পাশ্চাত্যে মানবিক স্নেহ-ভালোবাসার নমুনা ও অনুভূতি
আমি গত বৈঠকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মানসিকতা নিয়ে আলোচনা করে বলেছি,পাশ্চাত্য মানসিকতা কঠোর এবং হৃদয় নিষ্ঠুর। অবশ্য পাশ্চাত্যের মানুষরা এটা স্বীকার করে ও বলে ভালোবাসা,করুণা,আত্মত্যাগ,সহমর্মিত বিষয়গুলো প্রাচ্য মানসিকতা উদ্ভূত। এমনকি সন্তানের প্রতি পিতার,সন্তানের পিতা-মাতার প্রতি,ভাই ও বোনের প্রতি ভাইয়ের,ভাই ও বোনের প্রতি বোনের ভালোবাসাও খুব কম দেখা যায়। প্রাচ্যের অধিবাসী এটা অনুভব করে যে,মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রাচ্যেই রয়েছে এবং পাশ্চাত্যে এ বিষয়গুলো উপেক্ষিত; সেখানে ন্যায়পরায়ণতা এবং সামাজিক সমতা বিদ্যমান থাকলেও সহমর্মিতা ও ভালোবাসার অস্তিত্ব নেই।
আমাদের এক বন্ধু যিনি তার পাকস্থলীর অপারেশনের জন্য অষ্ট্রিয়া গিয়েছিলেন (তার পুত্র সেখানে পড়াশোনা করত সে সুবাদে) তিনি আমাদের জন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। ঘটনাটি এরূপ-তিনি বলেন,“
আমার অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার পর আরোগ্যের জন্য বিশ্রামের পর্যায়ে ছিলাম।একদিন আমার পুত্র আমাকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে সে আমার সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত ছিল এবং আমাকে ঘিরে যেন ঘুরছিল। আমাদের বিপরীত দিকে এক দম্পতি (আমার ধারণা) আমাদেরকে লক্ষ্য করছিলেন। একবার যখন আমার ছেলে তার স্থান হতে উঠে ঐ দম্পতিকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল তারা তাকে কি যেন প্রশ্ন করলেন। আমার পুত্রের আচরণ ও ভঙ্গিতে বুঝলাম সে যেন তাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। সে আমার নিকট ফিরে আসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম : তারা তোমাকে কি জিজ্ঞেস করল? সে বলল : আমাকে তারা জিজ্ঞেস করছিলেন,যে ব্যক্তির তুমি এত সেবা করছ উনি তোমার কি হন? আমি বললাম : আমার পিতা। তারা বললেন : পিতা হলেই কি এতটা সেবা করতে হবে? আমি তখন তাদের যুক্তিতেই জবাব দিলাম যাতে বিষয়টি তাদের বোধগম্য হয়। আমি বললাম,সে আমার জন্য টাকা পয়সা পাঠাত বলেই তো আমি পড়াশোনা করতে পেরেছি। নতুবা আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত। তারা আশ্চর্য হয়ে বললেন : যে অর্থ সে নিজে উপার্জন করে তা থেকে তোমাকে পাঠায়! আমি বললাম : হ্যাঁ। তখন তারা আমাদের দিকে এমনভাবে তাকাতে লাগলেন যেন আমরা অন্য কোন সৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর নিজেদের স্থান হতে উঠে এসে আমাদের সঙ্গে গল্প করলেন। তারা বললেন : আমাদেরও এক সন্তান দীর্ঘ দিন হলো বিদেশে অবস্থান করছে। সেও এমন। আমার পুত্র তাদের বিষয়ে পরে খোজখবর করে জানতে পারে যে,তারা মিথ্যা বলেছেন। তাদের কোন পুত্রই নেই। পরে তারা তা স্বীকার করে বলেন : আমরা ত্রিশ বছর পূর্বে এনগেজমেন্ট করেছি এবং বিবাহের উদ্দেশ্যে কিছুদিন একসঙ্গে থাকব ভেবেছিলাম যাতে করে পরস্পরের আচরণ বুঝতে পারি। যদি একে অপরের আচরণ পছন্দ করি,তবে বিয়ে করব। কিন্তু আজও সে সুযোগ হয়ে উঠেনি।”
জনাব মুহাক্কেকীকে (আল্লাহ্ তাকে রহমত করুন) আয়াতুল্লাহ্ বুরুজেরদী জার্মানীতে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সেখানকার একটি ঘটনা আমার নিকট বর্ণনা করেছিলেন যা বেশ আশ্চর্যজনক। তিনি বলেন,“
