ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল 0%

ইনসানে কামেল লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

ইনসানে কামেল

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: -
বিভাগ:

ভিজিট: 41091
ডাউনলোড: 6659

পাঠকের মতামত:

ইনসানে কামেল
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 83 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 41091 / ডাউনলোড: 6659
সাইজ সাইজ সাইজ
ইনসানে কামেল

ইনসানে কামেল

লেখক:
প্রকাশক: -
বাংলা

সমাজতান্ত্রিক মতবাদের পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন

) قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّـهَ وَلَا نُشْرِ‌كَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْ‌بَابًا مِّن دُونِ اللَّـهِ (

ইনসানে কামেল সম্পর্কিত অপর একটি মতবাদ হলো সোশ্যালিজম বা সমাজতন্ত্র। এ মতবাদে মানুষের পূর্ণতা ও অপূর্ণতা দু টি বস্তুতে বিশ্বাস করা হয়। মানুষের অপূর্ণতা মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে আর তার পূর্ণতা সমাজ বা সামষ্টিকতার মধ্যে এ অর্থে যে,যতক্ষণ মানুষ আমিত্বের ধারণায় থাকবে ততক্ষণ অপূর্ণ (অবশ্য এরফান যে আমিত্ব বলে তা থেকে এটা আলাদা) আর আমিত্বের ধারণার বিলুপ্তির মাধ্যমে তার পূর্ণতা অর্জিত হবে।

এরফানী ধারণায় আমিত্বকে তার জন্য ধ্বংস কর অর্থাৎ ব্যক্তির প্রথম ও নিজসত্তা হিসেবে আমিত্বের বিলুপ্তি ঘটলে তৃতীয় সত্তা যিনি হলেন মহান আল্লাহ্পাক তিনি সে স্থান দখল করবেন। তার মধ্যে আমার বিলুপ্তি অর্থ আল্লাহর মধ্যে মানুষের বিলুপ্তি।

এরফানী মতবাদের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের এ ক্ষেত্রে মিল রয়েছে যে,এ দু মতবাদই আমিত্বের অবসান চায়,তবে সমাজতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি চায় তৃতীয় সত্তার প্রতিস্থাপনের জন্য নয় বরং সেখানে সামষ্টিকতা বা আমরা কে স্থান দেয়ার জন্য। এদের মতে পূর্ণ মানব আরেফ নয় যে বলবে,আমার আলখাল্লার নীচে খোদা ব্যতীত অন্য কেউ নেই বরং আমরায় বা সামষ্টিক সত্তায় বিলুপ্ত আমিই হলো পূর্ণ মানব। সে পূর্ণ মানব আমিত্বকে অনুভব করে না,করে আমরাকে।

এ পর্যন্ত এ মতবাদ যা বলে,অন্যান্য অনেক মতবাদই তা গ্রহণ করে। এমনকি যে সকল মতবাদ তৃতীয় সত্তার জন্য প্রথম সত্তাকে বিলুপ্ত করার পক্ষপাতী তারাও এ বিষয়টির বিরোধী নয়। তারাও চায় আমি বিলুপ্ত হয়ে আমরা য় পরিণত হোক।

এ মতবাদের সারকথা

এ মতবাদ আমি কে আমরা য় রূপান্তরিত করার পথও বাতলে দিয়ে বলেছে,কোন বস্তু আমার নাহয়ে আমাদের হওয়া অর্থাৎ মালিকানা বিলুপ্ত হয়ে সামষ্টিক মালিকানায় রূপান্তরই এ পূর্ণতার পথ। আপনি যদি সম্পদের স্বত্বাধিকারের বিষয়টি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন তা দু ধরনের : এক ধরনের বিষয় রয়েছে যা আমাদের সমাজে আমাদের সকলের সম্পদ,যেমন ইরানীদের জন্য ফার্সী ভাষা- যা আমার-আপনার কারোরই ব্যক্তি মালিকানার বিষয় নয় বরং এটা সকল ফার্সী ভাষাভাষির সম্পদ। দেশ বা রাষ্ট্রও তেমনি কোন ব্যক্তির সম্পদ নয় বরং ঐ রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সম্মিলিত সম্পদ। যা কিছুরই সামষ্টিক মালিকানা রয়েছে তা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে। স্বদেশী,স্বভাষী,এক সংস্কৃতি,এক ধর্ম এরূপ বিষয়সমূহ ব্যক্তি মালিকানার বিষয় না হওয়ায় এগুলো সাধারণভাবে আমাদের ধারণার জন্ম দেয়।

