ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 7%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 42383 / ডাউনলোড: 7058
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

1

2

3

4

5

6

7

8

সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

) قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّـهَ وَلَا نُشْرِ‌كَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْ‌بَابًا مِّن دُونِ اللَّـهِ (

ইনসানে কামেল সম্পর্কিত অপর একটি মতবাদ হলো সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র। এ মতবাদে মানুষের পূর্ণতা ও অপূর্ণতা দু টি বস্তুতে বিশ্বাস করা হয়। মানুষের অপূর্ণতা মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে আর তার পূর্ণতা সমাজ বা সামষ্টিকতার মধ্যে এ অর্থে যে,যতক্ষণ মানুষ আমিত্বের ধারণায় থাকবে ততক্ষণ অপূর্ণ (অবশ্য এরফান যে আমিত্ব বলে তা থেকে এটা আলাদা) আর আমিত্বের ধারণার বিলুপ্তির মাধ্যমে তার পূর্ণতা অর্জিত হবে।

এরফানী ধারণায় আমিত্বকে তার জন্য ধ্বংস কর অর্থাৎ ব্যক্তির প্রথম ও নিজসত্তা হিসেবে আমিত্বের বিলুপ্তি ঘটলে তৃতীয় সত্তা যিনি হলেন মহান আল্লাহ্পাক তিনি সে স্থান দখল করবেন। তার মধ্যে আমার বিলুপ্তি অর্থ আল্লাহর মধ্যে মানুষের বিলুপ্তি।

এরফানী মতবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের এ ক্ষেত্রে মিল রয়েছে যে,এ দু মতবাদই আমিত্বের অবসান চায়,তবে সমাজতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি চায় তৃতীয় সত্তার প্রতিস্থাপনের জন্য নয় বরং সেখানে সামষ্টিকতা বা আমরা কে স্থান দেয়ার জন্য। এদের মতে পূর্ণ মানব আরেফ নয় যে বলবে,আমার আলখাল্লার নীচে খোদা ব্যতীত অন্য কেউ নেই বরং আমরায় বা সামষ্টিক সত্তায় বিলুপ্ত আমিই হলো পূর্ণ মানব। সে পূর্ণ মানব আমিত্বকে অনুভব করে না,করে আমরাকে।

এ পর্যন্ত এ মতবাদ যা বলে,অন্যান্য অনেক মতবাদই তা গ্রহণ করে। এমনকি যে সকল মতবাদ তৃতীয় সত্তার জন্য প্রথম সত্তাকে বিলুপ্ত করার পক্ষপাতী তারাও এ বিষয়টির বিরোধী নয়। তারাও চায় আমি বিলুপ্ত হয়ে আমরা য় পরিণত হোক।

এ মতবাদের সারকথা

এ মতবাদ আমি কে আমরা য় রূপান্তরিত করার পথও বাতলে দিয়ে বলেছে,কোন বস্তু আমার নাহয়ে আমাদের হওয়া অর্থাৎ মালিকানা বিলুপ্ত হয়ে সামষ্টিক মালিকানায় রূপান্তরই এ পূর্ণতার পথ। আপনি যদি সম্পদের স্বত্বাধিকারের বিষয়টি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন তা দু ধরনের : এক ধরনের বিষয় রয়েছে যা আমাদের সমাজে আমাদের সকলের সম্পদ,যেমন ইরানীদের জন্য ফার্সী ভাষা- যা আমার-আপনার কারোরই ব্যক্তি মালিকানার বিষয় নয় বরং এটা সকল ফার্সী ভাষাভাষির সম্পদ। দেশ বা রাষ্ট্রও তেমনি কোন ব্যক্তির সম্পদ নয় বরং ঐ রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সম্মিলিত সম্পদ। যা কিছুরই সামষ্টিক মালিকানা রয়েছে তা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। স্বদেশী,স্বভাষী,এক সংস্কৃতি,এক ধর্ম এরূপ বিষয়সমূহ ব্যক্তি মালিকানার বিষয় না হওয়ায় এগুলো সাধারণভাবে আমাদের ধারণার জন্ম দেয়।

অন্যদিকে কিছু বস্তু বা বিষয় রয়েছে যেগুলো ব্যক্তিগত ও বিশেষ সত্ত্বাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-আমার বাড়ি,আমার অর্থ,আমার পোশাক,আমার কার্পেট,আমার গাড়ী। আমার বাড়ি আমারই,অন্য কারো নয়। আমার অর্থ-সম্পদও আমার,অন্য কারো অধিকার সেখানে নেই। এরূপ মালিকানার বিষয় যা বিশেষ ব্যক্তির স্বত্বাধিকারের অন্তর্ভুক্ত সেটা সাধারণ নয়। বলা হয়ে থাকে,যে সকল বিষয় ব্যক্তিসত্তা ও মালিকানার জন্ম দেয় সেগুলো আমিত্বের সৃষ্টি করে। ব্যক্তি মালিকানা ও সত্বাধিকার হতে আমাদের ধারণা সৃষ্টি হয়। সুতরাং মানুষের পূর্ণতার মানদণ্ড হলো আমরা আমাদের হওয়া। আর আমাদের হওয়ার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি মালিকানা ও সত্তাকে বিলীন করে সামাজিক ও সামষ্টিকতাকে (সামষ্টিক মালিকানা) প্রতিষ্ঠা করা।

তাদের দাবি মানুষ যখন প্রথম সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করা শুরু করে তখন মানবসমাজ সামষ্টিক সমাজ ছিল,কোন ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। আমার জমি,তোমার জমি,আমার সম্পদ,তোমার সম্পদ এগুলোও ছিল না। সব কিছুর উপর সামষ্টিক মালিকানা ছিল এবং মানুষ সে সমাজে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করত। আমাদের ধর্মে যেমন এসেছে যে,আমাদের আদি পিতা-মাতা এক বেহেশতে বাস করতেন,অতঃপর অপরাধ করার কারণে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হন এবং মাটির এ পৃথিবীতে কঠিন জীবনের সম্মুখীন হন। এ মতবাদের প্রবক্তাদের বর্ণনাও আমরা এ ঘটনার অনুরূপে ব্যাখ্যা করতে পারি। মানব জাতি সৃষ্টির আদিতে সামষ্টিক মালিকানার স্বর্গীয় সমাজে বাস করত। পরবর্তীতে এক অপরাধ করে সেই স্বর্গ হতে বহিষ্কৃত হন। সেই অপরাধ হলো ব্যক্তি মালিকানার জন্মদান এবং আমাদের স্থানে আমার চিন্তার উৎপত্তি। যখন মানব সমাজে ব্যক্তি মালিকানার সৃষ্টি হলো তখন মানুষ সৌভাগ্য বঞ্চিত হয়ে কঠিন পরিবেশের সম্মুখীন হয়ে দুর্ভাগ্যগ্রস্ত হয়ে পড়ল এবং এখনও সে এ বোঝা বহন করছে। এখন মানুষকে তওবা করতে হবে যাতে করে পূর্ণতার সেই স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং সে তওবা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানা হতে অনুশোচনা করে ফিরে আসা। যখনই মানুষসামগ্রিকভাবে ব্যক্তি মালিকানা ও সত্বাধিকার হতে তওবা করবে ও সামষ্টিক মালিকানাকে গ্রহণ করবে তখনই মানুষ তার পূর্ণতায় পৌছবে।

