতে মানুষের আমিত্ব হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল। যেমনভাবে মানবদেহ তার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় তেমনিভাবে তার আত্মিক ও মানসিক শক্তি ও ক্ষমতা তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃত সত্তা নয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল হলো তার চিন্তা করার শক্তি ও ক্ষমতা। মানুষের প্রকৃত সত্তা হলো যা দ্বারা সে চিন্তা করে।

মানুষ যা দ্বারা চোখে দেখে তা চিন্তার হাতের একটি উপকরণ মাত্র,তেমনি যা দ্বারা কল্পনা করে,যা দ্বারা চায়,যা দ্বারা ভালোবাসে বা মানুষ যে সত্তার কারণে জৈবিক চাহিদার অধিকারী এ সবই চিন্তার সত্তার হাতের একেকটি উপকরণ। মানব সত্তার মৌল উপাদান তার চিন্তাশক্তি। তাই পূর্ণ মানব তিনিই যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছেছেন। চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছার অর্থ বিশ্ব ও অস্তিত্বজগতকে ঠিক যে রূপে আছে সে রূপেই উদ্ঘাটন ও জানা।

এ মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলকে মানব সত্তার মৌল উপাদান বলে জানে। এ ছাড়াও বিশ্বাস করে যে,বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তা-শক্তির দ্বারা বিশ্বকে তার প্রকৃত রূপে উদ্ঘাটন করা সম্ভব। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি অস্তিত্বজগতকে তার আসল রূপে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করার ক্ষমতার অধিকারী। ঠিক আয়নার¡মত বিশ্বজগৎ তার প্রকৃত রূপ নিয়ে এতে প্রতিফলিত হয়।

ইসলামী দার্শনিক সমাজ যারা এ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তারা বিশ্বাস করেন যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ও কোরআনের আলোকে ঈমান বলতে বিশ্বকে ঠিক যেমনভাবে আছে তেমনভাবে জানাই বোঝানো হয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিশ্বে বিরাজমান শৃঙ্খলা,প্রচলিত বিধান,বিশ্বের গতি ও লক্ষ্য এগুলোকে জানা। তারা বলেন,কোরআনে যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস,বিশ্বজগৎ আল্লাহর সৃষ্টি এ বিষয়ে বিশ্বাস,আল্লাহ্ বিশ্বজগতকে লক্ষ্যহীন ছেড়ে দেননি,বরং একে হেদায়েত ও পরিচালনা করছেন,যেমন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করছেন তা জানা,সব কিছু আল্লাহ্ থেকে এসেছে এবং তার প্রতিই প্রত্যাবর্তনকারী প্রভৃতি- এ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হলো বিশ্বজগতকে তার প্রকৃতরূপে জানা। তারা ঈমানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,ঈমান পরিচিতি-জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যতীত কিছু নয়। অবশ্য তাদের এ প্রজ্ঞা বা পরিচিতি জ্ঞানেরঅর্থ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা আংশিক জ্ঞান নয়,বরং এ জ্ঞান ও পরিচয় দার্শনিক ও প্রজ্ঞাগত। দার্শনিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ বিশ্বের উৎপত্তি ও পরিসমাপ্তি,অস্তিত্বের ধারা ও পর্যায়কে সামগ্রিকভাবে জানাও উদ্ঘাটন করা।

এ মতাদর্শের বিপরীত মতবাদ

এ মতাদর্শ যা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ বলে আমরা উল্লেখ করেছি এর বিপরীতে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে যে মতবাদগুলো এ মতবাদের বিরোধী ও সমালোচক। মুসলিম বিশ্বে প্রথম যে মতবাদটি এ মতবাদের বিরেুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো এশরাকী,সূফী ও খোদাপ্রেম মতবাদ। এরপর রয়েছে আহলে হাদীসের অনুসারীরা। শিয়াদের মধ্যে আখবারী এবং সুন্নীদের মধ্যে হাম্বলী ও আহলে হাদীস দার্শনিকদের বিপরীতে আকলকে অস্বীকার করেছে। তারা বলছেন,দার্শনিকরা আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপারে যত বেশি গুরুত্ব দেয় আকলের গুরুত্ব এত অধিক নয়।