অন্যদিকে কিছু বস্তু বা বিষয় রয়েছে যেগুলো ব্যক্তিগত ও বিশেষ সত্ত্বাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন-আমার বাড়ি,আমার অর্থ,আমার পোশাক,আমার কার্পেট,আমার গাড়ী। আমার বাড়ি আমারই,অন্য কারো নয়। আমার অর্থ-সম্পদও আমার,অন্য কারো অধিকার সেখানে নেই। এরূপ মালিকানার বিষয় যা বিশেষ ব্যক্তির স্বত্বাধিকারের অন্তর্ভুক্ত সেটা সাধারণ নয়। বলা হয়ে থাকে,যে সকল বিষয় ব্যক্তিসত্তা ও মালিকানার জন্ম দেয় সেগুলো আমিত্বের সৃষ্টি করে। ব্যক্তি মালিকানা ও সত্বাধিকার হতে আমাদের ধারণা সৃষ্টি হয়। সুতরাং মানুষের পূর্ণতার মানদণ্ড হলো আমরা আমাদের হওয়া। আর আমাদের হওয়ার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি মালিকানা ও সত্তাকে বিলীন করে সামাজিক ও সামষ্টিকতাকে (সামষ্টিক মালিকানা) প্রতিষ্ঠা করা।

তাদের দাবি মানুষ যখন প্রথম সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করা শুরু করে তখন মানবসমাজ সামষ্টিক সমাজ ছিল,কোন ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। আমার জমি,তোমার জমি,আমার সম্পদ,তোমার সম্পদ এগুলোও ছিল না। সব কিছুর উপর সামষ্টিক মালিকানা ছিল এবং মানুষ সে সমাজে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করত। আমাদের ধর্মে যেমন এসেছে যে,আমাদের আদি পিতা-মাতা এক বেহেশতে বাস করতেন,অতঃপর অপরাধ করার কারণে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হন এবং মাটির এ পৃথিবীতে কঠিন জীবনের সম্মুখীন হন। এ মতবাদের প্রবক্তাদের বর্ণনাও আমরা এ ঘটনার অনুরূপে ব্যাখ্যা করতে পারি। মানব জাতি সৃষ্টির আদিতে সামষ্টিক মালিকানার স্বর্গীয় সমাজে বাস করত। পরবর্তীতে এক অপরাধ করে সেই স্বর্গ হতে বহিষ্কৃত হন। সেই অপরাধ হলো ব্যক্তি মালিকানার জন্মদান এবং আমাদের স্থানে আমার চিন্তার উৎপত্তি। যখন মানব সমাজে ব্যক্তি মালিকানার সৃষ্টি হলো তখন মানুষ সৌভাগ্য বঞ্চিত হয়ে কঠিন পরিবেশের সম্মুখীন হয়ে দুর্ভাগ্যগ্রস্ত হয়ে পড়ল এবং এখনও সে এ বোঝা বহন করছে। এখন মানুষকে তওবা করতে হবে যাতে করে পূর্ণতার সেই স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং সে তওবা হচ্ছে ব্যক্তি মালিকানা হতে অনুশোচনা করে ফিরে আসা। যখনই মানুষসামগ্রিকভাবে ব্যক্তি মালিকানা ও সত্বাধিকার হতে তওবা করবে ও সামষ্টিক মালিকানাকে গ্রহণ করবে তখনই মানুষ তার পূর্ণতায় পৌছবে।