বলা হয়ে থাকে,ব্যক্তি মালিকানা হতেই জুলমের সৃষ্টি হয়। তাই ব্যক্তি মালিকানা হতেই শোষক ও শোষিতের জন্ম হয়েছে। মানুষ যতক্ষণ শোষক অথবা শোষিত থাকবে ততক্ষণ অপূর্ণ। শোষক ও শোষিতের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য যাদের একদল সম্পদ পুঞ্জিভূত করে দামাভান্দ পর্বতের মত উঁচু করেছে এবং অপরদল সম্পদহীনতার গভীর গহ্বরে নিপতিত হয়েছে। যতক্ষণ এ অবস্থা বিরাজ করবে মানবসমাজ সৌভাগ্যের মুখ দেখতে পারবে না। সমাজ তখনই সৌভাগ্যের মুখ দেখতে পারবে যখন পাহাড় ও গহ্বর সমতল ভূমিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি হবে এবং তখনই মানুষ পূর্ণতায় পৌছবে। সুতরাং এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতা ব্যক্তি মালিকানা ও এর ফলে উদ্ভূত শোষক ও শোষিত শ্রেণীর বিলুপ্তির মধ্যে নিহিত বলে মনে করে। শোষণ যেমন শোষিতের মধ্যে হিংসা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয় তেমনি শোষকের মধ্যে সৃষ্টি করে লোভ ও সম্পদলিপ্সা। যখন এই শোষণের মূল ব্যক্তি-মালিকানা র অবসান ঘটবে তখনই মানুষের পূর্ণতা ঘটবে।

এ মতবাদের মৌল ত্রুটি

আমি পরিবর্তিত হয়ে আমরা য় রূপান্তর অর্থাৎ আমিত্ব বলে সমাজে কিছু থাকবে না- এ ধারণা সমাজতন্ত্রের একার কথা নয়। যে পথ সমাজতন্ত্র দেখায় এবং এরই নিজস্ব তা হচ্ছে আমিত্ব -এর জন্মদানকারী হলো ব্যক্তি-মালিকানা এবং আমাদের ধারণার জন্মদাতা হলো সামষ্টিক মালিকানা।

কেউ সমাজতন্ত্রের এ চিন্তার উত্তর দিতে চাইলে এভাবে তা দিতে পারেন- তিনি বলতে পারেন, জনাব সমাজতান্ত্রিক! বস্তুর উপর ব্যক্তির মালিকানা আমিত্বের জন্ম দেয়,নাকি বস্তুর প্রতি মানুষের আসক্তি অর্থাৎ যখন বস্তুই মানুষের সর্বস্বে পরিণত হয়? বস্তুর উপর ব্যক্তির মালিকানা অর্থাৎ মানুষ মালিক এবং বস্তু তার অধীন হলে আমিত্বের সৃষ্টি করে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয় ও ঐক্য বিনষ্ট করে নাকি এর উল্টোটা? মানুষের মালিকানা ও স্বত্বাধিকার এর জন্য দায়ী নয় বরং এর বিপরীতে বস্তু যখন মালিক এবং মানুষ তার অধীন হয় তখন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরফানের পরিভাষায় মানুষ যখন বস্তুর আসক্ত হয়ে পড়ে তখনই আমিত্বের সৃষ্টি হয়। অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়া আমিত্বের জন্ম দেয় না,বরং অর্থ ও সম্পদের দাস হলেই মানুষের মধ্যে আমিত্বের সৃষ্টি হয় ও আমাদের ধারণার বিলুপ্তি ঘটে।

এ মতবাদের মতে ব্যক্তি-মালিকানাকে বিলুপ্ত করলে আমিত্ব পরিবর্তিত হয়ে আমাদের হয়ে যাবে। বিপরীতপক্ষে আমাদের মতবাদে (ইসলামে) এ কথা বলে না যে,ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্ত কর বরং বলে প্রকৃত মানুষ তৈরি কর,মানুষকে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ দান কর,তাকে সর্বোত্তম আদর্শ শিক্ষা দাও যাতে করে সম্পদ ও বস্তুর অধিকারী হলেও বস্তুর প্রতি তার আসক্তি থাকবে না,সে বস্তুর দাস হবে না,বরং স্বাধীন হবে। কোন্ মানুষটি আমাদের ধারণা পোষণ করে? যে মানুষের কোন কিছু নেই সে,নাকি যে মানুষ আত্মিক স্বাধীনতার অধিকারী? এটা কখনই ঠিক নয়,যে ব্যক্তির কিছু নেই সে-ই আমাদের ধারণার অধিকারী। মানুষ তখনই আমাদের ধারণার অধিকারী হবে যখন তার বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকবে না,বস্তু তাকে নিজের অধীন করবে না এবং কখনও করে না। এরূপ ব্যক্তিরই আমিত্ব নেই; রয়েছে আমাদের ধারণা। এখানে দু টি উদাহরণ দেয়া হয়। বলা হয় যে,আমরা সব সময় একদল মানুষকে দেখি যারা বস্তুর মালিক হয়েও বিশেষ প্রশিক্ষণের কারণে বস্তুর দাস,অধীন ও বন্দি নয়। যুহদ বা দুনিয়া বিমুখতার প্রকৃত অর্থ এটাই যা হযরত আলী নাহজুল বালাগায় বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ দুনিয়ার দাস না হয়ে স্বাধীনভাবে বাচা। অপরপক্ষে একদল লোক রয়েছে যাদের তেমন কোন সম্পদই নেই,অথচ ঐ সম্পদকে আঁকড়ে থাকে ও তারই দাস ও সেবক হিসেবে সে নিয়োজিত। এদের আমিত্ব আমাদের চিন্তায় পরিণত হয়নি।

আলীর (আ.) দৃষ্টিতে দুনিয়া

আলী দুনিয়াকে লক্ষ্য করে বলছেন, হে দুনিয়া! তোমাকে তিন তালাক দিলাম- যে তিন তালাক ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ নেই। أعزبی عنّی হে দুনিয়া! আমা হতে দূর হও।

فو الله لا أذلّ لک فستذلّینی و لا أسلس لک فتقودینی

আল্লাহর কসম! কখনই তোমার নতি স্বীকার ও তোমার অনুগত হয়ে অপমানিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করব না। (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৫)