এদের থেকেও ইন্দ্রিয়বাদীরা বর্তমান সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির চরম সমালোচক। বিগত তিন-চার শতকধরে ইন্দ্রিয়বাদীদের জয়-জয়কার। তাদের মতে বুদ্ধিবৃত্তিকে যতটা মূল্য দেয়া হয় তা ততটা মূল্যের অধিকারী নয়। আকলের তেমন কোন গুরুত্ব নেই,বরং আকল ইন্দ্রিয়ের অনুগত। মানবের মূল তার ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিসমূহ। আকল খুব বেশি হলে যা করতে পারে তা হলো ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উপর কাজ করা। যেমন কোন কারখানাকে যদি আমাদের বিবেচনায় আনি,সেখানে যেরূপ কাঁচামাল প্রবেশ করে তৎপর কারখানার মেশিনের মধ্যে তা মিশ্রিত বা বিভাজিত হয়,উদাহরণস্বরূপ কাপড় বুনন কারখানায় প্রথমে তুলা থেকে সুতা বের করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বুননের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাপড়ের আকৃতি দেয়া হয়। তেমনি আকল মেশিনের মতো শুধু ইনিদ্রয়লব্ধ কাঁচামালকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ তার নিজের স্থানে এখনও অটল। এখানে আমরা অবশ্য সে বিষয়ে আলোচনা করব না,বরং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার চেষ্টা করব।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের (মারেফাত) মৌলিকত্ব

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদে কয়েকটি বিষয় আছে যার প্রতিটিকে যাচাই করে দেখব যে,সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সংগতিশীল কিনা। প্রথম বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের মৌলিকত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ হলো আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি বিশ্বের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে এবং এ জ্ঞান ও পরিচিতি মৌলিক,নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ।

অনেক মতবাদই বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতা ও যোগ্যতায় বিশ্বাসী নয়। এখন আমরা দেখব ইসলামী উৎসগুলো থেকে আমাদের নিকট এ ধরনের দলিল-প্রমাণ রয়েছে কিনা যে,বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতায় আমরা বিশ্বাসী হতে পারি। ঘটনাক্রমে আমাদের হাতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দলিল রয়েছে যাতে আমরা বলতে পারি ইসলামের মতো কোন মতাদর্শেই আকলকে এত অধিক পৃষ্ঠপোষকতা করা হযনি বা প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে আকলকে অন্য কোন ধর্মেই ইসলামের মতো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আপনি খ্রিষ্টধর্মকে ইসলামের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন খ্রিষ্টধর্ম ঈমানের গণ্ডীতে আকলের প্রবেশের বিরোধী। তাদের মতে মানুষ যখন কোন কিছুর উপর ঈমান আনবে তখন এর উপর চিন্তা করার অধিকার তার নেই। চিন্তা যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তির কাজ তাই বিশ্বাসগত বিষয়ে চিন্তার অবকাশ নেই। যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হবে সে বিষয়ে চিন্তা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আকলকে কি কেন এ ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া যাবে না। একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি,বিশেষত ঈমানের রক্ষক চার্চের অধিপতির দায়িত্ব হলো ঈমানের গণ্ডিতে যুক্তি,চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রবেশকে প্রতিহত করা। মূলত খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক এর বিপরীত অবস্থা দেখি। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ে (উসূল) বুদ্ধিবৃত্তি ব্যতীত অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেমন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আপনার ধর্মের একটি মৌলিক বিষয় বলুন। আপনি হয়তো বললেন,তাওহীদ (একত্ববাদ)। এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করাহয়,কেন আপনি এক আল্লাহ্য় ঈমান এনেছেন? আপনাকে অবশ্যই এজন্য যুক্তি পেশ করতে হবে যেহেতু ইসলাম আকল ব্যতীত আপনার নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে না। যদি বলেন, আমি এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করি,কিন্তু এর পেছনে কোন যুক্তি পেশ করতে পারব না। আমার দাদীমার থেকে শুনে আমি বিশ্বাস করেছি। অবশেষে এক সত্যে পৌছেছি যেভাবেই হোক দাদীমার কাছে শুনে অথবা স্বপ্নদেখে। ইসলাম বলে, না,যদিও এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসী হও,কিন্তু এ বিশ্বাসের ভিত্তি স্বপ্ন বা পিতা-মাতার অন্ধ অনুকরণ অথবা পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে,তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের পর যুক্তির ভিত্তিতে যদি আপনি ঈমান আনয়ন করেন তবেই তা গ্রহণ করা হবে নতুবা নয়।

খ্রিষ্টবাদে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটাই খ্রিষ্টবাদের ভিত্তি। একজন খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির দায়িত্ব হলো এই গণ্ডিতে আকল ও চিন্তার প্রবেশকে রোধ করা। ইসলামে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের স্থান সংরক্ষিত। আকল ব্যতীত অন্য কোন কিছুর এ গণ্ডিতে প্রবেশাধিকার নেই।

ইসলামের উৎসসমূহে অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহয় আকলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন দেখা যায়। প্রথমত কোরআন সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির প্রশংসা করেছে। তদুপরি আমাদের হাদীস গ্রন্থসমূহেও বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব ও মৌলিকত্ব এতটা প্রকট যে,এ গ্রন্থসমূহ খুললেই দেখা যায়,তাতে প্রথম অধ্যায় হিসেবে কিতাবুল আকল এসেছে এবং এ অধ্যায়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।

ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) আকল সম্পর্কিত একটা আশ্চর্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ্পাকের দু টি হুজ্জাত (দলিল) রয়েছে। এ দু টি হুজ্জাত দু টি নবী। একটি অভ্যন্তরীণ নবী বা আকল,দ্বিতীয়টি বাহ্যিক নবী অর্থাৎ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ যারা নিজেরা মানুষ এবং অন্য মানুষদের দীনের দিকে দাওয়াত করেন। আল্লাহ্পাকের এ দু টি হুজ্জাত একে অপরের পরিপূরক অর্থাৎ যদি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি থাকে,কিন্তু পৃথিবীতে কোন নবী প্রেরিত না হয়,তবে মানুষের পক্ষে সফলতার পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। তেমনি যদি নবী থাকেন,কিন্তু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী না হয় তাহলেও সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। আকল ও নবী একসঙ্গে একই দায়িত্ব পালন করে। এর চেয়ে উত্তমরূপে আকলকে সম্মানিত করা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান আর কোনভাবে সম্ভব কি?

এ ধরনের বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্ভবত আরো শুনে থাকবেন। যেমন জ্ঞানীর নিদ্রা অজ্ঞের ইবাদত হতে উত্তম , জ্ঞানীর খাদ্যগ্রহণ মূর্খের রোযা অপেক্ষা উত্তম , জ্ঞানীর নিরবতা অজ্ঞের কথা বলা হতে শ্রেয় , আল্লাহ্ কোন নবীকেই প্রেরণ করেননি এ অবস্থার পূর্বে যে,তার আকল পূর্ণতায় পৌছায় ও সমগ্র উম্মত থেকে তার বুদ্ধিবৃত্তি উচ্চতর হয় ইত্যাদি। আমরা রাসূল (সা.)-কে বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্র রূপ বলে জানি। আমাদের এ ধারণা খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যশীল। যেহেতু তারা বুদ্ধিবৃত্তি থেকে দীনকে পৃথক বলে জানে। কিন্তু আমরা আমাদের নবীকে আকলের পরিপূর্ণ রূপ মনে করি।

সুতরাং পরিচিতিজ্ঞান ও প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে আমরা আকলকে দলিল বলে জানি এ অর্থে যে,বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান ও পরিচয় লাভ সম্ভব। দার্শনিকদের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ইসলাম সমর্থন করে।

মৃত্যুকে কিভাবে গ্রহণ করব?

মৃত্যুকে গ্রহণ করা সন্দেহাতীতভাবে মানুষের পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি। যেহেতু মৃত্যুভয় মানুষের জন্য একটি বড় দুর্বলতা সেহেতু মানুষের অধিকাংশ দুর্ভাগ্যের মূলে রয়েছে এটি। যেমন অপমানকে গ্রহণ,অসম্মানজনক অধীনতা গ্রহণ করা এরূপ হাজারো দুর্গতি। যদি কেউ মৃত্যুকে ভয় না পায় তাহলে তার পুরো জীবনই পাল্টে যাবে। মহৎ ব্যক্তিরা মৃত্যুর মুখোমুখি হলে সাহসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে হাসিমুখে তা গ্রহণ করেন। (অবশ্য আত্মহত্যার ফল আমরা বলছি না। বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে দায়িত্ব মনে করে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার কথা বলছি। যারা আত্মহত্যা করে তারা তো দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এ কাজ করে।)

যদি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু উপস্থিত হয় তবে মানুষের জন্য তা সাফল্য। ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন,

إنّی لا أری الموت إلا سعادة و لا الحیاة مع الظالمین إلا برما

আমি মৃত্যুকে সাফল্য ছাড়া কিছু মনে করি না আর জালেমদের সঙ্গে বেঁচে থাকাকে অপমান ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। (লুহুফ,পৃ. ৬৯)

মৃত্যুকে এভাবে গ্রহণকে আল্লাহ প্রেমিক ব্যতীত কেউ দাবি করতে পারে না। যাদের কাছে মৃত্যু এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থান পরিবর্তনের মতো। ইমাম হুসাইনের ভাষায় একটি সাঁকো অতিক্রম করার মতো,এ ছাড়া কিছু নয়। ইমাম হুসাইন আশুরার দিন সকালে তার সাথীদের বলেন,

ما الموت إلا قنطرة تعبر بکم عن البؤس و الضّرّاء إلی الجنان

মৃত্যু একটি পুলের মত যার উপর দিয়ে তোমরা অতিক্রম করবে ও জান্নাতকে আলিঙ্গন করবে (কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে)। (মায়ানী আল আখবার সাদুক,পৃ. ২৮৯)৮৬