বলা হয়ে থাকে,ব্যক্তি মালিকানা হতেই জুলমের সৃষ্টি হয়। তাই ব্যক্তি মালিকানা হতেই শোষক ও শোষিতের জন্ম হয়েছে। মানুষ যতক্ষণ শোষক অথবা শোষিত থাকবে ততক্ষণ অপূর্ণ। শোষক ও শোষিতের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য যাদের একদল সম্পদ পুঞ্জিভূত করে দামাভান্দ পর্বতের মত উঁচু করেছে এবং অপরদল সম্পদহীনতার গভীর গহ্বরে নিপতিত হয়েছে। যতক্ষণ এ অবস্থা বিরাজ করবে মানবসমাজ সৌভাগ্যের মুখ দেখতে পারবে না। সমাজ তখনই সৌভাগ্যের মুখ দেখতে পারবে যখন পাহাড় ও গহ্বর সমতল ভূমিতে পরিণত হবে। অর্থাৎ সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি হবে এবং তখনই মানুষ পূর্ণতায় পৌছবে। সুতরাং এ মতবাদ মানুষের পূর্ণতা ব্যক্তি মালিকানা ও এর ফলে উদ্ভূত শোষক ও শোষিত শ্রেণীর বিলুপ্তির মধ্যে নিহিত বলে মনে করে। শোষণ যেমন শোষিতের মধ্যে হিংসা ও বিদ্বেষের জন্ম দেয় তেমনি শোষকের মধ্যে সৃষ্টি করে লোভ ও সম্পদলিপ্সা। যখন এই শোষণের মূল ব্যক্তি-মালিকানা র অবসান ঘটবে তখনই মানুষের পূর্ণতা ঘটবে।

এ মতবাদের মৌল ত্রুটি

আমি পরিবর্তিত হয়ে আমরা য় রূপান্তর অর্থাৎ আমিত্ব বলে সমাজে কিছু থাকবে না- এ ধারণা সমাজতন্ত্রের একার কথা নয়। যে পথ সমাজতন্ত্র দেখায় এবং এরই নিজস্ব তা হচ্ছে আমিত্ব -এর জন্মদানকারী হলো ব্যক্তি-মালিকানা এবং আমাদের ধারণার জন্মদাতা হলো সামষ্টিক মালিকানা।

কেউ সমাজতন্ত্রের এ চিন্তার উত্তর দিতে চাইলে এভাবে তা দিতে পারেন- তিনি বলতে পারেন, জনাব সমাজতান্ত্রিক! বস্তুর উপর ব্যক্তির মালিকানা আমিত্বের জন্ম দেয়,নাকি বস্তুর প্রতি মানুষের আসক্তি অর্থাৎ যখন বস্তুই মানুষের সর্বস্বে পরিণত হয়? বস্তুর উপর ব্যক্তির মালিকানা অর্থাৎ মানুষ মালিক এবং বস্তু তার অধীন হলে আমিত্বের সৃষ্টি করে মানুষের পরস্পরের মধ্যে সীমারেখা টেনে দেয় ও ঐক্য বিনষ্ট করে নাকি এর উল্টোটা? মানুষের মালিকানা ও স্বত্বাধিকার এর জন্য দায়ী নয় বরং এর বিপরীতে বস্তু যখন মালিক এবং মানুষ তার অধীন হয় তখন এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরফানের পরিভাষায় মানুষ যখন বস্তুর আসক্ত হয়ে পড়ে তখনই আমিত্বের সৃষ্টি হয়। অর্থ-সম্পদের অধিকারী হওয়া আমিত্বের জন্ম দেয় না,বরং অর্থ ও সম্পদের দাস হলেই মানুষের মধ্যে আমিত্বের সৃষ্টি হয় ও আমাদের ধারণার বিলুপ্তি ঘটে।