আলী সব সময় দুনিয়া ও সম্পদের প্রতি উপেক্ষা ও ঔদ্ধত্য ভাব দেখিয়েছেন। কখনই দুনিয়াকে তার অন্তরে প্রভাব ফেলার কোন সুযোগ দেননি।و لا أسلس لک (أسلس অর্থ এমন উট বা প্রাণী যে এতটা অনুগত যে,একটা বাচ্চাও তাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম) আমি কখনই তোমাকে সে সুযোগ দেব না যাতে করে আমার মনে প্রভাব ফেলে আমাকে নিয়ন্ত্রণ কর,যে দিক খুশী টেনে নিয়ে যাও। এটাই ইসলামের দুনিয়া বিমুখতা ও দুনিয়ার নেয়ামতের নিকট নিজেকে বিক্রি না করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার নমুনা। অন্যত্র আলী বলেছেন,

الدّنیا دار ممرّ لا دار مقرّ و الناس فیها رجلان رجل باع فیها نفسه فأوبقها و رجل ابتاع نفسه فأعتقها

দুনিয়া অস্থায়ী স্থান,স্থায়ী বাসস্থান নয় (এটা বাজারের মতো)। এখানে দু ধরনের মানুষ রয়েছে :একদল নিজেকে বিক্রী করে ধ্বংস করে অন্যদল নিজেকে কিনে স্বাধীন হয় ও মুক্তি লাভ করে। (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ১৩৩)

একদিন আলী (আ.) নিজ মালিকানাধীন কিছু দিরহাম বা দিনার নিজের হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে অর্থ! তুমি যতক্ষণ আমার হাতে রয়েছ ততক্ষণ আমার নও। কথাটি আমাদের ধারণা ও কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা বলি যতক্ষণ অর্থ আমার পকেটে অথবা হাতে রয়েছে তা আমার,যখন খরচ করে ফেলব তখন আমার থেকে চলে গেল। আলী (আ.) এর বিপরীতে বলছেন, তুমি যতক্ষণ আমার হাতে রয়েছ আমার নও। কারণ ততক্ষণ আমাকে তোমার সেবা করতে হবে ও তোমাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যখন তোমাকে খরচ করে ফেলব তখন তোমার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই। তাই তখন তুমি আমার অধীন।

আলী (আ.) একদিন কুফার বাজারে এক কসাইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। কসাই তাকে ডেকে বলল, আজকে খুব ভালো মাংস এনেছি যদি কিনেন। আলী (আ.) বললেন, আমার নিকট অর্থ নেই। কসাই বলল, আমি অর্থের জন্য ধৈর্যধারণ করতে রাজী আছি। হযরত আলী বললেন, আমি আমার উদরকে বলব ধৈর্যধারণ কর। কেন তুমি আমার উদরের জন্য ধৈর্যধারণ করবে? আমি বরং তোমার নিকট ঋণী না থেকে ধৈর্যধারণ করব।

আমিত্ব থেকে মুক্তির জন্য আত্মিক সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

ইসলাম বলে যদি মানুষকে আমিত্ব থেকে আমাদের ধারণায় আনতে চাও,তবে তার অভ্যন্তরকে সংশোধিত কর। তাকে বস্তুর দাস ও অনুগত হওয়ার সুযোগ দিও না। নতুবা শুধু ব্যক্তি-মালিকানা রহিত করবার মাধ্যমে এর উপশম সম্ভব নয়। অবশ্য এ বিষয়ে দু ধরনের মত রয়েছে। কারো কারো মতে ব্যক্তি-মালিকানা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই,শুধু আত্মিক প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব দাও। অন্যদের মতে এটা ঠিক যে,মানুষের অভ্যন্তরীণ দিকটিই মুখ্য,তদুপরি তার বাইরের দিকটিকেও সংশোধন না করলে তা সম্ভব নয়। ইসলামে আমরা অভ্যন্তরের সাথে বাইরের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে দেখি। ইসলাম মানুষের বাইরের অসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যহীনতার সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়,তবে তা ব্যক্তি-মালিকানাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদের মাধ্যমে নয়। ইসলাম বাইরের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়,তবে আমি আমরা য় রূপান্তরিত হওয়ার জন্য বাইরের সামঞ্জস্য বিধানকে যথেষ্ট মনে করে না বরং সামঞ্জস্য বিধানের জন্য প্রকৃত আত্মিক ভারসাম্য প্রয়োজন বলে মনে করে।

ব্যাকরণে নিশ্চয়ই সম্বন্ধ সম্বন্ধিত পদ সম্পর্কে পড়েছেন। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য হলো সম্বন্ধের দিকে। এই সম্বন্ধ পদগুলো যখন আমার সঙ্গে আসে,যেমন আমার বাড়ি,আমার টাকা ইত্যাদি তখন আমিত্বের জন্ম হয়। এই সম্বন্ধ পদগুলোই সব সমস্যার মূল। তাই একে উচ্ছেদ করে আমাদের করতে হবে। (আপনারা জানেন,এরা পূর্বেও যেমন বর্তমানেও তেমন যৌথ মালিকানার বিষয়টি পরিবারের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারণের পক্ষপাতী ছিল,কিন্তু নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘটিত বিপ্লবের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারীর উপর সামষ্টিক মালিকানার বিষয়টি প্রয়োগের চিন্তা করে,কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৩৬ সালে রহিত করে।)

কিন্তু ইসলাম বলে,তাদের সম্বন্ধ করার কিছুই নেই; সম্বন্ধিত সত্তা অর্থাৎ আমি সব কিছুর জন্য দায়ী। আমাদের দেখতে হবে,এ আমি কার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। যদি সম্বন্ধ পদটি সীমিত ও ব্যক্তি বিষয়ের হয়,তবে আমি আমিত্বে পরিণত হবে (১*) আর যখন সমাজের আত্মা সম্পর্কিত বিষয় হয়,যেমন আদর্শ,ঈমান,স্রষ্টা প্রভৃতি তখন আমি আমাদের ধারণায় পরিণত হবে। এ মতবাদের সমর্থকরা যুক্তি দেখান, আমরা একদিকে একদল লোক দেখি যারা প্রচুর সম্পদের অধিকারী,কিন্তু তাদের আমি আমাদের সত্তায় পরিণত হয়েছে। যখন তাদের কিছুই ছিল না তখনও তাদের সত্তা আমাদের ছিল। আবার যখন সব কিছুই তারা লাভ করেছে তখনও তাদের সত্তা আমাদের ধারণা হতে সরে আসেনি। কারণ তাদের মন ও মানসিকতা বস্তুর প্রতি আসক্ত ছিল না। আলী ইবনে আবি তালিব এমনই এক ব্যক্তি। যখন আলীর জীবন অত্যন্ত সংগ্রাম মুখর ছিল ও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটত,হয়তো কোন দিন নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ার মতো খাদ্যই তার জুটেছে যার সবটুকইু দান করে দিতেন,নিজের পরিবারের জন্য কিছুই রাখতেন না। আবার এমন দিনও আলীর এসেছে যে,সর্ববহৎ দেশের অর্থাৎ তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে বায়তুল মালের অধিকারী ছিলেন। যেমন খুশী নিজের ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু এ দু অবস্থার কোনটিতেই তার মধ্যে আমিত্ব ছিল না,সব সময়ই তার সত্তা ছিল আমাদের। সব সময়ই নিজেকে ভুলে অপরের চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন। সুতরাং আমি কে আমাদের করার জন্য ব্যক্তি-মালিকানার অবসানের প্রয়োজন নেই।