হে আমার সাথীরা! আমাদের সম্মুখে শুধু একটি সাঁকো রয়েছে যার নাম মৃত্যু- এটা অতিক্রম করলেই আমরা জান্নাতে প্রবেশ করব। প্রতি মুহূর্তে যখন মৃত্যু নিকটবর্তী হচ্ছিল ইমাম হুসাইনের চেহারা তত সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল হচ্ছিল।

যুদ্ধের শেষ মুহূর্তে যখন ইমাম হুসাইন ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন উমর ইবনে সা দের একজন সহযোগী যে এ দৃশ্য লক্ষ্য করছিল সে পুণ্য লাভের উদ্দেশ্যে উমর ইবনে সা দকে বলল, অনুমতি দাও,ওর জন্য কিছু পানি নিয়ে আসি। এখন তো ও মারাই যাচ্ছে,পানি খেলেও কিছু করতে পারবে না। উমর ইবনে সা দ অনুমতি দিলে সে যখন পানি নিয়ে ফিরছিল তখন দেখল পাষণ্ড ও অভিশপ্ত শিমার ইমামের মাথা নিয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-কে দেখার অভিব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছে-

و لقد شغلتی نور وجهه عن الفکرة فی قتله

  তার চেহারার নূরে এতটা মোহিত হয়েছিলাম যে,তার নিহত হওয়ার চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

পূর্ণ মানব সে-ই যার উপর কোন পরিস্থিতিই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না (ক্ষমতা,প্রভাব,দুঃখ,কষ্ট,আনন্দ কোন অবস্থাতেই সে তার ভারসাম্য ও ব্যক্তিত্বকে হারায় না)। যেমন আলী (আ.) এরূপ এক নমুনা যিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক পদ ও মর্যাদার সকল স্তরেই অবস্থান করেছেন; রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদ খেলাফত থেকে সর্বনিম্ম পদ শ্রমিকের কাজও তিনি করেছেন। আলী আলওয়ারদী বলেছেন, আলী (আ.) কার্ল মার্কসের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছেন। আলীর কুড়ে ঘরেরঁ জীবনের সঙ্গে (শ্রমিক অবস্থায়) প্রাসাদের জীবনের (খেলাফতের সময়কাল,যদিও প্রকৃতপক্ষে আলী প্রাসাদে বাস করতেন না,তবে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে) কোন পার্থক্য ছিল না। শ্রমিক আলীর চিন্তার সঙ্গে খলিফা আলীর চিন্তার কোন পার্থক্য ছিল না। এজন্যই আলী (আ.) পূর্ণ মানব।

আলী (আ.)-এর গোপনে দাফন

আমরা কেন আজকে এখানে সমবেত হয়েছি? সমবেত হয়েছি এক পূর্ণ মানব-এর শোক পালন করতে। যেহেতু এ পূর্ণ মানবকে গোপনে দাফন করতে হয়েছে। কেন? কারণ তার যেরূপ পরম বন্ধু রয়েছে সেরূপ পরম শত্রুও রয়েছে। আলী (আ.)-এর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ গ্রন্থে (বাংলায় অনূদিত হয়েছে) আমরা উল্লেখ করেছি এ ধরনের ব্যক্তিরা যেমন প্রচণ্ড আকর্ষণ ক্ষমতার অধিকারী তেমনি বিকর্ষণ ক্ষমতারও। তাদের বন্ধুও যেমনি থাকে চরম অন্তরঙ্গ ও উচ্চ পর্যায়ের যারা যে কোন সময়ে তার জন্য প্রাণ দিতে অকুণ্ঠিত তেমনি শত্রুও থাকে যারা তার রক্তের জন্য পিপাসার্ত বিশেষত অভ্যন্তরীণ ও নিকটতম শত্রু। যেমন খারেজীরা দীনের বাহ্যিক কাঠামোতে বিশ্বাসী ও ঈমানের অধিকারী,কিন্তু দীনের মূল শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। আলী (আ.) নিজেই বলেছেন,এরা ঈমানদার,কিন্তু অজ্ঞ। তার ভাষায়-

لا تقولوا الخوارج بعدی فلیس من طلب الحق فأخطاه کمن طلب الباطل فأدرکه

খারেজীদের আমার মৃত্যুর পর আর হত্যা করো না,যেহেতু যারা সত্যের সন্ধানী,কিন্তু ভুল করছে তারা যারা অসত্যকে জানার পরও তার অনুসরণ করছে এক সমান নয়। খারেজীদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের তুলনা করে বলেছেন, আমার মৃত্যুর পর এদের হত্যা করো না। এদের সঙ্গে মুয়াবিয়ার অনুসারীদের পার্থক্য রয়েছে,এরা সত্যকে চায়,কিন্তু বোকা (তাই অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়) ও ভুল করে। কিন্তু মুয়াবিয়াপন্থীরা সত্যকে জেনেই তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত।