আমাদের সময়ে যে ক’
জন স্বনামধন্য ব্যক্তি মুসলমান হয়েছিলেন তার মধ্যে একজন জার্মান প্রফেসর ছিলেন। লোকটি যথেষ্ট জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তিনি আমাদের নিকট ঘন ঘন আসতেন,আমরাও সুযোগ পেলে উনার ওখানে যেতাম। তার জীবনের শেষ দিকে যখন তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আমরা এবং অন্য মুসলমানরা তাকে হাসপাতালে দেখতে যেতাম। একদিন এ বৃদ্ধ আমাদের নিকট বেশ কিছু অভিযোগ করলেন। তিনি বললেন : যে দিন প্রথম আমি অসুস্থ হই এবং ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান যে,আমার ক্যান্সার হয়েছে সে দিন আমার স্ত্রী ও পুত্র আমাকে এসে বলল : তোমার ক্যান্সার হয়েছে,তাহলে তো নিশ্চিতভাবেই মারা যাচ্ছ। আমরা আর তোমাকে দেখতে আসছি না,এখনই শেষ বিদায় জানিয়ে যাচ্ছি। তারা তখনই আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। চিন্তাও করল না এ হতভাগার একটু স্নেহ-ভালোবাসার প্রয়োজন। এ কথা শোনার পর আমরা ঘন ঘন তাকে দেখতে যেতাম। একদিন খবর পেলাম উনি মারা গেছেন। আমরা তার দাফন-কাফনের জন্য হাসপাতালে গেলাম। গিয়ে দেখি তার পুত্র সে দিন এসেছে। মনে মনে খুশী হলাম যে,অবশেষে অন্তত পিতার দাফন-কাফনের জন্য এসেছে। কিন্তু পরে খোজ নিয়ে বুঝলাম,সে তার পিতার লাশটি হাসপাতালের নিকট বিক্রি করে দিয়েছে,এখন এসেছে টাকা নেয়ার জন্য।”
কিরূপ আশ্চর্যের বিষয়!
আত্মত্যাগের পূর্বের ধাপ হলো ন্যায়পরায়ণতা
উপরিউক্ত ঘটনা থেকে বোঝা যায়,এ লোকগুলো ভালোবাসাশূন্য। এখানে আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে,আমরা আমাদের অনেক কাজকেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও অনুগ্রহের প্রকাশ মনে করি এবং সেগুলোকে মানবিকতা বলি,কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ভালোবাসা বা অনুগ্রহ নয়।
অনুগহের অর্থ কি? অনুগ্রহ হচ্ছে মানুষ তার বৈধ অধিকার হতে অন্যের কল্যাণে যে কাজ করে। যে ব্যক্তি এরূপ কাজ করতে চায় তাকে এর পূর্বের ধাপ অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। আর তা হলো সে কারো অধিকার খর্ব করবে না,অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেবে,নিজের অধিকারের সীমালঙ্ঘন করবে না বরং যথাযথভাবে তা মেনে চলবে। কোন ব্যক্তি এগুলো মেনে চললে তাকে সমাজহিতৈষী বলা যেতে পারে।
কিন্তু সমাজে আপনারা একদল লোককে সব সময় দেখেন যারা নিজেদের প্রাপ্ত অধিকারের প্রতি সন্তুষ্ট নয়,বরং সব সময় সেই প্রচেষ্টায় লিপ্ত যাতে অধিক সম্পদ কুক্ষিগত করা যায়। এরা হারাম-হালালের ধার ধারে না,মানুষের অধিকারের প্রতি সম্মান দেয় না,অন্যের অধিকার খর্ব করে। এরূপ কোন ব্যক্তি যদি তার কোন বন্ধুর জন্য একদিন কয়েক হাজার টাকা খরচ করে তাকে কি আমরা মানবসেবা ও দানশীলতা মনে করে বলব যে,এটা সমাজ-কল্যাণমূলক কাজ। না,কখনই তা নয়।বরং নাম অর্জনের জন্য সে এ কাজ করেছে,তাই এটা স্বার্থপরতা ছাড়া কিছু নয়। কোন ব্যক্তি যদি নিজের নাম ও সম্মান বাড়ানোর জন্য এরূপ কাজ করে তবে তাকে মানবকল্যাণ বলা যায় না।
এরূপ একটি উদাহরণ এখানে পেশ করছি। আমাদের মধ্যে অনেকেরই একটি স্বভাব রয়েছে মেহমানদারী করার। তারা বলে,“