আমিত্ব সৃষ্টির একমাত্র কারণ ব্যক্তি-মালিকানা নয়

সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলতে হয়,মানুষের সকল কর্মকাণ্ড অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় যে,বলা যাবে ব্যক্তি-মালিকানাকে সামষ্টিক মালিকানায় পরিণত করলে আমি আমরা য় পরিণত হয়ে যাবে। মানুষের জীবনের অনেকগুলো দিকের একটি দিক হলো অর্থনীতি যেখানে ব্যক্তি-মালিকানার বিষয় রয়েছে। কিন্তু তার জীবনের অন্যান্য দিক অর্থনীতি ও ব্যক্তি-মালিকানার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়,যেমন পদমর্যাদা নারী । এ দু টি বিষয় মর্যাদার দিক হতে কোন অবস্থাতেই অর্থনীতি হতে কম মূল্যের নয়। কখনো কখনো মানুষ একজন নারীর জন্য তার সকল অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করে বা কোন সামাজিক পদমর্যাদার জন্য তা ব্যয় করে। তাকে আমরা কি বলব? সকল নারীকে একই ছাঁচে ফেলে সকল দিক হতে পরস্পরের সমমান করা সম্ভব কি? যদিও বাস্তবে নারীর মালিকানার ক্ষেত্রে যৌথ বা সামষ্টিক মালিকানার কোন ব্যাপার নেই তদুপরি এখানে আমার ধারণা বর্তমান।

পদমর্যাদাও তদ্রূপ। যদি ধরি,যে ব্যক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন তিনি খাদ্য,বাসস্থান ও যানবাহনের ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকের সমান,যেমন সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার দেশের কোন এক কারখানার শ্রমিকের সম অবস্থানে রয়েছেন,তাদের বাসস্থান,যানবাহন সবই এক রকম,যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির উপহার তিনি গ্রহণ করে গর্বিত হন না। এখন কি বলা যাবে,তিনি বাকী সকল বিষয়ে সাধারণ নাগরিকদের পর্যায়ে রয়েছেন? না,কারণ তিনি যে পদ ধারণ করে রয়েছেন অন্যরা তা ধারণ করছে না এবং এ পদের সুবাদে রেডিও,টেলিভিশন,পত্রিক প্রভৃতিতে শতবার তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে ও ছবি আসছে,অথচ ঐ শ্রমিক এ সব ক্ষেত্রে সাম্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে ও ঐ সুবিধাগুলো পাচ্ছে না।

তাই বোঝা যায়,ঐ প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদাকে সামষ্টিক মালিকানার আওতায় আনা সম্ভব নয়। বাধ্যতামূলকভাবেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্বের দায়িত্ব কোন এক ব্যক্তিকে দিতে হবে। এক ব্যক্তি সাধারণ সম্পাদক হবে,কেউ সহ-সভাপতি হবে,এমন ভাবে দায়িত্ব বণ্টিত হতে হবে শেষ পদ পর্যন্ত। কোন অফিসের ক্ষেত্রেও সেরূপ।

আমি আমরা য় পরিণত হতে হলে ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্তকরণই যথেষ্ট নয়। যেহেতু অনেক স্থানেই দেখেছি ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্ত হলেও আমি আমরা য় পরিণত হচ্ছে না। এ কারণেই সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যেও প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা একে অপরের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের এ প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য আধিপত্য বিস্তার ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা। সুতরাং আমি আমরা য় রূপান্তরের তাদের এ কথা শুধুই কথা।

অবশ্য আমরা স্বীকার করি,আমিত্ব সৃষ্টিতে মালিকানার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এবং তা আমরা ধারণার প্রতিবন্ধক। এজন্য ইসলাম মালিকানা ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। পূর্ণ মানবের অন্যতম শর্ত হলো আমি আমরা য় পরিণত হওয়া,এটা আমরাও স্বীকার করি,কিন্তু শুধু আমি আমরা য় পরিণত হলেই মানুষ পূর্ণ মানবে পরিণত হবে- এ কথাটি ঠিক নয়। তাই সমাজতান্ত্রিক মতবাদ একপেশে মূল্যবোধ কেন্দ্রিক মতবাদ এবং তাদের এ ধারণাটি ঠিক নয় যে,সকল মূল্যবোধ আমি আমরা য় পরিণত হওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং এ ছাড়া মূল্যবোধের অস্তিত্ব নেই। আমরা অন্যান্য মতবাদের ব্যাপারেও লক্ষ্য করেছি যে,বিশেষ একটি মূল্যবোধকে মানবের পূর্ণতার জন্য যথেষ্ট মনে করেছে। কিন্তু একটি বিষয়কে একমাত্র মানবীয় মূল্যবোধ মনে করা ঠিক নয়।

জীবন কি শুধুই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম ?

এ ধরনের কথা আমাদের মধ্যেও অজ্ঞাতসারে প্রচার লাভ করেছে। যেমন কখনো কখনো আমরা বলি,জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়। না,জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম নয়,বরং জীবন হলো সত্যের জন্য সংগ্রাম। কখনো কখনো কোনো কোনো ইসলামী ব্যক্তিত্ব,যেমন ফরিদ ওয়াজেদী বলেছেন,যুদ্ধ মানুষের জন্য অপরিহার্য,যতদিন মানুষ আছে যুদ্ধও রয়েছে,যুদ্ধ যেন মানুষের জীবনের অঙ্গ। তিনি বিশ্বাস করেন কোরআনও তার বিভিন্ন আয়াতে এ কথাকে সত্যায়ন করেছে। যেমন সূরা হজ্বের এই আয়াতে- যদি মহান আল্লাহ্ মানুষের একদল দ্বারা অন্য দলকে প্রতিরোধ না করতেন তবে ইহুদী,নাছারাদের উপাসনালয়সহ সকল মসজিদ যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয় সব ধ্বংস হয়ে যেত। (সূরা হজ্ব : ৪০) এবং সূরা বাকারার এই আয়াতে- যদি আল্লাহ্ মানুষের মধ্যে এক দল দ্বারা অন্য দলকে প্রতিরোধ না করতেন,তবে প্রথিবীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। (সূরা বাকারা: ২৫১) তার মতে এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ্ যুদ্ধকে বৈধতা দান করেছেন। যেমনভাবে এ আয়াতগুলোতে বলছেন,যুদ্ধ না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত বা কোন উপাসনালয়ই অবশিষ্ট থাকত না।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সকল ব্যক্তি কোরআনের এ আয়াতকে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কোরআনের এ সকল আয়াত প্রতিরোধের ও জিহাদের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করছে। যেহেতু খ্রিষ্টানরা বলে,যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে নিন্দনীয় ও অন্যায়; আমরা শান্তিতে বিশ্বাসী,কোরআন তাদের জবাবে বলছে,যে সকল যুদ্ধ অধিকার হরণ ও সীমালঙ্ঘনের জন্য ঘটে তা অন্যায়। কিন্তু যে যুদ্ধ সত্যকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তা অন্যায় নয়। হে খ্রিষ্টান পাদ্রীসকল! যদি প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ না থাকত,তবে তোমরাও গীর্জায় বসে ইবাদতের সুযোগ পেতে না। কোন মুমীন ব্যক্তিও মসজিদে বসে ইবাদত করতে পারত না। জিহাদই সে বস্তু যা সত্য ও সত্যপথকে রক্ষা করছে। তাই পাদ্রীমহোদয়! আপনারও যে সৈনিক এজন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে তার নিকট কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