তাই কেন আলীকে এত বন্ধু ও সুহৃদ থাকা সত্ত্বেও রাত্রিতে গোপনে দাফন করা হয়েছে? এই খারেজীদের ভয়ে। যেহেতু তারা বলত আলী মুসলমান নয়,তাই ভয় ছিল তারা জানতে পারলে কবর থেকে তার লাশ বের করে অপমান করত।

ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময়ের শেষ দিকে প্রায় শত বছর পর্যন্ত নবী পরিবারের ইমামরা ব্যতীত কেউই জানত না যে,ইমাম আলী (আ.)-কে কোথায় দাফন করা হয়েছে।

একুশে রমযানের ভোরে ইমাম হাসান (আ.) জানাযার আকৃতিতে সাজিয়ে একটি খাটিয়া কিছু ব্যক্তির হাতে দেন মদীনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যাতে লোকজন মনে করে আলী (আ.)-কে মদীনায় দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু ইমাম আলীর সন্তানগণ ও কিছু সংখ্যক অনুসারী যারা তার দাফনে অংশগ্রহণ করেছেন তারা জানতেন তাকে কোথায় দাফন করা হয়েছে। বর্তমানে কুফার নিকটে নাজাফে যে স্থানে আলীর সমাধি রয়েছে সেখানে তারা গোপনে যিয়ারতে আসতেন। ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময় যখন খারেজীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং আলীর প্রতি অসম্মানের সম্ভাবনা রহিত হয় তখন ইমাম সাদিক তার এক সাহাবী সাফওয়ান (রহ.)-কে সে স্থান চিহ্নিত করে গাছ লাগিয়ে দিতে বলেন। এরপর থেকে সবাই জানতে পারে ইমাম আলীর কবর সেখানে এবং তার ভক্ত ও অনুসারীরা তার কবর যিয়ারত করতে শুরু করে।

যে রাতে আলীকে দাফন করা হয় খুব কম সংখ্যক লোক তার দাফনের সময় উপস্থিত ছিলেন। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন,সে সাথে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাহাবী। তাদের মধ্যে সামায়া ইবনে সাওহান যিনি আলী (আ.)-এর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও অনুসারী ছিলেন তিনি একজন তুখোর বক্তাও ছিলেন। আলীকে দাফনের সময় তাদের অন্তর যেরূপ বিরাগ বেদনায় স্তব্ধ ও কণ্ঠ বায়ুরূদ্ধ হচ্ছিল,সে সাথে মনে অনুভূত হচ্ছিল প্রচণ্ড ক্রোধ। এরূপ অবস্থায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে যখন সবাই কাঁদছিলেন সামায়া যার হৃদয় প্রচণ্ড কষ্টে মুষড়ে পড়ছিল তিনি কবর থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে মাথা ও সারা শরীরে মাখতে শুরু করলেন। কবরের মাটিকে বুকে চেপে ধরে বললেন,

السلام علیک یا أمیر المؤمنین لقد عشت سعیدا و متّ سعیدا

হে আমীরুল মুমিনীন! আমার পক্ষ থেকে সালাম। আপনি সৌভাগ্যের সাথে জীবন যাপন করেছেন,সৌভাগ্যের সাথেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আপনার সম্পূর্ণ জীবন ছিল সাফল্যমণ্ডিত,আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করেছেন,আল্লাহর ঘর মসজিদেই শাহাদাত বরণ করেছেন। জীবনের শুরুও আল্লাহর ঘরে,জীবনের পরিসমাপ্তিও আল্লাহর ঘরে। হে আলী! আপনি কতটা মহৎ ছিলেন আর এ মানুষরা কতটা হীন!

যদি এ সম্প্রদায় আপনার কথা মতো চলতلاکلوا فوقهم و من تحت أرجلیهم তবে আসমান ও তাদের পায়ের নীচে থেকে নেয়ামত বর্ষিত হতো। তারা আখেরাতে ও দুনিয়ার সাফল্য লাভ করত। কিন্তু আফসোস! এ জনগণ আপনার মর্যাদা বোঝেনি। আপনার অনুসরণ না করে বরং আপনাকে কষ্ট দিয়েছে,আপনার হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে। আপনাকে এ অবস্থায় কবরে পাঠিয়েছে।

لا حول و لا قوّة إلا بالله العلیّ العظیم

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের পর্যালোচনা

পূর্ণ মানব (বর্তমানের ভাষায় আদর্শ মানব) কে,তা জানা একটি অপরিহার্য বিষয়। ব্যক্তির প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠনের জন্য প্রতিটি মতাদর্শেই আদর্শ মানবের দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়। যেহেতু আমরা ইসলামের পূর্ণ ও আদর্শ মানবের প্রতিকৃতি ও স্বরূপ জানতে চাই সেহেতু প্রচলিত অন্য সব মতবাদের আদর্শ মানবের প্রকৃতির পর্যালোচনার পর এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরব। গত দিনের আলোচনায় বিভিন্ন মতবাদ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছি। আজকে আমাদের আলোচনা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ দিয়ে শুরু করব।