এ মতবাদের মতে ব্যক্তি-মালিকানাকে বিলুপ্ত করলে আমিত্ব পরিবর্তিত হয়ে আমাদের হয়ে যাবে। বিপরীতপক্ষে আমাদের মতবাদে (ইসলামে) এ কথা বলে না যে,ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্ত কর বরং বলে প্রকৃত মানুষ তৈরি কর,মানুষকে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ দান কর,তাকে সর্বোত্তম আদর্শ শিক্ষা দাও যাতে করে সম্পদ ও বস্তুর অধিকারী হলেও বস্তুর প্রতি তার আসক্তি থাকবে না,সে বস্তুর দাস হবে না,বরং স্বাধীন হবে। কোন্ মানুষটি আমাদের ধারণা পোষণ করে? যে মানুষের কোন কিছু নেই সে,নাকি যে মানুষ আত্মিক স্বাধীনতার অধিকারী? এটা কখনই ঠিক নয়,যে ব্যক্তির কিছু নেই সে-ই আমাদের ধারণার অধিকারী। মানুষ তখনই আমাদের ধারণার অধিকারী হবে যখন তার বস্তুর প্রতি আসক্তি থাকবে না,বস্তু তাকে নিজের অধীন করবে না এবং কখনও করে না। এরূপ ব্যক্তিরই আমিত্ব নেই; রয়েছে আমাদের ধারণা। এখানে দু টি উদাহরণ দেয়া হয়। বলা হয় যে,আমরা সব সময় একদল মানুষকে দেখি যারা বস্তুর মালিক হয়েও বিশেষ প্রশিক্ষণের কারণে বস্তুর দাস,অধীন ও বন্দি নয়। যুহদ বা দুনিয়া বিমুখতার প্রকৃত অর্থ এটাই যা হযরত আলী নাহজুল বালাগায় বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ দুনিয়ার দাস না হয়ে স্বাধীনভাবে বাচা। অপরপক্ষে একদল লোক রয়েছে যাদের তেমন কোন সম্পদই নেই,অথচ ঐ সম্পদকে আঁকড়ে থাকে ও তারই দাস ও সেবক হিসেবে সে নিয়োজিত। এদের আমিত্ব আমাদের চিন্তায় পরিণত হয়নি।

আলীর (আ.) দৃষ্টিতে দুনিয়া

আলী দুনিয়াকে লক্ষ্য করে বলছেন, হে দুনিয়া! তোমাকে তিন তালাক দিলাম- যে তিন তালাক ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ নেই। أعزبی عنّی হে দুনিয়া! আমা হতে দূর হও।

فو الله لا أذلّ لک فستذلّینی و لا أسلس لک فتقودینی

আল্লাহর কসম! কখনই তোমার নতি স্বীকার ও তোমার অনুগত হয়ে অপমানিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করব না। (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৫)

আলী সব সময় দুনিয়া ও সম্পদের প্রতি উপেক্ষা ও ঔদ্ধত্য ভাব দেখিয়েছেন। কখনই দুনিয়াকে তার অন্তরে প্রভাব ফেলার কোন সুযোগ দেননি।و لا أسلس لک (أسلس অর্থ এমন উট বা প্রাণী যে এতটা অনুগত যে,একটা বাচ্চাও তাকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম) আমি কখনই তোমাকে সে সুযোগ দেব না যাতে করে আমার মনে প্রভাব ফেলে আমাকে নিয়ন্ত্রণ কর,যে দিক খুশী টেনে নিয়ে যাও। এটাই ইসলামের দুনিয়া বিমুখতা ও দুনিয়ার নেয়ামতের নিকট নিজেকে বিক্রি না করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার নমুনা। অন্যত্র আলী বলেছেন,

الدّنیا دار ممرّ لا دار مقرّ و الناس فیها رجلان رجل باع فیها نفسه فأوبقها و رجل ابتاع نفسه فأعتقها