সুতরাং মানুষের পক্ষে সম্ভব পূর্ণতা ও প্রশিক্ষণের সে পর্যায়ে পৌছা যে পর্যায়ে প্রকৃতপক্ষে কোন সীমালঙ্ঘনকারীও থাকবে যার সঙ্গে যুদ্ধ বৈধ হবে। এ জন্যই যখন বলা হয জীবন বেঁচে থাকার সংগ্রাম ছাড়া কিছু নয়- যার অর্থ জীবনের জন্য যুদ্ধ ও সংগ্রাম অপরিহার্য কথাটি ঠিক নয় (সম্প্রতি ইসলামে আদর্শ সমাজ সম্পর্কিত যে আলোচনা হয় অর্থাৎ ইমাম মাহদী [আ.]-এর আবির্ভাবের পর সমাজের অবস্থা সেখানে বলা হচ্ছে,یصطلح سباع بهائم এমনকি হিংস্র প্রাণীরাও একে অপরের সঙ্গে শান্তিতে সহাবস্থান করবে এবং যুদ্ধ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে অর্থাৎ মানুষ পূর্ণতার এমন পর্যায়ে পৌছবে যে,সমাজে কোন সীমালঙ্ঘনকারীই থাকবে না যাতে করে যুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে)।

এ সম্পর্কে একটি বিষয় আলোচনা করতে চাই। সম্ভবত অনেকেই তা শুনে কষ্ট পাবেন যেহেতু আমাদের যুবকদের মধ্যে অনেকেই যা কিছু তাদের পছন্দমত নয় তা শুনলে দুঃখ পায়।

একটি কথা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বলে প্রচার করা হয়। এ কথাটির না অর্থ সঠিক,না কোনগ্রন্থে এটা ইমাম হুসাইনের বাণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের বেশি নয় এ কথাটি বলা হচ্ছে যে,ইমাম হুসাইন বলেছেন,إنّ الحیاة عقیدة و جهاد অর্থাৎ জীবন হলো এক বিশ্বাসএবং সেই বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম করা। কথাটি পাশ্চাত্যের চিন্তার সাথে সংগতিশীল যেহেতু তারা বলে মানুষের একটি বিশ্বাস বা আকীদা থাকা দরকার এবং সে আকীদার জন্য সংগ্রাম করা উচিত। কোরআন সত্যের কথা বলে। জিহাদ ও জীবন কোরআনের দৃষ্টিতে সত্যের উপাসনা ও সত্যের জন্য জিহাদ। বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম নয় বা জীবনের অর্থও বিশ্বাস বা আকীদা নয়। কারণ আকীদা সঠিক হতে পারে আবার বাতিলও হতে পারে।

আকীদা হলো চিন্তাসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সংযুক্তি। মানুষের চিন্তায় হাজারো ধরনের চিন্তার সম্মিলন ও সংযুক্তি ঘটে। ইসলাম ব্যতীত অন্যান্য মতাদর্শ বলে,মানুষের কোন এক বিশেষ বিশ্বাস,আদর্শ ও উদ্দেশ্য থাকা উচিত এবং সেই লক্ষ্য,উদ্দেশ্য ও বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা চালানো উচিত। এখন প্রশ্ন হলো সেই বিশ্বাস কি? তারা বলে,সেটা যা-ই হোক না কেন। কোরআনের কথাগুলো অত্যন্ত হিসেবী ও মাপা। কোরআন সব সময়ই বলছে,হক ও সত্য এবং সেই হক ও সত্যের জন্য জিহাদ। কোরআন এটা বলে না যে,তোমার আকীদা ও বিশ্বাসের জন্য জিহাদ কর,বরং বলছে,প্রথমে তোমার আকীদাকে সংশোধিত কর। প্রথমে তোমার আকীদার সঙ্গে যুদ্ধ করে সঠিক ও সত্য আকীদাকে গ্রহণ কর। তৎপর যখন সত্যকে উদ্ঘাটন করেছ তখন এ সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম ও জিহাদ কর।

যা হোক পূর্ণ মানুষ অর্থ ক্ষমতাবান মানুষ বা শক্তিবান মানুষ এ কথাটির মূল ভিত্তি এসেছে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামের ডারউইনের যে তত্ত্ব (Struggle for the fittest) সেখান থেকে।

ডারউইন তার এ তত্ত্বে জীবনকে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন,সকল জীবই সর্বাবস্থায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আমরা বলতে চাই,মানুষ ব্যতীত অন্যান্য প্রাণী এ ধরনের বলে কি আমরা মানুষকেও বলব যে,মানুষও বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে বেঁচে থাকার জন্য সহযোগিতা বলে কিছু নেই। যদি তাই হয় তবে একতা,বন্ধুত্ব,সহযোগিতা,ভালোবাসা যা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান তাকে কি বলব? তখন তারা বলেন,ভুল করেছেন,প্রতিযোগিতাকে আপনারা সহযোগিতা বলে মনে করেছেন।এই সহযোগিতা,ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের অন্তরালেও প্রতিযোগিতা ও সংগ্রাম লুকিয়ে রয়েছে। কিরূপে? জবাব দেন,প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনে যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতাই মুখ্য,কিন্তু যখন মানুষ তার থেকে বড় কোন শত্রুর মোকাবিলায় দাঁড়ায় তখন বড় শত্রুটি বন্ধুতকে তার উপর চাপিয়ে দেয়। তাই এ বন্ধুত্ব প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্ব নয়,এ হৃদ্যতাও বাহ্যিকতা মাত্র। বড় শত্রুকে মোকাবিলার জন্য এ সহযোগিতার জন্ম ও হৃদ্যতার সৃষ্টি। যখনই এ বড় শত্রুকে দৃশ্য থেকে সড়ানো হবে তখন দেখা যাবে যারা এতক্ষণ বন্ধু ছিল তারাই বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে। যদি পুনরায় একদল নিশ্চিহ্ন হয়,অন্য যে অংশটি বেঁচে থাকবে তারা আবার বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বেও একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার কাজে লিপ্ত হবে। এভাবে যখন শুধু দু ব্যক্তি থাকবে,তৃতীয় কেউ তাদের মোকাবিলায় থাকবে না তখন এরা দু জন একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ মতবাদে বিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো সকল বন্ধুত,হৃদ্যতা,আন্তরিকতা,ভালোবাসা,ঐক্য ও সহযোগিতা শত্রুতা থেকেই সৃষ্টি। তাই তাদের মতে প্রতিযোগিতাই মুখ্য আর সহযোগিতা প্রতিযোগিতারই সৃষ্টি।