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের সার-সংক্ষেপ

প্রাচীন দার্শনিক ভাবনায় মানুষের অস্তিত্বের মূল বিষয় ছিল তার বুদ্ধিবৃত্তি। তাদের মতে মানুষের আমিত্ব হলো তার বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল। যেমনভাবে মানবদেহ তার ব্যক্তিত্বের অংশ নয় তেমনিভাবে তার আত্মিক ও মানসিক শক্তি ও ক্ষমতা তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃত সত্তা নয়। মানুষের ব্যক্তিত্বের মূল হলো তার চিন্তা করার শক্তি ও ক্ষমতা। মানুষের প্রকৃত সত্তা হলো যা দ্বারা সে চিন্তা করে।

মানুষ যা দ্বারা চোখে দেখে তা চিন্তার হাতের একটি উপকরণ মাত্র,তেমনি যা দ্বারা কল্পনা করে,যা দ্বারা চায়,যা দ্বারা ভালোবাসে বা মানুষ যে সত্তার কারণে জৈবিক চাহিদার অধিকারী এ সবই চিন্তার সত্তার হাতের একেকটি উপকরণ। মানব সত্তার মৌল উপাদান তার চিন্তাশক্তি। তাই পূর্ণ মানব তিনিই যিনি চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছেছেন। চিন্তার ক্ষেত্রে পূর্ণতায় পৌছার অর্থ বিশ্ব ও অস্তিত্বজগতকে ঠিক যে রূপে আছে সে রূপেই উদ্ঘাটন ও জানা।

এ মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলকে মানব সত্তার মৌল উপাদান বলে জানে। এ ছাড়াও বিশ্বাস করে যে,বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তা-শক্তির দ্বারা বিশ্বকে তার প্রকৃত রূপে উদ্ঘাটন করা সম্ভব। আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি অস্তিত্বজগতকে তার আসল রূপে নিজের মধ্যে প্রতিফলিত করার ক্ষমতার অধিকারী। ঠিক আয়নার¡মত বিশ্বজগৎ তার প্রকৃত রূপ নিয়ে এতে প্রতিফলিত হয়।

ইসলামী দার্শনিক সমাজ যারা এ ধারণাকে গ্রহণ করেছেন তারা বিশ্বাস করেন যে,ইসলামের দৃষ্টিতে ও কোরআনের আলোকে ঈমান বলতে বিশ্বকে ঠিক যেমনভাবে আছে তেমনভাবে জানাই বোঝানো হয়েছে। ঈমান অর্থ বিশ্বজগতের স্রষ্টা,বিশ্বে বিরাজমান শৃঙ্খলা,প্রচলিত বিধান,বিশ্বের গতি ও লক্ষ্য এগুলোকে জানা। তারা বলেন,কোরআনে যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস,ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস,বিশ্বজগৎ আল্লাহর সৃষ্টি এ বিষয়ে বিশ্বাস,আল্লাহ্ বিশ্বজগতকে লক্ষ্যহীন ছেড়ে দেননি,বরং একে হেদায়েত ও পরিচালনা করছেন,যেমন নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে মানুষকে হেদায়েত করছেন তা জানা,সব কিছু আল্লাহ্ থেকে এসেছে এবং তার প্রতিই প্রত্যাবর্তনকারী প্রভৃতি- এ বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপনের অর্থ হলো বিশ্বজগতকে তার প্রকৃতরূপে জানা। তারা ঈমানকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,ঈমান পরিচিতি-জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ব্যতীত কিছু নয়। অবশ্য তাদের এ প্রজ্ঞা বা পরিচিতি জ্ঞানেরঅর্থ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বা আংশিক জ্ঞান নয়,বরং এ জ্ঞান ও পরিচয় দার্শনিক ও প্রজ্ঞাগত। দার্শনিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ বিশ্বের উৎপত্তি ও পরিসমাপ্তি,অস্তিত্বের ধারা ও পর্যায়কে সামগ্রিকভাবে জানাও উদ্ঘাটন করা।

