সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন
)
قُلْ
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا
وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّـهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ
شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِّن دُونِ
اللَّـهِ
(
ইনসানে কামেল সম্পর্কিত অপর একটি মতবাদ হলো সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র। এ মতবাদে মানুষের পূর্ণতা ও অপূর্ণতা দু’
টি বস্তুতে বিশ্বাস করা হয়। মানুষের অপূর্ণতা মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে আর তার পূর্ণতা সমাজ বা সামষ্টিকতার মধ্যে এ অর্থে যে,যতক্ষণ মানুষ আমিত্বের ধারণায় থাকবে ততক্ষণ অপূর্ণ (অবশ্য এরফান যে আমিত্ব বলে তা থেকে এটা আলাদা) আর আমিত্বের ধারণার বিলুপ্তির মাধ্যমে তার পূর্ণতা অর্জিত হবে।
এরফানী ধারণায় আমিত্বকে তার জন্য ধ্বংস কর অর্থাৎ ব্যক্তির প্রথম ও নিজসত্তা হিসেবে আমিত্বের বিলুপ্তি ঘটলে তৃতীয় সত্তা যিনি হলেন মহান আল্লাহ্পাক তিনি সে স্থান দখল করবেন। তার মধ্যে আমার বিলুপ্তি অর্থ আল্লাহর মধ্যে মানুষের বিলুপ্তি।
এরফানী মতবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের এ ক্ষেত্রে মিল রয়েছে যে,এ দু’
মতবাদই আমিত্বের অবসান চায়,তবে সমাজতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি চায় তৃতীয় সত্তার প্রতিস্থাপনের জন্য নয় বরং সেখানে‘
সামষ্টিকতা’
বা‘
আমরা’
কে স্থান দেয়ার জন্য। এদের মতে পূর্ণ মানব আরেফ নয় যে বলবে,আমার আলখাল্লার নীচে খোদা ব্যতীত অন্য কেউ নেই বরং আমরায় বা সামষ্টিক সত্তায় বিলুপ্ত আমিই হলো পূর্ণ মানব। সে পূর্ণ মানব আমিত্বকে অনুভব করে না,করে আমরাকে।
এ পর্যন্ত এ মতবাদ যা বলে,অন্যান্য অনেক মতবাদই তা গ্রহণ করে। এমনকি যে সকল মতবাদ তৃতীয় সত্তার জন্য প্রথম সত্তাকে বিলুপ্ত করার পক্ষপাতী তারাও এ বিষয়টির বিরোধী নয়। তারাও চায়‘
আমি’
বিলুপ্ত হয়ে‘
আমরা’
য় পরিণত হোক।
এ মতবাদের সারকথা
এ মতবাদ‘
আমি’
কে‘
আমরা’
য় রূপান্তরিত করার পথও বাতলে দিয়ে বলেছে,কোন বস্তু আমার নাহয়ে আমাদের হওয়া অর্থাৎ মালিকানা বিলুপ্ত হয়ে সামষ্টিক মালিকানায় রূপান্তরই এ পূর্ণতার পথ। আপনি যদি সম্পদের স্বত্বাধিকারের বিষয়টি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন তা দু’
ধরনের : এক ধরনের বিষয় রয়েছে যা আমাদের সমাজে আমাদের সকলের সম্পদ,যেমন ইরানীদের জন্য ফার্সী ভাষা- যা আমার-আপনার কারোরই ব্যক্তি মালিকানার বিষয় নয় বরং এটা সকল ফার্সী ভাষাভাষির সম্পদ। দেশ বা রাষ্ট্রও তেমনি কোন ব্যক্তির সম্পদ নয় বরং ঐ রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সম্মিলিত সম্পদ। যা কিছুরই সামষ্টিক মালিকানা রয়েছে তা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। স্বদেশী,স্বভাষী,এক সংস্কৃতি,এক ধর্ম এরূপ বিষয়সমূহ ব্যক্তি মালিকানার বিষয় না হওয়ায় এগুলো সাধারণভাবে‘
আমাদের’
ধারণার জন্ম দেয়।