দুনিয়া অস্থায়ী স্থান,স্থায়ী বাসস্থান নয় (এটা বাজারের মতো)। এখানে দু ধরনের মানুষ রয়েছে :একদল নিজেকে বিক্রী করে ধ্বংস করে অন্যদল নিজেকে কিনে স্বাধীন হয় ও মুক্তি লাভ করে। (নাহজুল বালাগাহ্,হেকমত ১৩৩)

একদিন আলী (আ.) নিজ মালিকানাধীন কিছু দিরহাম বা দিনার নিজের হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে অর্থ! তুমি যতক্ষণ আমার হাতে রয়েছ ততক্ষণ আমার নও। কথাটি আমাদের ধারণা ও কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমরা বলি যতক্ষণ অর্থ আমার পকেটে অথবা হাতে রয়েছে তা আমার,যখন খরচ করে ফেলব তখন আমার থেকে চলে গেল। আলী (আ.) এর বিপরীতে বলছেন, তুমি যতক্ষণ আমার হাতে রয়েছ আমার নও। কারণ ততক্ষণ আমাকে তোমার সেবা করতে হবে ও তোমাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যখন তোমাকে খরচ করে ফেলব তখন তোমার প্রতি কোন দায়িত্ব নেই। তাই তখন তুমি আমার অধীন।

আলী (আ.) একদিন কুফার বাজারে এক কসাইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। কসাই তাকে ডেকে বলল, আজকে খুব ভালো মাংস এনেছি যদি কিনেন। আলী (আ.) বললেন, আমার নিকট অর্থ নেই। কসাই বলল, আমি অর্থের জন্য ধৈর্যধারণ করতে রাজী আছি। হযরত আলী বললেন, আমি আমার উদরকে বলব ধৈর্যধারণ কর। কেন তুমি আমার উদরের জন্য ধৈর্যধারণ করবে? আমি বরং তোমার নিকট ঋণী না থেকে ধৈর্যধারণ করব।

আমিত্ব থেকে মুক্তির জন্য আত্মিক সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা

ইসলাম বলে যদি মানুষকে আমিত্ব থেকে আমাদের ধারণায় আনতে চাও,তবে তার অভ্যন্তরকে সংশোধিত কর। তাকে বস্তুর দাস ও অনুগত হওয়ার সুযোগ দিও না। নতুবা শুধু ব্যক্তি-মালিকানা রহিত করবার মাধ্যমে এর উপশম সম্ভব নয়। অবশ্য এ বিষয়ে দু ধরনের মত রয়েছে। কারো কারো মতে ব্যক্তি-মালিকানা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই,শুধু আত্মিক প্রশিক্ষণ ও সংশোধনের বিষয়ে গুরুত্ব দাও। অন্যদের মতে এটা ঠিক যে,মানুষের অভ্যন্তরীণ দিকটিই মুখ্য,তদুপরি তার বাইরের দিকটিকেও সংশোধন না করলে তা সম্ভব নয়। ইসলামে আমরা অভ্যন্তরের সাথে বাইরের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে দেখি। ইসলাম মানুষের বাইরের অসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যহীনতার সামঞ্জস্য বিধান করতে চায়,তবে তা ব্যক্তি-মালিকানাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদের মাধ্যমে নয়। ইসলাম বাইরের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়,তবে আমি আমরা য় রূপান্তরিত হওয়ার জন্য বাইরের সামঞ্জস্য বিধানকে যথেষ্ট মনে করে না বরং সামঞ্জস্য বিধানের জন্য প্রকৃত আত্মিক ভারসাম্য প্রয়োজন বলে মনে করে।