এ মতাদর্শের বিপরীত মতবাদ

এ মতাদর্শ যা বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ বলে আমরা উল্লেখ করেছি এর বিপরীতে বেশ কিছু মতবাদ রয়েছে যে মতবাদগুলো এ মতবাদের বিরোধী ও সমালোচক। মুসলিম বিশ্বে প্রথম যে মতবাদটি এ মতবাদের বিরেুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো এশরাকী,সূফী ও খোদাপ্রেম মতবাদ। এরপর রয়েছে আহলে হাদীসের অনুসারীরা। শিয়াদের মধ্যে আখবারী এবং সুন্নীদের মধ্যে হাম্বলী ও আহলে হাদীস দার্শনিকদের বিপরীতে আকলকে অস্বীকার করেছে। তারা বলছেন,দার্শনিকরা আকল বা বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপারে যত বেশি গুরুত্ব দেয় আকলের গুরুত্ব এত অধিক নয়।

এদের থেকেও ইন্দ্রিয়বাদীরা বর্তমান সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির চরম সমালোচক। বিগত তিন-চার শতকধরে ইন্দ্রিয়বাদীদের জয়-জয়কার। তাদের মতে বুদ্ধিবৃত্তিকে যতটা মূল্য দেয়া হয় তা ততটা মূল্যের অধিকারী নয়। আকলের তেমন কোন গুরুত্ব নেই,বরং আকল ইন্দ্রিয়ের অনুগত। মানবের মূল তার ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়জাত অনুভূতিসমূহ। আকল খুব বেশি হলে যা করতে পারে তা হলো ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উপর কাজ করা। যেমন কোন কারখানাকে যদি আমাদের বিবেচনায় আনি,সেখানে যেরূপ কাঁচামাল প্রবেশ করে তৎপর কারখানার মেশিনের মধ্যে তা মিশ্রিত বা বিভাজিত হয়,উদাহরণস্বরূপ কাপড় বুনন কারখানায় প্রথমে তুলা থেকে সুতা বের করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বুননের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাপড়ের আকৃতি দেয়া হয়। তেমনি আকল মেশিনের মতো শুধু ইনিদ্রয়লব্ধ কাঁচামালকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট আকৃতি দেয়। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদ তার নিজের স্থানে এখনও অটল। এখানে আমরা অবশ্য সে বিষয়ে আলোচনা করব না,বরং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করার চেষ্টা করব।

ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের (মারেফাত) মৌলিকত্ব

বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদে কয়েকটি বিষয় আছে যার প্রতিটিকে যাচাই করে দেখব যে,সেগুলো ইসলামের সঙ্গে সংগতিশীল কিনা। প্রথম বিষয় বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের মৌলিকত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতি ও জ্ঞানের অর্থ হলো আকল বা বুদ্ধিবৃত্তি বিশ্বের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে এবং এ জ্ঞান ও পরিচিতি মৌলিক,নির্ভরযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ।

অনেক মতবাদই বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতা ও যোগ্যতায় বিশ্বাসী নয়। এখন আমরা দেখব ইসলামী উৎসগুলো থেকে আমাদের নিকট এ ধরনের দলিল-প্রমাণ রয়েছে কিনা যে,বুদ্ধিবৃত্তির এরূপ ক্ষমতায় আমরা বিশ্বাসী হতে পারি। ঘটনাক্রমে আমাদের হাতে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দলিল রয়েছে যাতে আমরা বলতে পারি ইসলামের মতো কোন মতাদর্শেই আকলকে এত অধিক পৃষ্ঠপোষকতা করা হযনি বা প্রামাণ্য ও নির্ভরযোগ্যতার ক্ষেত্রে আকলকে অন্য কোন ধর্মেই ইসলামের মতো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আপনি খ্রিষ্টধর্মকে ইসলামের সঙ্গে তুলনা করে দেখুন খ্রিষ্টধর্ম ঈমানের গণ্ডীতে আকলের প্রবেশের বিরোধী। তাদের মতে মানুষ যখন কোন কিছুর উপর ঈমান আনবে তখন এর উপর চিন্তা করার অধিকার তার নেই। চিন্তা যেহেতু বুদ্ধিবৃত্তির কাজ তাই বিশ্বাসগত বিষয়ে চিন্তার অবকাশ নেই। যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হবে সে বিষয়ে চিন্তা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আকলকে কি কেন এ ধরনের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া যাবে না। একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি,বিশেষত ঈমানের রক্ষক চার্চের অধিপতির দায়িত্ব হলো ঈমানের গণ্ডিতে যুক্তি,চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রবেশকে প্রতিহত করা। মূলত খ্রিষ্টবাদের শিক্ষা এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।

ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা ঠিক এর বিপরীত অবস্থা দেখি। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ে (উসূল) বুদ্ধিবৃত্তি ব্যতীত অন্য কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। যেমন যদি আপনাকে প্রশ্ন করা হয় আপনার ধর্মের একটি মৌলিক বিষয় বলুন। আপনি হয়তো বললেন,তাওহীদ (একত্ববাদ)। এখন যদি আপনাকে প্রশ্ন করাহয়,কেন আপনি এক আল্লাহ্য় ঈমান এনেছেন? আপনাকে অবশ্যই এজন্য যুক্তি পেশ করতে হবে যেহেতু ইসলাম আকল ব্যতীত আপনার নিকট থেকে তা গ্রহণ করবে না। যদি বলেন, আমি এক আল্লাহ্য় বিশ্বাস করি,কিন্তু এর পেছনে কোন যুক্তি পেশ করতে পারব না। আমার দাদীমার থেকে শুনে আমি বিশ্বাস করেছি। অবশেষে এক সত্যে পৌছেছি যেভাবেই হোক দাদীমার কাছে শুনে অথবা স্বপ্নদেখে। ইসলাম বলে, না,যদিও এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসী হও,কিন্তু এ বিশ্বাসের ভিত্তি স্বপ্ন বা পিতা-মাতার অন্ধ অনুকরণ অথবা পরিবেশের প্রভাবে হয়ে থাকে,তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কেবল চিন্তা ও বিচার-বিশ্লেষণের পর যুক্তির ভিত্তিতে যদি আপনি ঈমান আনয়ন করেন তবেই তা গ্রহণ করা হবে নতুবা নয়।

খ্রিষ্টবাদে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এটাই খ্রিষ্টবাদের ভিত্তি। একজন খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তির দায়িত্ব হলো এই গণ্ডিতে আকল ও চিন্তার প্রবেশকে রোধ করা। ইসলামে ঈমানের গণ্ডিতে আকলের স্থান সংরক্ষিত। আকল ব্যতীত অন্য কোন কিছুর এ গণ্ডিতে প্রবেশাধিকার নেই।

ইসলামের উৎসসমূহে অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহয় আকলকে উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন দেখা যায়। প্রথমত কোরআন সব সময়ই বুদ্ধিবৃত্তির প্রশংসা করেছে। তদুপরি আমাদের হাদীস গ্রন্থসমূহেও বুদ্ধিবৃত্তির গুরুত্ব ও মৌলিকত্ব এতটা প্রকট যে,এ গ্রন্থসমূহ খুললেই দেখা যায়,তাতে প্রথম অধ্যায় হিসেবে কিতাবুল আকল এসেছে এবং এ অধ্যায়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।

ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) আকল সম্পর্কিত একটা আশ্চর্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ্পাকের দু টি হুজ্জাত (দলিল) রয়েছে। এ দু টি হুজ্জাত দু টি নবী। একটি অভ্যন্তরীণ নবী বা আকল,দ্বিতীয়টি বাহ্যিক নবী অর্থাৎ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ যারা নিজেরা মানুষ এবং অন্য মানুষদের দীনের দিকে দাওয়াত করেন। আল্লাহ্পাকের এ দু টি হুজ্জাত একে অপরের পরিপূরক অর্থাৎ যদি মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি থাকে,কিন্তু পৃথিবীতে কোন নবী প্রেরিত না হয়,তবে মানুষের পক্ষে সফলতার পথ অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। তেমনি যদি নবী থাকেন,কিন্তু মানুষ বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী না হয় তাহলেও সে সাফল্য লাভ করতে পারবে না। আকল ও নবী একসঙ্গে একই দায়িত্ব পালন করে। এর চেয়ে উত্তমরূপে আকলকে সম্মানিত করা ও পৃষ্ঠপোষকতা দান আর কোনভাবে সম্ভব কি?

এ ধরনের বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্ভবত আরো শুনে থাকবেন। যেমন জ্ঞানীর নিদ্রা অজ্ঞের ইবাদত হতে উত্তম , জ্ঞানীর খাদ্যগ্রহণ মূর্খের রোযা অপেক্ষা উত্তম , জ্ঞানীর নিরবতা অজ্ঞের কথা বলা হতে শ্রেয় , আল্লাহ্ কোন নবীকেই প্রেরণ করেননি এ অবস্থার পূর্বে যে,তার আকল পূর্ণতায় পৌছায় ও সমগ্র উম্মত থেকে তার বুদ্ধিবৃত্তি উচ্চতর হয় ইত্যাদি। আমরা রাসূল (সা.)-কে বুদ্ধিবৃত্তির সমগ্র রূপ বলে জানি। আমাদের এ ধারণা খ্রিষ্টবাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যশীল। যেহেতু তারা বুদ্ধিবৃত্তি থেকে দীনকে পৃথক বলে জানে। কিন্তু আমরা আমাদের নবীকে আকলের পরিপূর্ণ রূপ মনে করি।

সুতরাং পরিচিতিজ্ঞান ও প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে আমরা আকলকে দলিল বলে জানি এ অর্থে যে,বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে বাস্তব জ্ঞান ও পরিচয় লাভ সম্ভব। দার্শনিকদের এ দৃষ্টিভঙ্গিকে ইসলাম সমর্থন করে।


11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27