অন্যদিকে কিছু বস্তু বা বিষয় রয়েছে যেগুলো ব্যক্তিগত ও বিশেষ সত্ত্বাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-আমার বাড়ি,আমার অর্থ,আমার পোশাক,আমার কার্পেট,আমার গাড়ী। আমার বাড়ি আমারই,অন্য কারো নয়। আমার অর্থ-সম্পদও আমার,অন্য কারো অধিকার সেখানে নেই। এরূপ মালিকানার বিষয় যা বিশেষ ব্যক্তির স্বত্বাধিকারের অন্তর্ভুক্ত সেটা সাধারণ নয়। বলা হয়ে থাকে,যে সকল বিষয় ব্যক্তিসত্তা ও মালিকানার জন্ম দেয় সেগুলো আমিত্বের সৃষ্টি করে। ব্যক্তি মালিকানা ও সত্বাধিকার হতে‘
আমাদের’
ধারণা সৃষ্টি হয়। সুতরাং মানুষের পূর্ণতার মানদণ্ড হলো‘
আমরা’
ও‘
আমাদের’
হওয়া। আর‘
আমাদের’
হওয়ার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি মালিকানা ও সত্তাকে বিলীন করে সামাজিক ও সামষ্টিকতাকে (সামষ্টিক মালিকানা) প্রতিষ্ঠা করা।
তাদের দাবি মানুষ যখন প্রথম সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করা শুরু করে তখন মানবসমাজ সামষ্টিক সমাজ ছিল,কোন ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। আমার জমি,তোমার জমি,আমার সম্পদ,তোমার সম্পদ এগুলোও ছিল না। সব কিছুর উপর সামষ্টিক মালিকানা ছিল এবং মানুষ সে সমাজে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করত। আমাদের ধর্মে যেমন এসেছে যে,আমাদের আদি পিতা-মাতা এক বেহেশতে বাস করতেন,অতঃপর অপরাধ করার কারণে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হন এবং মাটির এ পৃথিবীতে কঠিন জীবনের সম্মুখীন হন। এ মতবাদের প্রবক্তাদের বর্ণনাও আমরা এ ঘটনার অনুরূপে ব্যাখ্যা করতে পারি। মানব জাতি সৃষ্টির আদিতে সামষ্টিক মালিকানার স্বর্গীয় সমাজে বাস করত। পরবর্তীতে এক অপরাধ করে সেই স্বর্গ হতে বহিষ্কৃত হন। সেই অপরাধ হলো ব্যক্তি মালিকানার জন্মদান এবং‘
আমাদের’
স্থানে‘
আমার’
চিন্তার উৎপত্তি। যখন মানব সমাজে ব্যক্তি মালিকানার সৃষ্টি হলো তখন মানুষ সৌভাগ্য বঞ্চিত হয়ে কঠিন পরিবেশের সম্মুখীন হয়ে দুর্ভাগ্যগ্রস্ত হয়ে পড়ল এবং এখনও সে এ বোঝা বহন করছে। এখন মানুষকে তওবা করতে হবে যাতে করে পূর্ণতার সেই স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং সে তওবা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানা হতে অনুশোচনা করে ফিরে আসা। যখনই মানুষসামগ্রিকভাবে ব্যক্তি মালিকানা ও সত্বাধিকার হতে তওবা করবে ও সামষ্টিক মালিকানাকে গ্রহণ করবে তখনই মানুষ তার পূর্ণতায় পৌছবে।
বলা হয়ে থাকে,ব্যক্তি মালিকানা হতেই জুলমের সৃষ্টি হয়। তাই ব্যক্তি মালিকানা হতেই শোষক ও শোষিতের জন্ম হয়েছে। মানুষ যতক্ষণ শোষক অথবা শোষিত থাকবে ততক্ষণ অপূর্ণ। শোষক ও শোষিতের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য যাদের একদল সম্পদ পুঞ্জিভূত করে দামাভান্দ পর্বতের মত উঁচু করেছে এবং অপরদল সম্পদহীনতার গভীর গহ্বরে নিপতিত হয়েছে। যতক্ষণ এ অবস্থা বিরাজ করবে মানবসমাজ সৌভাগ্যের মুখ দেখতে পারবে না। সমাজ তখনই সৌভাগ্যের মুখ দেখতে পারবে যখন পাহাড় ও গহ্বর সমতল ভূমিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি হবে এবং তখনই মানুষ পূর্ণতায় পৌছবে। সুতরাং এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতা ব্যক্তি মালিকানা ও এর ফলে উদ্ভূত শোষক ও শোষিত শ্রেণীর বিলুপ্তির মধ্যে নিহিত বলে মনে করে। শোষণ যেমন শোষিতের মধ্যে হিংসা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয় তেমনি শোষকের মধ্যে সৃষ্টি করে লোভ ও সম্পদলিপ্সা। যখন এই শোষণের মূল‘