দুর্বলতার মতবাদ

যেমনিভাবে অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক মতবাদের বিরোধিতা করেছেন এবং অনেকেই প্রেমের মতবাদকে সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক বলে মনে করেছেন তেমনিভাবে ক্ষমতার মতবাদেরও অনেকে বিরোধিতা করেছেন। কেউ কেউ ক্ষমতাকে বাড়াবাড়ি রকমভাবে সমালোচনা করেছেন এবং মানুষের পূর্ণতাকে প্রকৃতপক্ষে দুর্বল থাকার মধ্যেই মনে করেছেন। তাদের মতে পূর্ণ মানব হলো সে-ই যার কোন ক্ষমতা নেই। যেহেতু যদি ক্ষমতা থাকে তবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সীমালঙ্ঘনের সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ সা দী তার এক কবিতায় এ রকম একটি ভুল করেছেন। তিনি বলেছেন,

আমি সে পিপীলিকা,যে অন্যের পায়ে পদদলিত

হয় নই মৌমাছি যে তার আঘাতে অন্যকে কষ্ট দেয়।

আবার বলেছেন,

কিরূপে করিব আমি এ নেয়ামতের শোকর স্বর্গপতি?

সে শক্তি দাওনি আমায় করিব সৃষ্টির ক্ষতি।

না,জনাব সা দী,এমন নয় যে,মানুষকে হয় পিপীলিকা,না হয় মৌমাছি হতে হবে। ফলে আপনি এ দু য়ের মধ্যে পিপীলিকা হওয়াকে নিজের জন্য বেছে নিবেন। আপনার সেই পিপীলিকা হওয়ারও প্রয়োজন নেই যে অন্যের পায়ের নীচে পিষ্ট হয়,আবার মৌমাছি বা বোলতা হওয়ারও প্রয়োজন নেই যে অন্যকে কষ্ট দেয়। বরং আপনার এটা বলা উচিত,

আমি সে পিপীলিকাও নই,যে অন্যের পায়ে পিষ্ট হয়

নই মৌমাছিও,যে অন্যকে কষ্ট দেয়।

কিরূপে এ নেয়ামতের শোকর করব আমি?

রয়েছে শক্তি তবুও কষ্ট দেই না আমি।

যদি মানুষের শক্তি ও ক্ষমতা থাকে তদুপরি কাউকে কষ্ট না দেয় তখনই শোকরের প্রশ্ন আসে। নতুবা শক্তি না থাকার কারণে কাউকে কষ্ট দেয় না এরূপ হলে শিংবিহীন প্রাণীর মতো যে শিং না থাকার কারণে কাউকে গুঁতা দেয় না। যোগ্যতার প্রমাণ এখানেই যে,শিং থাকার পরও কাউকে গুঁতা দেয় না।

সা দী অন্য এক স্থানে বলেছেন,

দেখেছি এক সন্ন্যাসীকে থাকেন পর্বত চূড়ায়,

সন্তুষ্টির অন্বেষায় দুনিয়া ত্যাগীয়া নিয়েছেন আশ্রয় গুহায়।

জিজ্ঞাসিনু তারে কেন আসেন না মানুষের মাঝে

মানুষের বোঝা লাঘবের মহান কাজে?

এক সাধক যিনি পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেখানে ইবাদতে মশগুল তার প্রশংসায় লিপ্ত হয়েছেন সা দী। (অবশ্য সা দী এ কবিতায় ভাবার্থের বিপরীতধর্মী কথাও অন্যস্থানে বলেছেন। যেমনবলেছেন,

খানকা থেকে এলেন এক বুজুর্গ মাদ্রাসায়,

ভেঙ্গে তার চুক্তি যা ছিল সে পথের পথিকের সাথে।

জিজ্ঞাসিনু তারে কি পার্থক্য রয়েছে আলেম ও আবেদের মাঝে

যে কারণে ছেড়েছেন সে পথ,ধরেছেন এ রথ?

বললেন,যে বাঁচাতে চায় নিজেরে শুধু,উত্তাল সমুদ্রের মাঝে,

সে আবেদ,আর যে অন্যকেও বাঁচাতে চায় তাকেই আলেম বলা সাজে।

তিনি বলছেন,তাকে প্রশ্ন করলাম, কেন আপনি শহরে আসেন না,মানুষের খেদমত করেন না? সাধক তার জবাবে এক অজুহাত পেশ করেন। সা দী এখানেই নীরব হয়ে যান। মনে হয় তিনি সাধকের এ অজুহাতকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। তিনি বলছেন,

বললেন সাধক,সেথায় রয়েছে অপরূপ রূপসিগণ

ভয় পাই,যদি দেখিয়া তাদের রূপ হারাই নিয়ন্ত্রণ।

(যেমনভাবে হাতী কাদাযুক্ত পথে চলতে ভয় পায়)

যেহেতু অপরূপ রূপসীরা সে শহরে বাস করে। তাদের প্রতি দৃষ্টিপাতে আমার স্খলন ঘটতে পারে। যেহেতু নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় আছে তাই এ গুহায় নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছি।

বাহ্! কত সুন্দর এ পূর্ণতা! নিজেকে এক স্থানে বন্দি করে পূর্ণতায় পৌছার পথ খোঁজাকে কি পূর্ণতা বলা যায়? জনাব সা দী কোরআন আপানার জন্য সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছে। এ কাহিনী হযরত ইউসুফ (আ.)-এর। এ কাহিনী কোরআনের ভাষায় তাদের জন্য যারা তাকওয়া (খোদাভীতি) ও ধৈর্য অবলম্বন করে; যেহেতু কোরআন বলছে, নিশ্চয়ই যে তাকওয়া ও ধৈর্য অবলম্বন করে (অবশেষে সে সফলকাম হবে),যেহেতু আল্লাহ্পাক সৎকর্মশীলদের কর্মকে বিফল করেন না। (সূরা ইউসুফ : ৯০)অর্থাৎ কোরআন বলছে,তুমিও ইউসুফের মতো হও। প্রবৃত্তির ক্ষুধা মেটানোর সকল উপায়-উপকরণ প্রস্তত ছিল,এমনকি পালানোর পথও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তদুপরি তিনি নিজের পবিত্রতাকে রক্ষা করেছেন। মহান আল্লাহ্ তার জন্য বন্ধ দুয়ারগুলোও খুলে দিয়েছেন। যেহেতু হযরত ইউসুফ (আ.)অবিবাহিত এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে ছিলেন অপূর্ব,সেহেতু তিনি নারীদের পেছনে নন,বরং নারীরাই তার পেছনে ছুটত। এমন দিন তার জন্য অতিবাহিত হতো না যে,কোন নারী তাকে পত্র দেয়নি বা তার খোঁজে আসেনি। তাও যেমন তেমন নারী নয়,বরং মিশরের শ্রেষ্ঠ ও কূলনারীরা তার জন্য চরমভাবে আসক্ত ছিল। স্বয়ং মিশরের অধিপতির স্ত্রী জুলাইখা তার প্রেমে বিভোর। তাকে পাওয়ার জন্য সব উপকরণ প্রস্তত করেছে। তার জন্য মরণ ফাঁদ পেতেছে- হয় তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত করতে হবে,নতুবা তাকে হত্যা করা হবে। কিন্তু হযরত ইউসুফ কি করলেন? আল্লাহর প্রতি হাত উঠিয়ে বললেন, হে পরওয়ারদিগার! যে বস্তুর প্রতি এরা আমাকে আহবান করছে তার থেকে জেলখানায় বন্দিত্ববরণকে আমি অধিক পছন্দ করি। (সূরা ইউসুফ : ৩৩)