ব্যাকরণে নিশ্চয়ই সম্বন্ধ সম্বন্ধিত পদ সম্পর্কে পড়েছেন। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য হলো সম্বন্ধের দিকে। এই সম্বন্ধ পদগুলো যখন আমার সঙ্গে আসে,যেমন আমার বাড়ি,আমার টাকা ইত্যাদি তখন আমিত্বের জন্ম হয়। এই সম্বন্ধ পদগুলোই সব সমস্যার মূল। তাই একে উচ্ছেদ করে আমাদের করতে হবে। (আপনারা জানেন,এরা পূর্বেও যেমন বর্তমানেও তেমন যৌথ মালিকানার বিষয়টি পরিবারের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারণের পক্ষপাতী ছিল,কিন্তু নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘটিত বিপ্লবের প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারীর উপর সামষ্টিক মালিকানার বিষয়টি প্রয়োগের চিন্তা করে,কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৩৬ সালে রহিত করে।)

কিন্তু ইসলাম বলে,তাদের সম্বন্ধ করার কিছুই নেই; সম্বন্ধিত সত্তা অর্থাৎ আমি সব কিছুর জন্য দায়ী। আমাদের দেখতে হবে,এ আমি কার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। যদি সম্বন্ধ পদটি সীমিত ও ব্যক্তি বিষয়ের হয়,তবে আমি আমিত্বে পরিণত হবে (১*) আর যখন সমাজের আত্মা সম্পর্কিত বিষয় হয়,যেমন আদর্শ,ঈমান,স্রষ্টা প্রভৃতি তখন আমি আমাদের ধারণায় পরিণত হবে। এ মতবাদের সমর্থকরা যুক্তি দেখান, আমরা একদিকে একদল লোক দেখি যারা প্রচুর সম্পদের অধিকারী,কিন্তু তাদের আমি আমাদের সত্তায় পরিণত হয়েছে। যখন তাদের কিছুই ছিল না তখনও তাদের সত্তা আমাদের ছিল। আবার যখন সব কিছুই তারা লাভ করেছে তখনও তাদের সত্তা আমাদের ধারণা হতে সরে আসেনি। কারণ তাদের মন ও মানসিকতা বস্তুর প্রতি আসক্ত ছিল না। আলী ইবনে আবি তালিব এমনই এক ব্যক্তি। যখন আলীর জীবন অত্যন্ত সংগ্রাম মুখর ছিল ও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটত,হয়তো কোন দিন নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ার মতো খাদ্যই তার জুটেছে যার সবটুকইু দান করে দিতেন,নিজের পরিবারের জন্য কিছুই রাখতেন না। আবার এমন দিনও আলীর এসেছে যে,সর্ববহৎ দেশের অর্থাৎ তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে বায়তুল মালের অধিকারী ছিলেন। যেমন খুশী নিজের ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু এ দু অবস্থার কোনটিতেই তার মধ্যে আমিত্ব ছিল না,সব সময়ই তার সত্তা ছিল আমাদের। সব সময়ই নিজেকে ভুলে অপরের চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন। সুতরাং আমি কে আমাদের করার জন্য ব্যক্তি-মালিকানার অবসানের প্রয়োজন নেই।

আমিত্ব সৃষ্টির একমাত্র কারণ ব্যক্তি-মালিকানা নয়

সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলতে হয়,মানুষের সকল কর্মকাণ্ড অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় যে,বলা যাবে ব্যক্তি-মালিকানাকে সামষ্টিক মালিকানায় পরিণত করলে আমি আমরা য় পরিণত হয়ে যাবে। মানুষের জীবনের অনেকগুলো দিকের একটি দিক হলো অর্থনীতি যেখানে ব্যক্তি-মালিকানার বিষয় রয়েছে। কিন্তু তার জীবনের অন্যান্য দিক অর্থনীতি ও ব্যক্তি-মালিকানার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়,যেমন পদমর্যাদা নারী । এ দু টি বিষয় মর্যাদার দিক হতে কোন অবস্থাতেই অর্থনীতি হতে কম মূল্যের নয়। কখনো কখনো মানুষ একজন নারীর জন্য তার সকল অর্থ ও সম্পদ ব্যয় করে বা কোন সামাজিক পদমর্যাদার জন্য তা ব্যয় করে। তাকে আমরা কি বলব? সকল নারীকে একই ছাঁচে ফেলে সকল দিক হতে পরস্পরের সমমান করা সম্ভব কি? যদিও বাস্তবে নারীর মালিকানার ক্ষেত্রে যৌথ বা সামষ্টিক মালিকানার কোন ব্যাপার নেই তদুপরি এখানে আমার ধারণা বর্তমান।