ব্যক্তি-মালিকানা’
র অবসান ঘটবে তখনই মানুষের পূর্ণতা ঘটবে।
এ মতবাদের মৌল ত্রুটি
‘
আমি’
পরিবর্তিত হয়ে‘
আমরা’
য় রূপান্তর অর্থাৎ আমিত্ব বলে সমাজে কিছু থাকবে না- এ ধারণা সমাজতন্ত্রের একার কথা নয়। যে পথ সমাজতন্ত্র দেখায় এবং এরই নিজস্ব তা হচ্ছে‘
আমিত্ব’
-এর জন্মদানকারী হলো ব্যক্তি-মালিকানা এবং‘
আমাদের’
ধারণার জন্মদাতা হলো সামষ্টিক মালিকানা।
কেউ সমাজতন্ত্রের এ চিন্তার উত্তর দিতে চাইলে এভাবে তা দিতে পারেন- তিনি বলতে পারেন,‘
জনাব সমাজতান্ত্রিক! বস্তুর উপর ব্যক্তির মালিকানা আমিত্বের জন্ম দেয়,নাকি বস্তুর প্রতি মানুষের আসক্তি অর্থাৎ যখন বস্তুই মানুষের সর্বস্বে পরিণত হয়? বস্তুর উপর ব্যক্তির মালিকানা অর্থাৎ মানুষ মালিক এবং বস্তু তার অধীন হলে আমিত্বের সৃষ্টি করে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয় ও ঐক্য বিনষ্ট করে নাকি এর উল্টোটা? মানুষের মালিকানা ও স্বত্বাধিকার এর জন্য দায়ী নয় বরং এর বিপরীতে বস্তু যখন মালিক এবং মানুষ তার অধীন হয় তখন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরফানের পরিভাষায় মানুষ যখন বস্তুর আসক্ত হয়ে পড়ে তখনই আমিত্বের সৃষ্টি হয়। অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়া আমিত্বের জন্ম দেয় না,বরং অর্থ ও সম্পদের দাস হলেই মানুষের মধ্যে আমিত্বের সৃষ্টি হয় ও‘
আমাদের’
ধারণার বিলুপ্তি ঘটে।
এ মতবাদের মতে ব্যক্তি-মালিকানাকে বিলুপ্ত করলে‘
আমিত্ব’
পরিবর্তিত হয়ে আমাদের হয়ে যাবে। বিপরীতপক্ষে আমাদের মতবাদে (ইসলামে) এ কথা বলে না যে,ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্ত কর বরং বলে প্রকৃত মানুষ তৈরি কর,মানুষকে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ দান কর,তাকে সর্বোত্তম আদর্শ শিক্ষা দাও যাতে করে সম্পদ ও বস্তুর অধিকারী হলেও বস্তুর প্রতি তার আসক্তি থাকবে না,সে বস্তুর দাস হবে না,বরং স্বাধীন হবে। কোন্ মানুষটি আমাদের ধারণা পোষণ করে? যে মানুষের কোন কিছু নেই সে,নাকি যে মানুষ আত্মিক স্বাধীনতার অধিকারী? এটা কখনই ঠিক নয়,যে ব্যক্তির কিছু নেই সে-ই আমাদের ধারণার অধিকারী। মানুষ তখনই আমাদের ধারণার অধিকারী হবে যখন তার বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকবে না,বস্তু তাকে নিজের অধীন করবে না এবং কখনও করে না। এরূপ ব্যক্তিরই‘
আমিত্ব’
নেই; রয়েছে‘
আমাদের’
ধারণা। এখানে দু’
টি উদাহরণ দেয়া হয়। বলা হয় যে,আমরা সব সময় একদল মানুষকে দেখি যারা বস্তুর মালিক হয়েও বিশেষ প্রশিক্ষণের কারণে বস্তুর দাস,অধীন ও বন্দি নয়। যুহদ বা দুনিয়া বিমুখতার প্রকৃত অর্থ এটাই যা হযরত আলী নাহজুল বালাগায় বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ দুনিয়ার দাস না হয়ে স্বাধীনভাবে বাচা। অপরপক্ষে একদল লোক রয়েছে যাদের তেমন কোন সম্পদই নেই,অথচ ঐ সম্পদকে আঁকড়ে থাকে ও তারই দাস ও সেবক হিসেবে সে নিয়োজিত। এদের‘
আমিত্ব’
‘
আমাদের’
চিন্তায় পরিণত হয়নি।