অর্থাৎ এ স্ত্রীলোকদের ইচ্ছা পূরণ করার চেয়ে আমাকে বন্দিত্ব বরণের সুযোগ দিন যাতে করে এদের হাত থেকে রক্ষা পাই। যদিও আমার এ অপরাধ করার সামর্থ্য ও সুযোগ রয়েছে তদুপরি তা আমি করব না।

সুতরাং মানুষের পূর্ণতা তাদের দুর্বলতার মধ্যে নয়। যদিও আমাদের সাহিত্যে কখনো কখনো কেউ দুর্বলতাকে মানুষের পূর্ণতা মনে করেছেন। অন্য এক কবি বাবা তাহেরও এ রকম বলেছেন,

আমার এ চোখ ও অন্তর হতে আমি বাঁচতে চাই,

যা কিছু দেখে এ চোখ,অন্তর স্মরণ করে তা-ই।

এ পর্যন্ত কথা ঠিকই আছে,কিন্তু এরপর বলছেন,

বানাব এক তরবারী যা লৌহ কঠিন শক্ত

হানব আঘাত এ চক্ষুতে অন্তর হবে মুক্ত।

অর্থাৎ যা কিছুই চক্ষু দেখে অন্তর তা পেতে চায়। তাই অন্তরকে মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য এক তরবারী চাই যা দিয়ে এ চক্ষুকে অন্ধ করে দিব যাতে অন্তর কিছু না চাইতে পারে। যদি এমনই হয় তবে এমন অনেক অনেক কিছু আছে যা কর্ণ শুনে ও অন্তর পেতে চায় তাই কর্ণের মধ্যেও এক তরবারী প্রবেশ করান। আর পুরোদমে মুক্তি পেতে চাইলে খোজাও হতে হবে যাতে জৈবিক চাহিদার কথাও মনে না হয়। শেষ পর্যন্ত মাওলানা রুমীর মাসনভীর মাথা,পেট ও লেজবিহীন সিংহের গল্পের মতো হবে। বাবা তাহের অদ্ভুত এক ইনসানে কামেল তৈরি করেছেন। এই ইনসানে কামেলের না হাত আছে,না পা আছে,না চোখ,কান বা অন্য কিছু।

এ ধরনের দুর্বল চারিত্রিক প্রশিক্ষণের নির্দেশনা আমাদের সাহিত্যে প্রায়ই দেখা যায়। তাই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে মানুষ সব সময়ই ভুল করে। কখনো অতিরিক্ত,কখনো পরিহার তার জীবনে লক্ষণীয়। ইসলামে যেহেতু ত্রুটি নেই তাই বোঝা যায়,এটা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোথাও থেকে আসেনি। যদি মানুষ সক্রেটিস হয় তাহলে মূল্যবোধগুলোর হয়তো একটি দিক ধরে থাকেন ও ভুল করেন,প্লেটো হলে অন্য একটি দিক ধরে থাকেন ও ভুল করেন। তেমনিভাবে ইবনে সিনা একদিক,মহিউদ্দিন আরাবী ও মাওলানা রুমী অন্যদিক ধরে থাকেন। কার্ল মার্কস,জাপসে সারটার সকলেই এরূপ একদিক ধরে বসে রয়েছেন। তাই এঁদের পক্ষে কিরূপে সম্ভব মানুষের পথ প্রদর্শক হওয়া? নবীয়ানী ও মতাদর্শ তো সর্বজনীন,সর্বব্যাপী ও পূর্ণ হতে হবে। তাই প্রকৃতপক্ষে এ সকল ব্যক্তি যেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে একদল ছাত্র- নিজেদের চিন্তা-ভাবনা থেকে কিছু বলেছে। অবশেষে বিজ্ঞ শিক্ষকের কথা শুনলে বোঝা যাবে শিক্ষকের কথা তাদের থেকে কত উন্নত ও উত্তম!

প্রেম ও ভালবাসার মতাদর্শ (আত্মপরিচিতির মতবাদ)

পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্য আরেকটি মতবাদ যাকে প্রেম ও ভালবাসার মতবাদও বলা যায়। কয়েক হাজার বছর পূর্বে পূর্ব-এশিয়ায় চিন্তা ও জ্ঞানের উচ্চ পর্যায়ের চর্চা ছিল। অনেক পুরাতন ভারতীয় গ্রন্থ (ফার্সী ভাষায়ও অনুবাদ হয়েছে) যেমন উপনিষদ এ ধরনের উচ্চ মার্গের গ্রন্থ।

আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আল্লামা তাবাতাবায়ী কয়েক বছর পূর্বে যখন প্রথম উপনিষদ পড়েছিলেন তখন মন্তব্য করতেন,প্রচুর মূল্যবান কথা এ গ্রন্থে আছে,কিন্তু কমই এ গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।

এ মতাদর্শে মানুষের পূর্ণতার কেন্দ্রবিন্দু হলো আত্মপরিচয়। এ মতাদর্শ বলে, নিজেকে জান । অবশ্যই নিজেকে জান- এটা সক্রেটিসও বলেছেন,সকল নবীও বলেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে তার প্রতিপালককে চিনতে পেরেছে। কিন্তু এ মতাদর্শে যে বিষয়ের প্রতিই কেবল দৃষ্টি দেয়া হয়েছে তা হলো আত্মপরিচয়।

মহাত্মা গান্ধীর লেখা কিছু প্রবন্ধ ও পত্র এটাই আমার ধর্ম শিরোনামে ফার্সীতে গ্রন্থাকারে ছাপানো হয়েছে। এ অনুবাদ গ্রন্থটি আমার মতে বেশ ভালো। গান্ধী এ গ্রন্থে বলেছেন, আমি উপনিষদগুলো পড়ে তিনটি মৌলিক বিষয় পেয়েছি যা আমার সারা জীবনের দিক-নির্দেশনা হিসেবে রয়েছে। প্রথম মৌল বিষয় যা গান্ধী উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে পৃথিবীতে শুধু একটি সত্য রয়েছে,তা হলো নিজেকে চেনা ও জানা। নিজেকে জান এ বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই গান্ধী সুন্দরভাবে পাশ্চাত্যের উপর হামলা করেছেন। তিনি বলেছেন, পাশ্চাত্য বিশ্বকে জেনেছে,কিন্তু নিজেকে চিনেনি। যেহেতু নিজেকে চিনেনি তাই নিজেও যেমন দুর্ভাগা হয়েছে বিশ্বকেও দুর্ভাগ্যে নিপতিত করেছে। তার এ কথা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ও খুবই সুন্দর।