পদমর্যাদাও তদ্রূপ। যদি ধরি,যে ব্যক্তি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন তিনি খাদ্য,বাসস্থান ও যানবাহনের ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকের সমান,যেমন সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার দেশের কোন এক কারখানার শ্রমিকের সম অবস্থানে রয়েছেন,তাদের বাসস্থান,যানবাহন সবই এক রকম,যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির উপহার তিনি গ্রহণ করে গর্বিত হন না। এখন কি বলা যাবে,তিনি বাকী সকল বিষয়ে সাধারণ নাগরিকদের পর্যায়ে রয়েছেন? না,কারণ তিনি যে পদ ধারণ করে রয়েছেন অন্যরা তা ধারণ করছে না এবং এ পদের সুবাদে রেডিও,টেলিভিশন,পত্রিক প্রভৃতিতে শতবার তার নাম উচ্চারিত হচ্ছে ও ছবি আসছে,অথচ ঐ শ্রমিক এ সব ক্ষেত্রে সাম্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে ও ঐ সুবিধাগুলো পাচ্ছে না।

তাই বোঝা যায়,ঐ প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদাকে সামষ্টিক মালিকানার আওতায় আনা সম্ভব নয়। বাধ্যতামূলকভাবেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্বের দায়িত্ব কোন এক ব্যক্তিকে দিতে হবে। এক ব্যক্তি সাধারণ সম্পাদক হবে,কেউ সহ-সভাপতি হবে,এমন ভাবে দায়িত্ব বণ্টিত হতে হবে শেষ পদ পর্যন্ত। কোন অফিসের ক্ষেত্রেও সেরূপ।

আমি আমরা য় পরিণত হতে হলে ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্তকরণই যথেষ্ট নয়। যেহেতু অনেক স্থানেই দেখেছি ব্যক্তি-মালিকানা বিলুপ্ত হলেও আমি আমরা য় পরিণত হচ্ছে না। এ কারণেই সমাজতান্ত্রিক দেশের মধ্যেও প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা একে অপরের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের এ প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য আধিপত্য বিস্তার ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা। সুতরাং আমি আমরা য় রূপান্তরের তাদের এ কথা শুধুই কথা।

অবশ্য আমরা স্বীকার করি,আমিত্ব সৃষ্টিতে মালিকানার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে এবং তা আমরা ধারণার প্রতিবন্ধক। এজন্য ইসলাম মালিকানা ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। পূর্ণ মানবের অন্যতম শর্ত হলো আমি আমরা য় পরিণত হওয়া,এটা আমরাও স্বীকার করি,কিন্তু শুধু আমি আমরা য় পরিণত হলেই মানুষ পূর্ণ মানবে পরিণত হবে- এ কথাটি ঠিক নয়। তাই সমাজতান্ত্রিক মতবাদ একপেশে মূল্যবোধ কেন্দ্রিক মতবাদ এবং তাদের এ ধারণাটি ঠিক নয় যে,সকল মূল্যবোধ আমি আমরা য় পরিণত হওয়ার মধ্যে নিহিত রয়েছে এবং এ ছাড়া মূল্যবোধের অস্তিত্ব নেই। আমরা অন্যান্য মতবাদের ব্যাপারেও লক্ষ্য করেছি যে,বিশেষ একটি মূল্যবোধকে মানবের পূর্ণতার জন্য যথেষ্ট মনে করেছে। কিন্তু একটি বিষয়কে একমাত্র মানবীয় মূল্যবোধ মনে করা ঠিক নয়।