আমাদের মন বড়,আমাদের দরজা সব সময় মেহমানদের জন্য উন্মুক্ত। একজন মেহমান যাচ্ছে তো আরেকজন আসছে। সকাল,দুপুর,রাতের খাবারের মেহমানই শুধু নয়,রাতে থাকার মেহমানও আমার বাড়ীতে কম নেই।”
কারো সামর্থ্য থাকলে এরূপ কর্ম মন্দ নয়। কিন্তু অন্য একটি দিকও তো আমাদের দেখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় এ মেহমানদারী করতে গিয়ে ঘরে যে স্ত্রী রয়েছে তার উপর অতিরিক্ত চাপ নেমে আসে,অথচ আমাদের শরীয়ত সম্মত কোন অধিকার নেই তাকে এরূপ নির্দেশ দেয়ার। বরং সে আমাদের ঘরে কাজ করা বা না করার বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই তার উপর এরূপ নির্দেশ জারী মেহমানদারীর নামে একজন মানুষের উপর জুলুম ও অত্যাচারের শামিল।
আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) তার ঘরে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর কাজে সহযোগিতা করতেন। হযরত ফাতেমাও ঘরের কাজ নিজ ইচ্ছায় নিজের কাধে নিয়েছেন। আলী তা চাপিয়ে দেননি। তদুপরি আলী চান না তার প্রিয় স্ত্রীর উপর অতিরিক্ত চাপ থাকুক।
তাই একে কি আমরা মেহমানদারী ও বন্ধু হিতৈষী কর্ম বলব যে,এক ব্যক্তি সার্বক্ষণিক মেহমান এলে তার স্ত্রীকে নির্যাতন করবে আর একদিন এ নারী ক্লান্তির কারণে কাজ করতে অস্বীকার করলে সে বলবে,যদি কাজ না করতে চাও তবে আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও। তাই এগুলো সমাজহিতৈষিতা নয়। তবে এমন কিছু যা আত্মত্যাগের পর্যায়ে পৌছে তার কথা ভিন্ন। যে ব্যক্তি সমাজহিতৈষি তার ভিত্তিতে কাজ করতে চায় তাকে প্রথমে ন্যয়পরায়ণতার পর্যায় অতিক্রম করতে হবে অর্থাৎ যদি কেউ ন্যায়পরায়ণ হয়,অন্যের অধিকারের সীমালঙ্ঘন না করে,তারপর নিজের বৈধ অধিকার ত্যাগ করে তবেই তার কর্মকে আত্মত্যাগ বলা যাবে,নতুবা নয়। তাই প্রসিদ্ধ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা এবিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন থাকতেন যাতে করে কারো অধিকার সামান্য পরিমাণও খর্ব না হয়। এমনকি নিজ পরিবারে স্ত্রী বা পুত্র-কন্যাদের নির্দেশ দিয়ে নিজের কোন কাজ করিয়ে নিতেন না। (মানুষের ব্যক্তিগত কাজের ক্ষেত্রে এরূপ করতেন। কিন্তু যে বিষয়টি সন্তানদের প্রশিক্ষণের জন্য সেক্ষেত্রে নয়।)
মরহুম আয়াতুল্লাহ্ শেখ আবদুল করিম হায়েরীর শিক্ষক প্রসিদ্ধ মার্জায়ে তাকলীদ মির্জা মুহাম্মদ তাকী শিরাজী (রহ.)-এর ব্যাপারে এ রকম একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তিনি একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তার স্ত্রী মাড়ী ভাত তৈরি করে ঘরের মধ্যে রেখে যান তার জন্য। কিন্তু যখন তিনি ক্ষুধার্ত হয়ে খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন মনে করলেন দুর্বলতার কারণে যেখানে তা রাখা ছিল সেখান হতে তা গ্রহণে সক্ষম হলেন না। এভাবে কয়েক ঘন্টা অতিক্রান্ত হলে যখন স্ত্রী এসে দেখেন খাবার ঐ অবস্থায়ই রয়েছে তখন জিজ্ঞেস করলেন,“
কেন তা খাননি?”
তিনি বললেন,“
শরীয়ত আমাকে এ অনুমতি দিয়েছে কি যে,স্ত্রীকে রান্নাঘর থেকে ডেকে এনে সেটা আমার নিকট এগিয়ে দেয়ার নির্দেশ দানের-সে বিষয়ে সন্দেহে ছিলাম। যে কাজ তুমি নিজ ইচ্ছায় করছ,আমি তার বাইরে অন্য নির্দেশ দান নিজের জন্য বৈধ মনে করছি না।”
সুতরাং কোন কাজ তখনই সমাজহিতৈষী হবে যখন তা আত্মপ্রচার ও স্বার্থপরতার কারণে নয়,বরং আত্মত্যাগের মনোবৃত্তি নিয়ে হবে।