দ্বিতীয় মৌল বিষয় : যে নিজেকে চিনতে পেরেছে সে স্রষ্টাকেও চিনতে পেরেছে। সে সুবাদে সব কিছুকেই চিনতে পেরেছে।

তৃতীয় মৌল বিষয় : শুধু একটি শক্তিরই অস্তিত্ব রয়েছে আর তা হলো নিজের উপর পূর্ণ আধিপত্যও নিয়ন্ত্রণ। যে কেউ নিজের অধিপতি হবে অন্য সকল কিছুর উপরও আধিপত্য লাভ করবে। বিশ্বে একটি পুণ্য কাজ রয়েছে। আর তা হলো ভালোবাসা,অন্যদেরকে ভালোবাসা যেমনভাবে মানুষ নিজেকে ভালোবাসে। অন্যভাবে বললে অন্যদেরকেও নিজের মত করে দেখতে হবে।

তাদের ভাষায় পরিচিতি অর্থ আত্মপরিচয়। নিশ্চয়ই জানেন,হিন্দু দর্শনে মোরাকাবা বা আত্মনিয়ন্ত্রণ,নিজের মধ্যে নিমজ্জিত হওয়ার বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে (যদিও এখন এই আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে যোগীদের কঠিন অনুশীলন ও অন্যান্য বিষয় যোগ হয়েছে সেগুলো আমার উদ্দেশ্য নয়)। হিন্দু দর্শনের মূলে আত্মপরিচয়,আত্মনিয়ন্ত্রণ,নিজেকে উদ্ঘাটনের মাধ্যমে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।

সুতরাং এ মতবাদের মতে পূর্ণ মানব হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে চিনেছে। যখন সে নিজেকে চিনবে তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে। আর যখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে তখন অন্যদেরকে ভালোবাসতে শুরু করবে। এখন এ মতবাদকে আমরা আত্মপরিচিতির মতবাদও বলতে পারি,আবার প্রেম ও ভালবাসার মতবাদও বলতে পারি।

পূর্ণ মানব সম্পর্কিত অন্য দু টি মতবাদ

গত দু তিন শতাব্দীতে বেশ কিছু মতাদর্শের জন্ম হয়েছে যারা মূলত সামাজিকতার দিকটিকে প্রাধান্য দান করেছেন। অর্থাৎ তাদের এ প্রবণতা ব্যক্তির থেকে সমাজের দিকে বেশি। তাদের এক দল মনে করেন পূর্ণ মানব হলো শ্রেণীহীন মানুষ। যদি কোন মানুষ এক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়,বিশেষ করে আধুনিক ও উচ্চশ্রেণীর,তবে সে মানুষ ত্রুটিযুক্ত মানুষ। শ্রেণীকেন্দ্রিক সমাজে সঠিক ও ত্রুটিহীন মানুষ জন্মগ্রহণ করতে পারে না। এ মতাদর্শ আদর্শিক পূর্ণ মানবে বিশ্বাসী নয়,যেহেতু মানুষের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কোন মর্যাদা আছে বলে মনে করে না। এ মতবাদের দৃষ্টিতে পূর্ণ মানব সে যে শ্রেণীহীন সমাজে অন্যান্য মানুষের সমপর্যায়ে জীবন যাপন করে।

অন্য আরেকটি দল বিশেষত মানুষের সচেতনতা ও স্বাধীনতার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেন। সচেতনতা বলতে তারা সামাজিক সচেতনতাকেই বুঝান। অস্তিত্ববাদীরা মূলত স্বীধীনতা,সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধকে মানুষের মূল বলে মনে করেন। এঁদের মতে পূর্ণ মানব হলো যে মানুষ স্বাধীন,সচেতন,দায়িত্ববান ও প্রতিশ্রুতবদ্ধ। তাদের স্বাধীনতার অর্থও দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও বিদ্রোহ বৈ কিছু নয়।

সুবিধা ও অধিকারের মতবাদ

অন্য একটি মতবাদ যা ক্ষমতার মতবাদের কাছাকাছি তা হলো অধিকারের মতবাদ। তারা বলেন, ইনসানে কামেলকে প্রজ্ঞাবান হতে হবে , তাকে স্রষ্টায় পৌছতে হবে - এ ধরনের কথাগুলো অর্থহীন। প্রকৃতপক্ষে যদি পূর্ণ মানুষ হতে চাও তবে চেষ্টা কর কোন কিছুর অধিকারী হতে,সৃষ্টির যত বেশি বস্তুর অধিকারী হতে পার তত বেশি পূর্ণতা লাভ করেছ অর্থাৎ ইনসানে কামেল সব কিছুর অধিকারী। এ কারণে তারা মানুষের পূর্ণতাকে প্রজ্ঞায় না দেখে জ্ঞান বা বিজ্ঞানে দেখেন। জ্ঞান বলতে তারা বলেন,জ্ঞান হলো প্রকৃতিকে জানা এ উদ্দেশ্যে যে,এর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা ও মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারের লক্ষ্যে তা থেকে সকল সুবিধা ভোগ করা। তাদের এ কথার শেষ অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞানের মূল্য মানুষের নিকট একটা মাধ্যমের মতো এবং প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের সত্তাগত কোন মূল্য নেই। জ্ঞান এজন্য মূল্যবান যে,এর মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে ও প্রকৃতি মানুষের নিয়ন্ত্রণে আসে। আর যখন প্রকৃতি তার নিয়ন্ত্রণে আসে তখন সে প্রকৃতিকে ভালোভাবে ব্যবহার ও তার থেকে লাভবান হতে পারে। তাই যদি চাও মানুষকে পূর্ণতায় পৌছাতে তবে প্রকৃতি থেকে অধিকতর সুবিধা গ্রহণের জন্য চেষ্টা চালাও। জ্ঞানকেও এজন্য ব্যবহার কর। জ্ঞান তাদের নিকট একটি মাধ্যম ছাড়া কিছু নয়। যেমন ভাবে শিং গরুর জন্য প্রতিরক্ষার,সিংহের জন্য দাঁত আক্রমণের তেমনিভাবে জ্ঞানও মানুষের জন্য প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের একটি উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।

এতক্ষণ যে বিষয়গুলো আমরা আলোচনা করলাম এ মতবাদগুলোর পর্যালোচনার পর আমরা এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করে ব্যাখ্যা করব। ইসলাম বুদ্ধিবৃত্তিকে কতটা মূল্য দেয়,প্রেমও ভালোবাসাকে ইসলাম কতটা প্রাধান্য দেয়,সে সাথে ক্ষমতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ ও শ্রেণীহীন সমাজের মূল্য ইসলামের নিকট কিরূপ?


11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27